জায়া ও পতি পর্ব-৬+৭

0
7

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৬
#ইসরাত_ইতি

বাড়ির নামটা বেশ সুন্দর,“কমলা রঙের রোদ।” এতো সুন্দর বাড়ির নাম হয়? জান্নাত এর আগে এমন নাম দেখেনি কোনো বাড়ির। সাধারণত বাড়ির নেমপ্লেটে লেখা থাকে “অমুক মঞ্জিল”,“অমুক ম্যানশন”,“তমুক ভিলা” ইত্যাদি ইত্যাদি।
গাড়ি থেকে নেমেই নামটা চোখে পরতেই জান্নাতের চোখ আটকে যায় সেখানে, শামিরদের বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়িটা রেখে তার চোখ ঘুরে ঘুরে নেমপ্লেট টা দেখছে। তামাটে-সোনালি রঙের নেমপ্লেটটা খুব ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে জান্নাতের।

গাড়ি থেকে মালামাল নামাচ্ছে বাড়ির দাড়োয়ান। শামির এসে জান্নাতের পাশে দাড়াতেই জান্নাত সংকোচে জড়োসড়ো হয়, পাগলকে থাপড়ানোর ঘটনার পর থেকে জান্নাত আরো কিছুটা ভয় পাচ্ছে শামির কে, এ শুধু মেজাজী লোক নয়, বেপরোয়াও বটে।

শামির ওকে দেখে বলে,“ভেতরে এসো। এটা আমার বাড়ি। এখন থেকে তোমারও।”

রুহি আর শামা দু’জনে এসে ধরলো জান্নাতকে। হলুদ জামদানি,গলায় স্বর্ণালঙ্কার,একটা লম্বা ঘোমটা, একটা টকটকে হলুদ বৌ পা রাখে তার স্বামীর ঘরে।
চোখ বড় বড় করে জান্নাত শামিরদের বাড়িটা দেখে,বাড়িটা চেয়ারম্যান চাচার বাড়ির থেকেও তিনগুণ বেশি বড়। এবং বাড়িটার রঙ কমলা, এজন্যই বোধহয় অমন নাম দেয়া হয়েছে বাড়িটার।

স্বামীর গৃহে প্রবেশের পর জান্নাত টের পেলো এই দুনিয়া সম্পূর্ণ নতুন, সম্পূর্ণ আলাদা একটি জগত হতে চলেছে তার জন্য। যে দুনিয়া একটু বেশিই চকচকে, বিলাসবহুল। এসব কিছু জান্নাতের হজম হবে তো?

বরিশাল সিটিতে চৌধুরীদের যত আত্মীয় স্বজন ছিলো,সবাই ছুটে আসছে শামির বৌ নিয়ে এসেছে শোনামাত্রই।

জান্নাতকে প্রথমে বসানো হয়েছিল ড্রয়িং রুমে, এরপর রিজিয়ার নির্দেশে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় শামিরের ঘরে, বিশাল বড় রুমটায় ঢুকে জান্নাত হা হয়ে যায় একেবারে। অক্ষিযুগল প্রশ্বস্ত করে দেখতে থাকে চারপাশ,নীড়া যা কিছু বর্ণনা করেছিল ঘরটা তার থেকেও সুন্দর,ঝা তকতকে। বিশাল বড় পালঙ্কের মতো খাট, আলমারি,আরেকটা ছোটো খাট, কম্পিউটার সবকিছু ঠাশা। বিছানার কোণে বসে এসব যখন জান্নাতুল দেখছিলো তখন রুহী জান্নাতের লাগেজ থেকে সবকিছু বের করে একটা খালি আলমারিতে রাখতে রাখতে বলে,“ভাইয়া একটু অফিসে গিয়েছে, তুমি গোসল সেরে এই শাড়িটা পরো। রাজ্যের মেহমান আসবে কিন্তু ভাবী!”

জান্নাত মাথা নাড়ায়, শামির এসে পাঁচ মিনিটও থাকেনি বাড়িতে। পোশাক না পাল্টেই চলে গিয়েছে। জান্নাত এতে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেললো।
মায়মুনা পাড়ার মহিলাদের সাথে গল্প করছে,“চান্দের নাহান বৌ হইচে মোর শামিরের। চান্দের নাহান।”

জান্নাতুল তখন শাড়ি-ব্লাউজ নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকলো, নানা রকমের আর্টিফিশিয়াল প্ল্যান্টস দিয়ে সাজানো একটা কলঘর। বিশালাকার কলঘরটা চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ, জান্নাতের মনে ধরেছে খুব কলঘরটা, সে যেন গহীন অরণ্যে এসেছে গোসল সারতে।

একটা লাল জামদানি শাড়ি,যার পাড় কালো। জান্নাত জড়িয়ে নিল গাঁয়ে, ওর ননদরা অবাক হয় এতটুকু মেয়ে কি সুন্দর করে শাড়ি পরে।
শামির ফিরেছে কিছুক্ষণ পরেই,একটা হিসেব মিলিয়ে চলে এসেছে, বাড়িতে মেহমান আসতে শুরু করেছে, এখানে তার থাকা প্রয়োজন তাই।
ঘরে ঢুকতেই দেখলো তার বিছানায় চুপচাপ বসে আছে জান্নাত, শামিরকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় ঘোমটা টানলো।

শামির ব্লেজার খুলে রেখে শার্টের টপ বোতাম দু’টো খুলে বেশ আয়েশ করে বসলো বিছানায়, জান্নাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,“দাড়িয়ে আছো কেন? বসো! এটা তোমারও বিছানা।”

জান্নাত চুপচাপ বসলো,জড়তা কাটিয়ে। শামির ওকে দেখছে, সদ্য গোসল সেরেছে বলে ফরসা মুখটা আরো বেশি স্নিগ্ধ লাগছে। শামির বললো,“ও বাড়ির জন্য মন খারাপ?”

জান্নাত দু’পাশে মাথা নাড়ে,যদিও তার মন খারাপ। শামির পুনরায় বলে ওঠে,“সবাই আসবে আজ বাদে কাল অনুষ্ঠানে।”

লোকটা যা-ই বলে কেমন গম্ভীর হয়ে বলে, জান্নাত শুধু মাথা নেড়ে জবাব দেয়। হঠাৎ শামির বলে,“এদিকে এসো জান্নাতুল! তোমার নাকে কি হয়েছে?”

জান্নাত নাকে হাত রেখে চোখ তুলে তাকায়, শামিরের কন্ঠে আদেশ ছিলো, তবে সে কাছে না গিয়ে বললো,“আপনাদের দেয়া নাকফুলের ডাটা টা ঢোকাতে গিয়ে কাল ব্যাথা পেয়েছি, এজন্য লাল হয়েছে।”

জান্নাতের কথার জবাব না দিয়ে শামির ভারি স্বরে বললো,“আমি আমার কাছে আসতে বলেছি।”

এইবার জান্নাত চুপচাপ এগিয়ে যায়। এগিয়ে গিয়েও মাঝখানে কিছুটা যায়গা নিয়ে বসে,তবে শামির একটানে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দেখতে থাকে জান্নাতের নাক।

ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে যাওয়া জান্নাত চোখমুখ খিচিয়ে নেয়। ঢোক গেলে বারংবার।

শামির একহাতে জান্নাতকে ধরে রেখে আরেক হাত ছোঁয়ায় জান্নাতের নাকে,বলে,“ইশশ খুব খারাপ অবস্থা হয়েছে দেখছি। এটা পরে থাকতে কষ্ট হচ্ছে?”

