জলতরঙ্গের সুর পর্ব-২৫+২৬

0
6

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ২৫
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

সকালের নরম আলো জানালার ফাঁক দিয়ে কেবিনে ঢুকে পড়ছে। বাইরে থেকে ভেসে আসছে পাখির কুজনের শব্দ, বাতাস হালকা সিক্ত।

ঊর্মি চোখ মেলল। আজ বেশ সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গেছে। হসপিটালের চিরচেনা ব্যস্ততা শুরু হয়নি এখনো। কয়টা বাজে? কি জানি! পাশের টেবিল থেকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে সময় দেখতে ইচ্ছে করলো না।

ঊর্মি বালিশে আধবসা হয়ে বসলো। কালকে রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর কল্লোল চলে গিয়েছিল। আজকে এখনো আসেনি। ঘুমঘুম ভাবটা না কাটা পর্যন্ত ও বসে রইল বিছানায়।

তারপর ফ্রেশ হয়ে আসতেই ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল ওয়ার্ডবয়। ঊর্মি বিছানায় বসে বিরক্ত চোখে পাউরুটি, সিদ্ধ ডিম আর জুসের গ্লাস রাখা ট্রে-টার দিকে তাকালো।

প্রতিদিন একই খাবার খেতে খেতে ও বড্ড বিরক্ত। সবকিছুই পানসে লাগে। খাওয়া বাদ দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ও।

কেবিনটা দোতলায়। মাঝারি সাইজের কক্ষটার একপাশে বিশাল জানালা। জানালা দিয়ে হসপিটালের পাশের রাস্তাটা দেখা যায়। হসপিটালের দেয়াল ঘেঁষে কিছু বড় বড় গাছ সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এই গাছগুলোর ডালপালায় বসেই পাখিরা ডাকাডাকি করে ভোরবেলা। সূর্যের নরম আলো গাছেগুলোর পাতার ফাঁকে ফাঁকে পড়েছে, সবুজ পাতাগুলো আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে তাতে।

আনমনে মেয়েটা যখন বাহিরের সকালের শান্ত দৃশ্য আর ইট বাঁধানো রাস্তাটায় দু একজন মানুষের চলাচল দেখতে ব্যস্ত ঠিক তখনই দুটো হাত দু দিক থেকে ওর কোমর স্পর্শ করল ধীর গতিতে।

“Good morning, sweetheart!”

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলো ঊর্মি। কোমরে অবস্থানরত বলিষ্ঠ হাতদুটো নিজের ছোটখাটো হাতদুটো দ্বারা খামচে ধরলো তৎক্ষণাৎ। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছিল মেয়েটার।

হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়ালো ও। কল্লোলকে হাসতে দেখে রাগটা চিরবির করে উঠলো মাথায়।

“আপনি কি পাগল আবরার? এভাবে কেউ ভয় দেখায়!”
দুই হাত দিয়ে কল্লোলের বুকে ধাক্কা দিল ও।

প্রস্তুতি না থাকায় আচমকা এক পা পিছিয়ে গেল কল্লোল। তারপর আবার ধীর গতিতে এগিয়ে এলো আগের জায়গায়।

“আমি তো পাগলই! তোমার জন্য পাগল…”
বলতে বলতে দু পা সামনের দিকে এগিয়ে এলো ও।

ঊর্মি দু পা পেছালো, “দ-দেখুন একদম এগোবেন না বলে দিচ্ছি। সকাল সকাল আপনার বাজে মতলব আমার ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করবেন না একদম…”

“আচ্ছা? আমার কী মতলব সেটা আপনি কি করে জানলেন, মিস ঢেউ?” বলতে বলতে আরো দু পা এগিয়ে এলো ও।

“আ-আপনার চেহারা দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে!” আর দু পা পেছাতেই জানালার লোহার গ্রিলে ধাক্কা খেলো ঊর্মি।

“উম… যেহেতু বোঝাই যাচ্ছে তাহলে আর অস্বীকার করে কি হবে! কাছে এসো সুইটহার্ট…” ঊর্মির পেছনে জানালার গ্রিলে বলিষ্ঠ দুহাত রেখে ওকে নিজের বন্ধনীতে আটকে ফেলে মৃদু স্বরে আওড়ালো কল্লোল।

“না, একদম না…” আর পেছানোর পথ পেল না ঊর্মি।
বুকের ভেতরের ধকধক শব্দটা কানে বাজছে যেন। চোখ তুলে তাকাতেই কল্লোলের নেশাভরা দৃষ্টি জড়িয়ে ধরল ওকে। চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল ভেতরের অস্থিরতা ধরা দিচ্ছে ওর শ্বাসপ্রশ্বাসে।

“সকাল সকাল কি শুরু করলেন আপনি…?” কাঁপা গলায় ফিসফিসিয়ে শেষ রক্ষার চেষ্টা করল ঊর্মি, গাল ইতিমধ্যে লাল হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে।

কল্লোল সামনে ঝুঁকে এসে ওর কানে ফিসফিস করে বলল,“সকালটা সুন্দর করে শুরু করা উচিত, সুইটহার্ট।”

ঊর্মি কাঁপা হাতে ঠেলতে চাইল ওর বুক, কিন্তু শক্ত বুকের দেয়ালে হাত রেখে থমকে গেল হাতদুটো। কল্লোলের উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর রক্তিম গাল।

“দূরে যান বলছি, আমি চিৎকার করব কিন্তু…” ভয় আর লজ্জায় মেয়েটার গলার স্বর বেসামাল।

কল্লোল হেসে ফেললো, “মাই লিটল বার্ড, তুমি চিৎকার করলে গোটা হাসপাতাল জেনে যাবে যে, আমি আমার হবু স্ত্রীকে ‘গুড মর্নিং’ বলেছি… ব্যাস! শুধু এটুকুই, এর চেয়ে বেশি আর কিছুই হবে না!”

