জল ফোয়ারা পর্ব-১০

0
193

#জল_ফোয়ারা |১০|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan

১৪.
বলা হয় কখনো মন থেকে কিছু চাইলে উপরওয়ালা ফিরিয়ে দেয়না, শুধুমাত্র খুব করে চাইতে হয়। মুগ্ধও হয়তো খুব করে চেয়েছিলো নুর ভালো হয়ে যাক তাইতো সবাই আশা ছেড়ে দিলেও ও সম্ভাবনার সূক্ষ্মতর সুতোর টান আঁকড়ে ধরে ছিলো সযত্নে!তাই হয়তো নুর ভালো হওয়ার লক্ষণ দেখানো শুরু করলো সৌহার্দ্য আসার তিনমাস পর, ততোদিনে সৌহার্দ্যের ট্রান্সফার হালিশহরে হওয়ার সকল ব্যবস্থা শেষ। মাঝে সৌহার্দ্য কিছুদিনের জন্য ফিরে যেতে বাধ্য হলেও সব শেষে আবার ফিরে এসেছে, মাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু উনি সবটা জানতে পারলে তুমুল কা!ণ্ড বাজাবেন তা ওর খুব ভালো করে জানা, কোন এক অজানা কারণে ওর এই এলাকায় আসা কিংবা নাম নেয়াও ওর পরিবারের পছন্দের ছিলো। যদিও এখনকার কথা ওর জানা নেই কিন্তু রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। ওখানে কেয়ারটেকারসহ মা কিছুদিন আরাম করুক তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নিবে। আপাদত নুরের ভালো হয়ে ওর সবচেয়ে বড়ো ভাবনা।

এদিকে মাঝে একবার নুরের সাথে ওকে দেখে মুগ্ধ বেশ রে!গে গিয়েছিলো,ওর বন্ধুরা থামিয়েছে তাকে একপ্রকার জোর করেই মুগ্ধকে সেখান থেকে নিয়ে যায়, বিষয়টা নুরের মস্তিষ্কে খুব বড়ো ছাপ ফেলেছে তা ওর জানা ছিলো না।
আরো প্রায় তিনদিন পর ওরা দুজন সেই কাশফুল বাগানে নিরিবিলি বসে ছিলো, মাঠের কাশফুল তখন প্রায় পুষ্পহীন। এ কথা ও কথার মাঝেই নুর হঠাৎ বলে উঠলো

“ভাইয়ার সাথে তোমার সব মিটমাট হয়েছে তোমার?”

সৌহার্দ্য না বুঝে শুরুতে মাথা নাড়লেও কিছুক্ষণ পর চোখ বড়বড় করে তাকালো, সাবধানে ধীরেধীরে বললো

“তুমি কি করে জানলে মুগ্ধর সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে?”

নুর বেরসিকের মতো তাকালো, হাত দুটো নাড়িয়ে বললো

“ওদিন না আমার সামনেই লেগে গেলে? সত্যি বলতে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম, ভাগ্যিস ভাইয়া বাসায় যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করেনি তোমার সাথে কি করছিলাম! হুট করে কি হলো তোমাদের মাঝে?”

সৌহার্দ্য এতো দ্রুত খুশি হতে পারলো না, আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য কোমল কন্ঠে বললো

“তোমার মনে আছে তাহলে?”

নুর চোখ ছোটছোট করে বললো

“এই আবার আমাকে অপমান করছো? দুদিন আগের ঘটনা ভুলে যাবো কেনো?”

সৌহার্দ্য এরপর আর কিছু বললো না, নুরকে আরো কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসলো। এড্রেস নিয়েছে ওর বন্ধু আনিসের কাছ থেকে, ওর বন্ধুরা ওর ফিরে আসা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। হয়তো আগের মতো গলাগলি করার মতো সম্পর্ক নয় কিন্তু সবাই ওকে সাদরে গ্রহণ করেছে শুধুমাত্র মুগ্ধ ছাড়া। হয়তো নিজের বোনের বিষয়টা বিজড়িত না হলে ওকে সবার পুর্বে মুগ্ধই গলায় জড়িয়ে নিতো, এই শহর ছেড়ে যাওয়াতে শুধু ভালোবাসা নয়, নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকেও হারিয়েছে ও।

