#জামাই_শ্বশুর
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১
“সামান্য একটা রাস্তার জন্য তুমি তোমার মেয়ের জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিতে পারো না, বাবা। আমি ওই চেয়ারম্যানের ছেলেকে বিয়ে করব না। জেনে-বুঝে তুমি কীভাবে এমন একটা প্রস্তাব দিতে পারো?”
গ্রামের মধ্যখানে থাকা পথ বন্ধ হয়ে আছে প্রায় একশো বছর ধরে। মূলত ওই রাস্তার ওপর জেনিফারের বাবা ওমায়ের আলী ঘরবাড়ি গড়ে নিয়েছেন নিজের মতো করে। এতে করে গ্রামের পূর্বদিক দিয়ে যে কবরস্থান ও স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটা আছে, সেটা সম্পূর্ণ ব্লক হয়ে গেছে। গ্রামের মানুষের সুবিধা ও অসুবিধার কথা ভেবে নিজের বন্ধুবান্ধব নিয়ে, গ্রামের একজন সচেতন পুরুষ হয়ে ওই রাস্তার জন্য ইউনিয়নে দরখাস্ত জমা দিয়েছে মেহমাদ। শুধু ইউনিয়নেই নয়, গোটা উপজেলাকে সে নাড়িয়ে দিয়েছে ওই একটা লিখিত কাগজ ও কয়েকজন সাক্ষীর জোরে। কিন্তু, সমস্যা তৈরী করেছেন ওমায়ের আলী। তিনি কিছুতেই বাড়ি ভেঙে গ্রামের মানুষের রাস্তা তৈরী হতে দিবেন না। মেহমাদ যতই উপরমহলে দৌড়াদৌড়ি করুক, তার সব কাজ আটকে দিচ্ছেন ওমায়ের আলী, নিজের একটা ফোনকল দিয়ে। কারণ তিনি এলাকার বর্তমান এমপি। তার এক ফোনে পুলিশের গোটা বাহিনী বাড়িতে চলে আসে পাহারা দিতে। এদিকে মেহমাদ দৌড়াতে দৌড়াতে পুরোটাই ক্লান্ত। এই একটা রাস্তা যদি ক্লিয়ার না হয়, অনেক মানুষের প্রাণনাশ হবে। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের। স্কুলে যাওয়ার পথ বন্ধ হওয়াতে অনেকেই নদীপথে স্কুলে যাচ্ছে। এতে করে অনেক ছোটো ছোটো শিশু কখনও নৌকা থেকে পড়ে যাচ্ছে, পড়ে গিয়ে নদীর তলদেশে হারিয়ে যাচ্ছে। আবার নদীর পর যে বিশালাকার সড়ক আছে, সেখানেও প্রতিদিন কারও না কারও অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে। আবার বেশিরভাগ সময় ওইপথে নদী পেরিয়ে সহজেই গ্রামে ডাকাত ঢুকছে। ঘরবাড়ি ভাংচুর করে মানুষজন মেরে চলে যাচ্ছে। সময়মতো পুলিশও আসছে না। কোনো সমাধান হচ্ছে না। কেউ অসুস্থ হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া যাচ্ছে না। মানে, একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে। এতে করে গ্রামের পশ্চিমদিকের মানুষদের জীবন প্রায় অতিষ্ঠ। কখনও মৃত মানুষকে গোরস্থানে নিয়ে যেতে সে-ই লাশটাকে নিয়ে পর্যন্ত ওই নৌকা দিয়েই টেনে নিতে হচ্ছে, নয়তো পুরো গ্রাম চক্কর দিয়ে উল্টোপথে যেতে হচ্ছে। এতসব সমস্যায় অতিষ্ঠ হওয়া গ্রামের মানুষজন একটা রাস্তার জন্য মৃতপ্রায় প্রাণ নিয়ে ওই গ্রামেই পড়ে আছে। কিন্তু তারপরও রাস্তা ক্লিয়ার হচ্ছে না।
