#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_২১
#ইসরাত_ইতি
গাড়িতে চুপচাপ উঠে বসে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে জান্নাত। তারা তানিয়া রহমানের চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। হঠাৎ হাতের ওপর উষ্ণ শক্ত হাতটা শামির রেখে দিলে জান্নাত তাকায় শামিরের দিকে।
“শরীর খারাপ লাগছে জান্নাতুল?”
দু’পাশে মাথা নাড়ে জান্নাত, অস্ফুট স্বরে বলল,“এখন ঠিক আছি।”
_সকাল থেকে খাওনি কিছু। কিছু খাবে? গাড়ি থামাবো?
খাবার কথা শুনেই আবারও গা গুলোচ্ছে জান্নাতের, হঠাৎ নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরোয়,“কাচা আম খাবো।”
_হোয়্যাট! কাঁচা আম? খালি পেটে টক?
পরপর সামান্য হাসলো শামির। এখন তো এসবই খেতে ইচ্ছে করবে। ঠান্ডা গলায় জান্নাতকে বললো,“এটা তো কাঁচা আমের সিজন না। তবুও আমি চেষ্টা করবো খুজে বের করার,সময় দাও।”
শামির জান্নাতকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গিয়েছে এটা সবাই জানে,তবে জান্নাতের কি হয়েছে জানে না কেউ। কারো মন ভালো নেই,অতটা খুঁচিয়ে কেউ জানতেও চায়নি। বাড়িতে শারাফাত ছিলেন, ড্রয়িং রুমে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে ছিল,তবে টিভি দেখছিলো না। রিজিয়া কাঁদতে কাঁদতে শরীর খারাপ করে ফেলেছে,সেও চুপচাপ স্বামীর পাশে বসেছিল। জান্নাত আর শামির ঘরে ঢুকতেই রিজিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“কি হয়েছে বৌমার? শরীর খারাপ?”
কন্ঠে কোন প্রাণ নেই,নেই উৎকণ্ঠা, একেবারে নির্জীব। শামির মায়ের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলো,তবে মুখে বললো না কিছুই। ওর ঐ হাসি দেখে সবাই বুঝে গিয়েছে সব। শারাফাত চৌধুরী মেজো বৌমার দিকে তাকিয়ে বললো,“আলহামদুলিল্লাহ।”
জান্নাতের ভারি লজ্জা লাগছে,কারো দিকে তাকাতে অবধি পারছে না সে। রিজিয়া উঠে দাঁড়ায়,দুলছে তার শরীর,বললো,“ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। আর শামির,তুই থাক,তোর সাথে কথা আছে।”
সুহানা উত্তেজিত ভীষণ, খুশি চাপিয়ে রেখে জান্নাতকে বলে,“ঘরে যাও,আমি আসছি কিছু খাবার নিয়ে, সকাল থেকে খাওনি।”
জান্নাত ধীরপায়ে হেটে ওপরে চলে যেতেই রিজিয়া কেঁদে ওঠে,তিনি স্বামী আর মেজো ছেলেকে অনুরোধ করে সব রাগ সরিয়ে রেখে রুহীকে মেনে নিতে, এভাবে তো চলতে পারে না। তার পেটের সন্তান রুহী, যতই ভুল করুক, কোনো অপরাধ তো করেনি। ড্রয়িং রুমে মায়ের সাথে একদফা তর্ক লেগে যায় শামিরের, চেঁচিয়ে ওঠে,“ওকে ফিরিয়ে তো আনবোই। তবে বিয়ে মানতে বলবে না। ঐ ছেলের ঘর ওকে করতে দেবো না আমি।”
জান্নাত ঘরে ঢুকে ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়,ঘোমটা খসে পরেছে মাথা থেকে। মুখটা কেমন ফোলা ফোলা লাগছে হঠাৎ, ধীরে ধীরে জান্নাতের দৃষ্টি নামে পেটের কাছটায়। আবারও এক অচেনা অনুভূতিতে শরীরটা ঝাকুনি দিয়ে ওঠে,কন্ঠনালীর কাছে পীড়া হচ্ছে আবেগে। জান্নাত নিজের পেটে হাত রাখে, এখানে কেউ আছে! খুব ছোটো কেউ! যার প্রাণ আছে! একটা কাঠ বাদামের খোসার মতো সাইজ। যে বড় হতে থাকবে,জান্নাতকে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকবে নারীজন্মের আরেকটা অধ্যায়ের সাথে।
দরজা ঠেলে তখুনি ভেতরে ঢোকে শামির। অভ্যাস বশত ঘোমটা টেনে জান্নাত চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। শামির ওকে মিনিট খানেক চেয়ে চেয়ে দেখল এবং হঠাৎ ছুটে গিয়ে জরিয়ে ধরলো জান্নাতকে। চমকে উঠলো জান্নাত। নিজেকে সামলাতে অবধি পারলো না,ওদিকে শামির ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলতে থাকে,“ওহহ জান্নাতুল! জান্নাতুল! কি করেছো তুমি?”
