#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৫
.
রিখিয়া চোখ খোলার সাহস পাচ্ছেনা। যদি কেঁদে দেয়? যদি নিজেকে সামলাতে না পারে? ও ওপর দিয়ে নিজেকে যতই শক্ত দেখাক। ভেতর ভেতর তো ও আজও বিহানের প্রতি ততোটাই দুর্বল। মানুষ চেষ্টা করে বড়জোর নিজের বাইরেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও নিজের মনের ভেতরের অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। ও-ও পারবে না। তবুও অনেকটা সাহস নিয়ে চোখ খুলে তাকাল। কিন্তু না, ও কাঁদল না। ওর ভেতরের যন্ত্রণা, কষ্ট, অভিমান কোনটাই অশ্রু হয়ে ঝড়ে পরল না। রিখিয়া একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল,
” কিছু বলবেন?”
বিহান কয়েক মুহূর্ত মৌন রইল। এরপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” কেমন আছো?”
রিখিয়া একটু হাসল। সেই হাসিতে যে তাচ্ছিল্য মিশে ছিল সেটা বিহান স্পষ্ট বুঝেছে। ওর বুকে তীরের মত বিদ্ধ হল রিখিয়ার সেই হাসি। রিখিয়া বলল,
” আমি ভালো আছি। খারাপ থাকার তো কারণ নেই। আপনি কেমন আছেন?”
বিহান নিজের একত্রিত করে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” আছি।”
আবারও অনেকটা সময় নিরবতায় কাটল। হঠাৎই রিখিয়া হন্তদন্ত হয়ে বলল,
” তুর এখনও আসছেনা। আমি গিয়ে দেখছি তুর কোথায় আছে।”
বলে উঠতে নিলেই বিহান বলে উঠল,
” রিখিয়া, তুমিও বুঝতে পেরেছ আর আমিও বুঝতে পেরেছি যে ওরা কেন আমাদের এখানে একা ছেড়ে গেছে।”
রিখিয়া কিছু না বলে বসে পরল। হ্যাঁ ওরা দুজনেই বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। কিন্তু কি-বা করার? ওদের মধ্যে কী আদোও আর কিছু ঠিক হওয়া সম্ভব? বিহান অনেকক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
” আমাকে কী সত্যিই ক্ষমা করতে পেরেছিলে রিখিয়া?”
রিখিয়া বিহানের এমন প্রশ্ন শুনে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। ওর সেই চাহনীতে কিছু একটা ছিল, সেটা কী তা বিহান বুঝতে পারল না। রিখিয়া ওভাবে তাকিয়ে থেকেই বলল,
” আমি অন্যদের মত মনে আর মুখে আলাদা কথা নিয়ে চলিনা। যেটা মনে থাকে সেটাই মুখে বলি। আমি যখন মুখে বলেছি সেই ঘটনার জন্যে আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তারমানে সত্যিই আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।”
অন্যদের বলতে যে রিখিয়া বিহানকেই বুঝিয়েছে সেটা বুঝতে বিহানের সময় লাগেনি। কিন্তু ও কিছুই মনে করল না। হয়তো এটাই ওর প্রাপ্য ছিল। অনেক বড় অন্যায় করেছিল মেয়েটার সাথে ও। তার তুলনায় এই সামান্য দুই একটা কথা কিছুই না। বিহান বলল,
” তাহলে কী আমরা আগের মত বন্ধু হতে পারিনা? আগের মত স্বাভাবিক হতে পারিনা?”
রিখিয়া আবারও শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল বিহানের দিকে। সত্যিই কী আগের মত স্বাভাবিক হতে পারবে ওরা? চাইলেই কী সবটা স্বাভাবিক করা যায়? রিখিয়া অনেকটা খোঁচা মেরেই বিহানকে বলল,
” আগের মত বলতে একসাথে ঘোরা, খাওয়া, সময় কাটানো? কিন্তু এগুলো আপনার স্ত্রী মেনে নেবে? উনি নিশ্চয়ই চাইবেন না তার স্বামী অন্যকোন মেয়ের সাথে ঘোরাফেরা করুক। উনি আপত্তি করবেন না?”
