জায়া ও পতি পর্ব-৩০

0
1

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৩০
#ইসরাত_ইতি

ভাইয়ের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রুহী। হাতে তার একটা টিফিন ক্যারিয়ার। তাতে আছে ক্ষীর। যেটা শামিরের খুব পছন্দের।
বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে শামির বোনের দিকে তীক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে আছে, পা-মাথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে বোনকে। পরনে একটা খয়েরী রঙের শাড়ি। বিয়ের একমাসে স্বাস্থ্য কিছুটা ভারী হয়েছে রুহীর, গাঁয়ের রংটাও খুলেছে আরো। বোনকে এই হালে দেখে যদিও মনটা ভালো হলো শামিরের, তবে সেটুকু প্রকাশ করলো না সে। গমগমে আওয়াজে বলে দেয়,“কেন আসিস?”

রুহী কথা বলে না, চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকে। চোখ দু’টো টলটলে তার। শামির লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে,“আসিস! আসবিই তো! এ বাড়িতে তোর ভাগ আছে! একশো বার আসবি! তবে খবরদার আমাকে ওসব ছাতামাথা খাওয়াতে আসবি না। যারা খেতে চায় তাদের খাওয়াস।”

টিফিন ক্যারিয়ার ধরে রাখা হাতটা রুহীর কাঁপছে, আচানক কম্পমান গলায় বলে ওঠে,“আমাকে তন্ময় ভালো রেখেছে ভাইয়া!”

শামির এমনভাবে হাসলো যেন একটা মজার কথা শুনেছে, পর পর বললো,“আচ্ছা দেখবো ক’দিন ভালো রাখে!”

জান্নাত ঘরের এককোণেই দাঁড়িয়ে ছিল। শামিরের এই কথাটাতে প্রতিবাদ করে বসলো হঠাৎ সে, ধীরস্থির বলল,“দেখতে এসেছে আপনাকে। বাড়ির ভাগ চাইতে না। আর এখন আপনারা সবাই মিলে দোয়া করলেই ভালো থাকবে রুহী আপু আর তন্ময় ভাইয়া।”

শামির কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না জান্নাতের কথায়,আগে হলে তো গলা টিপে ধরতো শামিরকে জ্ঞান দেওয়ার অপরাধে। দিন দিন সেই ঝাঁঝ টা শামির হারিয়ে ফেলছে। ইচ্ছে করে না মেয়েটাকে বেশি কথা শোনাতে, ক’দিনে একটু ঠান্ডা হয়েছে, আবার কি না বলে বসে,“তালাক দেন।”

শুধু জান্নাতের কথার জবাবে মুখ বিকৃত করে শামির। রুহীর মুখটাতে তার মলিন দৃষ্টি রেখেই বললো,“কে রেঁধেছে ক্ষীর?”

_আমি।

ফোঁস শব্দে শ্বাস ফেলে শামির বলে,“তবে এক চামচ দিতে পারিস। তুই আর যাই হোক, অন্তত বিষ দিবিনা ওতে।”

রুহী তার টলটলে চোখ দু’টো তুলে ভাইকে আহত গলায় বলে,“আমার শশুর বাড়ীর প্রত্যেকে আন্তরিক, ভালো মনের, আমি এ কদিনে বুঝেছি। তারা জমির দ্বন্দ্ব নিয়ে আর যাই হোক, বিষ দিয়ে অন্তত মারতে চাইবে না তোমাদের। আর ভাইয়া এটা তো সত্যি জমিটা ওনাদেরই প্রাপ্য, আমার শ্বশুর মূল দলিল নিয়ে একদিন আলোচনায় বসে আমাকে দেখিয়েছে সব, সাথে সার্ভেয়ার অফিসার ছিলেন। তোমরা মামলা জিতলে তখন সেটা অবিচার হতো ওনাদের প্রতি! এটা তোমরাও জানো! আর আমিও জানি, জমির প্রতি তোমাদেরও বিশেষ লোভ নেই। যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে তোমাদের। তোমরা হেরেছো তাই এতো কষ্ট তোমাদের।”