ড.নিলার চেম্বার মেইন শহরের প্রাইভেট হাসপাতালে, তিনি এলাকার নামীদামী নিউরোলজিস্ট। নুরের পাশে মুগ্ধকে না দেখে তিনি অবাক হলেও চেহারায় প্রকাশ করেননি বরং নুরের চেকাপে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। টেস্ট রিপোর্ট আসার অপেক্ষায় দুজন বাইরে বসেছিলো, নুর তখন ফিসফিসিয়ে বললো

“তুমিও কি শুরু করলে বলো তো? ভাইয়াও এনার কাছে নিয়ে এসেছিলো, এখন দেখছি তুমিও। উফফ ভালো লাগে না আমার!”

সৌহার্দ্যের ঠোঁট প্রসারিত হলো কথাগুলো শুনে, প্রগ্রেশন! নুর নতুন তথ্য ধীরেধীরে গ্রহণ করছে। এই খবর শোনার পর ওর চেয়েও বেশি খুশি হবে মুগ্ধ, ওকে সহ্যই করছে একমাত্র নুরের জন্য নাহয় মুগ্ধ সত্যিই ওকে এলাকা থেকে বের করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। সবকিছু মনে করার পর নুরের কি রিয়াকশন হবে ও জানেনা, কিন্তু ও মন থেকে চায় নুর সুস্থ হয়ে যাক। আর তার জন্য ও সব করতে রাজি।

ভাবনার মাঝেই ডাক্তারের কেবিনে ডাক পড়লো, নুর পাশের নার্সের ছয়মাসের বাচ্চা নিয়ে খেলছে বলে ওকে আর কেবিনে নিয়ে গেলো না। ডাক্তার নিলা ওকে দেখেই মুচকি হেসে বললো

“আপনি নিশ্চয় তুষার? আপনার ব্যাপারে কিছু কথা শুনেছি”

সৌহার্দ্য থমকে গেলো, সবকিছুর মাঝে এ কথা ও ভুলেই বসেছিলো যে যদি চিঠিগুলো নুর না পাঠায় তবে কে পাঠিয়েছে? বিষয়টা নিয়ে খটকা থাকলেও এখন তা কিছুটা পরিষ্কার। এ বিষয় পরে ভাবা যাবে ভেবে ও ডাক্তারের কথায় মনোযোগ দিলো। উনি রিপোর্ট দেখা শেষে শান্ত গলায় বললেন

“নুর আমার রেগুলার পেইশেন্ট, প্রায় ছয়বছর ধরে আমি ওর সাহায্য করার চেষ্টা করেছি কিন্তু লাভ হয়নি। এই প্রথম হয়তো ও আশার আলো দেখিয়েছে। আমি জানি না আপনি কতোটুকু জানেন কিন্তু ওর হিপ্পোক্যামপাস এ ম্যাজর ক্ষ!তি হয়েছিলো। আজ রিপোর্টে দেখলাম তা কিছুটা স্নায়ুকোষের সাথে সংযুক্ত হওয়া শুরু করে দিয়েছে, তার মানে ধীরেধীরে ওর ডান হিপ্পোক্যামপাস হিল করা শুরু করেছে। সত্যি বলতে সঠিক সেবা আর ঔষুধে এটা নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায় কিন্তু নুর এক্সেপশন কে!ই*স ছিলো। এতোবছর পর সেটা আবার নিজে নিজে কাজ করা শুরু করছে তবে পরিবর্তন খুব স্বল্প। যা করছেন আপনি তাই করতে থাকুন, কিন্তু কোনভাবেই ওকে স্ট্রেস দেয়া যাবে না নাহয় হিতে বিপরীত হবে। ওর মস্তিষ্ক উদ্বেগহীন হওয়া প্রয়োজন, তাহলেই ও জোর করে সব ভুলে যেতে চাইবে না বরং সব মেনে নিতে চেষ্টা করবে।”

সৌহার্দ্য মাথা নাড়লো, অন্তত কিছু তো পরিবর্তন এসেছে তাতেই ও খুশি। ডাক্তার ঔষুধ পরিবর্তন করে সবটা বুঝিয়ে দিলো, প্রয়োজনে নুরকে মেডিটেশন করানোর পরামর্শ দিলো। সবশেষে বেরিয়ে যাবে তখন ডাক্তার নিলা সহানুভূতিশীল স্বরে বললো

