জামাই শ্বশুর পর্ব-০৩

0
260

#জামাই_শ্বশুর
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৩

ওয়ালিমার দিন সকাল থেকে মেহমাদ লাপাত্তা। ঘুম থেকে উঠে কোথায় যে গিয়েছে, কেউ কিচ্ছু জানে না। জেনিফার নিজেও টের পায়নি কিছু। পাওয়ার কথাও না। সেই যে রাতে কথাবার্তার ইতি টেনে ঘুমিয়েছিল, সেই ঘুম ভেঙেছে সকালে, তা-ও বাড়ির কাজের মেয়ের ডাকে। এরপর শাশুড়ি মা এসে মেহমাদের খোঁজ জানতে চাইলে, জেনিফার তখন চোখেমুখে হতভম্ব ভাব ফুটিয়ে তুলে বলেছিল, “উনি ঘরে নেই?”

নিজে যে এত বেখেয়ালি ও উদাসীন আগে বুঝেনি জেনিফার। এই প্রথমই টের পেল তার ঘুম কত গাঢ় আর সে কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন। তবে কারও সামনেই তাকে এত লজ্জা পেতে হলো না। দিনের প্রথম ভাগে সমস্ত লজ্জার হাত থেকে মেহমাদের ছোট্ট ম্যাসেজই তাকে বাঁচিয়ে দিল। ফোন হাতে নিয়ে যখন কল করতে যাবে, স্ক্রিনে দেখল ম্যাসেজ শো করছে। তাতে লেখা – “একটা জরুরী কাজে শহরে যাচ্ছি। ফিরতে সন্ধ্যা হবে।”

ম্যাসেজটা শাশুড়ি মাকে দেখালে তিনি দুঃশ্চিতাগ্রস্থ মলিন চেহারায় নির্ভার হাসি ফুটিয়ে তুলে বউমাকে বলেছিলেন, “ফ্রেশ হয়ে নাশতা শেষ করো। পার্লার থেকে পরিচিত মেয়ে একটা আসবে। তোমার সাজগোজ কমপ্লিট করতে হবে।”

শাশুড়ি মায়ের আদেশে নাশতা খেতে গিয়েছিল জেনিফার, অথচ খাওয়া হয়নি। অকারণ দুঃশ্চিন্তা ও নানান প্রশ্নের মেলা মন-মাথায় কিলবিল কিলবিল করছিল, তা-ই শুধু চা-ই খেয়েছে। রেজি সুলতানা জোর করেও বেশিকিছু খাওয়াতে পারেননি।

জেনিফারের সাজগোজ শেষ হলো, গ্রামের মানুষজনকে যত্ন ও সম্মানের সাথে খাওয়ানোর পর্বটাও শেষ হলো, দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যে নেমে এলেও মেহমাদ ফিরেনি। ফোনটাও রিসিভ করছে না। টেনশনে রেজি সুলতানা শ্বাস নিতেও ভুলে যাচ্ছেন। একটাই ছেলে, কোথাও গিয়ে বিপদ বাড়িয়ে ফেলল না তো? অস্থির ও অশান্ত মন নিয়ে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “মেহমাদ কোথায়?”

সমস্ত মেহমানদের যথেষ্ট সম্মানের সাথে বিদায় দিয়ে মাত্রই মোশাররফ হোসেন ইজি চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বন্ধ চোখের পাতায়ও যে নানান চিন্তা ভিড় করছে, সেটা আর কেউ না বুঝলেও রেজি সুলতানা ঠিকই বুঝতে পারেন। তা-ও প্রশ্ন না করে শান্তি পাচ্ছিলেন না দেখে, বিরক্ত করতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

স্ত্রীর প্রশ্ন শোনে মোশাররফ হোসেন চোখ মেলে তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, “চলে আসবে এখুনি। চিন্তার কিছু নেই।”

“তুমি জানো, ছেলে কোথায়?”

“আমি-ই পাঠিয়েছি।”

“কেন?”

“দরকার ছিল, তা-ই।”

“সারাদিন ধরে ওর চিন্তার আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি আর তুমি এখন বলছ, চলে আসবে এখুনি? এই কথা কি আমাকে আগে বলা যেত না?”