_কি করেছি?
কাঁপা স্বরে জান্নাত বলল।
_এটা কিভাবে হলো? কখন?
ভীষণ লাজুক হাসি বেরিয়ে আসল জান্নাতের থেকে, আবার পর পর ভয়ও হলো, মিনমিন করে বলল,“আমি বুঝতে পারছি না,হয়তো গতমাসে যে জ্বর হয়েছিল তখন আমি…..”
মনে করতে পারছে না জান্নাত কিছুই, শামিরের গলা থেকে তখন আহ্লাদ মাখা শব্দ বেরুচ্ছে,“ওহ আল্লাহ! কত ছোটো তুমি! যাই হোক। এটাই হয়তো আল্লাহর ইচ্ছা। ঘাবড়িও না তুমি। কেমন?”
জান্নাত চুপচাপ মাথা নাড়ে,শামিরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রেখেই হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে বলে,“আমি রুপাতলী যাবো না।”
হাসে শামির,“ধূর বোকা মেয়ে। কে তোমাকে রুপাতলী পাঠাবে? একটু ভয় দেখাচ্ছিলাম!”
অবাক হয়ে শামিরের দিকে তাকায় জান্নাত। ভয় দেখাচ্ছিলো? ভয় দেখাতে ওভাবে সারারাত কাদালো তাকে লোকটা?
শামির ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল,একটা লম্বা শ্বাস ফেলে আপনমনে বলতে লাগলো,“আমি ঘুনাক্ষরেও বুঝিনি আমার এত আনন্দ হবে। ডক্টরের চেম্বারে খুব নার্ভাস লাগলেও এখন ভীষণ আনন্দ লাগছে জান্নাতুল।”
জান্নাত বলেনা কিছুই। শামির খানিক বাদে টেনে বিছানায় নিয়ে বসায় ওকে। ঘোমটা সরিয়ে দেয় মাথা থেকে, দু গালে হাত চেপে ধরে রেখে আমুদে হয়ে বলে,“এখন থেকে খুব সাবধানে চলাফেরা করবে, কাজবাজ সব বাদ। শুধু বিশ্রাম নেবে। ঠিক আছে?”
মাথা নাড়ে জান্নাত। শামির কাছে টানে ওকে,“গুড গার্ল। এখন থেকে একটু আমার কথা শুনো।”
◻️
কক্ষে এককোণে একটি সোফাতে মন মরা হয়ে বসে আছে রুহী। তখন সকাল এগারোটা বেজেছে প্রায়, তন্ময় একটু বাইরে গিয়েছিলো। রুহী আর তন্ময় অবস্থান করছে মেধার সেই বান্ধবীর বাড়িতেই। এ ঘরে কাল রাতে ওদের বাসর সাজানো হয়।
হাতে একটা প্লেট নিয়ে তন্ময় ঘরে ঢোকে। রুহী মাথা তুলে তাকায়। ওর পাশে বসে তন্ময় বলে,“গতকাল রাতে ঘুমাওনি,কিছু খাওনি,এখন শরীর খারাপ করবে কিন্তু!”
_তন্ময় বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। আমি এখন কি করবো?
ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে ওঠে রুহী। তন্ময় হাত থেকে খাবারের প্লেট নামিয়ে ওকে বুকে টেনে নেয়,“আরে পাগল এতো কাঁদিস না। বললেই হলো ত্যাজ্য করবে? কেউই করবে না। এখন সবার মাথায় খুব রাগ বুঝলি? তাই এমন করছে। দু’দিন যেতে দে না!”
কান্না থামায় রুহী,চোখ মুছতে মুছতে বলে,“আল্লাহ জানে মেজো ভাবীর কি অবস্থা,ভাইয়া নিশ্চয়ই খুব বকেছে। বেচারী! আমি ফাঁসিয়ে দিলাম!”
তন্ময় পকেট থেকে ফোনটা বের করে নিয়ে বলে,“দাড়াও মেধা আপুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি জান্নাতুল ভাবীর কথা।”
ফোন রিসিভ করেই মেধা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,“কি হয়েছে? কোনো অসুবিধা?”
_আপু জান্নাতুল ভাবীর কি অবস্থা? কিছু বলেছে তোমায়? ভাইয়া কিছু করেছে ভাবীর সাথে?
মেধার কন্ঠস্বর স্বাভাবিক, সামান্য হেসে বলল,“বকেছিলো নাকি খুব, কিন্তু তোমার ভাবী এমন একটা কাজ করে ফেলেছে যে শামির আর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতেই পারলো না!”
অবাক হয় রুহী,“কি করেছে ভাবী?”
_তোমার ভাবী প্রেগন্যান্ট রুহী।
আচমকা লাফিয়ে উঠলো রুহী,ওর সাথে তন্ময়ও উঠে দাঁড়ায়। এতো টেনশনের মাঝেও খুশিতে লাফাচ্ছে রুহী, ঈষৎ আবেগে তিরতির করে কাঁপছে,চাপা স্বরে বলছে,“আমি ফুপি হবো! আমি ফুপি হবো!”
মেধা কল কাটে। তন্ময় কপাল কুঁচকে রুহীকে বলে,“নাচছো কেনো এভাবে?”
_নাচবো না? আমি ফুপি হবো! মেজো ভাইয়া বাবা হবে ! একটা ছোট্ট পুচকু আসবে!
তন্ময় কিছুক্ষণ রুহীর পাগলামি দেখলো,পর পর কপাল কুঁ’চ’কে বললো,“হু,খুব উদ্ধার করে দিয়েছে তোমার ভাইয়া, অতটুকু মেয়েকে প্রেগন্যান্ট বানালো,আর এদিকে বোন নাচছে।”
থেমে যায় রুহী, চোখ সরু করে বলে,“খবরদার খোচাবে না! যত যা-ই হোক, এটা ভীষণ আনন্দের ব্যাপার আমাদের কাছে। মেজো ভাইয়া বাচ্চা-কাচ্চা পছন্দ করে খুব!”
_সেজন্যই বাচ্চাবয়সী মেয়ে বিয়ে করেছে বুঝি?
_আবার খোচাচ্ছে!
তন্ময়ও চোখ সরু করে ফেললো,“কি করবে খোচালে? এই দেখো খোচাচ্ছি।”
বলেই কাতুকুতু দিতে শুরু করে রুহীকে,রুহী হাসতে হাসতে তন্ময়ের গায়ে হেলে পরে, দু’জনেই পরে যায় বিছানায়। হাসি থামিয়ে নেয় রুহী। তন্ময়কে নিজের ওপরে আবিষ্কার করতেই লজ্জায় রক্তাভ হয় মুখ। পরিবেশের নিশ্চুপতায় তীব্র এক অনুভূতি ঘিরে ধরে তন্ময়কে, ওষ্ঠাধর নিয়ে আরেকটু এগোতেই রুহী ঘাবড়ে গিয়ে বলল,“আরেকটু সময় চাই তন্ময়।”
_ধূর একটা কিস?
_নাআ!
_না প্লিজ!
শুনলোনা তন্ময় রুহীর কথা। বলতে দিলো না কিছুই। মিনিট তিনেক পরে তন্ময় উঠে চুপচাপ বসলো ,রুহী লজ্জায় মুখ ঢেকে শুয়েই আছে!
