#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫৫
.
সৌহার্দ্য সম্পূর্ণ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুর্বীর দিকে। তুর্বীর বলা কথাটা যেন ওর কানে বাজছে। ও ঠিক শুনেছে তো? তুর্বী একথা বলল? এটা হতে পারে? ভুল শোনেনি তো? হতেও তো পারে ও হ্যালুসিনেট করছে। ও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তুর্বীর দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
” সরি?”
তুর্বী একটুও দেরী না করে সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
” আমায় বিয়ে করবে?”
সৌহার্দ্য বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। ওর এখনো বিশ্বাসই হচ্ছেনা যে তুর্বী একথা বলতে পারে। যেই মেয়েটা প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাসই করেনা। যে দু-বছর আগেও সৌহার্দ্যকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, বিয়ে করবেনা বলে। সৌহার্দ্যর কোন আকুতি-মিনতি যেই মেয়ের মন গলাতে পারেনি। সে আজ সোজা সৌহার্দ্যকে এসে বিয়ের কথা বলছে? এটা যেকারো পক্ষে বিশ্বাস করা কষ্টকর। এটা সত্যিই তুর্বী তো? ওর মা বলেছিল গ্রামে ভুতের উপদ্রব বেশি থাকে। এটা কোন ভুত-পেত্নী নয়তো? যে তুর্বীর ছদ্মবেশে এসছে? পরক্ষণেই নিজেই নিজেকে মনে মনে বড়সর একটা গালি দিল এরকম উদ্ভট ভাবনার জন্যে। সৌহার্দ্যকে চুপ থাকতে দেখে তুর্বী বলে উঠল,
” কী হলো বল? বিয়ে করবে আমাকে।”
সৌহার্দ্যর মনে হল তুর্বীর শরীর ঠিক আছেতো? সজ্ঞানে বলছে এসব? ও তুর্বীর দিকে দু-কদম এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে আর গলায় হাত রেখে কিছু বলবে তার আগেই তুর্বী বলল,
” আমার মাথা-শরীর সব ঠিক আছে। আমি পাগলও হইনি আর আমাকে ভুতেও ধরেনি। আমি সুস্থ মস্তিষ্কে, সুস্থ শরীরে, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে জানতে চাইছি তোমার কাছে। বিয়ে করবে আমাকে?”
সৌহার্দ্য বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। তুর্বীর এই কথাগুলো শুনে ওর কীভাবে রিঅ্যাক্ট করা উচিৎ সেটাই বুঝতে পারছেনা। ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। তুর্বী সৌহার্দ্যর হাত ধরে বলল,
” তুমিতো বলেছিলে যে তুমি ভালোবাসো আমাকে। তাহলে এতো সময় কেন নিচ্ছো? বলো?”
তুর্বীর কথাটা শুনে হঠাৎ করেই সৌহার্দ্যর পুরোনো ঘা তাজা হয়ে উঠল। কী বলল তুর্বী? সৌহার্দ্য ওকে ভালোবাসে। যখন এই একই কথা সৌহার্দ্য বারবার তুর্বীকে বলেছে তখনতো তুর্বীর কাছে তার কোন মূল্যই ছিলোনা। তবে আজ কেন? কিছু একটা ভেবে হালকা হেসে সৌহার্দ্য বলল,
” তুমি আর বিয়ে? বাহ! তা প্রেম, জেলাসীর পর এবার বিয়ে নিয়ে এক্সপিরিমেন্ট করার ইচ্ছে হল বুঝি? আই নো তোমার জন্যে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু এই অপশনতো তোমার কাছে দু-বছর আগেই ছিলো। হঠাৎ আজ কেন? ও সরি,সরি আমিতো ভুলেই গেছিলাম যে তুমি নিজের মর্জির মালিক। কিন্তু বিয়েটা আমার কাছে কোনো ছেলেখেলা নয়। তাই অন্যকাউকে খুঁজে নাও।”
তুর্বী অবাক হয়ে গেল। সৌহার্দ্য কী বলছে এসব? এক্সপিরিমেন্ট? তাও বিয়ে নিয়ে। এরকমতো ও কোনদিন ভাবেও নি। ও কম্পিত কন্ঠে বলল,
” তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।”
” তাই? তাহলে ঠিক টা কী? তুমিই বল আমাকে? কেন বিয়ে করতে চাও আমাকে?”
