#জামাই_শ্বশুর
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৯
আইনের নোটিশ অমান্য করার পরও ওমায়ের আলীকে সুযোগ ও সময় দুটোই দেয়া হয়েছিল, যেন গ্রামবাসীর সামনে তিনি অপদস্ত বা অপমানিত না হয়ে নিজ উদ্যোগেই রাস্তার ঝামেলাটা মিটিয়ে নেন। কিন্তু ওমায়ের আলী কিছুই করেননি। নিজের রাগ, জেদ ও অহমিকা বজায় রেখে শক্ত পায়ে সরকারী জায়গা ভোগদখল করে যাচ্ছেন। নির্ধারিত সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পরও কাজ হয়নি দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্যে রাস্তা ঠিকঠাক করার কাজ শুরু হলো। কাজ শুরু না করলে সমাপ্তি হবে না। যেহেতু জায়গার মাপ ও সীমানা চিহ্নিত করা, তাই এর শুরু নিয়ে কোনো সমস্যা হলো না। যেখান থেকে রাস্তার শুরু হয়েছে, সকাল থেকে ঠিক সেখানেই ট্রলি দিয়ে মাটি এনে ভরাট করা চলছে। চেয়ারম্যান সাহেব নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ শুরু করেছেন এবং তার সঙ্গী-সাথী হিসেবে আইনের লোকজন, পরিচিত লইয়্যার ও গ্রামবাসী সবাই-ই উপস্থিত আছে। সকলের মুখে উপচেপড়া হাসি দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, দীর্ঘবছর পর রাস্তা পেয়ে তারা ঠিক কতখানি খুশি।
একদিকে মাটি দিয়ে রাস্তা ভরাট করা হচ্ছে, অন্যদিকে রাস্তার সামনে বাধাপ্রদান করা গাছগাছালি কাটতে হচ্ছে। যেহেতু গ্রামের মানুষের সুবিধার জন্য এই রাস্তা, সেজন্য এটাকে একদম পরিচ্ছন্ন ও প্রয়োজন অনুযায়ী চওড়া রাখতে হবে। যাতে করে সব ধরনের গাড়ি এই পথে সহজে যাতায়াত করতে পারে। গাছগাছালি কাটাকুটির ফাঁকে চেয়ারম্যান সাহেব যখন ওমায়ের আলীর বাড়ির প্রাচীর ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখনও গ্রামের মানুষের হুলস্থুল শোনে বাইরে আসেননি ওমায়ের আলী।
বাবা যদি কোনো গণ্ডগোল করেন, সেইজন্য সকালেই বাবার এখানে এসেছে জেনিফার। নিজের রুমে থাকা প্রয়োজনীয় জিনিস সরিয়ে, মায়ের স্মৃতিগুলো আঁকড়ে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় রেখে মোশাররফ হোসেনের সামনে এসে বলল, “আপনারা প্রাচীর ভাঙতে পারেন, বাবা। দরকারী জিনিস সব সরিয়ে ফেলেছি।”
মোশাররফ হোসেন একপলক ছেলের বউকে দেখে, তার সাহসিকতা ও সততায় মুগ্ধ হয়ে মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুমি মন খারাপ কোরো না, মা। ন্যায়ের পথে চললে এমন অসংখ্য সুখ এসে প্রাপ্তির খাতায় জমা হবে।”
“আমি মন খারাপ করিনি, বাবা।”
“তোমার বাবা কোথায়? তাকে ডাকো। তার অনুমতি ছাড়া কাজটা করা যাবে না।”
“বাবা ঘরে নেই। এমনকি জায়ানও নেই, রফিক ভাইও নেই। আমার মনে হয় তারা শহরে চলে গেছে।”
“কী বোলো! তাহলে তুমি একটা কল কোরো।”
“আমি কল করেছি, লাভ হয়নি। বাবার নম্বর বন্ধ দেখাচ্ছে। আমি অনুমতি দিচ্ছি। আপনারা আপনাদের কাজ করুন।”
