জলতরঙ্গের সুর পর্ব-৩৩+৩৪

0
5

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ৩৩ [কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য ‼️]
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

[রিয়াক্ট দিয়ে তারপর পড়া শুরু করুন]
ঊর্মি গোসল সেরে বেরিয়েছে। হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি ওর পরনে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ও কল্লোলের জন্য কফি বানানোর কথা চিন্তা করলো। কিন্তু এখানকার কিছুই তো চেনেনা ও। গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখল ডাইনিংয়ে ড্রিমলাইট জ্বালানো। সেই আলোতে রান্নাঘর দেখা যাচ্ছে। ঊর্মি নিঃশব্দে রান্নাঘরে ঢুকে আলো জ্বালালো।

তারপর সবগুলো ক্যাবিনেট খুলে খুলে দেখলো কোনটায় কফি আছে। কফির সব সামগ্রী এক পাশের ক্যাবিনেটে আলাদা করে রাখা। ‌ ও চুলায় গরম পানি বসিয়ে কফির জার নামালো।

ওদিকে কল্লোল বারান্দা থেকে রুমে এসে খেয়াল করল
ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে না। দরজার কাছাকাছি গিয়ে বুঝল দরজাটাও খোলা। ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল ওর। বউ কোথায়?

ঘরের দরজার কাছে এসে দেখলো এই দরজাও খোলা, চাপিয়ে রাখা। রুম থেকে বের হতেই রান্নাঘরের আলোটা চোখে পড়ল। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে এগিয়ে গেলেও রান্নাঘরের সামনে গিয়ে ওর পা জোড়া থমকে গেল।

ঊর্মি কোমরে আঁচল গুঁজে মগে চামচ নাড়াচাড়া করছে। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠময়। চুলের টপাটপ পানিতে শাড়ির কোমরের অনেকটা অংশ ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। গোলাপি শাড়িতে ওকে দেখতে একটা ফুটন্ত জবা ফুলের মতো লাগছে।

কল্লোল সম্মোহিতের ন্যায় এগোলো কিচেনের ভেতর। পেছন থেকে শাড়ির ভেতরে হাত গলিয়ে সরু কোমরটা টেনে মিশিয়ে নিল নিজের সাথে।

রাতবিরেতে এমন আচমকা স্পর্শে ঊর্মির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই কল্লোল ওর চুলে মুখ‌ ডুবিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী করছো, হানি?”

ঊর্মি এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো ওকে।‌ কল্লোলের কণ্ঠস্বর শুনে এক মুহূর্তেই রাগটা চিরবিড়িয়ে উঠলো মাথায়।

“আপনার সমস্যাটা কী বলুন তো? এভাবে নিঃশব্দে কেউ চলাফেরা করে?”

হঠাৎ করে ওর এমন প্রতিক্রিয়ায় কল্লোল থতমত খেয়ে গেল,” আ… আ’ম সরি, তুমি ভয় পেয়েছো?”

ঊর্মি কিছু না বলে নিজের কাজে মন দিল। আরেকটু হলে ওর জানটা বেরিয়ে যেত… আর এই লোক জিজ্ঞেস করছে ‘তুমি ভয় পেয়েছো?’ যত্তসব!

বউ রাগ করেছে বুঝে কল্লোল ভীত হলো। এগিয়ে গিয়ে আবার ওর কোমর জড়িয়ে ধরতে যাবার আগেই‌ ঊর্মি খেঁকিয়ে উঠলো, “খবরদার, একদম ছুঁবেন না আমায়!”

কল্লোল চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিল। অসহায় বোধ করল ভেতরে ভেতরে। এবার কী হবে? বউ তো ছুঁতেও নিষেধ করে দিল!

ঊর্মি ঘুরে দাঁড়িয়ে কফির মগটা ওর হাতে ধরিয়ে দিল, “ধরুন…”

কল্লোল অবাক হয়ে গেল এবার, “আমার জন্য কফি বানাতে এসেছ তুমি!”

ঊর্মি রাগী চোখে তাকিয়ে কিছু না বলে কিচেনের লাইট নিভিয়ে প্রস্থান ঘটালো।

“আরে…” কল্লোল অন্ধকারে কফি নিয়ে বিপাকে পড়ল। ওকে রেখেই বউ লাইট বন্ধ করে চলে গেছে! ওহ্ নো! বউ মনে হচ্ছে বেশি রাগ করেছে! এবার কী হবে?

কল্লোল কফির মগটা নিয়ে কোনোরকমে ঘরে এলো। এসে দেখলো বউ তার ইতিমধ্যে শুয়ে পড়েছে। কল্লোল কফিটা টেবিলে রেখে ঊর্মির পাশে বসলো, “সুইটহার্ট, শুয়ে পড়লে যে…?”

“তো মাঝরাতে কী মানুষ নৃত্য পরিবেশন করবে?”

“না মানে, আমাকে কফি করে রাত জাগার ব্যবস্থা করে দিয়ে তুমি ঘুমাবে?”