রাগে ও অপমানে রেজি সুলতানার মুখটা থমথমে হয়ে গেল। তিনি দাঁড়িয়ে থেকে শুধু ফুঁসছিলেন। মোশাররফ হোসেন স্ত্রীর চেহারার পরিবর্তন দেখে সামান্য হেসে বললেন, “সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম, নিজের চোখেই দেখেছ।”

“ওয়ালিমার দিনে ছেলেটাকে বাইরে না পাঠালে হচ্ছিল না? মানুষজন কত কী ভাববে এটা নিয়ে? ওর সম্মানের কথা একবারও ভাবলে না? যে কাজই পড়ুক, সেটা কাল করত।”

স্ত্রীর অগোচরে একটা দীর্ঘশ্বাস গিলে নিয়ে মোশাররফ হোসেন বললেন, “কাল গেলে অনেক দেরী হয়ে যেত।”

“কী এমন হতো?”

“সময় এলে জানতে পারবে। এখন যাও, ছেলের জন্য খাবার রেডি করো। বউমাকেও ডাকো। সারাদিন ধরে না খেয়ে আছে নিশ্চয়ই।”

না খেয়ে থাকার মেয়ে জেনিফার নয়, কিন্তু অচেনা এই জায়গায় মানিয়ে নিতে যেমন সময় লাগছিল, তেমনই পেটের ক্ষিধের কথাও বাড়ির লোকজনকে জানাতে দ্বিধা হচ্ছিল। তারমধ্যে একটা সংকোচ বাসা বাঁধল এইভেবে যে, স্বামী বাসায় নেই, স্ত্রী কীভাবে খায়? গ্রামের মানুষজন এমনিতেই নেগেটিভ কথাবার্তা ছড়ায় বেশি, এটাও ছাড় দিত না কেউ। যার কারণে পেটে অনেক ক্ষিধে থাকা সত্ত্বেও না খেয়ে রুমে বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে জেনিফার।

***

সারাদিনে গ্রামের মানুষ ও চেনা-পরিচিত আত্মীয়স্বজনের নানান সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে জেনিফারকে। এরকম একটা অনুষ্ঠানে মেহমাদ নেই, এই একটা কথা নিয়ে নেগেটিভ গুঞ্জন শুরু হয়েছিল সকাল থেকে, এখনও থামেনি। বাড়িতে যে-ই আসছে, সে-ই নতুন কনেকে না খুঁজে, শুরুতেই প্রশ্ন করছে, “বর ছাড়া এ আবার কেমন ওয়ালিমা? চেয়ারম্যান সাব কী শুরু করলেন এসব?”

যদিও ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলে নিয়েছেন মোশাররফ হোসেন, তবুও জেনিফারের মনটা খারাপ হয়েই রইল। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও যখন মেহমাদ ফিরল না, তখন তার নিজেরও এই আয়োজনকে তামাশা মনে হলো। এরমধ্যে তার বাবা ওমায়ের আলী নিজেই একশোটা প্রশ্নের ভীড়ে অতিষ্ঠ করে দিচ্ছিলেন নিজের বেয়াই-বেয়াইনকে। তাঁর ধারণা তাকে এবং তাঁর আত্মীয়স্বজনকে অপমানে ফেলার জন্যই বাবা ও ছেলে মিলে এই নাটক শুরু করেছে। তিনিও এক কথার মানুষ, নাটকের শেষ না দেখে যাবেন না। তাই মেয়ে জামাইয়ের অপেক্ষায় বসে রইলেন।

জেনিফার এরমধ্যে বাবার সাথে দেখা করে মনের রাগ-ক্ষোভ মিটিয়ে নিতে এলো। যখন বাবাকে ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে দেখল, একগাদা মানুষের সামনে এসে বলে উঠল, “শান্তি পেয়েছ? মেহমাদকে মেয়ের জামাই হিসেবে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ছিলে না? এখন ভালো লাগছে? এতগুলো মানুষের সামনে ও কীভাবে তোমার মেয়েকে লজ্জা, অপমান ও মানহানীর সম্মুখে দাঁড় করিয়েছে, এটা দেখে তৃপ্তি পাচ্ছ? তুমি তো এটাই চেয়েছিলে, তাই না?”

