জায়া ও পতি পর্ব-১৭

0
215

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_১৭
#ইসরাত_ইতি

দোতলার পেছনের বারান্দায় জান্নাতের গোলাপ গাছ গুলোতে কলি ধরেছে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে সবগুলো কলিকে দেখছিল জান্নাত, ও বাড়ির বেলকোনি থেকে মেয়েলি চাপা স্বর তাকে কখন থেকে ডেকে যাচ্ছে, সেদিকে জান্নাতের হুঁশ নেই। আচানক গায়ে কাগজের দলা এসে লাগতেই জান্নাত চমকে পেছনে ফিরল, মেধা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,“কি শামির আছে বাড়িতে?”

_জি।

_কখন যাবে?

_একটু পরে।

মেধা হাসে,“গ্রেট। যে বইটা দিয়েছিলাম পড়ে শেষ করেছো?”

_জি।

_ঠিক আছে, আজ আরেকটা বই দেবো, সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন। তোমার বর অফিসে গেলেই একটা সিগন্যাল দিও। আমি যাবো তোমাদের বাড়িতে।

জান্নাত হেসে মাথা নেড়ে নিচতলায় যায়,সময় বয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শামিরের টিফিন রেডি করে সাথে দিতে হবে, কিছু টাকাও চেয়ে রাখতে হবে,এতিমখানায় দান করে দেবে।

নিচতলায় খাবার টেবিলে শামা বসেছিল গল্পের বই হাতে নিয়ে ওর পাশের চেয়ারে শামির বসে খাচ্ছিল। রান্নাঘরে রিজিয়া আর সুহানা খুব ব্যস্ত। শামির আশেপাশে তাকিয়ে জান্নাতকে ডাকছিল, রিজিয়া বাঁধা দিয়ে বলে,“কিছু লাগবে? আমাকে বল!”

_হ্যা আমি উঠব। আমার টিফিন বক্সটা গুছিয়ে দিতে হতো।

রিজিয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে শামার দিকে তাকিয়ে ধমকে ওঠে,“চেয়ার ঠেশে বসে আসিছ! যা ভাইয়ার টিফিন গুছিয়ে দে।”

_হাতে নেলপলিশ লাগিয়েছি, পারব না, ভাবী কোথায়?

_ভাবী ভাবী করিস কেন সবসময়? এক গ্লাস পানিও গড়িয়ে খেতে চাস না, দিন দিন আঁটকুড়ে রানী হচ্ছিস! এসব ঠিক না শামা!

শামির ছোটোবোনকে একপলক দেখে মাকে বলে,“আহহা! এতো কথা শোনাচ্ছো কেন? ছোটো মানুষ। ও কি এখনই একেবারে করিৎকর্মা হয়ে যাবে?”

কথাটার জবাব সুহানা তৎক্ষণাৎ দিল হাসতে হাসতে,“জান্নাতুল ওরই বয়সী ভাইয়া। অথচ সে তোমার সংসার করছে।”

একটু থেমে সুহানা আবারো বলল,“অবশ্য পুরুষ মানুষ এমনই। এরা ভাই হিসেবে একরকম,স্বামী হিসেবে একরকম। ভাই হিসেবে বোনকে বলে,“আহারে আমার বোনটা কত পিচ্চি। দুধের দাঁত পরেনি।” আর স্বামী হিসেবে বৌকে বলে,“এইটুকু বোঝো না? কচি খুকি নাকি!”

