জায়া ও পতি পর্ব-১৯

0
4

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_১৯
#ইসরাত_ইতি

দিন গড়িয়েছে দু’দিন। রুহীকে কড়া পাহারা দিচ্ছে বাড়ির সবাই,শারাফাতের নির্দেশে। পাচ মিনিটের জন্য নজরের বাইরে যেতে দেয়না কেউ। রুহীর কাছে একটা গোপন বাটন ফোন ছিলো, ওয়াশ রুমে ঢুকে কল ছেড়ে দিয়ে তন্ময়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে পেরেছে তাই। শারাফাত চৌধুরী তার বড় দুই ছেলেকে নিয়ে বসে মিটিং করে ঠিক করেছে রুহীকে আংটি পরিয়ে যাওয়ার পরপরই আকদ টা সেরে ফেলবে। পাত্রপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, আগামীকাল এসে আংটি পরিয়ে যাবে।
রুহী এর মাঝে বহুবার এর কাছে,ওর কাছে গিয়ে ধর্না দিয়েছে বিয়েটা করবে না তাই, কেউ ভ্রুক্ষেপ করেনি, একমাত্র জান্নাত এবং সুহানা ব্যতীত। কিন্তু তাদেরই বা কি করার আছে? রুহীর বাবা মা আর ভাইদের ডিঙিয়ে তারা সিদ্ধান্ত দেবার কে?

আগামীকাল আংটি পড়াতে আসবে শুনেই রুহীর প্রাণ বেড়িয়ে যায়, কলঘরে ঢুকে তন্ময়কে কল করে সে কি কান্না! তন্ময় চাকরিটা পেয়েছে, তবে তার মাথায় ঢুকছে না এখন কি করবে সে? রুহী কান্নায় ভেঙে পরে বললো,“আমি শিয়র আংটি পড়িয়েই বিয়ে দিয়ে দেবে আমার।”

এবার ঘাবড়ে যায় তন্ময়ও,“এমন কেনো বলছো?”

_মেজো ভাইয়া কে আড়াল থেকে কাজীর নাম্বার কালেক্ট করতে দেখেছি। যদি এই পরিকল্পনা নাই থাকে তবে এখনই কাজীর নাম্বার দিয়ে কি? বলো?

চুপ করে রয় তন্ময়,রুহী হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,“এই তুই কিছু বলছিস না কেন তন্ময়ের বাচ্চা? এখন তোর হিরোগিরি কোথায় গেলো?”

দু’চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নেয় তন্ময়। রুহী বলতে থাকে,“আমার ভাইদের ধ’ম’ক খেয়ে তোর ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলো? বলেছিলি তো পালানো লাগবে না,সবার সামনেই বিয়ে করবি তুই।”

রাগ উঠলো তন্ময়ের, চেঁচিয়ে উঠলো,“এক চ’ড় মারবো। আমাকে জাজ করিস তুই? আর তুই? আমাকে যখন তোর ভাইয়েরা ধাক্কাচ্ছিলো তখন তো সিঁড়ির কাছে জান্নাতুল ভাবীর আঁচলের নিচে লুকিয়ে ছিলি, সাহস করে এসে সবার সামনে হাতটা ধরলি না তো। তো আমি তোকে তুলে আনতাম? সব ঠ্যাকা আমার?”

রুহী ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে, ওয়াশ রুমের দরজার ওপাশ থেকে জান্নাতুল ধাক্কা দিচ্ছে। সে এসেছিল রুহীকে নিয়ে শামিরের কাছে যেতে, শামির ডেকে পাঠিয়েছিলো। জান্নাত বুঝতে পারে রুহী ওয়াশ রুমে ঢুকে কারো সাথে কথা বলছে, শামির যদি চলে আসে তাহলে সর্বনাশ,তাই তাড়া দিচ্ছিল রুহীকে।

তন্ময় নিজেকে সামলায়,রুহীকে শান্ত করে বলে,“এই লক্ষিটি কাঁদে না।”

_আমি কি করবো তন্ময়? আমি ওদের সাথে পেরে উঠবো না।

ঘন ঘন শ্বাস ফেলে তন্ময়,“চল তবে পালাই?”

