জায়া ও পতি পর্ব-০৩

0
14

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৩
#ইসরাত_ইতি

“আমি বিয়ে করবো না মামী।”
আয়ত নেত্রযুগলের কার্নিশ বেয়ে উষ্ণ তরল গড়িয়ে পরছে জান্নাতের, ওড়না দিয়ে নাকের পানি মুছে নিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে, ছোট্ট শরীরটা কাঁপছে তিরতির করে।

শাহিনুর বিরক্ত হয়ে হিসহিসিয়ে ওঠে,“এই ছেড়ি! বিয়ে করবি না মানে ডা কি হ্যা? তোর মামা তোর জন্য সম্বন্ধ দেখতেছে কি আইজ থাইক্যা? এখন কও বিয়ে করবি না, মানে কি?”

_মামী আমি পড়বো।
কান্নার দমকে কথা বেড়োচ্ছে না মুখ থেকে। শাহীনুর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে নিজেকে শান্ত রাখতে। এই মেয়ের মনটা খুবই নরম,একটু ধৈর্য ধরে বোঝালেই বুঝবে, অযথা বকাঝকা করে পাড়ার লোক জড়ো করলে তারই ক্ষতি। চেয়ারম্যান বাড়ির লোক যদি টের পায় জান্নাতের বিয়েতে মত নেই তাহলে তো তারা আর এগোবেন না।

বুদ্ধি করে শাহীনুর জান্নাতকে নিজের কাছে টানলো, দু’হাতের আজলায় মুছিয়ে দিলো চোখের নোনা জল, কন্ঠে কোমলতা ঢেলে বললো,“মা’রে! তুই বোকা? পড়তে চাস পড়বি! কে মানা করছে?রিমা,সুরভী, ফুল ওদের তো ক্লাস নাইনে থাকতে বিয়া হইছে, ওরা তো বিয়ের পর পড়তেছে। তুইও পড়বি।”

_কিন্তু মামী আমি বিয়ে করবো না।
মুখ দিয়ে একটাই কথা পাগলের প্রলাপের মতন বকে যাচ্ছে মেয়েটা। শাহিনুর আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো না,চেঁচিয়ে উঠলো,“এই তুই আমাদের কি পাইছোস? বিয়ে করবি না মানে কি? ঢংয়ের কথা? মাইয়া হইয়া জন্মাইছো পরের ঘরে যাইতে হইবো না? তোর মামারা কতদিন তোরে পালবে? এই তুই বিয়ে করবি না ক্যান? তোর কারো লগে সম্পর্ক আছে?”

ভীতসন্ত্রস্ত মুখ, চোখদুটো বড় বড় হয়ে যায় জান্নাতের। ঝরঝর করে কেঁদে বলে,“না মামী,কিন্তু আমি বিয়ে করবো না।”

_তোর নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে কারো লগে, দেখি আমারে দেখতে দে।

জান্নাতের ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে জান্নাতের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে কোনো প্রেম ঘটিত লেখা না পেয়ে আশ্বস্ত হয় শাহীনুর। ঘরের এককোণে হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদছে জান্নাত। ওর দিকে ফিরে হুমকির মতো করে শাহীনুর বলে,“এতো অকৃতজ্ঞ হোইস না জান্নাতুল, এতো অকৃতজ্ঞ হোইস না।”

শাহীনুর ফোন নিয়ে বাইরে চলে যায়, এতো বড় একটা সুখবর জান্নাতের অন্য দু’জন মামাকে এবং শাহীন আকন্দকে জানাতে হবে এক্ষুনি। পাত্র নিজের মুখে প্রস্তাব দিয়েছে। খুশিতে আত্মহারা শাহীনুর,এতো বড়লোক,এতো সুন্দর পাত্র,দুই দুইটা তেলের পাম্প,দুই দুইটা লঞ্চ। শাহীনুর কল্পনায় দেখছে জান্নাত রানীর মুকুট পরে স্বামীর হাত ধরে তার বাড়িতে আসছে, প্রতিবার আসার সময়ে তার জন্য দামী দামী শাড়ি আনছে জান্নাত।
না না,এই পাত্র নিজের জান থাকতে হাতছাড়া করতে দেবে না শাহীনুর, অসুবিধা কি? পাত্রের একটা দুমাসের বিয়ে ছিলো আগে,দুই মাসের সংসার। এটা কোনো অসুবিধা না।
পুরুষের কোনোকিছুই কোনো অসুবিধা না যদি না পুরুষ গায়ে গতরে সুস্থ আর তার মুঠভর্তি পয়সা থাকে। পুরুষের এইসব ছোটো খাটো খুঁত ধরলে চলবে না।