“আমি নুরকে অনেকবছর ধরে দেখছি কিন্তু এই প্রথম মনে হলো ওর হাসি জোরপূর্বক নয়। যেনো যেই পাযেল ও খুঁজে বেড়াচ্ছিলো তার অবশেষে খোঁজ পেয়েছে। অন্তত শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমি চাইবো ওর চোখের হাসি হারিয়ে না যাক, ওর মস্তিষ্ক কখনোই আগের মতো সচল হবে না। তাই দ্বিতীয় হার্টব্রেক নেয়ার মতো ক্ষমতা ওর নেই, আশাকরি ওর তুষার এতোটুকু খেয়াল রাখবে ওর। ওকে হারাতে দিবেন না আর প্লিজ!”

সৌহার্দ্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, নুরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো পরিচিত গন্তব্যে। নুরকে এলাকার কিছুদুরে রাস্তায় নামিয়ে গন্তব্যহীন রাস্তায় গাড়ি চালাতে লাগলো। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয়টার বেশি বেজে গেলো, রোহিণী থাকায় অদিতার ওকে খুব একটা মনে পড়েনা। মেয়েটা ওকে একপ্রকার ভুলেই থাকে, এতে কিছুটা উপকার হয়েছে বটে। ওর পুরো মনোযোগ নুরের ভালো হওয়ার উপর যদিও ওর মেয়েকে ও মিস করে খুব। অদিতার জন্য কিছু চকলেট আর আইস্ক্রিম নিয়েছে আজ তাই, উদ্দ্যেশ্য অনেকক্ষণ খেলবে আর কথা বলবে অদির সাথে। বাসায় ঢুকবে তার পুর্বেই কেউ একজন হাত চেপে ধরে পাশের গলিতে নিয়ে গেলো। কিছু না বলেই হাতে ধরিয়ে দিলো চিরচেনা সেই খাম, সৌহার্দ্য একনজর তার দিকে তাকিয়ে সেটা হাতে নিলো।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর মুগ্ধ নিরস কন্ঠে বললো

“তোদের সম্পর্কের কথা আমি নুরের এ!ক্সি*ডে!ন্টের একমাসের মাথায় জানতে পারি। প্রথম প্রথম দেখতাম নুর একই স্থানে একইভাবে রোজ যেতো কিন্তু দিনশেষে মন হয়ে বাসায় ফিরে আসতো। ভাই হিসেবে সেই দৃশ্য বহুকষ্টের ছিলো দেখা। এদিকে ডাক্তারের কথামতে ওকে একা ছাড়া ব্যতীত উপায়ও নেই। তখনই সব খুঁজতে তুষার নামের এক ছেলের অনেকগুলো চিঠি পাই। অনেক খোঁজ নেয়ার পর শৈকত ভুলে আমাকে বলে দিলো সেটা তুই কারণ ও তোকে চিঠি লিখতে দেখেছে কিন্তু কিছু বলেনি। তখনই আমার হাতে এলো নুরের লিখা অনেকগুলো চিঠি যার একটিও তোকে পাঠায়নি, আসলে পাঠায়নি এমন না। যেহেতু তোরা বাড়ি বিক্রি করেছিস তাই বাড়ির নাম আর হোল্ডিং নাম্বার পরিবর্তন হওয়ায় সেই চিঠিগুলো ফেরত এসেছিলো। নুর সেগুলো নিজের কাছেই রেখেছিলো আর কিছু ছিলো ওর ডায়েরীর পাতায়। ওর মস্তিষ্কে প্রেসার না দেয়ার জন্য আমি সব ওর রুম থেকে সরালেও নিজের কাছে গুছিয়ে রাখি। তোর প্রতি রাগ আর ঘৃণা তীব্র হচ্ছিলো ডে বাই ডে, তাই তোকে যেকোনো মূল্যে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম।কিন্তু দিনশেষে আমি নুরের ভাই, ওর ভালো থাকা আমার কাছে সবকিছু। ডাক্তার যখন বললো ওর তোকে প্রয়োজন তখন তোর খোঁজ নিলাম আর পেয়েও গেলাম বহুকষ্টে। কিন্তু এতোসহজে আমি তোকে ফিরিয়ে আনতে চাইনি, তুই যা করেছিস তার জন্য একটু হলেও খারাপ লাগা কাজ করা দরকার তাই ওই চিঠিগুলো আমি পাঠিয়েছি এটা বুঝানোর জন্য যে তুই যতোই উপরে যাস না কেনো, কারো হৃদয় ভাঙ্গার দায়ভার থেকে চাইলেও বের হতে পারবি না। আর দেখ অপরাধবোধ তোকে কোথায় নিয়ে এলো!”

