জলফড়িঙের খোঁজে পর্ব-৪১+৪২

0
677

#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪১
.

কিছু মানুষ আমাদের স্মৃতিতে সর্বক্ষণ থাকে। তাদের নিয়ে আমরা ভাবি, চিন্তা করি, তাদের শুধু একবার দেখার জন্যে ভেতরে ভেতরে ছটফট করি। কিন্তু তারা যখন সামনে চলে আসে তখন কী বলব নিজেরাই বুঝে উঠতে পারিনা, কথাগুলো সব গলাতেই আটকে যায়, প্রচন্ড অস্বস্তি হয়। সেরকমই অবস্থা হয়েছে এখন সৌহার্দ্য আর তুর্বীর। দুজনে একটা রেস্টুরেন্টের টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে। এই রেস্টুরেন্টে আগে প্রায়ই আসত ওরা। ওদের অনেক সুন্দর সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী এই জায়গা, অনেক স্মৃতি আছে এখানে। বেশ অনেকক্ষণ যাবত দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। দুজনের মধ্যেই অনেক কথা জমে আছে। কিন্তু কোন এক জড়তার জন্যে বলতে পারছেনা। সৌহার্দ্য তুর্বীর এমন ব্যবহারে বেশ অবাক হচ্ছে। যেই মেয়েটার মুখে সবসময় খই ফুটতো সে এত চুপচাপ কীকরে? তুর্বীর মধ্যে এই ইতস্তততা ব্যপারটা ঠিক মানতে পারছেনা সৌহার্দ্য। তাই একটু গলা ঝেড়ে নিজেই বলল,

” কিছু বলবে বলছিলে?”

সৌহার্দ্যর কথায় তুর্বীর ধ্যান ভাঙে। ও জিভ দিয়ে ঠোঁটে ভিজিয়ে নিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,

” আগে বল কী বলে ডাকব তোমাকে? সৌহার্দ্য রায়হান না-কি আর জে SR?”

সৌহার্দ্য চমকে তাকার তুর্বীর দিকে। সেটা দেখে তুর্বী ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। সৌহার্দ্য প্রচন্ড অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তুর্বী একইভাবে হেসে বলল,

” এতক্ষণ নাইনটি পার্সেন্ট শিওর ছিলাম। এখন হান্ড্রেট পার্সেন্ট শিওর হয়ে গেলাম সে তুমিই SR।”

সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” তুমি কীকরে জানলে?”

তুর্বী নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। তারপর চোখ তুলে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুমি আমাকে যখন SR কিডন্যাপ করেছিলো তারপর থেকে আমি রেগুলার তাঁর শো শুনতাম। ভালোলাগত আরজে SR এর কথাগুলো। তোমার সাথে কথার ধরণ কন্ঠের বেশ মিল পেলেও ব্যাপারটা কাকতলীয় হিসেবেই নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু যখন তুমি চলে গেলে আর ঠিক তারপরেই SR ‘প্রভাতের আলো’ শো টা করা বন্ধ করে দিল। প্রথম খটকা তখনই লাগে। এরপর কেন জানি সবকিছুই মেলাতে পারছিলাম। হঠাৎই অফিসে আমার মডেল এপ্রুভ হওয়া। তারপর অফিসে তোমার এন্ট্রি। আমায় দেখেও অবাক না হওয়া। সবটা মেলাতে পারছিলাম। আর অলমোস্ট শিওর হয়ে গেছিলাম তুমিই আর.জে. S.R.। তুমি চলে যাওয়ার পর বেশ কয়েকদিন হৈ চৈ হয়েছিল। এখনও তো অনেকেই অপেক্ষা করে আছে কবে তাদের আর জে SR আবার ‘প্রভাতের আলো’ হোস্ট করবে।”

সৌহার্দ্য একটু হেসে বলল,

” আর তুমি?”