পরশি ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া ছোটো মেয়েটি তখন উঁকি দেয় জান্নাতের ঘরে,সেদিন দুপুরে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে ঘুমিয়ে পরেছিল জান্নাত। পুটি মাছের প্রাণ সম মনটা অস্থিরতায় টিকতে পারেনি। সে কেন বিয়ে করবে? সে তো পড়তে চায়। তাকে কেন বিয়ে দেয়া হবে,ঐ লোকটাকে সে বিয়ে করবে না।

________

চেয়ারম্যান বাড়িতে জরুরি আলোচনা চলছে শামিরকে নিয়ে। শামির তখন রুমের দরজা আটকে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিল, তার যেটুকু বলার সেটুকু মুরব্বিদের বলেছে। বাড়তি কথা শামির চৌধুরী বলতে পছন্দ করে না।

শামা বড়দের আলোচনায় চোখমুখ কুঁচকে বসে আছে, ভাইয়া কি করে অত ছোটো একটা বোকা বোকা মেয়েকে পছন্দ করেছে সে বুঝে উঠতে পারছে না! ঐ মেয়েটাকে ভাবী ডাকতে হবে যার টেকনোলজি সম্পর্কে ন্যুনতম কোনো ধারণা নেই? এমনকি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে জানে না। আলোচনার মাঝখানে হঠাৎ খুব সাহস করে শামা বললো,“কিন্তু গ্রামের মেয়েদের মাথায় উকুন থাকে।”

_ঐ চুপ। যা এইখান দিয়া ফাজিল ছেড়ি।
মায়মুনার ধমকে শামা চলে যায়। মায়মুনা সবাইকে উদ্দেশ্য করে রিনরিনে গলায় বললো,“মাইয়া আমার খুবই পছন্দ ওইছে। এতিম মাইয়া, মামার বাড়িতে মানুষ, আমার নাতির বুদ্ধি আছে, দেখছো কেমন জহুরির চোখ? এই মাইয়া অন্যের আশ্রয়ে মানুষ,এমন মাইয়াগো অন্তর থাকে কোমল,ভীতু,নরম। এরা অত চডরবডর করে না সংসারে, ধৈর্যশীলা অয় খুব। তোমরা আর গাইগুই কইরো না কেউ। কমবয়সী, সুন্দরী মাইয়া,বেশি লম্বাও না, মোর তো বেমালা পছন্দ ওইচে। অহন মাইয়ার মামা মামীর লগে কথা কইয়্যা আনুষ্ঠানিক দেখাদেখি পর্ব শ্যাষ করো, তারপর বিয়া পড়াইয়া মোরা বৌ লইয়া যামু।”

শারাফাত চৌধুরী, রিজিয়া বণিক,রাজন চৌধুরী কিংবা সুহানা কেউই এতো কমবয়সী পাত্রী দেখে সাহস করেনি শুরুতে, পরে শামিরের আগ্রহ দেখে দমলেন, এই ছেলে ভীষণ ত্যাড়া, এর যে কোনো মেয়ে হঠাৎ মনে ধরেছে এইতো অনেক, নয়তো আজীবন সংসার ছাড়া জীবন কাটানো লাগতো।

গতকাল রাতে শামির এসে সরাসরি চেয়ারম্যান মোর্শেদুল ইসলামের থেকে জান্নাতের খোজ নিয়েছে, যখন জানতে পেরেছে জান্নাতের মামাও জান্নাতের জন্য পাত্র খুঁজছে তখন শামির সরাসরি বাবা আর খালুর সামনে জানিয়েছে বিয়ের কথা। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে দুই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ ভীষণ আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল যদিও। তবে জান্নাতের মতো কোমল,নম্র,ভদ্র রূপবতী মেয়েকে পছন্দ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

এতো বড় খুশির খবর পেয়ে জান্নাতের অন্য দুই মামা আর মামী যেন উড়ে উড়ে এলেন। প্রতিবেশীরা ভীষণ কৌতুহলী হয়ে ঘুরে ঘুরে এসে দেখছে জান্নাতকে অবিশ্বাস্য নজরে। এই মেয়ের এলেম আছে বলতে হয়, নয়তো অত বড় বাড়ির ছেলেপেলের নজর আটকে দেয়?

