#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_২৯
#ইসরাত_ইতি
কষানো ছোটো ছোটো চিংড়ি গুলোতে নারকেল বাটা ও বিচি ছাড়িয়ে ধুয়ে রাখা কাঁচামরিচ কুচি গুলো ঢেলে দিয়েই জান্নাত হাতের গতি বাড়িয়ে খুন্তি নাড়ছে অনবরত। আজ এই বৃষ্টি দেখেই নারকেল-চিংড়ি রাঁধার সাহস পেয়েছে, খেলে পেটটা অতটা গরম হবে না হয়তো। নয়তো গরমে নারকেলের তরকারি শামিরের পেটে সয়না।
রিজিয়া কিচেনের দোরগোড়ায় এসে দাড়িয়ে ভেতরে উঁকি মারলো। ব্যস্ত জান্নাতকে দেখে দরাজ গলায় বললো,“এতো পরিশ্রম করতে হবে না। তরকারিতে পানি দিয়ে ওপরে যাও, গিয়ে ওকে দেখো, নিজেও রেস্ট নাও।”
জান্নাত হাত থামায় না, উদাস গলায় বলে,“আম্মা এটা ভালো করে কষিয়ে না নিলে স্বাদ হয়না।”
রিজিয়া কিছুক্ষণ দেখলো মেয়েটাকে, তারপর এগিয়ে এসে খুন্তি কেড়ে নিয়ে বললো,“আমি দেখছি। যাও।”
_কিন্তু আব্বা?
_তোমার শ্বশুর ঘুমাচ্ছে এখন। তুমি যাও।
ধুপধাপ শব্দ করে বাজ পরছে আশেপাশে, এই তিনদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হয়েই চলেছে, থামবার নাম নেই। ক্লান্ত পায়ে দোতলায় উঠে জান্নাত ঘরে ঢুকেই থমকাল। তার খেয়াল ছিলো না ঘরে তেমন পানি নেই,থাকলেও বা? লোকটা বোতলের মুখটা খুলতে পারবে না।
শামির উঠে বসে হাপাচ্ছে, নড়াচড়া করতেই পায়ে একটুখানি লেগেছে বিধায় ঘাম ছুটে গিয়েছে যন্ত্রণায়। খুব পানির তেষ্টা পেয়েছে তার, ব্যথাতুর কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে বোতল ধরবে তার আগেই জান্নাত গিয়ে বোতল নিয়ে ওটা খুলতে খুলতে উদ্বিগ্ন গলায় বললো,“আমাকে ডাকলেন না কেন? এটা তো আপনি পারবেন না হাতে ধরতে এখন। ব্যথা লাগবে।”
শামির চোখ তুলে তাকায়, সেদিন রাতে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলার পরে হসপিটাল থেকে মেয়েটাকে মেজাজ দেখিয়ে বিদায় করেছিল। এরপর সাতদিন হসপিটালে থাকার সময়টুকুতে সবাইকে বলেছে “এই স্বেচ্ছাচারী মেয়েটা” যেন এখানে এই হসপিটালে না থাকে,ওকে দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে।”
জান্নাত যায়নি হসপিটালে, বাড়িতেই কাটিয়েছে। কাউকে বলেওনি কিছু, শামিরকে আজ সকালে বাড়িতে আনার পরে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সালাম দিয়ে কথা বলেছে। যেন ওদের মাঝে কিছুই হয়নি,কিছুই না। যেন এই ক’দিন ছিলো দুঃস্বপ্নের মতো। ঘুম ভেঙে গিয়েছে আর জান্নাত ব্যস্ত হয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে রান্নাঘরে ঢুকেছে স্বামীর জন্য, স্বামীর পছন্দের নারকেল চিংড়ি ভাজা রাঁধতে।
পানিটা খাইয়ে দিয়ে জান্নাত শাড়ির আঁচলের কোণা দিয়ে মুছিয়ে দেয় শামিরের গলা, পানি খেতে গিয়ে গলার কাছের টিশার্ট ভিজিয়েছে। মুখভঙ্গি থমথমে ওর। শামির তেরছা নজরে জান্নাতকে দেখছিলো, দেখছিলো জান্নাতের নির্লিপ্ততা, কিছুক্ষণ দেখেই গমগমে স্বরে বলে ওঠে,“ব্লিডিং কেমন এখন? কমেছে?”