জান্নাত আড়ষ্ট হয়ে ছিলো স্বামীর সাথে মিশে, হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে টের পেলো, অনেকটা ভয়ে তবে কিঞ্চিত লজ্জাও ছিলো। জান্নাত বুঝতে পারছে না তার এই লোকের উপর রাগ হচ্ছে না কেন, সে শুধু পাচ্ছে লজ্জা, পাচ্ছে ভয়।

শামির আবারও গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলো,“খুলে দেবো?”

_আম্মা খুলতে বারণ করেছে।
দম আটকে থাকা জান্নাত অস্ফুটে বললো কোন মতে, সে কাঁপছে, শামির আলতো আঙ্গুল বুলিয়ে ওর নাকের লাল হওয়া স্থান ছুঁয়ে দিলো,চোখ বুজে থাকা জান্নাত,তার গাঁয়ের মিষ্টি ঘ্রাণ,এক নিস্তব্ধ দুপুর, শামির বৌ আর পরিবেশের নিস্তব্ধতায় লাই পেয়ে হুট করে জান্নাতের নাকে,গালে চু’মু খেতে লাগল।

আচানক অজানা পরম স্পর্শে জমে গেলো জান্নাত,কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ বড়বড় করে ফেললেও চোখ বুজে নিল আবারও, খামচে ধরলো বিছানার চাদর, শুধু অস্ফুটে বললো,“আমি যাই? আম্মা যেতে বলেছেন।”

থামলো শামির, নিঃশ্বাস ফেলছে ঘন,জান্নাতের মুখের দিকে কিছু পল তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিলো। তবে ছাড়লো না জান্নাতকে। এমন শক্ত বাঁধনে জান্নাতের অস্বস্তি হচ্ছিল তবুও ছাড়লো না, এক হাতে ফোনটা তুলে নিয়ে শামির ফোন করলো রুহিকে,বললো,“শিগগির মায়ের জুয়েলারি বক্স থেকে একটা সিম্পল নাকফুল নিয়ে আয় আমার ঘরে, একেবারে হালকা,ডাটা যেন খুবই সরু হয়।”

ফোন কেটে শামির জান্নাতকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। জান্নাত নিজের ঘোমটা সামলে নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। খানিক বাদে সুহানাই এলো,সাথে একটা ছোট বক্স হাতে।
শামিরকে দেখে বললো,“আমি তখনই শান্তাকে বলেছিলাম এতো ভারি কিছু না নিতে। ব্যাথা করছে জান্নাত?”

জান্নাত মাথা নেড়ে বলে,“জি।”

সুহানা বক্স থেকে অতি ক্ষুদ্রাকার একটা নাকফুল বের করে জান্নাতের নাক থেকে নাকফুলটা খুলে ওটা পরিয়ে দিতে দিতে বলে,“কি জাদু করলে গো জান্নাতুল। এক রাত পেরোতেই কত যত্ন করতে শুরু করেছে দেবর আমার,বাব্বাহ!”

কথাটি শুনে জান্নাতের গাল দুটো তার অজান্তেই লাল হয়, ভালোবাসা অনুভূতি এসবের সাথে এই কিশোরী মেয়েটি পরিচিত নয়, একজন পুরুষের প্রতি নারীর অনুভূতি কিভাবে আসে, কেন তাদের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি হয়, এসব কিছুই জান্নাত জানেনা। সে জানে,মামী চাচী বিবাহিতা বান্ধবীরা সবসময় বলেছে স্বামীকে ভালো বাসতেই হবে, এমনটাই নাকি নির্দেশ আছে নারীদের জন্যে।
তাই কিছুক্ষণ আগে যা হলো, জান্নাতের খারাপ লাগেনি মোটেই। কিছুসময়ের জন্য স্বামী নামের মানুষটার জন্য জান্নাতের বুকের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি এসে জড়ো হয়,যেমনটা ওর বান্ধবীদেরও হতো। এই অনুভূতি আর যাই হোক বিতৃষ্ণা নয় । জান্নাত হাত দিয়ে নিজের গাল ছোঁয়, ঐ লোকটা তার গাল চুমেছে তাই লজ্জায় কান দু’টো গরম হয়েছে তার। এসব কি তাকে রোজ সহ্য করতে হবে? ঐ মেজাজী লোকটার থেকে! সুহানার কথাবার্তা কিছুই জান্নাতের কানে ঢুকছে না, সে আড়চোখে শামিরকে দেখে,যে কানে ফোন চেপে কথা বলছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। জান্নাত নির্নিমেষ দেখছে লোকটাকে, কিশোরীর মনে স্বামী সম্বোধনের মানুষটার জন্য সমীহ এলো, কিছুক্ষণ আগে জান্নাতের নাক ছুঁয়ে দরদ নিয়ে জান্নাতের ব্যাথা দেখতে চেয়েছে বলে কিশোরী দেহের মধ্যে লুক্কায়িত এক অবলা নারী মন এতটুকুতেই বিগলিত হয়েছে। সে মন অনুভূতির ব্যাখ্যা খোজে না, ভালোবাসা নামের এই জটিল শব্দটা সম্পর্কে কোনো ধারণাও রাখে না, শুধু জেনেছে তার স্বামী তাকে আদর করেছে,যার সাথে সৃষ্টিকর্তা জান্নাতের কপাল বেঁধেছে,যাকে সমীহ না করলে তিনি পাপ দেবেন।

শামির ফোনে কথা বলছে একটানা, জান্নাত শুধু লোকটাকেই দেখছে। লম্বা একটা লোক। কোন পুরুষকে সুদর্শন বলতে হয় অত জটিল জ্ঞানও নেই জান্নাতের, শুধু বুঝতে পারলো তার গ্রামের সব মেয়েদের স্বামীর চেয়ে তার স্বামী দেখতে ভালো, রঙটা একটু চাপা, তবুও একেবারে নিখুঁত,একটা হিন্দি সিনেমার নায়কের মতো,নায়কটার নাম মনে পরছে না জান্নাতের।

একা একা মিটিমিটি হাসছে জান্নাত, সুহানা বললো,“চলো এবার, প্রতিবেশী চাচীরা এসেছে তোমায় দেখতে।”

লাল টুকটুকে শাড়ি পরা চৌধুরী বাড়ির মেজো বৌকে উপস্থাপন করা হলো প্রতিবেশী চাচীদের সামনে। চৌধুরীদের আত্মীয় মেহমানরা এখনও এসে পৌঁছায়নি।

জান্নাতকে দেখেই প্রতিবেশী চাচীরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পরলেন জান্নাতের রূপ নিয়ে, কেউ কেউ জান্নাতের মুখের সামনেই বলে উঠলো,“আগের বৌটার থেকে ঢের ভালো। শামির এবার জিতেছে।”

ওসব শুনে জান্নাতের মোটেও ভালো লাগেনি, তবুও চুপচাপ বসে রইলো। হঠাৎ আরেকটা কথা তার মাথায় এলো, লোকটার সাথে কেন তার আগের বৌয়ের বনিবনা হলো না? তাদের গ্রামে এমন পাঁচ ছয় বাড়িতে দেখেছে,বিয়ের দুই মাসের মাথায় তালাক। কারণ ছিলো বৌয়ের বাপের বাড়ী থেকে টাকা চাওয়া, সেখান থেকে শুরু হতো দ্বন্দ্ব। মারজিয়া ভাবীকে তো জাহিদ ভাই পিঁড়ি দিয়ে পিটিয়েওছিলো, তারপর হলো তালাক। লোকটা কি এমন কিছু করতো?