ওমায়ের আলীর একটাই কথা, যেহেতু ঘরবাড়ি তৈরী হয়ে গেছে, সেসব তিনি আর ভাঙবেন না। এখন গ্রামের মানুষ মরুক কী বাঁচুক, তাতে তার কিছু যায় আসে না। তা-ই তিনি চুপ থেকে মেহমাদের কাজ দেখলেন এবং গুটি উল্টাতে আইনের লোকেদের ঘুশটুশ খাইয়ে নিজের দলে টেনে নিলেন। এদিকে মেহমাদের বাবা নিজেও ওমায়ের আলীর বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। এ পর্যন্ত যতটুকু চেষ্টা তিনি করেছেন, সব চেষ্টাকেই এই লোকটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। আর শেষপন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছে মেহমাদকে। খুব গোপনে, গ্রামের লোকজনের আড়ালে চেয়ারম্যানের বাড়িতে এসে তিনি যখন বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, মেহমাদ এক গর্জন দিয়ে ওখানেই তাকে কাঁত করে দিল। ফলে তিনি নিজেও কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। কারণ এই ছেলেকে হাতের মুঠোয় আনা অনেক কঠিন কাজের একটা। এজন্য তিনি ভেবেছেন, যদি মেয়ের জামাই করে, কোনোভাবে নিজেদের দলে টেনে নিতে পারেন, তাহলে রাস্তা নিয়ে মেহমাদ আর কিছুই বলবে না। তখন সে তার আঙুলের ইশারায় উঠবে এবং বসবে। যেহেতু বেকার ছেলে, টাকা হাতে পেলে সে যেকোনো সময় খেলার পুতুল হয়ে যাবে, এটা নিশ্চিত।
বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান হওয়ার পর ওমায়ের আলী নিজের মেয়েকে বুঝাচ্ছিলেন, কীভাবে এই রাস্তার কাজ আটকাবেন। মেহমাদ যদি না থামে, তাহলে এই রাস্তা হবেই। হতে বাধ্য, কারণ এটা সরকারি রাস্তা। আর তার হাতেও জোর কম। যতটুকু আছে, ততটুকু না-ই হয়ে যাবে এবারের ইলেকশনের পর। এলাকার মানুষজন উঠেপড়ে লেগেছে, অন্যজনকে এমপির আসনে বসাতে। যদিও তিনি বেশিরভাগ সময় শহরে থাকেন, কিন্তু তবুও এই বাড়ি বাঁচাতে তিনি জান-প্রাণ দিয়ে লড়তে রাজি। এজন্য তিনি যথেষ্ট ভয়ে, উপায়ন্তর না পেয়েই প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন মোশাররফ হোসেনের কাছে। তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। কারণ তার প্রস্তাব শুনেই মেহমাদ মুষ্টিবদ্ধ হাতকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ভীষণ চড়া গলায় বলেছিল, “আপনার মতো দুর্নীতিবাজ মানুষকে এই বাড়ির আঙিনায় অ্যালাও করেছি শুধু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। আর একটা বাজে কথা যদি আপনি বলেছেন, তাহলে এর ফল ভোগ করতে হবে আপনাকে। আপনি জানেন না, এই এক রাস্তার জন্য আমি ঠিক কোথায় কোথায় যেতে পারি। দ্বিতীয় বার যদি এই কথা বলার সাহস আপনি দেখান, কীসের বলে এত বাহাদুরি করছেন, সেটাও একদিন জনগণের সামনে টেনে আনতে বাধ্য হব।”
এইসব কথা জেনিফারকে বলার পর, সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাবার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। সেইসাথে বকে যাচ্ছে মেহমাদকে। যদিও ওই বান্দাকে সরাসরি দেখার সাহস হয়নি, শুধু তার ফেসবুক পেইজটা নিয়মিত নিউজফিডে আসে দেখে, তার একটু-আধটু সাহসিকতা ও বাঁদরামির খবর সে জানতে পারছে। তাইবলে এখন ওই হাড়েবজ্জাত ছেলেকে বিয়ে করতে হবে? অসম্ভব! এইবলে আবারও যখন জেনিফার চেঁচিয়ে উঠল, মেয়েকে থামাতে ওমায়ের আলী বললেন, “আমি তো ভেবেছি, জামাই বানিয়ে ও’কে আমার দলে টেনে নেব।”