তুর্বী এবার সৌহার্দ্যর চোখে চোখ রেখে বলল,
” ভালোবাসি তাই। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
সৌহার্দ্য থমকে গেল। তুর্বীর কথাটা শুনে ওর মস্তিষ্ক জমে গেল একপ্রকার। এটা কী বলে ফেলল তুর্বী? সত্যিই কী এটা বাস্তব? এরকমটা সত্যিই কোনদিন হওয়ার ছিল? বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তুর্বীর দিকে তাকিয়ে রইল ও। তুর্বী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্যর উত্তর না পেয়ে ও বলল,
” অনেক আগে থেকেই বাসি। কিন্তু বড্ড স্টুপিড ছিলাম তাই বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারি। আই লাভ ইউ সো মাচ।”
সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই শব্দ করে হেসে উঠল। তুর্বী ভ্রু কুচকে ফেলল সৌহার্দ্যর হাসি দেখে। কিছুক্ষণ পর সৌহার্দ্য হাসি থামিয়ে বলল,
” সিরিয়াসলি? ভালোবাসো তুমি? তাও আমাকে? তো মিস তুর্বী, ছয় মাস আমার সাথে থেকে, এরপর দুইবছর আমার থেকে দূরে থেকেও যেটা ফিল করতে পারোনি। সেটা হঠাৎ করে এখন ফিল হচ্ছে? আমেজিং! তুমি বলেছিলে না? জগতে কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়। ভালোবাসাও না। তাহলে আজ এসব বলার কোন মানেই হয়না।”
তুর্বী হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” মানে?”
সৌহার্দ্য এবারও তাচ্ছিল্য মাখা হাসি দিয়ে বলল,
” মানে খুব সহজ। আজ তোমার মনে হচ্ছে তুমি ভালোবাসো আমাকে। কী গ্যারান্টি আছে যে হঠাৎ কালকে তোমার এই হঠাৎ জেগে ওঠা অনুভূতি মিলিয়ে যাবেনা? সব ভালোবাসা গায়েব হয়ে যাবেনা? তখন তো তুমি আবার আমাকে ফেলে চলে যাবে। কারণ তুমি তো শুধু নিজের কথাই ভাবো।”
সৌহার্দ্যর কথাগুলো শুনে তুর্বী স্হির হয়ে গেল একদম। সৌহার্দ্যর ওর প্রতি অনেক অভিমান জমে আছে সেটা ও জানতো। কিন্তু ওকে এভাবে বলবে ও ভাবতে পারেনি। সৌহার্দ্যর প্রতিটা কথা আজ ওকে ভেতর থেকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিচ্ছে। তুর্বীর এবার কান্না পেয়ে গেল। ও কান্নামিশ্রিত চোখে তাকিয়ে রইল সৌহার্দ্যর দিকে। আজ সত্যিই কিছু বলার ভাষা নেই ওর। সৌহার্দ্য আবার বলল,
” তুমি ঠিক বলেছিলে তুর্বী। তুমি সমুদ্রের ঢেউয়ের মত। একেক সময় একেক আকার, একেক গতি, একেক প্যাটার্ন। তুমি নিজেও জানোনা তুমি কী চাও। যাই হোক অনেক রাত হয়েছে। যাও গিয়ে শুয়ে পরো।”
তুর্বী শান্ত গলায় বলল,
” আমি কিন্তু আমার উত্তর এখনো পাইনি সৌহার্দ্য।”
সৌহার্দ্য তুর্বীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” আমার পক্ষে আর পেছনে ফিরে তাকানো সম্ভব না। আ’ম সরি।”
বলে সৌহার্দ্য চলে যেতে নিলেই তুর্বী সৌহার্দ্যর হাত খামচে ধরে কেঁদে দিয়ে বলল,
” আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি সৌহার্দ্য। এরকম করোনা প্লিজ। একটা সুযোগ দাও আমাকে। আমাদের বিয়ের পর যদি তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবাসিনা তুমি আমাকে ছেড়ে দিও। আমি কিচ্ছু বলব না। বাট একবার সুযোগ তো দাও। ”
তুর্বীর কান্না সৌহার্দ্যকে ভীষণরকম অস্হির করে তুলল। ও দ্রুত তুর্বীর হাত ছাড়িয়ে বলল,
” বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পরো তুর্বী।”
বলে একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেল ওখান থেকে। তুর্বী ওখানেই বসে পরল আস্তে আস্তে। শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল ও। এরকমভাবে ও শেষ কেঁদেছিল যখন ওর মা মারা গেছিল। সৌহার্দ্যর এভাবে চলে যাওয়াটা ও মানতে পারছেনা কিছুতেই। সত্যিই কী সৌহার্দ্য আর চায় না ওকে? হারিয়ে ফেলবে চিরকালের মতো?অপরদিকে সৌহার্দ্যর চোখেও জল চলে এসছে। ও নিজেও জানেনা ও কেন এসব বলে এলো। আজকের দিনটার জন্যে কত অপেক্ষা করেছিল ও। তুর্বীর মুখে এই কথাগুলো শোনার জন্যে কত অস্হির হয়ে পরেছিল ও। কিন্তু আজ যখন তুর্বী ওকে কথাগুলো বলল তখন তো ওর তুর্বীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলা উচিত ছিল ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি’। কিন্তু ওর মন ওকে বলে উঠল যে, ও কী তুর্বীর হাতের পুতুল না-কি? তুর্বীর যখন মনে হবে ওকে ভালোবাসেনা, তখন ওকে ফেলে চলে যাবে। আবার দুই বছর পর হঠাৎ করে ওর মনে হল যে সৌহার্দ্যকে ভালোবাসে আর ওকে বিয়ে করতে চায়? আর সৌহার্দ্যও এককথায় মেনে নেবে সবটা? কিন্তু সেদিনতো সৌহার্দ্যর কোন অনুরোধ, কোন আকুতি তুর্বীর মন গলাতে পারেনি। সৌহার্দ্য কী এতোটাই সস্তা?
