জলফড়িঙের খোঁজে পর্ব-৫১+৫২

0
674

#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫১
.

ঐ মুহূর্তে-ই বিহানকে শফিক রায়হান তার বাড়ি থেকে বেড় করে দিল। সৌহার্দ্য অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু উনি শোনেননি। এদিকে আমিনুর সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে এরকম কুলাঙ্গারকে তিনি তাঁর বাড়িতে জায়গা দেবেন না। আসমার মনে মনে এই সিদ্ধান্তে সম্পূর্ণ সহমত হতে না পারলেও কিছুই বললেন না। কী বলবেন? ছেলে যেই জঘন্য অন্যায় করেছেন এরপর কী বলার থাকে? আজ যদি তার ছেলে না হয়ে অন্যকারো ছেলে হত তাহলে তো উনি প্রতিবাদ করতেন। সেই ছেলেকে জেলেও পাঠাতেন। তাহলে নিজের সন্তান বলে পক্ষপাত কেন করবে? সৌহার্দ্য অনেকবার চেষ্টা করেও ওদের কিছুই বোঝাতে পারল না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল বিহান আর কিছুই বলেনি। একটা শব্দও না। উপায় না পেয়ে সৌহার্দ্য বিহানকে নিয়ে ঐ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। তখন ওরা দুজনেই স্টুডেন্ট। নিজস্ব কোন ইনকাম নেই। সৌহার্দ্য বিহানকে নিয়ে কী করবে, কোথায় যাবে বুঝতে পারছিল না। পরে ওর এক বন্ধুর বাড়িতে ওঠে বিহানকে নিয়ে। কিন্তু ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে না প‍ৌঁছলেও কানাঘুষায় বেশ হালকা পাতলা অনেকের কানেই পৌঁছে গেছে। তাই সৌহার্দ্যর সেই বন্ধুর বাবা-মা একদিনের বেশি বাড়িতে এলাও করলেন না বিহানকে। তখন কী করবে বুঝতে না পেরে নুসরাতকে ফোন করে। নুসরাতও তখন বিহানকেই দোষী ভাবছিল। কিন্তু বাকিদের মত বিহানকে ফেলে দিতে পারেনি। তাই ওর হাজবেন্ডের ফাঁকা পরে থাকা ফ্লাটে আপাতত ওদের থাকতে দিল। সৌহার্দ্য অনেকটা বাধ্য হয়েই বিহানের সাথে ঐ ফ্লাটে ওঠে। সৌহার্দ্যর কাছে যা টাকা ছিল সেটা দিয়েই চালাতে শুরু করে। তবে এতোকিছুর মধ্যে বিহান তখনও চুপ ছিল। কোন কথাই বলতোনা। ও স্বাভাবিক হয়নি। সৌহার্দ্য খাইয়ে দিলে খেতো। কথাই বলতো না। মাঝেমাঝে সৌহার্দ্যর জোরাজুড়িতে দু একটা শব্দ বেড় করত মুখ দিয়ে। একদিন ঘুম থেকে উঠে স‍ৌহার্দ্য এমন কিছু দেখবে ভাবেনি। বিহান সুইসাইড করার চেষ্টা করছে গলায় ফাঁস দিয়ে। সেটা দেখে সৌহার্দ্যর দুনিয়া থেমে গেছিল। অনেক কষ্টে সেদিন বিহানকে আটকে ছিল। দেখতে দেখতে বেশ অনেকগুলো দিন কেটে গেল। এরমধ্যে বিহান কয়েকবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। সৌহার্দ্য বুঝেছিল ও প্রচুর ডিপ্রেশনে ভুগছে। তখন কীভাবে সৌহার্দ্য বিহানকে আগলে রেখেছিল সেটা শুধু সৌহার্দ্যই জানে। সৌহার্দ্যকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে ওর বাড়ির লোক কিন্তু সৌহার্দ্য যায়নি। বিহানের অবস্থাও ওদের জানায় নি। সৌহার্দ্য নিজেও ওদের ওপর বেশ ক্ষুদ্ধ। একদিন সৌহার্দ্য টাকা তুলতে গিয়েছিল ব্যাংকে। ফিরে এসে দেখে বিহান আবার সুইসাইড করার চেষ্টা করছে। ছুড়ি দিয়ে হাতে টান মারার আগেই সৌহার্দ্য গিয়ে ছুড়িটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। এরপর ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মারল বিহানকে। কিন্তু বিহান তবুও কিছু বলল না। নিচের দিকে তাকিয়ে ওভাবেই বসে রইল। সৌহার্দ্য বিহানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কান্নাভেজা গলায় বলল,

