#জামাই_শ্বশুর
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
শেষপর্ব
ওমায়ের আলী জানতেন, তার সামনে আর পথ খোলা নেই। প্রতিটা পথের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে মেহমাদ। কীভাবে করেছে সেটা বিরাট প্রশ্ন। তবে তিনি হার স্বীকার করতে রাজি নন, তাই সাঙ্গপাঙ্গরা আইনের হাতে ধরা পড়ে গেলেও তিনি নিজের ডানহাত রফিককে নিয়ে গোপনে দেশ ছাড়ার ফন্দি আঁটলেন। সাথে রাখলেন জায়ানকেও। ছেলেটা এখনও অনেক ছোটো। দশম শ্রেণীর ছাত্র সবে। এই বয়সে এত দ্বন্দ ও রাজনীতির মারপ্যাঁচ সে বুঝে না। তাই তাকে একটা সুন্দর ও নির্ভেজাল জীবন উপহার দিতে পারলেই শান্তি। কিন্তু কে জানত, সেই সদিচ্ছাও পূরণ হবে না? এই ক’দিন লুকিয়ে-চুরিয়ে নিজেদের আইনের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিতে পারলেও শেষবেলা আর রক্ষে হলো না। সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে রাতের অন্ধকারে দেশ ছাড়তে গিয়ে বিজিবির কাছে ধরা পড়ে যান এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। এই খবর শোনা মাত্রই সকালের নাশতা কোনোমতে শেষ করে, অ্যারোপ্লেনে সিলেটে এসেছে মেহমাদ। ওমায়ের আলী ও রফিককে গ্রেফতার করে আইনের হাতে তুলে দেয়া হলেও জায়ানকে মুক্ত করা হয়। যেহেতু তার কোনো অপরাধ নেই, এবং সে এসবের সাতে-পাঁচে নেই, তাই তাকে নির্দোষ দাবী করতে, মেহমাদ নিজেই তার গার্ডিয়ান হলো। এরপর ওমায়ের আলীকে আইনে আশ্রয়ে রখে সে জায়ানকে নিয়ে নিজ শহর চট্টগ্রামের দিকে রওনা হলো।
জেনিফার এই সম্পূর্ণ খবর জানতে পারল টেলিভিশনের পর্দায়, তা-ও দুপুরের পর। সেখানে ওমায়ের আলী ও তার দলের সবাইকে গ্রেফতারের দৃশ্য দেখানোর পাশাপাশি সেদিনের সেই ফুটেজে দেখতে পাওয়া তার বাবার দলের সবাইকে চিকিৎসারত অবস্থায় একটা হসপিটালে দেখল। সব খবরাখবর দেখে ভারী যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেন যেন। সেদিনের সেই ফুটেজ দেখে মন মানতে চায়নি, মেহমাদ দোষী কিংবা খুনি। আজ তার নিশ্চয়তা পেয়ে হালকা হলো একটু। যদিও তার পেশা সম্পর্কে শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে সবটাই শুনেছে, তবুও ফুটেজটা দেখে মনের মধ্যে ভয় জন্ম নিয়েছিল। কাছের ও আপন মানুষদের কেউ-ই অপরাধীর তালিকায় দেখতে চায় না। সে-ও চায়নি, সর্বগুণেগুণান্বিত, সৎ ও সুন্দর মনের মানুষটা কোনো খারাপ কাজে-কর্মে যুক্ত থাকুক।
দেশের সব খবর টেলিভিশনে এলেও মেহমাদকে নিয়ে একটা খবরও এলো না। চিকিৎসারত যারা প্রত্যেকেই নিজেদের দোষ স্বীকার করে ওমায়ের আলীকে ফাঁসিয়ে দিল ঠিকই, তবে কেউ মেহমাদ নামক ব্যক্তিকে নিয়ে টুঁ-শব্দটিও করল না। আশ্চর্য এক মানুষ। কোনো শিরোনামেই থাকতে চায় না। অথচ এই সবকিছুর পিছনের সমস্ত ক্রেডিট মেহমাদের। যদি সে সাহস না করত, ওমায়ের আলীকে এত সহজে আইনের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব ছিল না।
এতসব কথা ভাবতে গিয়ে ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করল জেনিফার। তারমধ্যে ভাইয়ের জন্য মনটাও অস্থির হয়ে উঠল। সে মেহমাদকে কল না দিয়ে নিজের শাশুড়ির নম্বরে ডায়াল করল। রিসিভ্ হতেই সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে জানতে চাইল, “মা, জায়ান কি ওখানে আছে? এই ক’দিন ওর কোনো খোঁজ আমার কাছে ছিল না। ভীষণ টেনশন হচ্ছে।”
ওপাশ থেকে রেজি সুলতানা তাকে নির্ভার রাখতে বললেন, “ও তো এখানেই আছে। এইমাত্র মেহমাদ ও’কে আমার কাছে রেখে বাইরে গেল। তুমি কি ওর সাথে কথা বলবে?”
