#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_১৬
#ইসরাত_১৬
দিনগুলো জান্নাতের কাছে একেবারেই সুখময় স্বপ্নের মতো লাগছে। হ্যা স্বপ্নই। এটা জান্নাতের জীবনে সাতদিনের সুন্দর স্বপ্ন হতে চলেছে। কারণ জান্নাত জানে, বরিশাল ফিরলেই তার দিনগুলো কেমন কাটবে। হানিমুন ট্রিপের তিনদিন অতিবাহিত হয়েছে। তারা সবাই মিলে পুরো সিলেট ছানবিন করে ফেলেছে ইতোমধ্যে, দূরের কিছু ট্যুরিস্ট প্লেস বাকি আছে শুধু। আজ সকালে চা-বাগান ঘুরেছে, বিকেলে পরিকল্পনা পাহাড় দেখার।
আসরবাদ শামিরকে কল করে তানভীর বলল,“কি রে ? বের হবি না? আমরা সবাই রেডি তো!”
_না,আমি আর জান্নাতুল আজ কোথাও যাচ্ছি না। তোরা যা।
_মানে? তোদের রেখে যাবো? এই এই? কি করছিস রে তুই ভাবীর সাথে? প্লিজ ওসব রাতে করিস, আয় ঘুরে আসি!
_শাট আপ! বললাম না তোরা যা? উই আর টায়ার্ড!
আর কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে শামির কল কাটল। জান্নাত বেজার মুখ করে তাকিয়ে আছে শামিরের দিকে, সে ঘুরতে যাবে বলে শাড়ি পরে রেডিই হচ্ছিল। মনমরা কন্ঠে শামিরকে বলে,“আমরা যাচ্ছি না?”
_না।
কড়া গলায় শামির জবাব দেয়।
_কেন?
_কারণ আমি চাচ্ছি না তাই।
জান্নাত আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বসে পরল,মুখটা মলিন। শামির শুয়ে ছিল, আড়চোখে জান্নাতকে অবলোকন করে গমগম করে উঠল,“এখানে আসার পর থেকে খুব ফরফর করছো, ওদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার জন্য এতো উতলা কেন হ্যা?”
মৃদু শ্বাস ফেলল জান্নাত, দৃষ্টি পায়ের নখে নিবদ্ধ রেখে জবাব দিল,“আমি ওনাদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার জন্য আগ্রহী নই।”
_তো?
_আপনার সাথে…..
মিনমিনে স্বরে জবাব দেয় জান্নাত। শুনে বাঁকা হাসলো শামির, অতঃপর হ্যাঁচকা টানে জান্নাতকে বুকের উপর ফেলল। চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে জান্নাত স্বামীর মুখের দিকে। শামির এতক্ষণের গম্ভীরতা সরিয়ে বলে,“সেজন্যই ওদের না করে দিয়েছি। আজ আমরা দুজন ঘুরবো শুধু।”
জান্নাত বিস্মিত হয়ে চেয়ে রয়,শামির উঠে বসতে বসতে জান্নাতকে জানায়,“এখান থেকে সতের কিলোমিটার দূরে নদী পেরিয়ে একটা ছোট আইল্যান্ড আছে, সেখানে সাফারি পার্ক রয়েছে, তোমাকে ওখান থেকে ঘুরিয়ে আনব আজ।”
জান্নাত তখনও হা করে তাকিয়ে আছে, শামির ভ্রু যুগল গুটিয়ে এনে বলে,“কি ব্যাপার? খুশি লাগছে না? নাকি আমার বন্ধুরা না হলে তোমার চলবে না?”
জান্নাত সম্বিত ফিরে পেতেই মাথা নাড়ায় দ্রুত,লোকটাকে বোঝাতে চায় তার খুশি লাগছে, বরং একটু বেশিই খুশি লাগছে।
শামির জান্নাতকে নিয়ে যখন আইল্যান্ডে পৌঁছায় তখন সূর্য অস্ত যাবে যাবে প্রায়। ওপাড় থেকে নৌকা করে নদী পেরিয়েছে তারা। নৌকায় তাদের মতো আরও বেশ কিছু পর্যটক রয়েছে। ছোটোখাটো নদীটা পার হতে ওদের পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগেছে। সেদিন আইল্যান্ডে পৌঁছেই শামির বুঝে যায় মারাত্মক একটা ভুল করেছে সে। আরো সময় হাতে নিয়ে এখানে আসা উচিৎ ছিলো তাদের। এবং যায়গাটা গ্রুপ নিয়ে আসার মতো একটি যায়গা, এভাবে একা একটা মেয়েকে নিয়ে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসা উচিত হয়নি সন্ধ্যা লাগিয়ে।
শামির অবশ্য ফোনে বন্ধুদের ইনফর্ম করে দিয়েছে ওরা কোথায়, বন্ধুরা ভীষণ রাগারাগী করেছে এমনটা করায়,নিলয় এইমাত্র কল করে বলেছে,“এমন স্বার্থপরের মতো একটা কাজ করলি? আমরাও যেতাম!”