বিহান একটু হাসল। রিখিয়া যে খোঁচা মেরে কথা বলতেও শিখে গেছে সেটা খারাপ লাগল না ওর। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মুচকি হেসে বলল,
” আপত্তি করার মত কেউ নেই আমার জীবনে। আর স্ত্রীর কথা বলছ? সেও নেই।”
রিখিয়া মনে মনে বেশ অবাক হল। বিহান তাহলে এখনও বিয়ে করেনি? কিন্তু ওর সেই মনোভাব প্রকাশ না করে বিদ্রুপ করে বলল,
” ও, বিয়ে করেন নি তাহলে? দুদিও পরপরই গার্লফ্রেন্ড বদলাতে পারলে আর বিয়ের কী প্রয়োজন পরে, তাইনা?”
বিহান কিছু বলল না একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বসে রইল। রিখিয়াও মাথা নিচু করে আছে। বিহানকে এতো কড়া কড়া কথা বলার ইচ্ছা ছিলোনা ওর। কিন্তু কেন জানি নিজেকে সামলে রাখতে পারছেনা। ভেতরের সমস্ত ক্ষোভ আর অভিমান সব কড়া কথা হয়ে বেড়িয়ে আসছে।
____________
চেয়ারে হেলান দিয়ে ভ্রু কুচকে বিপরীত পাসে বসে থাকা মানুষদুটির দিকে তাকিয়ে আছে তুর্বী। ওর চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও কতটা বিরক্ত। কিন্তু সৌহার্দ্য আর দোলার সেদিকে খেয়াল নেই ওরা নিজের মত করে আলোচনা করছে আর কোল্ডকফি খাচ্ছে। এখানে আরেকটা জলজ্যান্ত মেয়ে বসে আছে সেদিকে ওদের খেয়াল নেই। পার্ক থেকে বেড়িয়ে ওরা শপিংমলে ঢুকেছিল। সৌহার্দ্য একপ্রকার জোর করেই দোলাকে পার্স কিনে দিয়েছে। দোলা বলেছিল ওর লাগবে না। কিন্তু সৌহার্দ্য বলল, ‘বলে যখন ফেলেছি তখন কিনে দিতে সমস্যা কোথায়?’ তুর্বী শুধু হাত ভাজ করে দেখছিল এদের তামাশা। দোলা মেয়েটা প্রচন্ড বাচাল প্রকৃতির, সৌহার্দ্যর সাথে সারাক্ষণ বকবক করেই চলেছে। আর তুর্বী শুধু হাটছিল ওদের সাথে। নিজেকে এলিয়েন এলিয়েন লাগছিল ওর। আর এখন রেস্টুরেন্টে এসেও দুজনেই বকবক করে যাচ্ছে। তুর্বীর ইচ্ছে করছে দু-জনের মাথাতেই কোল্ড কফি ঢেলে দিতে। কিন্তু সেটা করতে পারছেনা। হঠাৎ সৌহার্দ্যর মনে হল তুর্বী চুপচাপ বসে আছে। আর সেটা শুরু থেকেই। ও একটু অবাক হল। ওর মত মেয়ে এতক্ষণ এতোটা চুপচাপ কীকরে? তুর্বীর মধ্যে বদল ঘটেছে ও জানতো তাই বলে এতোটা?ও তুর্বীর দিকে তাকিয়ে দেখল ও কফিও খাচ্ছেনা। সৌহার্দ্য বলল,
” কী ব্যাপার? চুপচাপ বসে আছো? কফিটাও খাচ্ছোনা যে?”
তুর্বী সোজা হয়ে বসে একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল,
” যাক, আপনার মনে আছে তাহলে যে এখানে আমিও আছি?”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে ফেলে বলল,
” মানে?”
তুর্বী টেবিলের ওপর শব্দ করে দুই হাত রেখে বলল,
” মানে, আমি এতোদূর একটা ইম্পর্টেন্ট কাজে এসছি। সেই কাজটা হচ্ছে কি-না সেটা নিয়ে আমি যথেষ্ট চিন্তিত আছি এইমুহূর্তে। আপনাদের এই খোশগল্পে পার্টিসিপেট করার মুড বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই।”
দোলা ভ্রু কুচকে বলল,
” তুমি এতো রেগে যাচ্ছো কেন? আর ওদেরই বা ওখানে একা রেখে এলাম কেন? ওদের কী রিলেশন ছিল? এখন ঝগড়া হয়েছে?”
