#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৭
.
মাঠের পাশের পুকুরপারে সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে আছে সৌহার্দ্য আর তুর্বী। দুজনেই গভীর ভাবনায় মগ্ন। তুর্বী ভ্রু কুচকে রেখে ছোট ছোট চাকার টুকরো ছুড়ে মারছে পুকুরে আর একমনে ভেবে চলেছে। আর সৌহার্দ্য দুই হাত পেছনের দিকে রেখে পেছন দিকে হেলান দিয়ে সামনের সিঁড়ির দিকে দুই পা ছড়িয়ে বসে আছে। তুর্বী একটা লম্বা হাই তুলে বলল,
” কিছু ভেবে পেলে?”
সৌহার্দ্য হতাশ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
” উমহুম। কিছুই মাথায় আসছে না।”
তখনই পাশে রেখে দেওয়া সৌহার্দ্যর ফোন বেজে উঠল। তুর্বী তাকিয়ে স্ক্রিনে দোলা নামটা স্পষ্ট দেখতে পেল। ওর মেজাজ আবার বিগড়ে গেল। সারাদিনই কী সৌহার্দ্যর পেছনে লেগে থাকে না-কি? এখন কত ইম্পর্টেন্ট বিষয়ে ডিসকাস করছে ওরা, আর এই মেয়ে এখন প্রেমালাপ করতে ফোন করছে। সৌহার্দ্য ফোনটা রিসিভ করে বলল যে, পরে কথা বলবে। এরপর ফোন রাখতেই তুর্বী কটমট চোখে তাকিয়ে বলল,
” তা মাথায় আসবে কেন?এখনতো সারাদিন মাথায় হবু বউ এর চিন্তা ঘুরে বেড়ায় তাই না? অন্যদের নিয়ে ভাবার মত সময় আছে নাকি? আর তাছাড়াও তোমার মাথায় আবার কবে কোন প্লান এসছে? আগেও গাধা ছিলে এখনো গাধাই আছো। ”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে বলল,
” আমি গাধা?”
” হ্যাঁ গাধাই। বুদ্ধি থাকলে এতক্ষণে অন্তত একটা প্লান বলতে পারতে।”
” আহা! তোমার মাথাতো বুদ্ধিতে ভরপুর আছে তাইনা? তাহলে তুমিই বল কোন প্লান।”
তুর্বী এবার একটু হকচকিয়ে গিয়ে আমতা আমতা করতে শুরু করল। সৌহার্দ্য হেসে দিয়ে বলল,
” কী মিস বুদ্ধিমতি? দেখাও তোমার বুদ্ধি।”
তুর্বী নিজের ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে বিরক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
” হ্যাঁ বলছিতো, এতো তাড়াহুড়োর কী আছে? বলছি, বলছি।”
সৌহার্দ্য এবার নিজেও একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে। আপনি কী ভেবেছেন। মুখেই বড় বড় বুলি শুধু। কীকরে যে এই মেয়ের প্রেমে পরলাম কে জানে?”
তুর্বী সৌহার্দ্য দিকে ঘুরে রাগী কন্ঠে বলল,
” হ্যাঁ এখনতো এসব মনে হবেই। ওমন সুন্দরী হবু বউ আছে। তার এতো গুন। ওসব দেখার পর এখনতো আমার সবকিছুই খারাপ লাগবে। নরমাল।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। তুর্বীর কথায় আজ ও জেলাসির গন্ধ পাচ্ছে।তাহলে কী তুর্বী ওকে___ না, ও আগে থেকে আর কিচ্ছু ভাববে না এবার। যদি তুর্বীর মনে কিছু থেকে থাকে সেটা তুর্বীকেই বলতে হবে। তুর্বী নিজে থেকে বললেও সৌহার্দ্য কতটা ওকে আগের মত এক্সেপ্ট করতে পারবে সেটাও ভাবার বিষয়। সৌহার্দ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” তাতে তোমার কী সমস্যা? ইউ ডোন্ট কেয়ার রাইট?”