“জি, মা।”
পাশে বসে থাকা জায়ানের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে রেজি সুলতানা নিজের কাজ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জায়ান বলল, “আপু, ওনারা বাবাকে আটকে রেখেছে। বাবা না কি অপরাধী! বাবা কী করেছে আপু?”
ছোটোবেলা থেকে বাবার আদর-শাসন পেলেও বাবার কাজ ও পেশা নিয়ে দুই ভাইবোন একদমই মাথা ঘামাত না। জায়ান এমনিতে ভালো স্টুডেন্ট, সেই হিসেবে তার সব ধ্যানজ্ঞান থাকত পড়াশোনাকে ঘিরে। কে কোথায় যায়, কী করে, এসব নিয়ে একেবারেই ভাবত না। এজন্য নিজের বাবা যে অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে থাকতে পারেন, সেসবও তার জানার ও ভাবনার বাইরের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন করে অবুঝের মতো উত্তর অপেক্ষায় মুখিয়ে রইল জায়ান।
জেনিফার বলল, “এসব নিয়ে ভাবিস না তো। যে অপরাধী চিন্তা তার, আমাদের নয়। ঠিক আছিস তুই? সুস্থ আছিস?”
“আমি ঠিক আছি আপু।”
“এই ক’দিন কোথায় ছিলি?”
“বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেরিয়েছি। বাবা বলছিল, ইন্ডিয়া যাবে। ওদিক থেকে অ্যামেরিকা চলে যাবে। কিন্তু কিছুই তো হলো না।”
“কোথাও যেতে হবে না, তুই আমার কাছেই থাকবি।”
“আমি তো তোমার বাসাতেই এলাম। কিন্তু তুমি এখানে নেই। কোথায় আছো?”
জেনিফার আমতা-আমতা করে বলল, “বাসায় আছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমি কেয়ারটেকারকে পাঠাচ্ছি, তুই ওনার সাথে চলে আসিস। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা…।”
***
বিকেলের শেষভাগে জেনিফারের বিশ্বস্ত কেয়ারটেকার এসেছিল জায়ানকে নিতে, কিন্তু রেজি সুলতানা যেতে দেননি। লোকটাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন। ছেলের বউ যে কোনো এক কারণে মনে অভিমান পুষে রেখেছে সেটা তিনি টের পেয়েছেন আগেই। এজন্যই ছেলেকে বলেছিলেন, আজ যেন বউমাকে নিয়ে ফিরে। এদিকে মেহমাদ জায়ানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে চাইছে। তাকে এখানে রেখে বাবা ও মায়ের সাথে একদফা আলোচনা শেষ করেছে আগেই অথচ বউ নিয়ে আসার খবর নেই। বউকে ফেলে রেখে বউয়ের ভাইয়ের গার্ডিয়ান হতে চাইছে, মাথামোটা ছেলেটার আর বুদ্ধি হলো না। মনে মনে একগাদা বকা দিলেন ছেলেকে।
তিনি জায়ানকে পরিপাটি করে, খাইয়ে-দাইয়ে গেস্টরুমে বিশ্রাম নিতে বলেছেন। সে-ও বাধ্য ছেলের মতো সায় জানিয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছে। কতদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। কতদিন মায়ের আদর-স্নেহ পাওয়া হয়নি। আজ হঠাৎই মাতৃসম মানুষটার স্নেহ-মমতা তাকে পুলকিত করেছে। অবুঝ মনকে স্বস্তি দিয়েছে। সে ভীষণ সুখ সুখ অনুভূতি নিয়ে চুপটি করে চোখ বন্ধ করে থাকল, যেন এটাই তার ঘর, এখানেই তার শান্তি।
সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে অথচ মেহমাদের খবর নেই। চিন্তিতমনে রেজি সুলতানা ছেলেকে ফোন করেই গমগমে স্বরে জানতে চাইলেন, “কোথায় তুমি?”