তুর্বী শীতল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সৌহার্দ্যর দিকে। এরপর একটু হেসে বলল,

” একজন শ্রোতা হিসেবে অবশ্যই চাইব।”

সৌহার্দ্য স্হির দৃষ্টিতে তাকাল তুর্বীর দিকে। সে তো চেয়েছিল মনের মানুষ হিসেবে তুর্বী স‍ৌহার্দকে চাইবে। কিন্তু সেটা হয়তো কখনও হওয়ার নয়। এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। নিজেকে স্বাভাবিক করে সৌহার্দ্য বলল,

” তুমি খুব দরকারি কিছু বলবে বলছিলে। দু-বছর পর হঠাৎ কী হল? যে আমায় তোমার এতো প্রয়োজন? না-কি মন ঘুরে গেছে এখন?”

সৌহার্দ্যর শেষ কথাটায় তুর্বীর মনে লাগল। মাথা নামিয়ে হালকা তাচ্ছিল্যের হালকা হাসি হেসে বলল,

” খোঁচা দিচ্ছো?”

” একদমই না। আমার এতো সামর্থ্য কোথায়? তা হঠাৎ চাকরি ছেড়ে চলে গেলে যে?”

তুর্বী একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

” সিলেটে ভালো একটা জব ওফার ছিল। বেতন ভালো ছিল, জায়গাও সুন্দর ছিল তাই চলে গেলাম।”

সৌহার্দ্য শীতল দৃষ্টিতে তুর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

” এখন সিলেটেই থাকো তাহলে?”

” হুম।”

” একই পোস্ট?”

” সিনিয়র আর্কিটেক্ট।”

সৌহার্দ্য বেশ অবাক হল। তবে চোখেমুখে অবাক ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে বলল,

” হ্যাঁ এবার বল, কী বলছিলে?”

তুর্বী একটা লম্বা শ্বাস ফেলে ভাবল যে, না এখন কাজের কথায় আসতে হবে। এসব বাড়তি কথার আজ আর কোন মূল্য নেই। শুধুই সময় নষ্ট। তাই সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে ও বলল,

” বিহান কোথায় জানো?”

হঠাৎ বিহানের প্রসঙ্গ ওঠাতে চমকে উঠল সৌহার্দ্য। হঠাৎ এখানে বিহানের প্রসঙ্গ তোলার মানে বুঝল না। তাই ও অবাক হয়ে বলল,

” হঠাৎ বিহানের কথা বলছ?”

” জানো কোথায়?”

সৌহার্দ্য হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়ল। তুর্বী দুই হাত টেবিলের ওপর রেখে বলল,

” সৌহার্দ্য বিহান অন্যায় করেছিল ঠিকই। কিন্তু তুমি ওকে ছেড়ে এভাবে চলে না গেলেও পারতে। তুমি জানতে তুমি ছাড়া ওর পাশে কেউ ছিলোনা। ছেলেটা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল বলেই রিখুকে নিজে থেকে সবটা বলে ক্ষমা চেয়েছিল। হ্যাঁ ওর শাস্তি প্রাপ্য ছিল। তাই বলে তুমি ওর একমাত্র বাঁচার সম্বলটাই ওর থেকে কেড়ে নিলে? এটা কী লঘু পাপে গুরুদন্ড হয়নি?”

সৌহার্দ্য চোখ বন্ধ করে ফেলল। নিজের মনেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। তুর্বী এখনও মনে করে যে শুধুমাত্র বিহানের জন্যেই ও দেশ ছেড়েছিলো? কবে বুঝবে ওর তুর ওকে? একটুও কী বুঝতে পারেনা ? মনের কথা মনে রেখেই সৌহার্দ্য আফসোসের একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

” আমি জানি সেটা। আর যখন বুঝেছি তখন ওকে তো কোথাও খুঁজেও পাচ্ছিনা। কোথায় আছে কে জানে?”

” আমি জানি।”

তুর্বী হঠাৎ এমন কথায় চমকে উঠল সৌহার্দ্য। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তুর্বীর দিকে। তুর্বী বলল,

” হুম। জানি কোথায় আছে। বান্দরবান আছে এই মুহূর্তে ও।”

সৌহার্দ্য অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

” তুমি কীকরে জানলে?”

তুর্বী সৌহার্দ্যকে ওর বান্দরবানে ট্রেনিং এ যাওয়ার পরের ঘটনা সব খুলে বলল। সব শুনে সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বলল,

” হ্যাঁ কিন্তু। তুমি হঠাৎ আমাকে এসব বলতে কেন এলে?”

