#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_২৭
#ইসরাত_ইতি
রিজিয়ার কথায় তানভীর আর সিয়াম বহু খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে শামিরকে পেলো এখানে,এই নদীর পাড়ে । ওকে পেয়েই সিয়াম রিজিয়া বণিককে কলে আশ্বস্ত করে বলল,“খালাম্মা পেয়ে গেছি। আপনি খালুর দেখাশোনা করেন। ওকে পাঠিয়ে দেবো বুঝিয়ে।”
শামির রাত দুইটার সময় ওর দুই বন্ধুকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না, উল্টো সিগারেট ধরিয়ে নদী দেখতে থাকে।
তানভীর রাস্তার ঢাল বেয়ে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“শা’লা ঝাপ দিবি নাকি?”
শামির জবাব দেয়না। তানভীর আর সিয়াম গিয়ে ওর দু’পাশে বসলো। সিয়াম বড্ড নমনীয় স্বরে বলতে লাগলো,“একটু ঠান্ডা হ। বেচারী বাচ্চা হারিয়েছে, তার ওপর ঐ ধরণের কথা শুনিয়েছিস। রাগে দুঃখে এমন করছে। নয়তো আমাদের সুইটেস্ট জান্নাতুল ভাবী এমন করে?”
_আমার মাথায় রাগ নেই। আচ্ছা তোরা আমাকে একটা কথা বলতো, আমি দেখেছি ও কেমন উদাসীন থাকতো। প্রেগন্যান্সিতে একটু ভালোবেসে কথা বললেও সাড়া দিতো না, কেমন গম্ভীর হয়ে থাকতো, নিজের যত্ন নিতো না। প্রেগন্যান্সির মুড সুইং আলাদা, সেগুলো আমি বুঝি। তবে নিজের ও বাচ্চার যত্নের উদাসীনতা দেখার পরে আমি ওর ব্যপারে কি ভাবতাম? ও বাচ্চাটাকে নিয়ে খুশি না তাইতো?
শামিরের এই কথায় তানভীর সামান্য হেসে বলে,“এর পেছনে একটা ব্যাপার আছে। তুই আগে ভাবীকে যে যে সুবিধা গুলো দিতিস না, হঠাৎ ভাবী কনসিভ করায় বাচ্চার খাতিরে সেসব দিয়েছিস, এই বিষয়গুলো ভাবীর অভিমান বাড়িয়ে দিয়েছে তোর উপর। ভাবীর সাবকনসাস মাইন্ড ধরে নিয়েছে তুই ভালোবাসিসই না তাকে, এমনিতেও তো তোর রাক্ষসের মতো ন্যাচার। এই সব বিষয় গুলো খুব ইফেক্ট ফেলেছে ভাবীর মাইন্ডে,তার ওপর প্রেগন্যান্সির মুড সুইং তো আছেই। সবটাই তোর মনের ভুল শামির, জান্নাতুল ভাবীর মতো মেয়ের মনে নিজের সন্তানের জন্য অনীহা থাকবে?”
সিয়াম বলল,“আসলে তোদের দু’জনের এখন সাইক্রিয়াটিস্ট প্রয়োজন।”
তানভীর সিয়ামের কথায় আপত্তি জানিয়ে বললো,“সাইকোলজি পুরোপুরি ভুজুং ভাজুং ব্যাপার জানিস? ওদের দু’জনকে দু’জনের বুঝতে হবে,কোনো থেরাপিস্ট কিচ্ছু করতে পারবে না। ভাই শামির,ভালোয় ভালোয় বলছি,সময় থাকতে রাগ কমা। জান্নাতুল ভাবী যথেষ্ঠ ধৈর্য্য দেখিয়েছে। আমার সুপ্তি হলে এতদিনে…..”
ফোন বেজে ওঠে শামিরের হঠাৎ। সুহানাকে কিছুক্ষণ আগে কল করেছিলো,তখন ধরতে পারেনি দেখে কল ব্যাক করেছে। উদ্বিগ্নতা শামিরের কন্ঠে,জানতে চাইলো জান্নাতের কথা,“কি করছে?”
_এইতো ওর কাছেই ছিলাম, ঘুমাচ্ছে এখন।
_আচ্ছা কিছু লাগলে জানিও,টাকা পয়সা বা….
_তুমি কি আসবে?