“কাজে আছি।”
“কী কাজ কোরো তুমি সারাদিন?” ধমকে উঠলেন তিনি।
মেহমাদ নিচুস্বরে বলল, “কী কাজ করি, সেটা তুমি জানো, মা।”
“তোমাকে বলেছিলাম না, বউমাকে নিয়ে ফেরার জন্য? গিয়েছিলে ওখানে?”
“না, সময় পাইনি।”
“পাবেও না। কারণ তুমি চাইছ না, তারজন্য একটু সময় বের করতে। মেয়েটা তাদের বাড়ির কেয়ারটেকারকে পাঠিয়েছিল জায়ানকে ফেরত নেয়ার জন্য। আমি যেতে দিইনি।”
“ভালো করেছ।”
“ভালো যে করেছি, সেটা আমি জানি। এখন তুমিও একটা ভালো কাজ কোরো।”
মেহমাদ বড়ো করে শ্বাস ছেড়ে বলল, “বোলো, কী ভালো কাজ করতে হবে?”
“প্রফেশনাল কাজ ফেলে রেখে এখন ভালো স্বামী হওয়ার দায়িত্ব পালন কোরো। আজ যদি বউমাকে নিয়ে ঘরে না ফিরো তাহলে চেয়ারম্যান বাড়ির সদর দরজায় মোটা সাইজের তালা ঝুলিয়ে দিব। ধাক্কা দিয়েও ভাংতে পারবে না।”
মায়ের শাসনের ধরন দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল মেহমাদ। বলল, “অসুবিধা নেই, আমি গাছ বেয়ে ছাদে উঠে যাব। আর ছাদে উঠতে পারলে, ঘরে ঢোকা খুব একটা কঠিন কাজ হবে না।”
“খবরদার মেহমাদ, একদম উল্টাপাল্টা কাজ করবে না। যেটা বলেছি, সেটা কোরো। বউমাকে নিয়ে এসো।”
“তোমার বউমা যদি না আসে?”
“কেন আসবে না?”
“আমি তো বেকার, তারমধ্যে চার-পাঁচটা খুন করেছি। এমন একটা বিপদকে, কে স্বেচ্ছায় ঘাড়ে নিবে বোলো তো?”
“তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমি তোমার মা।” কঠিন শাসনের সুরে কথাটা বললেন রেজি সুলতানা।
ঝড়তুফানের আগমনী অবস্থা টের পেয়ে মেহমাদ বলল, “অকে, স্যরি। ফিরতে দেরী হলে চিন্তা কোরো না।”
“হম…।”
ফোন রেখে রেজি সুলতানা কাজের লোকেদের তাড়া দিয়ে বড়ো পরিসরে রাতের রান্নাবান্নার আয়োজন শুরু করলেন।
***
ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে জয়েন করার পর থেকে পেশাগত কাজের জন্য নিজের পরিচয় সবসময় গোপন রাখে মেহমাদ। এজন্য ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেইজের কোথাও নিজের পেশাগত যোগ্যতা উল্লেখ নেই, তেমনই কাজের কোনো প্রমাণও সেখানে নেই। যেহেতু কঠিন কঠিন ও অমিমাংসিত কাজগুলো করাই তার প্রধান কাজ, এই কারণে নিজ দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে দায়িত্বের সাথে একেকটা কাজের পিছনে সময় ব্যয় করে সে। বছর খানেক আগে থেকেই ওমায়ের আলীকে নজরে রাখছে সে এবং তার টিমের সবাই। সব জানতে ও ঠিকমতো তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে কেওটো বের হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। সবশেষে ওমায়ের আলীর মতো একজন দুর্নীতিবাজ মানুষকে কাছ থেকে দেখে এবং তার সব কাজের প্রমাণ জোগাড় করে তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে পেরেছে। সে গোপনে সব প্রমাণ হাতে রেখেছে আর ফারাবী প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিয়েছে।