ঘর গোছাতে গোছাতে জান্নাত জবাব দিলো,“হুম।”
_ব্যাথা করে?
_হুম।
_ওষুধ খাও?
_হুম।
শারীরিক যন্ত্রণায় আরো খিটখিটে হয়েছে শামির। মৃদু ধমক দিয়ে বলল,“হুম হাম্বা কি করছো? জবাব নেই? গোরু তুমি?”
চাপা রাগ নিয়ে ওদিকে ফিরেই দাঁত কিড়মিড় করে জান্নাত শামিরের ময়লা কাপড় গুলো ঝুড়িতে রাখে। এদিকে শামির ছটফটিয়ে উঠে বলে,“ভাব নিচ্ছো আমার সাথে?”
ঘুরে তাকায় জান্নাত, নিচু গলায় বলে,“সে আমার সাধ্যি?”
শামির তাকিয়ে থাকে। চুপ হয়ে যায় এইবার, এইমাত্র বলা কথাটিতে জান্নাতের চোখে মুখে সেই উল্কা জ্বলে উঠেছে সেটা সেদিন হসপিটালেও দেখেছে যখন জান্নাত আল্টিমেটাম দিয়েছিল শামির সেরে উঠলেই সে ওকে ছেড়ে যাবে।
ওই মেয়েটির এই ব্যপারটা শামিরকে থিতিয়ে দেয়, ইদানিং হঠাৎ করে খুব সামান্য কিছু বলে, দমে যায় শামির।
কথার পিঠে কেন জানি শামির কথা খুঁজে পেলো না। সত্যিই তো! শামিরের সাথে ভাব দেখানো জান্নাতের সাধ্যি? কিন্তু এই মেয়েটি ভাব না দেখিয়েও ভাব দেখাচ্ছে। আফসোস, শামির সেটা প্রমাণ করতে পারছে না।
দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলে উঠলো শামির,“ছেড়ে যাবে সত্যিই?”
_নাহ তো।
_তবে যে বলেছিলে?
_আমি যাবো না। আপনিই বাধ্য করবেন।
টেবিলের ময়লা ঝুল ঝাড়ু দিতে দিতে অকপটে জবাব দেয় জান্নাত। ওর কন্ঠে কোনো জড়তা নেই । শামির ভেতরে ভেতরে ফোঁস ফোঁস করছে, উত্তেজিত হলে পায়ে ব্যথা লাগে তাই উত্তেজিত হওয়া যাবে না। তবে এই মেয়েটার গোঁয়ার্তুমি মানতে নারাজ শামির। এই মেয়ের সাথে সম্পর্কের সমীকরণে তার ভুল নেই মানে নেই-ই। নিজের ভুলকে ঠিক মনে করে এই মেয়ে জিতে যাবে এটা তো হয়না!
হঠাৎ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে শামির,বলে,“এই অহেতুক জেদ নারীর ধ্বংসের কারণ এটা তুমি ধীরে ধীরে টের পাবে জান্নাতুল!”
জান্নাতও জবাবে মিষ্টি করে হেসে বলে,“অহেতুক জেদ পুরুষকেও সফলতার সিঁড়িতে পৌঁছে দেয়না, অহেতুক জেদ করলে পুরুষও ধ্বংস হয়, যেমন,“বৌ থাকে না” তাদের।”
জান্নাতের চূড়ান্ত বেয়াদবি বসে বসে হজম করছে শামির। জান্নাত হাতের কাজ শেষ করে চুলের খোঁপা খুলে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে একটু জিরোতে বসে। হাতে তার ফোনটা, গভীর মনোযোগে কিছু একটা করছে দেখে শামির কৌতুহলী হয়ে কপাল কুঁ’চ’কে বলে,“কি এতো ফোনে? কি দেখো ঐ ফোনে?”
