জায়া ও পতি পর্ব-২৮

0
2

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_২৮
#ইসরাত_ইতি

বরিশাল নেভাল একাডেমীর কাছাকাছি বিধ্বস্ত গাড়িটা দুই ঘণ্টা যাবত পরে আছে। আশেপাশে লোকজন দাঁড়িয়ে নিজেরা নিজেরা কিছু একটা বলাবলি করছে। জান্নাত নির্বাক হয়ে দেখছে সিএনজির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে, যতদূর অবধি দেখা যায়,দেখেই চলেছে সে !

সিএনজির ড্রাইভার কন্ঠে উত্তেজনা নিয়ে বলছে,“দেখছেন যায়গাটা দেখছেন? একটু হইলেই গাড়ি নিয়া এই ব্রিজ থেকে নদীতে পরতো। আচ্ছা এইটা কোনো কথা? এই সকাল সকাল এইখানে কে এসে এক্সিডেন্ট করে? উনি নাকি চৌধুরী লঞ্চের মালিকের ছেলে। এইসব বড়লোক, সারারাত নেশা টেশা করে কোত্থেকে আসে কে জানে?”

সিএনজি চালক কথা বলে শেষ করতে পারলো না, তার ওপর চেঁচিয়ে উঠল জান্নাত,“আমার স্বামী নেশা করেনা। একদম চুপ করেন। একদম চুপ।”

সুহানা ওকে ধরলো জড়িয়ে। জান্নাত ডুকরে কেঁদে উঠে গা এলিয়ে দিলো সিটে। অসহায় দৃষ্টি তার সিএনজির জানালা থেকে ছাড়িয়ে দূরে চলে যায়।

সিএনজি ড্রাইভার আমতা আমতা করছে,ফ্রন্ট মিররে কৌতুহলী দৃষ্টি রেখে দেখে জান্নাতকে। দেখছে এক অতি অল্পবয়সী ছোটোমোটো মেয়ে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে।

হাঁপিয়ে উঠেছে জান্নাত। তখন থেকে কাঁদছে,যখন থেকে মানুষটার বিপদের কথা শুনেছে। হ্যা জান্নাতুলরা এমনই, ওদের এমন করেই আল্লাহ গড়েছেন। “মায়া” নামের একটা অদৃশ্য কঠিন বস্তু ঢেলে ঢেলে দিয়েছেন আল্লাহ এদের দিলে। এই জান্নাতুলদের আর কি হবে?

সুহানা মেয়েটাকে ধরে রেখেছে শক্ত করে। অবুঝ আর ভীষণ আবেগী জান্নাত সুহানাকে ধরে হাঁসফাঁস করে যাচ্ছে,“ভাবী? এসব বুঝি আমার জন্য হলো? আমি তো এসব চাইনি। আমি কক্ষনো ওনার খারাপ চাইনা, মরে গেলেও না। অনেক রাগ থাকলেও আমার দিল ওনার অমঙ্গল কামনা করেনি, অভিশাপ দেয়নি কখনোই!”

সুহানা ওকে বুঝিয়ে শান্ত করতে পারলো না, ছেড়ে দিলো নিজেকে ইচ্ছা মতো তড়পাতে।

শামিরকে ভর্তি করা হয়েছে অ্যাপোলোতেই। খুব গুরুতর জখম না হলেও,যে জখম হয়েছে তা বেশ ভোগাবে শামিরকে, দীর্ঘ আর দীর্ঘমাস। মাথায় সামান্য লাগলেও বুকের পাঁজরে লেগেছে একটু বেশি। তবে হাড় ভাঙেনি‌। হাড় ভেঙেছে ডান পায়ের গোড়ালির। কাঁচামালবাহী বিশালাকার একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে গাড়িটা কাত হয়ে পরেছিল বিধায় দুমরে মুচড়ে গিয়েছিল শরীরটা। পায়ের গোড়ালির হাড়টা ভেঙেছে খুবই বিশ্রীভাবে। অপারেশন না করলে ওই পা টা আর স্বাভাবিক হবে না কখনো। আপাতত অপারেশন সম্ভব না, ডাক্তাররা সময় নিয়ে করাতে বলেছেন। আরো কিছু ছোটো খাটো আঘাত শরীরের বিভিন্ন স্থানে লেগেছে। দুই হাতে সাতটা আঙ্গুলের অগ্রভাগের মাংস থেতলেছে। তবে এটা ঠিক হবে।