অনেক বছর আগের অমিমাংসিত রাস্তার একটা স্থায়ী সমাধান হওয়াতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শহরে থাকা নিজের ফ্লাটে এসে মেহমাদ একটু রিল্যাক্স করতে চাইছিল, সেটাও সম্ভব হলো না। হবে কী করে? মন তো পড়ে আছে জেনিফারে। কাজের সূত্রে এখানেই সে থাকে, প্রয়োজন না হলে গ্রামে যাওয়া হয় না। এবারই দীর্ঘসময় গ্রামের বাড়িতে ছিল শুধু ওমায়ের আলীর জন্য। ভাবনারত মন নিয়ে ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখল, সন্ধ্যে সাতটা। এখান থেকে ওমায়ের আলীর বাসা কেবল পনেরো মিনিটের দূরত্বে। চুপ থেকে কিছুক্ষণ ভেবে পরনের পোশাক পালটে কালো রঙের শার্ট-প্যান্ট পরে বাসা থেকে বের হলো মেহমাদ। বাইকে স্পীড তুলে একটানে চলে এলো শ্বশুরবাড়িতে। তাকে দেখে গেট খুলে সালাম দিল দারোয়ান।
প্রবেশের আগে মেহমাদ জানতে চাইল, “জেনিফার বাসায় আছে?”
“জি, আপনি ভেতরে আসুন।”
ভেতরে প্রবেশের সময়ই চোখ পড়ল সামনের ব্যালকনিতে। ভয়ংকর রাগীমূর্তি দেখে ঠোঁট কামড়ে বাইক থেকে নেমে ধীরপায়ে সদর দরজার সামনে দাঁড়াল মেহমাদ। কলিংবেলে সুইচ্ দিতেই জেনিফারের বিশ্বস্ত কাজের মেয়েটা দরজা খুলে তাকে সালাম দিয়ে বলল, “আপনি বসুন, ভাইজান। আমি আপাকে ডেকে আনছি।”
মেয়েটিকে ডাকাডাকির সুযোগ না দিয়েই নিজের রুম থেকে ড্রয়িংরুমে এলো জেনিফার। কাজের মেয়েটাকে কফির কথা বলে বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে বলল, “দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।”
মেহমাদ তখনও দাঁড়িয়ে রইল। বসার অনুমতি পাওয়ার পরও বসতে ইচ্ছে করল না। মন চাইল, এখুনি মেয়েটার হাত ধরে এখান থেকে নিয়ে যাক। কিন্তু সাহসে কুলালো না। কী এক সমস্যা হলো তার! মুখ দিয়ে শব্দও বের হলো না। ঠিক কতদিন পর নিজের বৈধ মানুষটাকে দেখল, সেই হিসেব করার আগেই টের পেল, এই মুখ না দেখে থাকতে তার ভীষণ কষ্ট হয়েছে। নিষ্পলক চোখে চেয়ে থেকে শুধু বলল, “কেমন আছেন?”
জেনিফার একশব্দে উত্তর দিল, “ভালো।”
আর কোনো কথাই খুঁজে পেল না মেহমাদ। নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থেকে দু’চোখ ভরে অর্ধাঙ্গিনীকে দেখতে লাগল। জেনিফার বলল, “ভাইকে আনেননি?”
“না, সে ওখানেই থাকবে।”
“কেন?”
“আমি চেয়েছি, তা-ই।”
“আপনি এমন অদ্ভুত চাওয়া, চাইতে যাবেন কেন? ও আপনার কী হয়?”
“আপনার যা হয়, আমারও তাই হয়।”
প্রচণ্ড কষ্টে ধৈর্য্য ধরে থাকল জেনিফার। কোনোপ্রকার তর্কে ও দ্বন্দে যেতে মন চাইছে না। এমনিতেও কয়েকদিনের দুঃখ ও কষ্টে তার মন ভীষণ রকমভাবে দুর্বল হয়ে আছে। এখন বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যুদ্ধ করতে গেলেই কেঁদে ফেলবে। কোনোক্রমেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবে না সে। তা-ই শক্ত মেজাজে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “এখানে কেন এসেছেন?”