উঠে ঘরের এক কোণে চলে যায় তন্ময়,রুহীর জন্য প্রচুর শপিং করিয়েছে বন্ধুদের দিয়ে, সেসব গোছাতে গোছাতে মৃদু আওয়াজে বলে,“নেহাত ভদ্রলোক আমি! বুঝলে?”
রুহী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে মিটিমিটি হাসছে, অস্ফুটে বললো,“থ্যাংকস!”
তন্ময় মুখ বাকায়,“হয়েছে। ওঠো! খেয়ে নাও। আমরা এখান থেকে বেরুবো!”
_কোথায় যাবো?
_কোথায় আবার! বাসা ভাড়া নিয়েছি। সংসার করতে হবে না? ওঠো!
◻️
সকালের এই সময়টাতেই, জান্নাত খেয়াল করেছে ওর শরীর,মন মেজাজ কিছুই ভালো থাকছে না। এমনটা এই ক’দিন ধরে হচ্ছে। যখন থেকে প্রেগন্যান্সির খবরটা পেয়েছে। ঘুম থেকেও বেলা করে উঠছে, ফজরের নামাজ কাজা পড়তে হচ্ছে।
আড়মোড়া ভেঙে চুলে খোপা বাঁধতে বাঁধতে জান্নাত আশেপাশে তাকায়,শামির কোথাও নেই। বিছানার হেডসাইডে অনেকগুলো বৈয়াম দেখা যাচ্ছে। এসব আচার ও হেল্থ ড্রিঙ্কসের বৈয়াম,গতরাতে শামির এনেছে। রোজ কিছু না কিছু আনছেই, জান্নাত খেয়ে শেষ করতে পারে না সেসব।
মুখ হাত ধুয়ে চুল আঁচড়ে নিতেই শামির ঘরে ঢুকলো, শরীর মন মেজাজ খুব ফুরফুরে লাগছে তার, জান্নাতকে বলল,“ও তুমি উঠে গিয়েছো। আচ্ছা খেয়ে নাও, আর যে ওষুধ গুলো দেখিয়ে দিয়েছি সেগুলো খাবে ।”
জান্নাত শুধু মাথা নাড়ায়। শামির গলার টাই বেঁধে নিয়ে ওর কাছে এগিয়ে আসে। জান্নাত বিছানায় চুপচাপ বসে দেখছেই শুধু লোকটাকে,গত ক’দিনে লোকটার আচরণে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে জান্নাত। অহেতুক হম্বিতম্বি করছে না জান্নাতের সাথে।
ওর পেটে হঠাৎ হাত রাখে শামির, শিহরিত হয়ে উঠল জান্নাত তখন, লজ্জা পেলো। বাচ্চাটা নিয়ে শামির যে আসলেই বেশ আনন্দিত তা জান্নাত এ কদিনে বেশ টের পেয়েছে। সময়ে অসময়ে বড় আবেগী হয়ে ছোয় জান্নাতের উদর,বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে জান্নাতের পেটের দিকে। রাতে শুতে গেলে একটা হাত রেখেই দেয় পেটে। রুহীকে নিয়ে বাড়ির সবাই বিষন্নতায় ভুগছে, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বাড়িতে নতুন অতিথি আসার খবরে শুধু শামির নয়,বাকিরাও আনন্দিত। রিজিয়া সময়ে অসময়ে এসে খোজ খবর নিচ্ছে জান্নাতের। শারাফাত নিজে বাজারে গিয়ে গৃহস্থীদের থেকে কবুতরের বাচ্চা, দেশি মুরগির বাচ্চা, টাটকা সবজি, দেশীয় ফরমালিন মুক্ত ফল, এসব আনছে খুঁজে খুঁজে।
জান্নাতকে টেনে বুকে নেয় শামির। ওকে জড়িয়ে ধরে শামির দু’চোখ বুজে নেয়,পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে নম্রস্বরে বলে,“বিকেলে বাগানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করো,ছাদে উঠো, ফুরফুরে হাওয়া প্রয়োজন এই সময়ে, হাঁটাহাঁটি প্রয়োজন,নয়তো পা ফুলে যাবে।”
হ্যা এই সময়টাতেই শেষ বিকেলের হাওয়ার প্রয়োজন পরে মেয়েদের অন্যসময়ে পরে না। এই সময়েই বাগানে হাঁটাহাটি করা দরকার, অন্য সময়ে প্রয়োজন নেই এসবের। জান্নাত নীরব হাসে, তাচ্ছিল্যের হাসি।
শামির বলে যাচ্ছে,“তবে ক্ষণ মেনে চলো, খারাপ বাতাস লেগে আমার বেবির যদি কিছু হয়!”