_আইডি খুলেছি একটা।
ফেসবুকের নিউজফিডে আঙুল চালনা করতে করতে জান্নাত জবাব দেয়। মিনিট খানেক তো শামির নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না,যখন খেয়াল হলো, নিমিষেই চোখ দুটো ক্রোধে ফেটে পরতে চাইলো,চাপা রাগে কেপে উঠল,“মানে? আইডি খুলেছিস মানে কি? তোর সাহস হয় কি করে?”
জান্নাত ঘাবড়ায় না শামিরের ধমকে। মাথা ঠান্ডা রেখে বলে,“অসুবিধা কোথায়? প্রযুক্তির এই যুগে আমি কেন দুনিয়া জানবো না? কোথায় কি হলো আমি দেখবো না? শামার ফোন না থাকলেও মায়ের ফোনে ওর একটা আইডি আছে। আমি তো ওরও বড়। আমারো আইডি থাকা উচিত। আমিও দুনিয়া দেখবো।”
তপ্ত শ্বাস ফেলে শামির,
_হ্যা দেখবি, আর সেই সাথে দেখাবিও তাইনা? পেট বের করে ছবি দিবি? এই জান্নাতুল! খবরদার, আমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে সীমা লঙ্ঘন করবি না! ছবি দিয়েছিস তুই? ছবি দিয়েছিস?
_হ্যা দিয়েছি! কেন? ছবি দিলে অসুবিধা কি? যার আইডিতে তার ছবিই তো দেয়া উচিত। আপনিও তো দেন। অনেক মেয়ে কমেন্ট করে “আপনাকে সুন্দর লাগছে”। আপনি তো সেটা খুব উপভোগ করেন। আপনার মুখে হাসি ফোটে। মেয়েগুলোকে বকতে যাননা। তাহলে বৌকে কেন যক্ষের ধনের মতো লুকিয়ে রাখতে চান? পর্দা লেহাজ মেয়েদের থাকতে হয়, ছেলেদের নয়? ছেলেদের দেখে পরনারী তুষ্ট হলে ছেলেরা স্বস্তা হয়না? মেয়েরাই হয়?
কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো বলে জান্নাত উঠে দাঁড়ায়। শামির যেন লাফিয়ে উঠে জান্নাতের চুল টানতে পারলে বাঁচে, পায়ের যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,“তো ছেলেদের সমান সমান হতে চাইছিস?”
জান্নাত জবাব না দিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে ময়লা টিশার্ট দু’টো ধুলো শামিরের। এদিকে শামির বিছানায় পরে থাকা জান্নাতের ফোনটা বহু কষ্টে হাতে তুলে নিতে নিতে চেঁচামেচি করে,“ফেসবুকে ছবি দেয়া? আমাকে একটু সুস্থ হতে দাও! ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো এইসব সস্তা প্রতিশোধ নেওয়া একেবারে ছুটিয়ে দেবো। ঐ সাহস, যে সাহসে তুমি আমার কথার অবাধ্য হয়ে নিজের ছবি দিয়েছো পাবলিকলি, ঐ সাহস কবর দেবো বেয়াদব মেয়ে…..”