চোখ বড় বড় হয়ে গেল ঊর্মির। গাল আরও উষ্ণ হয়ে উঠল। “চুপ করুন! সকাল সকাল মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার!”

কল্লোল দুষ্টু হেসে আরও একটু ঝুঁকল, ওর চোখে খেলছে পরিহাসের ঝিলিক, “আমার মাথা তো অনেক আগেই খারাপ হয়েছে, তোমার প্রেমে পড়ার পর থেকেই, মাই লিটল বার্ড।”

ঊর্মি গাল ফুলিয়ে রাগ দেখানোর চেষ্টা করল, অথচ কণ্ঠ কেঁপে গেল ওর, “আপনি না… একদম অসহ্য!”

কল্লোল ফিসফিস করে ঊর্মির হাতের দিকে ইশারা করল,
“অসহ্য হলেও, তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিতে পারো না।”

ঊর্মির হাত তখনও ওর বুকে রাখা। কিন্তু ঠেলার বদলে হাতটা তখন থেকে আটকে আছে সেখানেই। ও আরেকবার চেষ্টা করল, কিন্তু ভেতরের অচেনা টান অবশ করে দিচ্ছে ওকে।

কল্লোল সুযোগ বুঝে টুপ করে চুমু খেল ঊর্মির বাঁ গালে।
তারপর ধীরেসুস্থে বলল, “ব্রেকফাস্ট করোনি কেন?”

ঊর্মি মৃদু কেঁপে উঠে মুখখানা ঘুরিয়ে নিল একপাশে। আস্তে করে বলল, “এগুলো খেতে ইচ্ছে করে না।”

কল্লোল ভ্রু কুঁচকালো, তারপর ফিচেল হেসে ভাবুক হওয়ার ভান করে বলল, “হুম… তাহলে তো তোমাকে একটা বিশেষ ডোজের ঔষধ দিতে হবে।”

“সেটা কী?” পাল্টা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ঊর্মি।

কল্লোল চোখ টিপে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এক চামচ ভালোবাসার সিরাপ।”

ঊর্মি তৎক্ষণাৎ ওর দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকালো।
“আপনি একদমই সিরিয়াস না! সবকিছুকে মজা মনে হয় আপনার?”

কল্লোল ভান করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
“আরে আমি তো খুবই সিরিয়াস, মিস ঢেউ! তোমার যদি খেতে ইচ্ছে না করে, তবে আমার ঔষধে মাস্ট কাজ হবে।”

ঊর্মি চমকে তাকাল,“মানে? ক-কি ঔষধ?”

কল্লোলের ঠোঁটে আবারো এক চিলতে দুষ্টু হাসি খেলল।
“একটা ছোট্ট কিস— গ্যারান্টি দিচ্ছি, তারপরে পাউরুটি–ডিমও তোমার কাছে স্বাদু লাগবে।”

ঊর্মির গাল গরম হয়ে উঠল। ও চুপচাপ কল্লোলের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মুখ ফিরিয়ে ফিসফিস করে বলল, “না, একদম না… আমি সেই ফাঁদে পা দেব না।”

কল্লোল হেসে ওর কানের কাছে আরও কাছে ঝুঁকল,
“ফাঁদ নয় সুইটহার্ট, এটা থেরাপি।”

ঠিক ওই মুহূর্তে টোকা পড়ল দরজায়। কল্লোল ঠোঁটে চাপা হাসি নিয়ে সরে দাঁড়াল, যেন কিছুই ঘটেনি। সরে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কানের খুব কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেল, “বেঁচে গেলে সুইটহার্ট!”

ঊর্মি প্রায় লাফিয়ে সরে এলো কল্লোলের কাছ থেকে। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক করছে প্রচন্ড জোরে, গাল দুটো লালচে হয়ে উঠেছে লজ্জায়।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন সিনিয়র নার্স। হাতে ছোট্ট ট্রে, সঙ্গে একজন সহকারী।

“মিস ঊর্মি, আজ আপনার সেলাই কাঁটা হবে। ডাক্তার আসছেন একটু পরেই, আপনি রেডি হয়ে নিন।”

ঊর্মির পেটে মোচড় দিল ভয়ে। সেলাই কাটার নাম শুনেই গলা শুকিয়ে এলো ওর।

এক মুহূর্তের মধ্যে শুকিয়ে যাওয়া মুখটা পাশ থেকে খেয়াল করেছে কল্লোল। আলতো করে ওর হাত চেপে ধরে নিচু গলায় বলল, “চিন্তা করো না, আমি আছি।”

নার্স টেবিলের ওপর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলেন।
ঊর্মি কুণ্ঠিত চোখে কল্লোলের দিকে তাকাল। ওর দুষ্টু হাসি তখন গম্ভীর আশ্বাসে বদলে গেছে।

কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার ভেতরে এলেন। চশমার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে উষ্ণ গলায় বললেন,
“Good morning, ঊর্মি! আজ খুব সহজ একটা প্রক্রিয়া হবে। টেনশনের কিছু নেই।”

ঊর্মি ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ল। ভেতরে ভেতরে কেমন আতঙ্ক কাজ করছে ওর। কল্লোল আস্তে করে ওর কানে ফিসফিস করল, “তুমি শুধু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে, everything will be alright.”