__________
কালকে রিখিয়া আর শাফিনের বিয়ে। সকাল থেকেই পুরো বাড়িতে অনেক মানুষ আর হৈ চৈ। প্রচুর কাজও করতে হচ্ছে তাদের। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। তুর্বী আর রিখিয়া দুজনেই বেশ ভোরবেলা উঠে পরেছে। আসলে দুজনের কেউই রাতে ঘুমাতে পারেনি। দুজনেই সারারাত কেঁদেছে। তবে একে ওপরের আড়ালে, নিঃশব্দে। চোখ লালচে হালকা ফুলে গেছে দুজনেরই। এই নিয়ে অনেকেই অনেক করেছিল কিন্তু ওরা কথা ঘুরিয়ে এড়িয়ে গেছে। সৌহার্দ্য আর বিহান বিকেলের দিকে এলো রিখিয়াদের বাড়িতে। এসে দেখল রিখিয়াকে মেহেদী পরাচ্ছে ওর রুমে আর পাশে তুর্বী বসে আছে। বসার ঘর থেকে ওদের দুজনকেই দেখা যাচ্ছে। তুর্বীকে দেখে চমকে উঠল সৌহার্দ্য। কী অবস্থা করেছে নিজের? চোখ-মুখ একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এতোটা ভালো কবে থেকে বাসতে শুরু করল? মাত্র কয়েকদিনের অবহেলাই ও সহ্য করতে পারছেনা? অথচ সৌহার্দ্যতো আড়াই বছর সহ্য করেছে। তুর্বীর সাথে চোখাচোখি হতেই সৌহার্দ্য সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে কাজে মনোযোগ দিল। তুর্বী ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল শুধু। কেন এমন করছে সৌহার্দ্য? কী হতো ওকে আরেকটা সুযোগ দিলে? একই প্রশ্ন তো ও নিজেকেও করতে পারে। কী হতো সেদিন সৌহার্দ্যকে একটা সুযোগ দিলে? মেহেদী দেওয়া মেয়েটা রিখিয়া জিজ্ঞেস করল, বরের নাম কী? রিখিয়া আনমনেই বিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বিহানের নাম বলে ফেলল। তুর্বীও অন্যমনষ্ক থাকায় খেয়াল করেনি। মেহেদী দিয়ে চলে যাওয়ার পর রিখিয়া তুর্বীকে বলল,
‘ সৌহার্দ্যর সাথে আমি একবার কথা বলব? দেখি আমি বোঝাতে পারি কি-না?”
তুর্বী উদাস চাহনী দিয়ে বলল,
” না, দু-বছর আগে আমি সেটাই করেছিলাম যেটা আমার ইচ্ছে হয়েছিল। আর এবার ওও সেটাই করবে যেটা ওর ইচ্ছে হবে।”
কথা বলতে বলতেই তুর্বীর চোখ পরল রিখিয়ার হাতে। ও অবাক হয়ে বলল,
‘ এটা কী রিখু?’
রিখিয়া হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল কারণ ওখানে বিহানের নাম লেখা। তুর্বী অবাক চোখে কিছুক্ষণ হাতের রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। রিখিয়া হাত দিয়ে লেপ্টে দিতে গেলেই তুর্বী হাত ধরে ফেলে বলল,
” মন থেকে মুছে ফেলতে পারবি?”