শামির ফুরফুরে মেজাজে ছিল,তাই ভাবীর সাথে তর্ক বাড়ালো না। রিজিয়া মিটিমিটি হাসছিলেন বড় বৌমার কথা শুনে। তখন রান্নাঘরে আসে জান্নাতুল, রুহী।
রুহী ঝিমুচ্ছে, গতকাল সারারাত ফোনকলে কথা বলেছে তন্ময়ের সাথে, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। শামির দিন দিন বোনকে ভালোই খেয়াল করছে,কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। রুহির বিয়ের কথা ভাবছে সে আর শারাফাত, একটা বেতাল কিছু ঘটার আগেই ওর বিয়ে দিতে হবে।
রেনু গিয়ে মাইমুনাকে ধরে ধরে ডাইনিং হলে নিয়ে আসে,আজ মাইমুনার ইচ্ছা হয়েছে টেবিলে খাবে। শামির দাদীকে দেখেই গম্ভীর কন্ঠে মজা করে বলে,“শুনলাম দাদী তুমি পীর সাহেবা হয়েছো? তোমার নাতি বৌদের দোয়া দরুদ লিখে দাও। এগুলো তুমি আবিষ্কার করো?”

মাথা নাড়ায় মাইমুনা,রিনরিনে গলায় বলে,“হ। আরো একটা দোয়া তৈয়ার করছি। বাচ্চা হবার দোয়া, এই দোয়াটা পইরা স্বামী স্ত্রী ঘুমাইয়া থাকপি, বাচ্চা এমনে এমনেই হইয়া যাইবো। রাইত জাইগা তোগো কষ্ট করা লাগবে না।”

রুহী আর শামা দাদীর কথা শুনে তৎক্ষণাৎ উঠে ড্রয়িং রুমে চলে যায়, তাদের দাদীর মুখে কোনো লাগাম নেই। রিজিয়াও শাশুড়ির কথায় হতভম্ব এবং লজ্জিত হয়ে আটামাখা হাত না ধুয়েই শারাফাতকে খাওয়ার জন্য ডাকতে চলে যায়।

শামির আশেপাশে তাকিয়ে দাদীকে বলে,“ছোটো বড় দেখে কথা বলো। তুমি খুব নষ্ট হচ্ছো দাদী।”

মাইমুনা গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলল,“ভাতার মরলে মেয়ে লোক নষ্ট হয়। আচ্ছা তুই কি একটু মোডা হইছিস?”

_বুঝতে পারছি না।
রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে শামির জবাব দেয়। জান্নাত তার দাদী শাশুড়িকে কর্নফ্লেক্স খাইয়ে দিচ্ছিল। মাইমুনা ওকে এক পলক দেখে বলে,“তোর বৌ একটু মোটা মোডা ওইছে। অবশ্য এই বাড়ির ভাত প্যাটে আর এই বাড়ির পোলাগো আদর শরিলে পরলে সব বৌরা মোডা ওইয়া যায়।”

রান্নাঘর থেকে সুহানা জবাব দেয়,“তা আমি মোটা হচ্ছি না কেন দাদী?”

_তুই তালগাছের মতো লম্বা, আর মোডো ওইয়া হরবি কি?

শামির খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায়,রুহী আবারো চলে এসে বসতেই শামিরও বসল। রুহির দিকে তাকিয়ে বলল,“রাত জাগিস কেন এত?”

_পড়ি।

_পড়িস? তাহলে রেজাল্টের এই অবস্থা কেন?

রুহী বিব্রত ভঙ্গিতে আবারো উঠে যেতে চায়, শামির ধমকে ওঠে,“বোস। কথা আছে।”

রুহী বসে। জান্নাত দুই ভাইবোনের মুখের দিকে তাকায় বারবার,আজ সকালটা রুহী আপুর বকা খাওয়ার সকাল সে বুঝে যায়।
খাবার টেবিলে তখন এসে বসে শারাফাত,রাজন। শামির বাবা আর বড় ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে অনুমতি নিয়েই কথা আগায়,রুহীকে বলে,“তোর বিয়ের কথা ভাবছি আমরা। ছেলে ডাক্তার। তানভীরের বৌ সুপ্তি ভাবী আছে না? তার ছোটোভাই।”

আঁতকে ওঠে রুহী,গলায় খাবার আটকে যায়,“মানে? কিসব বলছো ভাইয়া?”