তুর্বী ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
” ইয়েস, আই ডোন্ট কেয়ার।”
” তাহলে এসব অবান্তর কথা বন্ধ করো।”
তখন তুর্বী কিছু একটা চিন্তা করে নরম গলায় বলল,
” আমরা নিজেদের মধ্যে অযথাই ঝগড়া কেন করছি? আমরা বিহান আর রিখুর প্যাচ আপ করার প্লান করতে এসে নিজেরাই ঝগড়া করছি।”
সৌহার্দ্যর এবার ঠান্ডা হল। তারপর বলল,
” এভাবে শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা।”
তুর্বী মন খারাপ করে বলল,
” আর মাত্র দশদিন বাকি আছে বিয়ের। অামাদের এরমধ্যেই কিছু করতে হবে। আচ্ছা শাফিনের সাথে কথা বললে কেমন হয়।”
” শাফিন কে গিয়ে কী বলব? আগে তো এই দুজনকে রাজি করাতে হবে না? এরাতো বেঁকে বসে আছে। এদের ঠিক না করতে পারলে কোনকিছু করেই লাভ নেই।”
” হুম, সেটাও ঠিক।”
সৌহার্দ্য একটু ভেবে বলল,
” আমার মনে হয় রিখিয়ার জানা উচিত যে বিহান ওর জন্যে কী ফিল করে। কিন্তু সেটা আমাদের মুখে নয় স্বয়ং বিহানের মুখে।”
তুর্বী আরও বেশি চিন্তিত হয়ে বলল,
” কিন্তু সেটা কীকরে সম্ভব? তোমার কথা শুনে যা বুঝেছি। রিখিয়ার বিয়ের কথা শোনার পর ও কখনই কিছু বলবে না নিজে থেকে রিখিয়াকে।”
সৌহার্দ্য কিছু না বলে ভাবতে শুরু করল। তুর্বীও আবার ভাবনায় মগ্ন হল। ভাবনার মাঝেই হুট করে তুর্বী বলে উঠল,
” আমার একটা প্লান আছে।”
সৌহার্দ্য সোজা হয়ে বসে বলল,
” কী প্লান?”
” আমি তোমাকে টেক্সট করে দেব কী করতে হবে। এখন আমাকে উঠতে হবে। অনেকটা পথ যেতে হবে আমায়।”
” আচ্ছা। চল আগে কিছু খেয়ে নেবে।”
তুর্বী কিছু বলার আগেই আবার সৌহার্দ্য ফোন বেজে উঠল। এবারেও দোলাই ফোন করেছে। তুর্বীর কেন জানি এবার রাগের চেয়েও বেশি খারাপ লাগল। ও অনেকটাই অভিমানী গলাতেই বলল,
” এখন আমার খিদে নেই, আর সময়ও নেই। আসছি।”
বলে সৌহার্দ্যকে কিছু বলতে না দিয়েই তুর্বী চলে গেল। কেন জানিনা হঠাৎই কান্না পেল ওর। কান্না আটকানোর জন্যেই এই দ্রুত প্রস্হান। সৌহার্দ্যর পাশে দোলা নামটাই এখন সহ্য হয়না তুর্বীর। এটাই কী তবে প্রেম? প্রেম নামক রোগ কী তবে তুর্বীকেও গ্রাস করল?
___________
সৌহার্দ্য আর বিহান মিলে অনেকদিন পর আজ জমিয়ে রান্না করেছে। আজ প্রায় দুবছর পর দুই ভাই মিলে আবার রান্না করল। কিন্তু এখন আর আগের মত রান্নাঘর লন্ডভন্ড হয়না। ওরা এখন গুছিয়ে রান্না করতে শিখে গেছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আজ সৌহার্দ্য নিজেই বিহানকে বলল,
” ড্রিংক করবি না আজ?”