ভাঙাভাঙির এই সময়ে মেহমাদ উপস্থিত ছিল না। সকালে বেরিয়েছিল, এখনও ফিরেনি। সকাল ফুরিয়ে দুপুর হয়ে এসেছে। মাপযোগ নিয়ে নির্দিষ্ট অংশ ভাংচুর চলছে। সেই ভাংচুরের সাথে এই বাড়ির আনাচে-কানাচে জমে থাকা একেকটা স্মৃতিও ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। কষ্ট হলেও মনকে বুঝিয়ে নিয়েছে জেনিফার। আর যাই হোক, বেআইনীভাবে বিশাল অট্টালিকায় দিন কাটিয়েও শান্তি নেই। শান্তি তো সেই কুঁড়েঘরে, যেখানে বিশ্বস্ততা আছে। এজন্যই বলে; ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ। মাঝেমধ্যে এমনকিছু ত্যাগও করতে হয়, যে ত্যাগের বিনিময়ে অসহায় মানুষগুলো হাসবে, বাঁচবে।
জেনিফার লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছিল ওমায়ের আলীকে। কিন্তু কোনোভাবেই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারল না। উপায় না পেয়ে, বাসার কাজের লোকেদের কাছে বাবার খোঁজ নিল। তারাও জানাল, ওমায়ের আলী সেখানে নেই। যদিও সকালে একবার গিয়েছিলেন, এরপর ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে কোথায় যেন চলে গেছেন। সাথে জায়ান ও রফিক দু’জনেই আছে।
হতাশ জেনিফার বাড়ির বাইরের অংশে একটা চেয়ার পেতে বসল। বকুল তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা তাকে নানাভাবে হাসানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু কোথাও যেন মনের মধ্যে একদলা কষ্ট জমে থেকে জেনিফারকে খণ্ডবিখণ্ড করে দিচ্ছে। সে যতই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে, ততই মনটা তীব্র ব্যথায় হাহাকার করছে। মনটা অপ্রকাশ্য বলেই মনের ব্যথা কাউকে দেখাতে পারছে না, বুঝাতে পারছে না। আবার সহ্যও করতে পারছে না।
বিকেলের শেষদিকে মেহমাদও সেখানে উপস্থিত হলো। কাজ কতদূর এগোলো, সেটাই দেখতে এলো সে। ততক্ষণে উঁচু স্থাপনার একাংশ মাটির সাথে মিশে গেছে। সেখান দিয়ে নির্বিঘ্নে হাঁটাহাঁটি করছে গ্রামের মানুষজন। মেহমাদ দাঁড়িয়ে থেকে জানতে চাইল, “আপনার বাবা কোথায়, জেনিফার?”
“জানি না।” নিচুস্বরে উত্তর দিল জেনিফার।
জেনিফারের থমথমে মুখটা দেখে খানিকক্ষণ চুপ থাকল মেহমাদ। গ্রামের মানুষের মুখের উপচেপড়া হাসির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কত বছর পর এই গ্রামের মানুষজন একটা রাস্তা পাচ্ছে। সবকিছু সম্ভব হয়েছে আপনার জন্য।”
“আমি কিছুই করিনি।”
“কিছু না করেও অনেককিছু করেছেন, জেনিফার। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভাংচুর দেখছেন, তাতে গ্রামের মানুষ ধরে নিয়েছে, আপনি তাদের পাশে আছেন। এইটুকুতেই তারা ভীষণ খুশি। আপনি যদি নিষেধাজ্ঞা দিতেন, এটা সম্ভব হতো না।”
জেনিফার কোনো আওয়াজ করল না। একদৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে থাকল। চোখের সামনে অনেকগুলো বাচ্চার খিলখিল হাসি, দৌড়, মাটি ও ইটের টুকরো ছোঁড়াছুড়ি দেখে শান্তি পেল মনে। দু’চোখে স্বস্তি ও শান্তি নিয়েই বলল, “অবশেষে… আপনার কঠোর পরিশ্রম সফলতার মুখ দেখল।”
“হ্যাঁ…।”
“এরপর?”
প্রশ্নটা ঠিক বুঝল না মেহমাদ। ঠোঁটে হাসি নিয়েই বলল, “কী এরপর?”
