জায়া ও পতি পর্ব-১০

0
5

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_১০
#ইসরাত_ইতি

[ ১ম অংশ ]

হাওলাদার ভিলা। “কমলা রঙের রোদের” ঠিক পাশাপাশি বাড়ি খানা। চৌধুরীদের প্রতিবেশী তারা।
তবে জান্নাত কখনো ও বাড়িতে যায়নি। এখানে আসার পর থেকে শুনেছে চৌধুরীদের সাথে ওদের খুব একটা বনে না। দু বাড়ির মাঝে একটা শত্রু শত্রু ভাব আছে। দু বাড়ির মাঝখানে এক শতাংশ জমিই মূলত বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু। জান্নাত সময়ে অসময়ে আশেপাশের সব বাড়িতে গেলেও ও বাড়িতে তাই যাওয়া হয়নি। তবে ও বাড়ির সবাইকে জান্নাত চেনে। তার কারণ মেধা আপু। এখানে জান্নাতের অন্যতম পছন্দের একজন মানুষ। ও বাড়ির মেয়ে মেধা, পেশায় একজন সমাজ কর্মী, ভীষণ পড়ুয়া এবং খুব অমায়িক। জান্নাতের বিষন্নতায় ভরা সময়ের আরেকজন সঙ্গী। মাঝেমাঝে স্বামী সংসার দায়িত্ব কর্তব্য সবকিছু থেকে হাঁপিয়ে উঠলে জান্নাত ছুটে যায় দোতলার পেছনের বারান্দায়,বিকেল আর সন্ধ্যেটাতে মেধা আপুর দেখা মেলে মুখোমুখি বেলকোনিতে ওদের। কথা হয়,গল্প হয়, জান্নাতের মন ভালো হয়ে যায়। মেধা আপু জানে না হেন বিষয় নেই,সবকিছুতে জ্ঞান রয়েছে তার। খুব হাসিখুশি,তবে জান্নাত শুনেছে রুহির থেকে, মেধা আপু একজন ডিভোর্সী। কিন্তু মেয়েটির দৃঢ়তা আর জীবনীশক্তি জান্নাতকে খুব অবাক করে, জান্নাত ওকে দেখে সবসময় ভাবে এমন মেয়ে মানুষও হয়?

“ওহে জান্নাত, প্রতিবেশী ভাবী! অসুখ নাকি গো তোমার?”
মিহি স্বর ডাকলো জান্নাতকে। জান্নাতের মুখশ্রী উজ্জ্বল হয় নিমিষেই। এগিয়ে গিয়েই বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে তাড়াহুড়ো করে বললো,“না না, একটু ঘুমিয়ে ছিলাম বিকেলে আপু।”

চুলে বিনুনি করে নিতে নিতে মেধা হাসলো, বললো,“বর আছে নাকি বাড়িতে?”

_হু।

_হু? পাশ থেকে উঠতে দিলো শামির চৌধুরী?

_আসরের নামাজের সময় হয়ে এলো যে। তাই দিলো!

বলতে বলতে জান্নাত হেসে ফেললো,সে হাসি কিছুটা অন্যরকম, উদাসী হাসি। মেধা দেখে পিচ্চি মেয়েটাকে। গাঁয়ের শাড়িটা বড্ড ভারি পরেছে ঐ তরুণী মেয়েটির গায়ে,যেমন ভারি পরেছে শামির চৌধুরী,দ্যা গ্রেট অ্যাংরি ম্যান। মেয়েটা কি করে অমন গুন্ডা গোছের লোকটাকে সামলায় মাঝেসাঝেই ভাবে মেধা।

বারান্দার গোলাপের টব গুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে জান্নাত, পাশাপাশি চালিয়ে যেতে থাকে মেধার সাথে আলাপ। মেধা শামিরের বড়, জান্নাতের সাথে বয়সের ব্যবধান ব্যাপক হলেও এই কমাসে দু’জন বান্ধবীর মতো হয়েছে, তবে এই বন্ধুত্বের খবর যায়নি শামিরের কানে,গেলেই বিপদ।

মেধার থেকেই বিকেলে জানলো ও বাড়ির চাচী, মেধার মা তসলিমা ভীষণ অসুস্থ, দিন পনেরো আগে কোমরের হাড় ভেঙে বিছানা নিয়েছিলো। জান্নাতের মন খারাপ হলো, অসুস্থ একটা লোককেও ও বাড়িতে দেখতে যেতে পারবে না সে। শাশুড়ি অনুমতি যদিওবা দেন তবে শশুর আব্বা অথবা শামির কখনও দেবেনা। মুখের ওপর বলবে,“তুমি গেলে সুস্থ হবে? যদি সুস্থতা কামনা করো তবে জায়নামাজে বসে প্রার্থনা করে দিও। তার জন্য এক বাড়ির বৌ আরেক বাড়ির চৌকাঠে পা রাখার তো প্রয়োজন নেই! ”
এটাই শামির চৌধুরী,যে শামির চৌধুরীকে জান্নাত জেনে এসেছে। তার আঙুলের ইশারা ছাড়া জান্নাত দুকদম রাখতে পারবে না, প্রতিবেশীর বাড়িতে যাওয়া তো দূরে থাক।

