জামাই শ্বশুর পর্ব-০৪

0
196

#জামাই_শ্বশুর
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৪

ডিসি অফিসারের ফোন পেয়ে শরীর বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে ওমায়ের আলীর। তিনি ভেবেই পাচ্ছেন না, ডিসির কাছে কে অভিযোগপত্র দাখিল করল আর কীভাবেই বা তার কাজের ভালোমন্দের সব খবরাখবর কেউ জেনে গেল! তিনি যখন পায়চারী বাড়িয়ে দিয়ে চিন্তায় ঘামছিলেন, তখুনি তার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রফিক ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “স্যার, একটা দুঃসংবাদ আছে।”

ওমায়ের আলী চিন্তিতমুখে জানতে চাইলেন, “কী?”

রফিক আমতা-আমতা স্বরে বলল, “যেসব অল্পবয়সী কিশোরীদের পরিচয় পালটে দিয়ে অন্যায় কাজের পিছনে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। এতদিন ধরে প্রাণ বাঁচানোর আশা ছেড়ে দিয়ে যারা আপনার কথামতো কাজ করছিল, তাদের মধ্য থেকে চারজন পালিয়েছে।”

“কী বলছ তুমি এসব? মাথা ঠিক আছে তোমার? ওরা কীভাবে পালাবে? ওদের তো সব পথ বন্ধ।”

“আমি ঠিক জানি না, স্যার। কিছুক্ষণ আগে ফোন এসেছিল, কেউ একজন না কি আমাদের গোপন আস্তানায় ঢুকেছিল, এবং সেখানে থাকা সব ইনফরমেশন চুরি করে পালিয়েছে।”

ওমায়ের আলী হাঁটা থামিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। রফিক দ্রুত একটা হাতপাখা দিয়ে তাকে বাতাস করে, একগ্লাস পানি খাইয়ে দিয়ে বলল, “ভয় নেই স্যার। যে এসব করেছে, তাকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। জান-প্রাণ হাতে নিয়ে সে প্রমাণ নিয়ে পালিয়ে গেলেও যথাসময়ে ট্রিটমেন্ট না নিলে, খবর হয়ে যাবে। সিসিটিভির ফুটেজ চেক করে তার পরিচয় জানতে না পারলেও, ঢেকে রাখা চেহারা থেকে শুধু চোখদুটো আবিষ্কার করা হয়েছে। আমার ধারণা এই চোখের মধ্য দিয়েই আমরা তাকে চিনতে পারব। আর যখন চিনতে পারব, এক চান্সে গুলি করে দেব।”

“তাহলে ওই লোকটাই সব ইনফরমেশন ডিসির হাতে দিয়েছে আর ডিসি আমাকে শাসিয়েছে। লোক লাগাও, চারিদিকে লোক লাগাও। কে সে, কোথায় থাকে, সব খুঁজে বের করো, সব।”

দু’জনেই বাড়ির আলাদা ও গোপন কক্ষে এসে সিসিটিভি ফুটেজটা ল্যাপটপে চালু করে দেখতে লাগলেন। ওমায়ের আলী দেখলেন, নীল চোখের এক যুবক। যে খুব দক্ষতা ও সাহসীকতার সাথে তার গোপন আস্তানায় ঢুকেছে। ইডিয়টগুলো তখন নিশ্চয়ই পেটপুজোয় ব্যস্ত ছিল, নয়তো জলজ্যান্ত একটা মানুষ, একা এত সাহস দেখিয়ে কীভাবে তার ডেরায় প্রবেশ করল? তিনি চিন্তিত ও বিস্মিত চোখ নিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, “আশ্চর্য, নীল চোখ! এমন মানুষ আছে বাংলাদেশে?”

“আছে স্যার। তবে খুব কম।”

ওমায়ের আলী আবারও স্ক্রিনে চোখ ডুবিয়ে আবিষ্কার করলেন, যুবকটা এমন একটা পোশাক পরিধান করেছে, যেটা অন্যসব সাধারণ মানুষরা চোখেই দেখে না। এই ধরনের বুলেটপ্রুফ পোশাক-আশাক কেবল আইনের লোকজন পরে। সে কি তবে পুলিশের কেউ? এই শহরের সব পুলিশ তো তার আন্ডারে কাজ করে। তাহলে, কে সে-ই নীল চোখের পুরুষ যাকে তিনি এখনও চিনেন না? চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলেও যুবক সম্পর্কে যথোপযুক্ত কোনো আন্দাজকে মনে ঠাঁই দিতে পারলেন না। জানতে চাইলেন, “একটা ইনফরমেশন নাও। এই জেলায় নীল চোখওয়ালা কোনো পুলিশ অফিসার আছে কি না!”