তুর্বী আবারও মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
” অনেক লম্বা কাহিনী। রামায়ন ডেডক্রাইব করার সময় এখন নেই। পরে তোমার হবু বরের কাছে পুরোটা শুনে নিও।”
দোলা বোকার মত একবার তুর্বী একবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল। সৌহার্দ্য অবাক হয়ে দেখছে তুর্বীকে। তুর্বীকে সবসময় প্রাণচ্ছল আর চঞ্চল রূপেই দেখেছে ও। কিন্তু এতো গম্ভীর আর রাগী রূপে দেখে ওর ভালো লাগছে না। তুর্বী বুঝতে পারশ যে একটু বেশিই অদ্ভুত ব্যবহার করে ফেলেছে। তাই কথা ঘোরাতে বলল,
” আচ্ছা তোমাদের বিয়েটা কবে?”
দোলা ওদের সম্পর্কে কিছুই জানেনা। আর আপাতত সবাইকে এটাই বলতে হবে যে ওদের বিয়ের কথা চলছে। তাই ও হেসে বলল,
” এখনও ডেট ফিক্সড হয়নি। সবে কথা চলছে বিয়ের। তবে শীঘ্রই হবে।”
তুর্বী মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল,
” ও আচ্ছা। কনগ্রাচুলেশনস টু বোথ অফ ইউ।”
সৌহার্দ্য সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। ওর বিয়ের কথা শুনে তুর্বীর রিঅ্যাকশন টা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু বরাবরের মত এবারেও ব্যর্থ হল তুর্বীর মনের মধ্যে কী চলছে সেটা বুঝতে। হয়তো নিজের অনুভূতিতে অপ্রকাশিত রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তুর্বীর মধ্যে। তুর্বীর ভেতরে অস্হির লাগছে। সৌহার্দ্যর বিয়ে হয়ে যাবে ব্যাপারটা কেন যেন মানতে পারছেনা ও। কেন পারছেনা সেটা ওও জানেনা। সবকিছুই বিরক্ত লাগছে। এরকম ওর অনুভূতি এর আগে ওর কোনদিন হয়নি।
___________
রিখিয়া আর বিহান পার্কের সরু রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাটছে। কিন্তু কেউ কিছুই বলছেনা। দুজনেই নিরব। কিছুক্ষণ পর বিহান আড়চোখে রিখিয়াকে দেখলেও রিখিয়া তাকায়নি বিহানের দিকে। নিরবতা ভেঙ্গে বিহান বলল,
” রিখিয়া?”
রিখিয়া একটু হকচকিয়ে গেল হঠাৎ ডাকে। দ্রুতই নিজেকে সামলে বলল,
” হুম?”
বিহান অপরাধী কন্ঠে বলল,
” তুমি কী আমাকে এখনও ক্ষমা করতে পারোনি?”
রিখিয়ার সত্যিই এবার একটু মায়া হল। ছেলেটা দু-বছর নিজের ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে থেকেছে। যাকে ছাড়া ও একদিনও ঠিককরে থাকতে পারতোনা। এরপরও ওর মনে হয় বিহানের ভেতরে সুপ্ত আরও অনেক কষ্ট আছে। আর অনুতাপের চেয়ে বড় শাস্তি হতে পারেনা। আজ ও বিহানের মধ্যে তীব্র অনুতপ্ততা দেখেছে। তাছাড়াও যা হয়েছে সেটাকে তো আর বদলানো যাবেনা। তাই রিখিয়া বলল,
” আমি সত্যিই আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি, অনেক আগেই। প্লিজ এসব নিয়ে ভাববেন না।”
বিহান মুখটা ছোট করে রেখেই বলল,
” তাহলে এভাবে চুপ করে আছো কেন?”
রিখিয়া একটু হেসে বলল,
” আমিতো বরাবরই চুপ থাকি। বকবক করে আমার কানার মাথাতো আপনি খেতেন। কিন্তু সেই আপনি এতো ভদ্র, শান্ত। আবার কথাও কম বলছেন কীকরে?