_মানে?

_মানে আর অপশন নেই, বিয়ে করে নিলে মেনে নেবে দুই গ্রুপ। চল পালাই। অসীমকে কল করে বলছি কাজী রেডি রাখতে, তুই ফটাফট আইডি কার্ড নিয়ে বের হ,পারলে শারাফাত চাচার আইডি কার্ডের ফটোকপিও আনিস।

রুহী আপত্তি তুলছে বারবার,তার সাহস নেই এমন কিছু করার। তন্ময় রেগে গিয়ে বলে,“বেশ তবে বিয়ে করে নে ডাক্তারকে,তোরা মেয়েরা হচ্ছিস মেরুদন্ডহীন, একটু সাহস দেখাতে পারিস না, আর বিয়ের পর তো বরের আদর খেয়ে টেয়ে ভুলেই যাবি তন্ময় নামের আদৌও কেউ ছিলো জীবনে। এই ভীতুর ডিম,লজ্জা করবে না আমাকে উপেক্ষা করে অন্য পুরুষের বাসরে ঢুকতে? যাস্ট বিকজ অব ফ্যামিলি। লজ্জা করবে না তোর?”

রুহীর বুকটা হুহু করে ওঠে, তন্ময় নরম হয়, আকুতি নিয়ে বলে,“প্লিজ রুহি! আমার জান! একটু সাহস কর! দেখ তোর বাবা ভাইকে চিনিস তো নাকি? এ ছাড়া আদৌও উপায় আছে তোর মনে হয়?”

ফুঁপিয়ে নেয় কিছুক্ষণ রুহী, চোখের পানি মুছে নেয় আলগোছে, কাঁপাস্বরে বলে,“কি করতে হবে?”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তন্ময়, উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে,“তুই এক কাপড়ে আইডি কার্ড নিয়ে বাড়ি থেকে বের হ।”

_কি করে? পাহারা দিতে আজ মেজো ভাইয়া বাড়িতে যে!

_সম্বন্ধির ব্যাটাকে গুমরাহা কর। এখন সব প্ল্যান আমি করে দেবো গাধী? নিজে কিছু কর। আমি মোড়ের মাথায় বাইক নিয়ে আছি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই জান।

কল কেটে রুহী ঝটপট মুখে পানি দিয়ে ফোন লুকিয়ে বাইরে এসেই দেখলো সুহানা আর জান্নাত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। রুহী ঢোক গিলছে, সুহানা হতভম্ব হয়ে বলে,“তন্ময়ের সাথে কথা বলছিলে?”

রুহী ছুটে গিয়ে বড় ভাবীকে জড়িয়ে ধরলো,“ভাবী। ভাবী ওকে আমার লাগবে।”

_এখন এসব বলো না রুহী। বাদ দাও ওকে।

রুহী দুই ভাবীর পা জড়িয়ে ধরে, জান্নাত লাফিয়ে তিন কদম দূরে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,“করছো কি? পাগল তুমি আপু?”

_আমি পালাবো ভাবি। তোমরা কিছু করো!

হতভম্ব সুহানা এবং জান্নাত, চোখ বড় বড় করে রুহীর দিকে তাকিয়ে আছে। এর মাঝে শামা লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকে বড় ভাবীকে বলে,“ও বড় ভাবী। রুহী আপুকে তো কালই বিয়ে দেবে, পাত্রের দাদুর শ্বাস টান উঠেছে,এখন যায় তখন যায় অবস্থা, অ্যাপোলোতে ভর্তি আছে। আচ্ছা শপিং টপিং হবে না না কি?”

সাথে সাথে এক বিকট চ’ড় পরে শামার গালে, শামা আঁতকে উঠে রুহীর দিকে তাকায়,রুহী চেঁচিয়ে ওঠে,“আমি মরবো না বাঁচবো সে নিয়ে টানাটানি আর ও এসেছে ওর শপিং নিয়ে,ভাগ এখান থেকে বেয়াদব।”

শামা চ’ড় খেয়ে গাল ডলতে ডলতে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। জান্নাত গিয়ে দরজা আটকে দেয়, সুহানা রুহীকে ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে,“ক্ষেপেছো? পালাবে? কিসব বলছো?”

