জায়া ও পতি পর্ব-২৫

0
7

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_২৫
#ইসরাত_ইতি

“ব্যথা হচ্ছে আর? থেমেছে না ব্যথা?”

কন্ঠে খুব দরদ ঢেলে জানতে চাইলো অল্পবয়সী নার্সটা জান্নাতের কাছে। চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে জান্নাত। মুখটা ফুলে উঠেছে তার। মুখে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে শুধু মাথা ঝাকালো দুর্বল ভঙ্গিতে। বিগত সাতঘন্টা ছিলো তার জীবনে সর্বোচ্চ দুঃসহনীয় সাত ঘণ্টা। ঘন্টাখানেক আগে ডক্টর তানিয়া ব্যথা নাশক ইনজেকশন কোমরের নিম্নাংশে দিয়ে গিয়েছে। এখন একটু আরাম ঠেকছে বিধ্বস্ত শরীরটার জান্নাতের।

কেবিনে ওর বেডের নিচে মেডিকেল বক্স থেকে আরেকটা স্যানিটারি ন্যাপকিন বের করে জান্নাতের সায়া খানিকটা ওপরে তুলে বলে,“আরেকটা দিয়ে দিচ্ছি। প্রথম সাতদিন ফ্লো খুব বেশি থাকবে। একসাথে দুইটা প্যাড ইউজ করবেন। তারপর ধীরে ধীরে কমবে। আসলে ময়লা নেমে জরায়ু পরিষ্কার হতে একটু টাইম লাগবে তো!”

বিছানার চাদর খামচে ধরে জান্নাত দু’চোখ বন্ধ করে নেয়,চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে উষ্ণ অসহ্য তরল, বুকটা খা খা করে ওঠে। “ময়লা”, এরা ময়লা কেন বলছে ওটাকে এখন? ও কি ময়লা হয়ে গিয়েছে? না থাকুক আর জান্নাতের কাছে, চলে যাক আল্লাহর কাছে। তবে জান্নাত ময়লা শব্দটা শুনতে ইচ্ছুক নয়। ও বাচ্চা ছিল জান্নাতের।

জান্নাতকে কাঁদতে দেখে নার্স রিমি চিন্তিত ভঙ্গিতে হাঁক ছাড়ে, কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ডাকে,“পেশেন্টের হাসবেন্ড কোথায়? পেশেন্টকে সামলান, তার হুশ ফিরেছে। সামলান। পেশেন্টের হাসবেন্ড?”

অ্যাপোলোর ছয় তলায় গাইনী ওয়ার্ডের একটি ভিআইপি কেবিনের লবিতে,একটা স্টিলের বেঞ্চিতে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বসে আছে শামির। চোখ মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই তার। দৃষ্টি দেয়ালে সাঁটানো একটা বিশাল বড় ক্যালেন্ডারে, শেখানে আছে একটা ফুটফুটে শিশুর হাস্যোজ্জ্বল ছবি। শামির চোখ নামায় না ঐ ছবিটার থেকে।

রিজিয়া এগিয়ে গিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,“বাবা যা। কাঁদছে মেয়েটা।”

মায়ের হাতটা প্রথমে সরিয়ে দেয় আলতো হাতে শামির, হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে তার। অফিসের নাম্বার দেখে ফোনটা ছুঁড়ে মারে মেঝেতে প্রচণ্ড রাগে, চেঁচিয়ে উঠে মাকে বলে,“ওকে ন্যাকামি করতে বারণ করো।”

জান্নাত চোখের পানি মোছে হাতের আজলায়,সাথে সাথে আরো দুফোঁটা গড়িয়ে পরে। রিজিয়া শামিরকে শান্ত করতে বলে,“বাবা এসব আল্লাহর ইচ্ছেতে হয়, ওকে কেন দোষারোপ করছিস? কোনো মা কি ইচ্ছে করে করে এসব? এসব হয় আল্লাহর ইচ্ছেতে।”

_আর ও বুঝি আল্লাহর ইচ্ছেতে বৃষ্টিতে ভিজেছিল? ওকে বলা হয়েছিল,“যাও জান্নাতুল, এই অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজে পেটের বাচ্চাটাকে শেষ করো। বলো?”