বিহান একটু হাসল। কিন্তু কিছুই বলল না। রিখিয়া তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। অনেকক্ষণ যাবতই ও সেই ছটফটে, দুষ্টু, হৈ চৈ করে মাতিয়ে রাখা বিহানকে খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছেনা। কেমন শান্ত, স্হির হয়ে গেছে ছেলেটা। সত্যি বলতে রিখিয়া একসময় এরকম শান্ত, স্হির ছেলেদেরই পছন্দ করত। কিন্তু কীকরে যে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের বিহান নামক এই পুরুষের প্রেমে পরে গেল নিজেই জানেনা। কিন্তু আজ বিহানকে ওর মনের মত চরিত্রে দেখেও ওর ভালো লাগছেনা। ওর তো সেই বাদর ছেলেটাকেই পছন্দ। রিখিয়া এবার নিজেই বলল,
” তো? পেন্টিং করা হয় এখনও?”
বিহান মাথা নিচু করে ঠোঁটে বাঁকিয়ে হেসে বলল,
” ঐ গুনটুকুই তো আছে। ওটা ছাড়া আর কী করব?”
রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে কৌতূহলী কন্ঠে বলল,
” এখন নেশা করেন?”
বিহান আবার হাসল। হাসতে হাসতে বলল,
” ঐ একটা জিনিসই আছে যেটা কখনও আমায় ছেড়ে যায়না। তাহলে আমি কীকরে ছেড়ে দেই বল?”
রিখিয়া একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলল। সবই বদলেছে। কিন্তু যেটা সত্যি সত্যি বদলানোর দরকার ছিল সেটাই এখনো ধরে রেখেছে এই ছেলে। এবার বিহান বলল,
” এরপর আর কখনও কাউকে ভালোবেসেছিলে?”
কথাটা শুনে রিখিয়ার মুখের হাসি আবার মিলিয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে বলল,
” আর কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনি। বিশ্বাস জিনিসটাই এমন। একবার ভেঙ্গে গেল আবার সেটা জোড়া লাগানোটা খুভ বেশিই কঠিন।”
বিহান লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” আমি হয়তো তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় অপরাধী তাইনা রিখিয়া?”
রিখিয়া হাতের নখ ঘষতে ঘষতে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,
” নাহ। হয়তো এটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিল।”
বিহান রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
” তাতে আমার দ্বায়টা তো কমে যাচ্ছেনা।”
রিখিয়ার এবার বিহানের চোখে চোখ রেখে বলল,
” আচ্ছা তাহলে দ্বায়ভার নিতে কী করতে পারবেন আপনি?”
রিখিয়ার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারল না বিহান। কীকরে দেবে? যদি রিখিয়া বিবাহিত হয়? তাহলে ও নিজের মনের ভালোবাসাটা প্রকাশ করলে মেয়েটা আরও কষ্ট পাবে। তখন আর মনকে মানাতে পারবেনা রিখিয়া। এতে ওর মানসিক অবস্থা খারাপ হওয়ার সাথে সাথে বৈবাহিক জীবনেও খারাপ প্রভাব পরবে। দ্বিতীয়বার আর ওকে আঘাত করতে পারবে না বিহান। আর এখন তো একদমই না। খুব বেশি ভালোবাসে মেয়েটাকে ও। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে রিখিয়া বিয়ে করেনি। কথাটা ভাবতেই বিহান দ্রুত রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুমি বিয়ে করেছো রিখিয়া?”
রিখিয়া বিহানের এমন প্রশ্নে অবাক হল। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই না বোধক মাথা নাড়ল। বিহানের চোখমুখ উজ্জ্বল হল। ও কিছু বলতে নেবে তার আগেই রিখিয়া বলল,
” তবে বিয়ে ঠিক হয়েছে। তেরো তারিখে। কার্ডও চলে আসবে কাল পরশু। আপনাকে আর সৌহার্দ্যকে কার্ড পাঠিয়ে দেব। চলে আসবেন।”
কিছুক্ষণ আগে যে উজ্জ্বল আলোর রেখা দেখা দিয়েছিল ঘনকালো মেঘে তা নিমেষেই ঢেকে গেল। বিহানের হৃদয় আবারও গুড়িয়ে গেল। ও অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে রইল রিখিয়ার দিকে। ওদের সাথেই এমনটা কেন হয়? যখনই একটু সুখের খোঁজে বেড় হয়। অনেক কষ্টে সেই সুখটা চোখে পরলেও, ছুঁতে গেলেই সেটা উড়ে যায়। অনেক দূরে চলে যায়। ঠিক জল-ফড়িঙের মত। যেটা ওরা খুঁজেই যায় কিন্তু হাতে ধরা দেয়না।
#চলবে….