বিহান একটু অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল,
” কী ব্যাপার বলতো? আজ তুই নিজে থেকে আমাকে ড্রিংক করতে বলছিস?
সৌহার্দ্য জানে একমাত্র ড্রিংক করলেই বিহান নিজের ভেতরকার সব কথা উগলে দেয়। না হলে ওর মুখ ফোটেনা সহজে। সৌহার্দ্য ব্যাপারটা সামলাতে বলল,
” আসলে, তুইতো আর আমার কথা শুনবিনা। তাই বললাম।”
বিহান ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” হুম, চল ছাদে চল।”
” না, আজ ছাদে না তোর পেন্টিং রুমে বস গল্প করব। তোর পেন্টিং এর এক্সপ্লেনেশনগুলো শুনবো।”
” ওকে ফাইন।”
পেন্টিং করার রুমটাতে গিয়ে দুজনেই ফ্লোরে হেলান দিয়ে বসল। সৌহার্দ্য আগেই সব পেন্টিং এর কাপড় সরিয়ে দিয়েছে। এরপর বিহান ড্রিংক করতে করতে বিহানকে একেকটা পেন্টিং এক্সপ্লেইন করছে। সৌহার্দ্য যখন দেখল বিহানের নেশা হয়ে গেছে ও বিহানের চোখের আড়ালেই তুর্বীকে ফোন করল। এরপর রিখিয়ার পেন্টিংটাকে উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,
” আর এটা?”
বিহান মাতাল দৃষ্টিতে তাকাল ছবিটার দিকে। তারপর একটু হাসল। যে হাসিতে ভালোবাসা, কষ্ট, নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য সব মিশে ছিল। তুর্বী এতক্ষণ সৌহার্দ্যর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। ও দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে কানে নিলো। তুর্বীর পাশেই রিখিয়া বসে নিজের অফিসের কিছু কাজ করছে। তুর্বী চুপচাপ বিহানের বলা কথাগুলো শুনছে। তুর্বীকে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,
” কার ফোন যে এভাবে চুপ করে শুনছোই শুধু কিছু বলছোনা?”
তুর্বী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” আর বলিস না। হোল্ডে থাকতে বলে কোথায় যেন গেছে। আমারও ওয়াসরুম যেতে হবে। এই শোননা তুই ফোনটা একটু কানে ধরে রাখ। লাইনে আসলে বলবি আমি ওয়াসরুম গেছি, ওয়েট করতে।”
বলে ফোনটা লাউডে দিয়ে তুর্বী বাইরে চলে গেল। রিখিয়া বলল,
” আরে কে আছে সেটাতো বলে যাও?”
কিন্তু তুর্বী আর দাঁড়ায় নি। রিখিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এরপর ফোনটা থেকে কথার আওয়াজ পেয়ে ও কানে দিল ফোনটা, ভালোভাবে শোনার জন্যে। ওপাশ থেকে বিহানের গলা পেয়ে ও চমকে উঠল। বিহান বলছে,
” জানিস ব্রো। ওকে প্রথম একটা মলে দেখেছিলাম। লিফ্টের মধ্যে একটা মেয়ের সাথে ক্লোজ অবস্থাতেই আমাকে প্রথম দেখেছিল ও। লজ্জায় আর বিরক্তিবোধে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর এই ব্যাপারটাই ইন্টারেস্টিং লেগেছিল আমার। লিফ্টের বাইরে যখন ওকে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করলাম তখন ভয়ে ভয়ে সরলভাবে ওর সব বলে দেওয়া, ইনোসেন্স দেখে অবাক হয়েছিলাম। এরপর যখন টাকার জন্যে ঘড়ি কিনতে না পেরে গোমড়া মুখে ফিরে যাচ্ছিল, সেটা নিতে পারিনি আমি। তাইতো ওকে ঘড়িটা পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম। এরপর বারবার দেখা হয়েছে ওর সাথে। আমিও নানাভাবে ওরসাথে মজা করতাম। কেন জানিনা ওকে জ্বালাতে আমার অদ্ভুতরকম ভালো লাগতো। একটু একটু করে ওকে অন্যরকমভাবে আবিষ্কার করছিলাম। কিন্তু সেইদিন পার্টিতে ওর সম্মান বাঁচাতে গিয়ে যখন আমাকেই এরকম অসম্মানের শিকার হতে হয় শুধুমাত্র ওর একটু ভুল বোঝার কারণে। তখন আমার মাথায় শুধু মায়ার কথাই এসছিল। বারবার সেই দিনটা, সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছিল। সেই অপমান, সেই তিরস্কার, সকলের সেই ঘৃণাভরা দৃষ্টি সবকিছুই মাথায় ঘুরছিল। মনে হচ্ছিল সেসব আবার ফিরে এসছে। মায়ার জায়গায় রিখিয়াকে কল্পনা করছিলাম আমি। ঐ মুহূর্তে আমার মাথা বিগড়ে গেছিল। তখন মাথায় শুধু একটাই কথা ঘুরছিল। প্রতিশোধ!”