ছেলের চেঁচামেচিতে নিজেই কাঁপছে রিজিয়া। শারাফাত অ্যাপোলোর চার তলাতে ভর্তি। গোটা বাড়িতে এ কোন বিপদ ঘটে গেল? কোন দিকটা সামাল দেবে সে?

জান্নাতের বাবা মহসিন আর বড় মামা মামী এসেছে রূপাতলী থেকে। জামাইয়ের রাগ দেখে কেউ মুখ থেকে একটা কথা অবধি বের করছে না। সময় যত গড়াচ্ছে, শামির ততো বেশি স্বৈরাচারী পুরুষালি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে সন্তান হারানোর শোকে। একটুও সদয় হয়না জান্নাতের প্রতি, একটুও না। জান্নাত বেডে শুয়ে শুয়ে সেসব শোনে। বারবার বারবার নরম উদরে হাত রেখে পানি ঝরায় দু চোখের।

ডক্টর তানিয়া এসে শামিরের চেঁচামেচি শুনে বলল,“কি হয়েছে? এসব কি করে হলো বলোতো?”

শামির জবাব দেয়না, জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তানিয়া গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ায়, ওকে আস্বস্ত করতে বলে,“আজকাল দশের মধ্যে তিনজন মেয়ের একটা করে মিসক্যারিজ কেস থাকে শামির, এই তো গতকাল একজন এসেছে, দুইমাস বয়স প্রেগন্যান্সির। অটোতে করে দাদা বাড়ি গিয়েছে। অটো থেকে নেমে দেখে মিসক্যারিজ হয়ে গিয়েছে। এসব বিপদ আপদ নিয়ে এতো অধৈর্য হয়ে ওকে দোষারোপ করে তো লাভ নেই। ছোটো মানুষ।”

শামির কিছু বলছেই না। তানিয়া গিয়ে কেবিনে ঢুকলো, জান্নাত পারলো না চোখের পানি মুছে ফেলতে। তানিয়া গিয়ে মাথায় হাত রেখে বলে,“ভেঙে পরো না, আগে সুস্থ হও। শুকরিয়া করো আল্লাহ খুব একটা ভোগায়নি। যে ওষুধ টা দিয়েছিলাম মুখে, চুষে খেয়েছিলে?”

মাথা নাড়ে জান্নাত। তানিয়া জান্নাতের ব্লিডিং চেক করে চলে যায়। তানিয়া চলে যেতেই জান্নাতের মামী শাহিনুর ইনিয়ে বিনিয়ে জামাইকে বোঝায়,“ও জামাই, ও তো বোঝতে পারে নাই। আসলে ছোটো মানুষ, বুদ্ধি শুদ্ধি কম।”

শামির হাসে তাচ্ছিল্যের হাসি,“বুদ্ধি কম? কি বলেন? আপনাদের মেয়ের বুদ্ধি আবার কম! ঐটা আমিও শুরুতে ভাবতাম। তবে ওটা ভুল। ও অতি চালাক। অতি চালাকের যেমন গলায় দড়ি পরে,তেমনি ওরও পরেছে। সাথে আমারো।”

কথা শোনাতে কসুর করবে না বলে পণ করেছে শামির। লবিতে জমায়েত হয়েছে বাড়ির সবাই। রাজন আর সুহানা বুঝিয়ে যাচ্ছে শামিরকে, রাগ-শোকের মাথাতে ওসব ঢুকছে না। আর জান্নাত, নিশ্চুপ হয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।

“বৃষ্টিতে ভিজেছে,বৃষ্টিতে ভিজেছে, যতসব ন্যাকামি। বিয়ের পর থেকে ওর বহু রং আমি দেখেছি। সহ্য করেছি। আমার বাচ্চাটা খুইয়ে তবে শান্তি পেয়েছে বেয়াদব আর বেয়াক্কেল মেয়ে কোথাকার। ওকে বলো এখন গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে, মনে কত রং ওর। বেহায়া মেয়েছেলে।”