রফিক উত্তর দিল, “খোঁজ নিয়েছি, স্যার। নেই।”

“নেই! স্ট্রেঞ্জ! তাহলে এই যুবকটা কে!”

“আমার ধারণা সে আইনের লোক নয়! আমাদের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য এই ধরনের পোশাক পরে এসেছে। সে এমন কেউ, যে ডিসির খুব কাছের ও বিশ্বস্ত।”

“কিন্তু ডিসির সাথে তো আমার কোনো শত্রুতা নেই। কেন সে ডিসির হয়ে কাজ করে আমার ক্ষতি করবে?”

“আমরা শুধু ধারণা করেছি, স্যার। আরেকটা দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যুবকটা একজন দক্ষ ফাইটার। সে কোনোকিছুরই পরোয়া করে না। তার হাতের একেকটা ঘুশি, আমাদের একেকজনকে অজ্ঞান করার জন্যই যথেষ্ট।”

ইনফরমেশন সংগ্রহ করতে গিয়ে, যুবকটা যখন ধরা পড়ে গেল, তখনই দলবল নিয়ে তার ওপর আক্রমণ করল দলের লিডার দেলোয়ার। এরপর তার সাঙ্গপাঙ্গ। প্রথম কয়েকবার গুলি ছুঁড়ে দেখল, কাজ হচ্ছে না। একেকটা ডিগবাজি দিয়ে কীভাবে যেন এদিক থেকে ওদিক গিয়ে, যুবকটা নিজেকে বাঁচিয়ে নিচ্ছে। সেইসাথে চোখের পলকে তাদের অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে। এমন দক্ষ ফাইটারকে ঘায়েল করতে সবাই যখন একসাথ ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন যুবকটার পোশাক টেনেহিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলে, ছুরি-চাকু দিয়ে আঘাত করা হলো। এতে করে মারামারি ও জান বাঁচানোর চেষ্টায় লড়াই করতে যাওয়া যুবকটা শেষরক্ষায় নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে গিয়ে পিঠের পিছনে মারাত্মক আঘাত সহ্য করেও রক্তাক্ত শরীর নিয়ে সবাইকে সাইজ করে দিল। একজন, একজন করে মেরে আইন নিজের হাতে তুলে নিল। এরপর কাকে যেন ফোন করে নিজেকে সেই স্থান থেকে মুক্ত করে নিল মুহূর্তের মধ্যেই।

ওমায়ের আলী হতবুদ্ধির ন্যায় বসে থেকে বললেন, “ডেঞ্জারাস ছেলে! ওকে তো আইনের হাতে দেয়া উচিত।”

রফিক দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “ওকে আইনের হাতে তুলে দিলে আমরা ফেঁসে যাব, স্যার।”

“আমার এতগুলো লোককে খুন করে সে পালিয়ে যাবে!”

“পরিচয় পেয়ে গেলে তার ব্যবস্থা আমরাই করব। আপনি চিন্তা করবেন না।”

ওমায়ের আলী আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে ফুটেজটা বারবার দেখলেন, যদি কোনো সূত্র পান এই আশায়। কিন্তু না, তিনি ব্যর্থ। একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “এমনিতেই সবাই এই নির্বাচনে আমাকে চাইছে না। তারমধ্যে এতবড়ো একটা লস। কীভাবে সবদিক সামলাব আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না।”

“খোঁজ পেয়ে যাব, স্যার।”

“পেয়ে যাব বললে তো হবে না, খোঁজ লাগাও। কে আমার পিছনে পড়েছে জানার চেষ্টা করো। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। যাও…।”

***

ক্লান্ত শরীর বিছানায় হেলিয়ে দিতে গিয়ে, বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠল মেহমাদ। রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বান্ধবীর সাথে কথা বলছিল জেনিফার। আচমকা ‘আহ্‌’ শব্দ শোনে, দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, মেহমাদ একটা হাত পিছনে নিয়ে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট সরিয়ে কিছু একটা করছে। কী করছে, এটা দেখতে এসে রুমে পা দিয়েই ভয়ানকভাবে চমকে উঠল। পিঠের একাংশ জুড়ে মোটা সাইজের ব্যান্ডেজ বাঁধা। সেই ব্যান্ডেজটাও এখন রক্তাক্ত।

জেনিফার ভয়ে ও আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “ব্যথা পেলেন কীভাবে?”