রিখিয়ার চোখ ছলছল করছে বিহানের কথা শুনে। সৌহার্দ্য আড়চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখছে যে রিখিয়া লাইনে আছে কি-না। রিখিয়া ভাবছে যে মায়া কে? কার জন্যে বিহানকে অপমানিত হতে হয়েছিল? সকলের ঘৃণার পাত্র হতে হয়েছিল? কী করেছিল মায়া? বিহান আবার বলতে শুরু করল,
” এরপর ওর সাথে মেলামেশা আর বন্ধুত্বের শুরুটা নাটক ছিল ঠিকই। কিন্তু প্রথমবার যখন গাড়িতে ওকে আমার বুকে নিয়েছিলাম মনে হয়েছিল আমার সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে গেছে। ওর সংস্পর্শে এসে আস্তে আস্তে আমার ভেতরকার শূণ্যতা দূর হয়ে গেছিল। শুরুটা অভিনয় দিয়ে হলেও একপর্যায়ে আমি ওকে সত্যিই নিজের বন্ধু ভাবতাম। আর সেই বৃষ্টির রাতে যখন ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ওরকম অনুভূতি তার আগে আমার কক্ষণো হয়নি। ওকে যখন ঠিককরে চিনতে শুরু করলাম তখন বুঝেছি যে আমি কতবড় ভুল করছি। তাইতো আমি চেয়েছিলাম আমার উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার আগেই, ও আমাকে ভালোবাসার আগেই সব সত্যি বলে দিতে। কিন্তু দেরী হয়ে গেছিল। ততোদিনে ঐ বোকা মেয়েটা আমার মত একটা অযোগ্য, বাজে, ইউসলেস ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছিল। হয়তো আমিও বেসেছিলাম কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি। তাইতো ও যাতে আর কষ্ট না পায় তাই সরে এসছিলাম। কিন্তু সরে গিয়ে বুঝতে পেরেছি আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। যত দিন যাচ্ছিল ওর স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে, আমার রাত জাগার কারণ হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যেও সরাতে পারিনি মন থেকে। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আস্তে আস্তে সেই অনুভূতির নাম খুঁজে পেলাম। বুঝতে পারলাম যে ঐ বোকা মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি। নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু আজ এসব কথার কোন অর্থই নেই। আর দশদিন। এরপর ও অন্যকারো হয়ে যাবে। কিন্তু ও যারই হোক। আই লাভ হার। আই লাভ অর আ লট। কিন্তু আফসোস হচ্ছে। যদি একটা বার বলতে পারতাম, তোমার ভালোবাসা ব্যর্থ হয়নি রিখিয়া। আমিও ভালোবাসি তোমাকে। নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।”
রিখিয়া চোখ বন্ধ করে কেঁদে দিল। ওর হাত থেকে ফোনটা পরে গেল। সমস্ত শরীর কাঁপছে ওর। কী বলল বিহান এটা? কেন বলল? এখনই কেন বলল? একসময় এই তিনটে শব্দ ওর সমস্ত সুখের চাবিকাঠি ছিল। কিন্তু আজ যে এই তিনটে শব্দই ওকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিল। নিয়ত এতো নিষ্ঠুর কেন?