বকুল কাছেই ছিল। জেনিফার বলল, “বকুল, তোর ভাইজানের জন্য এক কাপ চা নিয়ে আয়। কড়া লিকারের চা আনিস। সাথে লেক্সাস বিস্কিট আনবি।”
আদেশ শোনে বকুল এই বাড়ির ভেতরের রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। মেহমাদ তখনও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল স্ত্রীর দিকে। জেনিফার সে-ই দৃষ্টি দেখে পা দু’খানা নাচাতে নাচাতে বলল, “রাস্তার সমাধান তো হয়েই গেল। নামমাত্র সম্পর্ক থেকে মুক্তি কবে পাব?”
এক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল মেহমাদ। পরমুহূর্তেই নিজের বলা কথাগুলো মনে পড়ল। শান্ত চোখে চেয়ে থেকে বলল, “পেয়ে যাবেন, শীঘ্রই।”
“লাভ-ক্ষতির হিসেবটা ক্লিয়ার করবেন না?”
মেহমাদ এবারও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। জেনিফার সামান্য হেসে বলল, “আপনিই তো বলেছিলেন, আপনার মতো বেকারকে বিয়ে করলে ভবিষ্যতে লাভ-ক্ষতির হিসেব দেখাবেন। ভুলে গিয়েছেন?”
“না, ভুলিনি।”
“তাহলে? হিসেবটা কখন দিবেন?”
“হিসেবটার কি খুব দরকার?”
“ওমা! দরকার হবে না? এইযে, আপনার কথার ওপর ভরসা করে আমি আমার চাওয়াগুলো বিসর্জন দিলাম, সেসব পূরণ হবে কী করে? এখন যদি হিসেব করতেই যাই, দিনশেষে আমার ভাগে শূণ্যই থাকবে। পড়াশোনাতে আমি খুব একটা ভালো ছিলাম না, মেহমাদ। কিন্তু হিসেবটা ঠিকই বুঝি। এই শূণ্য দিয়ে আমি নিজেকে যেমন কোনোরূপ সান্ত্বনা দিতে পারব না, ভবিষ্যতেও শূণ্যের আগে-পরে কোনো সংখ্যা বসাতে পারব না। হিসেবের খাতায় যদি শূণ্যই থাকে, এখানে আমার লাভটা কী হলো বলবেন?”
মেহমাদ এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারল না। চরম হিসাবী মানুষটাও আজ নিজের জীবনের হিসেবে গড়বড় করে ফেলল। কথার তাল হারিয়ে ফেলাতে কোনোপ্রকার শব্দ এলো না। সান্ত্বনাও এলো না।
জেনিফার একটা দীর্ঘশ্বাস গিলে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চা খেয়ে যাবেন। আমি আর বসব না। সন্ধ্যে হয়ে গেলে একা যেতে ভয় পাব।”
“কোথায় যাবেন?” চমকে গিয়ে প্রশ্ন করল মেহমাদ।
“যেখানে যাওয়া উচিত, সেখানে।”
মেহমাদ ধরে নিল জেনিফার তাদের বাড়ির কথা ইঙ্গিত করছে। তাই এই নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করল না। জেনিফার এগিয়ে গেল সামনের দিকে। কিছুদূর গিয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল মেয়েটা।
***
মাটি ভরাটের কাজ শেষ করে, গ্রামের মানুষের জন্য রাস্তাটা উন্মুক্ত করে বাবা-ছেলে বাড়ি ফিরে এলেন। মোশাররফ হোসেন আজ একটু স্বস্তিবোধ করলেন। বহু বছরের ফেলে রাখা রাস্তাকে এবার মুক্ত হতে দেখে সবাই-ই খুশি। খুশি তিনিও।
মেহমাদ রুমে এসে অভ্যাসবশত জেনিফারকে ডাকল। না পেয়ে সারাবাড়ির এদিক-ওদিক খুঁজে রান্নাঘরে গিয়ে মাকে বলল, “মা জেনিফার কোথায়? রুমে দেখছি না যে।”
রেজি সুলতানা রান্না রেখে ছেলের সামনে এসে বললেন, “ও তো ব্যাগ গুছিয়ে শহরে গেল। ওর বাবার কাছেই গেছে হয়তো।”
“তুমি জিজ্ঞেস করোনি?”
“না… আমি তো ভেবেছি, ও বাবার ওখানে গিয়ে কিছুদিন থাকতে চাইছে, তাই গেছে। কেন, কোনো সমস্যা? আসতে বলব?”