ঊর্মি বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখ তুলে কল্লোলের দিকে তাকাল। অদ্ভুতভাবে আটকে গেল ওই নেশাভরা স্থির দৃষ্টিতে।

ডাক্তার এপ্রোন পরে এগিয়ে এলেন। নার্স টেবিল থেকে জীবাণুমুক্ত কাঁচি আর তুলো এগিয়ে দিল।

“ব্যথা খুব সামান্য হবে।” ডাক্তার নরম গলায় বললেন।
ঊর্মির বুক ধকধক করছে, হাত দুটো আঁকড়ে ধরল বিছানার চাদর।

কল্লোল এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে নিল শক্ত করে।
“আমার দিকে তাকিয়ে থাকো, সুইটহার্ট।”
ঊর্মি চোখ বড় করে কল্লোলের দিকে চেয়ে রইল।

ডাক্তার ধীরে ধীরে সেলাইয়ের গিঁটটায় হাত দিলেন।
প্রথম কাটার মৃদু শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ঊর্মির শরীর কেঁপে উঠল।

কল্লোল তাড়াতাড়ি ওর আঙুল মুঠোয় চেপে ধরল।
“শ্… কিছু হবে না। আরেকটু সাহস রাখো।”

ডাক্তার নিপুণ হাতে ফোর্সেপ দিয়ে সুতো টেনে তুললেন।
ঊর্মির চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ব্যথায়, ঠোঁট থেকে চাপা গোঙানি বেরোল, গাল বেয়ে নেমে এলো ঘাম।
সামনে কল্লোলের দৃঢ় চোখ দুটোই যেন একমাত্র ভরসা।
কল্লোল মাথা নাড়ল আশ্বাস দিয়ে, যেন বলছে— আমি আছি, তুমি একা নও।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই কাজ শেষ। ডাক্তার মৃদু হেসে বললেন,“হয়ে গেছে! আর ভয়ের কিছু নেই। এখন আর ব্যান্ডেজের দরকার হবে না। তবে জায়গাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন, কয়েকদিন যেন পানি না লাগে।”

ঊর্মি চোখ বন্ধ করে পুরোপুরিভাবে বালিশে হেলান দিল। কল্লোল আলতো করে ওর গালে হাত রাখল, “দেখলে? কত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল।”

ঊর্মি ভিজে চোখে তাকাল ওর দিকে। কিছু বলল না। ডাক্তার বেরিয়ে গেলে কেবিনে নেমে এলো অদ্ভুত নীরবতা। ঊর্মি তখনও বিছানায় আধশোয়া, কপালে ঘাম জমেছে।

কল্লোল একটা টিস্যু নিয়ে সাবধানে ওর কপালের ঘাম মুছে দিল, “এবার একটু খেয়ে নাও? এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে আবার শরীর দুর্বল হবে।”

ঊর্মি ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ল, “এগুলো খাব না।”

কল্লোল হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল, “তাহলে কী খাবে বলো?”

ঊর্মি তারচেয়েও হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে, “জানি না, কিছুই খেতে ভালো লাগে না!”

কল্লোল ঊর্মির চোখের দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখল। ওর হতাশা, অজানা অস্থিরতা, সব মিলিয়ে ওকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারলো না কল্লোল। ও নরম কন্ঠে বলল, “ক্যান্টিনে যাবে?”

ঊর্মি মাথা নাড়ল।

“তাহলে জুসটা আগে খাও, তারপর যাব।” বলল কল্লোল।

বিরক্তির শ্বাস ছাড়লো ঊর্মি, কোনোরকম সুযোগই হাতছাড়া করতে চায় না ক্যাপ্টেন আবরার ইমতিয়াজ কল্লোল নামের এই অসহ্য পুরুষটা!

মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে অরেঞ্জ জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দিল। কল্লোল হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল ওর দিকে তাকিয়ে।

ঊর্মি জুসটা শেষ করে গ্লাসটা টেবিলে রাখতেই ও বলল, “এই তো খেয়ে নিলে, তাহলে এত কষ্ট করে নাটক করার কি দরকার ছিল?”

ঊর্মি রাগী চোখে তাকাল ওর দিকে, “আপনি না থাকলে আমি নিশ্চিন্তে না খেয়ে থাকতে পারতাম।”

কল্লোল হেসে কাছে এসে চোখ টিপে ফিসফিস করে বলল, “না খেয়ে থাকলে তো আমাকে অন্যভাবে পেট ভরানোর ব্যবস্থা করতে হতো, সুইটহার্ট।”

ঊর্মি সাদা বালিশটা তুলে ছুঁড়ে মারল ওর দিকে।
কল্লোল খপ করে ধরে নিল সেটা, হেসে বলল, “বাহ! ব্রেকফাস্ট সেরে এবার বালিশ থেরাপি শুরু হলো নাকি?”

ঊর্মি ঠোঁট কামড়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল, গালদুটো আচমকাই রক্তিম হয়ে উঠল অকারণে।

To be continued…

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ২৬ [রোমান্টিক এলার্ট ‼️]
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব কম নয়। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে বসে থেকে ঊর্মির অবস্থা নাজেহাল। পথিমধ্যে দুবার বমি করেছে মেয়েটা। সদ্য অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা শরীরটা নেতিয়ে পড়েছে একেবারে। গাড়ি থেকে নামার সময় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না, পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। কল্লোল তৎক্ষণাৎ দুই হাতে ওকে ধরে ফেলল,“তুমি একদমই গাড়িতে চড়তে পারো না, অথচ একা আসতে চাইছিলে!” ওর কণ্ঠে রাগের ছটা।

ঊর্মি ভ্রু কুঁচকাল, “এখন আবার লেকচার দেবেন নাকি?”