এতক্ষণ দু’জনার মাঝে একহাত দূরত্ব ছিল। এই প্রশ্ন শোনে সেই দূরত্ব সরিয়ে একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মেহমাদ বলল, “বউকে নিতে এসেছি।”
চরম বিস্ময়, রাগ ও তীব্র অপমানে জেনিফার দু’হাত দূরে সরে গিয়ে বলল, “কে আপনার বউ? এখানে আপনার বউ থাকে না। যান এখান থেকে।”
মেহমাদ চোরা হেসে বলল, “ওহ, সত্যিই তো। এখানে আমার বউ কী করে থাকবে? এখানে তো জায়ানের বোন থাকে। আমি বরং তাকেই নিয়ে যাই। চলুন আমার সাথে।”
“অসম্ভব। আমি আপনার সাথে যাব না।”
“শ্বশুর আব্বার মেয়েকে নিয়ে যাই তাহলে?”
“একদমই না।”
“মা তার বউমাকে খুব মিস করছেন।”
মুখফোলা অভিমান নিয়ে জেনিফার বলল, “তাতে আমার কী?”
“বাবা ও মা তাদের ঘরের সম্মানকে যত্নের সাথে ঘরে ফেরত চাইছেন। এমনকি, বকুলও চাইছে, তার ভাইজানের একটা কফি খাওয়ার সঙ্গী জুটুক।”
“শহরে মেয়ের অভাব নেই, জুটিয়ে ফেলুন একটা।”
“মেয়ের অভাব নেই, কিন্তু একটা জেনিফারের অভাব আছে। যে অভাব কেবল আপনার মাধ্যমেই দূর হবে।”
“স্যরি…।”
“মাঝি বলছিল, আমার বউয়ের জন্য প্রতি শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত নৌকাটা ফ্রিতে দিয়ে দিবে। বেকার মানুষ, সবসময় টাকা-পয়সা হিসেব করে খরচ করি তো। ফ্রি-ই যেহেতু পাচ্ছি, সুযোগটা হাতছাড়া করব কেন বলুন?”
জেনিফার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধু ফোঁসফোঁস করল, ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করল না। মেহমাদ আগের ন্যায় এগিয়ে এসে দূরত্ব ঘুচিয়ে বলল, “মা আপনার হাতের রান্না মিস করছেন।”
“আমি যাব না।” মুখের ওপর বলে দিল জেনিফার।
“ঠিক আছে, না গেলে কী আর করা। জোর তো করতে পারব না।”
অভিমানী মেয়ের অভিমান ভাঙাতে না পেরে মেহমাদ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। কয়েক’পা এগিয়ে গিয়ে আবারও ফিরে এলো। অর্ধাঙ্গিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, “রাতের ঘুম হারিয়ে গেছে। দিনের স্বস্তি-শান্তি সেটাও নেই। চোখ বুঁজলে প্রতিরাতে নির্ভরতার একটা হাত যখন চুলের ফাঁকে আঁকিবুঁকি করত, সেটা খুঁজে পাচ্ছি না। সকাল হোক কি রাত, দু’বেলা কফির কাপের সঙ্গিনীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অসুস্থ শরীরের যত্ন নেয়া মানুষটাকেও তীব্র মাথাব্যথার সময় পাশে পাইনি। যন্ত্রণায় যখন মাথা ছিঁড়ে যায়, তখন মনে হয়, একটা মানুষের অভাবে আমার এই অসুস্থতা। তার অবহেলা ও অনুপস্থিতিতেই যত কষ্ট, যত শূণ্যতা। আমি কী বাজেভাবে আপনাতে আসক্ত হয়ে গেছি, খেয়াল করেছেন, জেনিফার?”
এতসব কথা শোনে জেনিফারের খুশি হওয়ার কথা, তবুও সে খুশি হতে পারল না। কথার পিঠে কথাও বলতে পারল না। শক্ত পাথরের ন্যায় অনড় হয়ে রইল।
তার নত হওয়া মুখ দেখে মেহমাদ বলল, “ঘরের প্রতিটা কোণা আপনাকে ভীষণ মিস করছে, জেনিফার। তবুও যাবেন না?”