ওমায়ের আলী নিজেও যথেষ্ট রাগ করে আছেন মেহমাদের ওপর। মেয়ের রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক। জেনিফারের কণ্ঠে এমন অসম্মানজনক কথা শোনে বললেন, “আমি তো জানতাম না, মেহমাদ এত কাণ্ডজ্ঞানহীন। গ্রামের মানুষ ওর এত প্রশংসা করে যে, বুঝতেই পারিনি, ওদের সবারই উপরে ফিটফাট আর ভেতরে সদরঘাট। বেয়াই সাহেব নিজেও তো ছেলের খোঁজ করছেন না।”

জেনিফারের গলার আওয়াজে রেজি সুলতানা স্বামীর পাশ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। এসে দেখলেন বাবা-মেয়ে দু’জনে মুখভার করে বসে আছে। তাদের পাশেই দুই পরিবারের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন তখনও বসে আছেন। তিনি ছেলের বউকে শান্ত করতে বললেন, “তুমি ঘরে যাও, বউমা।”

যা কিছুই হোক, বড়োদের কথা উল্টানোর স্বভাব জেনিফারের নেই। শাশুড়ির একটা আদেশেই মাথা নিচু করে সেখান থেকে সরে পড়ল সে। এমনিতেই এটা মূল্যহীন একটা সম্পর্ক, অথচ গ্রামের মানুষজন খুঁচিয়ে আজকের পুরো দিনটাই মাটি করে দিয়েছে। সম্পর্ক যেমনই হোক, সবার সামনে সেটাকে এভাবে হাসির পাত্র হিসেবে আবিষ্কার করে মন আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল তার।

মেহমাদ ভেতরে প্রবেশ করে সবার উদ্দেশ্যে বলল, “আমি খুব দুঃখিত। আমার জন্য আপনাদের অনেক খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হলো। আসলে এত জরুরী একটা কাজ ছিল, না গিয়ে উপায় ছিল না।”

ওমায়ের আলী গম্ভীরস্বরে জানতে চাইলেন, “নিজের ওয়ালিমার আয়োজনের চেয়েও জরুরী কাজ থাকতে পারে মানুষের জীবনে?”

“কী করব, আব্বাজান? আপনার মেয়ের জামাই এমন একটা মানুষ, যাকে মানুষ ডানে গেলেও খুঁজে, বায়ে গেলেও খুঁজে। বেকার হলে কী হবে? কথার একটা দাম আছে না? আমি না থাকলে ঝামেলাটা মিটতোই না।”

“ওহ, তাই বলো। অন্যের ঝামেলা মিটাতে গিয়ে আমার মেয়ের সম্মানের দিকে যে আঙুল তুলেছ, সেটা কি ভেবে দেখেছ একবারও?”

মেহমাদ সোজা শ্বশুরের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলল, “কেন ভাবব না? সে আমার স্ত্রী। তার সম্মানের দায়িত্ব তো আমার কাঁধেই। আমাকে কি এতটাই অকর্মা মনে হয় যে, জেনে-বুঝে আমি আমার স্ত্রীর অসম্মান হতে দেব?”

“তাহলে? তাকে এই সিচুয়েশনে ফেলে রেখে গিয়েছিলে কেন? মানুষজন কত কটু কথা শুনাচ্ছিল।”

“মানুষের মুখ আছে, তা-ই শুনিয়েছে। এসব কথা গায়ে মাখলে চলে? আমি স্বেচ্ছায় তাকে এই পরিস্থিতিতে ফেলিনি শ্বশুর আব্বা। সত্যিই আমার খুব জরুরী কাজ ছিল।”

এতটুকু বলে মেহমাদ খানিকটা মাথা নুইয়ে শ্বশুরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “একজন মুখোশধারী লোকের মুখোশ টেনে খুলতে চাইছি। তারই পরবর্তী প্লানের বারোটা বাজাতে গিয়েছিলাম শ্বশুর আব্বা। বারো ঘণ্টার আগেই সব সমস্যার সমাধান করে এসেছি। আই মিন, ওই লোকটার গুলির নিশানা পালটে দিয়েছি।”

ওমায়ের আলী থতমত কণ্ঠে বললেন, “কী… কীসের প্লান? কীসের কথা বলছ তুমি? কার কথা বলছ?”