শামির কথা বাড়ায় না, ডাক্তার বেশি চেঁচামেচি করতে বারণ করেছে তাই চুপ থাকাই শ্রেয়। রুহী চোখ মুছে ক্ষীর বাটিতে বেড়ে শামিরের খুব কাছে গিয়ে বসলো। চামচে ক্ষীর তুলে ভাইয়ের মুখে দিয়ে কাঁপা স্বরে বলতে লাগলো,“অন্যায় করেছি। তন্ময় আমি দু’জনেই তো স্বীকার করি।”

_তোর বর কই?

_অফিসে।

_আচ্ছা এখন যা। ক্ষীর রাখ, আর খাবো না। এতো ঘন ঘন আসবি না, আমার মেজাজ খারাপ হয়। আর খাবার জিনিস তাই ফিরিয়ে দিলাম না আজ। এসব ছাতা মাথা আর আনবি না।

রুহী ভাবীর মুখের দিকে তাকায়। জান্নাত চোখের ইশারায় রুহীকে বলে চলে যেতে। একদিনে এই লোকের মান ভাঙানো কারো সাধ্যি? সে এক তপস্যার ব্যাপার। রুহী চোখ মুছে মাথায় ঘোমটা টেনে চলে যায়। শামির তাকিয়ে থাকে বোনের আনা ক্ষীরের বাটিতে। জান্নাত ওকে লক্ষ্য করে নিশ্চুপ হাসে কিছুক্ষণ, পর পর বলে,“আরেকটু দেবো ক্ষীর?”

শামির ভেতরে ভেতরে মৃদু শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ায়, গম্ভীর কন্ঠে বলে,“না। আমি অত লোভী না।”

জান্নাত আপনমনে হাসে। সে জানে তার স্বামী যথেষ্ট ভোজনরসিক একজন মানুষ। পিঠা পুলি জান্নাত বানাতে পারতো না, বিয়ের পর শামিরের জন্য শিখেছে। এই ক’মাসে এমন কোন সপ্তাহ নেই জান্নাত পিঠা,পায়েশ, ক্ষীর বানায়নি। জান্নাত এটাও জানে নিজেকে নির্লোভী দাবি করা লোকটা পায়েশ ক্ষীর ফ্রিজে রেখে খেতে ভীষণ ভালোবাসে, ঠান্ডা ঠান্ডা। গত ক’মাসে জান্নাতের জীবনের প্রথম প্রাধান্যতা ছিলো তার স্বামীর “রসনা বিলাস”। সেই ভাবনা আর অভ্যাস থেকে আপনা আপনি জান্নাত ক্ষীরের বাটিতে নিয়ে ছোটে ফ্রিজে রেখে আসতে।

খানিক বাদে যখন ঘরে ঢুকলো তখন শামির কথাটা তুললো, এতক্ষণ যেটা চেপে রাখতে চেয়েও রাখতে পারেনি। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,“খুব ভণ্ড হয়েছো হ্যা জান্নাতুল ? আমার বোনের ব্যাপারে অধিকার দেখছি আমার থেকেও বেশী দেখাচ্ছো। রুহী তন্ময়ের সম্পর্ক নিয়ে খুব কনসার্নড তুমি। কিসের ভিত্তিতে? অথচ আমার থেকে তালাক চাও। এতো দুমুখী আচরণ কেন?

আবার শুরু এই লোকের “হারেরেরে” ভজন। জান্নাত তপ্ত শ্বাস ফেলে জবাব না দিয়ে বিছানা গোছায়। শামিরের প্রেসক্রিপশন সবগুলো গুছিয়ে রাখে। ডাক্তারের পরামর্শে শামির তামিলনাডুতে পায়ের অপারেশন করাবে,কাগজপত্র গুলো যদি তখন প্রয়োজন হয়?