সুহানার এই প্রশ্নে চুপ করে রয় শামির। সুহানা বলে ওঠে,“একটু শান্ত ঠেকলো এখন। তুমি কি আসবে?”
_নাহ, আজ রাতে না। মাথাটা ঠিক নেই আমার, আবার বেয়াদবি করলে নিজেকে আটকাতে পারবো না,খুনাখুনি হয়ে যাবে।
কলটা কেটে থমথমে মুখে বসে থাকে শামির। মেয়েটা তাকে টানছে, খুব টানছে। নির্বোধ হলেও শামিরের বড্ড আদরের বৌ। মনে পরে যায় শামিরের হঠাৎ সে দিনগুলো, ঐ যে রূপাতলী গিয়ে দেখা হয়েছিলো খুব সাধারণ পোশাকে আবৃত এক লজ্জাশীলা মুর্তির সাথে। যে খুব ছটফটে ছিল না, ছিলো শান্ত নদীর মতো। ঐ দিন বিকেলে শামিরের নজরে পরেছিল মেয়েটিকে, দড়িলাফ দিতে গিয়ে মাথা থেকে ওড়না খসে পরাতে,বুক থেকে ওড়না সরে যাওয়াতে খেলা বাদ দিয়ে নিজের লজ্জা ঢেকে নিয়েছিল আগে। খুব স্নিগ্ধ শীতল লেগেছিল শামিরের কাছে দৃশ্যটা। তারপর সেদিন রাতেই যখন শামির শামা ভেবে ওর হাত টেনে ধরেছিল, আর মেয়েটা ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাপাচ্ছিল,ঠিক সেসময় শামিরের মনে হয়েছিল অমন পবিত্র নারী সে বোধহয় দেখেইনি তার জীবনের নারী সংক্রান্ত অভিজ্ঞতায়। হুট করে কি হয়েছিল তার সে জানে না! রাতে ঘুমাতে পারেনি ঠিক করে, মেয়েটার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখেছে মেয়েটা খুব কষ্টে বড় হয়েছে,এর মনটা খুব নরম, কোনো খারাপ কথা কেউ বলতেই পারেনি মেয়েটির সম্পর্কে। হঠাৎ খুব চমৎকার লেগে গিয়েছিল ঐ মেয়েটিকে। তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল,এই মেয়েটাকে তার লাগবে। তাই আর কিছু না ভেবেই প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছিল খালুর কাছে। বিয়ের পর মেয়েটার মনে যায়গা করতেও শামিরের খুব কষ্ট হয়নি। একটু আচার,একটু আদর,নরম দু’টো কথা। এসব হলেই হতো। এই মেয়ে তো বিলাসিতা কিছু দেখেনি। শামির যা দিতো সেটাই অনেক কিছু মনে করতো। সেই মেয়ে এমন হলো? এতো জটিলতা তৈরি করে নিলো শামিরের সাথে অযথা, অকারণে?
চোখ মুখ ধীরে ধীরে কঠিন হয় শামিরের। ঐ মেয়ের জন্য কতকিছু করেছে সে, আর ঐ মেয়ে স্বামীর দু’টো ধমক আর একটা চ’ড়ের বিরুদ্ধে এভাবে গর্জে উঠলো? এটা মানা যায়? তাও পড়াশোনার জের ধরে।
সব ঐ বেগম রোকেয়ার বাচ্চার দোষ। অসভ্য মহিলা নিজেও বেয়াদব ছিলো,আর ওর স্বামী ছিলো আস্ত একটা বলদ। ঐ বিগড়ে যাওয়া মহিলার জন্য আজ সমাজে এতো অধঃপতন,ঘরে ঘরে সীমা লঙ্ঘনের বিদ্রোহ। আরে যার মন চাইবে সে তার মেয়ে বৌ পড়াবে,যার মন চাইবে না সে পড়াবে না। তোকে এতো ধরে ধরে সকলকে উদ্বুদ্ধ করতে কে বলেছিল অসভ্য “বালপাকনা” মহিলা?
জান্নাতুলের ওপর থেকে রাগ সরে গিয়ে বেগম রোকেয়ার ওপর আছড়ে পরলো, কিছুক্ষণ বকলো তাকে মনে মনে। ঠিক সেসময় শামিরকে কল করলো শায়ন, ওপাশ থেকে থমথমে গলায় বলল,“তোমাকে একটা নিউজের লিংক পাঠাচ্ছি। দেখো ভাইয়া!”