কল্লোল গম্ভীর হলো, “ভেতরে চলো। লেকচার শোনার মত অবস্থায় আছো তুমি?”

গেট পেরিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে বিপত্তি বাঁধলো।পাঁচতলা বিল্ডিংটাতে লিফটের কোন ব্যবস্থা নেই। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। এদিকে মাথা ঘোরাচ্ছে ঊর্মির। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, সেখানে সিঁড়ি বেয়ে উঠবে কিভাবে!

কল্লোল গাড়ি থেকে ব্যাগ নামাতে গেছে। ঊর্মি চিন্তায় পড়ল। চিন্তিত মুখে প্রথম সিঁড়ি পেড়িয়ে দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা দিতে না দিতেই টলে গেল শরীর। ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে কল্লোল ধরে ফেলল ওকে।

“এতো পাকনামি করতে কে বলেছে? আমি বলেছি সিঁড়িতে উঠতে?”

বাজখাঁই ধমকে কেঁপে উঠলো ঊর্মি। ধমক খেয়ে ঠোঁট উল্টালো, “সিঁড়িতে না উঠলে বাসায় যাব কিভাবে? আজব…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজেকে শুন্যে অনুভব করল ও। সহসা আতঙ্কিত হয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠলো মেয়েটা, “আ-আবরার… ক-ক-কী ক-করছেন? প-পড়ে যাব তো!”

কল্লোল জবাব না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।

“আবরার, নামান প্লিজ! কেউ দেখে ফেললে…”

“কেউ দেখবে না।”

“আব…”
ঊর্মি মুখ খোলার আগেই কল্লোল চোখ পাকিয়ে তাকালো। চুপ করে গেল মেয়েটা। দুটো সিঁড়ি পাড় করে দোতলায় এসে পৌঁছালো ওরা। ঊর্মিকে নামিয়ে চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে আবার তুলে নিল ওকে।

আবারো আপত্তি করে উঠলো ঊর্মি, “এতটুকু পারব আমি। শরীর এতটাও খারাপ না।”

বেতের বড় সোফাটায় ঊর্মিকে নামিয়ে দিল কল্লোল, “তুমি বড্ড বেশি কথা বলো লিটল বার্ড!” তারপর ঊর্মিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বলল, “এখানে চুপ করে বসে থাকো, উঠবে না। আমি ব্যাগগুলো নিয়ে আসছি।”

কল্লোল বেরিয়ে গেলে ঊর্মি উঠে বেডরুমে গেল। ঘরের এদিক-সেদিক জিনিসপত্র পড়ে আছে। ট্রিপে যাবার আগে গুছিয়ে যাওয়া হয়নি। কল্লোল প্রথমবার এসেছে ওর বাসায়। এসব দেখে কি ভাববে! ঊর্মি চটপট পড়ে থাকা জিনিসগুলো গোছাতে ব্যস্ত হলো।

“তোমাকে সোফা থেকে উঠতে বারণ করেছি না? কী করছো তুমি?”

ঊর্মি পেছন ফিরল। কল্লোল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
গলা খাঁকারি দিল ও, “ও-ওই… মানে… একটু গোছাচ্ছিলাম, ঘরটা এলোমেলো হয়ে আছে…”

কল্লোল ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এল, “এলোমেলো থাকলে কী হয়েছে? অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘর গোছাতে হবে? আমি কি তোমার মেহমান?”

ঊর্মি গম্ভীর মুখে বলল, “মেহমান তো বটেই। আপনি এখানে প্রথমবার এসেছেন।”

কল্লোল ঠোঁটের কোণে খেলা করা হাসিটা লুকোল না এবার, সোজা এসে ওর হাত থেকে জামাটা কেড়ে নিয়ে চেয়ারে ছুঁড়ে ফেলল, “আজ প্রথমবার এসেছি, তবে এখন থেকে নিয়ম করে এখানে আমার পদধূলি পড়বে ম্যাডাম! চিন্তার কিছু নেই…”

ঊর্মি অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করল,
“মানে? আপনার পদধূলি কে চাইছে এখানে?”

কল্লোল ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“কেউ চায় নি, আমি স্বেচ্ছায় দিতে চাইছি!

“একদম না! পাগল হয়েছেন? এখানে আশেপাশের মানুষেরা কী বলবে!” বড় বড় চোখে চেয়ে থেকেই বলল ঊর্মি।

কল্লোল একদম কাছে গিয়ে তর্জনীর সাহায্যে ওর চিবুক ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল, “তাহলে তুমি আমার বাসায় চলো। সমস্যা মিটে যাবে।”

ঊর্মি এক ঝটকায় মুখ সরিয়ে নিল, গাল টুকটুকে লাল হয়ে উঠেছে, “চুপ করুন! খালি আজগুবি কথা!”

কল্লোল কুটিল চোখে হাসল, “আজগুবি নয় সুইটহার্ট… একদম প্র্যাক্টিক্যাল সলিউশন। তুমি এখানে একা থাকবে, অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই। আমার বাসায় গেলে সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে।”

ঊর্মি ভুরু কুঁচকে হাত ভাঁজ করলো, “না ধন্যবাদ। আমি একাই ঠিক আছি। আপনার এত টেনশন করার দরকার নেই।”

কল্লোল ভান করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আহ্! কি নিষ্ঠুর মেয়ে! নিজের হবু স্বামীকে মেহমানের মতো দূরে ঠেলে দেয়!”

