জায়া ও পতি পর্ব-৩২

0
2

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৩২
#ইসরাত_ইতি

[ এডাল্ট টপিক আছে,গল্পের প্রয়োজনে আনতে হচ্ছে বারবার। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে পড়বেন । এবং হ্যা, লেখনীতে ধরাবাঁধা নিয়মের শালীনতার মাত্রা ছাড়ানোর জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ]

জানালার কাঁচ গলিয়ে উঁকি দিলো শামির বাইরে। আকাশে সিঁদুর রঙের মেঘ জমেছে আজ হঠাৎ করেই। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পরবে ধরণীতে। একটুও সময় নেবে না।

জানালার কাঁচ ঠেলে সরিয়ে দেয় শামির, ত্বরিৎ গতিতে বাইরের ফুরফুরে শীতল হাওয়া তক্ষুনি এসে শামিরকে ছুঁয়ে দিলো। উগ্রমেজাজী লোকটার মেজাজটা ধপ করে পরে গেলো প্রশান্তিতে।

শামিরের মেজাজ টা এতক্ষণ গরম ছিল কারণ জান্নাত ফিরতে দেরী করছে। নিশ্চয়ই খুব মজা করছে বাইরে? রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাহা হিহি করতে করতে ফুসকা খাচ্ছে। ভুলেই বসে আছে শামিরের ওষুধ আছে সন্ধ্যার আগে।

না ওষুধটা শামির একাই খেয়ে নিতে পারে,লাগবে না ঐ মেয়েকে। অনেক দয়া দেখিয়ে উদ্ধার করছে রোজ, লাগবে না আর কিছু।

মেজাজী শামির রাগ কমিয়ে অসহায় মুখ করে বসে থাকে। স্বাধীনতার মজা পুরোদমে নিচ্ছে মেয়েটা। আজ হিজাবে খুব সুন্দর লাগছিল জান্নাতকে। একেবারে শামিরের মনের মতো। পুতুল পুতুল। ঐসব এখন বাইরের ছেলেরা দেখছে। বুক জ্বলছে শামিরের।

আচ্ছা শামির কি বেশি জোরজবরদস্তি করতো জান্নাতের ওপর? বেশি কষ্ট দিতো?

কই? জান্নাত তো বোরখা পরে না,এই নিয়ে তো শামির কখনো চাপ দেয়নি ওকে। শামির জান্নাতের কষ্টটা দেখেছে, জান্নাত নামাজী মেয়ে, মন সাদা মেয়েটার, খুব বড় কারণ না থাকলে নিশ্চয়ই বোরখা পরতো? হয়তো এখনো মানসিক ভাবে তৈরি না, তাই শামির এটা নিয়ে কথা শোনায়নি কখনো। শামির তো শুধুমাত্র সীমারেখা টেনে দিয়েছে যাতে পর্দার গাফিলতি হলেও মোটামুটি ভাবে জান্নাত সেইফ থাকে।
এটা জোর জবরদস্তি করে আটকে রাখা?

নাহ! এসব “ছাতার মাথা” নিয়ে আর পর্যালোচনা করবে না শামির। অনেক হয়েছে। শামিরের মনে হচ্ছে সে বেশি নরম হয়ে পরছে। না এভাবে নরম হয়ে ভাবলে চলবে না। এতকিছু ভাবলে চলবেই না। সব কথার এক কথা,“তার ভুল নেই।”

না না ভুল আছে। ভুল একটাই তার, মায়ায় পরেছে মেয়েটার। আচ্ছা কি করে,কবে এতো মায়ায় পরলো? ভাবার চেষ্টা করছে শামির। চোখ বুজলো,দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো ভেজা ভেজা স্নিগ্ধসরল মুখটা। রোজ সকালে জানালা খুলে দিয়ে নিচুগলায় যে বলতো,“শুনছেন,আপনি বলেছিলেন সকালে ঘুম থেকে তুলে দিতে। আপনি এখন উঠবেন?”

পর পর ভেসে উঠলো কান্না কান্না ভাব ধরে থাকা মুখটা, শামিরের আলগোছে দেওয়া ধমকে যার ঠোঁট কাপতো,তবে কাঁদত না শামিরের সামনে। কাঁদত লুকিয়ে লুকিয়ে।

সেই মুখটা দৃশ্যপট থেকে বিলীন হতেই ভেসে উঠলো শামিরের সব কাজ গুছিয়ে দেয়া ঘর্মাক্ত মুখটা। হ্যা এসব দেখে দেখেই তো মায়ায় পরেছে শামির!