শামির সবাইকে স্যরি বলে কল কেটে আশেপাশে তাকায়, সন্ধ্যার পরে সাফারি পার্কে ঢুকে লাভ নেই কোনো। এখানে আসাটাই বৃথা হলো যখন ভাবল,তখন এক আগন্তুকের থেকে জানতে পারল এই গ্রামের আরো কিছুটা দক্ষিণে নদীর পারে আদিবাসীদের মেলা হচ্ছে, শামিররা চাইলে সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারে।
শামির ভাবল যাওয়াই যাক, একেবারে বৃথা হবে না তবে এখানে আসাটা।
মেলার স্থানে পৌঁছাতে ওদের পায়ে হেঁটে দশ মিনিট লাগল, নদীর পাড়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন চড়কি, নাগরদোলা সাজিয়ে মেলা সাজিয়ে বসেছে।
জান্নাতের ভালোই লাগছে যায়গাটা, এমন মেলা খুব ছোটোবেলায় তাদের গ্রামেও হতো। তবে এতটা জমকালো মেলা এই প্রথম দেখছে। স্থানীয় লোকজনে গিজগিজ করছে । ঝুড়ি ভর্তি কত কি সাজিয়ে বসেছে আদিবাসী মেয়েদের দল,কিছু বাঙালি মেয়েও রয়েছে। জান্নাত ওদের স্টলগুলো দেখছে হাঁটতে হাঁটতে, বেতের, বাঁশের,কাঠের বানানো সুন্দর সুন্দর ওয়ালমেট, অলংকার আর চুড়ি।
জান্নাতের নজর গিয়ে আটকায় একটা বেতের তৈরি শোপিচে, কিছুক্ষণ উশখুশ করে শামিরের কাছে আবদার করে,“আমায় ওটা কিনে দিবেন?”
শামির কিনে দিল, আড়চোখে জান্নাতকে দেখল, কেমন সামান্য একটা শোপিচ হাতে নিয়ে খুশি হয়েছে, এই মেয়ে অল্পতেই খুশি হয়ে যায়, অন্যান্য মেয়েদের মতো লোভ এবং চতুরতা তার বৌয়ের মাঝে নেই, এটা শামিরকে মুগ্ধ করে বরাবর। শামির ওকে আরো কিছু ছোটো ছোটো শোপিচ কিনে দেয়, সেগুলো একটা প্যাকেটে নিয়ে টাকা দিতেই জান্নাত চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,“আচার।”
দূরেই একলোক হরেক পদের আচার বিক্রি করছিল, জান্নাতের মুখটা চকচক করছে সেসব দেখে। শামির বলে,“চেচাচ্ছো কেনো? ধীরে বলো।”
জান্নাত মিইয়ে গিয়ে বলে,“আচার কিনে দিবেন?”
_বাজে জিনিস। আনহাইজিনিক।
_অল্প?
_না।
জান্নাত চুপচাপ হাঁটছে, শামির কিছুটা সামনে গিয়ে আবারো ফিরে এসে বলে,“অল্প। বেশি না কিন্তু।”
এসব করে বেশ সময় গড়িয়েছে, শামির খেয়াল করেছে বেশ কুয়াশা জমছে। জান্নাতের শীতের চাদর তার জ্যাকেট কিছুই আনা হয়নি সাথে করে, এবার নদী পেরোতেই হবে। তবে নৌকাঘাটে গিয়ে যা শুনল তাতে শামিরের মুখটা পুরো পাংশুবর্ণের হয়ে গেল। নৌকা এখন ছাড়বে না কেউ ।
শামির হতবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে জানতে পারে, জলদস্যুদের প্রকোপ বেড়েছে, সন্ধ্যার পরে নৌকা নিয়ে নদীতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। পনেরো দিন হয় সন্ধ্যার পরে নৌ চলাচল বন্ধ।
জান্নাতুলকে নিয়ে শামিরের উৎকণ্ঠা বাড়লো,রাত বাড়ছে, যতই সুরক্ষিত আইল্যান্ড হোক, খারাপ মানুষ থাকবেই দুই একটা। জান্নাতুল তাকিয়ে আছে স্বামীর মুখের দিকে, এমন বিপদে পরতে হবে জানলে সে ঘুরতেই আসতে চাইতো না। শামির বন্ধুদের সাথে কথা বলে পরামর্শ নিয়ে হোমস্টের খোঁজে বেড়িয়ে পরল, আজ তাদের সাথে কি হচ্ছে বুঝতেই পারছে না, মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
দূর্ভাগ্যবশত আইল্যান্ডের সবগুলো হোমস্টে ছিলো বুকড।
শামির আজ খুব বিপদে পড়েছে, ঘাবড়ে গিয়েছে সে, জান্নাত কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,“এখন কি করবো?”