জান্নাত নিজেকে শুধরে নেয়। না না। এই বাড়ির সবাই কমবেশি খুব ভালো মনে হচ্ছে, যৌতুকের জন্য ডিভোর্স হলে লোকটা তো আর পরে জান্নাতকে বিয়ে করতো না, জান্নাত তো গরীব!

বিকেলটা জান্নাতের কেটেছে ভয়াবহ ব্যস্ততায়, চৌধুরীদের আত্মীয় স্বজনে ঘর ভরে গিয়েছে,জান্নাতকে সাজিয়ে গুছিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছিল পুতুলের মতন তাদের সামনে। মুখ দেখে কত মুরব্বি মহিলারা এটা সেটা উপহার দিলো, জান্নাতের হাঁফ ধরে গেলো এসবে।

সন্ধ্যাটা খানিকটা ছাড় পেয়েছিল জান্নাত। পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলো তার ননদ রুহি। শামির গিয়েছে তার বন্ধুদের গেট থেকে রিসিভ করতে, জান্নাতকে দেখতে আসবে আজ শামিরের বন্ধু এবং বন্ধু পত্নীরা।

বাড়ির সবগুলো ঘর ঘুরে ঘুরে দেখা শেষ জান্নাতের, দোতলায় সবথেকে দক্ষিণে তাদের ঘর। দুটো কামরা পরেই রুহির ঘর। বড়লোক মেয়েদের ঘর, ঘরভর্তি গোলাপী রঙের টেডি পুতুল,ঘরে যা কিছু আছে সবকিছু গোলাপী রঙের।

জান্নাত বিস্মিত হয়ে সবকিছু দেখছিলো ঘুরে ঘুরে,রুহি হেসে বললো,“এই পুতুল দাদীর চোখে পরলে খবর আছে। সব পুড়িয়ে দেওয়ার অর্ডার করে দেবে। তুমি বসো ভাবী, তুমি বলো, তোমার খারাপ লাগছে?”

জান্নাত চুপচাপ মাথা নাড়ে, সবকিছু নতুন, সে শুধু বিস্মিত হচ্ছে,তবে খারাপ লাগছে না। এর মাঝে সুহানার ফোন থেকে বাড়ির লোকের সাথেও একবার কথা বলে নিয়েছে। তার বান্ধবী ফুল আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছে,“ওখানে কোন কলেজ টাতে ভর্তি হবি রে জান্নাত?”

_জানিনারে, এখনও তো রেজাল্ট দিলো না, দেখি উনারা কি বলেন।

এশার নামাজের পরে জান্নাত শামিরের রূমেই চুপচাপ বসে ছিলো, শামির ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়ায়,শামিরের পেছন পেছন তার বন্ধু পত্নীরা ঢুকলো, যাদের সাথে কিছুক্ষণ আগে আলাপ করিয়ে দিয়েছে শামির নিচে ডেকে নিয়ে। মেয়েগুলো জান্নাতের থেকেও বয়সে অনেক বড়, গায়ের পোশাক অনেক দামী, এবং অনেক সাজগোজ। শামির জান্নাতকে বললো,“জান্নাতুল। ওনাদের সাথে গল্প করো।”

জান্নাত চুপচাপ মাথা নাড়ায়। মেয়েগুলো জান্নাতের আশেপাশে গোল হয়ে বসে জান্নাতকেই দেখছে, জান্নাতকেই কেনো শামির চৌধুরী বিয়ে করলেন শেষে এই নিয়ে তাদের কৌতুহলের অন্ত নেই, যোগ্যতা বিচারে এই মেয়ের রূপ এবং অল্পবয়সী কুমারী ব্যাতীত অন্য কোনো যোগ্যতা তারা পেলো না, অবশ্য পুরুষের কাছে এগুলোই তো নারীর বিরাট বড় যোগ্যতা। খুঁতখুঁতে শামির চৌধুরীও হয়তো এখানেই গলেছে ডিভোর্সের পরে এইবার।

◻️

শামির জ্বলন্ত সিগারেট টা কেবলই ঠোঁটে চেপে ধরছিল, তার বন্ধু সিয়াম এক ঝটকায় সিগারেট টা তার হাত থেকে ফেললো। শামির বিরক্ত মুখে তাকায় বন্ধুর দিকে। বাড়ির পেছনের আঙ্গিনায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো সে। সিয়াম ঠাট্টা করে বললো,“এখন সিগারেট খাস না দোস্ত, একটু পর বৌয়ের কাছে যাবি। বাচ্চা মানুষ, সিগারেটের গন্ধে কাশি উঠে যাবে।”

হো হো করে হেসে ওঠে বন্ধুরা। শামির রাগী চোখে সিয়ামকে দেখে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বলে,“পার্সোনাল বিষয় নিয়ে মজা পছন্দ করি না আমি।”

সিয়াম চুপ হয়ে যায়, বন্ধুদের মধ্যে শামির আগাগোড়াই অন্যরকম, বন্ধুরাও ওকে রয়ে সমঝে চলে। তানভীর বলে উঠলো,“আচ্ছা দোস্ত ফান বাদ, এখন একটা সিরিয়াস টপিকে তোর সাথে আলোচনা করি। ভাবী সাহেবাকে বড্ড ভালো লেগেছে সবার, তোর পছন্দ টপ ক্লাস! এখন একটা সাজেশন দিই বন্ধু হিসেবে, ছোটো মানুষ তো,ওর সাথে তোর ইগো কম কম দেখাস, ও তো বুঝতেই পারবে না তোকে, একটু বন্ধুর মতো থাকিস, তেমন আচরণ করিস।”

সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে শামির তানভীরের দিকে চায়,একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মুখটাকে চির গম্ভীর করে বলে,“স্বামী স্ত্রী হতে হবে বন্ধুর মতো, তোদের এই অতি আহ্লাদের কথাটা স্বামী স্ত্রীর অ্যাকচুয়াল সংজ্ঞাটাকে মিটিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা প্রভাবিত হচ্ছে ভুল টার্মে। স্বামী স্ত্রী,স্বামী স্ত্রীই হয়! এরা কখনো বন্ধু হয় না। স্ত্রীকে বন্ধু ভাবা নিজের স্বামীত্বের মান কমানো ছাড়া কিছুই না। বর্তমানে আশেপাশে চোখ বোলালেই দেখবি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের ব্যালেন্স নষ্ট হয় এই বন্ধু হতে গিয়ে। স্ত্রী একজন পুরুষের অধিনস্ত,এটা অস্বীকার করে পুরুষ নিজের মান কমাচ্ছে এটা পুরুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, আর এইসব নারীবাদী পুরুষ যারা স্ত্রীকে বন্ধু বানানোর মন্ত্র আওড়ায়,এরা নারীদের অ্যাটেনশন চায় শুধু। আমি সত্যি কথা বলি, আমার স্ত্রী আমার অধীন,আমার দায়িত্ব এক জন্মের। তাকে আমার অধীনস্থতা স্বীকার করতেই হবে। আদর,শাসন সবকিছু স্ত্রীর মতো পাবে, কোনো বন্ধুর মতো নয়। এবং শামির চৌধুরী বর্তমানে শিখে গিয়েছে বৌকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখে সংসার করতে হয়। ডোন্ট ওরি! তোরা চাপ নিস না!”