“অসম্ভব! আমি ও’কে বিয়ে করছি না। তুমি এক কাজ করো, রাস্তার ঝামেলাটা মিটিয়ে নাও। কতটুকু আর জায়গা? মাত্র ত্রিশ ফুট। ওইটুকু জায়গা ছেড়ে দিলে তোমার লস হবে না। প্লিজ বাবা, রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ভেজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করো। এমনিতেই গ্রামের মানুষজন তোমাকে নিয়ে নেগেটিভ কথাবার্তা বলে। আমার খুব খারাপ লাগে।”
“এটা তো সম্ভব নয় রে, মা। মেহমাদ যে ভুল, সেটাও আমি বুঝিয়ে দিব। শত বছরের বন্ধ রাস্তা আমি কোনোভাবেই ঘর ভেঙে বের করতে পারব না। ওইদিকে দেখ, ওই সীমানায় তোর লাগানো ফুলের গাছগুলো এখনও কত যত্নের সাথে বেড়ে উঠছে। যদি আমি ওই অংশটুকু ছেড়ে দিই, তাহলে এখানে যত ফুলের গাছ আছে, সব পিষে ফেলবে ওরা। সেইসাথে তোর রুম ও বেলকনিও ভাঙা পড়বে। আবার চওড়া ত্রিশ ফুট হলেও পথটা কিন্তু অনেক দীর্ঘ। এই দীর্ঘ পথের মালিকানা শুধু আমার। আর কারও না।”
জেনিফার মন খারাপ করে নিজের যত্নেগড়া বাগানের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার কাছে অনুরোধ করছি বাবা, রাস্তার দখলদারি ছেড়ে দাও। অনেকগুলো মানুষের জীবন বেঁচে যাবে।”
“আহা, তুই বুঝতে পারছিস না জেনি, মেহমাদকে বিয়ে করলেই…।”
“আর একবার ওই কথা বললে আমি এখুনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব।”
সিদ্ধান্ত জানিয়ে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেল জেনিফার। ওমায়ের আলী বাড়ির বিশাল বড়ো উঠোনের সামনে পায়চারী করতে করতে নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষকে দিয়ে আবারও বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
***
ঘরে বসে মেহমাদ যখন বাবার সাথে আলোচনা করছিল, ঠিক কীভাবে এক চান্সে দেয়ালটা ভেঙে দিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করবে, তখুনি চেয়ারম্যানের পিএস সুমনের ফোনে একটা কল এলো। সে ঝটপট কলটা বাড়িয়ে দিল, মোশাররফ হোসেনের দিকে। তিনি দরাজগলায় সালাম দিলে ওপাশ থেকে ওমায়ের আলী সালামের জবাব দিয়ে বললেন, “আমি একটু মেহমাদের সাথে কথা বলতে চাই।”
মোশাররফ হোসেন হাতের ফোনটা মেহমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলে ওমায়ের আলীর প্রথম কথায় তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। এরপর মনে মনে একটা ছক সাজিয়ে স্পষ্টকণ্ঠে বলল, “আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করব।”
আবারও ফোনটা বাবার দিকে বাড়িয়ে দিলে, মোশাররফ হোসেন কিছু বলার আগেই, ওমায়ের আলী মহানন্দে বিয়ের কথা একেবারে পাকাপাকি করে, দিনতারিখ ঠিকঠাক করে বললেন, “তাহলে ওই কথাই রইল বেয়াই সাহেব। বিয়ে আগামী শুক্রবারেই। ঠিক আছে?”
মোশাররফ হোসেন কোনো প্রতুত্তর না করেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ছেলের শক্ত হয়ে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “কী হয়েছে? ওই লোকটা কী এমন বলল যে, তুমি এক কথাতেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে?”