#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৬
.
রাতের অন্ধকার আকাশে ঘনকালো মেঘ যমে আকাশকে আরও অন্ধকার করে দিয়েছে। হালকা শো শো বাতাস বইছে। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রাতে বৃষ্টি নামবে। জৈষ্ঠ্য মাসের তীব্র গরমে আজ সারাটাদিন পার হয়েছে। সকলের অবস্থাই আজ নাজেহাল। তাই বোধহয় প্রকৃতি একটু সদয় হয়ে বৃষ্টি ঝড়িয়ে সবাইকে সিগ্ধ শীতলতা দেবে। ছাদের এককোণে পা ঝুলিয়ে বসে আছে বিহান আর সৌহার্দ্য। দুজনেই চুপচাপ বসে আছে, দুজনের মনই খারাপ হয়ে আছে। গোমড়া মুখ করে বসে আছে দুজনেই। বিহান মদের বোতলে চুমুকের পর চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। সৌহার্দ্য এতক্ষণ বারণ করেনি ঠিকই। কিন্তু এখন বেশি হয়ে যাচ্ছে তাই হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” বিহান, এবার থাম। অনেক হয়েছে।”
বিহান ঠোঁট বাকিয়ে গা দুলিয়ে হাসল। কিন্তু কিছুই না বলে আবারও বোতলে চুমুক দিতে গেলে সৌহার্দ্য হাত ধরে ফেলে বলল,
” বিহান প্লিজ। ইটস টু মাচ।”
বিহান বোতলট সাইডে রেখে দিয়ে মাতাল কন্ঠে বলল,
” আমি সত্যিই খুব খারাপ তাইনা ব্রো? তুই-ই দেখ আমার বাবা-মা আমার মুখও দেখতে চায়না। যেই মামু আমাকে বুকে জড়িয়ে বড় করেছে, মানুষ করেছে। সেই মামু আমাকে সহ্য করতেই পারেনা। জীবনে একটা মেয়ে এলো যে আমাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে। ইনফ্যাক্ট আমি ওকে এতোটা কষ্ট দেওয়ার পরেও ও এখনো আমায় ভালোবাসে। ও মুখে না বললেও আমি বুঝি সেটা। আজ ওর চোখের ভাষা অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারি আমি। কিন্তু আমি আমার দোষে সেই ভালোবাসাটাও হারিয়ে ফেললাম। কদিন পর ও অন্যকারো হয়ে যাবে। আমার রিখিয়া অন্যকারো হয়ে যাবে। তুই-ই বল সবাই আমার থেকে দূরে কেন চলে যায়। সবাই ভূল আমি ঠিক এটাতো হতে পারেনা তাইনা? আমি মানুষটাই খারাপ। তাই আমার সাথে থাকা কারো পক্ষে সম্ভব হয়না। জঘন্য মানুষ আমি।”
এরপর পিটপিটে চোখে সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল। সৌহার্দ্য বিহানেল কাঁধে হাত রেখে বলল,
” তুই যখন নিখোঁজ হয়ে গেছিলি। তখন তোর মামু প্রায় আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করত তোর কোন খোঁজ পেয়েছি কি-না। ফুপা-ফুপির সাথে আমি কথা বলতাম না। কিন্তু ওনারাও তোর খোঁজ করতো। তোর প্রতি রাগ, অভিমানে তোকে দূরে সরিয়ে রাখলেও আজও তোকে ওনারা ততটাই ভালোবাসে।”
বিহান টলমলে চোখে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলল,
” একটু বিশ্বাস করতে পারল না?”