” কারণ সৌহার্দ্য, আমি বিহানের চোখে রিখুর জন্যে অসম্ভব ভালোবাসা দেখেছি।”

সৌহার্দ্য বেশ অবাক হয়ে বলল,

” কী?”

” হ্যাঁ। তুমি এখন বিহানকে দেখলে চমকে যাবে। এখন অনেকটা বদলে গেছে ও।”

কথাটা শুনে সৌহার্দ্য নিজের মনেই হাসল। বদলেতো তুর্বীও গেছে। কতটা বদলেছে হয়তো তুর্বী নিজেও অনুমান করতে পারছেনা। সৌহার্দ্য একটু নড়েচড়ে বসে বলল,

” তুমি কীভাবে জানলে?”

তুর্বী সৌহার্দ্যকে বিহানের পরিবর্তন, মেয়েদের সাথে না মেশা, রিখিয়ার ঐ পেন্টিং, বিহানের বলা কিছু কথা, সবটা বলল। সব শুনে সৌহার্দ্য নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। ওর ভাইটা এতোটা বদলে গেছে? পরিস্থিতি বিহানকে আবার বদলে দিল? তাও নতুনভাবে? এসব ভাবতে ভাবতেই তুর্বী বলল,

” এবার তুমিই ভাবো। ভালো না বাসলে কোন মেয়ের এতো নিখুঁত ছবি আঁকা যায়? কেউ এমন দেবদাস টাইপ হয়ে যায়? আর ওর বলা কথাগুলো?”

সৌহার্দ্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। সবার ভালোবাসা বুঝতে পারলেও সৌহার্দ্যর ভালোবাসাটা আজও কেন বোঝেনা তুর্বী? না-কি বুঝেও বুঝতে চায়না। সৌহার্দ্য তৃপ্তির হাসি বলল,

” বিহান প্রেমে পরেছে? আমার ভাই সত্যিই ভালোবাসতে শিখে গেছে? ভালোবাসার মানে বুঝতে পেরেছে?”

” হুম। আর সেইজন্যই আমি ঢাকা এসছি। আমি জানি চেষ্টা করলেই ওদের আবার এক করা সম্ভব। আমি রিখিয়াকে যতটুকু চিনি ও আজও বিহানকে ততটাই ভালোবাসে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রিখিয়া যদি এতদিনে বিয়ে করে ফেলে? ওদের গ্রাম আর পরিবারের যা অবস্থা, এটা অসম্ভব নয়।”

সৌহার্দ্য একটু হেসে বলল,

” চিন্তা করোনা। সেরকম কিছুই হয়নি। ওর বিয়ে হয়নি এখনও। আর তোমার ধারণা ঠিক। শী স্টিল লাভ বিহান সো মাচ।”

তুর্বী ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

” তুমি কীকরে জানলে?”

” আমি সেদিন ওদের গ্রামেই গেছিলাম একটা বিয়েতে। সেখানেই দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে।”

তুর্বী কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,

” কেমন আছে ও?”

” এমনিতে ভালো তবে মানসিক শান্তিতে নেই।”

তুর্বী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” আপনার ভাই হয় বিহান। ও যা করেছে তার শাস্তি ও পেয়ে গেছে। প্লিজ এবার সবটা ঠিক করে নিন। আর হ্যাঁ আমি চাই ওরা আবার একে ওপরের কাছে অাসুক। তোমার সাহায্য প্রয়োজন। করবেতো হেল্প?”

স‍ৌহার্দ্য গ্লাস ঘোরাতে ঘোরাতে একটু হেসে বলল,

” আমি সবসময়ই চাইতাম আমার ভাই সত্যিই মন থেকে কাউকে ভালোবাসুক। এমন কেউ ওর জীবনে আসুক যে ওকে সবটা দিয়ে ভালোবাসবে। ওর সব ক্ষত সাড়িয়ে দিয়ে ওকে স্বাভাবিক জীবন দেবে। আর রিখিয়ার চেয়ে ভালো ওর জন্যে কেউ হতেই পারেনা। তাই আমার ভাইয়ের জন্যে হলেও আমি সাহায্য করব।”