“জ্বী হ্যাঁ, আপনি কফি খেয়ে ছায়ামানবদের নৃত্য পরিবেশন করুন গিয়ে।”

“এমন করে না বউ, সরি তো! আমি সত্যি বুঝিনি তুমি ভয় পাবে…”

‘বউ’ শব্দটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য মনে অনুভূতির সঞ্চার হলেও শেষ লাইনটা শুনে রাগটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ঊর্মির।

“বুঝতে পারেননি মানে? এমন অচেনা জায়গায় রাতবিরেতে পেছন থেকে আচমকা কেউ এসে স্পর্শ করলে কি আমার খুশিতে ডিগবাজি দেবার কথা?”

“আচ্ছা সরি না!! আমি এত কিছু ভাবিনি তো…”

“কফি শেষ করুন! আমি কষ্ট করে বানিয়েছি।” প্রসঙ্গ বদলে ফেলল ঊর্মি।

কল্লোল মগটা হাতে তুলে চুমুক দিল তাতে। কফিটা শেষ করে‌ ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “The coffee was good but I need some sweets, honey.”

“মানে? এত রাতে আমি মিষ্টি কোথায় পাব?” ভ্রু কুঁচকালো ঊর্মি।

কল্লোল ঝুকে এলো ওর ওপর, ঘোর লাগা চোখে ঊর্মির ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, “Your soft lips. I missed them since last seven days…”

ঊর্মি চোখ বড়বড় করে তাকালো, “দেখুন…”

“দেখতে তো হবেই… come closer honey…”

“আপনার উল্টাপাল্টা মতলব বন্ধ করুন প্লিজ! অনেক রাত হয়েছে…”

কল্লোল ওর গালে হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিসিয়ে বললো, “রাতই তো আদর করার আদর্শ সময় সুইটহার্ট! Night is the perfect time for romance…”

“একদ…”

কথা বলার কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে কল্লোল দখল করে ফেলল প্রেয়সীর নরম ওষ্ঠদ্বয়। দীর্ঘসময় প্রেমসুধা আস্বাদনের পর সেখান থেকে সরে এসে কপালে চুমু খেল। ঘরের ম্লান আলোয় তখন স্পষ্ট হচ্ছিল মেয়েটার কাঁপা বুক দ্রুতগতিতে ওঠানামা করছে হাঁপরের মতো। কল্লোল এক টানে ওর আঁচলটা কাঁধ থেকে ফেলে দিল।

ঊর্মি চমকে উঠে কল্লোলের হাত ধরে ফেলল।
“আ-আ-আবরার ক-ক-কী ক-করছেন…”

কল্লোল ওর হাতদুটো মাথার উপর দিয়ে বিছানায় চেপে ধরে মুখ ডুবিয়ে দিলো মসৃণ গ্ৰীবাদেশে। ঘাড় বেয়ে নামা উষ্ণ নিঃশ্বাসে শিহরিত হলো ঊর্মির শরীর। ঊর্মি আপত্তি করার শক্তি হারিয়ে ফেলল যেন। নিঃশ্বাসের ছন্দ গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রিয় পুরুষটার উষ্ণ স্পর্শে হার মেনে যেতে লাগল ওর সমস্ত দ্বিধা।

কল্লোল এবার ওর হাতদুটো ছেড়ে দিয়ে গ্ৰীবাদেশ থেকে নিচের দিকে নামলো। মাঝের আবরণটুকু সরিয়ে ফেলে মুখ গুঁজলো প্রেয়সীর উন্মুক্ত বক্ষদেশে। তুলতুলে শরীরটা বাঁকিয়ে উঠল এহেন স্পর্শে। নিঃশ্বাস ভেঙে ভেঙে আসলো, আঙুল শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো প্রিয় পুরুষটার চুল। প্রেয়সীর আস্কারা পেয়ে আরো উন্মাদ হলো সে।

বক্ষদেশ ছাড়িয়ে কোমর জড়িয়ে সে প্রেয়সীকে টেনে নিল আরও কাছে। কল্লোলের হাত ধীরে ধীরে পিঠ বেয়ে নামল কোমরের বাঁকে। কেঁপে উঠে ঊর্মির শরীর শক্ত হয়ে গেল, নিঃশ্বাস দ্রুততর হলো।

কল্লোল যেন সঙ্গে সঙ্গেই টের পেল ওর পরিবর্তনটা প্রেয়সীর কপালে আস্তে করে একটা চুমু দিল ও, তারপর গালে, তারপর খুব ধীরে ওর ঠোঁট খুঁজে নিল নিজের ঠোঁটে।

কল্লোল আবারও প্রেয়সীকে নিজের কাছে টানল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠল ঊর্মির। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়ালো নোনা জল। ঊর্মির প্রিয় পুরুষটা সে জল সযত্নে টেনে নিল নিজের পুরু ওষ্ঠদ্বয়ের ভেতর।

বিছানার চাদর ততক্ষণে এলোমেলো। দুটো দেহ গলে গিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। উষ্ণ নিঃশ্বাসে ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ। লজ্জা, ভয় সবকিছু গলে গিয়ে এক অদ্ভুত আবেশে ডুবে যাচ্ছিল দুজনেই।