” ওরাই তোর কাছে সব? আমি কেউ না? তোর জন্যে, শুধুমাত্র তোর জন্যে সবার সাথে লড়েছি। সবার থেকে দূরে সরে এসছি। আর তুই এরকম কাজ করছিলি? আমার কথা মনে পরেনি তোর একবার? এতোটাই স্বার্থপর তুই? যদি এতোই মরার শখ থাকে আগে আমাকে মার। এরপর আর কেউ তোকে আটকাবে না।”

কিছুক্ষণ অনুভূতিহীনভাবে বসে থেকে বিহান নিজেও জড়িয়ে ধরল সৌহার্দ্যকে। এরপর ফুপিয়ে কেঁদে দিল। দুজনেই অনেক কেঁদেছে সেদিন। এরপর বিহান ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ওর কথাও স্বাভাবিক হয়। খরচ চালানোর জন্যে সৌহার্দ্য পারটাইম জব করতে শুরু করে। আর এরপরেই আর.জে. SR এর জন্ম। বিহান তখনও কিছু করতোনা কারণ ও ততটাও স্বাভাবিক হয়নি। কিন্তু বছর কেটে যাওয়ার পর ও পেন্টিং শুরু করে। আবার বাইরে র জগতের সাথে মিশতে শুরু করে। তবে সেই বিহান ছিল অন্যরকম। যে মেয়েদের সাথে তেমন ভাবে কথাও বলতোনা সেই বিহান নিয়মিত মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতে শুরু করে, নেশা করা শুরু করে, দু-তিনটে করে গার্লফ্রেন্ড বানানো শুরু করে। যদিও বিহান নিজে থেকে কোন মেয়েকে প্রপোজ করতো না। কিন্তু যখনই কেউ প্রপোজ করতো ও একগড়ে এক্সেপ্ট করে নিতো। এমনিতে ওরা যা চাইতো, যা অফার করতো সেটাই করত বিহান। সৌহার্দ্য দেখত ব্যাপারটা। স্পষ্টই বুঝতে পারতো যে মেয়ে জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মে গেছে বিহানের। ও অনেক বোঝানোর চেষ্টা করতো কিন্তু বিহান শুনেও শুনতো না। পরবর্তীতে বিহান নিজেই আলাদা ফ্লাট নেয়। সৌহার্দ্যর মায়ের কান্নাকাটিতে বাধ্য হয়ে সৌহার্দ্যকে বাড়ি ফিরতে হয়। নুসরাতও ততদিনে বুঝেছিল বিহান আর যাই হোক এরকম কাজ করেনি। কিন্তু বিহানের অধঃপতন দিন দিন বেড়েই গেল। নেশা করা, ফ্লার্ট করা, একাধিক মেয়ের সাথে সম্পর্ক, এমনকি তাদের নিয়ে ফ্লাটে আসা। বিহানের সাথে যা হয়েছিল সেটা অন্যায় ছিল। কিন্তু তার বদলে বিহান নিজেকে যেটাতে পরিণত হয়েছিল সেটাও ঠিক ছিলোনা। কারো করা অন্যায়ের ওপর রাগ করে তুমি যদি নিজেকে খারাপ বানিয়ে ফেল তাহলে শেষমেশ ক্ষতিটা তোমারই। যেমন এসবে বিহানের ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ হয়নি। তাই অন্যের ওপর রাগ করে নিজেকে খারাপ বানানোটা মোটেও সঠিক কাজ নয়।