#চলবে…
[ রি-চেইক করা হয়নি]
#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৮
.
বিহান নিজের পেন্টিং করার রুমটায় একা একা বসে পেন্টিং করছে। কী আঁকছে নিজেও জানেনা, বোর্ডের ওপর রং চালিয়ে যাচ্ছে শুধু। আজ বুকের ভেতর ভীষণ ভার হয়ে আছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। কাঁদতে পারলে হয়তো খুব ভালো হতো কিন্তু আজ কান্নাও বিহানের সঙ্গ দিতে নারাজ। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর নাক টানছে একটু পরপর। চোখ, নাক সব লাল হয়ে গেছে। কিন্তু এই আঘাতগুলো হয়তো ওর পাওয়ানাই ছিল। ওরই দোষ আছে সবক্ষেত্রে। না হলে ওর সাথেই বারবার এমন কেন হবে? ওকেই কেন সবাই ঘৃণা করবে? সকালবেলায় সৌহার্দ্য চলে যাওয়ার পরে বিহানের ফোনে আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসছিল। ফোনটা রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে রিখিয়ায় গলা শুনে চমকে গেছিল বিহান। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বিহান নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কেমন আছো?”
রিখিয়া রাগী গলায় বলল,
” আপনার মত মানুষ যার জীবনে থাকে সে কখনও ভালো থাকতে পারে? কী চান কী আপনি?”
বিহান অবাক হয়ে গেল। এভাবে কথা কেন বলছে ওর সাথে রিখিয়া? ওর জানামতে ওতো এখন তেমন কিছুই করেনি। ও কিছু বলার আগেই রিখিয়া বলল,
” ভালোবাসেন আমাকে তাইনা?”
রিখিয়ার কথা শুনে বিহান চমকে উঠল। রিখিয়া কীকরে জানলো এই কথা? ওতো বলেনি? তাহলে কী সৌহার্দ্য বলে দিয়েছে? ও ইতস্তত করে বলল,
” এসব তোমাকে__”
কথাটা শেষ করার আগেই রিখিয়া একটু আওয়াজ করেই বলল,
” আমি জানতে চেয়েছি ভালোবাসেন কী-না?”
বিহান কিছুক্ষণ নিরব থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্পষ্ট ভাষায় বলল,
” হ্যাঁ ভালোবাসি।”
রিখিয়া একটু হাসল। যাকে বলে তাচ্ছিল্যের হাসি। তারপর বলল,
” তা এবার কীসের প্রতিশোধ নিতে চান আপনি? সেদিন গিয়ে কিছু করেছিলাম না-কি?”
বিহান চুপ করে আছে। কোনো উত্তর নেই ওর কাছে। তাছাড়াও ও জানে ও এসবই ডিসার্ব করে। রিখিয়া চেঁচিয়ে বলল,
” কী হল বলুন? এবার কোন প্রতিশোধের খেলায় নেমেছেন আপনি? কেন জানালেন এসব আমাকে? নিজেকেতো সামলে নিয়েছিলাম আমি। মেনে নিয়েছিলাম সব। তাহলে কেন এভাবে আবার আমাকে ভেঙ্গে দিলেন? কেন শোনালেন কাল এসব?”