“আপনি চিনবেন না।”

“যা-ই হোক, আজ আমার মেয়ের যে অসম্মান হলো!”

“আমার কাছে নারীর সম্মান সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমার এখানে না থাকাতে আপনার মেয়েকে যেসব কটু কথার ওপর দিয়ে যেতে হয়েছে, তারজন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতে এমনটা যেন না হয়, সেদিকে যথেষ্ট যত্নশীল হব।”

ওমায়ের আলী পাংশুমুখে বললেন, “আমি তোমাকে অনেক বুদ্ধিমান পুরুষ ভাবতাম, জামাই। আজকের পর আমাকে ভাবতে হবে, তুমি আসলেই আমার মেয়ের উপযুক্ত কি না।”

মেহমাদ হাতে-কলমে ওমায়ের আলীর ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলল, “দেখলেন তো, এখন আপনার আফসোস হচ্ছে। কেন যে এত দেরী করলেন বুঝতে! আরও আগে বুঝতেন, আপনার মেয়ের জীবনে এইদিন আসত না আর আপনাকেও এত আফসোস করতে হতো না। এখন আপনি প্রতি পদে পদে টের পাবেন, আমাকে মেয়ের জামাই বানিয়ে কত্ত বড়ো ভুল করেছেন।”

শেষের কথাগুলো ফিসফিসিয়ে বলল মেহমাদ। ওমায়ের আলী সব কথা শুনলেন না, পাত্তাও দিলেন না। নিজের মতো করে চিন্তায় ডুবে রইলেন।

***

মেহমাদ রুমে পা দিয়ে জেনিফারকে কোত্থাও পেল না। গলা বাড়িয়ে ডাকতে যাবে, তখুনি ব্যালকনিতে চোখ পড়ল। ভীষণ মনমরা, বিষণ্ণ ও দুঃখে ভরপুর মুখ ও অশ্রুভেজা কাজলকালো চোখ দেখে, কাছে এগোতে এগোতে বলল, “রাগ করেছেন?”

জেনিফার কোনো উত্তর দিল না। ফিরেও তাকাল না। সন্ধ্যের তারা ঝলমল আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের দুঃখ ও অপমান ভুলে থাকার চেষ্টা করল। মেহমাদ নিজের হাতে থাকা ছোট্ট একটা গিফটের প্যাকেট জেনিফারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা আপনার জন্য। বিয়ের রাতে কিছুই দিতে পারিনি।”

এবারও জেনিফার ফিরে তাকাল না। মেহমাদ বুঝল, মেয়েটা যথেষ্টই খেপে আছে। মেজাজে এখন তার আগুন। তার যেকোনো কথাই এখন ঘিয়ের কাজ করবে। নিশ্চুপে কতক্ষণ ভেবে গেল কী করবে। তারপরও জেনিফারকে চুপ থাকতে দেখে আস্তেধীরে বলল, “আমি জানি, আমার অনুপস্থিতি আপনাকে অনেক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। ট্রাস্ট মি, এটা আমার ইচ্ছাকৃত ছিল না। যতদিন আপনি আমার স্ত্রী হয়ে আছেন, ততদিন আপনার সম্মান ও অসম্মানের সব দায় আমার। আমি নিজের দোষ স্বীকার করে নিচ্ছি।”

অনেকক্ষণ পর জেনিফার এবার মুখ খুলল, “এই বিয়েটা মন থেকে মানি আর না মানি, কঠিন পরিস্থিতিতে আপনার উচিত ছিল, আমার পাশে থাকা। মানুষজন কথা শুনাতে ওস্তাদ, এটা জানেন তো? পক্ষে হোক বা বিপক্ষে, নেগেটিভ একটা কিছু পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।”

“আ’ম এ্যাক্সট্রিমলি স্যরি, জেনিফার। আমার যাওয়াটা জরুরী ছিল।”

“সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এতগুলো মানুষের মুখ বন্ধ করার মতো উপযুক্ত জবাব তো শিখিয়ে যাবেন। আমি আপনাকে ভালোমতো চিনি না, জানি না, বুঝিও না। হুট করে এই পরিস্থিতি আমি কীভাবে সামাল দিতাম? কী করে মানুষজনকে বোঝাতাম যে, আমাদের এই সম্পর্ক…।”

কথা শেষ করার আগেই মেহমাদ বলল, “আপনি একটু আমার সাথে আসবেন?”