নিচ তলা থেকে শামিরের রাশভারী আওয়াজ ভেসে উঠলো। নরম মনটা জান্নাতের কাপলো হঠাৎ, আবার কি হলো? আবার কি করলো সে? শামিরের ফুটফরময়ায়েশ খাটা নিয়ে জান্নাত কখনো কথা শোনেনি এখনও, লোকটা এই বেলায় একটু ছাড় দেয়,তবে বাকি সব বেলায় ছাড় পাওয়া মুশকিল।
শামিরের চেঁচামেচির কারণ জানতে ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি ভাঙছিলো সে । মাঝপথে এসেই পা থামলো তার, ড্রয়িং রুমে একাধিক ব্যক্তির গলার স্বর শুনে। জান্নাত এগোলো না আর, উঁকি দিলো নিচে, সাথে সাথে ঘোমটা টানলো মাথায়।
আজ এ বাড়িতে পারিবারিক সালিশ বসার কথা,মনে পরলো জান্নাতের ফুফাতো দেবর আর তার বৌয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়ে বোঝাপড়া হবে, বোঝাপড়া করিয়ে দেবেন মুরব্বিরা। শামিরের ফুপাতো ভাই হাসান, এতিম, ঢাকায় একটা ছোটোখাটো কোম্পানিতে চাকুরী করে, ইদানিং বৌয়ের সাথে নানা ঝামেলা হচ্ছে, মেয়েটিও এতিম। শামিররাই ছিলো বিয়ের সময়ে তাদের অভিভাবক,সেই সুবাদে ছেলে মেয়ে নালিশ জানিয়েছে শারাফাত চৌধুরীর কাছে, শারাফাত চৌধুরী দু’জনকে ডেকে নিয়েছে বাড়িতে।
ছেলে মেয়ে উভয়কেই খুব করে বোঝানো হয়েছে,বুঝিয়েছে শারাফাত চৌধুরী । কিন্তু কোনো লাভ নেই,মেয়ের এক কথা,“আমি থাকবো না আর ওর সাথে। সারাদিন বাইরে খেটে এসে রোজ রোজ আমার ওপর রাগ ঝাড়ে! দূর্ব্যবহার, অকথ্য ভাষায় গালি। চাকুরী তো পৃথিবীতে উনি একাই করে! আর? পরে এসে সরি বলে! চাইনা আমার সরি! থাকবো না ওর সাথে!”

শামির রেগেমেগে বললো,“থাকবি না? তবে কি করবি তুই? যাবি কই?”

_কই আর যাবো, পড়াশোনা তো বেশি করলাম না অলসতা করে! গার্মেন্টসে ঢুকবো কোনো! আমার মতো মেয়েদের জন্য গার্মেন্টস আছে।

খানিক বাদে মনে হলো ছোটোখাটো একটা বজ্রপাত হলো, টেবিলে চাপর মেরে শামির খেকিয়ে উঠলো মেয়েটার ওপর,“হ্যা হ্যা, এটাই তো তোদের মেয়ে মানুষের দৌড়, স্বামীর একটু আধতু ধমক নিতে না পারলে সোজা ডিভোর্স! অথচ গার্মেন্টসে চাকরি করে সুপারভাইজারের অকথ্য গালিগালাজ শোনার ধৈর্য্য আছে! গার্মেন্টস কি জানিস? দুনিয়াটা দেখেছিস? অসভ্য মেয়ে, ও তো ক্ষমা চাইলো, এখনও জেদ ধরে বসে আছিস! এতোটা বিগড়েছিস তুই সুমী!”

সুমী কাঁদছে। শামির একটু বেশিই উঁচু গলায় চেচালো। শারাফাত না থামালে আরো বকতো মেয়েটাকে। হাসানের দিকে তাকিয়ে শামির বলে,“তুই বৌকে শাসাতে এখানে এনেছিস দেখেই তোর ওপর আমার মেজাজ বিগড়েছে! নিজের বৌকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়, আমরা কেউ নই ওকে বোঝানোর। তোরা দু’জনই আমার দুই ফুফুর ছেলে মেয়ে। দু’জনকেই স্নেহ করি। রাতে খেয়ে বাড়িতে গিয়ে মিলে যাবি। নয়তো দু’টোকেই আচ্ছা মত থাপড়ে সিধে করবো!”

নাক টানছে সুমী। শামির শেষ বাড়ের মতো বললো,“গার্মেন্টসে চাকুরী করার দরকার নেই, সংসার কর। মাথা থেকে ওসব শয়তানের ওয়াসাওয়াসা দূর কর।”

এরপর বৈঠকে আর কথা বাড়লো না কোনো, সুহানা এসে সুমীকে মাথায় হাত দিয়ে বুঝিয়ে হাসানের হাতে সুমীর হাত তুলে দিলো, মিলিয়ে দিলো দু’জনকে। জান্নাত সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটা দেখলো। পেছন থেকে রিজিয়া ডাকলো,“বৌমা!”