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল রিখিয়া। বিহান অবাক হল খানিকটা। কী বলছে রিখিয়া? কাল কী শুনেছে ও? তাহলে কী ও যখন নেশার ঘোরে কথাগুলো বলছিল তখনই শুনেছে? কিন্তু কীভাবে? সৌহার্দ্য শুনিয়েছে? বিহান বলল,
” রিখিয়া এটা সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি___”
রিখিয়া ওকে থামিয়ে বলল,
” প্লিজ। আপনার সো কলড ভালোবাসার কথা আমি আর শুনতে চাইনা। কয়েকমাস আমার সাথে থাকলেন, তারপর মাঝে দুটো বছর কেটে গেছে। কিন্তু আজ আপনার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ভালোবাসেন? যখন আমার বিয়ের মাত্র ন-দিন বাকি। এসবের মানে কী ধরে নেব আমি?”
বিহান অসহায় কন্ঠে বলল,
” রিখিয়া এইজন্যই আমি তোমাকে কিছুই জানাতে চাইনি। কিন্তু হয়তো কাল ব্রো__ জানিনা কী হয়েছে, কিন্তু আমি কিছুই জানতাম না। ট্রাস্ট মি।”
রিখিয়া আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
” ট্রাস্ট ইউ? কীকরে করি বলুনতো? আসলে আপনার মনের প্রতিশোধের ইচ্ছাটা এখনো শেষ হয়নি। যখন শুনেছেন যে আমার বিয়ে হচ্ছে। আমি নতুন জীবন শুরু করছি। ভালো থাকছি। তখন আপনার সেটা সহ্য হয়নি। তাই আবার নতুন করে এই নাটক শুরু করেছেন তাইনা? যাতে আমাকে আবারও ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া যায়, শেষ করে দেওয়া যায়। আপনার মত মানুষ এরচেয়ে ভালো কী ভাবতে পারে। এক থাপ্পড়ের আর কত দাম নেবেন আমার কাছ থেকে? ইউ নো হোয়াট, এইজন্যই আপনার কাছে কিচ্ছু নেই। না পরিবার আছে, আর না ভালোবাসা আছে। আর নিজের ভাইকেও তো কাছে রাখার ক্ষমতা আপনার নেই। ছেড়ে চলে গেছিল। শুধুমাত্র একজন ভালো মানুষ বলেই আজও আপনার সাথে আছেন। না হলে আপনার মত মানুষের সাথে থাকা যায়না। একদম না।”
কথাগুলো বলে রিখিয়া ফোন রেখে দিল। আর এরপরেই শব্দ করে কেঁদে ফেলল। বিহানকে এসব বলতে চায়নি ও। কিন্তু আজ ওর ভেতরে জমানো অভিমানগুলো রাগ হয়ে বেড়িয়ে এলো। কেন করল বিহান এরকম? কেন ওর জীবনটাকে এতো জটিল করে দিল। যদি ভালোবেসেই থাকে তাহলে সেই অনুভূতিগুলো আগে কেন বুঝলোনা? আর যখন বুঝলো, এতো দেরী করে কেন বুঝল? কেন?