_বিয়ের কথা বলছি তোর। থার্ড ইয়ারে উঠে গেলি। এবার বিয়ে কর।ছেলেটা ভালো, আমি আরও আগে থেকে চিনি ওকে। পরিবারের সবাই ডাক্তার। মুয়াজ। শুনিসনি নাম তানভীরের কাছে?

রুহী কাঁপছে, অসহায়ের মতো এক এক করে বাড়ির সবার মুখের দিকে তাকায়। শামির বোনকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে নিরেট ভারী স্বরে বলে,“এখন যদি বলিস রাস্তার অগা বগা ছগা কাউকে পছন্দ করিস তাহলে এমন একটা থাপ্পর মারব,এক থাপ্পরেই দিন দুনিয়া ভুলে যাবি।”

রুহী ঢোক গেলে, রিজিয়া শামিরকে বলে,“অযথা এমন কথা বলিস কেন ওকে? ও বলেছে ওর কাউকে পছন্দ?”

_এমন কিছু না হলে তো ভালোই।

শারাফাত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,“ছেলেটা ভালো, পরিবার ভালো, ভালো ছেলে আজকাল মেলানো যায়না, আমরা কথা বলছি। তোকে দেখতে আসবে দুদিন পরে।”

_দেখতে আসবে?
কান্না মিশ্রিত কন্ঠে রুহী চিল্লিয়ে উঠল। রাজন টেবিলে চাপর মেরে বলে,“চুপ! আস্তে কথা বল। এতো মেজাজ দেখানোর কিছু হয়নি। বিয়ে করবি না কেন? সমস্যা কি?”

রুহী নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,“আমার পড়াশোনা আছে না?”

_বিয়ের পর পড়বি। অসুবিধা কি!

শামিরের মুখ থেকে কথাটা শুনেই রুহী তার দিকে তাকিয়ে বলে,“আর বিয়ের পর সে যদি তোমার মতো বৌকে পড়তে না দেয়?”

ওমনি শামিরের মেজাজ বিগড়ে যায়, হাতের কাছের কাঁচের গ্লাসটা এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে খেকিয়ে ওঠে বোনের ওপর,“এক চড়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদব কোথাকার। একদম বেশি বুঝবি না আমাদের থেকে ফাজিল।”

জান্নাত কেঁপে ওঠে, রুহী কেঁদে ওঠে, খাওয়া বাদ রেখেই ছুটতে ছুটতে দোতলায় চলে যায়। শারাফাত আর রাজন শামিরের দিকে তাকিয়ে বলে,“মেজাজটা একটু কন্ট্রোলে রাখ। এভাবে চাপ দিয়ে তো হবে না!”

_চাপ কই দিলাম! তবে মুখে মুখে তর্ক করছে কিভাবে দেখলে?

জান্নাত চুপচাপ দাদী শাশুড়িকে খাইয়ে দোতলায় ওঠে,রুহি আপুর জন্য তার খারাপ লাগছে। এ যেন তারই গল্প,তাকে যেভাবে সবাই চাপ দিয়ে বিয়েতে রাজি করিয়েছিল,রুহী আপুর সাথেও এরকম হতে চলেছে।

রুহী বিছানায় শুয়ে কাঁদছে, জান্নাত গিয়ে মাথায় হাত রাখতেই রুহী ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। জান্নাত বলে,“আপু। নিচে বলাবলি করছিল,তোমায় কেউ জোর করবে না। এভাবে কেঁদো না।”

_আমি মরে যাবো ভাবী।
ফোপাতে ফোপাতে বলে জান্নাত।

_ধূর বোকা, মরে যাবে কেন?

_তুমি বুঝবে না ভাবী তুমি বুঝবে না।

হাহাকার করছে রুহী। ঠিক তখনই শামির ডেকে ওঠে জান্নাতকে। জান্নাত রুহীকে রেখে শামিরের কাছে ছুটে যায়, শামির নাক চোখ কুঁচকে বলে,“আমার টাই গুলো কোথায়? আর তুমি, আমার অফিসে যাওয়ার সময়টাতেই রোজ কোথায় ঢুকে বসে থাকো? অসহ্য তো!”