অবশেষে রাতের নিস্তব্ধতায় শুধু ভেসে থাকল হৃদস্পন্দনের শব্দ, ভাঙা নিঃশ্বাস আর চাপা শীৎকার— যেখানে সমুদ্রের দুটো রূপ হারিয়ে গেল একে অপরের ভেতর।

______________________________

কল্লোলের হাত থেকে ঊর্মি নিস্তার পেল ভোরবেলায়। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা আলোটা পড়েছে ওর মুখে। অশান্ত রাতের পর এখন নিস্তব্ধতা- ক্লান্তির ভারে চোখ দুটো বন্ধ, বালিশে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলে ভোরের ম্লান আলো খেলে যাচ্ছে। চোখের কোণের শুকনো জলরেখা যেন রাতের সমস্ত আবেগের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে এখনো।

কল্লোল এক হাত বাড়িয়ে আলতো করে প্রেয়সীর এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিল কপাল থেকে। মেয়েটার নিঃশ্বাস এখন ধীর, কিন্তু কাঁপুনির রেশটা যেন শরীর থেকে মুছে যায়নি পুরোপুরি। কল্লোল বালিশে শুয়ে ঊর্মিকে বুকে টানলো। দীর্ঘ সময় নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো কপালে। ক্লান্তির ভারে ঘুমিয়ে পড়া শরীরটা টের পেল না সেই আদুরে স্পর্শ।

কল্লোল মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে বড্ড তৃপ্তি অনুভব করল। মেয়েটা সারা জীবনের জন্য ওর হয়ে গেছে। ওর স্ত্রী, ওর ভালোবাসা, ওর পৃথিবী, সব কিছু এই মেয়েটা। এই মেয়েটাকে ও হারাতে দেবে না কোনভাবেই। একদম ঢুকিয়ে রাখবে বুকের মধ্যে।

কল্লোলের চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসছে ঘুমের ভারে। শক্ত করে প্রেয়সীকে বুকে জড়িয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ও।

_____________________________

পিটপিট করে চোখ মেলে চাইতেই বুকের ওপর ভারী বস্তুর অস্তিত্ব টের পেল ঊর্মি। ভ্রু কুঁচকে মাথা নামিয়ে তাকাতেই চোখজোড়া ফুটবল আকৃতির হয়ে গেল। কল্লোল ওর বুকের উপর মাথা রেখে জাপটে ধরে আছে ওকে। তার চেয়েও বড় কথা— ঊর্মির পরনে কিছুই নেই, সারা শরীর জুড়ে কেবল চাদরের পাতলা আবরণ। মুহূর্তেই সারা শরীরজুড়ে ছড়িয়ে গেল লজ্জা আর অস্বস্তির আগুন। চোখ বড় বড় করে শ্বাস আটকে গেল বুকের ভেতর।

ঊর্মি এক হাত বাড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে শাড়ি খুঁজতে গিয়ে বুঝল— গত রাতের অশান্ত ঢেউয়ে সব কিছু এলোমেলো। কল্লোল শাড়িটা ঘরের কোন মাথায় ফেলেছে কে জানে। ও হাত বাড়িয়ে কাঁপা আঙুলে সাবধানে কল্লোলের মাথাটা সরাতে চাইল। কল্লোল নড়ে উঠলো তৎক্ষণাৎ,

“উমম… কী হয়েছে হানি? নড়াচড়া করছো কেন?”

কল্লোলের ঘুমঘুম কণ্ঠস্বর সোজা এসে ঊর্মির বুকে বিঁধলো। শুকনো ঢোক গিলে ও কোনরকমে বলল, “স-সরুন…”

“কেন?” কল্লোল আরো শক্ত করে ওকে জাপটে ধরল, চোখ পুরোপুরি খোলেনি ওর, তবু ঠোঁটে খেলে গেল দুষ্টু হাসি।

ঊর্মির বুকের ভেতর ধড়ফড় করে উঠল। গালদুটো গরম হয়ে গেছে লজ্জায়, “ছাড়ুন তো… আমি…”

“না, একদম না,” কল্লোল নাক ডুবিয়ে দিল ওর গ্ৰীবায়। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস ঊর্মির শরীর বেয়ে কেঁপে উঠল।

ঊর্মি অস্থির ভঙ্গিতে হাত দিয়ে ঠেলল ওকে, কিন্তু একচুলও সরাতে পারল না। কল্লোল ফিসফিস করে বলল, “গত রাতের পর আজ সকালে তুমি আমার থেকে দূরে যেতে চাইছো? ইমপসিবল, হানি।”

ঊর্মি নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, “আবরার… প্লিজ, ছাড়ুন…”

“কোনো ছাড়াছাড়ি নেই হানি! I need you…”

ঊর্মি ছটফট করে উঠল, কাঁধে চাদর টেনে ঢাকতে চাইল নিজেকে। কিন্তু কল্লোলের শক্ত বাহু ওকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

“আবরার… না…” ওর গলা কেঁপে উঠল লজ্জায়। চোখ দুটো ভিজে আসছে অস্থিরতায়।

কল্লোল ঝুঁকে এসে ওর কানের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলল, “হানি…?”