_________
অ্যাপোলোর সামনে শামির জান্নাতকে নিয়ে টানাটানি করছে! ছবি দু’টো বরিশাল নিউজ পোর্টাল থেকে আপলোড দেয়া হয়েছে। হেডলাইন লেখা,“অসুস্থ স্ত্রীকে মেরে ধরে গাড়িতে তুলছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ভার্সিটি স্টুডেন্টের সাথে স্বামীর পরকীয়ার গুঞ্জন, স্ত্রী যাবেন না স্বামীর সাথে।”
নিউজটা পাঁচ মিনিট আগে প্রচার হয়েছে। এতক্ষণে রাগে ফেটে পরলো শামির, লাভা ঝরছে তার দু’চোখ থেকে। দাঁতে দাঁত চেপে পাঁচ মিনিটে বরিশাল নিউজের এডিটরের নাম্বার যোগার করে খেকিয়ে উঠলো,“পাচ মিনিটে এই নিউজ সরাবি তুই দায়িত্ব নিয়ে মা*****। নয়তো তোর অবস্থা খুব খারাপ করবো আমি। চিনিস আমাকে? তোর এমডিকে কল করার আগে এই ভিডিও সরা, নিউজ সরা চো*না।”
রাগে মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে। এডিটর ভয় পেয়ে কল কাটে। শামিরের রাগটা সীমা ছাড়িয়ে পরলো, এতক্ষণে আবারো ঐ নির্বোধ মেয়েটার ওপর ক্রোধে গা কেঁপে উঠছে তার। এই দিন দেখার বাকি ছিল শামিরের? ঐ এক রত্তি মেয়ে তাকে শেষ করে দিচ্ছে! তবে আশ্চর্য শামির ওটাকে ঘাড় ধরে তালাক দিতে পারছে না,ফারিনকে যেভাবে দিয়েছিল !
নদীর পাড় থেকে উঠে শামির দ্রুত পায়ে গাড়ির কাছে যেতে নিলে তানভীর বললো,“কই যাচ্ছিস এতো রেগেমেগে? এডিটরের বাসায়? ওর বাসা জিরো পয়েন্টের ওখানে,চিনি আমি।”
শামির কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দিলো। সে এডিটরের বাসায় যাচ্ছে না, সে যাচ্ছে ঐ মেয়ের কাছে। যথেষ্ট হয়েছে, এখন গিয়ে ঘাড় ধরে আনবে বেয়াদবটাকে, এতো বড় কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পরলো শামির ঐ মেয়ের জন্য। আর লোক হাসিয়ে কাজ নেই।
শামিরকে দেখে সুহানা বেশ অবাক হলো। শামির বাড়িতে ঢুকে তাঐ মাঐয়ের সাথে কুশল বিনিময় করেই হন্তদন্ত হয়ে গেলো সুহানার দেখিয়ে দেয়া রুমে। ভাবটা এমন যে, এক্ষুনি বের করবে ওকে শামির ঘাড় ধরে, প্রয়োজনে বেঁধে নিয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে হাতা গুটিয়েই থামলো শামির দরজাতে। ভেতরে চোখ যেতেই দেখলো বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে জান্নাত। এক রাশ ক্লান্তি লেপ্টে আছে মুখটাতে। ঠিক তখুনি ফজরের আজান দিয়েছে । সুহানা এলো ঠান্ডা এক গ্লাস পানি নিয়ে। দেবরের রণমুর্তি দেখে ভয় পেয়ে সুহানা থেমে থেমে বললো,“নিতে এসেছো? এখন ঘুম থেকে উঠাবো?”
পানিটা খেয়ে শামির হাঁফ ছেড়ে জান্নাতের ঘুমন্ত মুখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,“না ঘুমাক। সকালে যাবো।”
সুহানা শামিরকে রাজনের কিছু ধোঁয়া পোশাক এনে দিলেও শামির পরলো না ,কিছু খেলোও না। দরজা বন্ধ করে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পরলো জান্নাতের পাশে। শুতে গিয়ে দেখলো জান্নাতের মাথাটা বেঁকে আছে, শক্ত হাতে সেটা ঠিক করতে গিয়ে থামলো শামির। অনিমেষে চেয়ে থাকলো মেয়েটার মুখের দিকে, কপাল কুঁচকে।
উহহ,ঘুমাচ্ছে দেখো! মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে সদ্য জন্ম নিয়েছে । অথচ কি জটিল মেয়ে! এই মেয়ের মুখ দেখে শামির কিনা ভেবেছিল নাদান?