দু’দিকে মাথা নেড়ে রুমে এসে বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকল মেহমাদ। ফোন করবে কি না, এই করতে করতে পাঁচ মিনিট চলে গেল। নিজের মনের সাথে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ এর দ্বন্দে পেরে উঠতে না পারাতে ফোন হাতে তুলে জেনিফারের নম্বরে ডায়াল করল। ফোন ঢুকল না, উলটে নম্বর বন্ধ দেখাল। চিন্তিত মেহমাদ রুমের ভেতরে পায়চারী বাড়িয়ে দিল তবুও মনকে শান্ত করতে পারল না।
ওমায়ের আলী নিজের শহরের বাসায় নেই, গেলেও ঢুকতে পারবেন না আর। চারিদিকে পুলিশের লোকজন তাকে ও তার দলবলকে ধরতে ওঁতপেতে আছে। তিনি যতই চালাকি করুন, আর পার পাবেন না। কারণ তিনি বড়োসড়ো মামলায় ফেঁসে গেছেন। জামিনেও এবার আর তার মুক্তি নেই। জেনিফারের নম্বর বন্ধ দেখে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল মেহমাদ। যখনই মনে পড়ল ওখানে পুলিশ আছে, সে তার প্রিয় বন্ধু ফারাবীকে ফোন করল। রিসিভ্ হতেই বলল, “কোনো খোঁজ পেয়েছিস?”
ওপাশ থেকে ফারাবী বলল, “না পাইনি।”
“আচ্ছা, একটা ইনফরমেশন দে আমাকে। তুই একটু ভেতরে গিয়ে দেখত, ওখানে জেনিফার আছে কি না! ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।”
“আমি ঘরেই আছি। ভাবী আমার সামনেই বসা। তুই কথা বলবি?”
মেহমাদ আমতা-আমতা করে বলল, “হুঁ…।”
ফারাবী ফোন দিল কি না, নিশ্চিত হতে পারল না মেহমাদ। ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। এদিকে লাইনও কাটছে না। নীরবতাতেই দ্বিধা সরে গেল তার। বলল, “শুনতে পাচ্ছেন?”
এবার আওয়াজ এলো, “হুম।”
খানিকটা রাগ ও দাম্ভিকতা বজায় রেখে মেহমাদ বলল, “আপনি তো আজব মানুষ। এইভাবে কেউ চলে যায়?”
“কী করতাম?”
“লাভ-ক্ষতির হিসেব লাগবে না আপনার?”
“দরকার নেই তো।”
“কেন দরকার নেই?”
“কেনর কোনো উত্তর নেই।”
মেহমাদ একটু রয়েসয়ে বলল, “আমি কথা দিয়েছিলাম না, নামমাত্র সম্পর্কে যতদিন থাকব, ততদিন আপনাকে ছোঁবো না? আমি তো কথা রাখতে পারিনি, জেনিফার। না চাইতেও কথার নড়চড় করে ফেলেছি। আর আপনি বলেছিলেন, যদি কথার নড়চড় হয়, শাস্তি দিবেন। মনে আছে?”
“হ্যাঁ, মনে আছে।”
“তাহলে? শাস্তি না দিয়ে দূরে চলে গেলেন কেন? আগে আমাকে আমার ভুলের শাস্তি দিন, তারপর যেখানে খুশি সেখানে যান। আমি বাধা দেব না।”
“কী শাস্তি দিব?”
“যা মন চায়!”
“মন তো কিছুই চায় না, কিচ্ছু না।”
“তাই?”
“হুম।”
“অকে, কবে ফিরবেন?”
“ফিরব না।”
“সত্যিই না?”
“কেন ফিরব?”
“শাস্তি দেয়ার জন্য।”
“ফাজলামি না করে ফোন রাখুন। এখানে অনেক মানুষ আছে। ওনাদের চা-নাশতা দিতে হবে।”
মেহমাদ ফোলা ফোলা মুখ নিয়ে বলল, “আর আমি যে সারাদিন ধরে না খেয়ে আছি, সেটা কে দেখবে?”
“এটা কি আমার দেখার কথা?”
“আপনার নয়তো কার? পাশের বাসার ভাবীর?”