শাহীন আকন্দ এসে স্ত্রী আর দুই ভাইকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন বিকেলে, শুরুতে শাহীন আকন্দ খানিকটা দোনামোনা করেছেন,“তাই বলে দোজবর? দোজবরের লগে বিয়া দিমু আমগো জান্নাতরে?”

স্বামীর বোকার মতো কথা দেখে শাহীনুর উঠলো খেকিয়ে,“ঐ দোজবর তো কি ওইচে? দোজবর তো কি ওইচে হ্যা? তোমারও তো প্রথম বৌয়ের লগে ছাড়াছাড়ি ছিলো,আমি ছিলাম আবিয়াতো, তোমারে আমি বিয়া কইরা সংসার করিনাই? তাছাড়া যতদূর শুনছি ঐ পোলার আগের বৌ ডাক্তার ছিল, অন্যান্য ডাক্তারগো লগে ঘষাঘষি আছিলো দেইখা তালাক হইছিলো,বেয়াদপ আছিলো হেই বৌ। এতে তো পোলার কোনো দোষ দেখি না।”

শাহীন আকন্দ দমলেন,তার অন্য দুই ভাই নেছার আর কামাল তাকে বোঝাতে লাগলেন। শাহীনুর পুনরায় কন্ঠস্বর নম্র করে বলতে থাকে,“পরশীর আব্বা, বোকদামি করবা না। আরে দোজবর হওয়ায় জান্নাতের যে কপাল আরেকটু খুলছে সেইটা বিবেচনা করলা না?”

_মানে?

শাহীনুর এগিয়ে এসে বসে বলতে লাগলো,“ছেলে দোজবর, মানে ছেলের একটা খুঁত আছে। এখন এই ছেলে উঠতে বসতে আমগো জান্নাতের মন যোগায়া চলবো, জান্নাতের সামনে নত থাকবো, দোজবর দেইখাই তো এই পোলা বৌরে ভালোবাসবো বেশি,এইডা কি বুঝতে পারতেছো না?”

শাহীন আকন্দের বৌয়ের যুক্তি পছন্দ হয়েছে,এমনিতেও শাহীনুর খুবই ধারালো বুদ্ধির মহিলা। বিয়ের পর থেকে মোটামুটি আয়ের সংসার শাহীনের, শাহীনুর বুদ্ধি খাটিয়ে বাপের বাড়ি থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে এটা ওটা এনে যথেষ্ট সাশ্রয় করে এই সংসারে।
জান্নাতের অপর দুই মামী ফতেমা আর জবা শাহীনুরের কথায় ঘনঘন মাথা নাড়ায়,“হ ভাইজান ভাবী ঠিক কইছে, তালাইক্যা ব্যাডারা বৌ ভালো পায় বেশি।”

শাহীনকে মানাতে ওদের বেশি পরিশ্রম করতে হলো না, শাহীনুর শেষে জ্ঞান দেওয়ার মতো করে বলে,“জান্নাতের বাপরে খবর দাও, নিজে তো মাইয়ার বিয়া দিতে পারবো না, শুধু আইসা উপস্থিত থাকুক। কাইল বিয়ালে জান্নাতরে হেরা দেইখা চেইন পরাইয়া যাইবে, আল্লাহ চাইলে কাইলগো রাইতেই বিয়া পড়ানো হইবে। যাও,তোমরা তিন মামা প্রস্তুতি নাও।”

জান্নাত ঘুম থেকে উঠে আরো একদফা কান্নাকাটি শুরু করে দিলো,তবে মামাদের সামনে,সে ভেবেছে মামীরা না হলেও মামারা তাকে বুঝবে। কারণ জান্নাতকে তিন মামা “মা” বলেই সম্বোধন করে।

কিন্তু শাহীন আকন্দ ভাগ্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,“জেদ করে না জান্নাত মা। বিয়া তো করতেই ওইবে। এমন জেদ করে না। ফুল,সুরভী ওদেরও বিয়া হইছে দেখো না?”