এসব শামির খুব রাগে,শোকে বলছে জান্নাত জানে। বাচ্চাটা শামিরের বড্ড আবেগের একটা যায়গা হয়ে উঠছিল। জান্নাতের হঠাৎ মনে আসলো তার জীবনের চরম সত্যিটা। জান্নাতের যেন অস্তিত্ব নেই ঐ লোকের কাছে। তবে তো একটু হলেও বুঝতো জান্নাতকে, দু’টো স্বান্তনা না দিক,একটু নরম হয়ে মাথায় একটু হাত রাখতে পারতো না? আচ্ছা ধরা যাক ঐ বাচ্চায় জান্নাতের মোটেই অংশ ছিলো না, বিজ্ঞান মিথ্যা, ঐ বাচ্চাটা পুরোটাই এই লোকের শুক্রাণু দিয়ে তৈরি। তবুও তো জান্নাত এই লোকের স্ত্রী, এই যে এতো ব্যাথা জান্নাত সহ্য করলো, একটুও কি দয়া আসলো না মনে? সহানুভূতি আসলো না?

__________

সন্ধ্যা নাগাদ আশপাশটা একটু ফাঁকা হলো। তানিয়া এসে বারবার দেখে যাচ্ছে জান্নাতকে। শামির না বাড়িতে গিয়েছে,না জান্নাতের কেবিনে ঢুকেছে। শুধু শক্ত হয়ে বসে আছে লবিতে,একটা সোফায়। জান্নাত টের পায় ঐ লোকটার অস্তিত্ব। শুধু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দরজায়। তানিয়া রহমান মাগরিবের নামাজের পরে যখন এলো, শামিরকে ওভাবে থম মেরে বসে থাকতে দেখে বলে,“কাম অন শামির। শুকরিয়া করো মেয়েটা বেশি ভোগেনি, অল্পতেই উতড়ে গিয়েছে বিপদ। ধৈর্য্য রাখো।”

আশেপাশে তখন বাড়ির লোক ছিলো না, সবাই গিয়েছে চারতলায় শারাফাতের কাছে, শামির তানিয়াকে হঠাৎ বলে ওঠে,“আপু! ওর নেক্সট বেবিতে কোনো প্রবলেম হবে?”

_এই না না, বেবি হবে না কেন বোকা? তবে ও একটু বড় হলেই নিও এবার শামির।

জান্নাত চুপচাপ শুনছে ওদের দুজনের কথা।

“আজ কি ডিশ্চার্জ দেওয়া হবে ওকে?”

ক্লান্ত স্বর শামিরের। তানিয়া রহমান জান্নাতের প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে শামিরকে জবাব দিলো,“এখুনি যেতে পারো। ওর তো কোনো জটিলতা নেই। হসপিটালের থেকে বাড়িতেই ওর মন ভালো থাকবে। তবে শোনো শামির, ব্লিডিংয়ের ব্যাপারে আমাকে আপডেট দিও। তিনদিন পর আবার নিয়ে এসো একবার।”

তানিয়া রহমান চলে যেতেই শামির ঘুরে কেবিনের দরজায় দৃষ্টি রাখলো। তখন সময় রাত আটটা। জান্নাতের ছুটি হয়েছে, ব্যথা পুরোপুরি কমেছে, সেই সাথে কমেছে শামিরের মেজাজের তাপটাও, কিছুটা। তবে রাগ কমেনি। চৌধুরী বাড়ির আর তার শ্বশুর বাড়ির সবাইকে লবিতে, বেঞ্চিতে বসিয়ে রেখে শামির কঠিন মুখ করে কেবিনে ঢোকে। দেখতে পায় জান্নাত জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। আপাতত মনটা একটু থিতু হয়েছে শামিরের। গিয়ে চুপচাপ বসে জান্নাতের বেডের পাশে। জান্নাত না তাকালো,না কথা বললো। যেন সে এই জগতে নেই। শামির ওর ধ্যান ভাঙতে গমগমে স্বরে বলে উঠলো,“ডালিম খাও। খোসা ছাড়ানো আছে।”

জান্নাত চোখ ফেরায় না ওর দিকে,ডালিমও খায়না। শামির শায়নকে কল করে কথা বলল ত্রিশ সেকেন্ড,“তোর ভাবীকে নিয়ে বাড়িতে যাবো। আজ রাতটা বাবার কাছে হসপিটালে তুই থাকবি।”

