#জামাই_শ্বশুর
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৭
নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ওমায়ের আলী এখন দিনরাত এক করে মেহমাদের প্রতিটা পদক্ষেপ যেমন ফলো করছেন, তেমনই তাকে পথ থেকে সরিয়ে নিজের আসন পাকাপোক্ত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেহেতু তিনি একজন নামীদামী মানুষ এবং তার শত্রুও অনেক, তাই মেহমাদকে শত্রুর আসনে বসিয়ে নিজেকে এখন তিনি পরিপূর্ণ নির্দোষ দাবী করার পাশাপাশি সাধারণ লোকের সামনে কেবলই সাধু থাকার ভান করে যাচ্ছেন। তাতে তিনি কতটা সফল সেটা বুঝা যাচ্ছে না। আর গ্রামের লোকজনও মেহমাদকে নিয়ে জয়জয়কার থামাচ্ছে না। চেয়ারম্যানের ছেলে হয়ে মেহমাদের এই সাহস ও তাকে উপযুক্ত আসন থেকে নামানোর এই অপচেষ্টাকে গ্রামের মানুষজন কীভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে, সেটারও কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। এদিকে নিজের মেয়েও তার কথা ও সিদ্ধান্তকে সম্মান দিচ্ছে না।
দিনদুনিয়ার খবর ভুলে তিনি যখন নিজস্ব ভাবনায় ডুবেছিলেন, তখুনি রফিক এসে ভয়ানক একটা খবর দিল। ল্যাপটপ তার সামনে রেখে স্ক্রিনে থাকা যুবকের দিকে আঙুল তুলে বলল, “সেদিনের সেই যুবকটা আর কেউ না, স্যার। আপনারই জামাই।”
ওমায়ের আলী চেহারায় বিস্ময় ফুটিয়ে তুলে জানতে চাইলেন, “কী বলছ? এটা কী করে সম্ভব? ওই যুবকটার তো নীল চোখ ছিল। মেহমাদের চোখ তো নীল না, বাদামি।”
স্ক্রিনে থাকা একেকটা ছবি, ভিডিয়ো, মেহমাদের হাঁটাচলা, শারিরীক উচ্চতা ও দাঁড়ানোর স্টাইল সবকিছু একত্রে করে, দুটো চোখের পাপড়ি, ভ্রু ও কপাল দেখিয়ে রফিক বলল, “আমি তাকে খুব ভালোভাবে নোটিশ করেছি, স্যার। ওই যুবকটা মেহমাদই।”
“মেহমাদ কেন এতগুলো মানুষকে মারবে? এমন যদি হয়, আইন ওকে কোনোভাবেই ছাড়বে না।”
“সেটাই একটা বিরাট প্রশ্ন, স্যার। ঠিক কীসের জোরে এটা করছে সে।”
“আমরা আইনের আশ্রয় নিব না। খুব সাবধানে পথেরকাঁটা উপড়ে ফেলব।”
“একদম। চব্বিশঘণ্টাই ওকে আমাদের লোকজন ফলো করছে। তবে ওর পেশা সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাচ্ছি না।”
“পেয়ে যাব শীঘ্রই।”
উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে রফিক বলল, “একটা দারুণ খবর কী জানেন? গত কয়েকদিন ধরে মেহমাদকে জেলা কমিশনারের সঙ্গে দেখা গেছে। দেখা গেছে বললে ভুল হবে, প্রতিটা পদক্ষেপে দু’জনে একসাথেই চলছে।”
“তারমানে মেহমাদ কোনোভাবে তাকে হাত করেছে।”
“কেউ হাত করলে তার অন্যায় কাজকে প্রশ্রয় দেয়ার যুক্তি কী, স্যার?”
“সেটাই তো ভাবাচ্ছে।”
আরামসে বসে যখন মেহমাদকে নিয়ে এতসব কথা ভেবে, তার প্রতি পদক্ষেপ ও এত সাহসিকতার সবগুলো সূত্র মিলানোর চেষ্টা করছিলেন, ঠিক সেই সময়ই ঘরের সদর দরজা আসা আইনের চার-পাঁচজন নামীদামী ব্যক্তিকে দেখে ওমায়ের আলী জানতে চাইলেন, “আপনারা এখানে?”
সবার মধ্যে থাকা প্রৌঢ় বয়সী একজন অফিসার কিছু অভিযোগপত্র দেখিয়ে বললেন, “আপনার নামে অভিযোগ আনা হয়েছে। সেই অভিযোগ তদন্তের জন্য সুষ্ঠু জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। আপনি এখুনি আমাদের সঙ্গে এলে ভালো হয়।”
ওমায়ের আলী হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। কী হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে? তিনি ঢোক গিলে বললেন, “অভিযোগ কে করেছে?”