_কিন্তু মামা আমি পড়তে চাই।
একই ভাবে কেঁদে দিয়ে বলে জান্নাত।

_আরে আরে এইডা কোনো ব্যাপার? শিক্ষিত ঘরের বৌ হইয়া যাবি তুই, তোর যতদূর ইচ্ছা হয় ততদূর পড়বি। আমাগো সামর্থ্য আছে অতদূর পড়ানোর মা? তুই-ই বিবেচনা কইরা দ্যাখ। তোর বাপ তো তোর বাপ।

কান্নার শব্দ কমিয়ে নিশ্চুপ কাঁদছে মেয়েটা। তিন মামা তাকে কপালে চুমু খেয়ে,মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বোঝালো, জান্নাত চাইলে বিয়ের পর ডাক্তারও হতে পারবে। কিন্তু কিশোরী মন বোঝে এসব কিছু? তার কাছে বিয়ে মানে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু,যার জন্য সে প্রস্তুত না, সে প্রস্তুত না ঐ লোকের সাথে বিয়ে করে নিতে, জান্নাত কারো সাথেই বিয়ে করে নিতে প্রস্তুত না।

বিকেলে খবর দেওয়ার পরে জান্নাতের জন্মদাতা মহসিন মিয়া এলেন , বহুদিন পরে এসেছেন, মেয়ের জন্য একসেট সালোয়ার কামিজ নিয়ে এসেছেন, এস.এস.সি. পরিক্ষার পূর্বে কিছুই দেননি মেয়েকে তাই। জান্নাত বড় আশা করে ছিলো আব্বা আসলে তার হাতে পায়ে ধরে বলবে,“আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাও আব্বা। আমি বিয়ে করবো না,আমি পড়বো কলেজে।”

কিন্তু সপ্তদশী কিশোরী আহত হলো যখন শুনলো তার জন্মদাতাও কেমন মামাদের সাথে তাদের কথায় মাথা দোলাচ্ছে। শাহীনুর মহসিনকে আসার পর থেকেই বোঝাতে শুরু করেছে,“আমরা পারতাম এমন ঘরে ওরে বিয়া দেতে? পারতাম? ঐ তো কোনো সৌদি প্রবাসী ম্যাট্রিক পাশ, এইট পাশের কাছে বিয়া দেওন লাগতো, আর এই পোলা ঢাকার সবথেকে নামী কলেজ থেইকা এম.এ পাশ করছে। বাড়ির বড় ব্যাবসা সামলায়,দেখতে শুনতে কত ভালো,তিন গেরামে এমন সুন্দর লম্বা পোলা খুইজা পাইবা? আর এইখানে কোনো যৌতুক দেওন লাগবো না, ছেলের চাহিদা একটা নম্র,ভদ্র,নামাজী মাইয়া। আমগো জান্নাতরে তো হেইর লইগ্যা পছন্দ করছে। তুমি অমত কইরো না মহসিন, এ যাবত কাল তো মাইয়ার কোনো দায়িত্ব নিলাই না,এখন একটু বিয়া ডা উতরাইয়া দিয়া যাও।”

পাত্র ,পাত্রের অবস্থান এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় মহসিন মিয়া মত দিতে দেরী করলেন না। এমনিতেও তার বর্তমান স্ত্রীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মেয়ের প্রতি কোনো দায়িত্ব সে পালন করতেই পারেনি কখনও। মহসিনের দূরদর্শী চিন্তা তাকে বোঝালো,“এখানে জান্নাত ভালো থাকবে। স্বামীর টাকা থাকলে নারীর সুখ পায়ের কাছে এসে গড়াগড়ি খায়,তার এতিম মেয়ে সুখে থাকবে এইখানে।”

সে ধীরে সুস্থে জান্নাতের মামা মামীকে জানাল,“আপনারাই জান্নাতের আসল অভিভাবক,আপনারা যা ভালো বোঝেন। আমার কোনো আপত্তি নাই।”

এ কথা শুনে জান্নাতের মামা মামীর মুখে ফুটলো বিশ্বজয়ের হাসি,তবে ভাঙলো একটা কিশোরী মেয়ের মন, টুকরো টুকরো হয়ে ভাঙলো, শব্দ হলো না কোনো।

চুপচাপ বসে রইলো হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে,এখন আর শরীর কাঁপছে না তার, কারণ সে কাদছে না, কাঁদতে কাঁদতে কাহিল হয়ে পরেছে।