বাইরে বাড়ির গাড়ি এসে থেমেছে, শামির দেখতে পেয়েই জানালা টেনে দিয়ে ক্র্যাচে ভর করে নিচে নামে। সে দেখবে, মহারানী পাঁচ ঘন্টা সময় ব্যয় করে ঠিক কি কি বাজার করেছে।

ড্রাইভার গাড়ি থেকে মালামাল নামিয়ে নিয়ে গিয়ে কিচেনে রাখলো, শামির নিচে নেমে শুরুতেই দেখলো জান্নাতের ফ্যাকাশে মুখটা। দেরী হবার জবাবদিহিতা চাইতে গিয়েও চাইলো না। ঘুরে তাকালো সুহানার দিকে, গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলো,“কি হয়েছে?”

জান্নাত মাথা নিচু করে নেয়। সুহানা পর পর দুইবার ফাঁকা ঢোক গেলে, লুকায় না কিছুই। গড়গড় করে বলে দেয় আজ কি হয়েছিল।

ছেলেগুলো ঐ বিশ্রী মন্তব্য করার পর জান্নাত সামনে এগোতে পারেনি। ঘুরে ছেলেগুলোকে কিছুক্ষণ দেখেছে। চরম অসভ্য আর কিশোর গ্যাংয়ের অভদ্র ছেলে গুলো আড়ে আড়ে তাকিয়ে মজা নিচ্ছিল। কেন জানি তখন জান্নাতের খুব রাগ চাপলো। এরা সবাই বুঝদার ছেলে,কি করে পারে নারীর এমন বিষয় নিয়ে এভাবে বিশ্রী মন্তব্য করতে? মায়ের বুকের দুধ খেয়েই তো এরা বড় হয়েছে,এরা ভুলে গিয়েছে?
সুহানাও রেগে মেগে জান্নাতের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সুহানাই শুরুতে বলে,“কে বলেছে এই কথা?”

ছেলেগুলো এমন ভাব করেছিল যেন তারা আকাশ থেকে পরেছে, কিছুই বোঝে না। জান্নাতের বুক ধুকপুক করছিল,তবুও জা তার পাশে আছে দেখে বুকে বেশ সাহস সঞ্চার করে বলে উঠলো,“আমি কিন্তু দেখেছি কে বলেছো। ফালতু ছেলের দল, এই কথাটা নিজের মায়ের সামনে বলিও। তোমাদের মা খুব গর্বিত হবে।”

ভীষণ মিহি স্বরের মেয়েটির এমন রূঢ় জবাবে ওরা থতমত খায়। অল্পবয়সী গাধার দল তাই বোকামি করে সবাই একযোগে তাকায় মন্তব্যটা যে ছেলেটি করেছে তার মুখের দিকে। জান্নাত বুঝে নেয় সবটা। ভারি শ্বাস ফেলে ঐ ছেলেটিকে বলে,“তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তুমি মায়ের বুকের দুধ খাওনি। দেখে মনে হচ্ছে ছোটো বেলা থেকেই গাঁজা টানো। তাই হয়তো “আম আম” করে মজা নিতে পারলে। তোমার চেহারায় আমার থুথু।”

জান্নাতের গলা কাপলেও ওর গলার জোর মুহুর্মুহু বাড়ছিলো । সুহানাও কথা হারিয়ে জান্নাতের দৃঢ়তা দেখছিলো। ভাবছিল,এই কি সেই মেয়েটা? সেই জান্নাতুল?

ঐ ছেলেটা ত্যাড়া ভীষণ, উঁচু গলায় বলে,“কোনো প্রমাণ আছে আমি বলেছি?”