রিজিয়া কেবিনের কাঁচ গলিয়ে ছেলেকে দেখছে। এই মাত্র ও.টি. থেকে বের করে এখানে এনে রাখা হয়েছে। মাথার পেছনে,বুকে, ছোটো ছোটো ক্ষত সেলাই দেয়া হয়েছে। ঘুম ও ব্যাথানাশক হাই ডোজের ইনজেকশনের প্রভাবে ঘুমাচ্ছে শামির। আঁচলে চোখ মুছে রিজিয়া ডুকরে কাঁদছে। এ কার দোষে হলো? এসব কেন হলো? এই অকস্মাৎ শোকটা সামলাতে পারছে না মায়ের মন।

জান্নাতকে দেখেই চোখের পানি মুছে চোখ মুখ কঠিন করে ফেললেন রিজিয়া। জান্নাত ওসব কিছু খেয়াল করলো না, রুহী এসে একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। জান্নাত গিয়ে ওকে ধরে চেঁচায়,“কই উনি? উনি কই?”

রুহী চোখ মুছে চুপচাপ তর্জনী তুলে কেবিন দেখিয়ে দেয়। জান্নাত পা বাড়াতে পারে না সেদিকে, রিজিয়া রাগে দুঃখে বলে উঠল,“এসেছো কেনো?”

পা থামলো জান্নাতের। জান্নাত জানতো এসব হবে তার সাথে, সে খুব জানতো। চোখের পানি মুছে শান্ত স্বরে শাশুড়িকে বললো,“আসবো না?”

রিজিয়া জানে সে অহেতুক রাগ দেখাচ্ছে, তবুও মা হিসেবে তার মাথা ঠিক নেই। কোথায় না কোথাও সে বিশ্বাস করে শামির ওভাবে রাগ দেখিয়ে গাড়ি না চালালে এসব কিছুই হতো না। তার ছেলে আঠারো বছর থেকে গাড়ি চালায়। যে কয়বার ছোটো খাটো এক্সিডেন্ট করেছে, সবসময় শামিরের মেজাজ ঠিক ছিলো না বলে অমন হয়েছিলো।

বড় শ্বাস ফেললো রিজিয়া, বললো,“না আসবে না। আসার হলে যেতে না।”

জান্নাত কোনো জবাব খুঁজে পায় না, শাশুড়ির দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। রিজিয়া বলে যায়,“স্বামীর মান বোঝো? আছিয়া কিন্তু ফেরাউনের ঘর করেছিলেন। তালাক চায়নি স্বামীর থেকে।”

বিধ্বস্ত জান্নাত অস্ফুটে বললো,“আম্মা আপনি বলতে চাইছেন আপনার ছেলে ফেরাউনের মতো?”

ঝাঝিয়ে উঠলো রিজিয়া,“না, আমি বোঝাতে চেয়েছি মেয়েদের ধৈর্য্য ধরতে হয়। আমাদের এভাবেই গড়েছে আল্লাহ। ধৈর্য্য না ধরলে সুখ পাওয়া যায়? একটু ধৈর্য্য ধরলে আজ ছেলেটা এভাবে পঙ্গু প্রায় হতো? এতো অধৈর্য হয়ে পরলে যে স্বামীর জন্য একটু ভাবলেও না?”