শামির চেঁচিয়ে ওঠে এইবার,
_কি হলো জবাব দিচ্ছো না কেন? শা’লা আমার হয়েছে যত জ্বা’লা!হাত দিয়ে কিছু করতে পারছি না পা ভেঙে বসে আছি তাই মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছি না ভালোবাসি তাই।

জান্নাত হাসলো এমন করে যেন একটা কৌতুক শুনলো। পর পর হাসি থামিয়ে বললো,“আরো কিছু বলা বাকি আছে আপনার?”

_তুমি যেসব কাজ-বাজ করে বেড়াচ্ছো ইদানীং, কিছুই তো বলছি না।

_কে বলতে নিষেধ করেছে? বলুন। আপনি বলুন। আমি তো কানে তুলোও আটিনি। আমি শুনবো।

_সেটাই তো, বলার তো কতকিছু আছে। কত গালি আর থাপ্পড় যে জমা পরে যাচ্ছে জান্নাতুল! তুমি ভাবতেও পারবে না। অথচ আমি নিরুপায়। ভালোবেসে ফেলেছি তাই।

লোকটার মুখে ভালোবাসার কথাগুলো যতটা মায়া মায়া লাগছে শুনতে, উপলব্ধি করতে ততটাই কষ্ট হচ্ছে জান্নাতের। জান্নাত ইনিয়ে বিনিয়ে জবাবটা দেয়,“ভালোবাসা? হ্যা ভালো তো বেসেছেন। ডাক্তার ফারিনকে ভালোবেসেছেন, আমাকেও ভালোবেসেছেন, এর পরে যাকে বিয়ে করবেন তাকেও ভালোবাসবেন। আপনাদের পুরুষদের মনে ভালোবাসা জিনিসটার অভাব নেই আসলে। আপনাদের যদি বলা হয় একসাথে পৃথিবীর সব মেয়েদের ভালোবাসো, আপনারা বাসবেন এবং কারো ভাগে একটুও কম পরবে না। মহান আপনাদের জাতটা।”

শামির চ’ম’কে উঠলো হঠাৎ। তার ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে এতো পাকা পাকা কথা তার সেদিনের পুঁচকে বৌ বলছে! এই কথার পিঠে শামির জবাব দিলো না কোনো। এই মেয়েটা পণ করেছে শামিরের ভালোবাসা সে বুঝতে চাইবেই না। নয়তো কি করে নিজেকে ফারিনের সাথে তুলনা করে? ফারিনকে জীবনে ধরে রাখার জন্য এতো চেষ্টা শামির করেছে? এই মেয়ে এতো গর্দভ আর উশৃঙ্খল হয়ে উঠলো কেন?

এই বিকেলে জান্নাত শোবে না, তাই সে ফোনটা নিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ ফোন ঘেটে হঠাৎ বেশ শব্দ করে বলে উঠলো,“অফিস কলিগের সাথে পরকিয়ায় জরিয়ে পরেছে স্ত্রী। রাজশাহীতে স্বামীর একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা।”

একটা খবরের হেডলাইন। জান্নাত কমেন্ট বক্সে ঢুকে জনৈক পুরুষ লোকদের মন্তব্য গুলো দেখে। সেগুলো ইচ্ছে করেই শামিরকে পড়ে শোনায়,এক লোক লিখেছে,“আরো চাকরি করাও বৌকে দিয়ে।”

এছাড়াও একাধিক লোক নারী স্বাধীনতা ও বেগম রোকেয়াকে তুলোধুনো করতে ছাড়েনি। শামিরও জান্নাতের কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, যেন এটি তার মনের মতো একটি খবর। চোখের ইশারায় জান্নাতকে যেন বলছে,“দেখেছো? দুনিয়ার কি হাল দেখেছো? আমি তো শুধু শুধু এমন করিনা!”