“যাদের সাথে অন্যায় হয়েছে, তারাই।”
একমুহূর্তেই ওমায়ের আলী নিশ্চিত হয়ে গেলেন এসব মেহমাদ করছে। কিন্তু কেন? এই ছেলে আর কীভাবে কীভাবে তাকে ডুবিয়ে শান্ত হবে? মনের ভেতর প্রশ্ন নিয়ে স্বাভাবিক চেহারায় বললেন, “আমি অবাক হচ্ছি আপনাদের সাহস দেখে। আমার মতো একজন মানুষের নামে অভিযোগ উঠেছে, সেই অভিযোগ সত্য না কি মিথ্যে যাচাই না করেই আমাকে তুলে নিতে এসেছেন! আপনারা কী জানেন, আমি কী করতে পারি?”
“কে মন্ত্রী, কে পুলিশ, কে চেয়ারম্যান, এসব আমাদের দেখার দরকার নেই। আমরা শুধু অপরাধ দেখি এবং সেইমতো অ্যাকশন নিই।”
ওমায়ের আলী অফিসারের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, “ফিরে যান। এসব করে খামোখা দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম বাড়িয়ে সাংবাদিকদের পেট ভরাতে চাইছেন। এরচেয়ে আমি আপনাকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে দিই, আপনি পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করেন।”
“আপনার এই কাজের জন্য আমি যে আপনার ওপর অভিযোগ করতে পারি, সেটা কি আপনি জানেন?”
ওমায়ের আলী কথাটা গায়ে না মেখে রুমে গিয়ে আলমারি থেকে অনেকগুলো টাকা তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এগুলো নিয়ে যান।”
মুহূর্তেই দরজার পাশ থেকে দরাজগলায় মেহমাদ বলল, “শ্বশুর আব্বা, আপনি তো দেখি টাকার পাহাড় জমিয়ে বসে আছেন। এভাবে টাকা ছড়াছড়ি না করে তাদেরকে আসল কাজটা করতে দিন। আপনি যদি নির্দোষ হোন, অভিযোগ যদি মিথ্যে হয়, কেউ আপনার কিচ্ছু করতে পারবে না।”
ওমায়ের আলী রাগে কিড়মিড় করতে করতে বললেন, “তুমি এখানে কেন এসেছ?”
“আপনার পাশে দাঁড়াতে এলাম।”
“কী বলতে চাও?”
“আমার শ্বশুর আব্বা নির্দোষ সেটা প্রমাণ করতে হবে না?”
“আমি তোমার কাছে সাপোর্ট চেয়েছি?”
“তা চাইবেন কেন? আমার একটা কর্তব্য আছে না? শত হলেও আপনি আমার শ্বশুর আব্বা। এত সহজে আমি আপনাকে মানহানীর মুখে ফেলতে পারি?”
দাঁতে দাঁত চেপে মেহমাদকে এখানে হজম করলেন ওমায়ের আলী। আইনের লোকজন তাকে থানায় নিয়ে যেতে চাইলে তিনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য ফের ঘুশ দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার সমস্ত কাজকর্ম ও ঘুশ দেয়ার দৃশ্যটা ভিডিয়ো করে সরাসরি ডিসির নিকট পাঠানো হলো। তিনি সাদামাটা কোনো অপরাধী নন, এ যাবৎ তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ এসেছে তারমধ্যে সবচেয়ে বড়ো যে অপরাধ সেগুলো হলো, গুম, হত্যা, লুটতরাজ ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ আরও অন্যান্য যত অপরাধের সাথে যুক্ত সেসবের যতটুকু প্রমাণ পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এগুলো কতটুকু সত্যি, সেটাই এখন খতিয়ে দেখা বাকি।
***
বিকেলের দিকে মেহমাদ নিজের বন্ধু ফারাবীর সাথে দেখা করার জন্য একটা রেস্টুরেন্টে এলো। ফারাবী যে টেবিল বুকড করে বসেছিল, সেটার কাছাকাছি এসে তার থেকে দুই টেবিল পিছনে জেনিফারকে একজন পুরুষের সাথে দেখে খানিকক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে থেকে নিজের আসনে বসল মেহমাদ। জেনিফার তাকে দেখেনি। কথা বলাতে ব্যস্ত। ডানে-বামে কোনোদিকেই চোখ নেই তার।
মেহমাদ বসতেই ফারাবী বলল, “কেমন আছিস?”