জান্নাত নিশ্চুপ নিজের কাজ করছে। শামির ফোনের লকটা খুলেই ফেসবুক অ্যাপ্লিকেশনে ঢুকতেই থমকাল। কিছুক্ষণ ওদিকে চেয়ে থেকে তাকালো ওয়াশ রুমের দিকে। ধীরে ধীরে কঠিন মুখটা সহজ হতে চাইলো। জান্নাতের অ্যাকাউন্টের প্রোফাইলে একটা গোলাপ ফুলের ছবি দেয়া। কিছুক্ষণ ওটা দেখেই ভেতর থেকে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে শামির। পরপর বিড়বিড় করে বলে,“ফুলের ছবি কেন দিয়েছো? তুমি ফুল? না তো। নিজেকে পাখি মনে করো তুমি, তোমার বৈশিষ্ট্য “ফুরুৎফারুৎ”। পাখির ছবি দিবে। চামচিকার ছবি হলে ভালো হয়।”
জান্নাত ও কথা শুনতে পেল না। শামির ব্যথাতুর হাতের আজলা থেকে ফোনটা নামিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে জানালা দেখে,দেখে বৃষ্টি। মনটা তার বিক্ষিপ্ত হতে চাইলো হঠাৎ, ভেতরে ভেতরে মৃদু শ্বাস ফেলে।
এই মেয়ের পা-থেকে মাথা সবকিছুই কি শামির ধর্ম আর অধিকারের দোহাইয়ে লুকিয়ে রাখে? রাখতে চায়? এর পেছনে তার ভালোবাসা নেই? একটা পুরুষ সে,সে জানে আরেকটা পুরুষ এক ঝলকে রাস্তায় দেখা একটা নারীকেও কখনো রাতে অবচেতন মনে বাসনা করতে ছাড়ে না। সে কিভাবে তার স্ত্রীকে স্বস্তা বানিয়ে এর ওর কল্পনার খোরাক মেটাতে দেবে? এসব ভাবলেই তো বুক পোড়ে শামিরের।
কিন্তু এই বেয়াদব মেয়ের তাতে কি? যা নষ্ট হবার তো হয়েই গিয়েছে! মাঝখান থেকে ভালোবেসে শামির ফেসেছে। একটা গেঁয়ো ছাপোষা মেয়ে, কোন কু-ক্ষণে কি দিয়ে শামিরকে বশ করেছিল জানেনা শামির চৌধুরী!
ওয়াশ রুমের দরজায় আওয়াজ হয়। শামির নড়েচড়ে উঠে কপাল কুঁচকে,রাগ রাগ ভাব করে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। জান্নাত দূর থেকে ওকে কিছুপল দেখে মলিন হাসলো। অতঃপর ধীরে ধীরে এসে শামিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের ফোনটাকে খানিক সময় দেখলো, পর পর বিছানায় বসে শামিরের ফোনটা নিতেই শামির বলে উঠলো,“কি? আমার ফোনে কি আবার?”
জান্নাত জবাব না দিয়ে দ্রুত আঙুল চালিয়ে শামিরের ফোনেও জান্নাতের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা বসিয়ে দিল । শামির চোখ বড় বড় করে সেসব দেখেই জান্নাতের চোখে চোখ রাখলো। জান্নাত নিচুগলায় বলতে থাকলো,“আমি আপনার স্ত্রী। কবুল বলে আমার দায়িত্ব নিয়েছেন আপনি। আমার যা কিছু গোপনীয়তা সব আপনার দখলে থাকুক তবে আমার স্বাধীনতা নয়। নিন আমার একাউন্ট।”
শামির জবাব দিল না কোনো, নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে ঘেমে লাল হওয়া ফর্সা মুখটাতে। জান্নাত শামিরের ফোনটা রেখে উঠে চলে গেল হন্তদন্ত হয়ে,নিচে।
ফিরে আসে জান্নাত খাবার নিয়ে, একটা বিশাল প্লেট হাতে। সেও এখানে বসেই খাবে। শামির তখনও নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল, জান্নাত এসে ওর সামনে বসে, মুখটা সাবেক থমথমে তার।
ওর মুখ থেকে শামিরের ভাবুক আর শান্ত দৃষ্টি নামে ওর হাতের প্লেটে। থালা ভর্তি নিজের পছন্দের খাবার দেখে আবার দেখে জান্নাতকে। এবার বেশ ধিমি আওয়াজে বলে,“মা রেঁধেছে?”