আঁতকে ওঠে জান্নাত। বুকটা দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে। শাশুড়িকে শুধু বললো,“আম্মা আপনি অবান্তর কথা বলবেন না। আমি আমার স্বামীর ভালো চেয়েছি নাকি না সেকথা আমি জানি।”

রাজন থামিয়ে দেয় রিজিয়াকে। জান্নাত আর কথা না বাড়িয়ে ছুটে যায় কেবিনে। গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ক্ষ্যাপাটে লোকটার বেহাল দশা। যেন সারা শরীর মুরিয়েছে ব্যান্ডেজে। শক্ত হাতটাতে কেনুলা লাগানো। নানা পদের ওষুধ ঢুকছে শরীরে।

জান্নাত দরজায় ঠেস দিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘসময় । না না, এসব সে চায়নি। লোকটা তাকে সব না দিক, অনেক কিছুই দিয়েছে,যা জান্নাত কখনো কারো থেকে পায়নি। লোকটা জান্নাতের মনের মতো স্বামী না হোক, স্বামী তো হয়েছিল। জান্নাতের অসুখ করলে ঐ হাত দুটোই এসে শুরুতে তার গাল ছুঁয়ে দেখতো, যেসব সে ছোটো বেলা থেকে কারো কাছ থেকে পায়নি। এসব কিছু কিভাবে অস্বীকার করবে জান্নাত? জান্নাত তো নেমক হারাম নয়। সব কিছু, যা সে তার স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছে, তার বিপরীতে আর যাই হোক, জান্নাত বদদোয়া করেনি দুঃস্বপ্নেও। লোকটার বর্বরতায় কুঁকড়ে গেলেও করেনি। গতকালও করেনি। কখনোই করেনি।

চোখের পানি আঁচলের কোণে মুছে জান্নাত এগিয়ে যায়। লোকটা ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। জান্নাত আঁতকে ওঠে বারবার থেঁতলে যাওয়া আঙুলে ব্যান্ডেজ দেখে। এই হাত, এই হাতটা জান্নাতকে চ’ড় মেরেছে দু’বার, কিন্তু ভালো তো বেসেছে বহুবার। এই লোকটা,জান্নাতকে বন্দী করেছে বর্বরতার সহিত। আবার আগলেও তো রাখতো কোমলতার সহিত। দেখেনি জান্নাত? লঞ্চে আগুন লাগার সময়ে তো দেখেছে, লোকটার প্রথম প্রাধান্যতা ছিলো জান্নাতের সুরক্ষা, দেখেছে তো সে! এসব কিছু তো ভোলেনি জান্নাত। এসব ছোটো ছোটো সব কিছু মনে রেখেছে জান্নাত। বিতৃষ্ণা জান্নাতের এসেছে এই সম্পর্কে, ঘৃণা তো আসেনি। ঘৃণা করার মতো বুকের পাটা নেই জান্নাতের, বড়জোর রাগ করে থাকতে পারবে, রাগ করে দূরেও চলে যেতে পারবে। তবে এই পোড়া কপালি জান্নাতেরা ঘৃণা করতে পারবে না স্বামীকে।

_________

শহর ছাপিয়ে বৃষ্টি পরছে। সাততলার জানালার থাই গ্লাসে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো গড়িয়ে পরছে আঁকাবাঁকা নকশা কেটে। জান্নাত নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখছে সেসব। তার কাছে মনে হলো ঐ বৃষ্টির ফোঁটা গুলো সে নিজেই। তার জীবনের গতিপথ যেমন সে জানে না,ঐ গড়িয়ে পরা বৃষ্টির ফোঁটা গুলোও জানেনা ওরা কোথায় কোথায় যাচ্ছে, শুধু যেতেই থাকছে ওরা। চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়েছে, শামির ঘুমাচ্ছেই। মাঝখানে একবার জেগেছিল, মুখে কিছু খাওয়া হয়নি তার, স্যালাইন চলেছে শুধু। ডাক্তার বলেছে চব্বিশ ঘন্টা পেরোলে জাউ ভাত খাইয়ে দিতে দু চামচ। রুহী ওর শশুর বাড়ী থেকে নিয়ে এসেছে রেধে। এতো এতো দূর্ঘটনায় একটা বিশাল পরিবর্তন এসেছে চৌধুরী বাড়িতে। হাওলাদার বাড়ির লোকগুলো বাড়ির পুত্রবধূর মুখের দিকে তাকিয়ে মানবিকতার খাতিরে বিবাদ ভুলে ছুটে এসেছে। মোশাররফ হাওলাদার,তার বড় দুই ছেলে, আত্মীয় হিসেবে যেটুকু করার করে যাচ্ছে। শারাফাত চৌধুরী নিজে অসুস্থ, শামিরের এই হাল, এতোকিছুর মাঝে মানসিক ভাবে এতটাই বিধ্বস্ত ছিলেন যে ওদের এই আন্তরিকতা পায়ে ঠেলতে পারেনি। আর যাই হোক, মানুষের দুঃসময়ে মানুষ এলে অন্তত ফিরিয়ে দেয়া উচিত না। তাছাড়া মেয়ে তো তার ঐ বাড়িতেই থাকবে, মেয়ে যেমন হোক, বাবা হিসেবে সে সেটাই করবে যাতে মেয়ের ভালো হয়। স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোক মানিয়ে রুহী যেভাবে ছোটাছুটি করছে, ঐ আন্তরিকতা শারাফাত চৌধুরী কিভাবে ঠেলে সরাবে? আজ যদি সে মরে যেত?