“এইতো…।”
স্বাভাবিকভাবে বসে থাকতে পারল না মেহমাদ। কেমন অস্থির হয়ে গেল। আশ্চর্য! এখানে এত খারাপ লাগার কী আছে? মানুষের কি বন্ধুবান্ধব থাকতে পারে না? বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে না? দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ মনে এসব ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল, জেনিফার বিয়েতে রাজি ছিল না। হয়তো তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ আছে। সে-ই কেউটা কি এই পুরুষ? যতসব আলুথালু ভাবনায় ডুবেছিল সে।
এমন সময় ফারাবী বলল, “কী সমস্যা? চুপ মেরে আছিস কেন? তোর শ্বশুরের খবর কী?”
মেহমাদ বলল, “কী আবার? উনি তো জামিনের ব্যবস্থা করছেন মনে হয়। হয়তো জামিন হয়ে যাবে।”
“ওনাকে আটকে রাখার জন্য এগুলো কি যথেষ্ট নয়?”
“যথেষ্ট তো ছিল। আমার মনে হয় এবার লাস্ট স্টেপটা নিতেই হবে।”
পরবর্তী কাজ কীভাবে করবে, সেইসব নিয়ে ফারাবী উপায় বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেহমাদ তখনও শান্ত হতে পারল না, কারণ তার মাথায় আজ জেনিফার ঘুরছে। মনে জমেছে এই পুরুষকে নিয়ে নানান প্রশ্নের মেলা। আধঘণ্টা বসে দুই বন্ধুতে মিলে প্রয়োজনীয় আলাপ-আলোচনা সেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বিদায় নিল। তার দশমিনিট পর একটা মেয়ে এসে প্রবেশ করল সেখানে। খুঁজে খুঁজে জেনিফারকে পিছনের দিকে বসে থাকতে দেখে সেদিকে গিয়ে, পাশে বসে গল্প জমাল। আরও ঘণ্টাখানেক এখানেই কাটিয়ে আড্ডা শেষ করে, বিল পেমেন্ট করতে গিয়ে শুনল অনেক আগেই বিল পেমেন্ট হয়ে গেছে।
জেনিফার কৌতূহলী হয়ে ওয়েটারকে বলল, “আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমরা এখনও বিল পেমেন্ট করিনি।”
ওয়েটার বলল, “না না, আপনাদের বিল পেমেন্ট করাই আছে। এই দেখুন, ইফতেখার হোসেন নামে কেউ একজন বিল পেমেন্ট করেছেন।”
অবাক হয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে সামনে থাকা দুই নারী-পুরুষের দিকে তাকিয়ে রইল জেনিফার। ওরা কাঁধ নাচালে জেনিফার ঠোঁট উলটে ওয়েটারকে বলল, “আপনি কি শিওর এটা ইফতেখার হোসেন পেমেন্ট করেছেন?”
“জি ম্যাম। ঘণ্টাখানেক আগে উনি নিজেই এখানে বসেছিলেন।”
সামনের দিকের টেবিল দেখিয়ে বলল ওয়েটার। জেনিফার তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ওদের দু’জনের থেকে বিদায় নিয়ে বলল, “আসছি। প্রয়োজন মনে হলে ডাকিস।”
কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠল জেনিফার। মাথার মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন ভীড় জমাল। মেহমাদ যদি এখানে ছিলই, তার সাথে কথা বলেনি কেন? তাকে এখানে দেখেও সামনে দাঁড়ায়নি কেন? আড়ালে থেকে বিল মিটিয়ে কী বুঝাতে চাইল সে? খুব বেশি দায়িত্বশীল স্বামী? ভাবনাটায় ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দিল, কিন্তু টেনশনে সেই হাসিটাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মনের মধ্যে কেমন কেমন একটা অনুভূতির জন্ম হলো।
***
বাসায় ফেরার পথে জ্যামে পড়ল মেহমাদ। এত এত গাড়ির ভীড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। সে শূণ্য দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছিল জ্যাম ছাড়ার। মুখের মধ্যে থাকা চুইংগাম চিবোতে চিবোতে হঠাৎই দৃষ্টি বাইকের আয়নায় স্থির হলো। অমনি সতর্ক চোখদুটো তার কোনো এক বিপদের ইঙ্গিত টের পেল। হেলমেট মাথায় চাপিয়ে ফের ডানে-বামে, সামনে-পেছনে সবদিকে দৃষ্টি দিয়ে নিশ্চিত হলো, এই জ্যাম এত সহজে থামবে না। বাইকটা ওখানে রেখে অসংখ্য গাড়ির ভীড়ে নিজেকে লুকিয়ে নিয়ে ফুটপাতের একটা বৈদ্যুতিক খুঁটির পিছনে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিকে পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে মুখ চেপে ধরে মুহূর্তের মধ্যেই আড়ালে চলে গিয়ে উরাধুরা ক্যালানি দিল। লোকটা ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল, তবুও মেহমাদ থামল না।
একটা সময় লোকটার হাতে থাকা সমস্ত অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গাল চেপে ধরে বলল, “কে পাঠিয়েছে তোকে?”