_ভাবছি! তুমি গলার স্বর্ণের চেইন আর কানের দুল খুলে নাও। এসব খারাপ লোক দেখলে বিপদ।
জান্নাত তাই করলো। ঠিক সেসময় তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করলো একজন মাঝি, বাড়ি যাওয়ার পথে শামিরকে বললো,“সাহেব আপনারা চাইলে আজ রাতটা বিদূষী কল্যাণ আশ্রমে উঠতে পারেন,ওনারা ঘর ভাড়া দেয়।”
_আশ্রম? সেটা কেমন?
অবাক হয়ে জানতে চাইলো শামির।
_মহিলাদের আশ্রম সাহেব, এখানকার স্কুলের হেড ম্যাডাম পরিচালনা করে। কোনো চিন্তা নেই। নিশ্চিন্তে বৌকে নিয়ে উঠতে পারবেন,ওরা টাকার জন্য ওদের বাইরের ঘর দুটো ভাড়া দেয় পর্যটকদের।
শামির কিছুক্ষণ ভাবলো,এটাই আপাতত তার ঠিক মনে হলো, এই মুহূর্তে এটাই সেইফ, যেহেতু জান্নাতুল আছে সাথে। লোকটাকে শামির দুশো টাকা দিয়ে বললো,“আমাদের ওখানে নিয়ে যান।”
মাঝি লোকটা খুশি খুশি শামিরদের আশ্রমের সামনে নিয়ে দাড় করিয়ে দিলো। গেটে দাঁড়িয়ে মাঝি হাক ছাড়তেই ওপাশ থেকে এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা বলে,“কে?”
_আমি মোজাম্মেল মাঝি মাস্টার আপা। দুইজন লোক আসছে ঘর ভাড়া চায়।
_মহিলা আছে?
_জি,জামাই বৌ তারা।
খানিক বাদে ভদ্রমহিলা গেঁটের দরজা খুলে দিলেন। ভদ্রমহিলার আনুমানিক বয়স ষাট হবে, চশমার নিচ থেকে ক্লান্ত দুটি চোখে শামির আর জান্নাতকে দেখছে। শামির তাড়াহুড়ো লাগিয়ে বলে ওঠে,“শুনেছি আপনারা ঘর ভাড়া দেন। আসলে আমার ওয়াইফ নিয়ে আইল্যান্ডে আটকা পরেছি, ইমার্জেন্সি একটা ঘর দরকার আজ রাতের জন্য, এর জন্য আপনাকে ডাবল টাকা দিতে পারি।”
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললেন,“বুঝেছি তোমার অনেক টাকা। এসো ভেতরে এসো।”
বৃহৎ এরিয়া নিয়ে আশ্রমটি। বাউন্ডারির ভেতরে খুপরির মতো অসংখ্য ছোট-বড় ঘর, মাঝখানে বিশাল বড় মাঠ, মাঠে দশ বারোজন মেয়ে লাইটের আলোয় বেত দিয়ে কিছু একটা বুনছে। বিভিন্ন বয়সী মেয়ে, সবার চোখে মুখে ক্লান্তি আর হতাশার ভাব স্পষ্ট।
শামিরদের যে ঘরটিতে থাকতে দেয়া হয়েছে সেটি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। কক্ষসংলগ্ন একটি কলঘর রয়েছে। ভেতরে ঢুকে বসতেই মাস্টার আপা এসে বললেন,“মাফ করবে, তোমাদের মন মতো কিছু খাওয়াতে পারবো না, ভাত সজনে দিয়ে ছোট মাছ চচ্চড়ি আর ডাল। এই যৎসামান্য আপ্যায়ন গ্রহণ করতে হবে।”