মেজাজটা হারায় আবার শামির, ইচ্ছে করছে এক্ষুনি একটা থাপ্পড় মারতে, হাত টা নিশপিশও করছে। তবে এতে বিপদ! কাল সকালে এটাকে যেভাবে হোক নিতেই হবে এখান থেকে। বৌ রাগ করে অন্যের বাড়িতে থাকছে এটা লোক জানাজানি হলে মুখ দেখাতে পারবে শামির চৌধুরী?
হাত সরিয়ে নিয়ে শামির শোয়,এখন ঘন্টাখানেক সেও ঘুমাবে। তার শরীরটাও বড্ড ক্লান্ত। মানসিক ও শারীরিকভাবে কম বিধ্বস্ত নয় সে।
দীর্ঘ এক রাত টানা ঘুমিয়ে শরীরটা হালকা হয়েছে জান্নাতের। তবে তলপেটে এখনো চিনচিনে ব্যাথা। পেটে হাত চেপে চোখ খুলে কাত হতেই জান্নাত লাফিয়ে উঠলো একপ্রকার, ওর খুব নিকটে ছিলো লোকটা,মাথার নিচে হাত রেখে ঘুমোচ্ছে বেঘোরে।
ব্যথাতুর শরীরটা নিয়ে উঠে বসে জান্নাত বুকে থুত্থুরি দিয়ে চোখের কোটর প্রশ্বস্ত করে তাকিয়ে থাকে লোকটার মুখের দিকে। আবারো বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এই লোক তার মান ভাঙাতে এসেছে? নাকি জবরদস্তি করতে এসেছে? কোনটা?
এক ঘন্টার স্থলে তিন ঘন্টা শামির ঘুমিয়েছে। ভোরের কড়া আলো জানালার পর্দা উড়ে যাওয়াতে পরলো এসে তার মুখে, চিড়বিড়িয়ে উঠলো গাল। চোখ না খুলেই মেজাজ দেখিয়ে বললো,“ধূর বাল, এই জানালা বন্ধ করে দাও তো জান্নাতুল।”
জান্নাত তাকিয়েই থাকে। শামিরের হঠাৎ খেয়াল হলো পরিস্থিতি। চকিতে চোখ খুলে তাকায় জান্নাতের দিকে।
কামরা জুড়ে পিনপতন নীরবতা। না শামির কথা বলছে,না জান্নাত। এর মাঝে সুহানা এসে দরজায় নক করে ডাকলো,“ভাইয়া। জান্নাতুলের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে, ওকে ডেকে দাও।”
শামির উঠে হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে দিতেই জান্নাত চোখ মুখ কঠিন করে ফেললো, গতকালের কাহিনী গুলো ক্রমান্বয়ে ভেসে উঠলো চোখের সামনে,শক্ত গলায় বললো,“কেন এসেছেন?”
সাত সকালে মেজাজটা আবার বিগড়ে গেলো জান্নাতুলের আচরণ দেখে, কত নষ্ট হয়েছে মেয়েটা, এক রাত্তিরের পরেও স্বামীর সাথে তেজ দেখাচ্ছে। অধৈর্য হয়ে তেড়ে গেলো জান্নাতের দিকে শামির, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,“তোকে নিতে এসেছি! কি কেলেঙ্কারি করেছিস জানিস? আমার মান সম্মান ডুবতে ডুবতে ডুবলো না গতকাল তোর জন্য ফাজিলের বাচ্চা!”
জান্নাত গুটিয়ে গিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখের পানি আর আনতে চায়না সে, তবুও আসে। শামির বলতে থাকে,“স্ত্রী চরিত্রহীনা না হলে তাকে ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিৎ। আমি ঐটাই করছি। নয়তো তোর মতো একটুখানি তালের আঁটি আমার ধৈর্য্য নিয়ে খেলছে ভাবা যায়? শামির এতো কসরত করছে তোর জন্য!”
শাড়ির আঁচল খামচে ধরে আবারো নাক টেনে বলে ওঠে জান্নাত,“তো আসছেন কেন যখন আমি এতোই তুচ্ছ? আসতে তো বারণ করেছি!”