_পালাবো আমি, এবং তোমাদের সাহায্য দরকার।

জান্নাত ঘামছে, সুহানা রেগে যায়,“অসম্ভব। এমন অহেতুক কথা বলো না। আমি পারবো না। এ বাড়ির মানসম্মান জড়িয়ে আছে রুহী।”

সুহানা বেড়িয়ে যায়,সে এসবে নেই। রুহীর অসহায় দৃষ্টি জান্নাতের চোখে আটকাতেই জান্নাত ঢোক গেলে,রুহী গিয়ে মেজো ভাবীকে জরিয়ে ধরে,“ভাবী তুমি প্লিজ কিছু করো । প্লিজ আমার লক্ষি মেজো ভাবি। তুমি না আমায় ভালোবাসো?”

_এসব কি বলছো তুমি রুহী আপু? এ হয়না। আব্বা আম্মা কষ্ট পাবে জানো?

রুহী দম ফেলে,কিছু মুহূর্ত ভেবে সে বুঝে যায়,এভাবে হবে না। তাকে অন্য পথ বের করতে হবে। জান্নাত এগিয়ে যায়,রুহীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,“আমি আব্বাকে ধরবো আজ। হাতে ধরে তাকে বোঝাবো। একটু ধৈর্য্য ধরো।”

শ্বাস ফেলল রুহী দু’চোখ বুজে,বলল,“ঠিক আছে তবে একটা কাজ করতে পারবে?”

_কি কাজ?

_ওর সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলে আসি! তুমি ভাইয়াকে আধাঘণ্টার জন্য আটকে রাখতে পারবে না?

_কোথায় কথা বলবে?

_বাউন্ডারির বাইরে অপরাজিতা বাগানের ওখানে, ও ছটফট করছে। ওকে একটু বুঝ দিয়ে আসি? যাবো আর আসবো।

বোকা জান্নাত কাঁপছে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,“তোমার মেজো ভাইয়া জানতে পারলে কি হবে জানো?”

_সেজন্যই তো তুমি কিছু করবে!

_আমি কি করবো?

_ভাইয়াকে কিছুক্ষণের জন্য আটকে রাখো,আমি ঘর থেকে বেড়োবো।

_মানে?

_মানে কিছু একটা করে আটকে রাখো ভাইয়াকে।

_তোমার ভাইয়া আমাকে মেরে ফেলবে আপু।

_ভাইয়া কখনোই তোমাকে মেরে ফেলবে না, ভাইয়া কি করে বুঝবে তুমি আমাকে সাহায্য করেছো? ভাবী,আমি মরে যাবো প্লিজ সাহায্য করো!

_এমন কথা বলো না আপু।

_তাহলে যা বলছি তাই করো,আটকে রাখো ভুলিয়ে ভালিয়ে আধাঘণ্টা। আমার জন্য এটুকু যদি না পারো তাহলে করতে হবে না, তবে তোমার স্বামীকে গিয়ে বলে দাও আমি ঘুমের ওষুধ খাবো‌।

রুহী নিজের সিদ্ধান্তে অটল। জান্নাতের বুকটা ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে। সে কি করে ঐ লোককে ভুলিয়ে রাখবে? ঐ শামির চৌধুরীকে। ঐ লোককে ভুলিয়ে রাখা জান্নাতের সাধ্যি? পাঠিয়েছিলো রুহীকে ডাকতে, এক্ষুনি ঘর থেকে বেরিয়ে হাকডাক শুরু করে দেবে হয়তো।

ধীরপায়ে জান্নাত এগিয়ে যায়। ঠিক তাই, শামির বেরুচ্ছিলো,জান্নাতকে দেখে বললো,“এতক্ষন লাগে ওকে আনতে? ও কই?”

_ঘুমাচ্ছে।

_ঘুমাচ্ছে মানে? এই ভরসন্ধ্যায়?

_হু, কাঁদছিল তো,আমি বুঝিয়ে মাথায় তেল লাগিয়ে চুল বেঁধে দিয়ে এলাম। যাবেন না প্লিজ বিরক্ত করতে এখন। আধাঘণ্টা পরে ওঠাই?