জান্নাত তখন দিশা হারিয়ে রেগেমেগে চিমসে শরীরের, নেশাখোরের মতো দেখতে ছেলেটার দিকে তেড়ে যায় চ’ড় মারবে তাই। সুহানা ওকে টেনে ধরে। আশপাশ থেকে কিছু লোক এসে ভিড় জমাতেই ছেলেগুলো যেন লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে চায়। জান্নাত তখন নিজের মধ্যেই ছিলো না, ওই আমওয়ালার ঝাপি থেকে পরপর চার পাঁচটা আম তুলে ছুড়ে মারে ছেলেটাকে লক্ষ্য করে। যদিও নিশানা ব্যর্থ হয়েছে। এবং পরবর্তীতে আমওয়ালাকে টাকা দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে গাড়িতে উঠে বসেছে জান্নাত।

সুহানা ধীরে ধীরে সবকিছুই বললো শামিরকে। শামিরের চোখদুটো তৎক্ষণাৎ বিস্ফোরণ ঘটায়। গোল্লা গোল্লা চাউনী আছড়ে পরে জান্নাতের সরল মুখটাতে, যে কিনা বসার ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলো মাথা নিচু করে। মনের মধ্যে কোথাও একটা তার সংকোচ জমেছে, এই লোক এখন তাকে খোঁচা দিয়ে বলবে,“আরো যাও বাইরে। মজা হলো তো? কেমন মজা হলো জান্নাতুল ফেরদৌস?”

শামির সেসব কিছুই বলে না, শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে জান্নাতকে। জান্নাত আড়ষ্টটা কাটিয়ে চোখ তুলতেই চোখে চোখে যখন দু’জনের মিলন ঘটলো, জান্নাত নড়েচড়ে উঠে চলে গেলো দোতলায়।

ওর পেছন পেছন শামিরও ঘরে ঢোকে খানিক বাদে। এতক্ষণ হেঁটে ভারি কষ্ট হচ্ছে তার। ক্র্যাচটা রেখে বিছানায় বসে পরে। তবে তার মনোযোগী দৃষ্টি আয়নায়,জান্নাতের প্রতিবিম্বে। মাথা থেকে হিজাব খুলছিল জান্নাত। আড়চোখে আবারো যখন আয়নায় শামিরের চোখে চোখ রাখে তখন শামির নিজের দৃষ্টি নামিয়ে গম্ভীর হয়। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,“সত্যিই চ’ড় মারতে নাকি?”

_হু।
নিচু স্বরে জবাব দেয় জান্নাত। শামির চোখ তোলেনা বরং আরো কিছুটা গম্ভীর হয়ে আমতা আমতা করে বলে,“অসভ্য,অজাত এবং মূর্খ ছেলেপেলে ওসব। আসলে এসব ছেলেপেলেতে ভরে গিয়েছে দেশটা। সেজন্য সব পুরুষ কথা শোনে।”

জান্নাত শ্বাস ফেলে জবাব দেয়,“জি। যেমন অসভ্য,অজাত মেয়েলোতে ভরে গিয়েছে দেশটা সেজন্য সবাই নীরিহ মেয়েদেরও কথা শোনায় অহেতুক।”

শামির চোখ তুললো, তবে গম্ভীরতা কাটলো না চেহারার, বললো,“আমি তোমাকে বলেছিলাম বাইরের পৃথিবী নোংরা!”

_জি বলেছিলেন, তাই তো নোংরাকে লাত্থি মারতে চাইলাম আজ।

থমথমে হয়ে যায় শামিরের মুখ, বললো,“আসলেই মারতে?”

_মনে তো হচ্ছে। হঠাৎ খুব সাহস এলো বুকে ।

বাইরে হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। শামির জান্নাত একইসাথে সেদিকে তাকায়। শামিরের কন্ঠস্বরে হঠাৎ তার উদাসীনতা প্রকাশ পেলো, জান্নাতের কথার জবাবে বলে উঠলো,“বেশ । আসলে নারীর এহেন স্বাধীনতা আর সাহসকে আমিও সাপোর্ট করি। ঐসব জানোয়ারদের লাথি মারাই উচিত। তবে কখনোই স্বামীর ওপরে গিয়ে নারীর বেশি বোঝাকে সাপোর্ট করবো না।”

জান্নাতও হঠাৎ উদাসীন হয়ে হাসলো। তবে বললো না কিছু শামিরের কথার জবাবে। ইদানিং লোকটা খুব কুচুটে ধরণের ঝগড়ুটে হয়েছে বাড়িতে বসে থেকে থেকে। কিছু হলেই ভীষণ ঝগড়া করে মেয়েদের মতো। জান্নাত ঝগড়া চায়না, এসব নিয়ে ঝগড়া করা অহেতুক ব্যাপার। সে লোকটাকে যতটুকু বুঝতে চায়, লোকটা ততবেশি এলোমেলো করে দেয় জান্নাতের ভাবনা।