তুর্বী উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,

” গ্রেট! আপনি বান্দরবান গিয়ে বিহানকে নিয়ে আসুন। এদিকে আমি রিখিয়ার কাছে গিয়ে ওকে শহরে আনবো। এরপর দুজনকে একজায়গায় কথা বলাতে পারলে। বাকি যা হবার হয়ে যাবে। আর কিছু বাকি থাকলে আমরাতো আছিই।”

সৌহার্দ্য একটু হাসল। ব্যাপারটা এতোটাও ইজি না ও জানে। তবে প্রথম ধাপ এটাই ঠিক আছে। তাই তুর্বীকে বলল,

” ওর এড্রেসটা দিয়ে দাও আমাকে।”

তুর্বী ফোন হাতে নিয়ে বলল,

” নাম্বারটা বলুন আমি টেক্সট করে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ রিখিয়ার ঠিকানাটাও লাগবে আমার। আমি ওর গ্রামের নামটা জানলেও এক্সাক্ট লোকেশনটা জানিনা।”

এরপর দুজনেই ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করে একে ওপরকে ঠিকানা পাঠিয়ে দিল। স‍ৌহার্দ্য বলল,

” আমি কালকেই বান্দরবান যাচ্ছি। সময় নষ্ট করা ঠিক হবেনা।”

তুর্বী সম্মতি জানিয়ে বলল,

” আমিও কালই বেড়িয়ে পরব।”

” আর কিছু বলবে?”

” নাহ।”

সৌহার্দ্যর মনে আবারও অভিমান জমা বেঁধেছে। দুইবছর পর দেখা হল। তুর্বী নিজে থেকে কথা বলতে চাইল ঠিকই কিন্তু ওর বান্ধবী আর বিহানের জন্যে। ওর জন্যে না। ওকে আলাদা করে কিছুই বলার নেই তুর্বীর? থাকবেই বা কেন? তুর্বীর কাছেতো ও সবসময়ই শুধুমাত্র একটা এক্সপেরিমেন্টের বস্তু ছিল। এসব ভেবে সৌহার্দ্য এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” আমার এবার উঠতে হবে। দোলাকে বসিয়ে রেখে এসছি শপিংমলে। লাঞ্চের টাইম হয়ে যাচ্ছে। তুমি আসবে আমাদের সাথে লাঞ্চে?”

ঐ মেয়ের কথা শুনেই তুর্বীর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। মন খারাপ হয়ে গেল আবার। কিন্তু কেন নিজেও জানেনা। তাই নিচু কন্ঠে বলল,

” না, তোমরা যাও। এনজয় কর। আমার কাজ আছে।”

সৌহার্দ্য আর জিজ্ঞেস না করে বলল,

” ওকে, আমি আসছি। পরে কথা হবে।”

বলে সৌহার্দ্য চলে যেতে নিলেই তুর্বী বলে উঠল,

” ঐ মেয়েটা কে?”

সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,

” বাবা-মা আমার জন্যে ওকেই পছন্দ করেছে। ওনারা চান আমাদের বিয়ে হোক।”

তুর্বীর ভেতরে কেমন করে উঠল। ওর বুক কাঁপছে হঠাৎ। তবুও নিজেকে সামলে একটু হেসে বলল,

” ওহ। খুব ভালো মানিয়েছে তোমাদের একসাথে।”

সৌহার্দ্য কোন উত্তর না দিয়ে সাথেসাথেই হনহনে চলে গেল। মেজাজ প্রচন্ড বিগড়ে গেছে ওর। এই মেয়ের সৌহার্দ্যর অন্যকারো সাথে থাকা না থাকাতে আগেও কিছু যায়-আসেনি এখনও যায়-আসেনা। ও বিয়ে করে, বাসর করে, দুই-তিন বাচ্চার বাপ হয়ে গেলেও এই মেয়ের কোন কষ্টই হবেনা। উল্টে সেই বাচ্চাদের গাল টেনে দিয়ে বলবে ‘ অঅঅ কী কিউট! একদম তোমার মত হয়েছে সৌহার্দ্য।’ রিডিকিউলাস। কাকে ভালোবেসে পাগল হচ্ছে ও? ভাবলে নিজের মাথা নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করে।