চোখ নামালো জান্নাত, একটা মৃদু শ্বাস ফেলে শামিরের কৌশলটাই কাজে লাগালো। ফোনের দিকে চেয়ে থেকে একা একা বলতে লাগলো,“ওও বুঝেছি, মেয়েটা হয়তো কর্মক্ষেত্রে কোনো মেয়ে কলিগের সাথেই পরকীয়া করেছে। নয়তো কমেন্টে মানুষ ঐ পরকিয়া প্রেমিকের কথা তুলেও গালিগালাজ করতো। সেটা করেনি কেউ। সব দোষ নারীটির হলো।”

একটু থেমে জান্নাত অল্প হেসে আরো একটা খবর পড়লো,এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সিলিংয়ের গ্রুপ।

বাড়িতে বৌ রেখে স্বামী অফিসের পিএ নিয়ে থাইল্যান্ড যায়। সেটি স্ত্রী ধরে ফেলেছে। বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে তালাকের কথা ভাবছেন না তিনি।

পুরুষের বহুগামীতার এরকম দু তিনটে খবর শামিরকে পড়ে শোনায় সে। সাথে সাথে বলতেও থাকে,“এই হচ্ছে পুরুষ জাত। সুযোগ পেলেই এদের মনটা মুখিয়ে থাকে নতুন নারীর জন্য।”

শামির বুঝতে পারে জান্নাতের উদ্দেশ্য কি। সে অবাক চোখে দেখে সেদিনের মেয়েটার মস্তিষ্কের কত কৌশল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,“এসব কেনো শোনাচ্ছ আমায়? মনে রেখো, সব পুরুষ এক না জান্নাতুল। তোমার সাথে বিয়ের পর তিনটা ডেটের প্রপোজাল আমি পেয়েছি। ঐ মেয়েগুলোকে যাস্ট “গেট লস্ট” বলে তাড়িয়ে দিয়েছি!”

এবার জান্নাত চোখ তুলে তাকায় সরাসরি শামিরের চোখে। বলে ওঠে,“জি জি। সব পুরুষ এক নয়। সব নারীও এক নয়। সব নারী স্বামীকে লাত্থি মারার জন্য পড়াশোনা করে না।”

শামির চুপ হয়ে যায়। পরিবেশটা কেমন গুমোট ভাব ধরেছে। হঠাৎ করেই জান্নাত মুখ হাসি হাসি করে ফোনটা রেখে দিয়ে হালকা গলায় বলল,“আরে ধূর আমি কাজ-বাজ রেখে কি সব দেখছি। সোস্যাল মিডিয়ার এসব অসুস্থ খবর দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই। এসব খবরে আমার মাথায় চাপ পরে, পুরুষের উপর অকারণে রাগ ওঠে। আমার চোখের সামনেই তো কত চরিত্রবান, ভালো ভালো উদাহরণ আছে পুরুষ জাতের। আমার শ্বশুর শারাফাত চৌধুরী, হাওলাদার বাড়ির কর্তা মোশাররফ চাচা। অ্যাডভোকেট চাচার ছেলে নুহাশ ভাই। এরা কত বাধ্য বৌয়ের। সোস্যাল মিডিয়ার পাঁচমেশালি খবর দেখে যারা নিজের জীবনে অহেতুক মানসিক অস্থিরতা বজায় রাখে তারা আসলে “বলদ”। আমি তো বলদ নই।”

জান্নাত উঠে মিছিমিছি কাজ করছে ঘরের, তার উদ্দেশ্য এখানেই থাকা, এখানে থেকে শামিরকে কথা শোনানো। জান্নাতের শেষ কথাটায় শামির মুখ ফুলিয়ে থাকে। বলে,“ওনারা সবাই চরিত্রবান। আর আমি নই?”