_________

লাগামহীন বৃষ্টি পরছে সন্ধ্যা থেকে। এখন রাত দশটা, বৃষ্টি থামার নাম নেই। খেয়ে দেয়ে জান্নাত আর শামির ঘরে ঢুকলো। আজ লোডশেডিং হচ্ছে খুব। জেনারেটরের বাতিও জান্নাত নিভিয়ে রাখলো। আধো অন্ধকার ভালো লাগছিল, জানালা দিয়ে বিদ্যুৎ চমকানো দেখতে দারুণ লাগছিলো। পরিবেশটা ভীষণ ঠান্ডা, একটা মোমবাতি জ্বেলে ঘরটাকে সামান্য আলোকিত করে জান্নাত বেলকোনিতে যায়। সেখানে গিয়ে মাথায় হাত দেয়। কিছু ক্যাকটাস প্ল্যান্টস , যেগুলোতে বেশি জল লাগলে ক্ষতি, সেগুলোর টব জলে থৈ থৈ করছে। জান্নাত দ্রুত সেগুলো সুরক্ষিত করে।

শামির রাতের ওষুধটা খেতে পানি হাতে নেয়। জান্নাত খানিক বাদে বেলকোনি থেকে ঘরে ঢুকলো কাকভেজা হয়ে। বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়েছে তাকে ভালো মতন। দ্রুততার সাথে এদিক ওদিক না তাকিয়েই এক কোণে গিয়ে শাড়ি ছাড়লো সে, খুব ঠান্ডা এই বৃষ্টির পানি। কলিজা অবধি কাঁপছে জান্নাতের।

শামির ওষুধ হাতে তাকিয়ে আছে, তার চোখের সামনে বারো হাতি শাড়ি খুলে খুলে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের নারী। মোমবাতির ঐ টিমটিমে আলোতেও জ্বল জ্বল করছিলো হলুদ ফরসা রঙের ঐ শরীরটা। শামির তাকিয়ে আছে, ওষুধ খেতে ভুলে গিয়েছে সে।
বাইরে বাজ পরছে, আজ বহুদিন, বহুদিন পরে শামিরের পুরুষালি মনটা হাহাকার করে উঠলো। এ তার অধিকার, তার শান্তির যায়গা। অথচ শামির লুফে নিতে পারবে না, তার অপরাধবোধ হবে। যেই বোধ ঐ মেয়ে ঢুকিয়েছে কথার ছলে।

জান্নাত একটা শুকনো সুতির শাড়ি জড়িয়ে বুকে আঁচল টানতেই শামিরের সাথে চোখাচোখি হলো। লোকটার ঐ ব্যাকুল দৃষ্টিতে মেয়েটির পা থেকে মাথা হঠাৎ কাঁটা দিয়ে উঠলো। আজ বহুদিন, বহুদিন পরে লোকটার অমন দৃষ্টিতে বন্দি হলো জান্নাত। স্বামীর আদর ভালোবাসা সবসময় যে জান্নাত অত্যাচার মনে করতো,তেমনটা নয় আসলে। সবসময় না হোক, কখনো কখনো সেও তো ঐ শক্ত বুকে শান্তি পেতো। বিশেষ করে শামির যখন তাকে কোমলতা নিয়ে ছুতো। তখন জাগতো, জান্নাতের স্ত্রী সত্তা খুব ভালো করেই জাগতো।

জান্নাত ঢোক গিললো, শামির দৃষ্টি নামায়না। মুহুর্ত কাটে, বৃষ্টির ঝাপ বাড়তে থাকে, বাজ পরার শব্দ জোড়ালো হতে থাকে। হঠাৎ হতবুদ্ধি হয়ে জান্নাত তুতলে বলে,“আমি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আসলে….”