“কোথায়?”

প্রশ্ন করে মেহমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল জেনিফার। মেহমাদ সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে, হাতের প্যাকেকটা ড্রেসিংটেবিলের ওপর রেখে, আলগোছে জেনিফারের হাত ধরে রুমের বাইরে অগ্রসর হতে হতে বলল, “স্যরি। এখন আর হাত না ধরে উপায় নেই। এরপর আমি যা করব, চুপচাপ হজম করে যাবেন। আই থিংক, আজকের পর আর কেউ আপনাকে অপমান করার সুযোগ পাবে না।”

জেনিফারকে নিয়ে সোজা ডাইনিংয়ে চলে এলো মেহমাদ। ড্রয়িংরুম থেকে আরও মানুষের ডাক ভেসে এলে, কাজের মেয়েটাকে বলল টেবিলে খাবার সাজাতে। এরপর জেনিফারকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে উপস্থিত সবাইকে বলল, “আমি কিছুক্ষণ পর আপনাদের সাথে কথা বলি? এত ব্যস্ত ছিলাম সারাদিন, নিজের স্ত্রীর দিকে খেয়ালই রাখতে পারিনি। কাজে ডুবে থাকলে সবদিক ভুলে যাই। আমি ঘরে ছিলাম না দেখে, আমার স্ত্রীও না খেয়ে আছেন।”

রেজি সুলতানা ছেলে ও বউমার খাবারটা তুলে রেখেছিলেন। এখন সবকিছু কাজের মেয়েটার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে, আগত মেহমানদের সঙ্গ দেয়ার জন্য মোশাররফ হোসেনকে ডাকতে গেলেন। মেহমাদের কথায় ইতিমধ্যে যে কানাঘুষো শুরু হলো, সেটুকুকে আরেকটু বাড়িয়ে দেয়ার জন্য মেহমাদ ইচ্ছে করেই জেনিফারের দিকে অতিরিক্ত যত্নশীল হয়ে গেল। খাবার এগিয়ে দিল, গ্লাসে পানি ঢেলে দিল, হাতের কাছে ভাত ও মাছ-মাংসের বাটি রেখে নিজ হাতেই সবকিছু একটু একটু করে প্লেটে তুলে দিল।

জেনিফার এসব দেখে বলল, “অতিভক্তি চোরের লক্ষণ।”

“মাঝেমধ্যে চোর হতেই হয়, জেনিফার। কিছু করার নেই।”

“হয়েছে, ড্রামা কম করেন।”

জেনিফার খাওয়া শুরু করল। মেহমাদও ঠোঁটে হাসি নিয়ে খাবার মুখে নিয়ে আড়চোখে ড্রয়িংরুমে দৃষ্টি দিয়ে বলল, “আপনার বাবা সব দেখছেন।”

“আপনি কি বাবাকে দেখানোর জন্য এসব করছেন?”

“উনি পজেটিভলি নিলে বাকিরাও নিবে। উনি আমার প্রশংসা করলে বাকিরাও করবে। এক কথায়, জামাই-শ্বশুর বন্ডিংটাকে শক্ত দড়ির ন্যায়, মজবুত বাঁধনে বেঁধে রাখতে গেলে একটু-আধটু শ্বশুরের মেয়ের যত্ন নিতে হবে। নয়তো কেইস পুরো উলটে যাবে।”

“আপনি যে একটা ধান্ধাবাজ লোক, সবাই যদি জানত!”

মেহমাদ খাওয়া থামিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে ধান্ধাবাজির কী হলো? আমরা একটা সমস্যার জন্য এক হয়েছি, সমাধান হয়ে গেলে আলাদা হয়ে যাব। ততদিন যদি সবার চোখে পর্দা বেঁধে উদ্দেশ্য সফল করে নিতে পারি, তাহলে তো লাভ এই গ্রামের মানুষেরই। এসব তো আমি নিজের জন্য করছি না। করছি মানুষের জন্য। এতে আমার লাভ এক পার্সেন্টও না। উলটে লস…।”