জান্নাত ঘুরে তাকায়।

_এখানে কি? দাঁড়িয়ে আছো যে!

_আম্মা মেহমানদের জন্য রাতে কি রাধবো? ওনারা রাতে খেয়ে যাবে তো?

_না,থাকবে না বললো, আর সেজন্য রেনু আছে। তুমি যাও, ঘরে যাও। হাসানের সামনে গিয়েছো দেখলে বকবে শামির।

হ্যা ঘরে যাবে জান্নাত! কারণ খানিক বাদে রিজিয়া বণিকের গুণধর মেজো ছেলে পদার্পণ করবে ঘরে। কিছুক্ষণ জান্নাতকে চটকে পরে গম্ভীর হয়ে বলবে ওখানে যাবে না,ওটা করবে না,আমার কথার যেন নড়চড় না হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব বাণী রোজ জান্নাত নিয়ম করে শোনে। শামির চৌধুরীর দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করলে, বৌ হচ্ছে পালতু তোতাপাখি,পালতু তোতাপাখিকে যেমন নিয়ম করে তিনবেলা বুলি শেখানো হয়, বৌয়ের বেলাতেও তাই।

একটা সাদা শার্ট,একটা ফরমাল প্যান্ট,বেল্ট,টাই, আন্ডারওয়্যার এসব বিছানার ওপর রেখেছে জান্নাত, শামির সন্ধ্যায় অফিসে যাবে,ফিরবে রাত দশটায়, সবটা গুছিয়ে দিয়ে জান্নাত ওযু করে দাদী শাশুড়ির ঘরে যাবে, মাগরিব বাদ মাইমুনাকে এক পাড়া করে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতে হয় রোজ। তবে ইদানিং মাইমুনার ঘরে গেলে জান্নাত চিন্তিত থাকে, বৃদ্ধামহিলা ইদানিং জান্নাতকে স্বামী বশীকরণের নতুন মন্ত্র শেখাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে রিনরিনে গলায় বলে,“ওয় মাগী হোন! চন্ডাল ভাতারের ঘর আমিও করছি। তোর দাদা শশুর আছিলো হেই মেজাজ ওয়ালা এক লোক,তার মেজাজের ধারে কাছেও নাই তোর ভাতারের মেজাজ। এইসব লোকরে খুব সহজেই বশে আনা যায়। একটা বাচ্চা নিয়া নে, দেখবি মেজাজ তাল উলডি খাইতে খাইতে ভাগবো।”

বাচ্চা! জান্নাতের গা শিরশির করে ওঠে বাচ্চার কথা শুনলেই। গাল দুটো হয় লাল লাল,লজ্জায়, সে মা হলে কেমন লাগবে? এতো অল্প বয়সে মা হলে বান্ধবীরা হাসবে তার? বাচ্চা নিয়ে শামির একরাতে তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। আদর করতে করতে বলেছে তার দু বছর পর বাচ্চা চাই-ই চাই। অথচ জান্নাতের এখনই কোনো আপত্তি নেই বাচ্চাতে, জান্নাতের কোনো কিছুতেই কোনো আপত্তি নেই তবে থেকে,যবে থেকে জান্নাত বৌ হয়েছে, পড়াশোনা করার অধিকার হারিয়েছে।
ছোটো করে জান্নাত বলেছিলো,“দুবছর পরেই কেনো?”

গম্ভীর মুখে, সিগারেটে পোড়া কালচে ঠোঁট দুটো উঁচিয়ে জান্নাতের চিবুক চুমুতে চুমুতে শামির চৌধুরী বড় আহ্লাদ দেখিয়ে বলেছে,“আমার পিচ্চি বৌটা বড় হোক আগে!”

পিচ্চি মেয়ে বিয়ে করতে বাঁধেনি শামির চৌধুরীর, পিচ্চি মেয়ের সাথে সংসার করতেও বাঁধে না, তবে পিচ্চি মেয়ে প্রেগন্যান্ট হলে শামির চৌধুরীর বড্ড হ্যাপা পোহাতে হবে। হাসি পায় জান্নাতের এসব বড় বড় কথা ভাবলে। অবশ্য এসব বড় বড় কথা জান্নাত কখনোই ভাবে না, সে স্বামীর বাধ্য বৌ‌। স্বামী যা ভাবতে দেবে তার বাইরে কিছু ভাবা যাবে না।

পেছন থেকে শক্ত দু’টো হাত বড় নমনীয় ছোঁয়া দিলো তার পেটে। জান্নাতের শ্বাস আটকে এলো, কি জানি তার কি হয় লোকটা যখন কাছে আসে, সে কেমন মোহগ্রস্তের ন্যায় হয়ে যায়, মায়া,প্রেম,স্বামীর প্রতি প্রেম, জান্নাতেরও পায় এই লোকের প্রতিটা ছোঁয়ায়, আবেগী হয় অন্যসব বৌয়ের মতো , ভুলে যায় এই লোক তার অধিকার খর্ব করে রেখেছে। কাঁধে শামিরের থুতনি, ছোটো ছোটো দাঁড়ির খোঁচা, সুরসুরি লাগতেই জান্নাত সরলো। শামির ঘুরে দেখলো ওকে, চোখ পরলো জান্নাতের গলায়।

“একি এটা কি!”