জেনিফার তা-ও চুপ করে রইল। মেহমাদ বলল, “বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধন কখনও ছেলেখেলা হয় না, জেনিফার। তবুও ওইদিন আপনাক বাধ্য করেছি গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা ভেবে। নামমাত্র সম্পর্কের কথা তুলে সম্পর্কে অদৃশ্য দেয়া তুলেছি কেবল আপনার পছন্দ-অপছন্দের কথা ভেবে। তখনও জানতাম না সময়ের সাথে সাথে আপনি আমার অভ্যাস হয়ে যাবেন আর আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলব। সবদিক হিসেব করলে, জিতটা কার হয় একবার ভেবে দেখুন তো!”
ঠোঁট কামড়ে শক্তপায়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল জেনিফার। এই অভিমানী বরফ গলানোর মতো আর কোনো উপায় খুঁজে পেল না মেহমাদ। আচমকাই জেনিফারের এই দাঁড়িয়ে থাকা ও রেস্টুরেন্টে বসে থাকা সেদিনের সেইসব দৃশ্য বজ্রপাতের ন্যায় জ্বলে উঠল মস্তিষ্কে। কপালে হাত চেপে বলল, “আপনি কি ডিভোর্স চান?”
মুহূর্তের মধ্যেই অশ্রুসিক্ত একজোড়া চোখে দৃষ্টি আটকাল মেহমাদের। এই দৃষ্টি, এই ভাষা তার অজানা নয়। খুববেশি অভিমান ও অধিকারবোধ থেকেই দৃষ্টি এমন নরম হয়। সাহস নিয়ে আঙুলের আলতোস্পর্শে চোখ ছুঁয়ে, ভীষণ যত্নে বুকের ভেতর আগলে নিল বউকে। কপালের একপাশে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “এত রাগ-অভিমান নিয়ে দিন কাটালেন কী করে? কষ্ট হয়নি?”
হুট করে এই আদর ও স্পর্শে হতভম্ব হয়ে গেল জেনিফার। চোখের পানি থেমে গিয়ে ঠোঁটে ফুটে উঠল লজ্জামিশ্রিত হাসি। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে বলল, “এটা ড্রয়িংরুম। যে কেউ দেখে ফেলবে, মেহমাদ।”
***
জীবনে একজন সৎ মানুষ আসুক, সেই মানুষটার সঙ্গে ঘর হোক, মনে মন বাঁধা পড়ুক, উপচেপড়া ভালোবাসা, বিশ্বাস ও ভরসার একটা সংসার হোক, এমনটাই প্রার্থনা ছিল জেনিফারের। ছাত্রজীবনে প্রেমের প্রস্তাব পেলেও মন হারানোর মতো কেউ কোনোদিন সামনে আসেনি বলেই কাউকে মন থেকে ভালোবাসা হয়নি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বিয়ের পর নিজের একান্তই বৈধ মানুষটাকে ভালোবাসবে। কিন্তু সেদিন, মেহমাদ যখন, গ্রামের মানুষের জীবনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিয়েটাকে তুচ্ছ করে দিল, খুব রাগ হয়েছিল তার। কেন একটা মানুষ বিয়েটাকে সিরিয়াসলি নিবে না? এই কারণেই বিয়ের পর মন ধীরেধীরে মেহমাদে স্বস্তি খুঁজে নিলেও অভিমানে মুখ খুলেনি জেনিফার। যেদিন মেহমাদকে রক্তাক্ত দেখেছিল, সেদিন থেকেই সম্পর্কের প্রতি সম্মান ও স্বামীর প্রতি মায়ার জন্ম নিয়েছিল মনে। সে মায়া সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসায় রূপ নিয়েছিল। মন থেকে চাইছিল, কেবল দায়িত্বের মধ্যে আটকে থাকা পবিত্র এই সম্পর্কটা পূর্ণতা পাক। কিন্তু