শামির ভদ্রতার সহিত বললো,“অসুবিধা নেই, চালিয়ে নেবো। আন্টি আপনাদের টাকা এখন দিতে হবে? বিকাশ নাম্বার দিলে ভালো হতো।”
_সকালে দিলেই হবে। খাবার পাঠাচ্ছি,খেয়ে তোমরা দরজা লাগিয়ে বিশ্রাম করো।
ভদ্রমহিলা বেড়িয়ে যাওয়ার পরে শামির দরজা লাগায়, জান্নাত বলে,“অনেক মেয়ে।”
_হ্যা। আশ্রম তো। এরা বিধবা, এতিম অথবা স্বামী পরিত্যক্তা।
জানালা খুলে দিয়ে জান্নাত জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে মেয়ে গুলোকে, গায়ে মলিন কাপড়, ভীষণ পরিশ্রমী সবাই।
খানিকবাদে দরজার কড়া নাড়ে একজন,“দরজা খুলুন। খাবার নিয়ে এসেছি।”
দরজা খুলে দিতেই খাবারের ট্রে হাতে ঢুকলো এক অল্পবয়সী মেয়ে, জান্নাতের বয়সী, তবে বয়সের উজ্জ্বলতা শরীরে নেই। শামির খাবারটা নিয়ে ধন্যবাদ দিতেই মেয়েটি চলে যায়।
খেয়ে দেয়ে দ্রুত শুয়ে পরলেও ওদের দু’জনের চোখে ঘুম নেই, বাইরে শব্দ হচ্ছিল। জান্নাত উঠে শামিরের দিকে তাকায়। শামির উঠে গায়ে শার্ট চাপিয়ে দরজা খুলতেই দেখে মেয়েগুলো তখনও কাজ করছিলো। ঘড়িতে সময় দেখলো শামির,রাত এগারোটার বেশি। এরা এই সময়েও এভাবে পরিশ্রম করছে দেখে অবাক সে। দরজা খুলে সামনে এগিয়ে যায়।
জান্নাতও মাথায় ঘোমটা টেনে বাইরে বেড়োয়, অদূরেই একটা খুপরির বারান্দায় বসে উলের সুতা দিয়ে অ্যাম্ব্রয়ডারির কাজ করছিলো মাস্টার আপা। শামির কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো,“আপনারা ঘুমান না? এরা এখনও কাজ করে কেন?”
হাসলো মাস্টার আপা,“তোমরা ঘুমাও নি?”
শামির আর জান্নাত এগিয়ে গেলো, ভদ্রমহিলা দু’টো বেতের চেয়ার ওদের দেখিয়ে বললেন,“বসো।”
ওরা বসতেই মাস্টার আপা বলতে লাগলেন,“ওরা ওভারটাইম করছে।”
_ওভারটাইম?
_জি, ওদের খরচ ওরাই বহন করে এই আশ্রমে, বেতের তৈরি জিনিসপত্র, শাড়ি তৈরি করে ওরা, সরকার তো যৎসামান্য দেয়। তাতে হয়না।
_তাই বলে রাতেও কাজ করবে?
অবাক হয়ে জানতে চায় শামির। জান্নাত উঠে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের কাজ দেখছে, একজন হেসে জান্নাতকে বসতে দিলো পাশে,নাম জানতে চাইলো।
মাস্টার আপা শামিরকে বলতে লাগলেন,“সবসময় ওভারটাইম করে না। ওদের সামনে বিরাট একটা খরচা আছে। বই কিনতে হবে। তাই টাকাটা ওঠাতে দশদিন কাজ করছে।”
_বই কেন?