মুগ্ধ কথাগুলো বলে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো, সিগারেট জালিয়ে তার ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে বললো

“এটা ওর ডায়েরীতে লিখা শেষ কিছু কথা, সবগুলো চিঠি তোর কাছে পৌঁছে আমি আমার দায়িত্ব শেষ করেছি। আশা করি তুই একটু হলেও বূঝবি কাউকে কষ্ট দিয়ে নিজে ভালো থাকা যায়না!”

সৌহার্দ্য মুগ্ধর কথায় কান না দিয়ে চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করলো

“প্রিয় কোন এক শুভ্রির তুষার,

তোমার কাছে পাঠানো চিঠিগুলো একে একে আমার কাছে ফিরে এসেছে এই বাণী নিয়ে যে তুমি সত্যিই বহুদুরে হারিয়ে গেছো, আমার লিখা চিঠিগুলো তোমার কাছে আর পৌঁছাবে না কখনোই। আমার কথাগুলো তুমি আর শুনবে না। ভাবছো তাহলে এই লিখাগুলো লিখছি কেনো? কারণ আমার জানা নেই। শুধু কলম হাতে তোমার কথাই মনে হলো আজকের দিনটায়। আজকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিয়েছি, দীর্ঘ একবছর অপেক্ষা করার পরও তুমি যখন ফিরে এলে না তখন আমার আর কোন উপায় ছিলো না, কোন বাহানা ছিলো না দেয়ার। প্রস্তাব যারা পাঠিয়েছে নাকি অনেক বড়োলোক। আমার ছবি দেখেই ভালো লেগেছে, শুভকাজে দেরি করতে চায়না। ছেলে শিক্ষিত এবং পরিচিত বলে ভাইয়া অমত করেনি আর মা বলেছে এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না কিন্তু রাজি হওয়ার পর আমার গলায় যে বেড়ি পড়লো? শ্বাস নিতে পারছিনা।মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে ফেলছি নিজেকে, ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেনো?”

ফোঁটা ফোঁটা কলমের কালি দেখে মনে হলো নুর আরো অনেককিছু লিখতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছে খুব সহজে। বেশ কয়েক লাইন ফাঁকা রেখে ছোট ছোট অক্ষরে লিখা,,,

“তুমি হয়তো কখনো জানতেই পারবে না আমার সংসার হয়েছে, আমি এখন অন্যকারো। এতো ব্যস্ততার ফাঁকে তোমার কি আর সময় হবে? আমি ভেবেছি নিজেকে সুযোগ দিবো আবার, কেউ কাউকে ছাড়া ঠিক মরে যায়না আর আমিও বেঁচে থাকবো। যদি কখনো আমাদের দেখা হয়, আমি সবচেয়ে সুখী মানুষ হিসেবেই তোমার সামনে যেতে চাই। এই কষ্টগুলো ভুলে যাবো তখন, শুধু সুখের মুহুর্তগুলো কোন এক বিকেলবেলা চায়ের কাপের সাথে স্মরণ করবো ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে। তোমায় ভেবে তখন আর কষ্ট পাবো না”

অদ্ভুতভাবে নুরের মনের আশা পুর্ণ হয়েছে, এখন পর্যন্ত সব কষ্ট ভুলে অদ্ভুত এক লুপের মাঝে আটকা পড়েছিলো বারংবার। সেই লুপের শেষ কোথায়?
সৌহার্দ্য চিঠিটা নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, আইস্ক্রিম এতোক্ষনে গলে হয়তো পানি হয়ে গিয়েছে কিন্তু সেদিকে আর মনোযোগ দেয়া হলো কই? শেষ চিঠির শব্দগুলো আওড়াতেই তো ব্যস্ত সে, একা একা নিঃশব্দে…

#চলবে…