যদিও বাবা আর বড় ভাই রাজন কথা বলে না রুহীর সাথে, তবে দুই বাড়ির এই স্বাভাবিক সম্পর্কে রুহী খুশি অনুভব করতে পারছে না, শামিরের জন্য দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে প্রত্যেকে। যেমন ভাবে কাটাচ্ছে জান্নাত।

রক্ত নামছে খুব, ঘন্টায় পাঁচটা স্যানিটারি ন্যাপকিন বদলাতে হচ্ছে। ব্যথা হচ্ছে ক্রমশ অসহ্য। মনটা খা খা করছে নামাজ আদায় করতে পারছে না তাই, শুধু দোয়া করছে শামিরের জন্য। শামির খেতে পারেনি দেখে সেও খায়নি, রিজিয়া ছেলের বৌয়ের ওপর সামান্য রাগ থাকলেও খাবার নিয়ে কম সাধছে না তাকে। জান্নাত খেতে পারছে না, শুধুই ছটফট করছে সে।

আবারো টানা বারো ঘন্টার ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ করেই শামিরের। শুরুতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে বড় বড় শ্বাস নেয়। তখন এশার আজান হচ্ছিলো। আজান শেষ হতেই শামির চোখ মেলে তাকিয়ে আবার চোখ বুজে ফেলে। আলোটা খুব লাগছে চোখে। ওর দিকে তাকিয়ে থাকা দীর্ঘসময়ের মনযোগী জান্নাত তৎপর হয়ে ঘরের আলো কমিয়ে দেয়। তার মনটা হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে উঠলো, পারছে না লোকটার বুকে মিশে যেতে। পারছে না এটুকু বলতে,“আমি কিন্তু এসব চাইনি হ্যা?”

জান্নাত ওসব কিছুই করে না, নিজেকে শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। রাগ তার পরেনি। আর নরম সে হবেই না, কখনোই হবে না। শামির ধীরে ধীরে চোখ মেললো এইবার, আর এইবার, টানা চব্বিশ ঘন্টা পরেই আবিষ্কার করলো মেয়েটাকে দু চোখের সামনে। প্রথমবার যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন অতটা মাথা কাজ করছিল না শামিরের। চোখ খুঁজেছে,মন খুঁজেছিল কাউকে। তবে মুখ ফুটে বলতে পারেনি।

সময় গড়ায়, দু’জন দু’জনকে দেখছে নিমেষ হীন ভঙ্গিতে। ঐ ক্ষ্যাপাটে লোকের স্বাভাবিক দৃষ্টি হজম হচ্ছে না জান্নাতের। সে নিজেই চোখ নামিয়ে নেয়। যেন এখানে তাদের দৈনন্দিন সংসারের একটা অংশে তারা অভিনয় করছে। কন্ঠে এমন স্বাভাবিকতা আর গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে,“আপনি জাউ ভাত খাবেন? ডাক্তার খেতে বলেছে! বেরে আনবো?”