মেহমাদ গোপনে সব রাগকে সংবরণ করে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল, “তেমন কিছু না। ওসব আমার ওপর ছেড়ে দাও। আর গ্রামবাসীদের জানাও যে, আগামী শুক্রবারেই জেনিফার তাবাসসুমকে জীবনসঙ্গী করতে যাচ্ছি।”
পিএস সুমন নিজেও হতবাক হয়ে বলল, “এসব কী বলছেন ভাই? মাথা ঠিক আছে আপনার?”
“মাথা ঠিকঠাক, ব্রেইনও ঠিকঠাক। লোকটা আমাকে চিনে না। সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হব, টেরও পাবে না।”
কথা শেষ করে মুহূর্তের মধ্যেই হাওয়া হয়ে গেল মেহমাদ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে এলো নদীরপাড়ে। একটা নৌকা সবে নদী পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহমাদ পাড়ে দাঁড়িয়ে নৌকার ভেতর চেক করে, গ্রামের কিশোরী মেয়ে বকুলকে বলল, “কোথায় যাচ্ছ?”
বকুল মুচকি হেসে বলল, “শহরে যাচ্ছি, ভাইজান। একটা কাজের অফার এসেছে। বেতন অনেক ভালো। আম্মাকে নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারব। আগে ওখানে গিয়ে কাজ ধরি, এরপর আম্মাকে নিয়ে যাব।”
কপালের সবকটা শিরা-উপশিরাকে ফুলিয়ে মেহমাদ বলল, “নৌকা থেকে নেমে সোজা বাড়ি যাবে। এখুনি চাকরিতে জয়েন করতে হবে না। আগে পড়াশোনা শেষ করো, তারপর কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে।”
কিশোরী বকুল বলল, “নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, চাকরি না থাকলে এত পড়াশোনা করে লাভ কী, ভাইজান? আর রাস্তাঘাটের যা অবস্থা! এই গ্রামে থাকাই তো কঠিন।”
“আমি জানি বকুল। আমাকে এত কথা শেখাতে হবে না।”
ঝটপট পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বকুলের হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিয়ে মেহমাদ বলল, “যাও, বাড়ি যাও। চাকরির ভূত মাথা থেকে তাড়াও। চাচীকে বলো, কিছু লাগলে আমাকে যেন ফোন করে।”
“কিন্তু আপনি এত টাকা পেলেন কোথায়? চাকরি তো করেন না।”
কিশোরী বকুলের বোকাসোকা কথাতে হেসে ফেলল মেহমাদ। সে যে এত বছর শহরে থেকে পড়াশোনা করেছে, এটা গ্রামের সবাই জানলেও তার চাকরি সম্মন্ধে সবাই-ই অজ্ঞাত। শুধু ঘরের লোক জানে, তার পেশা কী! আপাতত বকুলের এই কথার জবাব মেহমাদ এড়িয়ে গিয়ে বলল, “চুরি করে এনেছি। ভালো করিনি?”