বিহানের এমন অসহায় গলা সৌহার্দ্যকে আহত করল। বিহান ড্রাংক তাই এভাবে বলছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ও ওর পরিবারের প্রতি ক্ষোভ বা দুর্বলতা কোনটাই প্রকাশ করেনা বহুবছর যাবত। ও বিহানের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে ওকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
” পরিস্থিতি একটা হলেও। তার প্রভাব সবার ওপর একরকম পরেনা। ওনাদের দিক দিয়ে ভাবলে এরকম করাটা খুব বেশি অস্বাভাবিক না। ব্যাপারটাই এভাবে সাজানো ছিল।”
বিহান কিছুই বলল না। সৌহার্দ্য জানে ও পুরোপুরি ঠিক বলছে না। দোষ হোক বা ভুল বিহানের বাবা-মারও কম নেই। কিন্তু বিহানের সামনে এসব বললে ওর মনে পরিবারের প্রতি ক্ষোভ আরও বাড়বে। বিহান ভাঙা গলায় বলল,
” ব্রো, তুই জানতি তাইনা রিখিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”
সৌহার্দ্য গম্বীর স্বরে বলল,
” হুম জানতাম।”
” তবুও কেন নিয়ে গেলি ওর কাছে? আমিতো নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। মনকে বুঝিয়ে নিয়েছিলাম ও সুখে আছে, ভালো আছে। কিন্তু আজ রিখিয়াকে দেখে আমার সবটা এলোমেলো হয়ে গেছে। ওর আমার প্রতি আজও এতোটা ভালোবাসা দেখে আমি অস্হির হয়ে উঠেছি। আমি এখন আর নিজেকে সামলাতে পারছিনা। আমার কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে।”
সৌহার্দ্য দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে বলল,
” ওকে বললি না কেন তোর ভালোবাসার কথা? হয়তো সব ঠিক হতোনা।”
বিহান চোখ বুজে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
” ঠিক হতোনা ব্রো। আমি চিনি ওকে। ওর কাছে থেকে যতটা না চিনেছি, ওর থেকে দূরে গিয়ে আর ভালোকরে চিনেছি। বিয়ের আর বারোদিন আছে। ও নিজের কথা কখন-ই ভাবেনা। ও ওর দুই পরিবারের সম্মানের জন্যে, ওর হবু বরের, তার পরিবারের সম্মানের জন্যে আর পেছন ঘুরে তাকাবেনা। কিছুতেই না। কিন্তু আমি যদি এখন ওকে গিয়ে বলি আমি ওকে ভালোবাসি। তাহলে ওর মনে সারাজীবন আক্ষেপ থেকে যাবে যে নিজের ভালোবাসাকে ফিরে পেয়েও তাকে গ্রহন করতে পারেনি। গুমরে গুমরে মরবে ও। তারচেয়ে আমার ভালোবাসাটা ওর অজানাই থাক। আমি সারাজীবন আড়াল থেকেই ওকে ভালোবেসে যাব।”
সৌহার্দ্য গম্ভীর মুখে বসে রইল। বিহানের কথাগুলো যে খুব ভুল তা-না। সবটা ঠিক করার একটা সুযোগ এলো কিন্তু বড্ড দেরী করে। বিহান হেসে বলল,
” একটা সময় ছিল যখন ও আমায় নিজের ভালোবাসার কথা বলতে এসে ভাঙা মন নিয়ে ফিরে গেছিল। আর আজ আমি ওকে নিজের মনের কথা বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। একেই বলে রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার।”
সৌহার্দ্য রাগী গলায় বলল,
” ফালতু বকিসনা তো। কীসের রিভেঞ্জ? এই দু-বছরের যন্ত্রণা, কষ্ট, ছটফটানি কী কম ছিল? যে প্রকৃতিকে আরও রিভেঞ্জ নিতে হবে?”
বিহান কিছু না বলে সৌহার্দ্য কোলে শুয়ে পরল। চোখ বন্ধ করে ফেলল। সৌহার্দ্য বিহানের মাথায় আঙুল চালাতে চালাতে মনে মনে ভাবছে যে, কী করা যায়? কী করলে রিখিয়া-বিহান নিজের ভালোবাসাও ফিরে পাবে। আর দুই পরিবারের সম্মানও বাঁচবে। তুর্বীর সাথে আলোচনা করতে হবে এই বিষয়ে। বিহান বলল,
” তুর্বীকে তো আজও ততোটাই ভালোবাসিস। তাহলে আবার একটা চেষ্টা কেন করছিস না?”