রিখিয়া করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুর্বীর দিকে। অসহায় গলায় বলল,
” কেউ দেখলে খুব খারাপ হবে ব্যাপারটা।”
তুর্বী মেহেদীর টিউবটা নিয়ে ‘বিহান’ নামের চারপাশ দিয়ে এমনভাবে ডিজাইন করে দিল যাতে খুব গভীরভাবে না লক্ষ্য করলে বিহান নামটা দেখা না যায়। রিখিয়া বিহানের দিকে তাকিয়ে দেখল যে বিহান ওর দিকেই তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে।
রাতে রিখিয়ার হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হল। স্টেজে একে একে সবাই ওকে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে। খানিকটা দূরে সৌহার্দ্য আর বিহান দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের। বিহান আজ হলুদ শাড়ি আর ফুলের সাজে নিজের ভালোবাসাকে প্রাণভরে দেখে নিচ্ছে। তুর্বীও আজ শাড়ি পরেছে।সৌহার্দ্যর চোখ আজ সরতেই চাইছেনা তুর্বীর থেকে। তুর্বীর মাঝেমাঝে এদিকেই তাকাচ্ছে ফলসরূপ চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। বিহান ব্যাপারটা খেয়াল করে বলল,
” এটা কেন করলি বলতো? সবচেয়ে বেশি কষ্ট তো তুই-ই পাচ্ছিস।”
সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” সব কেনোর উত্তর দেওয়া যায়না।”
বিহান কিছু বলল না। কী আর বলবে? কাল সারারাত অনেক বুঝেয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। বিহান রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” আজ খুব সুন্দর লাগছে ওকে।”
সৌহার্দ্য কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিখিয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটা একদম অনুভূতিহীনভাবে বসে আছে। এমন মনে হচ্ছে একটা পুতুলকে সাজিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ওরা হয়তো একে ওপরের ভাগ্যেই ছিলোনা। বুকে পাথর চেপে হলেও এই সত্যি সবাইকে মেনে নিতে হবে।
আজ বিয়ের আনন্দে সারাবাড়ি মেতে উঠলেও চারটি ভাঙা, বিদ্ধস্ত মন যে নিরবে ধুকে ধুকে মরছে সে খবর সবারই অজানা।
___________
রিখিয়া হলুদের অনুষ্ঠান অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। অনেক রাত হয়েছে এখন। সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। কিন্তু রিখিয়ার বাড়ির সামনের মাটির রাস্তাটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। একদৃষ্টিতে মুক্ত আকাশটা দেখছে। মন বারবার একটাই প্রশ্ন করছে। ওর সাথেই এরকম কেন হল? ওকেই কেন এই পরিস্থিতিতে পরতে হল? তখন পেছন থেকে ওর নাম ধরে কেউ ডাকতেই হালকা চমক উঠল রিখিয়া। পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল বিহান দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো, নাক আর চোখে লালচে ভাব। একদম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ও অবাক কন্ঠে বলল,
” আপনি এখানে?”
বিহান ভ্রু কুচকে বলল,
” এতো রাতে বাইরে কী করছ?”
রিখিয়া উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” ঘরে দম আটকে আসছিল। মরে যাচ্ছিলাম আমি।”
বিহান রিখিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
” তোমাকে একবার দেখার আশায় এসছিলাম। ভাবিনি এভাবে দেখা পেয়ে যাবো। কালকের পর হয়তো আর..”
বিহান আর কিছু বলতে পারল না। ওর গলা ধরে আসছে। রিখিয়া কিছু না বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর চোখ দিয়ে নিরবে জল পরছে। বিহান বলল,
” তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছিল?”
” সাজটা অন্যকারো জন্যে ছিলো?”
” কিন্তু আমিতো তোমারই।”
রিখিয়ার ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছে। দ্রুত ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখতে চাইছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। ভেতরট জ্বলে যাচ্ছে ওর। বিহান কম্পিত কন্ঠে বলল,
” ভালো থেকো রিখিয়া।”
বলতে বলতে নিঃশব্দে কেঁদে দিল বিহান। রিখিয়া আর পারল না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলল বিহানকে। এরপর আওয়াজ করে কেঁদে দিল। বিহান চমকে গেল রিখিয়ার কান্না শুনে। ও রিখিয়ার পিঠে হাত রেখে বলল,
” রিখিয়া কান্না থামাও। সামলাও নিজেকে। কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
রিখিয়া হিঁচকি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” কেন এমন করলেন? কেন? কেন অন্যকারো অন্যায়ের শাস্তি আমায় দিলেন আপনি? আমিতো নিজের সবটুকু দিয়ে আপনাকেই ভালোবেসেছি,তার বদলে একটু ভালোবাসলে কী হত? আর তখন যখন বাসতে পারেন নি, এখন কেন বাসলেন? আমি নিজের কষ্ট করতে পারলেও আপনার কষ্ট সহ্য করতে পারছিনা। আমাকে মেরে ফেলুন প্লিজ। আমি আর পারছিনা সহ্য করতে। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। একদম শেষ হয়ে যাচ্ছি।”
বিহানও রিখিয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। ভাগ্য এতো অদ্ভুত খেলা কেন খেলল ওদের সাথে? একটুও দয়া করা যেতোনা ওদের ওপর? একটুও না?
#চলবে…
#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫৬
.
চারপাশটা স্তব্ধ হয়ে আছে। সবকিছুই কেমন স্হির। আকাশের গোল চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। তার সামনে দিয়ে মাঝেমাঝে ভেসে যাচ্ছে হালকা মেঘের দল। হঠাৎ হঠাৎ নিশাচরের ডাক শোনা যাচ্ছে। রিখিয়া ব্যালকনির রেলিং এর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে রিখিয়া। পরনে লাল বেনারসি, গায়ে কিছু গহনা আছে আর কিছু খুলে রেখেছে, চুল খুলে দিয়েছে। সত্যিই একমুহূর্তই যথেষ্ট সবকিছু বদলে দেওয়ার জন্যে। ওরও জীবনের সবকিছু বদলে একদিনেই। এখন বিবাহিত। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। এখন ওর জীবন জুড়ে গেছে অন্যকারো সাথে। ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিখিয়া। হঠাৎ করেই পেছন থেকে একজোড়া হাত ওকে জড়িয়ে ধরে কাধ থুতনি রাখল। রিখিয়া কেঁপে উঠল হালকা। পরক্ষণেই বুঝতে পারল যে ওকে জড়িয়ে সে ওর স্বামী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিখিয়া নিচু কন্ঠে বলল,
” এতো দেরী করলেন যে?”