শামিরের উত্তরের অপেক্ষা করলো না জান্নাত, নিজে নিজেই টিফিন ক্যারিয়ার থেকে একটা বাটিতে দুই চামচ জাউ ভাত বেরে নেয়।

এদিকে শামির চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে মেয়েটাকে, অবিশ্বাস্য নজরে। সারা গায়ে ব্যথা নেই তার ব্যথা নাশক ইনজেকশনের প্রভাবে,তবে শরীরটা কেমন অসাড় হয়ে আছে। দু’চোখে প্রকট বিস্ময় শামিরের, সবটুকু চেতনা ফিরেছে তার। মাথায় অতটাও আঘাত লাগেনি যে সব কিছু ভুলে যাবে। এ কাকে দেখছে সে সামনে? ঐ মেয়েটা যে শামিরের রাগে ফ্যাচফ্যাচ করে কাদতো? সেই মেয়েটাই তো? এখন এই মেয়েটা চোখের সামনে তার অসুস্থ স্বামীকে দেখেও বুকে ঝাঁপিয়ে পরে কাঁদছে না ? হ্যা,সে কাঁদবে কেন? এই বেয়াদব আর স্বেচ্ছাচারী মেয়েটা কাঁদবে তার অধিকারের জন্য। স্বামীর মাথা ফাটলো নাকি পা ভাঙল তাতে ওর কি?
রাগ চাপে শামিরের,বড় বড় শ্বাস ফেলছে রাগে। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে এই মেয়ের কাঠিন্যতায়। কেমন বেহায়া হয়েছে যে স্বামী মরার মুখ থেকে ফিরলেও তার বুকে ঝাঁপিয়ে পরে কাদে না?

কাছে এলে একটা চড় শামির মারবেই। অবশ্যই মারবে। তবে হাতের আঙ্গুল যে ব্যথা!
শামির চড়টা মারতে পারলো না, জান্নাত খাবারটা নিয়ে ওর কাছে আসতেই চুপ হয়ে যায় শামির। হাতের খাবারটা দেখে রাগ পরে যায় শামিরের। নাহ , মায়া অন্তত আছে এখনও মনে। পুরোটা শাহবাগী তবে হয়নি এই মেয়ে।

জান্নাত চুপচাপ একটা চেয়ার টেনে বসলো শামিরের বেডের কাছেই। শামিরের দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ খাবারটা চামচে করে ওর মুখের কাছে ধরতেই শামির বড্ড অভিমান মিশিয়ে গমগমে স্বরে বলে,“এলে কেনো?”

জান্নাত কিছু বলছে না, খাবারটা খাইয়ে দেয় শামিরকে। ওর নির্লিপ্ততা দেখে আবারো মেজাজটা বিগড়ে যায় শামিরের, বলে,“চক্ষু লজ্জায় এসেছো তাইনা?”

জান্নাত এবারো জবাব দেয়না,আরেক চামচ ঝাউ ভাত শামিরের মুখে ঢুকিয়ে দেয়। শামির খাবারটা গিলে এবার শক্ত গলায় বলে,“কবে থেকে?”

জান্নাত চোখ তুলে তাকায়, এতক্ষণে সে মুখ খোলে, বলে,“কি কবে থেকে?”

_কবে থেকে তোর মনে অন্য কেউ বাস করে?

হতবাক জান্নাত,আহত গলায় বলে,“এসব আপনি কি বলছেন?”

চিড়বিড়িয়ে ওঠে শামির,“ঠিকই বলছি। একটা মেয়ে তো এতোটাও নির্দয় হতে পারে না যে স্বামীর এই অবস্থায় তার বুকে ঝাঁপিয়ে পরে কাঁদবে না! বল কবে থেকে এমন হয়েছিস? কবে থেকে তোর মনে আমি নেই,বল!”