মেজাজ পাশে সরিয়ে রেখে শামির কথাগুলো বলেছে একেবারে শান্ত গলায়। ওর বন্ধুরা চেয়ে চেয়ে দেখেছে শুধু। ফারিনের সাথে দেড়মাসের সংসারের পরে বনিবনা হয়নি বলে ডিভোর্স নিয়েছে ফারিন। ওটাও অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিলো। অবশ্য ফারিনের মতো ডাক্তার মেয়ে শামিরের এই একরোখা আচরণ মানবে না। তাই আগে ভাগেই কেটে পরেছে বুদ্ধিমতী মেয়ে ফারিন। কিন্তু শামিরের বর্তমান স্ত্রীর জন্য চিন্তা হচ্ছে ওর বন্ধুদের। শামিরকে কিভাবে সামাল দেবে এই বাচ্চা মেয়ে কে জানে!

◻️

শহরের রাতগুলো গ্রামের রাতের মতো নয় জান্নাত বুঝতে পারলো, রাত তখন এগারোটা প্রায়, কিন্তু মনে হচ্ছে এই সন্ধ্যা রাত,অথচ গ্রামে আটটা নাগাদই ঘুম চলে আসে চোখে। সারাদিনের ধকল শেষে জান্নাত একটু জিড়োতে পারছে এখন, একঘন্টা হলো ছাড়া পেয়েছে সে, মেহমান চলে গিয়েছেন কিছু সংখ্যক,বাকিরা রয়ে গিয়েছেন, একেবারে বড় অনুষ্ঠান শেষ করে যাবেন।

রাতের খাবার খাইয়ে জান্নাতকে ঘরে পাঠিয়েছে তার জা আর শাশুড়ি, হাতে দু’টো আইস্ক্রিম কাপ ধরিয়ে দিয়েছে,শামিরকে নিয়ে খেতে বলেছে। জান্নাত ঘরে ঢুকে শামিরকে কোথাও পেলো না,আজ তাদের বিয়ের দ্বিতীয় রাত, রাত যত বাড়ছে আবারও উৎকণ্ঠায় জড়োসড়ো হচ্ছে জান্নাত, কি জানি কেমন হবে তার নতুন জীবনের অভিজ্ঞতা, যে জীবন সে না চাইতেও বড়রা বুঝে শুনে গড়ে দিলো, আইসক্রিম কাপ দুটো গলে গিয়েছে পুরো, শামির এখনও আসেনি। বাবা ভাইয়ের সাথে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা করছে নিচতলায়। এবাড়ির পুরুষ গুলোর কন্ঠ তো নয় যেন মাইক, জান্নাত খেয়াল করেছে। বড্ড জোরে কথা বলেন ওনারা, তার মধ্যে জান্নাতের স্বামীর কথা তো বলতেই নেই।

শামির ঘরে ঢুকলো রাত ঠিক সাড়ে এগারোটার সময়। ওর পায়ের শব্দ শুনেই জান্নাত শোয়া থেকে উঠে বসলো, জড়োসড়ো হয়ে।

বিছানার এক কোণে শামির ফোনটা রেখে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,“ঘুমাচ্ছিলে নাকি জান্নাতুল।”

বলেছে স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা, জান্নাত জবাবে দু পাশে মাথা নাড়ে। মাথায় টানে ঘোমটা।

শামির ফ্রেশ হয়ে এসে বারান্দার বাতি নিভিয়ে,ঘরের বাতি নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বিছানায় বসলো । জান্নাতের দিকে তাকালো আড়চোখে। জান্নাত জড়তা নিয়ে বসে আছে মাথা নিচু করে। শামির ওর হাত ধরে কাছে টেনে বললো,“আজও কি অসুস্থ বোধ করছো জান্নাতুল?”

দু’পাশে মাথা নাড়ে জান্নাত। শামির ওর দুগালে হাত রেখে তাপমাত্রা চেক করে, জান্নাত নড়েচড়ে ওঠে, আবারও মাথা নিচু করে নেয়।

জান্নাতের নির্লিপ্ততা বড্ড প্রশান্তিদায়ক শামিরের কাছে, ভীষণ ভদ্র মেয়েটি, শামির ওকে মুগ্ধতা নিয়ে দেখে এক হাতে থুতনি কিছুটা উঁচু করে ধরে কিছুক্ষণ দেখে, আবারও এত কাছে লোকটা, জান্নাত ভয় পাচ্ছে,লজ্জাও পাচ্ছে কিন্তু নিজেকে ছাড়াতে পারছে না।
শামিরের কন্ঠস্বর অত্যধিক ঠান্ডা, মেজাজ শান্ত তাই। বললো,“তুমি ভীষণ সুন্দর জান্নাতুল।”

জান্নাত মাথাটা আরও নুইয়ে নেয়,বুঝতে পারছে তার স্বামী কথা এগোতে চাইছে, কিন্তু সে কি বলবে?
শামির এবার আরেকটু কাছে এগিয়ে বসে জান্নাতের, কন্ঠে এবার দরদ নিয়ে বলে,“এগুলো এখনও পরে আছো কেন? র্যাশ উঠবে তো গায়ে।”

বলেই শামির জান্নাতের গলা থেকে স্বর্ণের হারটা টেনে টেনে খুলতে লাগল, আবারও বললো,“ইশশ লাল হয়েছে দেখছি গলার কাছটা। এখনো পরে আছো কেন?”

_আম্মা খুলতে বারণ করেছিলেন।
নিচুগলায় জবাব দেয় জান্নাত।

_সে তো মেহমান ছিলেন বলে, ঘুমানোর সময় এসব পরে থাকতে হবে না।

একটা একটা করে গয়না খুলে ফেলে শামির, জান্নাত সকালের মেজাজী লোকটার সাথে এই লোকটাকে মেলাতে পারছে না। সে আড়চোখে বারকয়েক লোকটাকে দেখে দৃষ্টি নত করে নিয়ে বসে থাকে।
সব গয়না খুলে শামির সাইড টেবিলে রেখে জান্নাতের ঘোমটা সরিয়ে দিয়ে ওকে আবারও কাছে টানে,নম্র কন্ঠে বলে,“শুধুই জান্নাতুল ফেরদৌস? আর কোন নাম নেই?”

_জি না।
ছোটো খাটো শরীরটা শামিরের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মৃদু কাঁপছে। কমলা আলোয় শামির চেয়ে চেয়ে দেখছে শুধু ওকে।

ঘনিষ্টতার প্রথম চুমু মাখিয়ে দেওয়ার পরে জান্নাতের খানিকটা হাশফাশ লাগতে শুরু করেছে, কিন্তু নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে পরক্ষনেই। একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে।
শামির খানিক বাদে ওকে দেখে নম্রকন্ঠে বললো,“জান্নাতুল!”

_জি।
ক্ষীণ আওয়াজে জবাব দেয়।

_ভয় লাগছে?