জান্নাত জবাব না দিয়ে টাই বের করে দিল, শামির টাই বাঁধছে তাড়াহুড়ো করে। জান্নাত দৃষ্টি নত করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে খুব সাহস জুগিয়ে বলে ওঠে,“একটা কথা বলি?”

_হু।

_রুহী আপুকে এভাবে বকাবকি না করে যদি ভালো করে বুঝিয়ে….

শামির ঘুরে তাকায় জান্নাতের দিকে, জান্নাত থেমে যায়, শামির বলে ওঠে,“হু। এক কাজ করবে, তুমি বোঝাবে। তোমার সাথে তো ওর ভালোই ভাব। ভালো করে দু’দিন বোঝাও কেমন? ওকে বলবে,ছেলে সুন্দর,ফর্সা এবং কমবয়সী। আমরা আমাদের বোনের জন্য যাকে তাকে ধরে আনব নাকি? অযথা ভয় পায় মেয়েটা। ওকে বুঝিও।”

_কিন্তু আপু তো বিয়েই করতে চাইছেনা।

_ওকে বুঝিও জান্নাতুল।
জান্নাতকে আর কথা বলতে না দিয়ে শামির বেড়িয়ে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়,“বালিশের নিচে টাকা রেখেছি। বাবাকে দিও এতিম খানায় দিয়ে আসবে। দুপুরে আসব না।”

_______

বাড়িতে একটি পুরুষ লোকও নেই। জান্নাত গিয়ে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেধাকে সিগন্যাল দিতেই মেধা সাতকাহন বইটা নিয়ে ছুটে আসে চৌধুরী বাড়িতে।
মেধা এসেই দোতলায় উঠলো সরাসরি, আশেপাশে তাকিয়ে বললো,“রুহী কোথায়?”

_আপু ঘরে। কাঁদছে।

_কাঁদছে কেনো?

_আব্বা আর তার ছেলেরা রুহী আপুর বিয়ে দিতে চাইছে। সেটা শুনে রুহী আপু কাঁদছে।

মেধার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় মুহুর্তেই, তন্ময় আর রুহীর প্রণয়ের কথা মেধা জানে। সে তন্ময়কে সতর্ক করেছিলো বারবার এমন একটা দিন আসবে বলে। শোনেনি তন্ময়।

_বিয়ে কি দিচ্ছেই?

_না, দেখাশোনা হবে। জোর করে বিয়ে দেবে না, আমার শ্বশুর তো বললেন।

_ওহ।

মেধা বসল দোতলার বারান্দায়,আজ বাড়িতে গিয়েই তন্ময়ের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে হবে। বাড়ির কেউ এই সম্পর্ক মানবে না এটা তো নিশ্চিত। ভাইয়ের দুঃসময়ে তাকেই পাশে থাকতে হবে।

জান্নাত চা বানিয়ে দিল মেধাকে, চা খেতে খেতে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলো দু’জনে। মেধা উৎসুক হয়ে জান্নাতের কাছে জানতে চায় হানিমুনের গল্প। জান্নাত বলে সবকিছু। কিছু সময় পরে মেধা নরম গলায় প্রশ্ন করে ওঠে,

_খুব ভালো আছো জান্নাত?

জান্নাত নিশ্চুপ হাসে। মেধা খুলেই বলে,“শামির একটু অন্যরকম,সবাই জানে। তবে ভালো দিকও আছে তার। মানুষ মাত্রই এমন জান্নাত, একেবারে নিখুঁত কাউকে পাবে না তুমি। ফিফটি ফিফটি,ভালো খারাপের মিশেল। দেখার বিষয় তোমাকে মানুষটার ভালো গুণ গুলো দাম্পত্য বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে নাকি খারাপ গুণগুলো তোমার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটায়। আমার বেলায় অবশ্য খারাপ জিতে গিয়েছিল। তারপর সংসার ভাঙলাম।”

জান্নাত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেধার দিকে, বলে,“তোমার স্বামী খারাপ ছিলো খুব?”