কথাগুলো বলতে বলতে জান্নাতের বারবার আটকাচ্ছিলো। শামির গিয়ে বিছানায় বসলো, ছটফটে ভাব শামিরের আচরণে। বোনের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো খুব। জান্নাত দুবার ফাঁকা ঢোক গিলে একটা কাজ করলো, লাগিয়ে দিলো দরজাটা।

শামির চোখ তুলে একবার দেখে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে অফিসের কারো সাথে কথা বলছিল, জান্নাত গিয়ে চুপচাপ শামিরের পাশে বসলো, শামির ফোন রেখে কিঞ্চিত অবাক হয়ে জান্নাতকে আগলে নিয়ে ওকে দেখলো,নরম গলায় বলল,“তোমার শরীর ঠিক আছে? মনে হচ্ছে অসুস্থ।”

_জি না।
অস্ফুটে বলে মেয়েটা।

_তো?

জান্নাত ধীরে ধীরে নিজের দুই হাত দিয়ে আগলে ধরলো শামিরের গলা, নিচু স্বরে বলল,“আপনি রেগে আছেন আমার ওপর কোনো কারণে?”

স্মিত হাসে শামির,দু’পাশে মাথা ঝাঁকায়,বৌকে গালে চুমু খেয়ে বলে,“তুমি রেগে থাকার মতো বৌ নও আমার লক্ষিটি।”

আচমকা পেলব দুই হাতে জরিয়ে ধরলো শামিরকে জান্নাত। নৈকট্য বৃদ্ধি পেতেই জান্নাতের উষ্ণতায় মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো শামিরের। জান্নাত আড়ষ্টতা ভেঙে আজ গালে চুমু খায় শামিরের। ভীষণ অবাক শামির,এভাবে জান্নাত কখনো আদর করেনা তাকে।
ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা তখন, শামির ঘড়ি দেখে জান্নাতকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলো। সন্ধ্যা বেলায় এসবের মুড নেই তার, তাছাড়া রুহীর খোজ নিতে হবে, অসময়ে ঘুমানো কোনো ভালো লক্ষণ না।

শামির উঠে যাবে বুঝতে পেরেই জান্নাত এক কাজ করে বসলো,কোলে চেপে বসে গলা জড়িয়ে ধরে থাকলো। শামির বৌকে এভাবে পেয়ে খুশিই, বৌটা তার বড় আদরের, অনেক
আদুরে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শামির বললো,“সেদিন রাতে বকেছিলাম,মন খারাপ এখনো?”

দু’পাশে মাথা নাড়ে জান্নাত, শামির নিচুস্বরেই বলতে থাকে,“আমার কথা শোনো না কেন? তাহলে বকি?”

জান্নাতের নরম ছোটো তুলতুলে ডানহাত টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলা করতে করতে বললো শামির কথাটা। জান্নাত জবাব দেয়না, তাকে আরো কিছুক্ষণ আটকে রাখতেই হবে শামিরকে। বৌয়ের উষ্ণ শ্বাস গলার কাছে আছড়ে পরছে, পৌরুষ নারীর কমনীয়তার ছলনায় হার মেনেছে। মৃদু শ্বাস ফেলল শামির। হঠাৎ নিজের খেই হারিয়ে ওকে শুইয়ে দিয়ে চড়াও হলো ওর ওপর। তার মাথায় আর অন্য কিছু নেই,সে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে শুধু দেখতে পাচ্ছে তার অধিকারে ঠাশা নারীকে,যে আজ নিজে থেকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তাকে।
ওকে চুমু খেতে গিয়ে আজ শামির বেশ অবাক হলো, আজ শুধু সহাস্যে সায়-ই নয় বরং জান্নাত বেশ উৎসাহী। এতটা সাহসী জান্নাত নয়। আচরণ গত দিক থেকে জান্নাত প্রচণ্ড লাজুক এবং ঘনিষ্ঠতায় সবসময় অনীহা থাকে জান্নাতের, শামির সবসময় টের পায়, মরা মাছের মতো পরে থাকা মেয়েটা আজ লাজের খোলস থেকে বেরিয়ে এভাবে শামিরকে আস্কারা দিচ্ছে দেখে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। শামির একবার চাইলো জিজ্ঞেস করতে জান্নাত এতো অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেন? পরপর নিজেকে নিজেই বাধা দিলো,যদি লজ্জা পেয়ে যায়! তাহলে এই সুন্দর সন্ধ্যাটা নষ্ট হবে।
ভালোবাসা বাসিতে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলো দীর্ঘসময় দুজন, একে অপরকে জরিয়ে ধরে শুয়ে ছিলো দীর্ঘসময়। শামির চোখ বুজে ছিলো। হঠাৎ চোখ মেলে তাকিয়ে তৎপর হয় শামির। রুহীর সাথে কথা বলতে হবে তার।