_না! আমি।
গম্ভীর কন্ঠে জবাব দেয় জান্নাত। এক লোকমা তুলে দিলে মুখে, শামির সেটা খেতে থাকে। কামরা জুড়ে পিনপতন নীরবতা। শামির কথা খুঁজে পায়না, অথচ তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ উশখুশ করে বললো,“তোমার হাতে রান্না খুব মজা।”
জান্নাত নিশ্চুপ। ওর ঐ ধারালো গম্ভীরতা আঘাত হানছে শামিরের অহংকারের প্রাচীরে। বিষয়টা সে জটিল করছে আপন মনেই। ভাবছে এই জান্নাত তাকে দয়া করছে। তবে মুখ ফুটে আর কথা শোনাতে ইচ্ছে করছে না। উল্টো হাল্কা গলায় বলল,“মাও এতো মজা করে নারকেল চিংড়ি রাঁধতে পারে না। তুমি এটা কিভাবে করো?”
জান্নাত সাথে সাথে জবাব দিলো সহজ ভঙ্গিতে,“নারকেল বাটাটা খুব ভালো করে কষাতে হয়, সাথে বেশি করে কাঁচামরিচ দিতে হয় ধুয়ে, আর একটা পোলাও পাতা। ব্যস!”
_কাচামরিচ দাও? তবে ঝাল লাগেনা, বেশ লাগে!
_ঝাল লাগবে না তো! বিচি গুলো ঘঁষে ঘঁষে সরিয়ে ফেলেছি!
_ইয়া আল্লাহ! কিভাবে করলে এটা? হাত জ্বলে যায়নি? দেখি!
শামির কৌতুহলী আর উদ্বিগ্ন হয়ে জান্নাতের হাত দেখে তার ব্যান্ডেজ করা হাতে উল্টেপাল্টে। জান্নাত লোকটার এহেন কান্ডে চমকে ওঠে। নিমিষেই ভীষণ আপ্লুত আর আবেগী হয়ে পরে মেয়েটা। তার সামনে এখন সেই মায়াময় মানুষটা, যাকে খুব কম সময়ই পেয়েছে জান্নাত বিয়ের ক’মাসে, তবে যতক্ষণ পেয়েছে জান্নাতের স্মৃতিতে সেই সুন্দর মুহুর্ত গুলো অম্লান। হাতটা সরিয়ে নেয় জান্নাত, নিচু গলায় বলে,“ডাল ঘুটনি দিয়ে ঘষেছি!”
শামির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,“গুড। তোমার সাংসারিক বুদ্ধি চমৎকার। এটাই তো প্রকৃত ভালো মেয়ের বৈশিষ্ট্য। তার মাথাভর্তি সাংসারিক বুদ্ধি থাকবে, বালপাকনা স্বাধীনচেতা বুদ্ধি নয়।”
জান্নাত কিছু সময় চুপ থেকে লম্বা শ্বাস ফেলে শামিরের এঁটো প্লেটেই নিজের জন্য ভাত বেড়ে খেতে থাকে। শামির ওকে দেখতে থাকে। ভাত বেশি খেতে পারে না জান্নাত। অল্প খানিকটা খেয়ে উঠে হাত ধুয়ে শামিরের ওষুধ ওকে খাইয়ে দেয়। পাল্টে দেয় শামিরের টি-শার্ট! শামির শুধু দেখছেই মেয়েটাকে। বিগত দশ দিনে চেহারা ভেঙে, শরীর শুকিয়েছে অথচ চেহারা থেকে পবিত্রতার একটুও ভাটা পরেনি যা শামিরকে সবসময় টানে। জান্নাত ওকে শার্ট পরিয়ে বোতাম লাগাতে খানিকটা ঝুকলো যখন,শামির এক হাতে জান্নাতের গাল ছু’লো। শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো জান্নাতের, কান্না পেলো। পরপর যখন মিসক্যারিজের সেই দিনটার কথা মনে পরলো, চোখ মুখ কঠিন করে জান্নাত হাতটা সরিয়ে দিলো শামিরের, গম্ভীর হয়ে বললো,“ব্যাথা পাবেন হাতে।”
শামির যেন এই ছোটো ছোটো উপেক্ষা গুলোতেই রেগে যাচ্ছে খুব। জেদ দেখিয়ে ধরলো জান্নাতের বাহু। ব্যাথা পেলে দাঁতে দাঁত চাপলো, তবুও হাত সরালো না। জান্নাত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো,“করছেন কি? ব্যথা পাবেন। ঐ দেখুন রক্ত বেরুচ্ছে।”
চেঁচিয়ে উঠলো শামির,“তাতে তোর কি? দয়া দেখানোর নাটক বন্ধ কর ভণ্ড কোথাকার। কে আসতে বলেছে আমার সেবা করতে? লাগবে না তোকে, যা!”
