জায়া ও পতি পর্ব-২০

0
202

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_২০
#ইসরাত_ইতি

বাইকে উঠে রুহী নিশ্চুপ কাঁদছে। তন্ময় বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,“আরে এখন থেকেই শুরু করে দিলি? কান্নাকাটি অনেক করতে হবে দুই পরিবারের জন্য, এখন একটু বিশ্রাম নে, চোখের পানি বাঁচিয়ে রাখ।”

রুহী হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,“খুব বড় একটা অন্যায় করেছি তন্ময়!”

_কি করেছিস?

রুহী ঘটনা খুলে বলতেই তন্ময় হুট করে বাইক থামায়। ঘুরে অবিশ্বাস্য নজরে রুহীকে দেখে বলে,“তাই বলে তুই এমন করবি?”

_অন্য কোনো উপায় যে ছিলো না তন্ময়। ওরা কেউ আমার সাথ দিতে চায়নি। ভাইয়ার চোখ কান সবসময় খোলা থাকে।

ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল রুহী কথাটা। লম্বা লম্বা শ্বাস ছাড়ে তন্ময়, অসহায়ের মতো ক্রন্দনরত রুহীর চেহারা দেখে বলে ওঠে,“দোষ আমার সম্পূর্ণটা। তোর নয়। ভাবীকে কখনো স্যরি বলে নেবো। চল।”

_______

নিশ্চুপ অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে জান্নাত গালে হাত চেপে। শামির দ্রুত দ্রুত শার্ট প্যান্ট পরে নিয়ে আবারো গিয়ে জান্নাতের সামনে দাঁড়ায়,
ভেজা চুল,ফরসা মুখ, গোলাপী ঠোঁট,আজ আদুরে মুখটা শামিরকে চূড়ান্ত রাগিয়ে দিচ্ছে, ওর বলিষ্ঠ এক হাতেই জান্নাতের হাত দু’টো ওর পেছনে নিয়ে জোরসে চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে,“ভোলাভালা গাঁয়ের মেয়ে দেখে বিয়ে করেছিলাম,দেখে মনে হয়েছিলো ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা। সেই মেয়ে ছলাকলা করে আমার সাথে। আমার সাথে? শামিরের সাথে?”

চোখ মুখ খিচিয়ে নেয় জান্নাত,খুব কাছ থেকে চেঁচাচ্ছে শামির। আজ কে জানে কি আছে তার কপালে,এই লোক তাড়াহুড়োতে আছে,একটা চড় দিয়ে যে শামির থেমে থাকবে না তা জান্নাত বুঝতে পারছে।

“বলো কেনো করলে এটা? বলো?”

_আ..আমি কিছু করিনি।

_আবার মিথ্যা বলে! এই বলদ আমি? আমি বলদ না তো! এই বেয়াদব! তোমার আদৌও ধারণা আছে তুমি কি করেছো? আছে?

জান্নাত ছাড়া পেতে মরিয়া,“একটু ছাড়ুন আমায়! আমি কিছুই করিনি! আমি জানতাম না রুহী আপু চলে যাবে, আমাকে বলেছিল পাঁচ মিনিট কথা বলে ফিরবে।”

শামির ছাড়ে না, উল্টো বলতে থাকে,“কথাই বা কেন বলার সুযোগ করে দেবে তন্ময়ের সাথে আমি বারণ করার পরেও! কি দুঃসাহস তোমার! এভাবে ছলা করলে আমার সাথে! ওরিব্বাস তুমিতো সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স টিমের মেয়েদের থেকেও ধুর্ত! কি দুর্দান্ত প্ল্যান! শোনো জান্নাতুল, রুহীকে তো পরে দেখে নেবোই আমরা। তবে তুমি আজ যেটা করলে, এর জন্য শাস্তি কিন্তু পাওনা তোমার হ্যা? রুহী তো আবেগে অন্ধ হয়ে বোকামি করেছে, তবে যদি তোমার এই স্টুপিডিটির জন্য আমার বোনের কোনো ক্ষতি হয় তবে….”

_কি হবে রুহী আপুর?
কান্নাভেজা কন্ঠে প্রশ্ন করে জান্নাত।

_যে কোনো কিছু, ধরো ওই কুত্তা আমার বোনকে বিয়ে না করে শুধুমাত্র বদনাম করতে চাইলো, কিংবা ধরো ও আর ওর বন্ধুরা মিলে আমার বোনকে…….. টিভিতে দেখো না ক্রাইম ফাইলে এসব? দেখো না?