তুর্বীর এবার বেশ খারাপ লাগছে। বাবা মায়ের পছন্দ করা মেয়ের সাথে এভাবে ঘুরতে বেড়িয়েছে? তার মানেতো একটাই যে সৌহার্দ্যও বিয়েতে রাজি। আর খুব শীঘ্রই বিয়েও হবে। কিন্তু তাতে ওর কী? বিয়ে হলেতো ভালো কথা। ছেলেটা আর কত একা থাকবে? কিন্তু ওর এতো খারাপ লাগছে কেন? এক অদ্ভুতরকম কষ্ট হচ্ছে। বুক ভার হয়ে আসছে। কই দু-বছর আগে যখন সৌহার্দ্যর পাশে অন্যকাউকে দেখতো, তখনতো এরকম লাগতো না? কষ্টও হতো না। তবে আজ এরকম লাগছে কেন? এতো অসহ্য লাগছে কেন সব?

#চলবে…

#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪২
.

রিখিয়াদের বাড়িতে আজ সবাই খুশি। বেশ খোশমেজাজে আছে সবাই। রিখিয়ার যে ভাই-ভাবি প্রায় বাড়িতে এসে এটা ওটা বলেছে, তাদের মুখ দিয়েও আজ মধু ঝড়ছে। রেজাউল ইসলাম, জাহানারাও আজ বেশ প্রসন্ন। মরার আগে নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ করে যেতে পারবেন, এরচেয়ে খুশির আর কী হতে পারে? সব বাবা-মাই নিজের সন্তানের সুখ চান। উনারাও তার ব্যাতিক্রম নন। রিখিয়া তাকিয়ে দেখছে নিজের পরিবারের মানুষের খুশি। এদের খুশির জন্যেই তো ওর ওর জীবনটাও দিয়ে দিতে পারে। বিয়েটা আর কী জিনিস? এতদিন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিলেও সেদিন যখন ওর ভাইয়া-ভাবি ওর বাবা-মাকে এসবের জন্যে দোষারোপ করা শুরু করল। তখন ও বেশ কষ্ট পেয়েছিল। ওর বাবার আহত দৃষ্টি ওর নজর এড়ায় নি। ওর জন্যে এখন ওর বাবা-মা কষ্ট পাচ্ছে সেটা মানতে পারেনি। শুধু ভাবছিল কী করবে। ঠিক সেই মুহূর্তেই শাফিন ওকে ঐসব কথা বল। শাফিনের চিন্তাধারা ওকে অবাক করেছিল। যদিও শাফিন মানুষ হিসেবে খারাপ নয় সেটা ও আগেও জানতো। সারারাত ভেবেছিল ও এই বিষয়ে। যে কারণে বিয়েতে ও রাজি ছিলোনা সেই সমস্যা তো শাফিন দূর করেই দিয়েছে। তাহলে বাবা-মাকে কষ্টে রেখে কী লাভ? হয়তো শাফিনকে ভালোবাসতে পারবেনা কিন্তু ভালো স্ত্রী হয়ে থাকতে অবশ্যই পারবে। এসব ভাবতে ভাবতেই কেউ ‘রিখু’ বলে ডেকে উঠল। রিখিয়া তাকিয়ে দেখে শাফিন দাঁড়িয়ে আছে। শাফিন মুচকি হেসে বলল,

” থ্যাংকস।”

রিখিয়া শাফিনের দিকে তাকিয়ে বলল,

” কেন?”

” বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্যে।”

রিখিয়া মলিন এক হাসি দিল। ও কেন রাজি হয়েছে শুধু ও-ই জানে। কিছু করার নেই এখন ওর আর। এখন শুধু মনপ্রাণ দিয়ে যতটা সম্ভব বিহানকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবে।

শাফিনরা আর রিখিয়া ভাই-ভাবি চলে যাওয়ার পর বাড়িটা ফাঁকা হল খানিকটা। বিকেল হয়ে গেছে। রিখিয়া এমনিতে বেশ ক্লান্ত লাগছে। ভাবল এখন যখন কাজ নেই তখন বিছানায় একটু গা এলিয়ে দেবে। তাই উঠোন থেকে ঘরে যেতে নিলেই পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল,

” রিখু!”