“কেউ পাঠায়নি। আমি তো এমনিই দাঁড়িয়েছিলাম।”
“তুই যে এমনি-এমনি দাঁড়াসনি, সেটা আমি ভালো করেই জানি। সত্য প্রকাশ কর, নয় আজ তোকে জানে মেরে ফেলব। তুই কি ওমায়ের আলীর লোক?”
“আমি কিছু জানি না। আমাকে ছেড়ে দিন।”
“বেআইনী অস্ত্র নিয়ে ঘুরছিস আর বলছিস, আমি কিছু জানি না। আমাকে বাচ্চা মনে হয় তোর? বল, এখানে কে পাঠিয়েছে তোকে? কেন তুই রিভলভার আমার দিকে তাক করেছিলি? বল তাড়াতাড়ি, নয়তো…।”
মেহমাদ নিজেও একটা অস্ত্র বের করলে লোকটা জান বাঁচানোর জন্য বলল, “আমাকে রফিক পাঠিয়েছে।”
“ওহ, গুড। কেন?”
“আপনাকে মারার জন্য?”
“এখানে আর কয়জন আছে?”
“আর কেউ নেই।”
“মিথ্যে। তুই একা আসিসনি। এখানে তোর দলের আরও অনেকেই আছে। তাদের কার কী নাম ঝটপট বল। নয়তো আজ এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি না।”
মেহমাদের কানে একটা ব্লুটুথ ছিল। ফোনে তার সাথে লোকাল থানার এসআই ফারাবী যুক্ত আছে। সে সব কথা শুনছিল। অনাকাঙ্খিত এই বিপদের কথা কানে গেলে, মেহমাদ শুধু তাকে আকার-ইঙ্গিতে ঠিকানা দিল। ফারাবী জানাল, পাঁচ মিনিট লাগবে আসতে। সেই সময়টুকু মেহমাদ তার সামনে থাকা লোকটার থেকে ইনফরমেশন নিতেই ব্যয় করল। যখন পুলিশ তার টিম নিয়ে এলো, লোকটাকে আইনের হাতে তুলে দিয়ে, মেহমাদ আবারও নিজের বাইকে বসল। ডানে-বামে ও সামনে-পেছনে আগে যে কয়জন সন্দেহজনক লোককে দেখেছিল, এখন আর কাউকে দেখল না। জ্যামও ছেড়ে গেছে ততক্ষণে। সে বাইক স্টার্ট দিয়ে সোজা বাড়ির দিকে রওনা দিল।
বাড়ি ফিরে দেখল, জেনিফার তার আগেই ফিরে এসেছে। তাকে দেখে ঘটা করেই বিলের কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইল, “এটা আপনি পেমেন্ট করেছেন?”
হুট করে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি পড়াতে বিব্রতবোধ করল মেহমাদ। তাও নিজেকে স্থির রেখে বলল, “হ্যাঁ, করেছি।”
“আপনি ওখানে কেন গিয়েছিলেন?”
“যে কারণেই যা-ই আপনাকে ফলো করতে যাইনি।”
“আমি কি সেটা বলেছি?”
“না বললেও আপনার ইঙ্গিত ওরকমই ছিল। আমি আমার কাজে গিয়েছিলাম, জেনিফার। আপনাকে দেখার পর মনে হলো, বিলটা নিজেই দিয়ে যাই।”
“হুম, ভালো কথা। আমার প্রশ্ন সেটা নয়, আমি বলতে চাইছি, আপনি যখন আমাকে ওখানে দেখলেন, সামনে কেন যাননি? লুকিয়ে-চুরিয়ে বিল পেমেন্ট করে কী বুঝাতে চান?”
মেহমাদ মাথায় হাত দিয়ে বলল, “আমি খুব টায়ার্ড। এখন এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।”
“উত্তর আপনাকে দিতেই হবে।”
জেদ ধরে পাথরের ন্যায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে মেহমাদ তাকে পাত্তা না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। জেনিফার শক্ত মুখে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি কিন্তু বুঝতে পারছি আপনি কেন এমনটা করেছেন।”
মেহমাদ ওয়াশরুম থেকেই বলল, “বেশ তো। বুঝেছেন, এখন বসে বসে মুড়িমাখা খান।”
“মুড়ি এনে দেন। সাথে পেয়াজ, সরষেতেল আর পকোড়াও এনে দিতে পারেন। আমি রাগ করব না।”
কট করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো মেহমাদ। জেনিফারের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আর কী লাগবে?”