ঊর্মি মুখ ঘুরিয়ে নিল। কল্লোল আঙুল দিয়ে আলতো করে ওর থুতনিটা ধরে ফেরালো নিজের দিকে। চোখে গভীর দৃষ্টি রেখে বলল, “তুমি জানো, আমি চাই তোমার প্রতিটা সকাল আমার বুকে শুরু হোক। তুমি আমার, ঊর্মি… শুধু আমার।”

ওর ঠোঁট এবার ধীরে ধীরে নামল গ্রীবা বেয়ে কাঁধে। চাদরের ফাঁক গলে উষ্ণ স্পর্শে শরীর কেঁপে উঠল ঊর্মির। হাত দিয়ে ঠেলতে গিয়ে নিজেই অসহায় হয়ে থেমে গেল।

“আবরার…” এবার ডাকটা এল হাপরের মতো ওঠানামা করা নিঃশ্বাসের ভেতর থেকে, “আ-আপনি খুব খারাপ! আদর করার কথা বলে কষ্ট দিয়েছেন আমাকে…”

কল্লোল মাথা তুলে ওর ঠোঁটে চুমু খেল, “প্রথমবার একটু কষ্ট হয় হানি, বাট ইটস ওকে! এরপর থেকে আর হবে না…” ফিসফিসিয়ে বলে কল্লোল ঠোঁট রাখল ওর কাঁপতে থাকা বুকে।

ঊর্মি চোখ বন্ধ করে শিউরে উঠল। ওর আঙুল শক্ত করে আঁকড়ে ধরল কল্লোলের চুল।

“এ-এখন ন-না প্লিজ আবরার… আমার কষ্ট হচ্ছে…”

কল্লোল মাথা তুলে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে গেল তৎক্ষণাৎ, “কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে হানি? আমাকে বলো নি কেন?” বলতে বলতে কল্লোল উঠে বসে ঊর্মির শরীরে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে বুকে টেনে নিল ওকে। ওর চোখে হঠাৎ করে চিন্তার ছায়া নেমে এল। ঊর্মিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,

“হানি… was I too rough yesterday?”

ঊর্মি ঠোঁট কামড়ে চোখ নামিয়ে নিল। লজ্জা, অস্বস্তিতে মুখ গুঁজে ফেলল ওর প্রশস্ত বুকে।

“Let’s go to the washroom. ফ্রেশ হলে বেটার ফিল করবে…” বলতে বলতে কল্লোল ওকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো।

ঊর্মি চমকে উঠলো, “আ-আ-আবরার আ-আমি একাই পারবো…”

কল্লোল হাসলো, “একাই পারবে? হানি, তুমি তো ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছো না।”

“আমাকে তো আপনি বিছানা থেকে নামতেই দিলেন না! নিজে নিজেই সব বুঝে নিলেন! নামিয়ে দিন না প্লিজ…” ঊর্মি হাত পা ছুড়ে আপ্রাণ চেষ্টা করল নিজেকে ছাড়াবার।

কল্লোল গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, “নো ওয়ে…”

ঊর্মি এবার গাল ফোলাল লজ্জায়, “আপনি একদম বাজে!”

কল্লোল এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো, “বাজে? তাহলে কি আবার গতকালের মতো ‘বাজে’ হবো নাকি, সুইটহার্ট?”

বলতে বলতে কল্লোল ওকে বাথটাবের ভেতর নামিয়ে দিল। ঊর্মি আঁতকে উঠে চাদর আঁকড়ে ধরল বুকের কাছে, “আ-আহ! আবরার…! এটা কী করছেন? আমি নিজেই করতে পারবো বলেছি তো!”

কল্লোল ভান করা সিরিয়াস গলায় বলল,
“আমার হানি একা একা ফ্রেশ হতে পারবে না। আমি এখন ডিউটিতে আছি। তুমি বেশি কথা বোলো না তো!”

ঊর্মি চোখ কুঁচকে তাকালো, “কিসের ডিউটিতে আছেন আপনি?”

কল্লোল হেসে ফেলল, “ফুল-টাইম হাজব্যান্ডের ডিউটিতে।”

ঊর্মি ঠোঁট কামড়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। কল্লোল বাথটাবের পানির ট্যাপ চালু করল, তারপর পাশ ফিরে বলল, “আচ্ছা হানি, তুমি চাইলে আমি চোখ বেঁধে রাখব।”

ঊর্মি ভুরু কুঁচকে গাল ফুলিয়ে তাকাল, “উহ… ঢং!!”