জান্নাত শামিরকে উঠতে দেখে আবারো বাধা দিলো,“উঠছেন?”

অবাকের পরে অবাক হচ্ছে শামির। আজ এই মেয়ের কি হলো? বৌয়ের কপালে একটা সন্তুষ্টির চুমু খেয়ে উঠে বসেই বলে,“হু,তুমিও ওঠো। রুহীকে ডেকে আনো।”

ঠিক সেসময়েই বাড়িতে রিজিয়ার চেঁচামেচি শোনা যায়, জান্নাতের বুক কাঁপছে,কেউ কি কিছু টের পেয়েছে? রুহী আপু কি ধরা খেয়েছে? পরপর দরজায় ধাক্কা পরে,শামার গলা,“মেজো ভাইয়া! আপু বাড়িতে নেই!”

_______

তন্ময়ের মাথা বনবন করছে, হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে,সে সত্যিই রুহীকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে?
মোড়ের মাথায় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়,ঘড়ি ধরা ঠিক সময় সাড়ে আটটায় রুহীর এখানে আসার কথা। রুহী সময়ের পাক্কা একেবারে। ঠিক সাড়ে আটটা নাগাদ, সোডিয়াম আলোতে তন্ময় দেখলো তার প্রেয়সী ছুটতে ছুটতে আসছে,হাতে শুধুমাত্র একটা পার্সব্যাগ। পরনে সালোয়ার কামিজ,আর কিছুই নেই,এভাবেই চলে এসেছে প্রেমিকের হাত ধরে পালাতে।

তন্ময় ভীষণ আবেগী হয়ে পরে। এই মেয়েটাকে ভালো রাখতে পারবে তো সে? পারবে তো?..

রুহী এসে তন্ময়ের বাইকের সামনে দাঁড়ায়। চোখ ভেজা তার। তন্ময় দেখে সেই ছোট রুহী এসেছে। ছোটো বেলা থেকে একইসাথে বড় হয়েছে দুজন, চৌধুরী আর হাওলাদার বাড়ির ছেলে-মেয়েরা একসাথে খেলতো। তন্ময় ভাইয়া,তন্ময় ভাইয়া বলে মাথা খারাপ করে দিতো মেয়েটা। বড়রা হাসাহাসি করে বলতো তন্ময় আর রুহীর বিয়ে দেবো। মজা করে এমনটা বললেও বড়রা চাইতেন এমনটা হোক,এতে দুই বাড়ির বন্ধন পোক্ত হবে। তন্ময় বড়দের করা ঐ মজাটাকেই আঁকড়ে ধরে ধীরে ধীরে অনুভূতি জড়ো করে ফেলেছিল, আজ সে এই রুহীকে সত্যিই বিয়ে করবে,অথচ বড়দের কষ্ট দিয়ে। বড়দের কষ্ট দিয়ে তারা সুখী হবে?

আস্তে করে তন্ময় বললো,“বাইকে ওঠো।”

রুহী বাইকে উঠলো,তন্ময় বললো,“ভয় করছে?”

_হু!

_আমারো করছে।

_তাহলে ফিরে যাবো?