ঊর্মি আঁতকে উঠে চাপা স্বরে বলল, “চুপ করুন… কেউ শুনে ফেলবে! একদম বাজে কথা বলবেন না।”

কল্লোল এগিয়ে এসে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “কেউ শুনবে না সুইটহার্ট! এখানে শুধু তুমি আর আমি। বাইরের দরজা বন্ধ।

ঊর্মি একবার দরজা আর একবার কল্লোলের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখ বড় বড় করল, “আ-আপনি আবার শুরু করলেন… আমি কিন্তু সত্যি রাগ করব এবার।”

কল্লোল ঝুঁকে এসে টুপ করে ওর কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল, “অসুস্থ শরীরে এত রাগ করা ভালো না সুইটহার্ট! হার্ট বিট বেড়ে যাবে… যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো।”

——-

ঊর্মি একেবারে গোসল সেরে বেরিয়েছে। গা ম্যাজ ম্যাজ করছিল, এখন একটু ভালো লাগছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই টাওয়ালে চুল মুছতে মুছতে শুনতে পেল রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। টাওয়ালটা চেয়ারের উপর রেখে পায়ে পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল ক্যাপ্টেন মহাশয় কফি বানাচ্ছেন। ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড়ও বদলে ফেলেছেন ইতোমধ্যে।

ঊর্মি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকাল,
“আপনি রান্নাঘরে কেন? এদিকে ঢোকার অনুমতি দিলাম কবে?”

কল্লোল গম্ভীর ভান করে ঘুরে তাকাল, মগে চামচ নাড়তে নাড়তে বলল, “সামরিক কর্মকর্তারা অনুমতি নিয়ে কাজ করেন না, ম্যাডাম। সরাসরি অ্যাকশন নেন।”

ঊর্মি ঠোঁট বাঁকিয়ে কটমট করে তাকাল, “হুহ! এক্ষুণি আপনার অ্যাকশন বন্ধ করুন আর বের হন। এটা আমার জায়গা।”

কল্লোল হেসে আবার কফি নাড়তে লাগল, “তোমার জায়গা মানেই আমার জায়গা। তাছাড়া অসুস্থ শরীরে গরম কফি বেস্ট ঔষধ হিসেবে কাজ করে।”

ঊর্মি হাত গুটিয়ে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, “আমি সুস্থ হয়ে গেছি। আপনি কফি নিন আর প্লিজ এখান থেকে যান।”

কল্লোল একটা মগ ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলল, “This is for you sweetheart!”

ঊর্মি বিরস মুখে মগটা হাতে নিলেও চোখাচোখি এড়িয়ে গেল। মগের ধোঁয়া উঠতে থাকা কফির গন্ধে মুহূর্তের জন্য মনটা নরম হয়ে এল। একটা চুমুক দিতেই ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল অজান্তে।

মগটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক পা সামনে আগাতেই এতক্ষণ ধরে ওর চুল থেকে টপটপ করে মেঝেতে জমা পানিতে পিছলে গেল পা। কল্লোল তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎগতিতে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল ওর কোমর।

দু’জনের মাঝের ফাঁকটুকু অদৃশ্য হয়ে গেল হঠাৎ। ঊর্মি আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে কল্লোলের দিকে, শ্বাসপ্রশ্বাস অতি দ্রুত।

কল্লোল ওর চোখের গভীরে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
“এত কেয়ারলেস কেন তুমি? এক্ষুনি পড়ে যেতে!”

ঊর্মি হঠাৎ স্পর্শটা সামলাতে পারল না, মৃদু কেঁপে উঠল,
“আমি… আমি ঠিক আছি… ছাড়ুন।”

কল্লোল একটুও নড়ল না। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি খেলে গেল, “ছাড়তে ইচ্ছে করছে না!”

ঊর্মি হকচকিয়ে গেল। কল্লোলের বাহুর বাঁধন থেকে বেরোনোর চেষ্টা করল, কিন্তু ওর খুচরো শক্তিতে কাজ হলো না।

“আ-আবার বাজে কথা শুরু করলেন…” কণ্ঠ কেঁপে গেল ওর।

কল্লোল মুখটা আরও কাছে আনল, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিস করল, “বাজে কথা নয়, হার্টবিট চেক করছি।”

ঊর্মির বুক সত্যিই ধকধক করে উঠল। গলা শুকিয়ে গেল, “কি-কি সব বলেন! প্লিজ ছাড়ুন…”

কল্লোল একচুলও না নড়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হাসল,
“ছাড়ব, তবে কন্ডিশন আছে।”

“কী কন্ডিশন?” ঊর্মির চোখ বড় বড় হয়ে উঠল।

কল্লোল ঠোঁটের হাসিটা মুছে ফেলে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, তোমার টাওয়াল কোথায়?”

ঊর্মি হতবাক হয়ে তাকাল, “কি?! এরমধ্যে আবার টাওয়াল কেন?”