এতক্ষণ ধরে বাড়ির সবাইকে এই জখমের কথা লুকিয়ে রাখতে পারলেও শেষবেলা এইভাবে জেনিফারের চোখে পড়ে যাওয়াতে মেহমাদ ফট করে স্ত্রীর ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে বলল, “আস্তে… মা শুনলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ছাড়বে। সেইসাথে আমাকেও বাঁশ দিবে।”

“মানে? কেন? সারাদিন আপনি কোথায় ছিলেন? দিনশেষে নিজেকে এইভাবে রক্তাক্ত করে ফেরার মানে কী?”

মেহমাদ শার্ট নামিয়ে, স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে বলল, “কিছু না। ছোট্ট একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।”

“এটা ছোট্ট অ্যাক্সিডেন্ট?” চেহারায় বিস্ময় ধরে রেখে প্রশ্ন করল জেনিফার।

“অন্যদের কাছে কী, জানি না। তবে আমার কাছে ছোটোই।”

“দেখে তো এটাকে ছোটোখাটো আঘাত মনে হচ্ছে না। আপনি একটু বসুন, আমি ব্যান্ডেজটা ঠিক করে দিচ্ছি।”

“আরেহ্‌, আপনাকে এত ঘাবড়াতে হবে না। আমি ট্রিটমেন্ট নিয়েছি। এই ট্রিটমেন্টের জন্যই দেরী হয়েছে। নয়তো আমি আরও আগে ফিরতাম।”

“আপনি চুপ করে বসুন তো। পুরো ব্যান্ডেজে রক্ত লেগে আছে। দেখতে কী ভয়ানক লাগছে! ঘরে ফাস্টএইড আছে না?”

“আছে, ওইযে।”

আঙুল দিয়ে ড্রেসিংটেবিলের ভেতরটা দেখাল মেহমাদ। জেনিফার তাকে বসিয়ে রেখে, ফাস্টএইড বক্স বের করে, পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, “শার্ট খুলে বসুন।”

“এসবের দরকার নেই, জেনিফার।”

“দরকার আছে কি নেই, সেটা আমি বুঝব! আপনি চুপ থাকুন।”

মেহমাদ শান্ত হয়ে বসে পরনের শার্ট খুলে একপাশ উন্মুক্ত করে দিলে, জেনিফার পরনের ছিঁড়ে যাওয়া স্যান্ডো গেঞ্জি দেখে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, “এটা অ্যাক্সিডেন্টে হয়েছে?”

মেহমাদ বলল, “হুঁ।”

“মিথ্যে বলছেন আপনি! এটা তো ছুরির আঘাত! আপনার পরনের গেঞ্জিটা দেখুন, অ্যাক্সিডেন্টে পোশাক এইভাবে ছিঁড়ে না।”

“আমি কি একবারও বলেছি রোড অ্যাক্সিডেন্টে এমন হয়েছে?”

“তা নয়তো কী?”

“মারামারি করতে গিয়ে!”

“কী বলছেন! আপনি মারামারি কেন করবেন? কার সাথে করবেন? আর মারামারিতে গিয়ে নিজেকে এইভাবে অর্ধমৃত বানিয়ে ফেরার কাহিনী কী? শরীরে এতবড়ো আঘাত নিয়ে এতক্ষণ কীভাবে স্ট্রং ছিলেন আপনি!”

প্রশ্ন করতে করতে ছিঁড়ে যাওয়া গেঞ্জি খুলে, ব্যান্ডেজ সরিয়ে সম্পূর্ণ কাটাছেঁড়া অংশ আবিষ্কার করে জেনিফার বিড়বিড়াল, “ইন্না-লিল্লাহ! এটা তো মারাত্মক জখম!”