বিহান অনুভূতিহীন ভাবে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নিয়ে ওভাবেই বসে ছিল কিছুক্ষণ। ওকে দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা ও অনুভূতি এখন কেমন। শুধু গলাটা কাঁপছিল ভীষনভাবে। এরপর সোজা পেন্টিং করার রুমটাতে চলে আসে আর উল্টোপাল্টা রং করতে শুরু করে। হঠাৎ করেই বিহান রঙের টিউবগুলো একটার পর একটা খুলে খুলে বোর্ডের ওপর ছুড়ে মারতে শুরু করল। সব টিউব খালি হয়ে যাওয়ার পর ও তুলি দিয়ে বোর্ডে লেগে থাকা রংগুলো মিশিয়ে দিতে শুরু করল। কী করছে সেটা ও নিজেও জানেনা। কিন্তু নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে ওর, এখন ভীষণ ব্যস্ত।
_____________
সারাদিনের বৃষ্টি আর বজ্রপাতের পরেও আকাশ এখনও মেঘলা। মনে হচ্ছে বিকেলে আবার বৃষ্টি হবে। তুর্বী জানালা ধরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূরের আকাশের দিকে। ওর অজান্তেই ওর ভাবনায় এখন সৌহার্দ্যর বসবাস চলছে। ও না চাইতেও বারবার সৌহার্দ্যর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে পরছে। ওদের সেই উদ্দেশ্যহীন, কমিটমেন্ট ছাড়া সম্পর্ক। হঠাৎ হঠাৎ একে ওপরের কাছে চলে আসা। খুনশুটিময় কিছু মুহূর্ত। এরপর সৌহার্দ্যর ওকে বিয়ের কথা বলা। বিয়ের কথা মনে পরতেই ওর মনে পরল সৌহার্দ্য আর দোলার বিয়ের কথা চলছে। আচ্ছা সৌহার্দ্য তো ওকে ভালোবাসতো তাহলে অন্যকাউকে কীকরে বিয়ে করছে? তবে কী আজ আর সেই ভালোবাসা নেই? নিজের এরকম চিন্তাতে নিজেই অবাক হল তুর্বী? ও এসব চিন্তা কেন করছে? সৌহার্দ্য বিয়ে করতেই পারে। সারাজীবন একটা মেয়ের স্মৃতি আকড়ে বসে থাকবে না-কি? কিন্তু ব্যাপারটায় হঠাৎ ওর এতো খারাপ কেন লাগছে। কেন মানতে পারছেনা সৌহার্দ্যর বিয়ে হয়ে যাবে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে রিখিয়া এসে দাঁড়াল ওর পাশে। তুর্বী না তাকিয়েও বুঝতে পারল যে রিখিয়া এসছে। তাই সামনে তাকিয়ে থেকেই বলল,
” এখনো রেগে আছিস আমার ওপর?”
রিখিয়াও রিক্ত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থেকে বলল,
” না, রেগে থাকব কেন?”
” কাল রাত থেকে আর কথা বলিস নি আমার সাথে, তাই বললাম।”
রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” মন ভালো ছিলোনা। আর তাছাড়াও কালকে সবটা প্লানিং করে করেছিলে তাইনা?”
তুর্বী মাথা নিচু করে বলল,
” হুমম।”
রিখিয়া উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে
” কী লাভ হল এসব করে?”
তুর্বী ভ্রু কুচকে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” রিখু, বিহান ভালোবাসে তোকে। আর তুই নিজের কানে শুনেছিস যে কতটা ভালোবাসে।”
রিখিয়া সামনে তাকিয়ে থেকেই হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
” এসব কথার কোন মানে হয় এখন তুর?”
তুর্বী রিখিয়ার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,
” তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ে হয়ে যায়নি ওকে? বিহান লাভস ইউ, রিখু। প্লিজ ভেবে দেখ।”
রিখিয়া হাত ছাড়িয়ে বলল,
” এতো ভাবাভাবির তো কিছু নেই। আমার সাথে এতোগুলো মাস কাটিয়ে ওনার আমার প্রতি কোন অনুভূতি জন্মালো না। ওনার মনে হল উনি আমাকে ভালোবাসেন না। অথচ দূরে গিয়ে দুই বছর পর ওনার মনে হল উনি আমাকে ভালোবাসেন? কাল তো আবার এটাও বলতে পারে যে ওনার ভুল মনে হয়েছিল।”
তুর্বী একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” রিখু অনেকসময় আমরা যেটা কাছে থেকে বুঝতে পারিনা সেটা দূরে গিয়ে বুঝতে পারি। বিহানের ক্ষেত্রে হয়তো এটাই হয়েছে।”
রিখিয়া আবারও একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। তারপর বলল,
” তো? কী দাঁড়াল? ওনার যখন মনে হবে আমাকে ভালোবাসেনা তখন আমাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন। আবার পরে যখন মনে হবে ভালোবাসেন তখন আমাকে কাছে টেনে নেবেন। আর আমি? আমি সেটাও এক্সেপ্ট করে নেব? আমি কী পুতুল?”