“কী যে বলেন না আপনি। নিশ্চয়ই চাচাজান দিয়েছেন।”
“ঠিক ধরেছ। এটা বাবাই দিয়েছে। এখন বাড়ি যাও তো। চাচী অপেক্ষা করছে বোধহয়।”
যাচাই-বাছাই না করেই বাড়ির পথে রওনা দিল বকুল। মেহমাদ মাঝিকে নৌকা ছাড়ার অনুমতি দিয়ে নদীরপাড়ে বসে থেকে আকাশ দেখল, পাখি দেখল, সুর্যাস্ত দেখতে দেখতে কচি ঘাসের বুকে মাথা হেলিয়ে দিয়ে অনেকক্ষণ ওখানেই চোখবুঁজে পড়ে থাকল। শেষবেলা পাখিদের সাথে নীড়ে ফিরে এলো।
***
মেহমাদ ও জেনিফারের বিয়ে, এই খবর শোনে গ্রামের প্রত্যেকটা আশাবাদী মানুষ হতাশায় ডুবে গেল। তাদের কারও ভাবনাতেই ছিল না, মেহমাদ এমন করে পালটি খাবে। যদিও এই সময়ে মেম্বার-চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সরকারি চাকরিজীবী প্রত্যেকটা পেশার মানুষকে সরকার ভালোই সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, সেই সুযোগে এখন মেহমাদও যে সরকারের নিকটাত্মীয় হতে যাচ্ছে, এটা ভেবেই লোকের মুখ থেকে হতাশার বাণী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে। সুমনের মাধ্যমে সব কথা কানে এলো মেহমাদের। সে শুধু দাঁতে দাঁত চেপে সব কথা হজম করে গেল। চেনা-পরিচিত যে কয়জন মেহমাদকে বিশ্বাস করতেন, সবাই এসে হতাশার গুঞ্জন তুলে কানের ভেতর পোকা ঢুকিয়ে দিলেন। প্রত্যেকের মুখে একটাই কথা, “মেহমাদ, তীরে এসে তরী ডুবিয়ে দিতে পারো না। একমাত্র তুমিই পারো, গ্রামবাসীর এই বিপদে তাদের হয়ে লড়তে। আমরা জানি, তুমি আর যাই করো, অন্যায়কে সাপোর্ট করবে না। তাই প্লিজ, এই বিয়েতে রাজি হয়ো না। তুমি জাস্ট ফেঁসে যাবে।”
কথাগুলো ভীষণই যৌক্তিক। মেহমাদকে ফাঁসানোর এটা একটা ছোট্ট টোপ ওমায়ের আলীর। তবে এত সহজেই তাকে জিততে দিবে না সে। গুটি কীভাবে উলটে দিতে হয়, সেটা সে খুব ভালোমতোই জানে। তাই উপস্থিত সবাইকে আশ্বস্ত করে বলল, “আপনাদের টেনশনের কোনো কারণ নেই। আমার ওপর আপনাদের বিশ্বাস যেহেতু আছে, কিছুদিন সময় দিন। কেমন করে শত্রুকে পরাস্ত করতে হয়, সেটা আমি খুব ভালোমতোই জানি। তাই আমি আপনাদের অনুরোধ করব, যতদিন না আমি আমার কথা রাখছি এবং রাস্তাটা ক্লিয়ার করতে পারছি, ততদিন আমাকে সময় দিন। যদি আমি সেটা না পারি, তখন যা শাস্তি দিবেন, সেটাই মাথা পেতে নেব।”
এমন কথা শোনে মুরব্বি একজন বললেন, “যদি না পারো, যদি রাস্তা না হয়, যদি শেষ পর্যন্ত তুমিও ওই এমপির দলের একজন হয়ে যাও, তখন কিন্তু তোমাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। আর বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কেমন হতে পারে, তুমি বোধহয় কল্পনাও করতে পারছ না।”
মেহমাদ সামান্য হেসে বলল, “যার জন্য করি চুরি, সে-ই বলে চোর। আপনারা এত অধৈর্য্য কেন বলুন তো? এতদূর এসে, এই শেষমুহূর্তে ওমায়ের আলী কেন এই টোপটা ফেলেছে, সেটাও তো দেখতে হবে আমাকে। তাই নয় কী? সবসময়, তর্জন-গর্জন করে সমস্যার সমাধান করা যায় না। মাঝেমধ্যে বুদ্ধিও খাটাতে হয়। কোনো কাজে জয় লাভ করতে হলে শক্তি এবং বুদ্ধি, দুটোরই কিন্তু প্রয়োজন পড়ে।”
কিছুটা আশা নিয়ে মুরব্বিরা চলে গেলে নিজের রুমের ভেতর পায়চারী করতে করতে সুমনকে ডাকল মেহমাদ। সুমন এসে বলল, “কিছু লাগবে?”
“জেনিফারের নম্বর আছে?”