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল জেনিফার। এই সম্পর্কে টান আসার কথা নয়, এটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি রকমের রাগ-অভিমানেরও কথা নয়, তবুও একদিনে অদৃশ্য একটা সুতো যেন এই সম্পর্ককে জোড়ালো করে দিতে চাইছে। নিজের অহেতুক ভাবনা, কাজ ও মন খারাপের চক্করে পড়ে জেনিফার ভুলেই গিয়েছিল, এই সম্পর্কের কোনো ভিত্তি নেই। সে চুপ থেকে খাওয়ায় মনোযোগ দিল।

খাওয়া শেষ হলেও নিজের আসনে বসে রইল মেহমাদ। জেনিফার বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল, “আপনি হাত ধুয়ে নিতে পারেন।”

“আপনি শেষ করুন, তারপর।”

“কতক্ষণ বসে থাকবেন?”

“অসুবিধা নেই।”

বাড়তি কথা না বলে আস্তেধীরে খাবারটুকু খেয়ে শেষ করল জেনিফার। তার খাওয়া শেষ হওয়ার পরই নিজের আসন ত্যাগ করল মেহমাদ। বেসিনে হাত ধুয়ে, টিস্যু দিয়ে ভেজা হাত মুছে নিল। জেনিফার নিজেও এবার হাত পরিষ্কার করে বলল, “এইটুকু সম্মানও কি লোকদেখানো?”

“আপনি যা ভাববেন, তা। এখন যান, বিশ্রাম করুন গিয়ে। আমি একটু শ্বশুর আব্বাকে নাকানিচুাবানী খাইয়ে আসি।”

“কী বললেন?” হতবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করল জেনিফার।

মেহমাদ হেসে বলল, “আপনার বাবা জানেন না, কী করে এসেছি আমি। ঠিক দশমিনিটের মধ্যে একটা কল আসবে ওনার নম্বরে, তাতেই তিনি সব ভুলে বাড়ির দিকে দৌড় দিতে বাধ্য হবেন।”

জেনিফার কোনোকিছুই বুঝল না, শুধু বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে তাকিয়ে রইল। দশমিনিট পেরোনোর আগেই ওমায়ের আলীর পারসোনাল মোবাইলটা বেজে উঠল। তিনি হ্যালো বলার পর ওপাশ থেকে কী কথা এলো, কেউ তা শুনল না, তবে ওমায়ের আলী নিজেও আর বসে থাকলেন না। মোশাররফ হোসেনের হাত ধরে বললেন, “দুঃখিত বেয়াই সাহেব, এখুনি উঠতে হচ্ছে। জরুরী একটা কল এসেছে। না গেলে বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে।”

মেহমাদ সেই সময় সেখানে উপস্থিত হয়ে বলল, “এখুনি কেন যেতে হবে শ্বশুর আব্বা? আমি আপনাকে কোত্থাও যেতে দেব না। আজ রাতে এখানেই খেয়ে যাবেন।”

ওমায়ের আলী তাড়াহুড়ো করে বললেন, “না না, এখুনি যেতে হবে। অন্য কোনো একদিন সুযোগ হলে, খেয়ে যাব।”

এরপর জেনিফারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, সঙ্গী-সাথীদের তাড়া দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই ওই স্থান ত্যাগ করলেন ওমায়ের আলী। মেহমাদ দাঁড়িয়ে থেকে ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বিড়বিড়াল, “আহারে… শ্বশুর আব্বা, আপনার কপালটাই খারাপ। কোন দুর্ভাগ্যের দোষে আমার মতো পুরুষকে মেয়ের জামাই হিসেবে পেয়েছেন, কে জানে!”

***

চলবে…

-‘আপনার কাপড়চোপড় ধুয়ে দেয়?’

উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল দোয়েল। রুদাইভ বিরক্তই হলো। তবে আচরণ দিয়ে বুঝতে দিল না। খাবার মুখে নিয়ে শুধু বলল,
-‘হ্যাঁ। এত প্রশ্ন করছেন কেন?’

ফুস করে দম ছেড়ে দোয়েল বলল,
-‘ওকে আসতে নিষেধ করবেন।’

-‘কেন?’