জান্নাত কিছুপল চুপ থেকে মাথা নেড়ে হ্যা বোধক জবাব দেয়। তার ভয় লাগছে। শামির এবার মুখ থেকে কাঠিন্যতা সরিয়ে জান্নাতকে শুইয়ে ওর কপালে চুমু খায়। আর পাঁচজন স্বাভাবিক পুরুষ হয়তো সেই পরিস্থিতিতে বলতেন,“ভয়ের কিছু নেই। আমি তোমার স্বামী।”

কিন্তু শামির চৌধুরী স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,“ভালো! স্বামীকে ভয় পাওয়া উচিত জান্নাতুল।”

জান্নাত অবাক হয়ে লোকটাকে দেখলো, শামির চোখ সরিয়ে নিয়ে হাসলো সামান্য, জান্নাত এই প্রথম দেখলো লোকটার হাসি। ভীষণ সুন্দর লোকটার হাসি, অথচ হাসেনা সে।
কিছুক্ষণ বাদে জান্নাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে শামির বললো,“তবে ভয় পেলে আমাকে ধরতে পারো জান্নাতুল। স্বামীকে ভয় পেলে স্বামীকেই ধরতে হয়।”

এইবার জান্নাত লজ্জা পায়। সে নির্জীব হয়ে পরে থাকে পুরো, বাকিটা সময় দু’চোখ বন্ধ করে থাকে, সে দেখতেও চাইলো না তার সাথে কি হচ্ছে, শুধু টের পেয়েছে বান্ধবীদের কাছ থেকে যেমনটা শুনেছে তেমন ভয়ংকর কিছু তার সাথে হয়নি, লোকটা ভীষণ নমনীয়তার সহিত আগলেছে তাকে। শুধু অনুভব করেছে নিজের নতুন জীবনকে,ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও লোকটার বুকে ঠাঁই পেয়েছে। লোকটা আর মেজাজী ছিলো না ঐ সময়টুকুতে, ভীষণ কোমল ছিলো জান্নাতের প্রতি। ঐ সময়টিতে জান্নাতের মনে হয়েছে তার স্বামী বোধহয় তার শোনা ভয়ংকর স্বামীদের মতো নয়।

চলমান…..

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৭
#ইসরাত_ইতি

জান্নাতুল ফেরদৌস ওরফে জান্নাতের নতুন জীবন শুরু হয়েছে। যে জীবন সম্পর্কে তার নেই কোনো অভিজ্ঞতা,নেই বিন্দু পরিমাণ ধারণা,নেই জ্ঞান। জান্নাত এই জীবনটাকে যত দেখছে তত বেশি বিস্মিত হচ্ছে, শিহরিত হচ্ছে, পুলকিত হতে শুরু করেছে।
সবকিছু তার সয়ে গিয়েছে এ কদিনে, স্বামী, শশুর বাড়ীর পরিবারের সাথে মানিয়ে নিচ্ছে একটু একটু করে। যদিও তেমন জটিল কিছু নয় এটা, তার শশুর বাড়ির লোকগুলোকে তার ভীষণ অমায়িক লাগে, আর স্বামী? জান্নাতের কাছে লোকটাকে তেমন দুর্বোধ্য মনে হয়নি এ ক’দিনে, লোকটা স্বভাব সুলভ ভীষণ রাগী, গম্ভীর,মেজাজী। জান্নাতের বড় ভয় করে মাঝে মাঝে লোকটাকে যদিও তবে জান্নাত এখনও তার মেজাজের প্রকোপে পরেনি। তবে যখন লোকটা তাকে কাছে টেনে নরম আদরে ভরিয়ে দিয়ে,নরম দু’টো কথা বলে তখন জান্নাতের ভয় চলে যায় একেবারেই। অদৃষ্ট যখন এ পর্যন্ত জান্নাতকে এনেছেই,জান্নাতও মানিয়ে নিচ্ছে, সম্মান দিয়ে স্বামীকে কাছে আসতে দিচ্ছে নির্দ্বিধায়,হয়ে উঠছে তার সংসারের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ। একটু একটু করে অনুভূতি জমাচ্ছে স্বামী নামের লোকটার প্রতি। এটা অভ্যাস,মায়া নাকি ভালোবাসা জান্নাত এটুকুও ধরতে পারছে না। সে শুধু জানে লোকটা তার বড় আপন,তার স্বামী, সে এই লোকের জায়া।

চৌধুরী বাড়ির অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে,নানা ব্যস্ততায় জান্নাত লেখাপড়া নিয়ে ভাববার ফুরসৎ টুকু পায়নি। অবশ্য ফলাফল প্রকাশিত হয়নি বলে তার নিজেরই আগ্রহ নেই এসব নিয়ে, সে অলস হয়ে তার ছুটি কাটাচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথায় ইয়া বড় ঘোমটা দিয়ে রান্নাঘরে যায়, শাশুড়ির সাথে গল্প করতে করতে সবকিছু হাতে হাতে গুছিয়ে দেয়। শামিরকে অফিসে পাঠিয়ে তারপরের সময়টুকু জায়ের সাথে গল্প করতে করতে কাটায়, রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করে, ইদানিং তার হাতের রান্না খুব প্রশংসিত হচ্ছে শ্বশুরের কাছে, জান্নাত খুব খুশি হয়ে রান্না করে, একটা দু’টো পদ। দুপুরে শামির এলে তার এটা সেটা এগিয়ে দেয়া,বিকেলে শামিরের পাশে চুপ করে শুয়ে ভাতঘুম দেয়া, সন্ধ্যায় শামির অফিসে গেলে ননদ আর দেবরের সাথে লুডু খেলা,দাদী শাশুড়ির সেবা করা,তাকে কোরআন শরীফ পাঠ করে শোনানো, রাতে স্বামীর আবদার পূরণ করা। এগুলো হচ্ছে জান্নাতের প্রাত্যহিক রুটিন,যেটা বিয়ের দু সপ্তাহ ধরে চলছে রোজ।

জানালার পাতলা সাদা পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই বাইরের মিঠা কমলা রঙের রোদটা এসে ঘরের কানায় কানায় ভরে গেলো। ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছে নিতে নিতে জান্নাত বিছানার এক পার্শ্বে বসে ভয়ে ভয়ে ডাকতে লাগল শামিরকে,“শুনছেন। আপনি বলেছিলেন খুব সকালে উঠাতে। আপনি কি উঠবেন?”

মিহি স্বরটা কানে যেতেই শামির ভ্রু কোচকালো। পর পর চোখ মেলে তাকিয়ে ঘুমঘুম চোখে দেখলো জান্নাতের ফরসা স্নিগ্ধ মুখটা, ক্ষণিকের মাথায় হ্যাঁচকা টানে ওকে ফেললো বিছানায়। জান্নাত চমকালেও সামলে নেয় নিজেকে, চার দেয়ালের মধ্যে এই লোকটা রোজ এমন করে,সে অভ্যস্ত হচ্ছে।

শামির উঠলোই না, উল্টো জান্নাতের গলায় মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকলো। তির তির করে কাঁপতে থাকা জান্নাতের হাত টা আঁকড়ে ধরলো শামিরের চুল, হাতটা চুলে বুলিয়ে দিয়ে অনুরোধের সুরে বলল,“আমি যাই? আপনি উঠুন।”

চোখ মেললো শামির, মুখভঙ্গি গম্ভীর। জান্নাত চিন্তিত হলো,এই লোকটার স্বভাব হলো উনি নিজের মর্জি মাফিক চলা লোক,এই যে জান্নাত যেতে চাইছে, এটা হয়তো লোকটার পছন্দ হয়নি। এখন জেদ করে হলেও কমপক্ষে আধাঘণ্টা ধরে রাখবে, অতঃপর নিজের মর্জিতে ছাড়বে। মাঝে মাঝে লোকটার এই ব্যাপারটা খুব বিরক্ত লাগলেও জান্নাত মুখ ফুটে বলে না, উল্টো ধ’ম’ক খাওয়ার ভয়ে।
তবে আজ ছাড়লো শামির। উঠে বসে উন্মুক্ত শরীর ঢেকে নিলো টি-শার্টে,হাই তুলতে তুলতে ভারী আওয়াজে বললো,“কম্পিউটার টেবিলের ওপর একটা বক্স আছে,নিয়ে এখানে এসো জান্নাতুল।”

জান্নাত চুপচাপ বক্সটা এনে শামিরের পাশে বসলো। শামির বক্সটা খুলবার নির্দেশ দেওয়ায় বক্সটা খুলে দেখতে পেলো একটা স্মার্টফোন। শামির জান্নাতুলকে টেনে কাছে নিয়ে বললো,“পছন্দ হয়েছে গিফট?”