রিখিয়া থমকে গেল। কারণ কন্ঠটা ওর খুব কাছের কারো। পেছনে ঘুরে তাকাতে ভয় করছে। যদি এটা ওর ভ্রম হয়? যদি মিথ্যা হয়। তাহলে আবার মন খারাপ হয়ে যাবে ওর। এসব ভাবতে ভাবতে সে আবারও ডেকে উঠল,

” রিখু।”

রিখিয়া আবারও নড়ে উঠল। একটা ঢোক গিলে লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। তারপর আস্তে আস্তে পেছন ফিরে তাকিয়ে চমকে উঠল ও। নিজের চোখকে বিশ্বাস সত্যিই ওর সামনে তুর্বী দাঁড়িয়ে আছে। রিখিয়া যেন জমে গেল। দু-বছর পর হঠাৎ এভাবে তুর্বীকে দেখতে পারবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি। ও রোজ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত যাতে শুধুমাত্র একটাবার যাতে ওর তুরের দেখা পায়। আজ সত্যিই তুর্বী ওর সামনে আছে। অবাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। গলা দিয়ে কোন আওয়াজই বেড় হচ্ছে না। চোখে পানি জমা হচ্ছে ধীরে ধীরে। তুর্বীও স্হির চোখে দেখছে রিখিয়াকে। আজ কতদিন পর এই মুখটা দেখল। নিজের বোনের চেয়েও বেশি আপন এই মেয়েটার কাছ থেকে কীভাবে এতদিন নিজেকে দূরে রেখেছিল শুধু ওই জানে। বুকের মধ্যে করে উঠছে। ও আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বলল,

” কী? একেতো ওভাবে চলে এসছিলি। আজ আমি যখন নিজে থেকে এতো কষ্ট করে এতটা পথ পার করে এলাম। এতোদিন পর দেখা হল আর তুই কিছুই বলছিস না! আমি কী এতোটা খারাপ? চলে যাবো?”

কথাটা বলতে না বলতেই রিখিয়া অস্ফুট স্বরে একবার ‘তুর’ বলে জাপটে ধরল তুর্বীকে। এতক্ষণ চোখে জমে থাকা জলগুলো ছেড়ে দিল। তুর্বী এতক্ষণ ধরে অনেক কষ্টে নিজের আবেগ কে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল ঠিকই কিন্তু এখন ওরও কান্না পাচ্ছে। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজের কান্না আটকে, চোখের কোণে জমা জল মুছে রিখিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,

” একদম ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদবি না। কী হয়েছে? এমনভাবে কাঁদছিস যেন মরে গেছি আমি।”

রিখিয়া তুর্বীকে ছেড়ে দিয়ে নাকে নাক টেনে বলল,

” থাপ্পড় খাবে কিন্তু। এতোদিন পর এসেও এসব কথা বলছো? কোথায় ছিলে তুমি? এভাবে হুট করে জব ছেড়ে চলে যায়? আমি চলে এসছিলাম তাও তো তুমি জানতে আমি কোথায়। কিন্তু তুমিতো কিচ্ছু না জানিয়ে ভ্যানিস হয়ে গেলে। ঢাকাও গিয়েছিলাম তোমাকে খুঁজতে। কিন্তু পাইনি। আর আজ তোমার মনে হল এসে আমার সাথে একবার দেখা করা উচিত? এরকম করে কেউ?”

তুর্বী মুখ ফুলিয়ে বলল,

” তো কী করব? খুব তো একা ফেলে চলে এসছিলি অামাকে। আমার অভিমান হয়না না-কি?”

আবার দুজন দুজনকে আবারও জড়িয়ে ধরে হেসে ফেলল। একে ওপরের প্রাণ ওরা। টানা দুটো বছর আলাদা কীকরে থেকেছে শুধু ওরাই জানে। আজ এতোদিন পর নিজের প্রিয় বন্ধুকে ফিরে পেয়েছে এরচেয়ে বেশি খুশির কী হতে পারে।

রিখিয়ার বিছানায় পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে বসে আছে তুর্বী আর রিখিয়া। রিখিয়ার মনটা এখন অনেকটাই ফুরফুরে। এতোদিনের মন খারাপ কিছুটা হলেও কেটেছে। টুকিটাকি গল্প করছে দুজনে। এতোদিনের বিভিন্ন ঘটানা নিয়ে আলোচনা করছে। রিখিয়া বেশ অবাক হয়ে বলল,

” সৌহার্দ্যই তাহলে আরজে এস আর ছিলেন?”