_এই না না, খুব খারাপ না। ঐ যে বললাম,ভালো খারাপের মিশেল। ভালো তো ছিলোই, মাঝে মাঝে রেগে গেলে চড় মারতো এই যা।

জান্নাত দেখছে চেয়ে চেয়ে,মেধা হেসে ফেলে,“দেখলে। কিসব বলতে শুরু করেছি। সবাই ঠিকই বলে,আমার আসলে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো দরকার। আচ্ছা আমি উঠলাম, তোমাদের বাড়ির পুরুষরা চলে এলে আবার হুলুস্থুল ঘটে যাবে!”

এদিকে তন্ময় লাগাতার রুহীকে কল দিচ্ছে, রুহী কল ধরছে না। মেজাজ তুঙ্গে তন্ময়ের। এই অলস মেয়েটা নিশ্চয়ই দিনের বেলায় পরে পরে ঘুমায় ভার্সিটি না গিয়ে,ভাবল সে।

রুহীর বেলায় অসীম ধৈর্য্য তন্ময়ের। তন্ময় কল দিতেই থাকল সে, ঠিক দুপুর দুটোয় রুহী কল ধরল, কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে ফেলেছে‌। উদ্বিগ্ন তন্ময় বলল,“কাদছো কেনো?”

রুহী ফোপাতে ফোপাতে সব বলল। ওপাশে তন্ময়ের মাথায় হাত। কিছু বলছে না সে ,রুহীই কাঁদতে কাঁদতে চেঁচায়,“প্লিজ তুমি কিছু করো।”

______

মাগরীবের আজানের সময় হয়ে এসেছে, শামির বিকেলেই ফিরেছে, আপাতত ঘরে কিছু কাগজপত্র দেখছিল। জান্নাত তার দাদী শাশুড়ির ঘরে , দাদী শাশুড়িকে ওযু করিয়ে দিয়ে নিজে নামাজে দাড়াবে।

মাইমুনা আজ বিকেল থেকে অযথা হাসছেন, ইদানিং বৃদ্ধা অস্বাভাবিক আচরণ করে ভীষণ, কখনো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় অযথাই, কখনো কাঁদতে কাঁদতে শ্বাস উঠিয়ে ফেলে। হাসির তোড়ে এখন ওযুতে মন দিতে পারছে না মাইমুনা। জান্নাত বলল,

_দাদী আপনি এতো হাসবেন না। ওযু টা করে নিন।

_ওই মাগী,আমি হাসলে তোর কি? তোর জ্বলে নাকি? মোর লগে শত্রুতামি করোছ মাগী!

_দাদী এখন গালাগাল করবেন না, আল্লাহ পাপ দেবে। আপনি ওযু করেন।

মাইমুনা হাসছে তো হাসছেই,হাসতে হাসতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে,“তুই আমার শত্রু। যেইদিন হইতে এই বাড়িতে আইছো মোর নাতী মোরে জিগায়ও না।

জান্নাত বলে,“আচ্ছা আচ্ছা। আমি ওনাকে বলব যাতে আপনাকে জিগায়। এখন ওযু করেন।”

মাইমুনা বকবক করতেই থাকে,“একটা মহিলার সবচেয়ে বড় শত্রু কে হয় জানিস?”

_কে?

_আরেকটা মহিলা। আর পুরুষের সবথেকে বড় শত্রু কে জানিস?

_কে?