_নাহ।
কেঁদে ওঠে জান্নাত। তার গা হিম হয়ে আসছে, ওসব কখনো হবে না তার রুহী আপুর সাথে, কখনোই না।

শামির ওর কব্জিতে আরেকটু চাপ দিলো,চেচালো,“স্বামীর পেছনে ষড়যন্ত্র করো? তোমার এই বালপাকনামির জন্য আজ আমার বোনের কিছু হলে একেবারে….”

_একেবারে কি?

_তা তো দেখতেই পাবে।

একপ্রকার ধাক্কা মেরে জান্নাতকে ছাড়লো শামির। এরপর বিছানা থেকে ফোনটা তুলে নিতে নিতে আপনমনে গজগজ করছে,“মেয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরে,মেয়ে সাদাসিধা,মেয়ে সরল, অথচ এই মেয়ে এখন স্বামীকে এক হাঁটে কিনে আরেক হাটে বেঁচে দেয়। ভালোবেসে স্বামীর কাছে আসতে ওনার যতো ঘ্যাতরামি, অথচ আজ! ছিঃ আই যাস্ট কান্ট বিলিভ। তোমাদের মতো মেয়েকে কি করে সাইজ করতে হয় জানা আছে শামিরের! বুঝতে পারলে?”

ঘরে আসে সুহানা,শামিরকে তাড়া দিতে, এসে দেখে শামির জান্নাতের ওপর গজগজ করছে। সুহানা আশ্চর্য হয়ে যায়,“ভাইয়া তোমার ভাইয়া নিচে ডাকছে তোমায়, এই সময়ে জান্নাতকে বকাবকি করছো কেন আবার? এটা এখন ওকে ধমকাধমকি করার সময়? কি করেছে ও?”

শামির জবাব না দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামে, তাকে বেড়িয়ে রুহীকে খুজে বের করতে হবে কোন দূর্ঘটনা ঘটার আগেই।

জান্নাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, সুহানা এগিয়ে যায়,“কি করেছো? বকছিলো কেনো?”

জান্নাত চুপচাপ মাথা নাড়ে, অস্ফুটে বলে,“কিছু না।”

তন্ময়ের কাছের সব বন্ধু,রুহীর সব কাছের বন্ধুদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়, চৌধুরী এবং হাওলাদার বাড়ির পুরুষেরা উভয়ই তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কোথাও রুহী-তন্ময়ের টিকিটি নেই। তারা তখনো থানায় যায়নি।

রুহী তন্ময় তখন মেধার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়িতে। মেধা জানতো এই যায়গাটা নিরাপদ, বুদ্ধি করে সেই পাঠিয়েছে ওদের। ভাইয়ের হঠকারী সিদ্ধান্তে যদিও নারাজ সে, কিন্তু কি আর করা। এখন ফিরিয়ে আনলে দুটোকে যে দুই ফ্যামিলি জবাই করবে তা তো নিশ্চিত!

রুহী বসে আছে, মাথায় টেনে দেয়া সালোয়ার কামিজের ওড়না। তার শরীর মৃদু কাঁপছে। সে সত্যিই এটা করতে যাচ্ছে? বিয়ে করতে যাচ্ছে তন্ময়কে? আর বাড়ির সবাই? ওরা কষ্ট পাবে যে! ভাবতে ভাবতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে রুহীর,সে কিছু ভাবতে পারছিলো না। ঘাড় ঘুরিয়ে তন্ময়কে দেখে,তন্ময়ের মুখ এখন হাসি হাসি, কাজীর সাথে কথা বলছিল।
শেষটায় মনের সব দোটানা,সব ভয়,সব অপরাধবোধ চেপে রেখে নিচুস্বরে কবুল বলে দেয় রুহী।

থানায় জটলা দু’পক্ষের মাঝে,এখানে রীতিমতো তর্ক যুদ্ধ লেগেছে তন্ময়ের পরিবার আর রুহীর পরিবারের মাঝে। দুপক্ষই একে অপরের ছেলেমেয়েকে আসামী বানিয়ে অপহরণ এবং মানহানির মামলা দিতে চাইলো। ওসি হিমশিম খাচ্ছিল দু পক্ষকে সামলাতে, অভিযোগ কিভাবে নেবে সেটাই বুঝতে পারছিল না,ছেলে মেয়ে দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক।

ঠিক রাত বারোটা নাগাদ শারাফ চৌধুরীর ফোনে কল আসে একটা আননোন নাম্বার থেকে। শারাফাত চৌধুরী কলটা রিসিভ করতেই ওপাশে কান্নায় ভেঙে পরে রুহী।

মেয়েকে ওভাবে কাঁদতে শুনে বুকে ব্যথা হয় শারাফাতের, থানার মধ্যেই চেচিয়ে ওঠে,“কি হয়েছে আম্মু? কোথায় তুই?”