গিয়ে এবার ওর চোয়াল চেপে ধরলো শামির, চেঁচিয়ে উঠলো,“বৌ তুই আমার। আসবো না? তুই আসতে নিষেধ করার কে? এতো অসহ্য হয়ে উঠেছে স্বামী এখন? এতো স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতার নেশা? তাহলে চল তোকে শাহবাগে ছেড়ে দিয়ে আসি। ওখানে তুই ল্যাংটা হয়ে দাঁড়িয়ে অধিকার অধিকার করতে পারবি নিশ্চিন্তে। আমি ফিরেও তাকাবো না বান্দর কোথাকার!”
ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে জান্নাত সুহানার দিকে তাকায়,“ভাবী এই লোক এসব কি বলছে? তুমি একে ঢুকতে দিলে কেন? আচ্ছা আমার ফোন দাও, বাবুগঞ্জ আমার এক বান্ধবী থাকে। আমি ওখানে চলে যাবো।”
তরতর করে বেড়ে চলেছে মেজাজ শামিরের। পারছে না জান্নাতের গাল ফাটাতে, শুধু হাতটা ধরলো ওর, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,“আসলে তোকে কি করা উচিত জানিস? রূপাতলী তোর ঐ মামা বাড়ি কিংবা তোর সৎ মায়ের ঘরে রেখে আসা উচিত কয়দিনের জন্য। তবে তোর শিক্ষা হতো,বুঝতি জীবন কি, বাস্তবতা কি। বাট আমি তো এইটা করতে পারবো না, আমি তো কাপুরুষ না যে বৌকে খাওয়া পরার কষ্ট দিয়ে রাখবো।”
ওকে ছিটকে সরিয়ে দেয় জান্নাত, সেও চাপা রাগ উগড়ে দেয়,“হ্যা আপনি সুপুরুষ। আমার মতো বিগড়ে যাওয়া মেয়ের জন্য এতো হেদিয়ে মরতে হবে না। তবে আমি জানি জীবন কি, আপনার বোঝাতে হবে না। জীবন কি এটা আমার মা মরে গিয়ে বুঝিয়েছে আমাকে ,আমার আব্বা আরেকটা বিয়ে করে আমাকে মামাবাড়ি ফেলে রেখে বুঝিয়েছে, আমার মামা মামী টাকার লোভে পরে আপনার সাথে বিয়ে দিয়ে বুঝিয়েছে, আর শেষে এসে আপনি বুঝিয়েছেন যে জীবন আসলে কি। আমি জীবন বুঝে গিয়েছি,তাই আর কিছু বোঝার নেই।”
_আমি জীবন বুঝিয়েছি তোকে মানে? আমি তোকে অতিরিক্ত শাসন করি? তুই পোটকামি করিস বলেই তো রাগ দেখাই! অকারণে কখন তোকে ধমকেছি বল? বল!
কাঁদতে কাঁদতেও ফিচেল হাসলো জান্নাত,চোখ মুছে বললো,“অথচ আমি কিছুই করি না যেগুলো আপনার কাছে পোটকামি মনে হয়। কিছুই করি না আমি।”
সুহানা পরেছে বিপদে, দুই জনকে সে একসাথে কি করে সামলাবে? ঢোক গিলে শামিরকে বললো,“ভাইয়া ও আর দু’টো দিন এখানে থাকুক। মাথা ঠান্ডা হলে…..”