শামির হঠাৎ রেগে গেলো প্রচুর। দাঁতে চাপলো দাঁত। ভারি নষ্ট মেয়ে তো! শামির একটু তাকাতেও পারবে না? তাহলেই মনে করবে শামিরের শরীর চাই? এটার জন্যই বসে থাকে শামির চৌধুরী সারাদিন? রাগে গা কেঁপে উঠলো শামিরের, চোখ সরিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে,“কিছু লাগবে না। ঘুমাও।”

জান্নাত অবাক চোখে তাকাল, লোকটার হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলো না ও। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে জড়তা নিয়ে জান্নাত চুপচাপ শামিরের পাশে দূরত্ব নিয়ে শু’লো। শামির তীক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে ছিলো “মাসুম মাসুম” দেখতে মেয়েটার গোলগাল মুখে। আপনাআপনি ভেতরে ভেতরে একটা দীর্ঘশ্বাস বয়ে যায় শামিরের এবং কিছুক্ষণ ওভাবে চেয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল,“আচলটা সরাও।”

গুরুগম্ভীর স্বরে ঠান্ডা আদেশ। জান্নাত ভীষণ চমকালো কথাটাতে, বিব্রত হলো খুব। শুয়ে থেকেও মনে হচ্ছে কাঁপছে সে। শামির দ্বিতীয়বার একই সুরে বলে উঠলো,“আচলটা সরাও।”

হাঁসফাঁস করে উঠলো জান্নাত। খুব খারাপ লাগলো তার হঠাৎ। মিসক্যারিজের পরে এতকিছু হয়ে গেল, এখনো দু’জনের অন্তর্দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। কখনো বাচ্চাটার প্রসঙ্গ টেনে জান্নাতকে সহানুভূতি দিলোই না লোকটা। সারাদিন অভিযোগ করতেই ব্যস্ত থাকে, অথচ একটি বার স্বীকার করলো না,“জান্নাত ওটা আমাদের বাচ্চা ছিল। তুমিও কখনো ওর কথা ভেবে কষ্ট পেয়ো না।”

তবে তো জান্নাত বিগতদিন গুলোর সব তিক্ত অতীত মুছে লোকটার কাছে ঠাঁই নিতো, এবং দিনশেষে এটাই করবে জান্নাত।
কিন্তু জান্নাতের সব সুপ্ত বাসনাকে পায়ে দাবিয়ে সে দিনশেষে তার চরিত্রেই অটল থাকলো। আর আজ সেই একটুও না শোধরানো লোকটাকেই জান্নাতের আপন করতে হচ্ছে।

জান্নাত খুব স্বাভাবিক আচরণ করলো, চুপচাপ বুক থেকে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে দিতেই হঠাৎ দেখলো লোকটা তার বুকে পরম আবেগে আশ্রয় নিলো। ঠিক যেভাবে কখনো কখনো জান্নাত মাথা ঠেকাতো লোকটার বুকে। একই ভাবে ঠেকিয়েছে লোকটা।

গোটা শরীরটা ঝাকুনি দিলো জান্নাতের লোকটার এহেন আচরণে। পর পর হাত চলে গেলো শামিরের মাথার চুলে। এবং দু’জনে চুপচাপ, একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে ওভাবেই পরে থাকলো।

নীরবতা ভাঙলো শামির। সেই চিরায়ত গম্ভীর স্বভাব থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করে বলে উঠলো,“আমার ছোঁয়ায় কখনো ভালোবাসাও খুঁজে পাওনি তুমি? এই এখনো পাচ্ছো না জান্নাতুল?”

বড় বড় শ্বাস ফেলছে জান্নাত। সে থ হয়ে গিয়েছে। শামির বলতে থাকে,“বলো তো সত্যি করে!”

জান্নাত কি জবাব দেবে? সে এই লোকের এই রূপ হজম করতে পারছে না। শামির আরো মিশে যায় জান্নাতের নরম তনুতে, বলতে থাকে,“সবসময় চাহিদা নিয়েই ঘুরতাম? সারাদিন অফিস, বাইরের হ্যাপা সামলে ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরলে একটু শান্তিও তো খুঁজতাম তোমার মাঝে। সেগুলো বলো না কেন? ভালোবাসা নাকি কিসব ছাই, সেসব খুঁজে পেতেই না?”