মুখফুটে বলার মতো সাহস ছিল না। কারণ একটাই, শুরুতেই মেহমাদের অযাচিত আদেশ জারি করা। তাই সে চাইছিল, এই অহেতুক আদেশের দেয়ালটা মেহমাদ নিজের হাতে ভাঙুক। বুঝুক, একটা সম্পর্কে বিচ্ছেদ টেনে আনা এত সোজা নয়। এজন্য ইচ্ছে করেই নিজেকে প্রকাশ করেনি উলটে অভিমান দেখিয়ে দূরে সরে গিয়েছিল। মেহমাদ যে আস্তো এক গাধা এটা তো বুঝেনি। তার অভিমান ও অনুভূতি বুঝেও কেমন পাষাণের মতো ব্যবহার করেছে। এই ব্যবহারই জেনিফারকে কষ্ট দিয়েছে। মেহমাদ নিজেও যে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে, এটা সেদিনই বুঝেছিল জেনিফার, যেদিন রেস্টুরেন্টে তাকে অন্য পুরুষের সাথে বসতে দেখেছিল। তা-ও ইগো ধরে রেখে কীভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখল, সেসব ভাবলেই অভিমান যেন ফুলে ফেঁপে উঠছিল তার। আজ যদি জড়িয়ে না ধরত, নিজেকে প্রকাশ না করত, এত সহজে অভিমানের বরফ গলত না বোধহয়।
মাঝনদীতে শব্দহীন ঢেউয়ের তালে বয়ে চলা ছোট্ট নৌকায় মেহমাদের হাতের শক্ত পেশীতে মাথা ঠেকিয়ে ঝিকিমিকি করে জ্বলে ওঠা তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্তহীন ভাবনায় ডুবেছিল জেনিফার। পিছনের কথা ভেবে ঠোঁটের কোণে হাসি নেমে এলো। বলল, “ওইদিন খুব রাগ হয়েছিল আপনার?”
“কোনদিন?” প্রশ্ন ছুঁড়ল মেহমাদ।
“আমাকে রেস্টুরেন্টে দেখেছিলেন যেদিন।”
“না, রাগ হয়নি। ধরে নিয়েছিলাম, লোকটা আপনার পরিচিত কেউ। বন্ধুবান্ধব তো থাকতেই পারে জীবনে।”
“কিন্তু তা-ও আপনার মন খারাপ হয়েছিল, এবং কিঞ্চিৎ সন্দেহ জেগেছিল মনে।”
“উঁহু…।”
“উঁহু নয়, মিস্টার। এটাই সত্য। মেয়েরা এসব বুঝতে পারে। আর এজন্যই, নিজেকে প্রকাশ করেননি। ইগো ধরে রেখে বসেছিলেন।”
মেহমাদ নিশ্চুপে হাসল। জেনিফার বলল, “ছেলেটা আমার বেস্টফ্রেন্ডের স্বামী। দু’জনের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল। ডিভোর্স নিতে চাইছিল। ওদের মিটমাট করানোর জন্যই গিয়েছিলাম।”
“ভালো, বেশ ভালো। নিজেরটা ঝুলিয়ে রেখে অন্যেরটা জোড়া লাগাতে গিয়েছিলেন। মহীয়সী নারী।”
বলার ধরনে শব্দ তুলে হেসে ফেলল জেনিফার। বলল, “কথার নড়চড় করেছেন, আপনাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।”
ঘাড় ফিরিয়ে বউয়ের রহস্যেভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে মেহমাদ বলল, “কী শাস্তি?”
একহাতের কনুইতে ভর দিয়ে, অন্যহাতটা মেহমাদের বুকের ওপর রেখে, হাতের মধ্যে থুতনি ঠেকিয়ে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে জেনিফার বলল, “সারাজীবন ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে হবে। কখনও একফোঁটা ভালোবাসা কমতি রাখতে পারবেন না। যদি কমতি টের পাই, সোজা বিচ্ছেদের দরজায় টেনে নিয়ে যাব।”
“শুধু এইটুকুই?”
“আরও আছে।”
“আর কী?”