এগিয়ে আসে শামির, বাবার হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে চেঁচায়,“কোথায় তুই?”

_ভাইয়া!

_কাদছিস তুই রুহি? ঐ তন্ময় তোকে কি করেছে বল? আটকে রেখেছে তোকে?

দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে রুহীর বুকটা,বহু কষ্টে ভাইয়াকে বলে,“আমরা বিয়ে করে নিয়েছি ভাইয়া!”

হতভম্ব হয়ে শামির,রাজন আর শারাফাত দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মোশাররফ হাওলাদার আর তার দুইছেলের মুখটাও থমথমে। থানার ওসির মুখটাও থমথমে। তখনই শারাফাত চেঁচিয়ে ওঠে,“বিয়ে করে নিলি?”

কাঁপছে শারাফাতের গলা। রুহী কাঁদতে কাঁদতেই বলে,“হ্যা বাবা।”

শারাফাত কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো,শামির কাঁপছে প্রচণ্ড রাগে। চেঁচিয়ে রুহিকে কিছু বলতে যাবে,ঠিক তখনই শারাফাত শামিরকে থামিয়ে শীতল কন্ঠে মেয়েকে বলে,“আজ তোকে আমি ত্যাজ্য ঘোষণা করলাম। তোর মুখ যেন আমি আর কখনো না দেখি।”

একই অবস্থা হাওলাদারদের, মোশাররফ হাওলাদার ছেলেকে চিল্লিয়ে বলে,“তুই ত্যাজ্য। আমার বাড়ি আর ব্যবসা থেকে দূরে থাকবি অপদার্থ!”

যতটা হৈচৈ নিয়ে দুপক্ষ থানায় ঢুকেছিল,ততটাই নির্লিপ্ত এবং মনমরা হয়ে বেরিয়ে যায় দুই পক্ষ।

বাড়িতে উৎকণ্ঠা নিয়ে বসেছিলো রিজিয়া এবং বাকিরা, শারাফাত এসে ধীরস্থির সবাইকে জানিয়ে দেয়,“রুহীর সাথে আর এ বাড়ির কারো যোগাযোগ থাকবে না।”

শামিরেরা দুইভাই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে বসে রয় দীর্ঘসময়,দীর্ঘসময় রিজিয়া বিলাপ করে কাঁদে, দীর্ঘসময় কেউ কোনো কথা বলে না সে রাতে,কেউ মুখে একফোঁটা পানি অবধি দেয়না।

জান্নাতের বিধ্বস্ত মনমরা মুখটা ঘুরেফিরে বাড়ির সবাইকে দেখে। নিজের অজানতেই সে রুহী আপুকে পালাতে দিয়েছে। সে এটুকুই জেনে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল।

শামির আর বসলোনা, মুখটা আবার মলিন থেকে কঠিন আকার ধারন করেছে তার। সবাইকে ফেলে গটগট করে উঠলো দোতলায়,ওকে ওভাবে ধেয়ে আসতে দেখে বুক কাঁপছে জান্নাতের, ঘাবড়ে গিয়ে করিডোর থেকে ছুটে যায় রুমের ভেতর। এই লোকটা তাকে আজ খুব শাস্তি দেবে,যদি গাঁয়ে হাত তোলে দুমদাম? যা করে ঘরের মধ্যে না হয় করবে।

হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে শামির। জান্নাত ঘরে এককোণে চুপসানো বেলুনের মতো চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই শামির সন্ধ্যার থেকে চারগুণ বেশি ক্রোধান্বিত হয়ে তেড়ে যায় জান্নাতের দিকে,জান্নাত শুধু বলতে পারলো,“শুনুন আমার কথাটা,রুহী আপু বলেছিলো এতটুকু না করলে সে আত্মহত্যা করবে!”