কল কেটে জান্নাতকে দেখে পুনরায় বলে ওঠে,“ডালিম খাও।”

জান্নাত চোখই তোলে না, ওর এই নির্লিপ্ততায় শামিরের আবারো রাগ উঠলো। ইচ্ছে করলো একটা থাপ্পর মারতে। তবে নিজেকে সংযত করে নিয়ে এবার কৈফিয়ত চাইলো, চেঁচিয়ে উঠলো,“কেন বৃষ্টিতে ভিজেছিলে।”

জান্নাত তখনো জবাব দিলো না, শামির ধৈর্য্য হারা হয়ে ওর চোখে চোখ রেখে জবাব চায়। জান্নাত চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, অতঃপর ধীরে ধীরে বললো,“বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। মন চেয়েছিল বলে।”

_মন চেয়েছিলো বলে? বাচ্চা পেটে তোমার, জানো অসুখ করতে পারে, তবুও মন চাইলে যা খুশি করা যাবে? এতো মন চায় তোমার?

শামির আবারো ভীষণ আবেগী হয়ে ওঠে তার বাচ্চার কথা তুলে। জান্নাতকে কেন জানি হঠাৎ সে আবেগ ছুঁতেই পারলো না,যেমন ভাবে শামিরকে ছুঁতে পারেনি। সে আচানক চেঁচিয়ে উঠলো,“হ্যা মন চেয়েছে বলে ভিজেছি। চায়না মানুষের মন কতকিছু? কতকিছুই তো চায় এই মন। এই যেমন আপনার মন চায় আমাকে আদর করতে রাতে। বাচ্চার ঝুঁকি হতে পারে জেনেও আমায় আদর না করে থাকতে পারেন না, আমিও বাচ্চার ঝুঁকি আছে জেনে বৃষ্টিতে না ভিজে থাকতে পারিনি। বাচ্চার ঝুঁকি থাকতে পারে জেনেও আপনি আমাকে দেখে সামলাতে পারেন না নিজেকে, আমিও পারিনি বৃষ্টি দেখে নিজেকে সামলাতে। এমনই তো মন আমাদের। বেহায়া মন।”

জান্নাতের কথাগুলো শুনে শামিরের মুখ থেকে যেন রক্ত সরে গেল,পর পর আবার লাল হয়ে উঠলো মুখটা। বিস্ময়ে হতবাক শামির কিছু বলতে যাবে তার আগে জান্নাত আবারো বলে ওঠে,“কি করবো বলেন। এই মন তো! এই সর্বনাশা মন কত কিছুই চায়। আপনি পুরুষ বলেই সব আপনি একাই চাইবেন? আমি চাইবো না?”

জান্নাতের থেকেও দ্বিগুণ জোরালো ছিলো শামিরের ধ’ম’ক,রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠে বলে,“থাপরাতে থাপরাতে গাল ফাটিয়ে দেবো বেয়াদব মেয়ে। চোখ নামা, নামা বলছি।”

জান্নাত পাল্টা জবাব দিলো,
_নামাবো না। নামাবো না চোখ। কি করবেন?

বড় বড় শ্বাস ফেলছে শামির। ওদের চেঁচামেচি ততক্ষণে বাইরে পৌঁছেছে। বাইরে থেকে ছুটে এসেছে বাড়ির সবাই, এসেছে জান্নাতের বাবা,মামা,মামী।

_কি হয়েছে?
রিজিয়া হতভম্ব হয়ে ছেলে আর ছেলের বৌয়ের মুখ দেখে। শামির চেঁচিয়ে ওঠে,“একটা অসভ্য এই মেয়ে। চরম অসভ্য।”

শাহিনুর কটমট দৃষ্টিতে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বললো,“একটা থাপ্পড় খাবি ছেড়ি। এইডা হাসপাতাল। স্বামীর অসম্মান করো এইভাবে চিল্লাইয়া। বেকুব বলদা ছেড়ি,জীবনে আক্কেল হবে না তোর।”

_আর উনি যে আমার অসম্মান করেছে সারাটা দিন চিল্লিয়ে। সবাইকে শুনিয়েছে আমি আমার বাচ্চা খুন করেছি সে বেলায়?