__________

রিখিয়া নিঃশব্দে কাঁদছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটার সাথে এরকম নির্মম ঘটনা ঘটেছে শুনলে যেকেউ কষ্ট পাবে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে ওর। এখন ও বুঝতে পারছে সেদিন ভুল বুঝে থাপ্পড় মেরে, বিহানকে ক্যারেক্টারলেস ট্যাগ দিয়ে, জেলে পাঠিয়ে আসলে ও বিহানের পুরোনো ক্ষতে প্রচন্ড জোরে আঘাত করেছিল। তুর্বী এতক্ষণ অবাক হয়ে শুনছিল সব। ওও হালকা ইমোশনাল হয়ে গেছে। ও সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

” মায়ার সাথে কী হয়েছিল এরপর? ও এখন কোথায়?”

সৌহার্দ্য কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,

” ঐ ঘটনার এক সপ্তাহ পর মায়াকে নিয়ে ফুপা-ফুপি ইন্ডিয়া চলে যায়। এলাকায় ছড়িয়ে পরেছিল কথাটা। তাই আর ওখানে থাকেনি। শুনেছিলাম ওখানে বেশ বড়লোক ছেলেকে বিয়ে করেছে। যদিও সেদিন মায়া ঠিক কী করেছিল মায়া ছাড়া কেউ জানেনা। আমি নিজে এসবের সাক্ষী না হলেও আমার জানি ও এমন কিছুই করেনি। ”

তুর্বী অবাক কন্ঠে বলল,

” মানে মায়া এখন দিব্বি সুখে আছে? একটা ছেলের লাইফ হেল করে দিয়ে, তাকে একপ্রকার নিঃস্ব করে দিয়ে সে কীকরে এতো আনন্দে থাকে? রিভেঞ্জ অফ নেচারও কী আজকাল পক্ষপাত করছে না-কি? ঐ মেয়ের সাথে সত্যি সত্যি এমন হলেই বুঝত।”

রিখিয়া বলল,

” না তুর। এভাবে বলো না। ও যা করেছে তা জঘন্যতম অন্যায়। তাই বলে তার সাথেও অন্যায় হোক এটা চাওয়াটাও আরেক অন্যায়।”

” বাহ রে! কর্মফল পাবেনা?”

” কর্মফল সবাইকেই পেতে হয়। কিন্তু কার কর্ম কেমন, আর তার ফল কী হবে সেটা আমরা ঠিক করতে পারিনা। তারজন্যে ওপরওয়ালা আছেন। সঠিক সময়ে উনি এমনিতেই সবার কর্মের ফল দিয়ে দেন।”

তুর্বী মুখ গোমড়া করে বলল,

” সরি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি।”

রিখিয়া সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

” বিহানের রুমের চাবি আছে আপনি কাছে? আমি জানি ও ঘুমোচ্ছে না। আমি আছি তাই আমার সামনে আসতে চাইছে না। সেদিন অনেক কথা শুনিয়েছিলাম তো। আমি গিয়ে দেখতাম একটু।”

সৌহার্দ্য পকেট থেকে চাবি বেড় করে রিখিয়ার হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” আমি ছাদে যাচ্ছি।”

বলে চলে গেল। রিখিয়া চলে গেল বিহানের রুমের দিকে। তুর্বী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সৌহার্দ্যর পেছন পেছন গেল। ছাদে গিয়ে দেখে সৌহার্দ্য বসে আছে মাঝের দিকেই। তুর্বী ধীরপায়ে গিয়ে সৌহার্দ্যর পাশে বসল। সৌহার্দ্য একপলক তুর্বীর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। দুজনের মনেই অনেক কথা জমে আছে কিন্তু বলতে পারছেনা।
বেশ অনেকটা সময় দুজন চুপ করে রইল। তুর্বী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যর দিকে। চাঁদের আলো এসে পরছে সৌহার্দ্যর ওপর। কিন্তু কয়েকদিন পর সে দোলার হয়ে যাবে? ভাবলেই বুকের মধ্যে ইদানীং কেমন অসহনীয় ব্যথা হয় তুর্বীর। সৌহার্দ্য বলল,

” তাকিয়ে আছো যে? কিছু বলবে?”