জান্নাত চোখ বুজে নেয়, ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। রাগ তো তারও উঠছে, তবে সে দেখায় না, শুধু মুখে বলে,“আল্লাহর ওয়াস্তে এতো চেতে যাবেন না, আর আমাকে বদনাম দেবেন না, আমি আমার বাচ্চার খুনী নই,আমি দুশ্চরিত্রাও নই, একটু শান্তি দেন আমাকে।”

শামির হঠাৎ করে হাত বাড়িয়ে জান্নাতের হাত থেকে খাবারের বাটিটা ঠেলে ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে। চমকে ওঠে জান্নাত। এমনটা করায় শামির নিজেও হাতের আঙুলে ব্যথা পেলো,তবে সে সেটা গায়ে মাখালো না, খেকিয়ে উঠলো,“বের হ। এখান থেকে বের হ তুই আমার চোখের সামনে থেকে নির্দয় মেয়েমানুষ কোথাকার! যা দিলাম তোকে শান্তি!”

শাড়ির আঁচল চেপে ধরে বসে থাকে জান্নাত। ছলছল চোখে দেখছে লোকটাকে। দেখছে একটা লোক কতটা বেহুদা হতে পারে। এই লোক কখনো শোধরাবে না?
বড় বড় শ্বাস ফেলছে শামির, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পরায় জান্নাত উদ্বিগ্ন হলো, অপেক্ষা করতে লাগলো লোকটা যাতে শান্ত হয়।

মুহুর্ত যায়, হঠাৎ শামির শান্ত হয়ে বলে,“যা,আসতে হবে না তোর আমার কাছে।”

সামান্য হাসলো জান্নাত, দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে শামিরের চোখে রাখলো চোখ, নিজের কাঁপা হাতটা ধীরে ধীরে এগিয়ে দিয়ে ছু’লো শামিরের গাল। জান্নাতের এহেন আচরণে চোখ তোলে শামির, দৃষ্টি রাখে জান্নাতের ভেজা চোখ দুটোতে। জান্নাত বলে ওঠে,“কি ভেবেছেন? আমি থাকবো আপনার সাথে? মোটেই না। আমি তো থাকতে আসিনি। আমি তো যাবোই। তবে আপনি সুস্থ হলে। কেন জানেন?”

শামির চুপচাপ দেখছে জান্নাতকে। জান্নাত এইবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে,বলে,“কারণ আমার আসলেই বদনামের ভয়। লোকে বলবে,“ঐ দ্যাখ ঐ গাইয়া মেয়েটাকে,যে বড়লোক দেখে টাকার লোভে বয়সের দ্বিগুণ এক লোকের কাছে বিয়ে বসেছিল, ঐ মেয়েটা এখন স্বামী প্রায় পঙ্গু হয়েছে বলে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। থুথু দে ঐ মেয়েটাকে।”

এসব বলবে লোকে আমাকে, আপনাকে বলবে,“আহা বেচারা।” আমি আপনাকে কেন বেচারা সাজাবো? আপনি তো বেচারা নন! আপনি মোটেই বেচারা নন। আমাদের গল্পে দু’জনের দোষ গুণ কাটছাঁট করে কেউ যদি বেচারা থেকে থাকে, ওটা আমি। আমি আপনাকে কেন বেচারা সাজাবো?”

কান্নার তোড়ে কাঁপছে জান্নাতের গা। শামির চেয়ে আছে শুধু। এখন আর উত্তেজিত হচ্ছে না। কিছুক্ষণ কেঁদে জান্নাত আঁচলে চোখের পানি মুছে বলে,“আমি তো আপনাকে ছেড়ে যাবোই। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হোন। এই অসহায় অবস্থায় আপনাকে ছেড়ে গিয়ে নিজে দোষী হবো না। আপনার জীবন থেকে গেলে আমি বেচারী হয়েই যাবো,কারণ আমি নিশ্চিত, ইতরামি আপনি কখনো বন্ধ করবেন না। আপনি সুস্থ হলে আবার শুরু করবেন, তখনই আমি যাবো।”

বলেই আবার ডুকরে উঠলো জান্নাত। কাঁদতে থাকলো চোখ চেপে। আর শামির নির্নিমেষ দেখতে থাকে সতের বছর সাতমাসের পিচ্চি মেয়েটিকে, যে মেয়েটাকে সে রুপাতলী থেকে এনেছিল, তার জায়া করে।

চলমান…….