” ওই বাঁদরগুলো আটকে রেখেছিল। অনেক করে কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই এসছি। জানো আমি ভাবতেও পারিনি আজকের রাতটা আমার জীবনে আসবে। সত্যিই তুমি পুরোপুরি আমার হয়ে যাবে।”
রিখিয়া হাতদুটো থেকে নিজেকে মুক্ত করে পেছন ঘুরে বলল,
” আমরা স্বার্থপর হয়ে গেলাম, বিহান?”
বিহান রিখিয়ার চোখের দিকে কিচুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি এক হাসি দিল। এরপর ওর দুই বাহুতে হাত রেখে বলল,
” আমারও প্রথমে সেটাই মনে হচ্ছিল। গিল্টি ফিলও করছিলাম প্রচুর। কিন্তু শাফিনের সাথে কথা বলার পর বুঝতে পারলাম যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, সবার জন্যে।”
রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,
” শাফিন ভাইর সাথে কথা হয়েছে তোমার?”
বিহান পকেট থেকে একটা কাগজ বেড় করতে করতে বলল,
” হ্যাঁ। তোমার জন্যে একটা চিঠি আছে। শাফিন দিয়েছে।”
বলে ভাজ করা একটা কাগজ রিখিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো। রিখিয়া অবাক হয়েই কাগজটা নিয়ে আস্তে করে ভাজ খুলে পড়তে শুরু করল;
‘রিখিয়া
প্রথমে তোমার কাছে ক্ষমা চাইঙছি। ভালোবাসার মানুষটার চোখের জলের কারণ হওয়া মস্ত বড় অন্যায়। আমার জন্যে তোমাকে এতোটা কাঁদতে হবে সেটা কখনও ভাবতেই পারিনি। সত্যিই অন্যায় করে ফেলেছি। তবে এটা ঠিক যে তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছি। কিন্তু তোমার ভালোবাসার পাল্লা সবসময়ই ভারি ছিল। আমারই ভুল ছিল যে তোমার মন পড়তে দেরী করে ফেলেছি। বিহান তোমাকে মাত্র দুবছর যাবত ভালোবাসলেও ওর ভালোবাসা একদম খাটি। আমি তোমাকে মন থেকে অনেকটা সময় ধরে ভালোবাসলেও আমার ভালোবাসায় কিছুটা হলেও খুঁত ছিল। তোমার মনে প্রশ্ন উঠত না? তোমার ভাই কেন আমার সাথে তোমার বিয়ে দিতে এতো ইন্টারেস্টেড ছিল? তুমি হয়তো জানোনা আমি তোমার বড় ভাইকে বড় মাপের এমাউন্ট অফার করেছিলাম তোমাকে যেকোন মূল্যে রাজি করানোর জন্যে। আমার মনে কোন খারাপ উদ্দেশ্য না থাকলেও আমার বেছে নেওয়া পদ্ধতি ভুল ছিল। আমি তোমাকে পাওয়ার মূল্য নির্ধারণ করেছিলাম, কিন্তু বিহান তা কখনও পারত না। ও তোমাকে এতোটা ভালোবাসার পরেও বিন্দুমাত্র ইমোশনাল প্রেশার ক্রিয়েট করেনি তোমার ওপর। তুমি যাতে দোটানায় না ভোগো, কষ্ট না নাও তাই তোমার কাছে নিজের ভালোবাসার প্রকাশটুকু করতে চায়নি। কী ভাবছ? আমি কীকরে জানলাম? কাল রাতে বিহানকে বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে খুঁজতে বেড়িয়েছিলাম ওকে। আর তোমাদের ওভাবে দেখে আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে বিহানই তোমাদের সেই ভালোবাসা। তোমাদের কথপোকথন আর কান্না দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে কতবড় ব্লান্ডার হতে যাচ্ছিল। আর বাড়ি ফিরে আসার পর সৌহার্দ্য আর বিহানের কিছু কথাও শুনেছি আমি। আমি জানি তুমি সবার কথা ভাবো কিন্তু নিজের কথা না। তুমি জানতে আমার বাবা এমপি। আর আজ আমার বিয়ে তোমার সাথে না হলে আমার বাবার সম্মান নষ্ট হবে। ফ্যামিলির রেপুটেশন খারাপ হয়ে যাবে। তাই কত অনায়াসে নিজের সব সুখ ত্যাগ করে দিচ্ছিলে। আর তোমার পাগল প্রেমিকও। কিন্তু আমি কীকরে এতো স্বার্থপর হই বলোতো? যাকে ভালোবেসেছি তার সারাজীবনের কষ্টের কারণ কীকরে হই? তাই যেটা করেছি একদম ঠিক করেছি। ভালো থাকবে তুমি। বিহান তোমাকে আমার চেয়েও ভালোরাখবে। তবে ভেবোনা তোমার বিরহে আমি সারাজীবনে কষ্টে মরব। এতোগুলোদিন আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম এইজন্য নয় যে আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। কারো জন্যে কেউ মরে যায়না। আমি এইজন্যই