পেটে হাত চেপে জান্নাত হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। মহসিন মেয়েকে ধমকায় ,“তো বব্বোরের মতো বৃষ্টিতে ভিজছিলি কেনো? এটা কোনো যুক্তির কথা? তুই ছোডো গুঁড়া গাড়া? তুই বোঝো না?”

_না আমি ছোটো নই, আমি বড়ও নই, আমি যে কি আসলে আমি সেটাই জানি না। তোমরা সবাই আলোচনা করে আমাকে বলো। আমি কি?

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পরে জান্নাত। শামির ফুঁসছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। রিজিয়া কোমল স্বরে জান্নাতকে বললো,“রাগের মাথায় বলে ফেলেছে বৌমা ওসব কথা। বোঝো না ওর প্রথম বাচ্চা?”

_বুঝি তো, বুঝব না কেন আম্মা? যেটা যায় সেটা ওনার যায়, যেটা থাকে সেটা ওনার, যেটা হবে সেটা ওনার। সবটাই ওনার, উনিই সব, বুঝবো না কেন! ভুল হয়ে গিয়েছে আমার,আমি ওনার বাচ্চাকে মেরেছি, আসলে মূর্খ মানুষ তো। আমি সত্যিই জানতাম না এন্টি বায়োটিক খারাপ কিছু, গর্ভাবস্থায় কত কিছু মেনে চলতে হয়, জানতাম না আমী। এসব বলার কেউ আছে আমার? কেউ তো নেই, মা নেই, আমি যে এতিম। উনি সম্ভবত ভুলে গিয়েছেন।

শামির হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে জান্নাতকে দেখলো। জান্নাত হাঁপাতে হাঁপাতে বসলো বেডে। তার শরীরটা ভেঙে চুরে আসছে। শামির ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বলে,“আপনারা সবাই বাইরে যান।”

এরপর জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,“তৈরি হও। বের হবো।”

_কোথায় যাবো?

_বাড়িতে।

_বাড়িতে যাবো না।
জান্নাতের ঠান্ডা গলায় জবাব।

_বাড়িতে যাবো না মানে?
চোখ বড়বড় হয়ে আছে শামিরের।

_বাড়িতে যাবো না মানে আমি আপনার সাথে বাস করতে চাইনা।

কথা গুলো বলেছে জান্নাত ধীরে ধীরে,থেমে থেমে। ওখানে দাঁড়ান সবাই চূড়ান্ত হতবাক হয়ে জান্নাতকে দেখে। শামির থমথমে গলায় বলে,“এ্যাই ,এ্যাই, এ্যাই। আমার সাথে বাস করতে চাওনা মানে?”

_আমি তালাক চাই।

জান্নাতের মুখ দিয়ে কথাটা বের করতে দেরী,শামিরের বলিষ্ঠ হাতের এক চ’ড় ওর গালে পরতে দেরী নেই। জান্নাত এক চ’ড়ের ধাক্কা সামলাতে পারেনি অসুস্থ শরীরে। পরে যেতে নিলে সুহানা এসে ধরলো।

শাহিনুর শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ছিঃ ছিঃ করে ওঠে,“ছিঃ এইসব কেমন কথা বেয়াদব ছেড়ি। পাপ হইতেছে তোর পাপ। ছিঃ।”

জান্নাত জবাব না দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,“আমি তালাক দিতে চাই উনাকে। আমি বাস করবো না এই লোকের সাথে।”

সুহানার কাছ থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো জান্নাতকে শামির। টেনে নিজের কাছে এনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে,“সাহস কি করে হয় তোমার? তুমি কে তালাক দেওয়ার? মেয়েরা তালাক দেয়? জানো না কিছু? এই তোমার নষ্ট রূপ‌। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ো নাকি তুমি? ভণ্ড কোথাকার!”