ওর কোমর চেপে ধরলো শামির। এই সরল মুখের মেয়েটাকে ওর এই দুঃসাহসের জন্য শামির আগের শামির হলে তুলে আছাড় মারতো,আজ কেন জানি পারলো না,হয়তো জান্নাতের টলমলে টানা টানা চোখ দেখে। গলায় মেঘের গর্জন ঢেলে শুধু বলে,“কি করেছো এটা? কি করেছো? কি করেছো বলো?”

কাঁদছে জান্নাত,“ছাড়ুন।”

_ওদিকে আমার বোনটার জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে আর তোমাকে ছাড়বো? স্বামীর থেকে বেশি বোঝো তুমি? আমার থেকে বেশি বোঝো তাইনা?

দু’পাশে ঘনঘন মাথা নাড়ায় জান্নাত,তুতলে বলে,“না বু-বুঝি না,বে-বেশি বুঝি না আপনার থেকে।”

ওর কান্না দেখে দমলো শামির,তবে পরক্ষনেই আবার ফোঁস করে উঠলো,“সব গুছিয়ে নিবি। কালই তোকে তোর বাপের বাড়ি দিয়ে আসবো।”

কেঁপে উঠলো জান্নাত,“মানে?”

_মানে বাপের বাড়ি যাবি তুই। তোর মামা মামীকে কল করে বলবো যদি তারা আদব শিখিয়ে পাঠাতে পারে তাদের মেয়েকে, তবে যেন পাঠায়,নচেৎ নয়।

_নচেৎ নয় মানে?
হু হু করে কেঁদে ওঠে জান্নাত,শামিরকে আগলাতে চায়,“আপনি কষ্ট পেয়েছেন জানি,আমি ক্ষমা চাইছি‌ । তবে একথা বলবেন না দয়া করে,আমি যাবো না কোথাও। আমি আর কখনো মিথ্যাচার করবো না…”

ওকে এক ঝটকায় সরিয়ে দেয় শামির,“ঐ কুলাঙ্গারের সাথে তো আমার বোনের সংসার আমরা মানবোই না, বাবা ত্যাজ্য করেছে রাগের মাথায়। আমি তো জীবিতাবস্থায় বোনকে কুত্তার কামড় খেতে ছেড়ে রাখতে পারি না। বোনকে ফিরিয়ে আনবো,আর যতদিনে না আনি তুই বাপের বাড়ি থাকবি। এটা হচ্ছে তোর বেশি বোঝার শাস্তি, স্বামীর এক কাঠি ওপরে গিয়ে বেশি বোঝার শাস্তি।”

সেরাতে ঘুমায়নি জান্নাত, বুকে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করেছে সারারাত। এতো বার,এতো ভাবে মাফ চেয়েছে শামিরের কাছে, শামির ছিটকে সরিয়ে দিয়েছে রাগে। একটু ছুঁতেও পারেনি লোকটাকে। একটু ফিরেও তাকায়নি ওর দিকে। জান্নাত নিশ্চুপ কেঁদেছে,শুধুই কেঁদেছে, লোকটার বুকের মাঝে শুয়ে তার মান ভাঙানোর জন্য ছটফট করেছে, কিন্তু সে সুযোগ তাকে দেয়নি শামির।

রাতে বাড়ির কারো খাওয়া হয়নি, সকালেও সবাই জড়বস্তুর মতো হাঁটাচলা করছে,শোক সামলিয়ে উঠতে পারেনি কেউই। জান্নাত এমতাবস্থায় বাপের বাড়ি যাবে শুনে শারাফাত বিরক্ত হয়, বেজার মুখে জান্নাতকে বলে,“এই সময়ে বাপের বাড়ি যাবে? এটা কেমন বিবেচনা? তোমার শাশুড়িকে সামলাও।”

জান্নাত বলেনি বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা,সে তো যেতেই চায়না।এসব বলেছে শামির,সকালে উঠেই জান্নাতকে তাড়া দিচ্ছে তৈরি হতে। সারারাত না ঘুমিয়ে ক্লান্ত শরীর জান্নাতের,নড়ছিলো না মোটেও। শরীরটা বিগত তিনদিন ধরেই খারাপ যাচ্ছে, আজ আরেকটু বেশিই খারাপ।

শামিরের মুখ থেকে ধমক বের হয়,“এই নাটক কম। নাস্তা সেরে রেডি হও শিগগির।”