কল্লোল হেসে ফেললো, “জানো, তোমাকে এভাবে ছোট্ট বাচ্চার মতো সামলাতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।”

ঊর্মি কণ্ঠ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আমি বাচ্চা নই…”

কল্লোল থেমে ওর চোখে গভীর দৃষ্টি রাখল, “হুম… তুমি বাচ্চা নও, তুমি আমার প্রিয়তমা। তবে আমার চোখে তুমি সবসময় কিউটেস্ট লেডি।”

ঊর্মি হঠাৎ করে চাদরটা বুকের কাছে আরও টেনে নিল, যেন নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। কল্লোল হেসে ফিসফিস করল, “এভাবে লজ্জা পাচ্ছো কেন, হানি?তোমার চোখের এই ভেজা লাজুক চাহনি কিন্তু আমায় পাগল করে দেয়…”

ঊর্মির বুক ধড়ফড় করে উঠল। ও ঠোঁট কামড়ে ফিসফিস করে বলল, “চুপ করুন অসহ্য পুরুষ…”

To be continued…

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ৩৪
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

[রিয়াক্ট দিয়ে তারপর পড়া শুরু করুন]
কাল কল্লোল চলে যাবে, তাই আজকের দিনটা ওরা নিজের মতো করে কাটাক- এটা ভেবে রাহেলা চৌধুরী অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে সকালবেলা চলে গেলেন নিজের বাসায়। ব্রেকফাস্ট সেরে সবাই চলে যেতেই ঊর্মি কিছু না বুঝতে পেরে কল্লোলকে জিজ্ঞেস করল, “আবরার, সবাই এত তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন?”

কল্লোল কপালে তর্জনী ঘষলো। ঊর্মিকে এখন কী করে বলবে ওর যাওয়ার কথাটা?

গলা খাঁকরি দিয়ে বিছানায় বসলো ও। তারপর হাত বাড়িয়ে ঊর্মিকে টেনে ওর কোলে বসালো, “Honey, I have something to tell you…”

ঊর্মি অবাক হলো। ওর চোখে তখন মিশ্র অনুভূতি— অস্থিরতা আর কৌতূহল।

কল্লোল গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে হাতটা ঊর্মির কোমর ঘিরে ধরল, আলতো করে টান দিয়ে ওকে আরও কাছে নিয়ে এলো। ধীর কণ্ঠে বলল, “আমাকে কাল যেতে হবে লিটল বার্ড…”

ঊর্মির ভ্রু কুঁচকে গেল, “যেতে হবে মানে? কোথায় যেতে হবে?”

“একটা অপারেশনে…”

ঊর্মি দুহাত দিয়ে ওর বুকে ধাক্কা দিল, “একদম এরকম ফালতু মজা করবেন না, আবরার! I don’t like it.”

কল্লোল মাথা নীচু করে ওর কাঁধে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “আমি মজা করছি না, হানি… সত্যিই…”

“আবরার! Please stop!”

“সুইটহার্ট, প্লিজ আমার কথাটা শোনো…”

উর্মি ওর হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে উঠে গেল, “আপনার এসব আজেবাজে কথা শোনার সময় নেই আমার।”

কল্লোলও উঠে দাঁড়াল, তড়িৎ দু’পা এগিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়াল, “Honey, look at me!”

ঊর্মি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাথা তুলে ওর দিকে তাকালো, “বলুন।”

কল্লোল হাত বাড়িয়ে আলতো করে ওর আঙুল ধরে অসহায় চোখে তাকালো, “এমন কোরো না, সুইটহার্ট… আমি নিরুপায় এখানে…”

ঊর্মি আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তারপর চোখে অবিশ্বাস নিয়ে খুব ধীরে ধীরে বলল, “মানে আপনি সত্যি সত্যিই চলে যাবেন, আবরার…?!”

কল্লোল ঠোঁট কামড়ে থেমে গেল। ঊর্মি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর পানে। মেয়েটাকে কী জবাব দেবে ও?

কল্লোল কিছু বলছে না দেখে ঊর্মি পেছন ফিরে বিছানায় গিয়ে বসলো। ঠোঁট কামড়ে চুপ করে বসে আছে। চোখে জমে ওঠা পানিটুকু ঝরে পড়তে চাইছে, কিন্তু ও জেদের বশে মরিয়া হয়ে আটকাচ্ছে। যেন বিশ্বাসই করতে চাইছে না— এত তাড়াতাড়ি, এত নিষ্ঠুরভাবে কল্লোল চলে যাবে!

কল্লোল ধীরে ধীরে ওর কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল,
“আমি যেতে চাইনি বিশ্বাস করো! হঠাৎ করে যে উপর থেকে এমন অর্ডার আসবে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। কিন্তু ডাক এলে যেতে তো হবেই… এটা আমাদের কর্তব্য!”

ঊর্মি রাগে, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিল, “কর্তব্য! আমার প্রতি কোনো কর্তব্য নেই আপনার? গতকাল বিয়ে হলো আমাদের, এখনো চব্বিশ ঘন্টাও হয়নি… আর আপনি এখন বলছেন, কাল আপনাকে যেতে হবে! Wow, wonderful!”