তুর্বী হেসে দিয়ে বলল,

” ভাব! এতমাস একসাথে থেকেই টের পাইনি।”

” সেটাই! আমারও অদ্ভুত লাগছে। তুমি তাহলে এতোদিন সিলেট ছিলে?”

” হুম। তোর এখানকার জব কেমন চলছে?”

” ভালো।”

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর তুর্বী শীতল দৃষ্টিতে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” বিহানকে মিস করিস?”

রিখিয়া হালকা কেঁপে উঠল। কিন্তু সাথেসাথেই নিজের চোখেমুখে ফুটে ওঠা বেদনাকে কাটিয়ে নিয়ে, নিজেকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক করে বলল,

” ছাড়ো এসব কথা। অতীত নিয়ে ভাবতে চাইনা আমি।”

” কিন্তু…”

এরমধ্যেই জাহানারা ট্রে তে করে চা আর নুডুলস নিয়ে এলেন। ওনাকে দেখে ওরা দুজনে থেমে গেল। জাহানারা নুডুলসের বাটি ওদের হাতে দিতে দিতে বললেন,

” তোমার কথা রিখিয়া প্রায়ই বলে। মাঝখানে না-কি উধাও হয়ে গেছিলে। যাই হোক, এবার ভালো সময়ে এসব। শুভ কাজ শেষ হওয়ার আগে কিন্তু যাওয়া যাবেনা। বিয়ে পর্যন্ত থাকতে হবে।”

তুর্বী হাসি মুখে নুডলস নাড়তে নাড়তে বলল,

” কার বিয়ে? ”

জাহানারা অবাক হয়ে বল‍লেন,

” সে-কী? রিখিয়া তোমাকে বলেনি? রিখিয়ার তো বিয়ে ঠিক হয়েছে। পনেরো দিন পরেই বিয়ে। আমাদের এম.পি. সাহেবের ছেলে শাফিনের সাথে।”

তুর্বী বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে জাহানারার দিকে তাকাল। কী শুনছে এসব? বিখিয়া বিয়ে করছে? অবাক রিখিয়ার দিকে তাকাতেই রিখিয়া চোখ নামিয়ে নিল। এখনই বিয়েটা ঠিক হওয়ার ছিল? এখন তীরে এসে তরী ঢুববে না তো?

____________

ড্রয়িংরুমের বড় সোফাটায় বিহান মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। তারপাশে সিঙ্গেল সোফাটায় বসে সৌহার্দ্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। এতক্ষণ ফরিদও ছিল ওখানে কিন্তু পরে চলে গেছে। এখন ফ্লাটে শুধু বিহান আর সৌহার্দ্যই আছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছেনা।

বিহান ফরিদের সিথে বসে ওদের পরবর্তী কোন ক্রেতা পেন্টিং নিতে আসবে সেটা নিয়ে আলোচনা করছিল। তখনই বেল বেজে ওঠে। এসময় কারো আসার কথা না তাই দুজনেই অবাক হল। ফরিদ রং ঢালছিল টিউবে তাই বিহানই উঠে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে যা দেখল তাতে ও স্হির হয়ে গেল। ওর সামনে সেই মানুষটাই দাঁড়িয়ে আছে যাকে দেখার জন্যে দুই দুইটা বছর ধরে ও মনেমনে ছটফট করছে। ওর জীবনের বেঁচে থাকার একমাত্র ভিত্তি ছিল এই মানুষটা। হ্যাঁ সৌহার্দ্যই দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। এতগুলো দিন পর ওকে নিজের সামনে দেখে অনুভূতি শূণ্য হয়ে গেল ও। শুধু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সৌহার্দ্যর ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলে আছে কিন্তু চোখ ছলছল করছে। ওর আদরের ভাইটাকে এতোদিন পর নিজের কাছে পেয়ে ইচ্ছে করছে জাপটে ধরতে। কিন্তু কেন যেন পারছেনা। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। তবুও অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” ভেতরে আসতে দিবিনা?”