গাঢ় ভ্রু যুগল গুটিয়ে এলো শামিরের,দৃঢ় বৃদ্ধাঙ্গুলে শামির ছুলো জান্নাতের গলার দগদগে লাল দাগ,গম গম করে উঠলো,“আবার ! তোমাকে আগামী পরশু ডার্মাটোলজিস্টের কাছে নিয়ে যাবো। আপাতত ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ খেয়ো না।”

নতমস্তকে লাজুক হাসলো জান্নাত। কিছু পল আমতা আমতা করে বললো,“এটা আপনি করেছেন।”

শামির বৌকে দেখলো । কাছে টানলো হ্যাঁচকা টানে, জান্নাত সামলে নিয়ে নিজেকে, ধরলো বরের গলা। নৈকট্য বৃদ্ধি পেলো দুজনের।

“ওয়েল! তো এটা শামির চৌধুরীর কাজ হুম?!”

নম্র আদুরে স্বর লোকটার, এতো আদুরে কথোপকথন জান্নাতের ভালো লাগে, সারাদিনের গম্ভীরতা আর ধমকাধমকির মাঝে জান্নাতের ভালো লাগে এটুকুই,এই লোকটাকে তখন এই পৃথিবীতে তার একমাত্র আপন মনে নয়। সে মিছিমিছি আপত্তি দেখাতে বললো,“আজানের সময় হয়েছে।”

_আরো পঁচিশ মিনিট বাকি।

_আজ দেড়ি করে ফিরবেন?

_না দেড়ি করে অফিসে যাবো।

মুড বোঝার চেষ্টা করছে জান্নাত শামিরের, তার মাথায় হঠাৎ এলো ও বাড়ির চাচীকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি আদায় করে নেবে এখন। শামির এখন নমনীয়, অবশ্য এই সময়ে সব পুরুষ নমনীয়, বললো,“শুনছেন!”

শামির শুনেছে,তবে তার মনোযোগ জান্নাতের গ্রীবা দেশে, চুমুতে চুমুতে আপনমনে লোকটা বলছে,“ইউ নো হোয়াট জান্নাতুল! হোয়াট পারপাস নেক ইজ মেইড ফর? নেক ইজ মেইড ফর কিসেস।”

জান্নাত কিছু মূহূর্ত চুপ থেকে আবারও বললো,
_শুনুন না!

_হু।

গলার কাছে বেসামাল উৎপীড়ন জান্নাতের, নিজেকে আরো মিশতে দিয়ে নম্রকন্ঠে আওড়ালো,“ও বাড়ির চাচীআম্মার কোমরের হাড্ডি ভেঙেছে।”

_শুনেছি, তো?

_তো বলছিলাম…. বলছিলাম আমি একটু দেখে আসি?

জান্নাত অসীম সাহস জুগিয়ে বলেই দিলো কথাটা। শামির মুখ তুললো তৎক্ষণাৎ, ভাবলেশহীন চেহারা। জান্নাত আমতা আমতা করছে।
“একটু যাই? দেখুন আপনাদের ঝামেলা তো ও বাড়ির পুরুষ লোকদের সাথে জমিজমা নিয়ে, চাচী আম্মা বড্ড ভালো মানুষ,সেবার দাদীর পা ভাঙল, কতবার লুকিয়ে এসে দেখে গেলো দাদীকে। একটু যাই? যাবো আর আসবো!”

শামির কিছু বললো না, মুখচোখ গম্ভীর ভীষণ। জান্নাত হতাশ, এখন তিতকুটে কথা শুনিয়ে দিলে জান্নাত কেঁদেই ফেলবে, সারাদিন বাড়িতে বন্দি হয়ে থাকতে তারও ভালো লাগে না, আগে যা পূর্ব পাশের বাগানে হাঁটতে যেত বিকেলে, বাউন্ডারির বাইরে ও পাড়ার উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলের দল ক্রিকেট খেলতে আসে। শামির জানতে পেরেই জান্নাতের ও বাগানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
রুপাতলী যাবে, সেই সুযোগও নেই, শামির যেতে দেয় না, ধমকাধমকি না করলেও নানা বাহানায় আটকে রাখে, কারাবন্দী জীবন যেন তার।

শামির কোনো তিতকুটে কথা শোনালো না । মাগরীবের আজান দিয়ে দিয়েছে তখন, জান্নাতের খসে যাওয়া ঘোমটা মাথায় তুলে দিয়ে শামির বলে,“দরকার নেই। চাচী আম্মার জন্য দোয়া করো তাতেই হবে।”

চুপ হলো জান্নাত। আর অনুনয় করতে কথা খরচ করবার দরকার নেই বুঝে গেল, শামির তার সিদ্ধান্তে থাকবে অটল।
আজান শেষ হতেই বাইরে দরজায় কড়া ঘাত, জান্নাত গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো রুহী দাঁড়িয়ে আছে। হরবরিয়ে জান্নাতকে বললো,“নামাজ আদায় করে জলদি রেডি হও ভাবি। বড় ভাবী পাঠালো আমাকে।”

শামির বললো,“কোথায় যাবে ও? কেন রেডি হবে?”