অপেক্ষায় ছিলাম যাতে পরে আমাকে আফসোস করেতে না হয় যে আমি অপেক্ষা করিনি। কিন্তু আজ আমার কোন অফসোস নেই। আমি নিজের মনকে এখন বোঝাতে পারব যে আমি অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার ভাগ্যে ছিলেনা। আর ভাগ্যের ওপর কারো হাত থাকেনা। তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে। এতে কারো দোষ নেই। তাই যদি মন থেকে কখনও আমায় বন্ধু ভেবে থাকো একফোটাও অপরাধবোধে ভুগবে না। প্রমিস রইল কিন্তু। বিহানকে ভালো রেখো। অনেক অনেক শুভকামনা তোমার জন্যে।
ইতি
তোমার অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী”
চিঠিটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিখিয়া। সত্যিই শাফিন ওর অন্যতম একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। আজ শাফিন ওর জন্যে যা করেছে তার ঋণ ও কোনদিন শোধ করতে পারবেনা। করতে চায়ও না। কিছু মানুষের কাছে ঋণী থাকতে ভালোলাগে। আজ সকাল থেকেই রিখিয়ার বিয়ের তোরজোড় চলছিল। তুর্বী আর সৌহার্দ্য দুজনেই হতাশ হয়েছিল। ভেবেই নিয়েছিল আর কিছুই সম্ভব নয়। রিখিয়া আর বিহান গত রাতেই নিজেদের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে একেওপরের থেকে অনেক দূরে সরে এসছিল, অনুভূতিহীন হয়ে পরেছিল। রিখিয়াকে গোসল করাতে নেবে তখনই হল সমস্যা। শাফিন রিখিয়াদের বাড়ি এসে সোজসাপ্টাভাবেই বলে দিল ও রিখিয়াকে বিয়ে করবে না। সবাই বেশ অবাক হয়েছিল শাফিনের এমন কথায়। উপস্থিত সকলেই হতভম্ব। পেছন পেছন শাফিনের পরিবারও এসছে। সবাই কানাঘুষা করছে। কেউ কেউ শাফিনকে নানারকম প্রশ্ন করেছে। শাফিন এরপর ওর রিখিয়া আর ওর পরিবারকে সবার আড়ালে করে বসিয়ে।সবাইকে শান্ত করে এরপর সত্যি সত্যি সবটাই খুলে বলে দিলো। রিখিয়া-বিহান, সৌহার্দ্য তুর্বী চারজনই ভীষণ অবাক হয়েছে। শাফিন সবটা কীকরে জানলো কীকরে? সবটা শোনার পর রিখিয়ার বাবা-মা প্রচন্ড আফসোস করলেন। রিখিয়াকে বকলেনও। নিজের এরকম ক্ষতি কেউ করে? রিখিয়ার বাবা তো বলেই দিলেন, ওনার মেয়ের খুশিই ওনার জন্যে সব। ওনার মেয়ের বিয়ে বিহানের সাথেই হবে। শাফিনের বাবা নিজের মানসম্মানের কথা ভেবে একটু ঝামেলা করেছিলেন কিন্তু শাফিনের জেদের সাথে পেরে উঠলেন না। অনেক তর্ক আর আলোচনার পর অবশেষে এটাই ঠিক হল যে আজ রিখিয়া আর বিহানের বিয়ে হবে। সৌহার্দ্য আর তুর্বীর বুক থেকে একপ্রকার পাথর নেমে গেল। সৌহার্দ্য তো শাফিনকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। তুর্বীও রিখায়াকে জড়িয়ে ধরে হেসে দিয়েছিল। কিন্তু রিখিয়া আর বিহান তখনও ঘোরের মধ্যে ছিলো। ওদের কাছে সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। আর যখন ওরা স্বাভাবিক হল, তখন মনে মনে ভীষণ খুশি হলেও একটা গিল্টি ফিলিংও হচ্ছিল শাফিনের জন্যে। এরপর বেশ আনন্দের সাথেই রিখিয়া আর বিহানের বিয়েটা হয়ে যায়। পুরোটা সময় শাফিন বেশ হাসিমুখেই ছিল। সেই হাসির পেছনে হয়ত একবুক কষ্টও ছিল। তবে বিহান রিখিয়ার কাছে পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা মিরাকল। ওরা কখনও ভাবেনি ওদের সাথে হঠাৎ এমন কিছু হতে পারে। বিদায়ের পর রিখিয়াকে নিয়ে ওরা বিহানের ফ্লাটেই এসে উঠেছে। সাথে সৌহার্দ্য তুর্বীসহ শাফিন আর আরও কিছু বন্ধু বান্ধবী এসছে।
বিহানের ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে রিখিয়া। বিহান রিখিয়ার কপালের চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল,
” মন খারাপ করোনা। আজ যদি তোমার বিয়েটা শাফিনের সাথে হয়ে যেতো। না তুমি ভালো থাকতে না শাফিন। সেটা শাফিনের কথায় আজ বুঝেছি আমি। শুধু আমরা উইশ করতে পারি, যাতে ওর জীবনে এমন কেউ চলে আসে যে ওকে ভীষণ ভালোবাসবে আর ভালোরাখবে।”