_হ্যার নিজের নুনু।

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পরে মাইমুনা। হতভম্ব জান্নাত। বুড়ির আজেবাজে কথা শুনে জান্নাতের মাথা ঝিমঝিম করছে। মাইমুনা আবারো হাসি থামিয়ে বিজ্ঞের ন্যায় বলতে থাকে,“এই পৃথিবীতে অর্ধেক আকাম কুমাম হয় ঐ নুনুর কারনে। পুরুষ মানুষ যায়গায় যায়গায় ধরা খায় ঐ নুনুর কারনে। নুনুডারে সামলাইতে পারে না তাই।”

আবারো খিকখিক করে হাসছে মাইমুনা,হাসির শব্দ ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছে। জান্নাত কোনোমতে দাদী শাশুড়িকে ওযু করিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে যায় ও ঘর থেকে, এ ঘরে আজ নামাজ আদায় করবে না সে, বুড়ির আজেবাজে কথা শুনে নয়তো বারবার ওযু ভেঙে যাবে তার।

ঘরে ঢুকতেই শামির তাড়া দেয়,“নামাজ শেষ করে রুহীকে ডেকে নিয়ে এসো তো জান্নাতুল।”

রুহী ঘরে ছিলো না,সে ছাদে,মাথা নিচু করে মেঝেতে বসে আছে মেয়েটা। ছাদের দরজা বন্ধ। তার সামনেই হাঁটু ভেঙে বসে আছে তন্ময়। দু’হাতে চুল খামচে ধরে মুখটা বিকৃত করে বলে,“শাআলা এই মুয়াইজ্যা ফুয়াইজ্যা কোত্থেকে টপকালো আবার!”

_নাম ভেঙচিও না।

বিরক্তির সুর রুহীর কন্ঠে। তন্ময়ের চোখ বড় বড় হয়, রাগ উঠে যায় নিমিষেই,রুহীর থুতনি ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে,

_ওরে! ভাইয়ের আনা পাত্রের নামের জন্য খুব দরদ দেখছি! ভেঙচাবো! একশো বার ভেঙচাবো! এই শোনো, মুয়াজ ফুয়াজ বুয়াজ গুয়াজ শুয়াজ দুয়াজ পুয়াজ লুয়াজ কুয়াজ…..

রুহী বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে। তন্ময় থেমে বলে,“দুটো দিন সময় দে।”

_তারপর?

_চাকরির কনফারমেশন লেটার হাতে নিয়েই আব্বু আর ভাইয়াদের জানাব। মানলে মানবে নয়তো নিজের পথ দেখব।

_এই গেল তোমার পরিবার,আর আমার?

_মানলে মানবে নয়তো পালাবি আমার সাথে।

_আমি পারব না।

_কেন? তোর পরিবার তোর সাথে জল্লাদের মতো আচরণ করতে পারলে তুই পারবি না কেন পালাতে।

_সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে তন্ময়।

_আর আমি তোকে ভালোবাসি না?

রুহী চুপ হয়ে যায়, কাঁদছে সে। তন্ময় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,“আরে বোকা এটা তো প্লান বি। প্লান এ আগে এপ্লাই করবো না? চাপ নিসনা।”

নামাজ পড়ে জান্নাত রুহিকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ছাদের দরজায় কড়া নাড়লো ।

“রুহি আপু ছাদে?”

_হ্যা ভাবী! কি হয়েছে?

_তোমার ভাইয়া ডাকছিল।

অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল রুহীর,ঘুরে তন্ময়ের দিকে তাকায়। তন্ময় ফিসফিসিয়ে বলল,“চোখ মুছে যাও,কি বলে আমাকে জানিও। আমি গেলাম।”

জান্নাতের পিছু পিছু তখন শামিরও উঠে আসে ছাদের দরজার কাছে,দরজায় টোকা দিয়ে বলে,“রুহী দরজা খোল, ভর সন্ধ্যায় ছাদে কি কাজ তোর?”

তন্ময় পাইপ বেয়ে সাবধানে নামছে,ও বাউন্ডারির বাইরে না যাওয়া অবধি রুহী দরজা খুলবে না,এদিকে তার ভয় করছে শামির যদি কিছু সন্দেহ করে?