উত্তেজনায় মেজো ভাইয়াকে খেয়াল করেনি রুহী, এবার ঘাবড়ালো । ঢোক গিলে বললো,“তুমি অফিসে যাওনি?”

_কেন আমি সারাদিন অফিসে থাকলে লাফালাফি করতে সুবিধা হয়? মোড়ের মাথায় গিয়ে বান্ধবীদের নিয়ে হাহা হিহি করতে সুবিধা হয়?

রুহি মলিন মুখ করে বললো,“তা না। এমনি।”

ওর দিকে সন্দেহের নজরে তাকিয়ে শামির বললো,“জান্নাতুলকে নিয়ে কোথায় যাবে বড় ভাবী এই ভর সন্ধ্যায়?”

_শপিংয়ে! সামনে সুপ্তি আপুর বিয়ে না? তাই বাড়ির সবার জন্য টুকটাক কেনাকাটা করবে ভাবী।

_তো? জান্নাতুল কি করবে শপিংয়ে?

_ভাবীর জন্যেও তো শাড়ি কিনতে হবে!

_তোরা গিয়ে কিনে আন, নীল রঙের পিওর সিল্ক টাইপ আনবি, জান্নাতুলের গায়ে রঙটা ভালো লাগে।

_ভাবী যাবে না?

_না।

এক কথায় উত্তর শামিরের। এবং আলাপচারিতা এখানেই শেষ, রুহির সাহস হয়নি আর কিছু বলার, অন্তত মেজো ভাবীর ব্যাপারে শামিরের ওপরে গিয়ে কেউ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। সে চলে গেলো চুপচাপ,বড় ভাবীকে জানাতে। জান্নাতের সামান্য মন খারাপ হয়, সে চলে যায় মাগরিবের নামাজ আদায় করতে।

চলমান….

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_১০
#ইসরাত_ইতি

[ ২য় অংশ ]

শামির সে সন্ধ্যায় অফিসে গেলো না, ক্লায়েন্ট আসার কথা ছিলো,তারা নাকি আসবেনা। ম্যানেজারকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে। ঘরে ল্যাপটপ নিয়েই বসেছিল, কিছুক্ষণ কিছু ফাইল দেখে চিরায়ত উঁচু গলায় চেঁচাতে লাগলো,“অ্যাই জান্নাতুল!”

জান্নাতুল তখন ছিলো রিজিয়া বণিকের ঘরে। শামিরের ডাক শুনে দোতলায় উঠলো সুহানা, তার শামিরের সাথে কিছু কথা ছিলো, মাগরিবের সময়টা উতরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলো শুধুমাত্র।

ভাবীকে দেখে শামির বললো,“জান্নাতুল কোথায়?”

_মায়ের ঘরে।

_তুমি এলে যে, কিছু বলবে? শপিংয়ে যাবে না?

_যাবো, জান্নাত রেডি হলেই।

শামির ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে তাকায়, কপাল কুঁ’চ’কে ভাবীকে বলে,“মানে? জান্নাতুল যাবে না,তোমাকে বলা হয়নি?”

সুহানার আজ জেদ চাপলো,শামিরকে কিছু কঠিন কথা শোনাতে ইচ্ছে হয়েছে তার, বললো,“সেটা তো তোমার সিদ্ধান্ত,জান্নাতের নয়। শাড়ি ওর কিনবো, ওর যাওয়াটা জরুরি।”

কিছু সময় বাদেই অল্পস্বল্প তর্কাতর্কি শুরু ভাবী দেবরের মধ্যে, জান্নাতুলের শপিংয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে। নিচতলা থেকে রিজিয়া, জান্নাত,রুহি,শামা ছুটে গেলো দোতলায়।

শামির নিজের মেজাজকে যথেষ্ট সংযত রেখে বললো,“তোমার স্বামী তোমাকে পারমিশন দিয়েছে, যাও! তাতে তো আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমার বৌটাকে নিয়ে এতো টানাটানি কিসের তোমাদের? অনেকদিন থেকে দেখছি ওকে খালি ওস্কাও।”

_বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকে কিন্তু শামির ভাইয়া। মেয়েটাকে কোথাও যেতে দাও না, সারাদিন বাড়িটাতে আটকে রাখো,কাজটা কি উচিত? একটু বালিশে মাথা রেখে ভেবে দেখো তো?

_না না, উচিত নয়, বৌকে সংসারে না রেখে আকাশে ছেড়ে দেবো ডানা মেলে উড়তে। শপিংয়ের নাম করে যাবে কোথায়? ঐ তো বেলস পার্ক আর ত্রিশ গোডাউন, হাহা হিহি করবে রাস্তায় নেমে! ওমুকের গাঁয়ের শাড়ি দেখে আফসোস করবে ইশ আমার অমন শাড়ি কেন হলো না, অমুক ছেলেকে দেখবে ভাববে ইশশ আমার অমন বর কেন হলো না!