আচমকা প্রশ্ন শোনে মুখ বাঁকিয়ে জেনিফার বলল, “কিচ্ছু লাগবে না।”
“এইতো বললেন, এটা-ওটা লাগবে। এখন, মানা করছেন কেন?”
“আপনি একটা ধান্ধাবাজ লোক। আমি ধান্ধাবাজ লোকদের পছন্দ করি না। তাদের সাথে ভাব জমাতেও পছন্দ করি না, তাদের কাছে ঋণী থাকতেও পছন্দ করি না।”
কথা শেষ করে পার্স থেকে বিলের টাকা বের করে মেহমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে জেনিফার আবারও বলল, “যে সম্পর্ক ক্ষণিকের জন্য তৈরী হয়েছে, সেই সম্পর্ককে ঘিরে কোনো ঋণ তৈরী হোক, আমি সেটা চাই না। এরপর থেকে আমার জন্য আপনি আর টাকা খরচ করবেন না।”
জেনিফার চলে গেলে মেহমাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কপালে হাত চেপে বিছানায় বসল। তার ধারণা মিথ্যে নয়। শুধু তার কথা রাখতে ও গ্রামের মানুষের ভালো চাইতে গিয়ে নিজেকে একটা নামহীন সম্পর্কের মধ্যে আটকে রেখেছে বেচারী। ইশ, কী ভুল করল সে? কেন সবার কথা ভাবতে গিয়ে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিল? এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তির উপায় কী?
***
চলবে…
গান শেষ করে অনেকক্ষণ ইয়াশও ইমির দিকে তাকিয়ে থাকল। একসময় চোখ নাচিয়ে বলল, “রাজহংসের কণ্ঠে গান কেমন শুনলি, বললি না তো!”
ইমি চোখের পানি চোখেই আটকে নিয়ে মুচকি হেসে বলল, “খারাপ না, ভালোই।”
রুশা ও ইশরাত প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিলেও ইমি সেসব কানে না নিয়ে মাদুর ছেড়ে উঠে বলল, “আমার আর খেলতে ইচ্ছে করছে না। আমি যাচ্ছি।”
ইশরাত কণ্ঠে হতাশা নিয়ে বলল, “যাহ্, এখনও তো জুটিবেঁধে খেলা জমলোই না আপু। এরমধ্যেই উঠে যাচ্ছ?”
মাদুর থেকে সরে ইমি পায়ে জুতো পরে বলল, “তোরা খেল। আমার মাথাব্যথা করছে।”
সবাই যখন বেকুব বনে গিয়ে ওর দিকে তাকাল, তখনই ইমি ইয়াশকে বলল, “তোর গানের গলা এতোই সুন্দর যে আমার মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছে। ফাটাবাঁশ ও রাজহংসের আওয়াজও এরচেয়ে ভালো। নেক্সট টাইম আর গান গাইবি না। তোর গলার আওয়াজে আশেপাশের মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে।”
ইয়াশ দাঁত কটমট করে বলল, “কী বললি?”
এইবলে আশেপাশে কিছু একটা খুঁজল ইয়াশ। না পেয়ে হাতে থাকা লুডোর সাদা ডাইস ছুঁড়ে মারলে ইমি তার আগেই দৌড় দিল। ডাইস ছুঁড়ে মারাতে ওটা ঘাসের ফাঁকফোকরে আটকে গিয়ে হারিয়ে গেল। ইশরাত কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল, “তুমি ওটাকে ছুঁড়তে গেলে কেন?”
“বেশ করেছি।” শক্ত কণ্ঠে এইটুকু বলে বড়ো সাইজের লুডোটাও ছিঁড়ে ফেলে হনহনিয়ে ঘরে চলে গেল ইয়াশ।
রুশা চুপটি করে বসে দুটোর অকারণ রাগারাগি ও মান-অভিমানের কারণ বুঝতে চাইল। এদিকে ইশরাত হাত-পা ছড়িয়ে কেঁদে ফেলবে, এমন সময় রুশা বলল, “ইশু, কোথাও একটা গণ্ডগোলের আভাস পাচ্ছিরে।”
***
* পড়ুন ই-বই ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়’
https://link.boitoi.com.bd/CWHp