তুর্বী চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” ব্যাপারটা সেরকম হলে সবার আগে আমি তোকে আটকাতাম। কারণ আমার কাছে তোর সেল্ফ-রেস্পেক্ট সবার আগে। কিন্তু বিহান কী তোকে একবারও বলেছে যে ফিরে এসো? বা আমি তোমাকে ভালোবাসি? বরং ও নিজে থেকে বলবেনা বলেই আমরা প্লান করে ওকে দিয়ে অন্যভাবে তোকে বলিয়েছি। ও তখন ড্রাংক ছিল রিখু।”
রিখিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকাল তুর্বীর দিকে। বিহান মাতাল অবস্থায় বলেছিল সেসব? তুর্বী বলল,
” আর ও তোর সাথে যা করেছিল তার শাস্তিও কম পায়নি ও। সৌহার্দ্য ওর কাছে কী তুই জানিস না? সেই ভাই ওকে ছেড়ে চলে গেছিল। ওর বাবা এসে মেরেছিল ওকে। সকলের থেকে দূরে গিয়ে বান্দরবান একা কাটিয়েছিল এই দুই বছর। দিন-রাত গুমরে মরেছে ও। রিখিয়া ও নিজে থেকেই তোর কাছে এসে স্বীকার করেছিল সবটা। ও যদি স্বীকার না করত? তাহলে তুই জানতে পারতি ওর প্লান? তুইতো ভাবতি যে তুই-ই নিজে থেকে বেশি এগিয়ে গেছিস, দোষটা তোর। কিন্তু তোকে সেরকম ভাবনায় রাখেনি। বরং সবটা স্বীকার করে নিজে থেকে সরে গেছিল। হ্যাঁ ও যা করেছিল তা অন্যায় ছিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে ওর অপরাধের যথেষ্ট শাস্তি ও পেয়ে গেছে। ও এখন বদলে গেছে রিখিয়া।”
রিখিয়া ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তুর্বীতো ঠিকই বলেছে। অথচ সকালে ফোন করে কত কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছে বিহানকে ও। একটা ভুলের শাস্তি কতদিন ভোগা যায়? ও কিছু একটা ভেবে বলল,
” মায়া কে তুর?”
তুর কপাল ভাজ করে ফেলে বলল,
” মায়া? চিনিনা তো! কেন?”
রিখিয়া কালকে বিহানের বলা কথাগুলো সব বলল তুর্বীকে। কথাগুলো শুনে তুর্বী একটু ভাবুক হয়ে বলল,
” এর উত্তর তো সৌহার্দ্য-ই আমাদের দিতে পারবে।”
রিখিয়া কিছু বলল না। ওর এখন বিহানের সাথে করা ব্যবহারের জন্যে মন খারাপ হচ্ছে। এভাবে না বললেও হত। সত্যিই তো বিহান ওকে একবারও বলেনি ওর কাছে ফিরে যেতে। ওকে ভালোবাসতে। বরং নিজের ভালোবাসাটা নিজের মধ্যেই রাখতে চেয়েছিল। আর ও আজ সকালে কীসব বলে দিয়েছে। কিন্তু ও-ই কী করত ঐ মুহূর্তে ওর মাথা ঠিক ছিলোনা। বিহানের সাথে কথা বলতে হবে ওকে এ ব্যাপারে। ওর কথায় হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা।
আর তুর্বী এখন রিখিয়ার বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে ভাবছে। মায়া কে ছিল? কী এমন করেছিল মায়া যার জন্যে বিহান ওরকম হয়ে গেছিল? হতে পারে এর খোলাশা হলে রিখিয়ার মনে বিহানের প্রতি থাকা অবশিষ্ট ক্ষোভটুকুও আর থাকবেনা। তারজন্যে ওকে আগে এই মায়া নামক রহস্যের সমাধান করতে হবে।
#চলবে…