জান্নাতের মাথা ঘুরতেই থাকে। এই মানুষকে বোঝাতে জান্নাত পারবে না, শুধু কষ্ট বাড়ছে জান্নাতের। কারো জায়া হলে বুঝি এমন হয়, মানুষটার শত তুচ্ছতাচ্ছিল্য উপেক্ষা করে তার জন্যই হেদিয়ে মরতে হয়! বিয়ের পর থেকে দুর্ব্যবহার কম পায়নি শামিরের থেকে, যতখানি ভালোবাসা দিয়েছে, দুর্ব্যবহারও দিয়েছে ততখানি, জান্নাত ছিলো চাবি দেয়া পুতুল শামিরের, অভিমানের পাহাড় জমেছে নানা কারণে লোকটার প্রতি, রাগ জমেছে, এখনো তো আছে, তবুও এতো মায়া কেন জান্নাতের? এইতো কদিন আগেও রুপাতলী যাওয়ার জন্য তড়পেছে কত! এখন তবে কেন এতো যন্ত্রণা হচ্ছে?

খাবার টেবিলে রিজিয়া নিস্তেজ হয়ে বসে আছে। শারাফাত ওকে বোঝায়,“খেয়ে নাও। ওর মতো স্বার্থপর মেয়ের জন্য না খেয়ে থাকার দরকার নেই।”

মাইমুনা কাল থেকে আবোলতাবোল বলছে,নাস্তার টেবিলেই বললো,“আমার নাতনি ভাইগা যাওনের মতো মাইয়া না। শারাফাত, ওরা চিনি পড়া খাওয়াইয়া ওরে ভাগাইয়া নিছে। তুই মতি হুজুররে ডাক।”

শামির বিরক্ত হচ্ছিলো এসব কথায়, কপাল কুঁ’চ’কে কিচেনের দিকে তাকায়। জান্নাত চা করছিলো শামিরের জন্য। শামির হাক ছাড়লো,“চা খাবোনা আমি। তুমি রেডি হও তাড়াতাড়ি।”

জান্নাত যাবেই না। চোখ ভিজে আসছে তার,শামিরের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে‌। শামির ওর ছলছল চোখ দেখে, পরপর চোখ সরিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে।

জান্নাতকে শামির কখনোই রুপাতলী দিয়ে আসবে না, অত বোকা আর আহাম্মক শামির নয়। অল্পবয়সী সুন্দরী বৌকে দূরে পাঠিয়ে শাস্তি দেয়া, এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। এই বয়সী মেয়েদের মাথায় শয়তান ঢুকতে সময় লাগে না,দেখা গেল ওখানে গিয়ে কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরলো,তখন হাত কামড়াতে হবে। শামির তো শুধু রাত থেকে ভয় পাইয়েছে, এক রাত কাঁদিয়েছে মেয়েটাকে যাতে উচিত শিক্ষা হয়। যাতে শামিরের প্রতি পুরনো ভয়টা চলে আসে। মাঝখানে অতি আদর দিয়ে সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিলো,যার ফলে আজ এই অবস্থা, কথায় কথায় ছলনা করে।‌ শামিরের থেকে গোপন করে এটা সেটা!

রিজিয়া বণিক আবারো কেঁদে ওঠে সকালে, সুহানা ওকে সামলায়। জান্নাত শাশুড়ির বিলাপ শুনে কিচেন থেকে বেড়োতে নিলে পঞ্চমবারের মতো দুলে ওঠে সবকিছু তার চোখের সামনে, এবং আবারো ব্ল্যাক আউট।

গা থেকে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে জান্নাতের। পিটপিট করে তাকিয়ে আছে শামিরের দিকে। চিন্তিত, উদ্বিগ্ন শামির ওর দিকে ঝুকে বসে আছে। জান্নাত দেখছে শামির একটা নয়, দু’টো, এইতো আরো দু’টো বাড়লো। এতো গুলো শামির! এতগুলো হাড়ে বজ্জাত শামিরকে কিভাবে সামলাবে জান্নাতুল?

জান্নাতের দুগালে তখন আলতো চাপড় মেরে শামির ডাকলো,“খারাপ লাগছে জান্নাতুল? খারাপ লাগছে?”