বিদ্রুপ শামিরের কন্ঠে। জান্নাত দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে দুজনের তাকে নিয়ে তর্কাতর্কি দেখছে।

সুহানা নিজেকে সামলায়,বেশি একটা উচ্চবাচ্য করলো না,দেবর হলেও শামিরের রাগটাকে ভীষণ ভয় তার, এবার একটু নরম হয়েই বলে,“যাক না মেয়েটা। আমরাই তো।”

_না। তোমরা দেখেশুনে একটা শাড়ি কিনে এনো, কার্ড নিয়ে যাও আমার।
বরফ ঠাণ্ডা জবাব শামিরের।

_কিন্তু আমাদের পছন্দ যদি ওর পছন্দ না হয়?

_ঠিকাছে,তবে ওরটা রাখো,আমি পছন্দ করে একটা কিনে দেবো।

_সেটাও তো তোমার পছন্দ হবে। ওর তো হবে না। একটা শাড়িও কি নিজে পছন্দ করে কিনতে পারবে না?

_ঠিকাছে বাবা,অনলাইন থেকে ও নিজেই পছন্দ করবে,আমি অর্ডার করে দেবো।
গম্ভীর জবাব শামিরের।

_অনলাইন শপিং? শাড়ি? শাড়ি হাতে ছুঁয়ে না দেখলে হয়?

সুহানার এই কথার পরে শামির কিছু সময় ভাবলো, বেশ বুঝতে পারলো তার ভাবী তাকে তর্কে হারাতে চাইছে। কিন্তু নিজের বৌয়ের ব্যাপারে অন্য কারোও মাতব্বরি তো শামির মানবে না। রিজিয়া, জান্নাতুল,রুহি,শামা, সুহানা শামিরের মুখপানে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। ভেবেছিল শামির বোধহয় অনুমতি দেবে। জান্নাতের বুক ঢিপঢিপ করছিল, সুহানা ভাবী বলেছিলো শামির পারমিশন দিলেই আজ তারা বাইরে ঘুরবে, সে উত্তেজনায়। কিন্তু শামিরের থেকে উত্তর এলো,“জান্নাতুল শাড়ি হাতে ছুঁয়ে দেখেই কিনবে। অপেক্ষা করো।”

পঁয়তাল্লিশ মিনিট পেরিয়েছে। বাড়ির মেয়ে বৌরা নিচতলায় জমায়েত হয়েছে। শামিরের কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো তারা তখন,যখন সদর দরজা হাট করে খোলা হলো। বরিশাল সিটির বিখ্যাত শাড়ির শোরুম “শাড়ি চুড়ির” দু’জন স্টাফকে কল করে নিয়েছে শামির। দু’জনের হাতে দু’টো গাট্টি বোচকা। এক্সক্লুসিভ কালেকশন গুলো নিয়ে এসেছে।

জান্নাতুল সহ বাড়ির সকলে তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে শামিরের মুখের দিকে, এই কাজটা ছিলো তাদের কল্পনাতীত। রিজিয়া বণিক বিমূঢ় হয়ে ছেলেকে দেখছেন, নিজের জেদ বজায় রাখতে কত কি করতে পারে এই ছেলে!

স্টাফরা শাড়িগুলো মেলে রাখছে সেন্টার টেবিলে। শামির সুহানা আর রুহির মুখের দিকে তাকিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বললো,“জান্নাতুল শোরুমে গিয়ে কমপক্ষে বিশটা শাড়ি দেখে দু’টো বেছে নিতো তাইনা? এর বেশি বাছাবাছি করতো না। এখানে পঞ্চাশটা শাড়ি আছে। জান্নাতুল, যে কয়টা পছন্দ হয় নিয়ে ঘরে যাও, আর ভাবী! তোমরা যাও, তোমাদের শপিং করে আসো।”

সুহানা একটি কথাও বললো না আর। জান্নাতুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শামির পুনরায় বলে ওঠে,“কি হলো জান্নাতুল?”

জান্নাতের মন উঠে গিয়েছে, বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও করছিলো না একটা শাড়িতেও হাত রাখার, তবুও গা টেনে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঝাঁপসা চোখে দু’টো শাড়ি তুলে নিলো। শামির নিজেও একটা পছন্দ করে দিলো। দু’টো শাড়ি জামদানি, একটা বেনারসী সিল্কের। শোরুমের স্টাফদের বিল মিটিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে শামির সুহানার দিকে তাকালো,“কি হলো? জান্নাতুলের শপিং তো হয়ে গেলো? তোমরা যাও, রাত হলো তো।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুহানা বললো,“ইচ্ছে নেই আজ। কাল যাবো।”

শামির একে একে প্রত্যেককে দেখলো,তার ঠোঁটে অহংকারী জিতে যাওয়া হাসি। রিজিয়া বণিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক দর্শক হয়ে, রুহি শামা কপাল কুঁচকে মেজো ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আর জান্নাতুল হাতে শাড়ির প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ কেন জানি জান্নাতুলের নিশ্চুপতা শামিরের মেজাজটা আরও বিগড়ে দিলো। রুহি শামার দিকে তাকিয়ে বললো,“এই তোরা ঘরে যা তো।”

রুহি শামার সাথে সুহানাও চলে গেলো ওপরে একরাশ মন খারাপ নিয়ে। দাঁড়িয়ে ছিলো শুধু রিজিয়া আর জান্নাত। শামির এবার জান্নাতের দিকে ফিরে বললো,“সমস্যা কি? শাড়ি পছন্দ হয়নি?”