রিখিয়া মাথা নাড়ল। বিহান বিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” আমার কাছে এখনো সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছে জানো? কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি। তুমি আমার স্ত্রী। যেখানে কাল অবধি আমি তোমাকে হারানোর যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। গুমরে মরছিলাম। আমি ভাবতেও পারিনি যে__”
রিখিয়া মুচকি হেসে বলল,
” আল্লাহ যা করেন সবার ভালোর জন্যে করেন। হয়তো আমাদের দুজনের এই কষ্ট পাওয়াটা দরকার ছিল। এই কষ্টটাই হয়তো আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা একে ওপরকে কতটা চাই। তাই দেখুন, ভুল করে হলেও আমার হাতে আপনার নামের মেহেদীই পরেছি।”
বিহান রিখিয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে রিখিয়ার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করে দিও। অনেক কাঁদিয়েছি তোমাকে। অনেকটা কষ্ট দিয়েছি।”
রিখিয়া মুখ হালকা ফুলিয়ে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আর কখনও কষ্ট দেবেন না তো?”
” কখনও না। কথা দিচ্ছি সারাজীবন বুকে আগলে রাখব।”
” জানেন আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো যে মরে__”
বিহান সাথেসাথেই রিখিয়ার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল,
” চুপ! আজকের রাতে এসব কথা একদম বলবেনা। আজকের রাতটা আমাদের জন্যে অনেক স্পেশাল। অনেকটা সাধনার পর পেয়েছি একে ওপরকে। তাই এই রাতটা বিশেষ হওয়া খুব জরুরি, খুব।”
শেষের কথাটা রিখিয়ার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল বিহান। রিখিয়া লজ্জা পেয়ে গেল হঠাৎ করেই। সাথেসাথেই বিহানকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল। বিহানও শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল নিজের প্রিয়তমাকে। আজ মনের সব দুঃখকে মুছে ফেলে আজ এক হওয়ার পালা। নতুন যাত্রা শুরু করার পালা।
___________
অনেকটাই রাত হয়ে গেছে। সৌহার্দ্য ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বিহান আর রিখিয়ার বিয়েটা এভাবে হয়ে যাওয়াতে ও ভীষণ খুশি হয়েছে। অবশেষে ওর ভাইটার জীবনে কেউ তো এসছে, যে ওকে ভালো রাখবে। কিন্তু এইমুহূর্তে মন খারাপও কম হচ্ছেনা। আজ সারাদিন এত আনন্দের মধ্যেও তুর্বীর ফ্যাকাশে মুখটা ওর সহ্য হচ্ছিলো না। যতই অভিমান থাকুক, ওতো ভালোবাসে মেয়েটাকে। মেয়েটা যে কতটা কষ্ট আছে সেটা ও জানে। ও বুঝে গেছে এবার তুর্বীর অনুভূতিগুলো একদম খাঁটি। আচ্ছা? অভিমানটা আর না করলে হয়না? এতে কার লাভ হচ্ছে? ও নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। জীবনকে তো আরো একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। তাইনা? এসব ভাবতে ভাবতেই তুর্বী এসে দাঁড়াল ওর পাশে। কিন্তু সৌহার্দ্যর দিকে না তাকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। সৌহার্দ্য আড়চোখে একবার তাকিয়ে থেকে বলল,
” ঘুমাও নি?”
তুর্বী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ঘুম আসছিল না।”
সৌহার্দ্য কিছুই বলল না। তুর্বী নিজেই বলল,
” আজ সত্যিই মিরাকল হল তাইনা? সত্যিই ভাবিনি রিখু আর বিহানের বিয়েটা এভাবে হয়ে যাবে। সবটাই স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।”
সৌহার্দ্য একটু হেসে বলল,
” সবটাই শাফিনের জন্যে হয়েছে। ওই ছেলেটার কাছে আমরা সবাই ঋণী। তবে সত্যি বলতে ওরা একে ওপরের ভাগ্যে লেখা ছিল। তাই শেষ মুহূর্তে এসে সবটা বদলে গেল।”
তুর্বীর সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
” আর আমরা?”