জান্নাত ঢোক গেলে। বেশ খানিকটা সময় পর জবাবটা দেয়,“পেতাম তো, অস্বীকার করবো না। তবে ভালোবাসার সাথে আরো অনেক ভারি ভারি জিনিস থাকতো যে সেসব সরিয়ে আপনার ঐ ভালোবাসা বুঝে নিতে কষ্ট হতো। এখনো হয়।”

শামির চুপ হয়ে যায়। জান্নাত বলতে থাকে,“ওভাবে বারবার আপনাকে ছোট করতে চাইনি। ছোটো মানুষ মুখ থেকে কিসব বলে ফেলেছি রাগের মাথায়। অভিযোগ থাকলেও ছোটো করতে চাইনি আপনাকে।”

ম্লান হাসলো শামির, নিচু স্বরে শুধালো,“ছোটো মানুষ তুমি? কই? রুহীকে ভাগিয়ে দিতে আমাকে যখন ব্যবহার করলে তখন তো মনে হয়নি তুমি ছোটো!”

জান্নাত চোখ বন্ধ করে নেয়, ভাবলো সেদিনটা। শ্বাস ফেলে বললো,“আমি শুধু আটকে রাখতে চেয়েছিলাম আপনাকে কিছু সময়ের জন্য। কাছাকাছি থেকে গল্প করতাম, আমি ওসব মনে নিয়ে আপনাকে আটকাইনি। ছলনা করতে চেয়েছি,তবে ঐ উপায়ে নয়। আপনিই তো..”

এইবার এই কথাটাতে শামির হঠাৎ হেসে দিল, কিছুক্ষণ হেসে পুনরায় গম্ভীর হয়ে বললো,“ও, তো সেদিন ওটাও আমার বোঝার ভুল ছিল। এজন্যই দাদী হরহামেশা বলে পুরুষ মানুষের আসল শত্রু……তো আমি বুঝতে ভুল করেছি বিধায় আমার বোন পালিয়েছে! তুমি এখানেও নির্দোষ বনে গেলে! ”

জান্নাত ঘাড় ঘুরিয়ে জানালায় তাকায়। বৃষ্টি যেন থামবেই না আজ। শামিরের কথার জবাব সে দেয়না। শামির কথা থামিয়ে ওভাবেই ঘনিষ্ট হয়ে থাকলো মুহুর্তের পর মুহুর্ত। সুপ্তি ভাবীর কথা মোতাবেক আর মেলে ধরতে ইচ্ছে হলো না নিজেকে। তার চুপ থাকতে ভীষণ আরাম লাগছে। শান্তি পাচ্ছে সে এই বুকটাতে।
এই দ্বন্দ্বের, এই দূরত্বের, এই বিচ্ছেদের পরে আজ এই মুহুর্তটুকু দারুণ উপভোগ করলো দু’জনের অবচেতন মন। কেউ কাউকে আর খোঁচায় না, কোনো অভিযোগের প্রসঙ্গ টানে না। জান্নাত বৃষ্টির শব্দে আর লোকটার উষ্ণতায় ভুলে গেলো বিগত তিনটা মাস। শামিরও ভুললো।
শুধু নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে বেরিয়ে আসে প্রশান্তির আমেজ। যা একটা সুস্থ স্বাভাবিক দম্পতি হর হামেশাই একে অপরের মাঝে খুঁজে পায়।

আগামীকাল সকালে আবার কি হবে জানে না দু’জন। শামির আবারো তার অহেতুক ঠাটবাট নিয়ে জান্নাতের ওপর চড়াও হবে কি না, জান্নাত আবারো তালাক চেয়ে বসবে কিনা দুজন জানে না। তবে কিছু সময়ের জন্য দু’জন ক্ষমা দিলো দু’জনকে অভিযোগের পাতা থেকে।

“জায়াটি বাচ্চা মারার অপবাদ পেয়েছে, জায়াটি স্বাধীনতা না পাওয়ার কষ্ট পেয়েছে, পতিটি জায়ার অবহেলায় বাচ্চা হারিয়েছে, জায়া স্বেচ্ছাচারী হয়ে তালাক চাইছে বলে পতিটি কষ্ট পেয়েছে।”

কিছুক্ষণের জন্য এসব ধামাচাপা পরে গেলো। গুরুম গুরুম বজ্রপাতের আওয়াজও তাদের হুশ ফেরাতে পারলো না। ওরা দু’চোখ বুজে তলিয়ে রইলো এক শান্তির দুনিয়ায়,যেখানে জায়া পতিদের মাঝে অহেতুক বিষয়গুলি নিয়ে ঠোকাঠুকি হয়না।

চলমান…..