“যখন খুব রেগে যাব, রাগ ভাঙানোর দায়িত্ব নিতে হবে। যখন অভিমানে কথা বলা বন্ধ করে দিব, তখন নিজে থেকে অভিমান দূর করে দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। ইগো ধরে রেখে যদি আমার ওপর অবহেলা করেন, আমি আপনাকে ছাড় দিব না।”
জেনিফার কিছু সময়ের জন্য থামল। মেহমাদ তাকে পূণরায় হাতের ওপর শুইয়ে রেখে, মাথা তুলে প্রিয় রমণীর চোখের তারায় হারিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল, “আর?”
“খুব বেশি কষ্ট পেলে যদি কখনও চোখে পানি আসে, নিজ দায়িত্বে সে-ই পানি মুছে দিবেন। রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দিলে মুখে তুলে খাইয়ে দিবেন। একা বাসায় থাকতে গিয়ে যদি বোর হয়ে যাই, ঘুরতে নিয়ে যাবেন। সারাদিন যা কিছুই কাজ থাকুক, দিনশেষে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। আর অবশ্যই, ফেরার পথে একটা গোলাপ নিয়ে ফিরতে হবে। গভীররাতে যখন ঘুম ভেঙে যাবে, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে হবে।”
মেহমাদ ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল, “এগুলো শাস্তি না কি আবদার?”
“যা খুশি ধরে নিতে পারেন।”
“এখন কী করতে হবে?” দুষ্টু হাসি ঠোঁটে নিয়ে বলল মেহমাদ।
জেনিফার লাজুকলতার ন্যায় মিইয়ে গিয়ে দু’হাতে মেহমাদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “তারা গুনতে হবে। দেখুন, আকাশে অনেক অনেক তারা জ্বলছে।”
এইটুকু বলে দূরে যেতে চাইলে, ভালোবাসার প্রগাঢ় স্পর্শের কাছে আটকা পড়ল জেনিফার। একহাতে বউকে আগলে রেখে, অন্যহাতে ঠোঁটের কাছে আঁকিবুঁকি করে মেহমাদ বলল, “এখন আমি বলি?”
“কী?” চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করল জেনিফার।
“আমায় একটা পরিপূর্ণ সংসার দিলে, আমি আপনাকে একপৃথিবী সমান সুখ এনে দিব। দিবেন একটা বিশ্বস্ততার সংসার?”
চোখের পলক ফেলে মেহমাদকে আশ্বস্ত করল জেনিফার। মেহমাদ বউকে দেখল, মুগ্ধ চোখে, অপলকে। চুলের ফাঁকে আঙুল নাড়িয়ে অধরোষ্ঠে সম্পর্কের বৈধতম স্পর্শ এঁকে দিয়ে বলল, “শ্বশুর আব্বার মেয়ে শ্যাষম্যাশ বেকার ছেলেকে ‘কবুল’ করে নিল। এখন কী হবে?”
জেনিফার ভুবনমোহিনী হাসিতে ঠোঁট ভরিয়ে তুলে রাতের জ্বলজ্বলে তারাদের মতোই উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “কী আর হবে? সংসার হবে।”
“তাহলে চলুন, সংসার শুরুর পরবর্তী অধ্যায়ে পা রাখি।”
লজ্জা পাওয়ার বদলে হাসতে হাসতে মেহমাদকে জড়িয়ে ধরল জেনিফার। বুকের কাছে মুখ গুঁজে বুকভরে শ্বাস টেনে জীবনের নতুন অধ্যায়ের স্বপ্ন বুনতে লাগল। সেই স্বপ্নে উঁকি দিল, ছোটো ছোটো হাত-পা দিয়ে ধুপধাপ পায়ে হেঁটে বেড়ানো এক ছোট্ট পরী। আধো আধো বুলি দিয়ে পরীটা তাকে মা বলে ডেকে ঝাঁপ দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল। জেনিফার নিজেও তাকে জড়িয়ে নিল, ভীষণ মমতায় ও আদরে। মা মা গন্ধে মনটা ভরে উঠল। দিনটা হয়তো খুববেশি দূরে নেই, হয়তো খুব কাছে। ওই তো হাত বাড়ানো দূরত্বে। একদিন নিশ্চয়ই ধরা দিবে, পরিপূর্ণ সুখ হয়ে। পূর্ণতার খবর নিয়ে। জীবন হয়ে উঠবে তখন আরও সুখের, ভীষণ সুখের।
***
সমাপ্ত…