“ছিঃ…। নজর ঠিক করুন।”
“নজর তো ঠিকই আছে। এদিক-সেদিক করিনি।”
ফিসফিসানির পর রাগত্বস্বরে ভেসে এলো, “রাখছি। আর আমাকে বিরক্ত করবেন না।”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মেহমাদ সিদ্ধান্ত নিল, জেনিফারকে আর বিরক্ত করবে না। তাকে তারমতো বাঁচতে দিবে। তাদের সম্পর্কে অধিকারের আগেই অভিমান চলে এসেছে। এই অভিমান ভাঙার কোনো উপায় জানা নেই। সত্যিই তো, লাভ-ক্ষতির হিসেবে জড়িয়ে মেয়েটার লস বৈ লাভ হয়নি। একে তো স্বামীর সংসার হবে না, দ্বিতীয়ত বিচ্ছেদ হলে ডিভোর্সি তকমা লাগবে গায়ে। সেই তকমাকে গায়ে মেখে পরবর্তী জীবন এগিয়ে নেয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে তারজন্য। তাছাড়া সেদিনের সেই পুরুষ যদি তাকে গ্রহণ না করে? যদি কলঙ্কিনী ভেবে ছুঁড়ে ফেলে, তখন কী হবে? যে ভাবনাগুলো আরও আগে মনে আসার কথা, যে ভাবনা নিয়ে আরও আগেই সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা, সেই ভাবনা বড়ো অসময়ে এসে তাকে পুরোটাই দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। এর সঠিক সমাধান কী, কীভাবে হবে, ভেবে পেল না মেহমাদ। তবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারলে হয়তো সংসারটাকে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারত। এটাও তো হলো না। এখন কী করবে?
রাত গেল, দিন এলো, তবুও মেহমাদ এই কঠিন সমস্যার যুতসই কোনো সমাধান খুঁজে পেল না। শুধু নিজের চারপাশে অদ্ভুত শূণ্যতা অনুভব করল। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, এমন মনে হলো। এই শূণ্যতা কাউকে বলারও উপায় রইল না। তীব্র অভিমান বুকে নিয়ে গোটা সপ্তাহ কাটিয়ে দিল। ভুল করেও জেনিফারকে কল করল না, ম্যাসেজ দিল না। কাজের মধ্যে ডুবে থেকে বুঝিয়ে দিল, সে মোটেও কাউকে বিরক্ত করতে পছন্দ করে না।
ছেলের এমন বিষণ্ণ চেহারা ও উদাসী চলাফেরা রেজি সুলতানার নজরে পড়ল। এক সকালে চা-নাশতার ফাঁকে আকারে-ইঙ্গিতে তিনি ছেলের মনের খবর জানতে চেয়ে বললেন, “বউমা কবে আসবে?”
মেহমাদ খাবারে মনোযোগ দিয়ে বলল, “জানি না, কথা হয়নি।”
“সেকী কথা! কথা হবে না কেন? তুই ফোন করিস না?”
“আমার অনেক ব্যস্ততা, মা। ফোন করার সময় নেই।”
“আহারে আমার গুণধর পুত্র, দিনরাত তোমার এতই ব্যস্ততা যে, বউয়ের খোঁজখবর নেয়ার সময় পাও না? এমন করলে তো চলবে না বাবা। বউয়ের জন্যও ভাবতে হবে।”
মেহমাদ নাশতার প্লেটে আঁকিবুঁকি করে গেল, রেজি সুলতানা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “বাবার দোষে মেয়েটা কেন শাস্তি পাবে, মেহমাদ? তার তো কোনো অন্যায় নেই। সে এই ঘরের বউ, এই ঘরের সম্মান। তার সম্মানের দায়িত্ব তো তোমার কাঁধেই। তুমি কেন তোমার দায়িত্ব থেকে সরে যাবে?”
জেনিফার বিচ্ছেদ চায়, এই সত্যিটা কীভাবে বলবে মাকে? কীভাবে বলবে, বিচ্ছেদের এই সিদ্ধান্ত বন্ধন শুরুর আগেই নেয়া? সাহস ও মনের জোর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই মেহমাদের। শুনেও না শুনার ভান করে চুপ হয়ে থাকল। রেজি সুলতানা ফের বললেন, “ফেরার পথে বউমাকে নিয়ে ফিরিস। ও ছাড়া ঘরটা একদম খালি খালি লাগছে।”
***
চলবে…
“উইল ইউ বি মাই বেস্টফ্রেন্ড?”