তুর্বী হালকা চমকে গেল। সাথেসাথেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” তোমাদের বিয়ের ডেট ফিক্সট কবে হচ্ছে?”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে তাকালো তুর্বীর দিকে। এরপর বলল,

” কী ব্যাপার বলবে? ইদানীং আমার বিয়ে নিয়ে বেশি প্রশ্ন করছ?”

তুর্বী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে বলল,

” না এমনি জানতে চাইলাম।”

সৌহার্দ্য স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

” বিয়ে যখন করব দেখতেই পাবে। তোমাকে ইনভাইট অবশ্যই করব।”

তুর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল এরপর হঠাৎই বলল,

” যদি কখনও বলি যে ভালোবাসি। আবার তোমার হাত ধরতে চাই। আরেকটা সুযোগ চাই। মেনে নেবে আমাকে? ভেঙে দেবে ঐ বিয়ে?”

সৌহার্দ্য অবাক হয়ে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

” আগে থেকে কিছু ভেবে নিয়ে দ্বিতীয়বার আঘাত পেতে চাইনা। আর তাছাড়াও তুমি আমাকে এসব বলবে? সেই দিন কোনদিন আসবেনা।”

তুর্বী তাকিয়ে রইল সৌহার্দ্যর দিকে। সত্যিই কী আসবে না সেই দিন? কিন্তু আজ ওর মন যে অন্য কথা বলতে চাইছে? তার কী হবে?

___________

বিহান বারান্দার রেলিং ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আর রিখিয়া ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ও রুমে ঢোকার পর থমকে গেছিল। কারণ ওর চোখ ওর নিজেরই পেন্টিং এর ওপর পরেছিল। ওর বুঝতে বাকি থাকেনি এটা কে এঁকেছে। রিখিয়াকে দেখে বিহান শোয়া থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেছে। রিখিয়া কিছুক্ষণ ঐ পেন্টিং হাত বুলিয়ে চোখের পানি ফেলল। এখন আর ওর মনে কোন সন্দেহ নেই যে এই দুই বছরে বিহান ওকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে। এরপর ও বারান্দায় যায় বিহানে কাছে। এখনো কথা বলেনি ওর সাথে। দীর্ঘ নিরবতার পর রিখিয়া নিজেই বলল,

” কথা বলবেন না আমার সাথে?”

বিহান বাইরে তাকিয়ে রইল কিছু বলল না। রিখিয়া আবার বলল,

” আমি বুঝতেই পারিনি সেদিন অজান্তেই আপনার পুরোনো ক্ষতে আঘাত করে ফেলেছি। কিন্তু এখনতো আপনি বদলে গেছেন। সব ঠিক হয়ে গেছে। আপনি এতো ভালো ছবি আঁকেন। আর ভবিষ্যতে আরও ভালো আঁকবেন। প্লিজ আমাকে__”

বিহান বলল,

” রিখিয়া প্লিজ বারবার ক্ষমা চেয়ে আমায় অস্বস্তিতে ফেলে দিওনা। অন্যায়তো আমি করেছিলাম তোমার সাথে।”

রিখিয়া বিহানের কাঁধে হাত রেখে বলল,

” আমি আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি আপনাকে। মন থেকে। তবে আগে একটা অভিমান ছিল আপনার ওপর। কিন্তু এখন আর সেটা নেই।”

বিহান শান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রিখিয়ার দিকে। এরপর মলিন হেসে বলল,

” তুমি খুব ভালো রিখিয়া। একটু বেশিই ভালো।”

” তাই?”