বসে পরলো জান্নাত হতাশ হয়ে, বললো,“আমার ভালো মন্দের চিন্তা বাদ দিলাম, আপনি কি নিজের ভালো মন্দের চিন্তাও করতে পারেন না?”
আবার চেঁচিয়ে উঠলো শামির রাগে,“এই চুপ কর! তোর এইসব জ্ঞানী জ্ঞানী কথাও সহ্য হচ্ছে না। একেবারে চুপ।”
জান্নাত উঠে দাঁড়ায়। মাথায় আঘাত পেয়ে হয়তো এই লোক পাগল হয়েছে, এর সামনে প্রয়োজনের বেশি থাকাই উচিত না। তাই ঘর থেকে যখন বেরুতে চাইলো তখুনি আবার চিল্লিয়ে ওঠে শামির,“খবরদার এখান থেকে বেরুবি না। এখানে আমার চোখের সামনে বসে চুপ করে থাকবি ফাজিল।”
জান্নাত চুপচাপ বসে রইল। হাতে কোনো কাজ নেই তার, আর কিইবা করার? শামির যেন একটু শান্ত হলো এইবার, জান্নাত কথা শুনলো তাই। রাগটা দমিয়ে কঠিন চোখে চেয়ে রইল জান্নাতের মুখের দিকে। জান্নাতও তাই, যেন একে অপরের চোখের দিকে চেয়ে থাকার প্রতিযোগিতা চলছে।
প্রতিযোগিতায় হার মানে শামির, এর মাঝে একটা কল এলো তাই। কলটা রিসিভ করে বললো,“হ্যা আপু! এখন পাঠাবো? হ্যা!”
ফোনটা রেখে দিয়ে শামির এবার শান্ত ভঙ্গিতে জান্নাতকে বলে,“রেডি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি। ভাবীকে নিয়ে তানিয়া আপুর চেম্বারে যাও। তোমার চেকআপ দরকার! ব্লিডিং কেমন হয় সেটা বলো।”
আচমকা আবারো চোখ ছাপিয়ে জল এলো জান্নাতের। উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ি পাল্টে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো পার্স হাতে। আর শামির ঢুকলো জান্নাতের আইডিতে, কাকে কাকে বন্ধু তালিকায় যুক্ত করেছে এটা দেখতে। শামির, রুহী, সুহানা, ফুল, সুরভী, শায়ন, মেধা। মেধার আইডিটা দেখেই মেজাজ টা বিগড়ে গেলো শামিরের। পর পর ঢুকলো “ইনবক্সে” , জান্নাত কার সাথে কথা বলেছে সেটা দেখতে।
ইনবক্সে শুধুমাত্র জান্নাতের বান্ধবীরাই ছিলো, যাদের প্রত্যেককে জান্নাত একটি মেসেজ পাঠিয়ে রেখেছে দেখতে পেলো,“তোদের দুলাভাইকে বাড়িতে আনা হবে আজ,আমি ব্যস্ত থাকব উনাকে নিয়ে।”
কপাল কুঁচকে ফেলে শামির। ব্যস্ত? কই ব্যস্ত থাকলো ফাজিল মেয়েটা? কথার বেলায় বহুত বাড়িয়ে বলে যেন স্বামী সেবা করতে করতেই ওর দিন যায়, অথচ কাজ-বাজ তো কিছুই করতে হয় না! এসে একটু পানি খাওয়ালো, ভাত খাওয়ালো , এতে হয়ে যায়? ভালোমন্দ কিছু তো জানতে চাইলো না! অবশ্য কেন চাইবে! ভালোবাসলে তো চাইতো। কখনো ভালোবেসেছে কিনা সন্দেহ!