শামিরের কিঞ্চিত সন্দেহ জাগে,জান্নাতকে বলে,“রুহীর ঘরে যাও, আমি রুহীকে নিয়ে আসছি। এই রুহী, দরজা খোল!”

জান্নাত রুহীর ঘরে গিয়ে দেখল জানালা সব খুলে রাখা, বাইরে থেকে মশা ঢুকছিল প্রচুর। জান্নাত যখন জানালার কাঁচ টানছিল, তখনই জান্নাতের চোখে পরে আধো অন্ধকারে এক ছায়ামূর্তি কাঁটাতার পেড়িয়ে হাওলাদার বাড়ির বাউন্ডারিতে ঢুকল। জান্নাতের মস্তিষ্ক দ্রুত ঘটনাটি বুঝে ফেলে। তৎক্ষণাৎ মোচড় দিয়ে ওঠে বুক, রুহী আপু তবে সম্পর্ক করছে কারো সাথে? সে হাওলাদার বাড়ির কেউ? কে হতে পারে? তন্ময় ভাইয়া?

সেই রাতে জান্নাতুল সারাক্ষণ মনের মধ্যে খচখচানি নিয়ে থেকেছে,সে চেয়েছিলো রুহীর সাথে একটু কথা বলতে, সামনে যে এ বাড়িতে বিরাট ঝামেলা লাগবে তা জান্নাত বুঝতে পারছে। সে রুহী আপুকে বোঝাতে চায়।
রুহীর সাথে কথা বলতে পারেনি জান্নাত, শামির বোনকে তিন ঘন্টা ধরে বিয়ের জন্য বুঝিয়েছে। রুহী কান্না চেপে রেখে চুপচাপ শুনেছেন সেসব। ভেতরটা তার ছটফট করছিল।

খেয়ে দেয়ে রাত এগারোটায় শামির ঘরে এসেই একটা সুন্দর দৃশ্য দেখতে পায় আজ, টকটকে কাঁচা হলুদ রঙের সোনালী পাড়ের একটা টাঙ্গাইল শাড়ি পরে জান্নাত বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে, তার মাথার কাছে একটা বই, বইটা সম্ভবত পড়তে পড়তে ঘুমিয়েছে। শামির দেখছে,যেন কোন ইন্দ্রানী শুয়ে আছে তার বিছানায়। এগিয়ে যায় শামির চিন্তিত ভঙ্গিতে, একটা মেয়ে এত সুন্দর হতে যাবে কেন তার বুঝে কুলোয় না। একেবারে মাখনের মতো নরম,ফকফকে।
বিছানায় উঠেই বইটা নজরে পরে শামিরের, সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন। বইটা বোধ হয় রুহীর। শামির বইটা মাথার কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে রাখতে বিড়বিড় করে বলে,“সাতকাহন পড়ে দীপাবলি হওয়ার শখ হয়েছে নাকি?”

কারো হাতের গভীর স্পর্শ পেতেই ঘুমের মধ্যে লাফিয়ে ওঠে জান্নাত, এটা যে তার স্বামী মশাই তা বুঝে নেয় অতি দ্রুত, আতঙ্কে জমে গিয়ে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলে ওঠে,“আজ না,আজ না, আজ না।”

থামল শামির,অবাক হয়ে কিছুপল তাকিয়ে থেকে বলে,“কি আজ না? ঠিক হয়ে শোও। ধনুকের মতো বেঁকে আছো। ঠিক করে শুইয়ে দিচ্ছিলাম আমি।”

জান্নাত সামলে নেয় নিজেকে,শুয়ে পরে এক সাইড হয়ে চুপচাপ, শামিরও শোয়,তার দাম্ভিক পুরুষ মস্তিষ্ক ঘটনাটি ধরতে পারল না , ঐ মস্তিস্ক বুঝতে পারল না যে সে ঠিক কি পরিমাণ আতঙ্ক দিয়ে রেখেছে তার বৌকে।

চলমান……