________

পরেরদিন বিকেল…..
আজ জান্নাতকে আনুষ্ঠানিক ভাবে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে দেখতে আসবে। গতকাল রাতে চেয়ারম্যান মোর্শেদুল ইসলাম শাহীন আকন্দ এবং জান্নাতের বাবা মহসিন মিয়াকে ডেকে নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। এখানে কোনো অনুষ্ঠান করার দুশ্চিন্তা তাদের মাথায় নিতে হবে না, আনুষ্ঠানিক ভাবে দেখাদেখি করে রাতেই বিয়ে পড়ানো হবে, পরেরদিন বৌ নিয়ে চলে যাবে তারা, শহরে বিশাল বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে পাত্র।

এ কথা শুনে জান্নাতের বাবা-মামারা দ্বিগুন খুশি মনে মনে, তবে বাড়িতে ফিরে তারা আয়োজন করতে লাগলেন মেহমানদারির। যতই ওনারা বলুক খরচা করতে হবে না, তবুও হালকা নাস্তা পানির আয়োজন তো করতেই হবে বিকেলে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো,আজ জান্নাতের বাবা মেয়ের জন্য খরচা করতে হিমশিম খেলেন না। আজ তার হাতে টাকা আছে, বাজারে গিয়ে পাত্রপক্ষকে আপ্যায়ন করার জন্য সবকিছু নিজ উদ্যোগে কিনে আনলেন, ফল, মিষ্টি সবকিছু।

জান্নাতের মামী তিনজন এমন ভাবে লাফালাফি করছে আনন্দে যেন বিয়েটা জান্নাতের নয়, রাজরাণী জান্নাত হচ্ছে না,হচ্ছেন ওনারা।
বারবার এসে মজার ছলে জান্নাতকে আহ্লাদ করে বলছে“আছিলি ঘুটেকুরানী,হইতেছিস রাজরানী, তোর কপাল জান্নাত, তোর কপাল।”

শাহীনুর তো কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করছে একেবারে, মনে মনে একটা গোপন পরিকল্পনাও করে ফেলেছে সে, টিভিতে একটা নাটক দেখেছে সে, সেখানে নায়িকার এমন বড় ঘরে বিয়ে হয়, এবং পরে নায়কের ছোটো ভাইয়ের সাথে নায়িকার ছোটো বোনের বিয়ে হয়ে যায়। জান্নাতের হবু দেবরকে দেখে শাহীনুরের প্রচণ্ড মনে ধরেছে,শায়ন নাম। ইঞ্জিনিয়ারিং পরে। জান্নাতের সাথে শামিরের বিয়ের পরে কোনো ভাবে যদি শায়নের সাথে পরশীর একটা ব্যবস্থা করা যায় তবে তো কেল্লাফতে! উড়ছে শাহীনুর,এমন মিষ্টি মিষ্টি দিবাস্বপ্ন দেখে খুব উড়ছে।

জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌসকে পাত্রপক্ষের সামনে উপস্থাপন করানো হবে একটা গোলাপী রঙের তুলতুলে নরম সুতি শাড়ি পরিয়ে। এই শাড়িটা শাহীনুরের,জান্নাত নবম শ্রেনীতে থাকতে একবার এটা পরে রুপাতলী হাইস্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, পরেরদিন চার যায়গা থেকে চারটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল জান্নাতের জন্য,যদিও তখন জান্নাত ছোটো ছিলো তাই কিছু হয়নি।

দেড় বছরে জান্নাত রূপে আরো বেড়েছে,খুলেছে শরীরের গঠনও, গোলগাল শরীর জান্নাতের,না কোথাও চর্বি কম না বেশি, আর গায়ের রং টা একেবারে হলদে। বেশি ফরসাও না,তবে এই রঙের কাছে ফরসা রঙটা মলিন লাগে। উজ্জ্বল ত্বক জান্নাতের। ভ্রু ঘন, ঠোঁট একেবারে গোলাপী।
জান্নাতের মুখ দেখেও শামিরের দাদীর মনে ধরেছে,মেয়ে মানুষের মুখ থাকবে এরকম ছোটো, বোয়াল মাছের মতো বড় মুখের মেয়ে শামিরের দাদীর পছন্দ না,দেখলেই মনে হয় সংসারটাকে গিলে খাবে। সুহানার মুখটাও বড়,চওড়া ঠোঁট।
তবে জান্নাতের ভাতের লোকমার সাইজ দেখতে ইচ্ছুক মায়মুনা,কারণ তার মতে ভাতের লোকমার সাইজ দেখে বিচার করতে হয় মেয়ে মানুষের স্বভাব।