জান্নাত নিশ্চুপ। শামিরের রাগ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে।
“তবে সমস্যা কি? মুখটা এমন কেন? বাইরে যেতে পারোনি বলে?”

জান্নাত এখনও নিশ্চুপ। রিজিয়া ছেলেকে চেনে, এরপর কি হবে তার আন্দাজ হয়, সে শামিরকে থামানোর আগেই খুব চড়া একটা ধ’ম’ক আছড়ে পরে জান্নাতের ওপর,“শপিং মলে গিয়ে ছেলে পেলে দেখতে দেখতে শপিং করলে মন ভালো থাকতো?”

এহেন কথা জান্নাত নিতেই পারলো না,সে চোখ তুলে আতঙ্কিত হয়ে শামিরকে দেখলো কয়েক মুহূর্ত, তারপর দিলো কেঁদে। শ্বাস নিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,
“আমি তো যেতে চাইনি কোথাও।”

শামির ওকে বিশ্বাস করলো না, চেঁচিয়ে বললো,“খুব লাফাতে ইচ্ছে হয় তাইনা? ও বাড়ি যাবো, পাশের বাড়ি যাবো, কেন? ঘরে মন টিকছে না? মন কোথায় যেতে চাচ্ছে শুনি? ”

রিজিয়া চুপচাপ ঘরে চলে গেলো,দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে তার। কি ছেলেকে জন্ম দিলো সে!

জান্নাত আর দাঁড়ালো না, হাতের শপিং ব্যাগ রেখে দোতলার সিঁড়ির কাছে যেতে নিলে শামির বলে,“শাড়িগুলো কে নেবে?”

জান্নাত ঘুরে এসে ব্যাগ গুলো নিয়ে চুপচাপ দোতলায় উঠলো। ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদল। কেঁদে কেঁদে আবার মুছেও নিলো চোখ, লোকটার উপর এখন তার অনুভূতির নাম রাগ, অভিমান আর বিরক্তি। তবে জান্নাত জানে, এই আজ রাতেই, লোকটা যদি তার কাছে আসে, জান্নাতের শরীর খারাপ কিনা,জানতে চাওয়ার অযুহাতে জান্নাতকে বুকে টানে, জান্নাত আজ সন্ধ্যার সবকিছু ভুলে মোমের মতো গলবে, যেটা বরাবর হয়ে আসছে তার সাথে।
নারী জন্ম বড় অদ্ভুত, জান্নাত বুঝতে পারছে, জান্নাতের মতো করে আর কেউ বুঝতে পারছে না।

◻️

“আমি পড়তে চাই!”

_এক কথা শুনতে ইচ্ছে করে না রোজ জান্নাতুল,আই ওয়ার্ন ইউ। নয়তো……

শামিরের বজ্রধমকের তোয়াক্কা না করে জান্নাত উল্টো চেঁচায়,“নয়তো কি? তালাক দেবেন ‍‍? দিন তালাক!”

শামিরের হতবাক দৃষ্টি জান্নাতের মুখবিবরে। জান্নাত গলায় তেজ ঢেলে বলতে থাকলো,“তালাকের পর কি করবেন শামির?”

_হোয়্যাট! তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকছো! তোমার কতবড় সাহস! তোমার থেকে আমি কত বড়!

_বড়, তবে স্বামী তো। আর নাম তো শামির,ডাকবো কি তবে? কালামদন বলে?

হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো শামির, দু’চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললো,“আশেপাশের বাড়ির ভাবী, আর ঐ মেধার সাথে মিশে নষ্ট হয়ে গিয়েছো একেবারে!”

_মিশি তো আমি আপনার মায়ের সাথেও,সেও কি আমাকে বিগড়ায়?

_হ্যা বিগড়ে দিয়েছে, আজ থেকে তুমি আমার মায়ের সাথেও মিশবে না।

_সে পরে দেখা যাবে। আগে বলুন পড়তে দিবেন কি না!

_না দেবো না।

_তবে তালাক দেন!

_জিন্দেগীতেও না।

_তা দেবেন কেনো? বুড়ো ভাম যে আপনি! খুব ভালো করে জানেন এরপর আর বৌ জুটবে না । আর আমার মতো ন্যাকাছ্যাদা কচি বৌ তো পাবেনই না।

_মুখটা সামলে কথা বলো জান্নাতুল। ছোটো ছোটোর মতো থাকো।

_ছোটো? আমি ছোটো? আর বিছানায় বুঝি খুব বড় হয়ে যাই? লজ্জা করে না? লজ্জা করে না বাল্যবিবাহ করে….