বেশ অবাক হলো রুদাইভ। মেয়েটা ঘরের সব কাজ করে। এমন না যে কাজে ফাঁকি দেয়। এই শহরে মনমতো কাজের মেয়ে পাওয়া যায় না। অনেক খুঁজে মারিয়া মেয়েটাকে এনেছিল। এখন কি-না একদিন মেয়াদের বউ বলছে, মেয়েটাকে আসতে নিষেধ করতে হবে! বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে দোয়েলের দিকেই চেয়ে রইল। দোয়েল নির্দ্বিধায় বলল,

-‘প্রতি মাসে কত খরচ হয় আপনার?’

-‘চাল-ডালসহ সব মশলাপাতি আনার দায়িত্ব ভাইয়ার হাতে ছিল। আর আমি মাছ-মাংস আনতাম। খরচ হয়ে যেত পনেরো হাজারের মতো।’

-‘গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, এগুলো কে দিত?’

-‘একটা ভাইয়া আর একটা আমি।’

-‘রোজগার করার পর থেকে নিজের জন্য কিছু জমিয়েছেন?’

-‘যা জমিয়েছি, বিয়েতে খরচ হয়ে গেছে। বাকি যা ছিল, তার থেকে আপনার দেনমোহরে টাকা বাদ দিলে খুব অল্পই আছে। প্রয়োজনে খরচ করব বলে রেখে দিয়েছি।’

-‘এখন তো খরচ অর্ধেক কমে গেছে, তাই না? মাস শেষে গাদা গাদা খরচ লাগবে না। মাছ-মাংস, মশলা যা-ই লাগবে, সেটা সীমিত হলেও মানিয়ে নেয়া যাবে। আমি একটা হিসেব করে দেখব, প্রতিমাসে এই সংসারের পিছনে কত টাকা খরচ হয়। বাড়তি যে টাকাটা থাকবে ওই টাকা ব্যাংকে রাখবেন।’

ভালোবাসতে নিষেধ করবে আবার সংসার আগলে রাখার দায়িত্বও নিবে। খারাপ লাগা থাকলেও এই সুন্দর মুহূর্তে জীবনটাকে তার সত্যিই সুন্দর মনে হলো। গুছিয়ে দেয়ার জন্য কেউ একজন এসেছে, সেটা ভেবে মন হালকা হলো সামান্য। সব হিসাব ফেলে রেখে হাসিমুখে বলল,

-‘বাসার এতসব কাজ কে করবে শুনি?’

-‘আমি করব। কোনো অসুবিধা?’

-‘আপনি কাজ করতে জানেন?’

-‘আশ্চর্য! জানব না কেন? আমাকে এত অকর্মা ভাবছেন কেন, আপনি?’

মনে মনে একগাদা হাসি হেসেও মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে রুদাইভ বলল,
-‘আপনি শুধু ঘর-সংসারের দায়িত্ব নিতে এসেছেন?’

প্রশ্নটা এত গভীর করে আমলে না নিয়ে দোয়েল বলল,
-‘মেয়েদের কাজই ঘর-সংসারের দায়িত্ব নেয়া। যেটা নিজের সেটা আগলে রাখার দায়িত্ব তো নেয়া উচিত। আমি দায়িত্ব অবহেলা করা পছন্দ করি না।’

-‘আমিও তো আপনার। আমার দায়িত্ব কি নিয়েছেন?’

ক’টা শব্দ উচ্চারণ করে মুখ নামিয়ে গপাগপ খাওয়া শুরু করল রুদাইভ। দোয়েলের ওই রাগী, মায়াবী, আবার ফোলা ফোলা মুখ দেখার ইচ্ছে নেই তার। ভুল করেও যদি তাকিয়ে ফেলে, টুপ করে চুমু খেয়ে ফেলবে। এরচেয়ে ‘সে কিছু বলেনি’ এই মেজাজে খাওয়ার-দাওয়ার কাজ কমপ্লিট করা যেতে পারে। কতক্ষণ পরও কোনো রাগ-অভিমানের আনাগোনা টের না পাওয়াতে আড়চোখে নিজের বউয়ের দিয়ে তাকিয়ে তাকেও নিঃশব্দে খেতে দেখে নিশ্চিত হলো, মেয়েটা মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা শুরু করেছে সবে। কতদূর পারবে কে জানে!

***

পড়ুন ই-বই ‘যে পাখি ঘর বোঝে না’
https://link.boitoi.com.bd/xFWJ

***