উষাদের এই কথায় ভীষণরকম চমকাল রুদিতা। বিয়ের প্রথম রাতে কেউ বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়? এমন সংজ্ঞা ও সম্পর্ক নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই মনে। সে শুধু জানে, পুরুষের কাছে নারীদের মন বলতে কিচ্ছু নেই। হাসি মুছে গিয়ে আবারও তার চেহারায় ফুটে উঠল একরাশ বিস্ময়।
উষাদ তার বিস্ময়কর ভাব দূর করতে বলল, “বন্ধুত্ব এমন এক সম্পর্ক যেখানে বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা সবকিছু লুকিয়ে আছে। সম্পর্ক মজবুত রাখতে সবার প্রথমেই দু’জনের মনে দু’জনকে ঘিরে কোনো ভয়ভীতি জন্ম নেয়ার আগে, বিশ্বাসটা পাকাপোক্ত হওয়া জরুরী। এই বিশ্বাসের ওপর ভর দিয়েই সম্পর্ক এগোনো সহজ হবে। তখন তুমি নিজেই বুঝবে, সব পুরুষ সমান নয়। কিছু পুরুষ হয়, নারীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত আশ্রয়। এখন বোলো, বন্ধু হবে আমার?”
নির্ভরতার হাত বাড়াল উষাদ। রুদিতা একপলক সেই হাতের দিকে তাকাল। আবার উষাদের গভীরচোখের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করল। কয়েক সেকেন্ড পর, উষাদ উপরনিচ মাথা নেড়ে বলল, “হবে না?”
সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে নিজের ডানহাতটা উষাদের হাতে রাখল। এই প্রথমই স্বেচ্ছায় উষাদকে স্পর্শ করল রুদিতা। হাতটা কেঁপে কেঁপে উঠল। কম্পনরত হাত মুঠোবন্দী করল উষাদ। মৃদুস্পর্শে অধর ছুঁলো হাতের তালুতে। বলল, “আমি এই দুটোহাত সারাজীবন এইভাবেই আগলে রাখার চেষ্টা করব, ইনশা’আল্লাহ।”
টালমাটাল দেহখানি এতক্ষণ খুব কষ্টে আটকে রেখেছিল রুদিতা। এইটুকু স্পর্শের পর আর পারল না। শরীরের সবটুকু শক্তি হারিয়ে যেতে লাগল তার। হাতের সাথে সাথে এখন সারা শরীর কাঁপছে। চোখ বন্ধ করে গভীর করে শ্বাস টেনে ভারী হওয়া নিঃশ্বাসটা অতি সন্তর্পণে আড়াল করে নিতে চাইল। মনে মনে অন্তহীন প্রার্থনায় ডুব দিল। তার এই রুক্ষশুষ্ক মুখখানি দেখে দেখে ভয় পেল উষাদ। জানতে চাইল, “তুমি ঠিক আছো?”
আগের দিন যেহেতু জ্বর ছিল, উষাদের মনে হলো আজও বোধহয় জ্বর এসেছে। কপাল ছুঁয়ে জ্বরের মাত্রা চেক করল। সব স্বাভাবিক বুঝতে পেরে, অর্ধাঙ্গিনীর ভয় দূর করতেই হাত বাড়িয়ে তাকে আগলে নিয়ে, ভরসায় ন্যায় বুকের সাথে জড়িয়ে রেখে বলল, “জীবন একটাই। বাঁচতে হবে। পিছনের অধ্যায়টাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকলে চলবে, বোলো?”
ডুকরে কেঁদে উঠল রুদিতা। উষাদ বাঁধা দিল না। কাঁদতে দিল। নিঃশব্দে জড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। মাথার উপরিভাগে অধর ছুঁইয়ে ধীরকণ্ঠে বলল, “এসো, ঘুমাবে। তোমার ঘুম দরকার। এভাবে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যদি নির্ঘুম রাত কাটাও, আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
***
* পড়ুন ই-বই ‘সুতোয় বাঁধা জীবন’
https://link.boitoi.com.bd/RUXc
***