_ওরা পড়াশোনা করছে।
শামির মেয়েগুলোকে দেখতে থাকে। মাস্টার আপা এক এক করে সবার পরিচয় দেয়,“ও শান্তি, বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের পর পড়াশোনা ছেড়েছিলো, স্বামীর পরকিয়া ধরা পরে,ওকে ছেড়ে দেয়, যেহেতু পড়াশোনা ছিলো না, কোনো চাকরিও পায়নি, ওকে প্রায় রাস্তা থেকে তুলে এনেই আশ্রমে উঠিয়েছি, এখন গায়ে খেটে খাচ্ছে। পড়াশোনা শুরু করেছে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছি।
ওইযে শাড়ি বুনছে,ওর নাম জয়া। গরীব বাবা মা এক লোহা ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে দিয়েছিলো, বিয়ের পর স্বামী পড়তে দেয়নি। বেচারীর মা বাবার কোনো পুত্রসন্তান ছিলো না, লুকিয়ে লুকিয়ে স্বামীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে জমিয়ে মা বাবাকে দিতো ওষুধ খেতে, কখনো চাল কিনতে। এ নিয়ে স্বামী খুব কথা শোনাতো,অপরদিকে না দিতো পড়াশোনা করতে। অনেক মানসিক অস্থিরতায় ভুগেছে, বাপ মা মারা গেলো, স্বামীও হঠাৎ মারা গেলো, বেচারী পরলো রাস্তায়। তারপর এখানে এলো।
ওর নাম ঝুমা, রুবি, মিথিলা, কারিমা। ওদের গল্পও এমন। এখানে যতগুলো মেয়ে দেখছো ওভারটাইম করছে, তাদের জীবনের সবার গল্পই এমন। আগে পড়াশোনা করতে পারেনি,অথবা গুরুত্ব বোঝেনি,এখন জীবনের তাগিদে শিখতে হচ্ছে।”
শামির চুপচাপ মেয়েগুলোকে দেখে, ধীরে ধীরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে জান্নাতকে দেখে, জান্নাত তার দিকেই তাকিয়ে আছে। শামির দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মাস্টার আপা শামিরকে বলে,“তোমার বৌয়ের বয়স খুবই অল্প, পড়াশোনা করছে?”
শামির প্রসঙ্গটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলে,“এরা আর কি করে?”
_শাড়িই বোনে, ওদের হাতের শাড়ির কত চাহিদা জানো? নাম বলবো না,তবে দেশের নামকরা একটা ব্র্যান্ডের শাড়ি কিন্তু ওদের হাতে বোনা, তারা নিজেদের নামে চালিয়ে দিচ্ছে, বিনিময়ে ওদের দ্বিগুণ দেয়।
শামির সব শুনছিল মন দিয়ে। মাস্টার আপা এক এক করে সব মেয়েদের জীবনের গল্প শোনায়,একজনকে ডেকে বলে,“মেহমানদের জন্য চা নিয়ে এসো।”
চা খেতে খেতে শামির সে রাতে দীর্ঘসময় মাস্টার আপার সাথে গল্প করেছে, জান্নাত চুপচাপ পাশে বসেছিলো। শামির মাস্টার আপাকে কিছু বায়ার্সদের নাম্বার দিয়েছে,যারা শাড়ি এবং বেতের তৈরি জিনিসপত্রের কারবার করে।
রাতে সামান্যই ঘুমিয়েছে শামির জান্নাত। খুব সকালে উঠেছে নৌকা ঘাটে যাবে বলে, এদিকে মাস্টার আপা মেহমানদের জন্য নাস্তা বানিয়েছে হরেক রকম। ক্ষমা চেয়েছে রাতে খুব সাধারণ খাবার খাইয়েছে বলে।
শামির ভদ্রমহিলার আপ্যায়নে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, ঘরের ভাড়া একরাতে ছয়শো। শামির দশ হাজার টাকা বিকাশ নাম্বারে ট্রান্সফার করে দিলে মাস্টার আপা যারপরনাই বিস্মিত হন।
শামির বলেছে,“ওনাদের জন্য দিয়েছি। ওনাদের বই কিনতে।”
জান্নাত ভীষণ অবাক। মাস্টার আপা আপত্তি করেছে, শামির হেসে বলেছে,“অসুবিধা নেই, আল্লাহ যথেষ্ট দিয়েছেন আমাকে। আপনি রাখুন।”
সকাল সাড়ে নয়টায় শামির জান্নাতকে নিয়ে আইল্যান্ড ছেড়েছে। পুরো রাস্তায় জান্নাত কোনো কথা বলেনি। চুপচাপ শামিরকে লক্ষ্য করেছে,কটেজে ফিরতেই শুরুতেই খুব সাহস করে জান্নাত বলে ওঠে,“আপনি ওদের বই কিনতে টাকা দিয়ে এলেন?”
হাতের খুব দামী ঘড়িটা খুলতে খুলতে শামির জবাব দেয়,“হু।”
জান্নাত ধীরে ধীরে শামিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,“কেন দিলেন? আমাকে তবে কেন পড়তে দিচ্ছেন না?”
শামির মুখ তুলে তাকায়, কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ধমকে ওঠে জান্নাতকে,“আগে চোখ নামাও, নামাও বলছি।”
জান্নাত মিইয়ে গিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ।
খুব কাছে এগোয় শামির জান্নাতুলের,“কি ব্যাপার? আবার এই টপিক কেন জান্নাতুল?”