সৌহার্দ্য একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
“ওকে নিয়ে আমি আর কোন আশা বা স্বপ্ন সাজাবোনা। দ্বিতীয়বার একই ধাক্কা নিতে পারবনা আমি। যদি কিছু ঠিক করতেই হয় ওকে নিজে থেকে আসতে হবে আমার কাছে। ওকে নিজে থেকে বলতে ও কী চায়। এইবার আমি নিজে থেকে এক পাও এগোবো না।”
বিহান সৌহার্দ্যর কোল জড়িয়ে ধরল আর মনে মনে প্রার্থনা করল এবার যাতে তুর্বী নিজে থেকে এগোয়। ওর ভাইটা কোনদিন অন্যকাউকে মানতে পারবেনা সেটা ও বুঝে গেছে। এখন সবটাই তুর্বীর হাতে।
____________
রিখিয়া বিছানা গোছাচ্ছে। আর তুর্বী মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আসার পর থেকেই রিখিয়া ওর সাথে একটাও কথা বলেনি। সৌহার্দ্য, দোলা আর তুর্বী, ওরা তিনজন রেস্টুরেন্টে থেকে বেড়িয়ে পার্কে এসে দেখে ওর পার্কের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মধ্যে যে কিছুই ঠিক হয়নি সেটা সৌহার্দ্য আর তুর্বী দুজনেই বুঝতে পেরেছিল। যদিও এটাই এক্সপেক্টেড। কারণ একদিনে সবটা ঠিক হওয়ার কথাও না। তারপর ওরা একসঙ্গে লাঞ্চ করে ফিরে এসছে। খুব বেশি কাজ না হলেও প্রথম স্টেপ কম্প্লিট হয়েছে ওদের। তুর্বী অসহায় কন্ঠে বলল,
” এমন করছিস কেন? তুই খুশি হোস নি ওদের সাথে দেখা হয়ে সবটা ঠিক হওয়াতে?”
রিখিয়া এবার বালিশ ছুড়ে রেখে বলল,
” হ্যাঁ হয়েছি। কিন্তু আমাকে একবার জানাবেনা তুমি?”
” সরি ইয়ার। আমি ভেবেছিলাম আগে থেকে বললে তুই যাবিনা।”
” ওও। তাই মিথ্যে বলে নিয়ে গেছে।”
” সরি!”
নিচু কন্ঠে বলে মাথা নিচু করে ফেলল তুর্বী। রিখিয়া ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। রিখিয়া শুয়ে পরল। তারপর তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে না থেকে শুয়ে পরো।”
তুর্বীও রিখিয়ার পাশে শুয়ে পরল। পাশাপাশি টানটান হয়ে শুয়ে আছে দুজন। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ ছিল। এরপর তুর্বী ইতস্তত কন্ঠে বলল,
” বলছিলাম যে, বিহানের সাথে কথা বলে কী বুঝলি?”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,
” কী বুঝবো?”
তুর্বী একটু অবাক হয়ে বলল,
” এতক্ষণ কথা বলেও তোর কিছুই মনে হয়নি?”
রিখিয়া একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
” কী বলছ বলোতো?”
তুর্বী এবার আর কোনরকভ ভনিতা করতে না পেরে সরাসরিই বলল,
” মানে, ওর মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করিস নি তুই?”
রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” হুম। অনেকটা বদলে গেছে। আগের মত নেই। বেশ শান্ত আর ভদ্র হয়ে গেছে।”
তুর্বী রিখিয়ার দিকে ঘুরে শুয়ে বলল,
” তুই জানিস ও এখন আর কোন মেয়ের সাথেও তেমন মেশেনা। আই মিন ওভাবে মেশেনা।”
রিখিয়া একটু অবাক হল। অবাক হয়েই তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুমি কীকরে জানলে?”
” বান্দরবান গিয়ে যখন দেখেছিলাম তখন খোঁজ নিয়েছিলাম।”
রিখিয়া ছোট স্বরে বলল,
” ওহ।”
তুর্বী উৎসাহি কন্ঠে বলল,
” তোর কী মনে হয়? ওর এই বদলের কারণ কী? এতো বদলে গেল কেন?”