কল্লোল চোখ বন্ধ করে মাথাটা নুইয়ে ফেলল। ঠিক এটারই ভয় পাচ্ছিল ও। এ জন্যই তো চেয়েছিল ফিরে এসে বিয়েটা করতে। কিন্তু…

কল্লোল মাথা তুলে ঊর্মির ছলছলে চোখের দিকে তাকালো গভীর দৃষ্টিতে। তারপর খুব আস্তে করে বলল, “তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কর্তব্য, ঊর্মি। কিন্তু নোটিশটা এসেছে ঠিক বিয়ের আগের দিন রাতে। আমি সেই রাতেই ফুপিকে ফোন করেছিলাম বিয়েটা কয়েকদিন পেছানো যায় কিনা… কিন্তু ফুপি বলল শেষ মুহূর্তে এসে এটা ঠিক হবে না। তাই…”

“তাই আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বিয়ে করে একদিনের নতুন বউকে একা ফেলে চলে যাবেন, তাই তো?” গভীর নিশ্বাস নিয়ে উথলে আসা কান্নাটাকে দমাবার চেষ্টা করল ঊর্মি।

“হানি… আমাকে ভুল বুঝো না, প্লিজ! I was just helpless. ওই মুহূর্তে আমার মাথাই কাজ করছিল না কী করব, কী করা উচিত!” কল্লোল আবারো মাথা নামিয়ে ফেলল।

“আমি… আমি কী করবো আবরার? আপনি কালকে চলে গেলে তারপর আমি কী করবো?” ঊর্মির কন্ঠস্বর রুদ্ধ।

কল্লোল মেঝে থেকে উঠে ঊর্মির পাশে বসলো, তারপর ওকে বুকে টেনে নিল। ওর চোখের গভীরে তাকিয়ে শুধালো, “এটা আমাদের বিচ্ছেদ না— এটা কাজ, বাধ্যবাধকতা। আমি আবার তোমার কাছেই তো ফিরব। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ আছে, বলো? তুমিই আমার ঘর, আমার শান্তি। তোমার মাথাটা এই বুকটায় চেপে না ধরলে আমার হৃদয় শান্তি পায় না। সেই আমি কোথায় যাব তোমায় ছেড়ে?”

ঊর্মির বুক কেঁপে উঠল। চোখে জল জমে ঝাপসা করে দিল সবকিছু। ও হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরল কল্লোলকে। ওর বুকে মুখ গুজতেই এতক্ষণ ধরে জোর করে আটকে রাখা কান্নাটা উথলে এলো এবার। কান্নার দমকে পিঠ ফুলে উঠল ঊর্মির। কল্লোল হাত বুলালো প্রেয়সীর আধভেজা চুলে। মাথায় চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকলো, “ঊর্মি…?”

ঊর্মি মুখ না তুলে আরো জোরে আঁকড়ে ধরল ওকে।কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলল, “আমি আপনাকে হারাতে চাই না আবরার… এক মুহূর্তের জন্যও না।”

কল্লোল ওর মাথাটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরল, “হারাবে না। I promise— যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ফিরব তোমার কাছে। আজকের দিনটা আমরা একসাথে কাটাই হানি? আর কান্নাকাটি করো না, প্লিজ!”

ঊর্মি কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে যাওয়া চোখ মেলে তাকাল প্রিয় পুরুষটার পানে। কল্লোল এক হাত বাড়িয়ে ওর দুগাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনা স্রোত মুছে দিলো সযত্নে। তারপর একটা আলতো চুমু খেল ঠোঁটে।

এই স্বল্প সময়ের স্পর্শ পেয়ে ঊর্মির মন আজ সন্তুষ্ট হলো না। ও আগ বাড়িয়ে তীব্র আশ্লেষে আঁকড়ে ধরল প্রিয় পুরুষটার পুরুষালি ঠোঁট দুটো।

কল্লোল হতবাক হয়ে চোখ বড় করে তাকালো। পর মুহুর্তে ঊর্মির ভেতরের অস্থিরতাটা বুঝতে পেরে ও নিজেও সায় দিল প্রেয়সীর পাগলামিতে। ওর প্রেয়সী তখন পুরু ওষ্ঠদ্বয়ে কামড় বসিয়েছে। কল্লোল চোখ বন্ধ করে ব্যথাটা সহ্য করে নিল। কিন্তু এতেও শান্তি হলো না তার প্রেয়সীর। ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে সে এবার টিশার্টের ওপর দিয়েই কাঁধে কামড় বসালো।

“আআআ… হানি! কী করছো এটা?”

ঊর্মি থামল না। কাঁধে দাঁত বসিয়ে আবার মুখ তুলে ওর গলা জড়িয়ে ধরল, তারপর ঝড়ের বেগে আবার ঠোঁটে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওর ভেতর যেন একরাশ ভয়, যেন কল্লোলকে না জড়ালে, না ছুঁলে মানুষটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।

“তুমি আমাকে ফেলে যাবে না আবরার… যাবে না… যাবে না…” কাঁপতে কাঁপতে একই কথা বারবার বলতে বলতে কল্লোলের ঠোঁট-চিবুক-গালে অস্থির চুমুর বৃষ্টি নামিয়ে দিল অস্থির মেয়েটা।

কল্লোল হতভম্ব, তারপর অসহায় ভঙ্গিতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল প্রেয়সীকে, “ঊর্মি… calm down, baby… আমি আছি তো, এই দেখো, তোমার কাছেই আছি।”

কিন্তু ঊর্মি শুনছে না। ওর আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরেছে কল্লোলের টিশার্ট, প্রায় ছিঁড়ে ফেলার মতো করে টানছে।
“আমি চাই না আপনি আমাকে একা রেখে কোথাও যান… আমি পাগল হয়ে যাবো আবরার!”