দুর্বল হাতে শামিরকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল জান্নাত, ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,“পাপ পূণ্য বোঝেন আপনি? আপনি কয় ওয়াক্ত নামাজ পড়েন শুনি তো। আপনি তো সেই পুরুষ যারা নামাজের ধারে কাছে যায়না অথচ নামাজী বৌ চায় তাদের আঁচল ধরে বেহেশতে যাবে বলে। খুজেছিলেন না বিয়ের আগে তাই নামাজী বৌ? আপনি পাপের কথা বলবেন না আমাকে। পাপ হোক,একটু না হয় পাপ হোক। একটু হোক।”

কেঁদেই যাচ্ছে জান্নাত বুকে হাত চেপে । ওকে বকাবকি করছে সবাই। ছিঃ ছিৎকারে ভারি হয়ে উঠছে কামরা। জান্নাত সহ্য করতে পারছে না এতো লোকের এতো ভণ্ডামি,কান চেপে ধরে চেঁচাচ্ছে,“আমি থাকবো না এই লোকের সাথে। পারবো না আর থাকতে। সত্যিই পারবো না।”

শামির আবারো ওকে টানলো,চেপে ধরে বলল,“তাই নাকি? থাকবে না! তা যাবে কোথায়? কোথায় যাবে তুমি? শুনি তো? কোথায় স্থান হবে তোমার?”

সবথেকে দুর্বল জায়গাটিতে খোঁচা বসেছে জান্নাতের। রাগে রক্তিম শামিরের মুখে বিদ্রুপ আর তাচ্ছিল্যের হাসি। ভেবেছে জান্নাতকে বাস্তবতা চিনিয়ে দিয়েছে, তবে জান্নাত আজ বাস্তবতার উর্দ্ধে চলে গিয়েছে, হাতটা সরিয়ে দেয় সে শামিরের। তলপেটে ভীষণ ব্যথা। পেট চেপে রেখেই বলে,“কোথায় আবার? গার্মেন্টস আছে না? গার্মেন্টস করে খাবো।”

শামির দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহসিনের দিকে তাকায় , চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,“আব্বা আপনার মেয়েকে বোঝান,নয়তো ও আমার হাতে খুন হবে আজ।”

মহসিন এবার মেয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকায়,“জান্নাত জামাইকে অসম্মান করিস না খবরদার।”

জান্নাত বলে,“কেন? আমাকে তালাক দিতে অসুবিধা কি আপনার? আগের বৌটাকে তো এক তুড়িতে ছেড়েছেন। আমাকে কেন ছাড়তে চাইছেন না? কারন আমার মতো মদন আপনি আর পাবেন না তাইনা? কিন্তু আমি তো কারো মদন হয়ে থাকতে চাইনা। আমি বৌ হতে চাই, যেখানে বাচ্চা আসলে দু’জনের আসে, বাচ্চা চলে গেলে দু’জনের যায়। বাচ্চা চলে গেলে কষ্ট যে দু’জনের হয়,এটা অন্তত বোঝে দু’জন।”

শামির থমথমে মুখে জান্নাতকে দেখছে। জান্নাত চোখের পানি মুছে আশেপাশে তাকিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যায়, ওর বেডের মাথার কাছে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কাঁপা হাতে ফোনটা বের করে,কল দেয় মেধার নাম্বারে, মেধা রিসিভ করতেই জান্নাত কেঁদে দিল,“মেধা আপু। তোমার কাছে কি একটা চাকরি হবে? তোমার এনজিওতে। আমার এস.এস.সির সার্টিফিকেট দিয়ে যেটা পাওয়া যায় পাইয়ে দাও। হাত জোড় করছি তোমাকে।”

শামির এসে এক আছাড়ে জান্নাতের ফোনটা ভাঙলো। এবার ধরলো জান্নাতের চুলের মুঠি, চোখ রাখলো জান্নাতের চোখে,“খবরদার জান্নাতুল। বারবার বলছি। সীমা ছাড়িয়ে যেও না।”

জান্নাতের চোখের কার্নিশ বেয়ে স্বৈরাচারিতার প্রতিবাদের অশ্রু গড়িয়ে পরছে, লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলে,“একটু ছাড়িয়ে দেখবো। আমি দেখবোই।”

শামির জবাব দিলো,“আচ্ছা! খুব সাহসী হয়ে উঠেছো না? পারলে এই কাজটা করে দেখাও!”

চলমান…….