শামির আর ঘাটলো না জান্নাতের ফেসবুক একাউন্টের ইনবক্স, ওপাশ থেকে ওর বান্ধবীরা যদি কোনো ব্যক্তিগত কথা বলে ফেলে জান্নাতকে? সেটা যদি শামির দেখে ফেলে? রুচিতে বাধে শামিরের কাজটি করতে । ফোনটা রেখে দিল চুপচাপ, পর পর আবার ফোনটা তুলে তানভীরকে কল করে বললো,“ভাই! সুপ্তি ভাবীকে বলেছিস একজন ম্যারেজ কনসালটেন্টের খোজ দিতে আমাকে?”
ওপাশে হাসে তানভীর শামিরের ছটফটানি দেখে, বলে,“ভাই! আপাতত কয়দিন বিশ্রাম নে! তোর বৌ যাচ্ছে না তোকে ছেড়ে। রিল্যাক্স!”
দাঁত চেপে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠল শামির,“তুই জানিস? আজ ও আমার চোখে চোখ রেখে বলেছে ও যাবেই! ভাই শোন, আমার জন্য দোয়া কর যাতে আমি কখনো সুস্থ না হই। আমি সুস্থ হলে আই সয়্যার ওই মেয়ে জীবিত থাকবে না, ও যা যা করছে!”
_আচ্ছা, দোয়া করলাম সুস্থ হোস না। এখন রাখ,আর একটু বেশি বেশি ঘুমা। এন্টি বায়োটিকের প্রভাবে আরো বেশি খিটখিটে হচ্ছিস। ঘুম প্রয়োজন, ঘুমা।
বিকেলে একটা লম্বা ঘুম হয়েছে শামিরের, এর মাঝে শায়ন এসে জানতে চাইলো শামির ওয়াশ রুমে যাবে কি না। শামির থমথমে মুখে বসে আছে,বলল,“তোর ভাবী আসেনি? এতক্ষণ লাগার তো কথা না আপুর চেম্বারে!”
কথাটা শেষ করতে পারলো না তখুনি জান্নাত ঘরে ঢুকলো। হাতে একগুচ্ছ লাল শাপলা। শায়ন চলে গেল ভাবীকে দেখে। শামির কিছুক্ষণ জান্নাতকে দেখছে,দেখছে ওর হাতের লাল শাপলা। চেঞ্জিং কর্ণারে ঢুকে জান্নাত গুনগুন করে শাড়ি পাল্টাচ্ছে,
“পানসি বানু উড়তি ফিরু, মাস্ত গাগান মে।
আজ মে আজাদ হু দুনিয়া কি চামান মে।”
গান শুনে নির্বাক চেয়ে রইল শামির। শাড়ি পাল্টে জান্নাত শামিরের বিকেলের ওষুধটা খাইয়ে দিতেই শামির গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,“খুব খুশি খুশি লাগছে যে ? খুব ভালো লাগছে না স্বাধীনতা ?”
জান্নাত জবাব না দিয়ে শাপলা ফুল গুলো নিয়ে শামিরের মুখোমুখি বসলো। শামির বললো,“এসব কোথা থেকে আনলে? নাকি আবার স্বাধীনতা পেয়ে উজিরপুর চলে গিয়েছিলে উড়তে উড়তে!”
চুলে খোঁপা করে শাপলা ফুলের মালা বানাতে ব্যস্ত হয় জান্নাত, ধিমি আওয়াজে বলে,“সদর রোডে গাড়ি থামিয়ে কিনলাম।”
একটু থামলো জান্নাত, পর পর তার সরল ভাসা ভাসা চোখ দু’টো রাখলো শামিরের চোখে, স্পষ্ট করে বললো,“সত্যি বলতে এটুকু স্বাধীনতাই আমি চেয়েছিলাম। এই হুট করে গাড়ি থেকে নেমে কিছু শাপলা ফুল কেনার স্বাধীনতা। আমার কাছে আমার স্বাধীনতা বলতে এটুকুই ছিলো, বাড়তি কিছুই নয়।”
চলমান……