জান্নাত থামে, জবাব দেয়,“হ্যা হ্যা। আর আপনিও চরিত্রবান। আপনিও ভালো। মাঝে মাঝে একটু গালি দিয়ে অপমান করে বসেন তাতে কি? আপনার চরিত্র তো ভালো। মাঝে মাঝে বিছানায় অকারণে ধমকাধমকি করেন, তাতে কি? আপনার চরিত্র তো ভালো। মাঝে মাঝে বাপ তুলেও গালি দেন,তাতে কি? আপনার চরিত্র তো ভালো। মাঝে মাঝে বিছানায় একটু জবরদস্তি করেন। তাতে কি? আমি আপনার বৌই তো, আপনার চরিত্র তো ভালো।”

থমথমে হয়ে আছে শামিরের মুখটা। জবাব দিলো খানিক বাদে, বললো,“একটু শুকরিয়া, না কখনো আগে ছিলো, না এখন আছে। পরতে যদি কোনো গাঁজা খোর রেন্ট টেকারের ঘরে তবে বুঝতে!”

জান্নাত যেন উত্তরটা তৈরি করেই ছিলো, বললো,“আমি পরেছি শামির চৌধুরীর ঘরে। তাই সে অনুযায়ীই আমার চাহিদা রাখবো। আমি খুব ভালো আছি, তাই বলে আরেকটু ভালো থাকতে চাইতে পারবো না এটা তো বিয়ের সময় কোথাও লেখা দেখিনি! আপনি চাহিদা কমিয়েছেন কখনো? না তো। উল্টো দিনের পর দিন বাড়িয়েছেন। আমিও তাই।”

_আমার কি চাহিদা?
অবাক হয়ে জানতে চায় শামির।

_ঐ যে। রাতে ন্যাকামি করে বলতেন “কাল অল্পতেই ছেড়েছিলাম, আজ দুই ঘণ্টায়ও ছাড়বো না।” সেটাই আমি বোঝাতে চাইছি। অল্পতে কে সন্তুষ্ট থাকে যদি চোখের সামনে দেখে তার আরো অনেক কিছু পাওয়ার সুযোগ আছে? এটাই মানুষের প্রবৃত্তি। অথচ আপনি আর আপনারা এই আচরণ করলে জায়েজ। আর জান্নাতুল করে বসলেই “শুকরিয়া নেই জান্নাতুলের।” যা পেয়েছে সেটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত?

কথা বলতে পারছে না শামির, তার ফিরতি জবাব আসছে না। জান্নাত প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,“যাক সে কথা। আমরা অহেতুক তর্ক করছি। এসব করার তো দরকার নেই। আপনি আপনার নীতিতে বলীয়ান থাকুন। এমন না করলে যে পুরুষের সৌন্দর্য কমে যাবে। সে কি সর্বনাশের কথা!”

আসরের আজান দিয়েছে। জান্নাত ঘরেই জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নেয়, আর শামির দেখতে থাকে মেয়েটিকে। কথাবার্তায় নয়, দশ দিনের ভেতরে পরিবর্তন এসেছে মেয়েটির চাল চলন আর হাঁটাচলায়ও।

নামাজ শেষে শামিরকে ফল কেটে দেয় জান্নাত। এর মাঝে শামা এসে বলে,“বাগানে যাবে ভাবী? আমার ফুলগাছে নিড়ানী দিয়ে দেবে।”

_হ্যা আসছি।

শামা চলে যায়। জান্নাত ঘর থেকে বেরুনোর প্রস্তুতি নিলে শামির আটকে দিলো,“যাবে না তুমি।”

_কেন? বাগানের আশেপাশে পর্দাঘেরা তো।

_আমি এখানে একা। তুমি যাবে না।

মানুষটাকে জান্নাত দেখলো, ভেতরে ভেতরে শ্বাস ফেলে বলে,“একা তো কি?”

_একা তো কি মানে? কতক্ষন এভাবে চার দেয়ালের মাঝে থাকা যায়? আমি কি রোবট?

দাঁড়িয়ে পরলো জান্নাত, বললো,“আমি তো প্রায় এভাবেই থাকি। আমার তো অসুবিধা হয়না!”