সৌহার্দ্য হালকা চমকে উঠল। কী বলবে ও? ওর মনতো চাইছে তুর্বীকে। কিন্তু বলতে পারছেনা। তারওপর কালকে ওসব কথা বলার জন্যে মনে মনে গিল্টি ফিলিংস ও হচ্ছে ওর। সৌহার্দ্যকে চুপ থাকতে দেখে তুর্বীর মন আবার কেঁদে উঠল। ও কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
” সৌহার্দ্য আমি জানি আমাদের সম্পর্ক চলাকালীন ঐ ছ-মাস আমি তোমাকে অনেক আঘাত করেছি। কিন্তু আমাকে কী আর একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি কথা দিচ্ছি আমি আর কখনও ওমন ছেলেমানুষী করব না। তোমাকে কষ্টও দেবোনা। আই লাভ ইউ সৌহার্দ্য।”
সৌহার্দ্য রেলিং শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ওর গলা কাঁপছে। কিন্তু কিছুই বলল না। বেশ অনেকক্ষণ সৌহার্দ্যর কাছে কোন উত্তর না পেয়ে ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” আমি যখন ছোট ছিলাম। তখন দেখতাম মা-বাবার মধ্যে দারুন বন্ডিং ছিল। এমন মনে হতো যেন একে ওপরের প্রাণ। একদম মেড ফর ইচ আদার ইউ নো। কিন্তু মা মারা যাওয়ার ঠিক একসপ্তাহ পর বাবা আরেকজন মহিলাকে নিয়ে বাড়িতে এলেন। তার সাথে একটা বাচ্চা। মজার ব্যাপার ছিল যে ঐ ছেলে আমার বাবারই ছিল। মানে উনি আমার মা জীবিত থাকতেই দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। সব বিশ্বাস, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সেদিনই চলে গেল। সেদিন প্রথম মনে হয়েছিল যে ভালোবাসা বলে কিছুই হয়না। সবটাই সাময়িক আবেগ। কাউকেই বিশ্বাস করা যায়না। সবাই ঠকায়। তাই আবেগ জিনিসটা বিসর্জন দিয়েছিলাম। সেটাই করতাম যা ভালোলাগত। কোন কিছু শুরু করার আগে এক্সপিরিমেন্ট করে দেখলাম যে সেটা আমার জন্যে কেমন হবে। ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিণত হল। কিন্তু তুমি আমায় বুঝিয়েছ যে ভালোবাসা কী হয়, বিশ্বাস কী হয়, সম্পর্ক কী হয়। আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়ে মাঝরাস্তায় এভাবে একা ফেলে যেওনা সৌহার্দ্য। আমি নিতে পারব না।”
সৌহার্দ্য স্তব্ধ হয়ে শুনছিল এতক্ষণ। মেয়েটার মনেও যে এরকম একটা ক্ষত আছে ও জানতোই না। সত্যিই একটা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ থাকে।অনেকটা সময় হয়ে গেল কেউ কিছুই বলছে না। দুজনের মনই ছটফট করছে। সৌহার্দ্যর দিক থেকে কোন উত্তর না পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুর্বী চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য হাত ধরে ফেলল। তুর্বী অবাক চোখে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” আমি তোমাকে এক্সেপ্ট করতে পারব না।”
তুর্বীর দৃষ্টি অসহায় হয়ে উঠল। চোখ দিয়ে জল পরবে ভাব। সৌহার্দ্য বলল,
” আমি সেই তুর্বীকেই চাই। যেই তুর্বীর অদ্ভুত কথা শুনে আমার মন ভালো হয়ে যেত। যে কাউকে পরোয়া করতো না। যে সারাদিন হেসে খেলে বেড়াতো। আমি আমার সেই মিস ভয়ংকরীকে চাই।”
তুর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বলল,
” তো মিস তুর্বী? উইল ইউ বি মাই মিসেস ভয়ংকরী?”
তুর্বী চোখের জল ছেড়ে দিল। হেসে সৌহার্দ্যকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই সৌহার্দ্য হাত দিয়ে বাধা দিয়ে বলল,
” আ..আ। আরেকটা কথা। এসব এক্সপিরিমেন্ট করা আর চলবে না। এটা জীবন, সাইন্স ল্যাবরেটরি না।”
তুর্বী হেসে দিয়ে সৌহার্দ্য বুকে কিল মারল। সৌহার্দ্য হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরল সৌহার্দ্যকে। তুর্বীর মনে হল ওর সকল না পাওয়া পাওয়ায় পরিণত হল। এখানেই ওর চির শান্তি।
বিচ্ছেদ, বিরহ, কষ্ট, যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে পুড়ে ওদের চারজনের ভালোবাসা আজ খাঁটি হয়ে গেল। জীবনের লড়াইয়ের চারজনকই পেল জলফড়িঙের খোঁজ।
#চলবে…