জান্নাতকে এসে তৈরি করিয়ে দিয়েছে নীড়া। কনুই অবধি গোলাপী ব্লাউজ,পরনে গোলাপী শাড়ি,আর একটা খোপা করে দিয়েছে সে। প্রসাধনী হিসেবে একটু লিপস্টিক লাগাতে চায় কিনা জান্নাতের কাছে প্রশ্ন করেছিলো সে। জান্নাত জবাব দেয়নি, শুধু মাথা নিচু করে বসে থাকে জান্নাত, তবে দূর থেকে দৌড়ে এসেছে শাহীনুর,“আরে করো কি,করো কি নীড়া? জান্নাত এইসব দেয়না মুখে।”

নীড়াকে কোনোমতেই জান্নাতের মুখে বেশী প্রসাধনী ছোঁয়াতে দিলেন না শাহীনুর। কারণ বেশি সাজলে যদি পাত্রপক্ষ উল্টোপাল্টা ভাবে? পাত্রের সাদামাটা মেয়ে পছন্দ শাহীনুর তার বুদ্ধি দিয়ে ধরতে পেরেছে । অতিরিক্ত সাজগোজ করিয়ে পাত্রকে বেজার করতে চান না তিনি।

চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে শান্তার বর রাজীব,শান্তা, সুহানা,রুহি আর শায়ন গিয়েছিল শহরে। নতুন বৌয়ের জন্য “পয়নামা” কিনতে। যদিও এখানে তেমন ভালো জিনিসের আশা তারা করেনি। তাদের পরিকল্পনা বরিশাল সদরে ফিরে তারপর ভালো করে শপিং করবে অনুষ্ঠানের আগে। আপাতত এই দিয়েই বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবে।

বিকেলে সবকিছু গুছিয়ে চৌধুরী বাড়ি আর চেয়ারম্যান বাড়ির সবাই উপস্থিত হলো শাহীন আকন্দের বাড়িতে। পাত্রের সাহেবী বেশভূষা,পাত্রের মুখের শ্রী দেখে পাড়া প্রতিবেশী না চাইতেও হিংসা করে বসছে জান্নাতকে। মনের সুপ্ত আফসোস পাত্রের চোখে কেন তাদের মেয়ে পরলো না?

টিনশেড ঘরটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছে সবাই, পাত্রপক্ষকে বসতে দেয়া হলো সামনের বারান্দায়। কালো রঙের শার্টে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মুখটাকে দেখছিলো প্রতিবেশী মেয়ে বৌরা আড়াল-আবডাল থেকে। এতো সুন্দর লোকের সংসার করবে জান্নাত? যার আবার এতো টাকা?

অতিথিদের সাথে আলাপে ব্যস্ত জান্নাতের বাবা এবং মামারা। শামির চৌধুরী এককোণে একটা চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে ফোনে কিছু অফিশিয়াল মেসেজ চেক করছে। চলনে বলনে আভিজাত্য,গুরুগম্ভীর হাবভাব পাত্রের,খুব ব্যস্ত বাবু,তাই সবার কৌতুহল বেশি।

পর্দার আড়াল থেকে জান্নাতের ছোটো মামী জবা শাহীনুরকে বললো,“এই ভাবী। আমি আইজ দুপুরে একটা কথা শুনছি।”

_কি?

_পরশী বলছে এই ছেলে নাকি বছরে একবার হাসে? সারাদিন নাকি সবাইরে ধমকায়?

বিরক্ত শাহীনুর,জা’কে চুপ করিয়ে দিয়ে বললো,
“তো? সমস্যা কি? পুরুষ মানুষের পকেট,মেজাজ,মুখ সব যদি গরম না থাহে, হে আবার কেমন পুরুষ মানুষ? আর বছরে একবার হাসলে কি ওইচে? ছেড়ি মাইনষের মতো হাঙ্গাদিন হিক্কির হিক্কির করলে পুরুষের দাম থাহে? চুপ কর তো। পাত্র মাশাআল্লাহ,খাসা। প্যাচাল পুটিস না। আল্লাহ আল্লাহ কর যেন বিয়াডা আইজ রাইতেই হইয়া যায়, তাইলে কপাল শুধু জান্নাতের খোলবে না,আমাগোও খোলবে।”

চলমান…….