শামির এবারো কোনো জবাব দিলো না। জান্নাত ঘর থেকে বেরুলো ঠিকই,তবে তার মন টানলো না কোথাও যেতে। ঘুরে আবার ঘরেই ঢুকে চুপচাপ বিছানায় বসলো। এবং গম্ভীর হয়ে বসেই রইলো।

শামির নিস্পন্দ চোখে দেখছে জান্নাতকে। বাইরে থেকে আসা কমলা রঙের রোদে জান্নাতের ফর্সা মুখটা সোনার মতন ঝকঝক করছে। শামিরের মুগ্ধতা কাটে ফোনের শব্দে। জান্নাত উঠে কলটা রিসিভ করে শামিরের কানে ধরলো ফোনটা। ওপাশ থেকে রাজন কিছু একটা বলতেই শামিরের ভ্রু কুঁচকে গেলো, চেঁচিয়ে উঠলো,“হিসেবটা আমি কিভাবে এখনি দেবো? শায়ন বাড়িতে নেই। আমি টাইপ করতে পারবো এই হাতে?”

_কিন্তু হিসেবটা লাগবেরে ভাই। শামাকে দিয়ে টাইপ করা!

কল কাটলে শামির জান্নাতকে বললো,“শামাকে ডেকে আনো।”

শামা ততক্ষণে ও পাড়ায় এক বান্ধবীর বাড়িতে গিয়েছে। এবার বেশ রাগ ধরে গেলো শামিরের। জান্নাতকে বললো,“ল্যাপটপ টা নিয়ে এসো।”

শামিরের সাতটা আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ করা ছিলো। জান্নাত ল্যাপটপ আনতেই আঙুলের অগ্রভাগ থেকে ব্যান্ডেজ সরাতে গেলেই বেশ ব্যাথা পেলো শামির। জান্নাত ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে থামিয়ে দিল শামিরকে। পাশে বসে নরম গলায় বলল,“কি করতে হবে? আমাকে বলুন, আমি করে দিচ্ছি!”

_পারবে তুমি?

জান্নাত ল্যাপটপ অন করে চুপচাপ মাথা নাড়ে। শামির ওকে দিয়ে হিসেবের ফাইলটা বের করিয়ে বললো,“এখন ব্যালেন্স টা বের করতে হবে। তুমি এগুলো সব ক্যালকুলেট করো। যাও ক্যালকুলেটর নিয়ে এসো।”

জান্নাত তাই করলো। চুপচাপ শামিরের কথা অনুযায়ী কাজ করছে। আর শামির নির্দেশনার ফাঁকে ফাঁকে দেখছে জান্নাতকে। হঠাৎ একটু থেমে বললো,“এতো কিছু কিভাবে শিখলে?”

_শিখিনি। আপনি রাত জেগে কাজ করতেন, আমি পাশে শুয়ে দেখতাম। দেখতে দেখতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে।

শেষ বিকেলের মৃদু হাওয়ায় মেঘ সমান কালো, লম্বা চুল গুলো উড়ছে জান্নাতের। যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে শামিরের। কি যে স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটিকে ! হঠাৎ শামির অনুভব করলো যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে জান্নাত কাজটা করছে সেই আত্মবিশ্বাসে শামিরের জ্বলুনি হচ্ছে না। মোটেই হচ্ছে না।

চোখ তুললো জান্নাত। চোখাচোখি হলো দু’জনের। শামির গলা খাঁকারি দিয়ে নামিয়ে নিলো চোখ। জান্নাত বলে উঠলো,“ওপরের হিসেবটা ঠিক করে দেবো? ডেবিটের ঘরে সংখ্যাটা সম্ভবত ভুল।”

শামির তাকায় ল্যাপটপের স্ক্রিনে। পর পর বললো,“এতো কিছু রাতে দেখে দেখে শিখেছো?”