_এটা আমার?
বিস্মিত জান্নাতুল, এতো সুন্দর একটা ফোন পেয়ে।

জান্নাতের হাত থেকে নিয়ে ফোনটা অন করে শামির। বললো,“হ্যা। সিমকার্ড দিয়ে দিয়েছি, সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছি। এখন থেকে এটা ব্যবহার করবে।”

জান্নাত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে শামিরের হাতের পানে। শামির ফোনের সেটিংস চেক করে নিতে নিতে বললো,“ব্যবহার করতে পারো?”

_জি মোটামুটি। মামীর ফোনটা মাঝেমাঝে ধরতাম।

_আচ্ছা। ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম এসব সম্পর্কে ধারণা আছে?

_শুধুমাত্র ফেসবুক সম্পর্কে আছে। তবে আমি ব্যবহার করিনি। মামীর আইডি।

শামিরের মুখভঙ্গি গম্ভীর, বললো,“ফোনটা শুধুমাত্র আমার এবং তোমার আমার কাছের মানুষদের সাথে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে। কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট প্রয়োজন নেই গট ইট জান্নাতুল?”

চুপচাপ মাথা নাড়ে জান্নাতুল,সে তো এসব ব্যবহার করার কথা স্বপ্নেও ভাবে নি। বৌয়ের নমনীয়তা,সায় বড় প্রশান্তিদায়ক শামিরের কাছে,কাছে টেনে চুমুতে লাগলো হঠাৎ, জান্নাতুল নড়েচড়ে উঠতেই মিহি স্বরে বললো,“এখন যাও,চা নিয়ে এসো,চিনি দিবে একচামচ।”

রান্নাঘরে জান্নাতুলের শাশুড়ি,জা আর হেল্পিং হ্যান্ড সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। এ বাড়িতে তিনদিন অন্তর অন্তর নাস্তার মেন্যু পরিবর্তন হয়, প্রথম দিন রুটি,সবজি,ডিম হলে দ্বিতীয় দিন সবজি খিচুড়ি নানা পদের ভর্তা,ভাজি এবং তৃতীয় দিন কোনো ওয়েস্টার্ন কুইজিন হয়। আজ রোববার তাই নিয়ম অনুযায়ী সবজি খিচুড়ি আর কুমড়া ফুল,মুশুরি ডালের বড়া,বেগুনী এসব হচ্ছে। সুঘ্রাণে রুহি শামা ঘরে টিকতে না পেরে এসে ডাইনিং টেবিলে বসলো।
শামিরকে চা দিয়ে এসে জান্নাতুল ননদদের তার মোবাইল ফোনটা দেখায়। রুহি ফোনটা লুফে নিয়ে বলে,“ওয়াও ভাবি। ভাইয়া দিলো?”

হেসে মাথা নাড়ায় জান্নাত। শামা মন খারাপ করলো,“ইশশ আমি কবে একটা পার্সোনাল ফোন পাবো!”

রান্নাঘর থেকে রিজিয়া জবাব দেয়,“গোল্ডেন এ প্লাস এনে দিলেই।”

আড্ডায় আড্ডায় জমে উঠেছে রান্নাঘর। এক ফাঁকে জান্নাত রুহিকে বললো,“রুহি আপু। আমি অত কিছু তেমন বুঝিনা, একটা ইমো অ্যাপ নামিয়ে দেবে ফোনে? বা তুমি আমাকে শিখিয়ে দাও।”

_ইমো অ্যাপ কেনো?

_মামা-মামীরা আর বান্ধবীদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলবো।

রুহি হেসে ফেলে,বলে,“ইমো একটা থার্ড ক্লাস অ্যাপ ভাবী। ইমো মানেই স্বামী বিদেশ।”

জান্নাত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এই বাড়ির মেয়েগুলো বড্ড নাটকীয় কথা বলে বেড়ায় সবসময়,যার অর্থ ধরতেই জান্নাতের দিন পেরিয়ে যায়। অস্ফুটে বিড়বিড় করলো জান্নাত,“স্বামী বিদেশ মানে?”

_ঐ গ্রামের প্রবাসীদের বৌয়ের কাছে জনপ্রিয় একটি অ্যাপ,তাই আর কি।
তাচ্ছিল্যে করে জবাব দেয় রুহি।

জান্নাতের ভালো লাগে না বিষয়টি,একটা অ্যাপ নিয়েও কত শ্রেণী বিভক্তি এদের, জবাব দিলো,“তবুও তো চলে যায় আপু। উনারা উনাদের আপন লোকের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। তুমি আমাকে ঐ স্বামী বিদেশ অ্যাপটাই এনে দাও। আমার বান্ধবীরা কেউ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে না।”

রুহি হাসতে হাসতে বলে,“আচ্ছা।”

শামা স্কুল ড্রেস পরে গপাগপ গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায়, বাড়ির পুরুষেরা তখনও নাস্তা খেতে এসে বসেননি। এই ফাঁকে জান্নাত রুহিকে বললো,“আপু? এখানে ইন্টারের জন্য কোন কলেজ টা বেশি ভালো হবে? তুমি কোনটাতে পড়েছো?”

ফোন টিপতে টিপতে রুহি অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দেয়,“মহিলা কলেজে।”

পাল্টা জানতে চাইলো না রুহি জান্নাত কেন কলেজের খোজ নিচ্ছে। দূর থেকে রিজিয়া বণিক শুনে জান্নাতের দিকে চোখ তুলে তাকায় তৎক্ষণাৎ । জান্নাত কথা না বাড়িয়ে টেবিল সেট করছে। রিজিয়া বণিকের মুখটা নিমিষেই ফ্যাকাশে হয়,আহারে! মেয়েটা বুঝি কলেজে পড়তে পারবে না বিধায় সারাক্ষণ আফসোস করে। অথচ রিজিয়া বণিক জানেন না আসলে জান্নাত নিজেই এখনও জানতে পারেনি তার কপালে আর পড়ালেখা নেই।

আজ রেজাল্ট প্রকাশিত হবে। এটা জান্নাত এই মাত্র জেনেছে ফুলের কাছ থেকে। ঘরে ঢুকে দেখলো শামির গায়ে শার্ট পরে নিচ্ছে অফিসে যাবে বলে, জান্নাত এগিয়ে যায় শামিরের কাছে,হাতে ব্লেজার নিয়ে।
ওকে দেখে শামির ব্লেজার সহ ওকে কাছে টানলো, কথায় কথায় লোকটা হ্যাঁচকা টান মারে, জান্নাতের বড্ড হাঁসফাঁস লাগে, পরক্ষনেই সামলে নেয় নিজেকে।
রাশভারী আওয়াজ জান্নাতের কাছে জানতে চাইলো,“কিছু বলতে চাচ্ছো?”