_আপনি আজ তবে কেন ওদের বই কিনতে টাকা দিয়ে এলেন? আমাকে তো পড়তে দেন না।
শামির হঠাৎ মেজাজ হারিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,“কারণ ওদের স্বামী নেই, তোমার আছে।”
বজ্রধমকে কেঁপে ওঠে জান্নাতুল, লোকটার চোখের দৃষ্টি পরিবর্তন হচ্ছে, কঠিন হচ্ছে, এক হাতে জান্নাতকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ধরে বলে,“এবং আমি তোমার স্বামী, আমি এটাই চাই, তুমি আর পড়াশোনা না করো, এবং এটাই বাস্তবতা তোমার স্বামী আছে,সে বুঝবে তোমার সাথে কি করতে হবে। এবং জান্নাতুল দিজ ইজ লাস্ট টাইম তুমি এই টপিক তুলেছো,এরপর আর করবে না…. তুমি কি ভেবেছো? ঐ ভদ্রমহিলার থেকে ঐ মেয়েদের ব্যাপারে জানতে পেরে আমি নরম হবো? আমার গ্লানি হবে? সেল্ফ রিয়ালাইজেশন হবে? ভাববো,ইশ আমার বৌটাকে পড়াই তবে। না জান্নাতুল,শুনে রাখো এমন কিছুই হয়নি, আমি সেই শামিরই, ভিন্ন ধাতুতে গড়া আমি। এবং ঐ মেয়েদের লাইফস্টোরি শুনে এতো প্রভাবিত হবার কিছু নেই, সবার লাইফ আলাদা। ওরা তুমি না, তুমি কে? তুমি জান্নাতুল, আমার বৌ, এবং আমার থেকে এক লাইন বেশি বোঝার চেষ্টাও করবে না,গট ইট? ফল ভালো হবে না তবে। এই যে কাঁদো কাঁদো হয়ে থাকো আমি পড়তে দিইনা বলে, এটাও বেয়াদবি, এই বেয়াদবি যেন আর নজরে না পরে। কোনটায় অভাব আছে তোমার? কোনটায়? জবাব দাও!”
প্রত্যেকটা ধমকে কাঁপছে জান্নাত। জবাব দেয়না সে,মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে, শামির চেঁচাচ্ছে,“ইবাদাতের পরে, সংসার এবং স্বামী এই দুইটা জিনিস জপ করবে সারাদিন। কোনো পড়াশোনা নয়, অন্য মেয়েরা ডাক্তার হোক, জজ হোক, ব্যারিস্টার হোক। আমার বৌ শুধু আমার বৌ-ই হবে। আমার ঘর করবে,আমার বাচ্চা পালবে,বুঝলে তুমি?”
জান্নাত বুঝে গিয়েছে,যেমন করে সবসময় বুঝে যায়। আর কোনো কথা শোনায়নি শামির জান্নাতের চোখে পানি দেখে, এই একটা জিনিসই শামির একটু কেয়ার করে, জান্নাতকে কাঁদতে দেখলে স্বামী বলে মানুষটা কিঞ্চিৎ নরম হয়।
রাতে যখন জান্নাতকে কাছে টানলো শামির, সারা শরীরে ওষ্ঠছোয়া দিতে দিতে আমুদে হয়ে বৌকে বললো,“তুমি রেসপন্স করো না কেন?”
জান্নাত তখন উদাস চোখে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিলো, অন্যমনস্কতা কাটিয়ে স্বামীকে বলে,“রেসপন্স কিভাবে করে?”
জান্নাতের শরীর নিয়ে মত্ত ছিলো শামির,ঘন প্রশ্বাস ফেলে বললো,“বোঝো না?”
_না বুঝি না। আপনি বুঝিয়ে দিন। কতটুকু বুঝতে হবে? আপনার থেকে কয় লাইন কম বুঝতে হবে? খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিন, আমি নিজে নিজে বুঝতে গেলে যদি আবার আপনার থেকে বেশি বুঝে ফেলি!
শামিরের কানে সম্ভবত জান্নাতের এই ত্যাড়া কথা গুলো যায়নি, সে ব্যস্ত ছিলো তার কাজে। আর জান্নাত আকাশ দেখছিলো, চাঁদ দেখছিলো, কখনো মেঘ যাকে ঢেকে দিচ্ছে, কখনো সরে যাচ্ছে মেঘ।
চলমান…….