মাথা নাড়ায় জান্নাত, আস্তেধীরে বলে,“সাইন্স খুব ব্যায়বহুল হবে বিধায় আমি শুরুতে কমার্স নিয়েছিলাম। চার মাস ক্লাসও করেছিলাম।‌ তারপর হেডস্যার এসে বললেন,“তুই সাইন্স নে। আমি তোকে পড়াবো।”

শামির ভীষণ অবাক হয়, অস্ফুটে বলে,“চারমাসে অনেক কিছু শিখেছো।”

জান্নাত যেন সবকিছু ভুলে হঠাৎ খুব লাই পেল শামিরের কাছ থেকে, যেন খুব আস্কারা পেলো, উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,“আমি খুব হিংসুটে ছিলাম জানেন, আমার চেয়ে বেশি কেউ পারবে এটা আমি মানতেই পারতাম না, তাই কোনো পাঠ্যবই পেলেই একেবারে গিলে খেয়ে ফেলতাম।”

খিলখিলিয়ে হাসছে জান্নাত। শামির ওর হাসি দেখে। জান্নাত হাসতে হাসতে হিসেবটা ঠিক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে মাগরিবের আজান দিয়েছে। জান্নাত ল্যাপটপ তার যায়গা মত রেখে এসে শামিরকে ধরে,“উঠুন এখন একটু হাঁটবেন। ডাক্তার বলেছে একটু আধটু হাঁটতে। নয়তো মেরুদন্ড ধরে যাবে।”

ধীরে ধীরে শামির ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটল সন্ধ্যেটা, ওকে পাশ থেকে ধরে থাকলো জান্নাত। দোতলার করিডোর পেরিয়ে বারান্দায় গেলো একটু বাইরের বাগানের ফুলের ঘ্রাণ নিতে। সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো শামির। ওপাশে সেই এক শতাংশ জমিতে রুহী আর তন্ময় ফুলের গাছ লাগিয়েছে অনেক। সন্ধ্যা বেলা অফিস থেকে এসে তন্ময় বৌকে নিয়ে সেখানে চেয়ার পেতে বসে চা খাচ্ছে। শামির কিছুক্ষণ ওদের দেখে জান্নাতকে বললো,“ঘরে নিয়ে চলো।”

জান্নাত তাই করলো। একটু হেঁটেই শামিরের পায়ে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। ওকে দু’হাতে আগলে ধরে জান্নাত নিচুগলায় বললো,“সবটুকু ভর আপনি আমার গায়ে দিয়ে হাঁটুন। ও পায়ে মোটেও ফেলবেন না।”

_পারবে তুমি?

_জি।

জান্নাত বেশিক্ষণ ভর ধরে রাখতে পারলো না, শামিরকে বিছানার কাছটাতে এনেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। ফলাফল, শামির পরলো আগে বিছানায়, তারপর পরলো জান্নাত, শামিরের বুকেই।

ব্যাথার তোড়ে তীব্র আর্তনাদ করতে গিয়েও শামির করলো না। দাঁতে দাঁত পিষে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল জান্নাতের সিঁথিতে। জান্নাত শামিরের বুক থেকে মাথা তুলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসলো, লোকটার নীল হয়ে যাওয়া ব্যথাতুর মুখটা দেখে ছটফটিয়ে উঠল,“দুঃখিত দুঃখিত। আমি না বুঝতে পারিনি। আপনি ব্যাথা পেয়েছেন বেশি?”

এলোমেলো হয়ে আছে জান্নাতের খোপা খুলে আলগা হওয়া চুল। ঠোঁট কাঁপছে জান্নাতের, মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে মেয়েটা। শামির হঠাৎ ম্লান হাসলো, জান্নাত আরেকটু এগিয়ে ওর বুকে হাত রেখে কেঁদে দিয়ে বললো,“ব্যথা পেয়েছেন বুকের পাঁজরে?”

দু’পাশে মাথা নাড়ে শামির। আস্তেধীরে বলে,“নাহ। ভালোই লাগলো।”

চলমান……