_আ..আমি..রুপাতলী যাবো না।
বলতে বলতেই হরহর করে বমি করে দিল জান্নাত।

বমি হওয়াতে কিছুটা ভালো লাগছে এখন,তবে শরীরটা দুর্বল। এভাবে হঠাৎ করে তাল কেটে গিয়েছে কেন বুঝতে পারছে না জান্নাত। শামিরকে চিন্তিত লাগছে, গম্ভীর মুখে জান্নাতকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছুক্ষণ দেখে, পরপর কিছু একটা মনে পরতেই গিয়ে আলমারি খুলে ড্রয়ারে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ইনটেক প্যাকেটটা দেখে জান্নাতের দিকে তাকায়। জান্নাত মলিন মুখে শামিরকেই দেখছিলো।

_এই মান্থে পিরিয়ড হয়নি?

তাড়াহুড়ো করে প্রশ্ন করল শামির। কিছু মনে করতে পারছিলো না জান্নাত,এই হিসেব গুলো সে কখনই ঠিক রাখতে পারেনি। শামির ওর থেকে আর উত্তরের আশা না করে হন্তদন্ত হয়ে পাড়ার ফার্মেসি থেকে একটা কিট নিয়ে এসে জান্নাতকে দেয়,“এখানে যেভাবে যেভাবে বলা আছে,সেটা করে কিটটা আমার কাছে দাও।”

হঠাৎ করেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় জান্নাতের, উত্তেজিত কাঁপা হাতটা শামিরের থেকে কিটটা নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢোকে। শামির ঘরময় পায়চারী করছিলো,জান্নাতকে বেড়োতে দেখেই গিয়ে ছো মেরে জান্নাতের হাত থেকে কিটটা নেয়।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাত,শরীরটা তার অদ্ভুত অনুভূতিতে মুহুর্মুহু কাঁপতে শুরু করেছে হঠাৎ। দু’টো স্পষ্ট লাল দাগ, শামির এক দৃষ্টে কিছু পল সেদিকে তাকিয়ে থাকে, পুনরায় মাথা তুলে দেখতে থাকে জান্নাতকে। জান্নাত চোখে চোখ মেলাতে পারছে না, শামির স্বাভাবিক গলায় বললো,“শাড়িটা পাল্টে নাও। ডাক্তারের কাছে যাবো আমরা।”

গাইনোকলজিস্ট ডক্টর তানিয়া রহমান শামিরের পরিচিত। হাসি হাসি মুখ করে একবার জান্নাতকে দেখছে, একবার শামিরকে। তার হাতে জান্নাতের রিপোর্ট। জান্নাত স্বামীর পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে, তখন থেকে আতঙ্ক, উত্তেজনা,ভয়, আনন্দ,হতাশা সবকিছুর সমন্বয়ে তৈরি একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে। বের হতে পারছে না কোনোভাবেই।

তানিয়া রহমান মজার ছলে শামিরকে বলে উঠলো,“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কোন কারণে আপসেট। মুখটা এমন কেন?”

সামান্য হাসে শামির,“নো নো,নট একচ্যুলি! দিস ইজ মাই ফার্স্ট বেবি আপু, অ্যান্ড আই কান্ট ডিসক্রাইব মাই ফিলিংস ইন ওয়ার্ডস! ”

_তবে? ঘামছো কেনো?

_ও ছোটো! সতের বছর সাত মাস কি মা হবার জন্য ঠিক আছে?

হেসে ফেললেন ডক্টর তানিয়া, ব্যঙ্গ করে শামিরকে বলে,“ছোটো তবে বিয়ে করলে কেন?”

শামির কপাল কুঁচকে নেয়, পুনরায় বলে,“আপনি বলুন আপু, বয়সটা কি ঠিক আছে?”

_সত্যি বলতে গেলে ঠিক নেই। তবে ঘাবড়ানোর কিছু হয়নি, অনেকেই হয় এই বয়সে মা। এতো ঘাবড়ে যেয়ো না, তোমারই যদি এই অবস্থা হয় ঐ বেচারী তো আরো ভয় পেয়ে যাবে!

শামির তাকায় জান্নাতের দিকে‌। তখনো চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে,ওর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই শামির ডক্টরকে বললো,“যা যা দরকার সব লিখে দিন, মেডিসিন থেকে শুরু করে দিকনির্দেশনা। আমাদের উপকার হবে, আমি এসব জানিনা এবং ও স্বভাবে চাপা।”

ডক্টর তানিয়া তাই করলেন,কিছু মেডিসিন লিখে দিয়ে একটা ম্যাগাজিন শামিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,“এটা দু’জনেই পড়বে। সবটা বুঝে যাবে। আর হ্যা শামির, সাবধান! আশা করি বুঝতে পারছো?”

চলমান……