জান্নাত চুপচাপ শুনছে। লোকটা এই একটা কথাই সেদিন থেকে জিকির করছে,“আমার বেবি,আমার বেবি।”
যেন বেবিটা জান্নাতের কিছুই না,সবটা এই লোকের,যেন জান্নাতের পেটটা একটা মাধ্যম শুধুমাত্র। শামির উঠে দাঁড়ায়, জান্নাত আমতা আমতা করে বলল,“একটা কথা বলবো?”
_হু।
_রুহী আপুর কোনো খোঁজ পেলেন?
শামির জান্নাতের দিকে তাকায়, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,“পেয়েছি। সেখানেই যাচ্ছি। ওকে নিয়ে আসতে।”
_নিয়ে আসতে মানে? মেনে নিয়েছেন আপুকে? মেনে নিয়েছেন বিয়েটা আপনারা?
জান্নাতের এই কথার জবাবে দুর্বোধ্য হাসি দিলো শামির। তবে মুখে কিছু না বলেই বেড়িয়ে গেলো।
◻️
একটা দুই রুমের ছোটো বাসা। আসবাবপত্র বলতে আপাতত প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার, সেগুলো। তন্ময়ের স্কলারশিপের সংরক্ষিত টাকা দিয়ে একটা খাট কিনেছে, কিছু টাকা বাচিয়ে রেখেছে। প্রথম মাসের বেতন পেলে ধীরে ধীরে সব কিনে ফেলবে।
সংসার জীবনের প্রথম দিনেই রুহী হাত পুরিয়ে ফেলেছে, বাপের বাড়িতে থাকতে কাজ-বাজ শেখা থেকে দূরেই থাকতো। এখন রুহীর অবস্থা লেজেগোবরে, তন্ময় অবশ্য টুকটাক কাজ-বাজ জানে, স্টুডেন্ট অবস্থায় একা থাকার সুবাদে রান্নায় মোটামুটি দক্ষ সে। রুহীকে হাতে ধরে শেখাচ্ছে সবকিছু। রুহী খুব দ্রুতই শিখে নিচ্ছে সব।
আজ রান্না হবে ডিম ভুনা আর ডাল। সকালেই রান্নাটা করে রেখে তন্ময় অফিসে যায়। ডালে ফোড়ন দিতেই ছিটকে, লাফিয়ে গিয়ে তন্ময়কে জরিয়ে ধরলো রুহী। তন্ময়ের মুখে দুষ্টুমির হাসি, রুহীকে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,“আজ ছুটি নিই অফিস থেকে,কি বলো?”
লজ্জা পেয়ে রুহী ছাড়লো ওকে। চোখাচোখি হলো দু’জনের। ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠল!
এই সময়ে কে এলো এটা ভেবে দু’জনেই চিন্তিত। তন্ময় এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই শিউরে উঠলো রুহি,পরপর আতঙ্কিত গলায় বললো,“ভাইয়া!”
শামির আর রাজন দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, অবাক দৃষ্টিতে খানিক সময় বোনকে পা মাথা দেখে ঘরে ঢুকলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো ঘরের সবকিছু, দেখলো তন্ময়কে।
তন্ময় বোঝার চেষ্টা করছে শামিরদের মতিগতি, এরা যে কোনো ঝামেলা পাকাতেই এসেছে সেটা তো নিশ্চিত ভাবে বলাই যায়। শামির এগোলো ওর দিকে, ঠান্ডা স্বরে বলল,“রুহীকে নিয়ে যাবো। তুইও বাড়ি যা। এসব বাদ দে।”
আঁতকে উঠলো রুহী। এসব কেমন কথা? দু’পাশে ঘনঘন মাথা নাড়ায় রুহী,“ভাইয়া আমরা কিন্তু বিবাহিত!”