আয়নায় মেহমাদের নিশ্চুপে বসে থাকা ফেইস দেখে আঙুল দিয়ে পিছনের পনেরোটা সেলাই গুনে জেনিফার হতভম্ব হয়ে মুখে হাত চেপে বলল, “আপনি ঠিক আছেন?”

মেহমাদ উপরনিচ মাথা নাড়ল শুধু। জেনিফার সেলাইকৃত অংশের শুকিয়ে যাওয়ার রক্ত মুছে, ঔষধ লাগিয়ে, পূণরায় নতুন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। আগেরটা যেভাবে গলার একপাশ দিয়ে পেঁচানো ছিল, এটাও সেইভাবে পেঁচিয়ে ছোট্ট দুটো গিট্টু দিয়ে জানতে চাইল, “ঔষধ নিয়ে এসেছেন?”

আঙুল দিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনের দিক আবারও দেখিয়ে দিল মেহমাদ। জেনিফার এবার দেখল, গিফটের বাক্সটার সাথে ঔষধের একটা ব্যাগ রাখা, যেটা তখন তার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। সে ঔষধগুলো বের করে, মেহমাদের হাতে তুলে দিয়ে, একগ্লাস পানি হাতে নিয়ে পাশের খালি জায়গায় বসে বলল, “ওরা কারা?”

“চিনি না।”

“চিনেন না, জানেন না, অথচ কেউ আপনাকে এইভাবে মারল! বিষয়টা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগছে না?”

“হুঁ, আমি সত্যিই চিনি না।”

“তাহলে মারল কেন!”

“জানি না।”

“একটু আগেই তো বললেন, মারামারি করতে গিয়েছিলেন। কাউকে না চিনে, না দেখে, তার সাথে মারামারি করতে চলে গেলেন! কেন?”

“দরকার ছিল, তাই।”

“জেনে-বুঝে নিজেকে এতবড়ো বিপদের মধ্যে কেন ঠেলে দিয়েছেন?”

“এটা আমার দায়িত্ব।”

“মারামারি করাও দায়িত্ব?”

“উঁহু, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা আমার দায়িত্ব।”

“অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা প্রত্যেকটা দায়িত্ববান ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য আমি জানি। তাইবলে আপনি নিজের কথা ভাববেন না? ফ্যামিলির কথা ভাববেন না?”

মেহমাদ সামান্য হেসে বলল, “নিজের কথা আর কী ভাবব?”

“কেন? নিজের জীবনের মূল্য নেই আপনার কাছে? যদি আপনার কিছু হতো…।”

জেনিফারকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মেহমাদ বলল, “আপনি বেঁচে যেতেন। নামহীন সম্পর্কের বোঝা বয়ে বেড়াতে হতো না। আমার জন্য আপনি নিজের জীবনের সাচ্ছন্দ্যটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। কী করব বলুন! মাঝেমধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের বেড়াজালে আটকে গিয়ে আমাদের এমনকিছু কাজ করে ফেলতে হয়, যা আমরা সজ্ঞানে কোনোদিন চাইও না, ভাবিও না।”

জেনিফার থেমে গেল এবার। আর কোনো কথাই তার মুখে এলো না। ফাস্টএইড বক্স জায়গায় রেখে, রুমের বাতি নিভিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলে মেহমাদ বলল, “এত রাতে ওখানে গেলেন কেন? ঘুমিয়ে পড়ুন।”

“গতকাল আপনি ডিভানে ঘুমিয়েছেন, আজ নাহয় বিছানায় ঘুমান।”

দুর্বলতা ও ঔষধের প্রভাবে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে মেহমাদের। সে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে থেকে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “সুস্থ থাকলে আজও ডিভানেই ঘুমাতাম। এই শরীর নিয়ে ওখানে ঘুমানোর জোর নেই। ব্যথা আর জ্বলুনিতে শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে।”

“বেশি বকবক না করে আপনি ঘুমান তো।”