কল্লোল গম্ভীর মুখ করে কাঁধ ঝাঁকাল, “কারণ তোমার চুল ভেজা। ঠান্ডা লেগে যাবে।”

ঊর্মি ঠোঁট বাঁকাল, “নিজের কাজ নিয়ে ভাবুন, আমার চুল নিয়ে ভাবতে হবে না।”

কল্লোল দুহাতে ওর কোমর জড়িয়ে এক ঝটকায় ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মুচকি হাসল,
“চুল নিয়ে ভাবছি না… ভাবছি তোমাকে নিয়ে। উম… ভেজা চুলের সাথে তোমার লালচে গাল… জানো এটা ঠিক কতটা ডিস্টার্বিং? এরপর উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেললে তো আবার আমাকে আমাকে দোষ দেবে…”

ঊর্মি হতভম্ব হয়ে কল্লোলের বুকে ঠেসে থাকা অবস্থায় কেঁপে উঠল। কল্লোল ওর কানের কাছে ঝুঁকে ধীর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, “আমার কন্ট্রোল ভাঙিয়ে দিচ্ছো তুমি, সুইটহার্ট।”

ঊর্মির নিঃশ্বাস আটকে এলো। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ আওয়াজ যেন ছড়িয়ে পড়েছে ঘরজুড়ে।
“ছ-ছাড়ুন…”

কল্লোল একচুল দূরে সরে এলেও হাতের বাঁধন ঢিলে করল না। চোখে সেই একই গাঢ় দৃষ্টি। ঊর্মির কোমরে আলতো চাপ প্রয়োগ করে বলল, “ঘরে চলো। তোমার চুলের পানিতে আমার টি-শার্ট ভিজে গেছে!”

ঊর্মি হকচকিয়ে কল্লোলের দিকে তাকাল, চোখ বড় বড় করে বলল, “কী বললেন? আপনার টি-শার্ট ভিজে গেছে? দেখি ছাড়ুন!”

ঊর্মি বেশ শক্তি খাটিয়ে কল্লোলের বাঁধন মুক্ত হলো।

“প্রায় পুরোটাই তো ভিজে গেছে!” ও ঠোঁট উল্টে তাকালো কল্লোলের দিকে।

“No need to think about it. তোমার টাওয়াল…?”

“ঘরে…”

_______________________________

কল্লোল চেয়ার থেকে আধভেজা টাওয়ালটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। মাথা সামান্য কাত করে হাত বাড়িয়ে বলল, “Come here.”

ঊর্মি দরজার পাশে দাঁড়িয়েই সঙ্কোচে ভ্রু কুঁচকাল, “কেন?”

কল্লোলের কণ্ঠ গাঢ় হলো, তবে সেই স্বরে যেন একচিলতে আদেশ, “কারণ তোমার চুল ভেজা। আমি মুছে দেব।”

ঊর্মি অস্বস্তি নিয়ে নাকচ করতে চাইল, “আমি নিজেই—”

কল্লোল ওর কথার মাঝে কেটে দিয়ে ধীরস্বরে আবার বলল, “ঊর্মি… I said, come here.”

ঊর্মির বুক ধক করে উঠল। কল্লোলের চোখের দৃষ্টি এতটাই গম্ভীর আর তীব্র যে ওর গলা শুকিয়ে গেল। কিছুক্ষণ দ্বিধায় দাঁড়িয়ে থেকে মাথা নিচু করে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নিজের সর্বনাশের দিকে। ভেবেছিল কল্লোলের পাশে গিয়ে বিছানায় বসবে, কিন্তু কল্লোল সে সুযোগ দিল না ওকে।

বিছানার কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই কল্লোল টাওয়ালটা একপাশে রেখে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ওকে টেনে বসিয়ে দিল নিজের কোলের উপর।

আচমকা টাল সামলাতে না পেরে ঊর্মি হুমরি খেয়ে পড়লো কল্লোলের বুকে। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেয়েটা। কী ঘটেছে বুঝে ওঠার সাথে সাথেই চমকে উঠে শুরু হলো ছটফটানি, “আ-আবরার আ-আপনি… নামান
আমাকে—”

কল্লোল শক্তপোক্ত হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল ওকে,
“Not now. আমার কাজ শেষ হবে তারপর।”

শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে আটকে পড়ে না চাইতেও ছটফটানি থামাতে হলো। কল্লোল টাওয়ালটা হাতে তুলে নিয়ে আলতো করে ওর ভেজা চুলে আঙুল গুঁজে টাওয়াল ঘষতে শুরু করল।

প্রতিটা ছোঁয়ায় ঊর্মির শরীর শিরশির করে উঠছে। ও
ঠোঁট কামড়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখল অন্যদিকে। অগোছালো দৃষ্টি স্থির করতে পারল না কোথাও।

কল্লোল একদৃষ্টে ওর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে করতে নিজের কাজ করছে। ঊর্মি ভেতরে ভেতরে নিজেকে সামলানোর তীব্র চেষ্টা চালাচ্ছিল, কিন্তু শিরশির অনুভূতিটা ক্রমশ বাড়ছে। হাতগুলো অচেতনভাবে চলে যাচ্ছে কল্লোলের কাঁধের দিকে। দুহাতে কল্লোলের কাঁধ খামচে ও অস্থির কণ্ঠে বলল, “আ-আ-আবরার প-প্লিজ স্টপ…”

কল্লোল থেমে গেল তৎক্ষণাৎ। ধীরগতিতে টাওয়ালটা সরিয়ে নিয়ে এক হাতে ওর কোমরে আলতো চাপ দিয়ে ওকে টেনে নিল আরো অনেকটা কাছে। ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে ঘোরগ্ৰস্থ কন্ঠে বলল, “Do you know, তোমার চুলের গন্ধটা আমার ব্ল্যাক কফির থেকেও বেশি অ্যাডিকটিভ?”