কল্লোল বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ওর কান ঘেঁষে ফিসফিস করল, “পাগলি মেয়ে… তোমার এই অস্থিরতাই বলে দিচ্ছে তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। কিন্তু আমি তো তোমাকে প্রমিস করেছি খুব তাড়াতাড়ি আসব। মাত্র ক’দিনের ব্যাপার…”

ঊর্মি চোখ ভেজা, চুল এলোমেলো, ঠোঁট কাঁপছে। ও হঠাৎ করে কল্লোলের বুকে কষে ঘুষি মারল, “আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না! কেন আমার সাথে এমন করছেন আবরার?”

ব্যথা পেলেও কল্লোল কিছু বলল না। হাত বাড়িয়ে ওর মুখে জমে থাকা কান্নার ফোঁটাগুলো মুছল,
“বিশ্বাস করো হানি— আমি তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি শুধু কাজের জন্য যাচ্ছি। খুব তাড়াতাড়ি আসব তোমার কাছে।”

ঊর্মি হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর মুখ তুলে কল্লোলের চোখের গভীরে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদতে শুরু করল। একদম বাচ্চাদের মতো।

কল্লোল ওকে বুকের ভেতর মুড়ে নিয়ে মাথায় একের পর এক চুমু দিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল, “ঊর্মি, প্লিজ সোনা, কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমার বুকের এইখানে ব্যথা করে, দেখো…”

ঊর্মি মাথা নাড়তে নাড়তে কল্লোলের বুকের ভেতর আরও গুটিয়ে গেল। ভাঙা গলায় বলল, “তাহলে আমায় শক্ত করে ধরে রাখো… ছেড়ো না এক মুহূর্তের জন্যও।”

ওর হাতদুটো মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরল কল্লোলের গলা। যেন ভয়— ছেড়ে দিলেই মানুষটা হারিয়ে যাবে।

তারপর হঠাৎ মুখ তুলে কল্লোলের চোখের দিকে তাকাল। চোখদুটো লাল, পলক ভেজা, কিন্তু দৃষ্টিটা তীব্র, “আজকের দিনটা শুধু আমার আবরার… তুমি কোথাও যাবে না। আমি তোমায় কোথাও যেতে দেব না।”

বলেই ওর ঠোঁটে শক্ত করে একটা চুমু খেল ঊর্মি। একরাশ কান্না, অভিমান আর পাগলামি মিশে গেছে সেই চুমুতে।

কল্লোল হাত বাড়িয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিল ওকে, প্রেয়সীর এই পাগলামিকে থামানোর চেষ্টা করল না।

কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ করে ঊর্মির হাতদুটো আলগা হয়ে এলো। কল্লোল প্রথমে ভয় পেয়ে গেল, তারপর মাথা নিচু করে তাকিয়ে দেখল— ক্লান্তিতে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা।

অশ্রুভেজা মুখটা ওর বুকে হেলে আছে, নিঃশ্বাসগুলো ভারী। যেন ঝড় পেরিয়ে গিয়ে একটা নিরুপায় ঘুম এসে জড়িয়ে ধরেছে ওকে।

কল্লোল দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাবধানে ওকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে গালে বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছল দুহাতে। মেয়েটার নাকের ডগাটা টকটকে লাল হয়ে গেছে। কল্লোল মাথা ঝুঁকিয়ে চুমু খেল সেখানে। পরপর দুগালে, কপালে তারপর ঠোঁটে এবং সবশেষে থুতনিতে।

ঊর্মি একটু নড়েচড়ে উঠলো, “আ.. আব-রার…?”

“হুঁ… ”

ঊর্মি ঘুমের মধ্যেই দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। অগত্যা কল্লোলও শুয়ে পড়ল ওকে জড়িয়ে…

_________________________

ঊর্মির ঘুম ভাঙলো ভর দুপুরে। চোখ কচলিয়ে ঝাপসা দৃষ্টিতে পাশে তাকাতেই দেখল কল্লোল নেই; বিছানা খালি। বুকটা ধক করে উঠল ওর। আতঙ্কে লাফিয়ে উঠল বিছানা থেকে। চোখ ভিজে গেল আবার।

“আ… আবরার…?” কাঁপা গলায় ডাক দিল ও। কোনো সাড়া নেই। কাঁপা কণ্ঠস্বরটা যেন শূন্য ঘরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে।

“না… না… এটা হতে পারে না…” নিজের সাথেই বিড়বিড় করতে করতে ঊর্মি এলোমেলো পায়ে ঘর থেকে বের হলো। ড্রইংরুম, বারান্দা, কোথাও নেই কল্লোল।