রাজন তেতে ওঠে বোনের ওপর, এগিয়ে গিয়ে আবার একটা চড় মারে, চেঁচিয়ে ওঠে,“তুই জীবনে ভালো থাকতে পারবি? এই তুই জিন্দা থাকবি? গর্দভ মেয়ে! রুহী শোন, এখনো সময় আছে, জানাজানি হয়নি বিয়ের কথা,চল।”
রুহীর চোখে পানি আসলো ভাইদের কথা শুনে। এমন মানুষও হয়? এরা এখনো এমন করছে?
চোখের পানি মুছে দু’পাশে মাথা নাড়ে রুহী, কন্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে বলে ,“জানাজানি হোক, পাপ করেছি না আমি? হোক জানাজানি, আফসোস নেই আমার।”
এবার চ’ড়টা খায় শামিরের থেকে, শামির রাজনের মতো নিচুগলায় নয় বরং চেচালো উঁচু গলায়,“নির্লজ্জ কোথাকার! ওদিকে বাবা এখন মরে,তখন মরে অবস্থা আর তুই! অমানুষ একটা!”
রুহী এতো মারধোর খাচ্ছে! সহ্য হয়না তন্ময়ের, চেঁচিয়ে ওঠে,“আর তোমরা খুব মানুষ? এতো বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলো! রুহী কষ্ট পাবে নয়তো….”
শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে শামির এগিয়ে যায়,চেপে ধরে তন্ময়ের কলার। পর পর লাগাতার কতগুলো ঘুষি মেরে বলে,“নয়তো কি? বাস্টার্ড!”
রুহী কাকে ধরবে? ডুকরে কেঁদে দিয়ে ছুটে গিয়ে তন্ময়কে সরিয়ে নেয়। তন্ময় শামিরের গায়ে হাত তোলেনি রুহীর জন্য, মা’র খেয়েছে চুপচাপ, বড়জোর হাত দিয়ে ফেরানোর চেষ্টা করেছে।
তন্ময়কে সরিয়ে রুহী কান্নাভেজা দৃষ্টিতে শামিরকে দেখলো, চিল্লিয়ে বলে উঠলো,“এক্ষুনি বের হও এখান থেকে। এক্ষুনি!”
_রুহী?
শামির অবিশ্বাস্য নজরে দেখে বোনের মেজাজ। চোখের পানি মোছে রুহী, হাঁফ ছেড়ে বলে,“না বুঝেছো! না বোঝার চেষ্টা করবে! তোমাদের বলে লাভ নেই। তোমরা যাও এখান থেকে। বাবা আমাকে ত্যাজ্য করেছে, বাবাকে বলে দিও আমি লজ্জিত, পারলে যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। দয়া করে আমার স্বামীকে এভাবে মারবে না। আমি অমানুষ তো,আমার গায়ে থুথু ছিটিয়ে চলে যাও।”
ফোপাচ্ছে রুহী। শামির আর কিছু বলতে পারলো না,রাজন ওকে থামিয়ে দিল,রুহীকে বললো,“দুই দিনের প্রেমের জন্য রুহী? ছিঃ”
রুহী কাঁদতে কাঁদতে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তন্ময় ধীর স্থির দাঁড়িয়ে ছিল, এবার শান্ত স্বরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে,“আপনাদের রাগ জায়েজ ভাইয়া। কিন্তু একটু তো বোঝার চেষ্টা করতেন আমাদের! মেয়েটাকে ধরে বেধে বিয়ে দিতে চাইছিলেন! আর কি করতাম?”
শামির আবারও চেঁচায়,“একটাও কথা শুনতে চাই না তোর থেকে। আর রুহী! জাহান্নামে যা তুই! শুনলি তুই? জাহান্নামে যা। বাবার আশেপাশেও যাতে না দেখি আর কখনো তোকে!”
চলমান….