” হুম। আমার অতীত জেনেও আমার সাথে এতো ভালো করে কথা বলছ। সবার চোখ‍েতো আমি রেপিস্ট।”

রিখিয়া বিহানকে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,

” আমার চোখে নন। সৌহার্দ্য ভাইয়ার মত আমিও নিশ্চিত আপনি এমন কিছুই করেন নি। করতে পারেন না। আই ট্রাস্ট ইউ।”

বিহান নিজের ভেতরের আবেগকে আটকে রাখতে পারল না, শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রিখিয়াকে। রিখিয়াও আলতো হাতে বিহানের পিঠ আকড়ে ধরল। বিহান বলল,

” আই লাভ ইউ।”

রিখিয়া কেঁদে ফেলল বিহানের এই কথায়। কত অপেক্ষা করেছিল বিহানের মুখে এই তিনটে শব্দ শোনার জন্য। আজ মনে হচ্ছে ও সব পেয়ে গেছে। রিখিয়াও আস্তে করে বলল,

” আমিও ভালোবাসি আপনাকে। খুব ভালোবাসি।”

#চলবে….

#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫২
.

বিহান আর রিখিয়া আজ যেন নিজের মধ্যেই নেই। এই দু-বছরের জমানো দুঃখ, অভিমান, অভিমান, ভালোবাসা সব একসাথে বেড়িয়ে আসছে। বেশ অনেকটা সময় একে ওপরকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে দুজনেরই হুশ ফিরলো। রিখিয়ার মনে পরল ও কারো হবু বউ। আর বিহানেরও মনে পরল যে রিখিয়ার আর তিনদিন পর বিয়ে। তৎক্ষণাৎ একে ওপরকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল। কী অদ্ভুত সময়চক্র! অাড়াই বছর যাবত যারা একে ওপরের আড়ালে একে ওপরকে সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে গেছে। তারা আজ নিজেদের অনুভূতি একে ওপরের কাছে স্বীকার করলেও তারা আজ একে ওপরের কাছে থাকতে সংকোচ বোধ করছে। বিহান অনেকটা ইতস্তত করে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” আ’ম সরি।”

রিখিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। এরপর ছুটে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। বিহান ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পুরো ব্যাপারটাতে হতভম্ব হয়ে গেছে ও। ও আর রিখিয়া এতোটা কাছাকাছি ছিল ভাবলেও অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর। ওপরদিকে রিখিয়া অন্য রুমে গিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিলো। কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা ওর জন্যে ঠিক কী ছিল সেটা শুধুমাত্র ওই জানে। কতগুলো দিনের অপেক্ষার ফল ছিল কিছুক্ষণ আগের সেই মুহূর্ত। কিন্তু এই আনন্দ, এই অনুভূতি, এই ভালোবাসার আদোও কোন ভবিষ্যৎ আছে কী? আজ পরিস্থিতি এমন জায়গাতে এসে দাঁড়িয়েছে যে ওদের ভাবতে হচ্ছে এরপর ওরা কী করবে? কী করা উচিত হবে এখন? ওরা কী সত্যিই একে ওপরের হতে পারবে কোনদিন?

___________

রাতে সৌহার্দ্য আর বিহান এক রুমে আর পাশের রুমে তুর্বী আর রিখিয়ার থাকার ব্যবস্থা করে দিল। তুর্বী খেয়াল করল যে রিখিয়া মন খারাপ করে বসে আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। ও মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছে যে বিহান আর রিখিয়ার মধ্যকার সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। এখন এরা দুজন অন্য চিন্তায় চিন্তিত। তুর্বী রিখিয়ার পাশে বসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

” কী হয়েছে?”

রিখিয়া অসহায় দৃষ্টিতে একবার তাকাল তুর্বীর দিকে। আজ রিখিয়ার সত্যিই নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। ও তুর্বীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। তুর্বী অবাক হয়নি। ও খুব ভালো করেই চেনে রিখিয়াকে আর তার আবেগ কে। তাই আলতো করে রিখিয়ার কাঁধে হাত রাখল। রিখিয়া ভাঙা গলায় বলল,

” তুই জানিস উনি আজ নিজের মুখে বলেছে উনি আমাকে ভালোবাসেন। ওনার মুখে এই কথাটা শোনার জন্যে আমি কত ছটফট করতাম। কিন্তু আজ? আজ আমি কী করব?”

রিখিয়া তুর্বীকে ছাড়িয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

” কী করবি মানে? শাফিনকে গিয়ে বলে দিবি যে তুই বিয়েটা করতে পারবি না। ইউ লাভ সামবাডি এলস। সিম্পল!”