“আবরার! আবরার কোথায় তুমি? না… না… তুমি আমাকে ফেলে যেতে পারো না আবরার… আমি বলেছিলাম না? আমি সহ্য করতে পারব না…”

ওর শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। অস্থির পায়ে ছুটে আবার শোবার ঘরে ফিরে এলো ও। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে কাঁপা হাতে বালিশটা আঁকড়ে ধরল, যেটার ওপর কল্লোলের মাথার ছাপ এখনো গরম।
বালিশটা বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করল, “তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারো না… পারো না…”

ঠিক তখনই পেছন থেকে কল্লোলের পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “হানি…”

ঊর্মি তড়িঘড়ি ঘুরে তাকাল। দরজা দিয়ে কল্লোল
ঢুকছে— হাতে কফির মগ, ধোঁয়া উঠছে সেখান থেকে।

কল্লোল ভ্রু কুঁচকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল, “তুমি এমন ছুটোছুটি করছো কেন? আমি তো কিচেনে ছিলাম।”

ঊর্মি শব্দ না করে দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। ওর বুকের ভেতর মুখ গুঁজে হাপরের মতো শ্বাস নিতে লাগল।

“আমি ভেবেছিলাম… আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছ…”

কল্লোল অবাক হয়ে ওর মাথার উপর হাত রাখল, তারপর ধীরে ধীরে আঁকড়ে ধরল প্রেয়সীকে, “ও মাই গড! পাগলি মেয়ে, আমি কি এমন করে তোমাকে রেখে চলে যাব? তুমি ঘুমাচ্ছিলে, তাই কফি আনতে গেলাম একটু আগে। আমি আছি তো তোমার কাছেই।”

ঊর্মি মাথা তুলে ভিজে চোখে তাকাল, “প্রমিস?”

কল্লোল ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল, “হাজারবার প্রমিস।”

ঊর্মি আবার বুকে মুখ গুঁজে শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে রইল, যেন ছেড়ে দিলেই আবার হারিয়ে যাবে মানুষটা।

_________________________________

রাত নেমেছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, দূরে কোথাও থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে মাঝেমধ্যে। ঘরে আলো জ্বলছে, বিছানার ওপরে বসে আছে ঊর্মি। চোখদুটো লাল এখনো, নিস্তেজভাবে কল্লোলের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।

কল্লোল গোছগাছ করছিল। উর্মিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও ধীরে উঠে এসে বসলো ওর পাশে। হাত বাড়িয়ে ওর চুলগুলো সরিয়ে দিল কপাল থেকে, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন, হানি?”

ঊর্মি ধীরে মাথা ঝাঁকালো, তারপর ফিসফিস করে বলল,
“কীভাবে…?”

কল্লোল প্রসঙ্গ ঘোরালো, “এখনো জেগে বসে আছো, ঘুমাবে না?”

“না…”

ভ্রু কুঁচকে তাকালো কল্লোল, “কেন?”

ঊর্মির চোখ আবার ছলছল করছে, “ঘুমালে তো রাতটা তাড়াতাড়ি চলে যাবে, আপনার সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না…”

কল্লোলের বুকটা কেমন হাহাকার করে উঠল ওর কথায়। এক মুহূর্তে হাতটা বাড়িয়ে ঊর্মিকে কাছে টেনে নিল।
“সুইটহার্ট, এভাবে বলো না… আমি তো তোমার কাছেই আছি।”

“কতটা সময় আছেন বলুন? সকালে চলে গেলে এখন থেকে আর ক’ঘন্টা…?” ঊর্মি ফিসফিস করে বলতে বলতে আঙুলে কর গুনলো।

কল্লোল ঠোঁটে মৃদু হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু চোখে ক্লান্তি আর অসহায়তা ভেসে উঠেছে। ও আলতো করে ঊর্মির আঙুলগুলো নিজের হাতে চেপে ধরে বলল,
“সময়টা যতটুকুই পাই, ততটুকুই আমাদের। রাতটা লম্বা করি আমরা, কী বলো?”

ঊর্মি নিঃশব্দে ওর বুকে মুখ গুঁজে দিল। বুকের ভেতর কান্নার দমক উঠছিল, বহুকষ্টে চাপল তা।

ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে এলো। বাইরে কুকুরের ডাক থেমে গেছে, কেবল দেওয়ালের ঘড়ির টিকটিক শব্দ ভেসে আসছে। কল্লোল আলতো করে ঊর্মির মাথায় হাত বুলালো।

“জানো ঊর্মি… সময়কে তো আমরা থামাতে পারি না। কিন্তু সেই সময়ের মাঝে আমরা একে অপরকে কতটা ধরে রাখতে পারি, কতটা অনুভব করতে পারি সেটা আমাদের হাতে। আজ রাতটা শুধু আমার আর তোমার হয়ে থাকুক।”

ঊর্মি মাথা তুলে ভেজা চোখে তাকাল। কল্লোল মৃদু হাসি দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “চল… ঘড়ির টিকটিক ভুলে যাই। মনে করি পৃথিবীতে শুধু আমরা দুজন।”

To be continued…