ঊর্মির অস্থিরতা বাড়লো। থামতে বলে তো আরো বেশি বিপত্তি বাঁধলো! পাগল লোকটা পাগলামির সুযোগ পেয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল ওর। কিন্তু কল্লোলকে বাধাপ্রদান করার মতো শক্তি কিংবা ইচ্ছা কোনোটাই এলো না ভেতর থেকে।

সবকিছুই ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিজের শরীর মস্তিষ্কের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। মস্তিষ্ক বলছে “এটা ঠিক হচ্ছে না,” কিন্তু শরীর নিজের মতো প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, সমর্পণের সেই মুহূর্তে ওর ভেতরের দ্বন্দ্ব আরও জোরালো হয়ে উঠছে ক্রমশই।

কল্লোল ভেজা চুলগুলো কাঁধ থেকে সরিয়ে গ্ৰীবাদেশে মুখ ডোবালো। ঊর্মি পুনরায় কেঁপে উঠলো। শরীর ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে। নিঃশ্বাস যেন আটকে আসছে, টান অনুভূত হচ্ছে বুকের ভেতরে। ছটফটিয়ে উঠলো ও, “আ-আ-আবরার…”

কল্লোল মসৃণ গ্রীবাদেশে একেকটা অস্থির স্পর্শের ঝড় তুলতে তুলতে কোন রকমে সাড়া দিল, “উমমম…”

অস্থির স্পর্শগুলোয় ঊর্মির নাজুক শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল। বুকের ভেতরে ঢিপ ঢিপ করে ছুটে চলা অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে, ঠোঁট কেঁপে উঠছে ওর। সহ্য করতে না পেরে কল্লোলের ছোট ছোট চুলগুলো দুহাতে টেনে ধরলো ও।

আচমকা বেল বেজে উঠল সদর দরজায়। হঠাৎ তীব্র শব্দে চমকে উঠে ক্যাপ্টেনের সম্বিত ফিরল। তৎক্ষণাৎ ছিটকে সরে এলো ও। উর্মিকে জ্বালাতন করতে গিয়ে কখন যে নিজেই ডুবে গেছিল বুঝতেই পারেনি।

কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে ঊর্মির দিকে তাকালো ও। কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা নাজুক মেয়েটার ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেটাই বোঝার চেষ্টা চালাল।

ঊর্মি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে রেখেছে মেয়েটা, শরীর এখনো কাঁপছে সামান্য।

কল্লোল কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর আলতো করে ডাকলো, “ঊর্মি…?”

ঊর্মি দৃষ্টি মেলালো না। দ্রুত উল্টো ঘুরে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে কোনোরকমে বলল, “আমি… আমি দেখি কে এসেছে…”

_______________________________

“আবরার শুনছেন?”

“কী হয়েছে সুইটহার্ট?”

অজানা অচেনা ডেলিভারি বয়ের সামনে আচমকা এমন সম্বোধন শুনে লজ্জায় পড়লো ঊর্মি। চোখ পাকিয়ে তাকালো কল্লোলের দিকে।

কল্লোল ততক্ষণে ওর পিছে এসে দাঁড়িয়েছে।

“আপনি খাবার অর্ডার করেছেন?”

“হ্যাঁ। তুমি ভেতরে যাও, আমি নিয়ে আসছি।”

উর্মি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ভেতরে চলে গেল। কল্লোল প্যাকেট নিয়ে দরজা বন্ধ করে ডাইনিং টেবিলে এনে রাখলো।

ঊর্মি কিচেন থেকে প্লেট, গ্লাস, চামচসহ প্রয়োজনীয় সব জিনিস নিয়ে এলো। কল্লোল হাতে হাতে খাবার সার্ভ করতে সাহায্য করলো ওকে। তারপর একসাথে খেতে বসলো দুজনে।

খাওয়া দাওয়া শেষে খানিক রেস্ট করে বিকেলের দিকে কল্লোল নিজের বাসায় চলে গেল। ঢাকায় ওর নিজস্ব ফ্লাট আছে। আগামী বেশ কিছুদিন ওর ছুটি আছে। ছুটির দিনগুলো ও বেশিরভাগ সময় ঢাকাতেই কাটায়। এবারেও তার ব্যতিক্রম নয়।

কল্লোল চলে গেলে‌ নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরলো ঊর্মিকে। সারাদিন কল্লোলের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো মনের কোণে ঘুরে ফিরে আসছে বারবার।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে কয়েকটা গভীর নিঃশ্বাস নিল ও। চেষ্টা করল শান্ত হওয়ার, কিন্তু কল্লোলের উপস্থিতি ছাড়া শরীর আর মন যেন স্বাভাবিকভাবে শিথিল হতে পারছে না। গত কিছুদিনে ক্যাপ্টেনের সঙ্গ-তে যে কতটা বাজেভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেটা বেশ ভালোভাবেই টের পেল মেয়েটা।

ঊর্মি চোখ খুলল, জানালার ফাঁক দিয়ে শেষ বিকেলের আলো ঘরে ঢুকছে। দক্ষিণমুখী জানালা দিয়ে আসা বাতাস ঢেউ তুলছে চুলে। কিন্তু ওর মন এখনও আবিষ্ট কল্লোল-এ।

বারবার মনে হচ্ছে, কল্লোলের স্পর্শ আর গলার স্বর এখনও বাতাসের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর চারপাশে।কেমন বাজে অভ্যাস করে ফেলেছে লোকটা।

ঊর্মি উঠে বসে ফোনটা হাতে নিল। কোনোকিছু না ভেবে প্রথমবারের মতো ডায়াল করল ক্যাপ্টেনের নাম্বারে।

কলটা রিং হয়ে কেটে গেল। কেউ ধরল না। কলটা কেটে যাওয়ার পর ঊর্মির বুকটা যেন হঠাৎ খালি হয়ে গেল। চোখ পিটপিট করে কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা।

“কেন ধরল না?”
অকারণেই মনের ভেতর খচখচে অস্থিরতা তৈরি হলো। আবার ডায়াল করার জন্য আঙুল এগিয়ে গেলেও থেমে গেল শেষ মুহূর্তে। ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনটা লক করে ফোনটা বিছানার একপাশে ছুঁড়ে দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো আবার।

দুমিনিটের মাথায় ফোনের রিংটোনের শব্দে চমকে উঠলো ও। মাথা তুলে দেখল, স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে “Captain Abrar Calling…”

ওর বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো। হাত বাড়িয়ে ফোনটা কানে তুলতেই অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর, উষ্ণ কন্ঠস্বর ভেসে এলো,

— হ্যালো? ঊর্মি?