_আজ আমার রেজাল্ট দেবে।
থেমে থেমে বললো জান্নাত।

শামির কয়েকপলক জান্নাতের মুখটা দেখে বলে,“ভালো কথা। শায়ন আছে বাড়িতে,ও দেখে দেবে। আমি তো লাঞ্চে আসছিই।”

লোকটা চলে যায়, জান্নাত জড়তা কাটিয়ে বলতেই পারলো না আর কোনো কথা, কি জানি কেন এখনও জান্নাত সহজ স্বাভাবিক দু’টো কথা লোকটার সাথে বলতে পারে না। হয়তো লোকটা মেজাজী তাই তার অযথা কথা বলতে বড্ড ভয় করে।

সময় কাটছে না, দুপুর বারোটায় প্রকাশিত হবে রেজাল্ট। সকাল ন’টা থেকে এগারোটা জান্নাত নিজেদের ঘরটা ঝাড়পোছ করেছে। নীল সুতি শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে ঘরের ছাটকাট পরিবর্তন করেছে, এছাড়া তার আর কাজ কি। ইদানিং জান্নাত শাড়িই পরছে , শামিরের সালোয়ার কামিজে কোনো আপত্তি নেই তবে তার শাশুড়ি আর দাদী শাশুড়ি বলেছে সবসময় শাড়ি পরতে। লোকজন দেখলে প্রথমেই প্রশ্ন করে বৌ তো একেবারে পিচ্চি, শামির এতো পিচ্চি একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে? এজন্য সবসময় শাড়ি পরার আদেশ পেয়েছে জান্নাত যাতে তাকে খানিকটা বড় বড় লাগে।

কাজ করতে করতে জান্নাত ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের কাছে এসে পৌঁছাতেই দেখলো ড্রেসিং টেবিলের প্রথম ড্রয়ারটা হাট করে খুলে রাখা। কৌতুহলী জান্নাত এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ারটা খুলে দেখল রাজ্যের আচার আর চকলেটের বৈয়াম। চোখ বড় বড় করে দেখতে থাকে সেগুলোকে সে। ঠিক তখনই শামিরের ফোন আসে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর স্বরে বলে,“জান্নাতুল একটা নীল রঙের ফাইল কম্পিউটার টেবিলের ওপর ফেলে এসেছি, ওটা আলমারিতে তুলে রাখো।”

জান্নাত ঘাড় ঘুরিয়ে ফাইলটা দেখে বললো,“জি আচ্ছা! শুনছেন, এই চকোলেট আর আচার এখানে কেন?”

কিছু একটা টাইপ করছিলো শামির,ফোন কানে চেপে রেখে গম্ভীর আওয়াজে বলে,“ওহহ, ওগুলো তোমার, সবকিছু হাইজিন মেনে বানানো, স্বস্তা আচার খেয়ে পেট নষ্ট করার চেয়ে ওগুলো খেয়ো। রাখছি আমি, ব্যস্ত!”

কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে জান্নাতের মুখ ছেয়ে যায় হাসিতে। মনে পরে গতকাল বিকেলে শামা রাস্তার ভ্যান থেকে চালতার আচার এনে তাকে দিয়েছিল, জান্নাতকে ওসব খেতে দেখে লোকটা এমন এক ধ’ম’ক দিয়েছিল যে জান্নাতের চোখে পানি চলে এসেছিল তৎক্ষণাৎ, কেঁদেই ফেলতো তার আগেই শামিরের ফোন আসে আর সে সামনে থেকে চলে যায়।

আজ লোকটা এতো কিছু তার জন্য এনেছে। জান্নাতের এতোটা খুশি কখনো লাগেনি, লোকটা ধমকা ধমকি করলেও জান্নাতের ছোটো ছোটো অনেক খুশির কারণ হচ্ছে লোকটা। তাই মাঝেসাঝের ধ’ম’ক জান্নাত মাফ করে দেয়,রাগ করে থাকতে পারে না। সেদিন ভোরে অফিসের ঝামেলা নিয়ে রাজনের সাথে কিঞ্চিৎ তর্কাতর্কির সময়ে জান্নাত চা নিয়ে গেলে লোকটা এমন করে চোখ রাঙিয়েছিলো, তখনও জান্নাতের কান্না পেয়েছিল, পরক্ষনে ঘরে এসে জান্নাতকে কোলে বসিয়ে জান্নাতের হাতে চা খেয়েছে, এক কাপ নয়,দুই কাপ। এটার পর জান্নাত আর রেগে থাকতে পারেনি। দাম্পত্যের টুং টাং ছন্দে এমন করেই নাচছে জান্নাত, তার কিশোরী অবলা মনও বুঝতে পারছে সে এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত,তার স্বামীর দ্বারা,তার সংসারের দ্বারা। তবে তখনও এই নিয়ন্ত্রণ তেতো লাগতে শুরু করেনি জান্নাতের কাছে।

উজ্জ্বল মুখশ্রীতে চওড়া হাসি, দু’হাতে লুফে নিলো জান্নাত আচার গুলোকে, তারপর কিছু একটা ভেবে আচার আর চকলেট গুলো চারভাগ করলো, একভাগ তার আর বাকি তিনভাগ তার জা এবং ননদদের।

বাইরে তখন শায়নের হাঁকডাক,“মেজো ভাবী! ও মেজো ভাবী! এদিকে এসো।”

আচার আর চকলেট গুলো ফেলে রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে জান্নাত ছুটে যায় শায়নের ঘরে, সম্পর্কে ছোটো হলেও বয়সে জান্নাতের থেকে ঢের বড় বিধায় জান্নাত ছোটো দাদা বলে ডাকে শায়নকে আর রাজনকে ডাকে বড় দাদা। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জান্নাত বললো,“কি হয়েছে ছোটো দাদা?”

ল্যাপটপ বন্ধ করে শায়ন উঠে দাঁড়িয়ে বললো,“ফোর পয়েন্ট সিক্স এইট পেয়ে পাশ করেছো তুমি! কংগ্রাচুলেশন।”

_______

রূপাতলী হাইস্কুলের এবছর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ নাম্বারধারী মেয়েটি হলো জান্নাতুল ফেরদৌস। অজপাড়া গাঁয়ের এক হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এর বেশি নাম্বার এর আগে কেউ তুলতে পারেনি,তাও শুধুমাত্র ক্লাসে পড়া বুঝে নিয়ে। জান্নাত এতে সন্তুষ্ট নয়, বরং সে ভীষণ খুশি। তার স্কুলের হেড স্যার শাহীন আকন্দের বাড়িতে এসে জান্নাতের সাথে কথা বলেছে ফোনকলে, অনুপ্রেরণা দিয়েছে জান্নাত সুযোগ সুবিধা পেলে আরো অনেক কিছু করতে পারবে,ও যেন লেখাপড়াটা চালিয়ে যায়।

দুপুরে চারদিকে মিষ্টি ছড়াছড়ি শুরু হয়েছে, জান্নাতের শশুর শারাফাত চৌধুরী ছেলের বৌ ভালো মার্কস নিয়ে পাশ করেছে শুনেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুব কাছের একটি বড় মিষ্টির দোকান থেকে নানা পদের মিষ্টি নিয়ে এসেছে। পাড়া প্রতিবেশীদের বিলিয়ে নিজে ছেলেমেয়ে আর ছেলের বৌদের নিয়ে খেয়েছে। এ বাড়ির মানুষগুলোর এতো আন্তরিকতায় জান্নাত ভীষণ আপ্লুত । মার্কশিট টা খুব যত্নে তার ফাইলে তুলে রেখে অপেক্ষা করছিল শামিরের।

আজ শামির এলো বড্ড দেরী করে,খুব ব্যস্ত ছিলো তাই লাঞ্চে আসা হয়ে ওঠেনি। এসেছে বিকেলে, একেবারে,সব কাজ শেষ করে।
জান্নাত সদর দরজা খুলে দিয়ে দেখলো শামিরের হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট,জান্নাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে শামির বললো,“অভিনন্দন।”
জান্নাত লজ্জা পেয়ে সেটা নিলো, বললো,“টেবিলে খাবার দেবো?”