“নেই।”
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওর নম্বর আমার চাই, সুমন।”
“দিচ্ছি ভাই, আপনি একটু অপেক্ষা করুন।
পাঁচ মিনিটের আগেই কীভাবে যেন জেনিফারের নম্বর জোগাড় করে ফেলল সুমন। এরপর সেটা মেহমাদের ফোনে তুলে দিয়ে, মোবাইল হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। মেহমাদ ফোনটা কানে ঠেকিয়ে, অপেক্ষায় রইল ওপাশ থেকে কোনো একটা শব্দের।
রিসিভ হওয়ার পরপরই মাধুর্যজড়ানো কণ্ঠে সালাম ভেসে এলো। মেহমাদও জবাব দিল। পরক্ষণেই গুছানো শব্দগুলো এলোমেলো হয়ে যাওয়াতে চুপ করে রইল। ওপাশ থেকে জেনিফার বলল, “আপনি কে বলছেন?”
“ইফতেখার হোসেন বলছি।” ভীষণ থেমে থেমে উত্তর দিল মেহমাদ।
“স্যরি, চিনতে পারিনি।”
ফোন কানে নিয়ে সবসময় ইফতেখার হোসেন বলাটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অভ্যাসের কারণে ভুলেই গেছে, এই এলাকার সবাই তাকে মেহমাদ নামে চিনে। নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বলল, “আমি মেহমাদ।”
ফোনের এপাশ-ওপাশে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। কেউ-ই কোনো কথা খুঁজে পেল না আর। অনেকক্ষণ চুপ থেকে মেহমাদ বলল, “আপনার বাবার সিদ্ধান্ত শুনেছেন নিশ্চয়ই?”
“জি…। কিন্তু আমি রাজি নই।” স্পষ্ট স্বীকারোক্তি জেনিফারের।
মেহমাদ জানত, উত্তরটা এমনই হবে। কিন্তু সে এখন নিরুপায় ও ভীষণই অসহায় এক বান্দা। যার একটা সৎ পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্তের মধ্যে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো মানুষের জীবন। তা-ই নিজের অসহায়ত্ব লুকিয়ে বলল, “আমার নিজেরও মত নেই।”
“তাহলে বিয়েটা হবে কেন?”
“কারণ, এই বিয়ে হলে গ্রামের অনেক মানুষের উপকার হবে।”
“এতে আবার কার কী উপকার হবে?” বিরক্ত জেনিফার প্রশ্ন ছুঁড়ল।
“সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আজ দেব না। সময় বলবে, কার উপকার হচ্ছে।”
“বাবা আপনাকে ফাঁসাতে চাইছে। প্লিজ, এই বিয়ে ভেঙে দিন।”
“আমি জানি, আমি খুব বাজেভাবে ফেঁসে গিয়েছি। কিন্তু তারপরও, আমার কাছে এইমুহূর্তে গ্রামের প্রত্যেকের জীবনের মূল্য বেশি। তাই আমি চাইছি, বিয়েটা হোক।”
“আপনি বাবাকে চিনেন না।”
“আপনার বাবা আমাকে চিনেন না।” বলে নিঃশব্দে হাসল মেহমাদ।
শব্দবিহীন এই হাসিও যেন দখিনা বাতাসের মতো ছুঁয়ে গেল জেনিফারকে। সে ত্যক্তবিরক্ত কণ্ঠে বলল, “আপনার মতো বেকারকে বিয়ে করে লাভ কী?”
“আপাতত লাভ-ক্ষতির হিসেবে যাচ্ছি না। তবে ভবিষ্যতে যদি মনে হয় যে, এর হিসেব দেয়া উচিত, তখন দেখাব লাভ আসলে কী হলো আর কতটুকু হলো। সাথে ক্ষতিটাও দেখিয়ে দেব।”
এতসব কথায় মোটেও গলে গেল না জেনিফার। স্পষ্টকণ্ঠে বলল, “আমি আপনাকে বিয়ে করছি না, মেহমাদ।”
আরও কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেলে একসময় অসহায় কণ্ঠে মেহমাদ ডাকল, “জেনিফার…।”
চেনা নেই, জানা নেই, মেহমাদ সম্পর্কে খুব বেশি ধারণাও মনে নেই। তা-ও মন কেমন ছলকে উঠল জেনিফারের। থমকানো কণ্ঠে বলল, “বলুন…।”
“একটা পথ খোলা আছে।”
“কী?”