ঊর্মি চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। জবাব দিল না।

কল্লোল আবার ডাকল, স্বর এবার আগের চেয়েও উষ্ণ।
— লিটল বার্ড, আছো?

ঊর্মির আস্তে করে জবাব দিল,
— হুঁ…

ওপাশে খানিক নীরবতা। যেন কল্লোলও ওর কণ্ঠের এক অক্ষরটুকুতে ডুবে গেছে। তারপর নিচু, স্থির গলায় বলল,
— আমাকে মিস করছো তুমি?

ঊর্মির নিঃশ্বাস এক লহমায় থমকে গেল। বুকের ভেতর ঝড় বয়ে গেলেও ঠোঁট শুকিয়ে এলো হঠাৎ। চোখ পিটপিট করে সিলিংয়ের দিকে তাকাল, যেন অদৃশ্য কোনো প্রশ্নপত্র ওর সামনে রাখা হয়েছে আর উত্তর দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না ও।

ও কিছু না বলে চুপ করে রইল।

ওপাশ থেকে আবার কল্লোলের গলা ভেসে এল,
— লিটল বার্ড?

ঊর্মি ঠোঁট কামড়ে চোখ বুজল। শব্দ বেরোল ভাঙা স্বরে, প্রায় ফিসফিসিয়ে,
— আ-আপনি… কেন জিজ্ঞেস করছেন?

কল্লোলের হালকা দীর্ঘশ্বাস কানে এলো।
— কারণ আমি চাইছি… তুমিও স্বীকার করো। আমি একা মিস করছি না।

ঊর্মির শরীর কেঁপে উঠল। লজ্জা, অস্থিরতা আর বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ মিলেমিশে যেন তোলপাড় তুলল পুরোটা অস্তিত্বে।

— আমি… আমি… (গলা শুকিয়ে গেল ওর)

— তুমি…?

— আমি আপনাকে মিস করতে যাব কেন?

কল্লোল হেসে উঠল, যেন বোকা মেয়েটার মিথ্যে ধরতে কোনো অসুবিধাই হয়নি।
— সুইটহার্ট, তোমার নিঃশ্বাসের শব্দই বলে দিচ্ছে তুমি মিথ্যে বলছো।

ঊর্মির নিঃশ্বাস আটকে গেল। ফোন শক্ত করে কানে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল ও।

কল্লোলের গলা ভেসে এলো আবার,
— তুমি সত্যিই আমাকে মিস করছো না?

ঊর্মি গলা শুকিয়ে যাওয়া গলা থেকে জোর করে শব্দ বের করল, প্রায় ফিসফিসিয়ে,
— ক-করছি…

ওপাশে মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা। তারপর খুব ধীরে গভীর তৃপ্তির হাসি মিশে এল কল্লোলের কণ্ঠে,
— That’s all I needed to hear.

ঊর্মির বুক ধড়ফড় করে উঠলো। মনে হলো, একটুকরো স্বীকারোক্তির মধ্যেই যেন সমস্ত দুর্বলতা, সমস্ত প্রতিরোধ গলে গিয়ে ও নিজেকে সঁপে দিল কল্লোলের হাতে।

কল্লোল নিচু স্বরে আবার বলল,
— ঊর্মি… তোমার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আমি খুব স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

ঊর্মি চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস আটকে ফেলল। শরীর ঝিমঝিম করছে। ও আস্তে করে ফিসফিসিয়ে বলল—
— Please… don’t say like that…

কল্লোল নেশামাখা কণ্ঠে বলল,
— কেন? সত্যিটা শুনতে ভয় লাগে তোমার? যে তুমি আমাকে ছাড়া এখন আর ভালো থাকতে পারো না?

ঊর্মি চুপ করে রইল। ফোন আঁকড়ে ধরা হাতটা কাঁপছে। বুকের ভেতর ঝড় বইছে ওর।

কল্লোল এবার আগের চেয়েও নেশামাখা কণ্ঠে বলল,
— ঊর্মি… আমার স্পর্শ মিস করছো?

ঊর্মির ঠোঁট শুকিয়ে গেল। চোখে জল টলমল করছে। মোহাবিষ্টের ন্যায় ভাঙা গলায় উত্তর দিল ও,
— হুঁ…

— God…
ওপাশে গভীর নিঃশ্বাস টানল কল্লোল,
— তুমি বুঝতে পারছো কী বললে তুমি?

ঊর্মি উত্তর দিল না। মুখ গুঁজে ফেলল বালিশে।

কল্লোলের গলায় এবার তীব্র আকাঙ্ক্ষার ছোঁয়া,
— I swear sweetheart, আমি যদি এখন ওখানে থাকতাম…

ঊর্মির পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো। যেন কল্লোল ফোনের ওপাশ থেকেও ছুঁয়ে ফেলছে ওকে।

— আ-আ-আবরার…!
ঊর্মি সজোরে প্রতিবাদ করতে চাইল।

সেটা বুঝতে পেরে কল্লোল হাসলো ওপাশ থেকে,
— Oh sweetheart… be ready for tomorrow!

To be continued…