” নো, নট সো সিম্পল।আর তিনদিন পর আমার বিয়ে। কার্ড বিলি করা হয়ে গেছে। শাফিন ভাইদের বাড়িতে কাল পরশু থেকে গেস্ট আসতে শুরু করবে। বুঝতে পারছ ব্যাপারটা?”

” বুঝেছি! কিন্তু রিস্ক নিতে হবে রিখু। না হলে কিছুই হবেনা। বিহান এমনিতে অনেক কষ্ট পেয়েছে নতুন করে আর কোন কষ্ট দিস না।”

রিখিয়া দু হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,

” আমাকে ভাবতে হবে। হুটহাট কিছু করতে পারব না আমি।”

তুর্বী একটা হতাশ শ্বাস ফেলে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পরল। আর রিখিয়াও তুর্বীর পাশ দিয়ে শুয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল।

সৌহার্দ্য আর বিহান পাশাপাশি টানটান হয়ে শুয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি সিলিং এর দিকে। দীর্ঘ সময়ের নিরবতা ভেঙ্গে সৌহার্দ্য বলল,

” কী ভাবলি?”

বিহান সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,

” আমার তো এখানে আর ভাবাভাবির কিছু নেই। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোরা ওকে আমার ফিলিং জানিয়েছিস। কাল আবেগের বসে আমিও ওকে বলে দিয়েছি যে ভালোবাসি। ব্যাস! হয়ে গেছে। ও আমার সম্পর্কে আমার অনুভূতি সম্পর্কে ক্লিয়ার। এখন আমার দিক থেকে আমি ক্লিয়ার আছি।”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

” তারমানে তুই এখন কিছুই করবি না?”

বিহান একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

” এখানে এখন আমার আর কিছুই বলার বা করার নেই। আমি রিখিয়ার ওপর আর কোনরকমের মানসিক প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারব না। এমনিতেই সবাইকে ভালো রাখার যাতাকলে অনেক পিসেছে মেয়েটা। আমি ওকে নতুন কোন দ্বিধায় ফেলব না। ইমোশানালি কোন প্রেশার দেবো না। এবার ও সেটাই করবে যেটা ওর মন ওকে করতে বলবে। আমি বা অন্যকেউ না।”

সৌহার্দ্য আর বলার মত কিছুই খুঁজে পেলোনা। ওদের দ্বারা যতদূর করা সম্ভব ওরা করেছে। এবার বাকি কাজ হয় রিখিয়া বিহানকেই। নয়তো কিছুই করার থাকবে না।

____________

শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে শাফিন এর জন্যে অপেক্ষা করছে সৌহার্দ্য, বিহান, তুর্বী, রিখিয়া আর দোলা। শাফিন আসছে রিখিয়া আর তুর্বীকে নিয়ে যেতে আর কিছু কেনা কাটা করার আছে বিয়ের জন্যে। বিহান আর রিখিয়া দুজনেই একদম চুপ হয়ে গেছে। কাল থেকেই কিছু একটা ভেবেই চলেছে ওরা। আর এদিকে তুর্বীর মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে আছে কারণ সকাল সকাল দোলা এসে হাজির হয়েছে ওখানে। এখানো বিয়ের ডেট অবধি ঠিক হয়নি। সব জায়গায় এই মেয়ের হাজির হওয়ার কী আছে? রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ওর। একটু পর পর শুধু আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে সৌহার্দ্যকে কিন্তু কিছুই বলতে পারছেনা। সৌহার্দ্যর সেদিকে খেয়াল নেই। এরমধ্যেই শাফিন চলে এল। তুর্বীর চোখ শাফিনের দিকে পরতেই ও বলে উঠল,

” ঐতো শাফিন ভাই চলে এসছে।”