_মাথা ঠান্ডা মাই ফুট! ওকে যেতে হবে, তালাক দেবো কি দেবো না সেটা পরের বিবেচনা । এখন ও আমার বৌ,যেতে হবে মানে হবেই।
চেঁচিয়ে যাচ্ছে শামির। জান্নাত যাবেনা পণ করেছে, একটা গোটা রাত পরেও এই লোকের এই মূর্তি? একটু নরম হয়নি লোকটা, একটুও না।
শামির ওকে টানছে,“আমি এমন,তোর স্বামী এমন। এটা মেনেই সংসার করবি তুই। যদি ভেবে থাকিস, বা পরিকল্পনা করে থাকিস তুই রাগ দেখিয়ে তিন চারদিন এখানে থাকবি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে তিনদিন পর এসে তোর পা ধরে নিয়ে যাবো তাহলে তুই ভুল। আমার কোনো ভুল নেই যে আমি স্বীকার করবো। আর তিনদিন পর এলেও তোকে থাপড়েই নিয়ে যাবো এত এত বেয়াদবি করার জন্য আমার সাথে। অসভ্য মেয়ে।”
জান্নাত শ্বাস ফেলে বড়, এই লোকটা তার মন পড়লো কিভাবে? লোকটা সত্যিই বলছে,জান্নাতের মনে ক্ষীণ ইচ্ছে ছিলো, লোকটা যদি সকালে এসে জান্নাতকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিতে চায়, জান্নাত হয়তো গেলেও যেতে পারে। কারণ জান্নাতের হাতে আর কি অপশন আছে? তাছাড়া যেভাবেই হোক,জান্নাতের জীবনের এই একমাত্র পুরুষটাকে জান্নাত ভালোবেসেছে । এতো সহজে জান্নাত তো পারে না স্বামীকে ছাড়তে। তবে এখন জান্নাত হতাশ। এই লোক আবার তার গলার ফাঁস হয়ে এসেছে, মালা নয়। এই লোক পণ করেছে মালা সে হবেই না, মালা হলে এই লোকের পৌরুষ খাঁটো হবে।
সুহানার বাবা-মা এসে শামিরকে ঠান্ডা করতে চাইলে পারলো না। শামির বৌ নেবে মানেই নেবে। আর জান্নাত যাবে না মানে যাবেই না। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে জান্নাত খেই হারিয়ে লোকটার হাত কামড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল প্রত্যেকে। জান্নাত কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গিয়ে আরেক রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আর শামির নিজের হাতের দিকে প্রকট বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকলো। এই অপমানের কি জবাব দেবে শামির জানে না, শুধু টের পেলো এক্ষুনি এখান থেকে না বেড়িয়ে গেলে হয়তো দরজা ভেঙে ঐ অসভ্য ফাজিল মেয়েকে খুন করতেও তার বাঁধবে না।
শামির গটগট করে বেড়িয়ে যায়, সুহানা পরেছে ভারি বিপদে। পেছন থেকে ডাকছে,“ও ভাইয়া শান্ত হও। এখন ড্রাইভ করার দরকার নেই, তুমি ঠিক নেই। একটু বসো, আমি জান্নাতকে বোঝাচ্ছি।”
শুনলো না শামির,গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলো। আর জান্নাত দোতলার জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শুধুই দেখলো চোখ ভরা জল নিয়ে।
সুহানা এসে ওকে বুঝিয়েও কিছু খাওয়াতে পারলো না। লোকটা গিয়েছে এক ঘণ্টা হয়েছে মাত্র। জান্নাত সেই ঘোর থেকেই বেড়োতে পারছে না। জান্নাত আসলেই বিগড়ে যাওয়া মেয়ে? সে স্বামীভক্ত নয়? সে উজাড় করে তার বাধ্যতা দেয়নি ঐ লোককে? এমন কথা কি করে পারলো লোকটা বলতে? জান্নাত বেশি বেশি চায়? কি চায় জান্নাত? একটু বাইরের হাওয়া,একটু বৃষ্টি কিংবা ঘরের সামনের বাগান। এসব বেশি বেশি চাওয়া? পড়াশোনার জেদ তো সে করেই না। তবে জান্নাত কি বেশি চায়? সবাই বলছে যা আছে তাই নিয়ে শুকরিয়া কর জান্নাত। জান্নাত অনেক কিছু পেয়েছে দেখে আর চাইতে পারবে না? চাইতে পারবে না শাড়ি গয়নায় মুড়িয়ে রাখুক তার স্বামী নিজের মন মতো করে, বন্দী বানিয়েও রাখুক, অন্তত জান্নাতকে না বকুক। জান্নাত পায়েই পরে থাকবে লোকটার। এগুলো জান্নাতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা? কি করা উচিত তবে? শ্বাস নেওয়াও বন্ধ করা উচিত? লোকটা তাকে শুধুই বাস্তবতা বুঝিয়ে যাবে? তবুও জান্নাতের জন্য একটা কোমল বাস্তবতা হতে পারবে না?
দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে বসে কাঁদছে জান্নাত। হঠাৎ করেই তার কেমন নিঃস্ব লাগতে শুরু করেছে, বুকটা পুড়ছে। ঠিক সেই সময়ে সুহানা এলো ছুটতে ছুটতে, দরজার দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,“জান্নাত ভাইয়া অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।”
চলমান……