_তুমি খেয়েছো?
ঘরের দিকে যেতে যেতে শামির জানতে চাইলো।

_জি না। আপনি পোশাক বদলে আসুন। আমি খাবার বাড়ছি।

এমনিতে জান্নাতকে শামিরের জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করতে হয়না। তার দাদী শাশুড়ি একটু খিটখিটে হলেও খাওয়াদাওয়ার ব্যপারে জান্নাতকে সবসময় উৎসাহ দেন, বলে,“খাইয়া লইয়া দুলদুলা থাকবি মা’গী। পুরুষ মানষের কাছে দুলদুলা বৌরা খুব পাত্তা পায়। শুঁটকি মাছ না।”

জান্নাতের যখন ইচ্ছা হয় তখনই খেতে পারে, তবে আজ জান্নাতের খুব ইচ্ছে করলো মানুষটার সাথে খেতে। একা একা ওনারও নিশ্চয়ই খেতে ইচ্ছে করবে না আজ।

খেতে বসে টেবিলে বাহারি রকমের খাবার দেখে শামির বললো,“আজ এতো পদ কেন? তুমি পাশ করেছো বলে?”

_জি। আম্মা করলেন।
সামান্য হেসে জবাব দিল জান্নাত।

খাওয়া শেষে শামির উঠে দাঁড়ায়,জান্নাত উঠে টেবিল পরিষ্কার করতে থাকে তখন শামির বললো,“এসব রেনু করবে। তুমি রুমে এসো জান্নাতুল।”

কন্ঠে সেই চিরায়ত আদেশের সুর,তবে জান্নাত লজ্জায় মরি মরি হয়, আশেপাশে ঘরের হেল্পিং হ্যান্ড ঘুরঘুর করছে, এই লোকটার রাগ খুব বেশি তবে লজ্জা খুবই কম, সবার সামনে ডেকে ওঠে,“অ্যাইই জান্নাতুল! ঘরে এসো।”

গুটি গুটি পায়ে ঘরের দরজায় পা রাখতেই ওপাশ থেকে ভারী আওয়াজ বলে,“হচ্ছে টা কি? এতো গাইগুই করছো কেন?”

ঢোক গিলে জান্নাত ঘরে ঢুকতেই শামির দরজা লাগিয়ে ওকে দেখলো, কপাল কুঁচকে আছে তার। জান্নাত ভীত হয়ে বললো,“আসছিলাম তো।”

তিন পলক জান্নাতকে দেখে পাঁজাকোলা করে তুললো শামির। জান্নাত এবার চমকায় না,এ কদিনে এসব বেশ সয়েছে সে, লোকটা ভারি অদ্ভুত। এই মনে হয় ধ’ম’ক দেবে দেবে,জান্নাতও কেঁদে ফেলবে বলে প্রস্তুত হয় তবে দিয়ে ফেলে চুমু।

জান্নাত নিজেকে সামলাতে শামিরের শার্টের কলার খামচে ধরলো, পরমুহূর্তেই নিজেকে আবিষ্কার করল বিছানার একপাশে বসা। শামির ওকে রেখে চেয়ারের ওপর রাখা ব্লেজারের পকেট থেকে একটা পেন্ডেন্ট এনে জান্নাতের পাশে বসে গলায় পরিয়ে দেয়।

অবাক হয়ে জান্নাত বললো,“এসব কেনো?”

_আজ একটা ভালো দিন তোমার,তাই। বাই দ্য ওয়ে, আমি পছন্দ করিনি এটা রুহিকে দিয়ে পছন্দ করিয়ে নিয়েছি। তোমার ডিজাইন পছন্দ না হলে বলো,চেঞ্জ করে দেয়া যাবে জান্নাতুল।

জান্নাত আবার ডিজাইনের কি বোঝে? তাও আবার স্বর্ণালঙ্কারের। সে শুধু বিস্মিত হচ্ছে,এতো ভালো মার্কস সে পায়নি,অথচ সে স্বর্ণ উপহার পেলো স্বামীর থেকে?
কিশোরীর বধূ মন বিগলিত হয়, আপ্লুত হয়। লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকে, শামির ওকে কাছে টেনে জরিয়ে ধরে, আবেশে জান্নাত দু’চোখ বন্ধ করে, শামির বললো,“বাড়িতে কথা হয়েছে নাকি!”

_হ্যা।

_কি কথা হলো?
ওর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে শামির জানতে চাইলো। জান্নাত বুঝতে পারলো জবাব শুনতে এই প্রশ্নটি করা হয়নি। জান্নাত থেমে থেমে বললো,“শুনছেন।”

_হু।

_হেড স্যারের সাথেও কথা হয়েছে।

_ভালোকথা।
জান্নাতের শাড়ির আঁচলের পিন খুলতে খুলতে জবাব দেয় শামির।

_তো উনি জানতে চেয়েছেন আমি কোন কলেজে ভর্তি হবো, আচ্ছা আমাকে কি মহিলা কলেজে ভর্তি করাবেন?

থামলো শামির, জান্নাতের শাড়ির আঁচল থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে ওর মুখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,“মানে?”

_মানে কোন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়বো আমি?
অস্ফুটে বলে ওঠে জান্নাত।

শামিরের শান্ত চোখের দৃষ্টি জান্নাতের মুখবিবরে। উঠে বসলো শামির। জান্নাতও উঠলো। শামির ওর দিকে তাকিয়ে বলে,“কোন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়বে মানে? কিসের ইন্টারমিডিয়েট জান্নাতুল?”

ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতো তাকিয়ে আছে জান্নাত,বললো,“আমার!”

_তুমি কেনো কলেজে ভর্তি হবে?

_মানে?
অবাক জান্নাত।

_মানে তুমি তো কলেজে ভর্তি হচ্ছো না!

এখনও বোকার মতো তাকিয়ে আছে মেয়েটা। কম্পিত স্বরে বলল,“এসব কি বলছেন? কেন?”

_কারণ আমি চাচ্ছি না!

ঠান্ডা স্বর জবাব দিলো, তক্ষুনি কান্না পেলো জান্নাতের, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,“আপনি কেনো চাচ্ছেন না?”

_কারণ আমার বৌকে পড়াশোনা করানোর ইচ্ছে নেই জান্নাতুল।

কথাগুলো বড্ড শান্ত তবুও রুক্ষ,এবার আর নিজেকে সামলাতে পারেনি জান্নাত, ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,“কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন আপনি আমাকে পড়াবেন!”

চলমান…..