তুর্বীর কথায় সবাই শাফিনের দিকে তাকাল। শাফিন এসে সৌহার্দ্য, বিহান আর দোলার সাথে হাত মিলিয়ে পরিচিত হল। বিহান শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাফিনের দিকে। এই তবে সেই শাফিন? যে তার প্রেয়সীকে নিজের করে নেবে? রিখিয়ার ওর শুধু তাঁর অধিকার থাকবে। ওর চেয়ে কোন অংশে কম বলা যায় না ছেলেটাকে। ব্যবহারও কী চমৎকার। আচ্ছা রিখিয়াকে কী ওর চেয়েও বেশি ভালোবাসে শাফিন? হয়তো বাসে। না হলে এতোগুলো বছর অপেক্ষা করবে কেন? কিন্তু শুধুমাত্র অপেক্ষার সময় দিয়েই কী ভালোবাসা মাপা যায়? হয়তো যায়! শাফিন রিখিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল,

” তো ম্যাডাম! এবার চলুন!”

রিখিয়া মলিন হেসে হাটা শুরু করল। সবাই মিলে একসাথেই মলে ঢুকলো। তুর্বীর কোনদিকেই মনোযোগ নেই। ওর ফোকাস শুধু সৌহার্দ্য আল দোলার দিকে। ওরা দুজন হাসাহাসি করছে, কেনাকাটা করছে যেটা সাধারণ চোখে দেখলে খুবই নরমাল। কিন্তু তুর্বীর এখন আর এসব মোটেও সহ্য হচ্ছেনা। ও নিজেই এখন বুঝতে পারছে যে ও জেলাস। ওর মনে হচ্ছে সৌহার্দ্যর ওপর শুধু ওরই অধিকার। ওর মানে ওর। সেখানে এই মেয়ে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল? আর বিহানেল দৃষ্টি রিখিয়া আর শাফিনের দিকে। শাফিন রিখিয়ার হাত ধরে রেখেছে। এটা-ওটা বলছে। শাফিন রিখিয়ার হাত ধরে নিয়ে একটা শাড়ির কাছে গেল। শাড়িটা রিখিয়ার গায়ের ওপর দিকে বলল,

” ওয়াও! দারুণ মানিয়েছে। আমাদের বিয়ের পরেরদিক সকালে তুমি এটাই পরবে।”

রিখিয়া একবার তাকাল বিহানের দিকে। বিহান ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ওর চোখে প্রিয়জনকে অন্যকারো সাথে দেখার কষ্টটা স্পষ্ট।

এদিকে হঠাৎ কোন এক কথার মধ্যে দোলা হাসল হাসতে হাসতে সৌহার্দ্য হাত আকড়ে ধরল। তুর্বীর মেজাজ এমনিতেই চটে ছিল আরও চটে গেল। ও সোজা ওদের কাছে গিয়ে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো। কটমটে চোখে সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল। সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। তুর্বী সৌহার্দ্য হাত ধরে টেনে অনেকটা দূরে নিয়ে গেল। এরপর ঝাড়া দিয়ে হাথ ছেড়ে বলল,

” এমনিতেতো এতো আদর্শের কথা বলতে। এখন সেসব কোথায় গেল? বউ হয় ও তোমার? এখনো তো বিয়েও হয়নি এতো ঢলাঢলি কীসের একে ওপরের সাথে। মনে হচ্ছে যেন ওনাদেরই একা বিয়ে হবে দুনিয়াতে আর কারো বিয়ে হবেনা। আর এই? তুমি না আমাকে আমাকে ভালোবাসতে? সব ভালোবাসা এতো দ্রুত শেষ? এবার দেখলে আমি ঠিকই বলেছিলাম? কোনকিছুই চিরকাল থাকেনা। যেমন তোমার ভালোবাসা থাকেনি।”

সৌহার্দ্য এতক্ষণ ভ্রু কুচকে শুনছিল তুর্বীকে। এবার ও একটু হাসল। তারপর এগিয়ে গিয়ে একটু চেচিয়েই বলল,

” কিন্তু তুমিতো ভালো বাসোনি রাইট? তাহলে আমি কার সাথে মিশছি, কার সাথে ঢলাঢলি করছি, কাকে বিয়ে করছি, তাতে তোমার কী? হু আর ইউ? কীসের জোরে বলছো এসব? ভালোবাসো আমাকে? বলো? ভালোবাসো?”

#চলবে…