মেহমাদ সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের অর্ধপ্রহর পর্যন্ত ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকলেও শেষপ্রহরে বিছানায় পিঠ ঠেকাতে বাধ্য হলো জেনিফার। নির্ঘুম রাত কাটানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে মেহমাদ শরীরে কিছুই দেয়নি। তার ব্যান্ডেজ বাঁধা পিঠটা দেখলে ভয়ে শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। উপায় না পেয়ে সে একটা নকশিকাঁথা জড়িয়ে দিল মেহমাদের শরীরে। অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ঘুমন্ত এক নিষ্পাপ মুখের দিকে। না চাইতেও নিয়ন্ত্রণহীন হাতটা স্পর্শ করল মেহমাদের চুল। আলতোস্পর্শে চুলের ফাঁকে আঙুলগুলো তার হাঁটাচলা বাড়িয়ে দিল। আধশোয়া হয়ে বসে থেকেই আঙুলের স্পর্শ অব্যাহত রেখে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল জেনিফার। ঘুম তো এলোই না, উলটে মাথার ভেতর একগাদা দুঃশ্চিতার পোকামাকড় কিলবিল শুরু করল। ভাবনারত মন নিয়ে কখন যে চোখ বন্ধ করল, টেরও পেল না। ঘুম ভাঙল বাড়ির লোকজনের আওয়াজে। এদিক-সেদিক থেকে ভেসে আসা আওয়াজ যখন ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাল, চোখ মেলে পরিপূর্ণ একটা সকালকে আবিষ্কার করে, সোজা হয়ে বসে ঘুমন্ত মেহমাদকে একইভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তাকে আর জাগাল না। উঠে হাত-মুখ ধুয়ে, মেহমাদের পিঠ ঢেকে রেখে ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হলো।

ড্রয়িংরুমে তখন গ্রামের চেনাপরিচিত কয়েকটা মুখ দেখা গেল। তারমধ্যে একজন ছিল বকুল। তার কণ্ঠেই ভেসে এলো, “আল্লাহ, কী আচানক কাণ্ড ঘটে গেল! গত চার বছর ধরে এই গ্রামের দুটো মেয়ে নিখোঁজ ছিল। হুট করে ওরা আজ গ্রামে এসে হাজির। বলছে, ফেরেশতার মতো একটা মানুষ না কি তাদের জীবন বাঁচিয়েছে। আমি তো শোনে অবাক।”

কেউ কেউ বকুলের কথা বিশ্বাস করল, কেউ কেউ হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল। তবে মোশাররফ হোসেন ঠোঁটে একটা নির্ভার হাসি ফুটিয়ে বকুলকে বললেন, “মেয়ে দুটোকে নিয়ে আসিস তো একবার। আমিও ঘটনাটা ওদের মুখ থেকে শুনব।”

“অবশ্যই চাচাজান। কালকেই নিয়ে আসব।”

জেনিফার বকুলের সামনে এসে বলল, “কেমন আছো বকুল?”

বকুল গদগদ কণ্ঠে বলল, “খুব ভালো আছি, ভাবীজান। ভাইজান কই?”

“তোর ভাইজান এখনও ঘুমাচ্ছে। তুই একটু আমার সাথে ছাদে আয় না বকুল, মাথায় একটু তেল দিয়ে দিবি।”

বকুল হাসিমুখে বলল, “আপনি যান ভাবীজান, আমি এক্ষুণি আসছি।”

জেনিফার রুম থেকে তেলের বোতলটা হাতে নিয়ে ছাদের দিকে এগোলে তার পিছন পিছন বকুলও এগিয়ে গেল। রেজি সুলতানা এতক্ষণ এখানে বসে থেকে বকুলের সব বকবক শোনে বিরক্ত হলেও স্বামীর মুখের ভাবভঙ্গি তাকে যথেষ্ট চিন্তায় ফেলে দিল। ড্রয়িংরুম খালি হওয়ার একফাঁকে তিনি স্বামীকে বললেন, “এসবের পিছনে মেহমাদ আছে?”

মোশাররফ হোসেন পত্রিকার একটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পরবর্তী পৃষ্ঠায় দৃষ্টি আটকে ছেলের প্রতি গর্ববোধ থেকে কণ্ঠে একরাঁশ ভালো লাগা জড়িয়ে বললেন, “কম করে হলেও রোজ একবার রবের নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপন করো, মেহমাদকে ছেলে হিসেবে পেয়েছ বলে। সাথে ওর দীর্ঘায়ু জীবন চেয়েও প্রার্থনা করতে পারো। বাবা-মায়ের দোয়া থাকলে সন্তানের জীবনে সফলতা অবশ্যই আসবে।”

***

চলবে…