এইবার জান্নাতের চোয়াল চেপে ধরল শামির,জান্নাত ঘাবড়ে গিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো। শামির দাঁতে দাঁত চেপে বলে,“ওরে! আমার তোতাপাখি খুব কথা শিখেছে যে! কিন্তু তোতাপাখি! এগুলো তো আমার শেখানো বুলি নয়।”

_লাগছে আমার , ছাড়ুন।
কোনোমতে বললো জান্নাত।

শামির ছাড়লো না,বললো,“তার আগে আমার শেখানো বুলি বলো, বলো, আমি আমার স্বামীর পালতু তোতাপাখি।”

_বলবো না এসব বাল ছাল। কি করবেন আপনি?

_কি করবো? তালাক দেবো তোকে এসব না বললে।

_আচ্ছা দেন।

_আচ্ছা,তবে শোন, এক তালাক, দুই তালাক….

আঁতকে উঠে আর্তনাদ করে বসে জান্নাতুল। দুকান চেপে ধরে কেঁদে ওঠে,“আমি তালাক চাই না। আমি তালাক চাইনা। আমি বলছি। বলছি আমি, আমি আপনার পালতু তোতাপাখি।”

গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল শামিরের। জান্নাত ছিলো তার বুকের সাথে লেপ্টে। কাঁচা ঘুম ভেঙে,ঘটনা বুঝতে তার মিনিট খানেক লাগলো। ঘুমন্ত জান্নাতকে ছটফট করতে দেখে আরো শক্ত করে ধরে গালে হাত রেখে বলে,“অ্যাই জান্নাতুল! কি হয়েছে? কে কাকে তালাক দিচ্ছে? কি বলছো তুমি?”

জান্নাত তখনও বিড়বিড় করছিলো,“আমি আপনার পালতু তোতাপাখি,আমি আপনার পালতু তোতাপাখি।”

শামির এবার ধাক্কা দিলো,“জান্নাতুল ওঠো!”

ঘুম ভেঙে যায় জান্নাতের। চোখের কোণে জল জমেছে, দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতেও কাঁদছিল। উঠে হাঁপাতে লাগলো ভীষণ। শামির উঠে ওকে পানি খাওয়ালো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,“দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”

মাথা নাড়ে জান্নাত, তাকায় শামিরের দিকে। আজ সন্ধ্যা রাতে কান্নাকাটির পরে নিজেকে সামলে নিচে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এসেই ঘুমিয়ে পরেছিল, লোকটা আসেনি তার কাছে নরম কথা বলে ভোলাতে, তবে সে ঘুমিয়ে গেলে চোরের মতো বুকে টেনেছে, জান্নাত ভেংচি কাটে মনে মনে। যত্তসব পুরুষ মানুষ! বৌয়ের গন্ধ নাকে না নিলে ঘুম আসে না সম্ভবত!

শামির ওকে বলে,“কি স্বপ্ন দেখেছো? কে কার পালতু তোতাপাখি?”

চমকাল জান্নাত। আমতা আমতা করে বলল,“না কিছু না।”

ফরসা মুখটা ঘেমে নেয়ে লাল হয়ে গিয়েছে। শামির ওকে দেখলো মিনিট দুয়েক, তারপর জান্নাতের শাড়ির আঁচল টেনে জান্নাতের ঘর্মাক্ত মুখটা মুছিয়ে দিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বলল,“আচ্ছা ঘুমাও এখন।”

জান্নাত ধীরে ধীরে শুয়ে পরলো,বাকিটা সময় ঘুম না আসা পর্যন্ত নীরব থাকলো। শেষ রাত অবধি জেগে থাকলো শামির,বৌকে দেখছে সে। গাঁয়ের মেয়ে জান্নাতের স্বাস্থ্য এতোটাও গোলগাল ছিলো না, ইদানিং যেমন হয়েছে, আর গাঁয়ের রঙ, দুধ সাদা ছিলো যদিও, তবে রোদে পুড়ে অতটা উজ্জ্বলতা ছিলো না। বিয়ের এ কমাসে গৃহবন্দী হয়ে স্বর্ণের মতো চকচক করছে গাঁয়ের রঙ। শামির মুগ্ধ হয়ে সেসব দেখছে। আজ কি বেশিই রাগারাগী করে ফেলেছিল শাড়ির বিষয়টি নিয়ে? সবাই উস্কে না দিলে,প্ররোচনা না দিলে বৌটা কত লক্ষ্মী হয়ে থাকে। বিরক্ত শামির নিজের ভাবী আর বোনদের ওপর,নিজেরা তো গোল্লায় যাবেই,সাথে তার বৌকেও নিয়ে যাবে।
একটা লম্বা শ্বাস ফেলে শামির জান্নাতের কপাল থেকে এলোমেলো চুল সরিয়ে দেয়, ওর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকে। ঘুমন্ত জান্নাত একটু নড়েচড়ে ওঠে, পরক্ষনেই থেমে যায়। শামির মৃদু আওয়াজে অস্ফুটে আওড়ায়,“এতো সুন্দর বৌ ঘরে তোলা উচিত হয়নি আমার জান্নাতুল। সবসময় ইনসিকিউরড থাকতে হয়।”

চলমান…..