“দেখুন, আমরা কেউ-ই এই বিয়েটা মন থেকে মেনে নিব না। কাজ না হওয়া পর্যন্ত, আপনার বাবার চোখের সামনে আমরা স্বামী-স্ত্রী সেজে থাকব। এরপর সমাধান হয়ে গেলে ডিভোর্স নিয়ে নিব।”
“বিয়েটাকে ছেলেখেলা মনে হচ্ছে আপনার?”
“এছাড়া আর কোনো উপায় নেই, জেনিফার। আপনার বাবাকে আরও কাছ থেকে জানতে, তার খুব কাছাকাছি পৌঁছাতে হবে আমাকে। এরজন্য আপনার সাহায্য আমার দরকার। আমি কথা দিচ্ছি, যতদিন এই নামমাত্র সম্পর্কে আমরা জড়িয়ে থাকব, আমি আপনাকে ছোঁবোও না। দেখুন, এই সামান্য একটা অনুরোধ রাখলে আমি গোটা গ্রাম এবং গ্রামের মানুষকে বাঁচাতে পারব। মানুষ কতটা অসহায় আপনি জানেন না।”
জেনিফার এবার রয়েসয়ে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। এক বেকারের গলায় ঝুলে যদি গ্রামের মানুষ শান্তি পায়, তাহলে তা-ই হোক। তবে একটা কথা মনে রাখবেন…।”
“কী কথা?”
প্রশ্ন শোনে কী বলতে চাইছিল, সেটাই ভুলে গেল জেনিফার। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়ে চুপ করে রইলে মেহমাদ বলল, “কী মনে রাখতে হবে, বলুন? ডিভোর্সের দিন পর্যন্ত মনে রাখব।”
জেনিফার কথা ঘুরিয়ে বলল, “এরপর কি ভুলে যাবেন?”
মেহমাদ স্পষ্টতার সাথে জানাল, “এরপর মনে রেখে কী হবে? আমরা তো আর সারাজীবন একই ছাদের নিচে থাকছি না।”
“সেটাই কথা।”
“তাহলে? কী বলতে চান বলে ফেলুন।”
“যদি কথার নড়চড় হয়, আপনি কঠিন শাস্তি পাবেন।”
মেহমাদ এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, “হায় আল্লাহ, কী দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি দেখুন তো! মানুষের উপকার করতে যাচ্ছি না কি শাস্তির বোঝা মাথায় নিতে যাচ্ছি কে জানে! মানুষগুলো এত স্বার্থপর… ধ্যাৎ।”
এবার জেনিফারও হেসে ফেলল। হাসিমুখেই বলল, “লাভ-ক্ষতির হিসেব যেহেতু সময় বলবে, দুর্ভাগ্য না কি সৌভাগ্য সেটাও সময় বলবে। এখন রাখি? আমার কিন্তু আর কিছু বলার নেই।”
“আমারও আর কিছু জানার নেই।”
মোবাইলটা বালিশের একপাশে রেখে দিয়ে অন্তহীন ভাবনায় ডুবে গেল মেহমাদ। তার সেই ভাবনায় দুনিয়ার সব যৌক্তিক ও অযৌক্তিক বিষয়াদি ভীড় জমাল। সেইসাথে ওমায়ের আলীর চেহারাটাও ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। দাঁত কটমট করে বিড়বিড়াল, “ওমায়ের আলী, আপনি জানেন না কাকে মেয়ের জামাই হিসেবে পেতে যাচ্ছেন। একবার শুধু বিয়েটা হোক, ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’ দেখে জামাই-শ্বশুর সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত ঠিক কোথায় গিয়ে কোনদিকে মোড় নেয়, গোটা দেশ সেটা দেখবে।”
***
চলবে…