হাসলো তন্ময়,বাইক স্টার্ট করে বললো,“সে সুযোগ নেই। তোকে আমার লাগবে।”

______

রুহী বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। মুহুর্তেই হাহাকার লেগে গেলো কমলা রঙের রোদে। রিজিয়া বুক চাপড়ে কাঁদছে মেয়ের বোকামি দেখে। সুহানা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, সে কেন সতর্ক করলো না রাজনকে! রুহী যে এতো কম সময়ের মধ্যে এমন একটা কাজ করে ফেলবে সে বুঝেই উঠতে পারেনি।
বাইরে মায়ের চিৎকার। বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে শামির আবারো বললো,“কি হয়েছে শামা?”

_ভাইয়া আপু বাড়িতে নেই।

জান্নাত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে নিজেকে আঁচলে জড়িয়ে,শামির কথাটা শুনেই হতভম্ব হয়ে জান্নাতের মুখের দিকে তাকায়। জান্নাত দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। সে নিজেই হতভম্ব এবং তার শরীর কাঁপছে। শামির কিছু পল জান্নাতকে দেখে পোশাক নিয়ে চুপচাপ ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়, শাওয়ারের পানিতে ভিজতে ভিজতে ক্রমশ শামিরের মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে।
ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে শামির ভেজা চুল না মুছেই হন্তদন্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। জান্নাত মাথা নিচু করে মুর্তির মতো দাঁড়িয়েই থাকে।

রুহী ঘরে নেই এটা প্রথম আবিষ্কার করে সুহানা, রিজিয়া মাইমুনার ঘরে ছিলো তখন। শামির নিচতলায় নামার সাথে সাথে রিজিয়া ছুটে আসে,“ও বাবা,তোর বাপকে কি করে সামাল দেবো আমি।”

শামির ফোনে কারো নাম্বার ডায়াল করতে করতে ভীষণ শান্ত স্বরে জবাব দেয়,“গেলে ওদের দৌড় কাজি অফিসে, চিন্তা করো না, খুজে আনবো।”

এক এক করে সমস্ত যায়গায় কল করতে থাকে শামির, পরিচিত বন্ধু বান্ধব থেকে শুরু করে, বরিশালের নেতা শ্রেণীর লোকজন যারা শামিরের বন্ধু তাদের সকলকে। শহর চষে বেড় করবে রুহিকে।

অফিস থেকে ছুটে এসেছে রাজন, শারাফাত। চেঁচামেচি কেউই করছে না। যতক্ষন সম্ভব বিষয়টাকে চেপে রাখতে হবে, পাড়াপড়শিরা টের পাবে নয়তো।

বুকে হাত বেঁধে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে শামির। রাজন শার্টের হাতা গোটাচ্ছে,“চল তন্ময়ের বন্ধুদের বাড়িতে ছানবিন করি,আমি কয়েকটাকে চিনি।”

শামির ভাইকে বলে,“তুমি দাঁড়াও। আমি আসছি একটু।”

বলেই সে দোতলায় ওঠে, জান্নাত গোসল সেরে ভেজা চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মলিন মুখে, তার সমস্ত শরীর কাঁপছে, একটু আগে সে কি করেছে? রুহী আপুকে ভাগতে সাহায্য করেছে? রুহী আপু ভেগেই গেলো তাকে মিথ্যা বলে? তার সময়গুলো কেমন ঘোরের মতো কাটছে।
বাইরে পদধ্বনি শোনা যায়,জান্নাত চোখ তুলে দেখলো শামির ঘরে ঢুকছে।
ভয়ে জড়সড় হয়েও জান্নাত নিজেকে সামলে নিলো, কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে এগিয়ে এলো সামনে,“খবর পেলেন রুহী আপুর?”

একটা প্রকাণ্ড চ’ড় সে মুহূর্তে তার গাল ছুঁয়ে যায়, ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল জান্নাত,চড়ের ধাক্কা সামলাতে বেগ পেতে হয় তাকে। এমন চ’ড় ইহজীবনে তাকে কেউ দেয়নি। মুহুর্তেই মাথাটা দুলে ওঠে,ডান গালটা টনটন করছে, যন্ত্রণায় কাতর জান্নাত গালে হাত চেপে ঘাড় ঘুরিয়ে শামিরের দিকে তাকায়,শামির ক্ষোভে ফেটে পরছিলো, চেঁচিয়ে উঠলো সে,“ছলনা করতে শিখেছিস আমার সাথে?”

চলমান…..