রিখিয়া নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল,
” আমি কীকরে জানবো? তোমার সামনেই তো ছিল জিজ্ঞেস করে নিতে।”
” কিন্তু তবুও! তোর একটা আইডিয়া আছেনা?”
” না নেই। এবার আমার কথা ছেড়ে নিজের কথা বল। বিয়ে কেন করছনা এখনও?”
বিয়ের কথা শুনে তুর্বী মুখটা মলিন করে ফেলল। তারপর বলল,
” আমার কথা বাদ দে তো। আমার ভাইটাকে এখন সেটেল করে দিতে পারলেই আমার শান্তি। মা মারা যাওয়ার পর ওর সব দায়িত্ব তো আমার কাধেই।”
রিখিয়া নরম কন্ঠে বলল,
” আন্টি কীভাবে মারা গেল?”
” ন্যাচরাল ডেথ। দেড় বছর আগেই মারা গেছেন। যেমনই হোক। সৎ মা হলেও মা বলেতো ডাকতাম।”
তুর্বীর কথা শুনে রিখিয়া একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” তুর তুমি যদি এখনো ভেবে থাকো সৌহার্দ্য নিজে এসে আবার সব শুরু করতে চাইবে তো ভুলে যাও। দুই-বছর আগে যা হয়েছে তারপরেও এই আশা করোনা। তুমি যদি কিছু চাও তো এবার তোমাকে নিজে থেকেই এগোতে হবে।”
তুর্বী কয়েকসেকেন্ড নিরব রইল। সৌহার্দ্য আর দোলার একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো ভাবলে কষ্ট হয় ওর। এখনো হচ্ছে। ও দ্রুত নিজেকে সামলে বলল,
” আমি কিছু চাইনা। আর তাছাড়াও ওর বিয়ের কথা চলছে। দোলা মেয়েটা ভালোই। আমার চেয়ে বেটার অপশন।”
” হয়েছে! কথা না বলে চুপচাপ ঘুমাও এখন।”
তুর্বী রিখিয়ার ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল। রিখিয়া আর কিছু বলল না ভাবনায় মত্ত হয়ে গেল। সত্যিই বিহানের এই বদলের কারণ কী? শুধুই কী সৌহার্দ্যর থেকে দূরে থাকা? লোকটা নিজেকে এতো বদলে ফেলল কেনো? রিখিয়াকে ভাবতে দেখে তুর্বী মনে মনে খুশি হল। ও তো এটাই চেয়েছিল। ও চেয়েছিল রিখিয়া এ বিষয়ে ভাবুক। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রিখিয়ার ভাবনায় ছেদ ঘটল ফোনের রিংটনে। রিখিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল এটা শাফিনের ফোন। ও কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে থেকে ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করল। তুর্বী ভাবছে শাফিন ছেলেটা এতো ভালো না হলেও হত। খারাপ হলে এই বিয়েটা ভাঙতে ওর গিল্টি ফিল হতোনা। কিন্তু এখন তো হচ্ছে। তবে শাফিন যখন ফোন করল তখন রিখিয়ার চোখেমুখে তুর্বী সেই খুশিটা দেখেনি যে খুশিটা বিহান ফোন করলে থাকত। বরং দেখেই বোঝা যাচ্ছে রিখিয়া বাধ্য হয়ে ফোন ধরেছে। জোর করে কথা বলছে। এভাবে সংসার করবে কীকরে? যদি বিহান রিখিয়াকে ভালো না বাসতো তাহলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু যখন একে ওপরকে ভালোবাসে তখন এই বিচ্ছেদ ঠিক হবেনা। আর মনে একজনকে রেখে অন্যজনের সাথে সংসার করাটা খুব যন্ত্রণার। বিশেষ করে একটা মেয়ের জন্যে। রিখিয়াকে ও সেই যন্ত্রণা দিতে চায়না। মেয়েটা এমনিতেও অনেক কষ্ট পেয়েছে। ওকে সবটা ঠিক করতেই হবে। যেভাবেই হোক।
#চলবে…
[ রি-চেইক করা হয়নি।]