বিহানের চোখমুখ লালচে হয়ে গেছে। অনেকটা অনুভূতিহীন ভাবেই দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ভেতরে গিয়ে সোফায় বসে পরল। সৌহার্দ্য আস্তে আস্তে গিয়ে সামনাসামনি সোফাটায় বসল। বিহান একদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্যও কিছু না বলে বসে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। ফরিদ অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল দুজনের দিকে। পরে বুঝতে পেরেছিল যে ওরা হয়ত কাছের কেউ। তাই এদের মধ্যে থাকাটা ঠিক হবেনা চিন্তা করে ফরিদ বেড়িয়ে গেছে।

বেশ অনেক্ষণ হলো দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। বিহানতো সৌহার্দ্যকে দেখেই খুশি হয়ে গেছিল। জড়িয়েও ধরত। কিন্তু হঠাৎ আগের কিছু কথা মনে পরাতে থেমে গেছিল। নিরবতা ভেঙে বিহান নিজেই ধীর গলায় বলল,

” আমার এড্রেস কোথায় পেলে?”

সৌহার্দ্য বিহানের মুখে ‘তুমি’ শুনেও রিঅ্যাক্ট করল না। স্বাভাবিকভাবে বলল,

” তুর্বী দিয়েছে।”

বিহান একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,

” তুর্বীর সাথে দেখা হয়েছে তোর?”

” হুম হয়েছে।”

বিহান আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” হঠাৎ আমার মত একটা রেপিস্টের সাথে দেখা করার ইচ্ছা হল যে?”

সৌহার্দ্য এতক্ষণ শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,

” আরেকবার তোর মুখ দিয়ে এই শব্দটা বেড় হলে আই সোয়ার তুই আজ আবার আমার হাতে চড় খাবি কিন্তু।”

বিহান কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিল। সৌহার্দ্য উঠে গিয়ে বিহানের পাশে গিয়ে বসল। এরপর হাত ধরে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,

” সমস্যা কী তোর? হ্যাঁ। মানছি সেদিন রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলেছি। তাই বল আজও সেসব কথা মনে রাখবি? শুধু আমার ঐ একদিনের বলা কথাগুলোই মনে রাখবি। আর আমার এতো বছরের দেওয়া ভালোবাসা? সেগুলো কিচ্ছু না?”

বিহানের গলা কাঁপছে, চোখ টলমল করছে এখন। ও আটকে যাওয়া কন্ঠে বলল,

” হ্যাঁ খুব ভালোবাসা দেখিয়েছেন আপনি। তাইতো দুটো বছর বিদেশে কাটিয়ে দিয়ে এসছেন। এখানে যে বিহান নামে একটা ভাই আছে আপনার। সে বেঁচে আছে না-কি মরে গেছে সেটা জেনে আপনি কী করবেন?”

সৌহার্দ্য হালকা হেসে তাকাল বিহানের দিকে। তারপর বলল,

” সরি! সত্যিই ভুল হয়ে গেছে। দেশ ছেড়ে যাওয়াটা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমিতো কতসময় তোর কত ভুল ক্ষমা করে দিয়েছি। কত দোষ ঢেকেছি। আমার একটা ভুল ক্ষমা করা যায় না?”

বিহান কোন রিঅ্যাক্ট না করে এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য বলল,

” তুই যখন চাসই না আমি এখানে থাকি তাহলে আর আমি কেন থাকব? চলে যাচ্ছি তাহলে।”

কথাটা বলে উঠতে নিলেই বিহান সৌহার্দ্যর হাত ধরে ফেলল। কিছুক্ষণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জোরে জড়িয়ে ধরল সৌহার্দ্যকে। কান্নামাখা গলায় বলল,

” প্লিজ আমাকে ছেড়ে আর যাস না ব্রো। আমি আর নিতে পারব না। প্রচন্ড কষ্ট হয়। আমিও তো মানুষ বল। দরকারে রোজ মারিস আমাকে। আমি কিচ্ছু বলব না। তবুও আমাকে ছেড়ে আর যাসনা, প্লিজ।”

সৌহার্দ্য চোখে জল চলে এল। ও দুহাতে বিহানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

#চলবে…

[ রি-চেইক করিনি। তাই ভুলত্রুটিগুলো বুঝে নেবেন।]