#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৩৩
#ইসরাত_ইতি
সেদিন রাত থেকে টানা এক সপ্তাহ বৃষ্টি ছিলো। আজ সকাল থেকে ধরণী জুড়ে ঝকঝকে রোদের খেলা। ছাদ থেকে আচারের বৈয়ম দু’টো দুহাতে আগলে নিয়ে জান্নাত নিচে নামলো। তার মধ্যে তাড়াহুড়ো ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আজ রুহীর রিসেপশন। বাড়ির সবাই তৈরি হচ্ছে,খানিক বাদেই কনভেনশন হলের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে সবাই।
জান্নাত আচারের বৈয়ম নিয়ে ঘরে ঢুকলো নিজের, শামির তৈরি হবে , তাকে সাহায্য করতে হবে।
সাদা রঙের একটা ব্লেজার স্যুট পরবে শামির আজ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ক্র্যাচে এক হাতের ভর রেখে আরেক হাতে চুল সেট করছিলো। জান্নাত আড়চোখে এক পলক শামিরকে দেখে তাকে অফ হোয়াইট রঙের শার্ট পরিয়ে বোতাম সবগুলো লাগিয়ে ওপরে ব্লেজার পরিয়ে দিলো, তারপর গিয়ে নিজে তৈরি হয়ে নেয়।
নীল রঙের বেনারসী কাতান জড়িয়েছে জান্নাত আজ গাঁয়ে। এই শাড়িটা শামির কিনে দিয়েছিল তাকে। আঁচল ঠিক করতে করতে সেই দিনটার স্মৃতিচারণ করে জান্নাত। শামির ওকে আর পড়াবে না সেকথা জানতে পেরে জান্নাত যেদিন রুপাতলী গিয়েছিল, এবং বাধ্য হয়ে আবার যখন শামিরের সাথেই ফিরে এসেছিল, সেদিন রাতে না খেয়ে, কেঁদেকেটে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো জান্নাত। সকালে উঠে দেখেছে লোকটা একটা শাড়ি আর একটা সোনার চেইন তার জন্য বিছানায় রেখেছে স্বান্তনা স্বরূপ, যেন তাৎক্ষণিকভাবে আরো একবার বোঝাতে চেয়েছে জান্নাতের চোখে আঙুল দিয়ে “দেখো দেখো, তোমার স্বামী এমনি এমনিই কত কি করতে পারে তোমার জন্য, প্লিজ আর ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে মাথা খেও না! আল্টিমেটলি তোমাদের নারীদের চাহিদা তো এই শাড়ি গয়নায় এসেই শেষ হয়। পড়াশোনা করে চাকরি করে তো এসবই কিনবে!”
যেন বাচ্চাকে ললিপপ দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেছে সেদিন।
নীল শাড়িতে বৌকে দেখে তাকিয়ে থাকে শামির কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ মুখটা বেজার হয়। এতো সুন্দর হতে হবে কেন একজন মানুষকে? আজ পাবলিক প্লেসে যাচ্ছে, কি অঘটন ঘটায় এই মেয়ে কে জানে!
জান্নাত অঘটন ঘটানোর মতো সাজলোই না তেমন আজ। তবে অঘটন একটা ঘটলো। ননদের বিয়ে খেতে গিয়ে জান্নাত নিজেই প্রস্তাব পেলো বিয়ের। রুহীর এক ঘনিষ্ট বান্ধবীর মা জান্নাতকে রুহীর কাজিন ভেবে ছেলের জন্য প্রস্তাব দিলেন রিজিয়ার কাছে। খবরটা শামিরের কানেও গিয়েছে।
সেই থেকে ঘোমটা টেনেই প্রায় অর্ধেকটা মুখ ঢাকা জান্নাতের । তারপর আর কমিউনিটি সেন্টারে ভিড় ভাট্টার মধ্যে গিয়ে সামাজিকতাও করেনি সে। রিজিয়া বণিক মেজো বৌমাকে আড়ালে থেকে বিশ্রাম নিতে বলেছে। সে তো তার ছেলেকে খুব ভালো করে চেনে।
রুহী তন্ময়ের রিসেপশনকে ঘিরে কত হৈ হুল্লোড় হচ্ছে। সেদিকে যাওয়ার সাহস নেই জান্নাতের। যতই হোক, ঐ লোকের মুখের লাগাম নেই, আবার সবার সামনেই যদি চেঁচামেচি শুরু করে অহেতুক ? এই অনুষ্ঠান মাটি করে কি লাভ?
শামির সামাজিকতার খাতিরে বোন আর বোন জামাইয়ের সাথে হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুললো তিন-চারটা। পরপর গম্ভীর হয়ে এসে বসলো রেস্ট রুমে,পায়ের ব্যাথার অযুহাত দিয়ে। এই কক্ষে জান্নাত এবং কিছু মহিলা ছিলেন। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে আশেপাশে। শামির এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বসে বাচ্চাদের দেখতে লাগলো। সে বাচ্চা ভীষণ পছন্দ করে, বাকি সবার মতো আহ্লাদী কথা বলে মুখের ফ্যানা না তুললেও ছোটো ছোটো বাচ্চা দেখলেই কোলে নিয়ে দোলাতে থাকে সে। ও বাড়ির তায়েফের একটা আঠারো মাস বয়সী ছেলে আছে। কক্ষময় হাটি হাটি পা পা করছিলো। বাচ্চাটাকে কাছে ডেকে শামির নিজের কোলের ওপর বসালো। কোনো কথা নেই, শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো, দৃষ্টিতে সরল মুগ্ধতা তার। বেশ গোলুমলু বাচ্চাটা। জান্নাত যখন প্রেগন্যান্ট ছিলো,তখন শামির কল্পনায় ঠিক এমন গোলুমলু বাচ্চারই প্রতিচ্ছবি আঁকত। খুব করে চাইতো মেয়ে হলে যেন মুখের আদল হুবহু জান্নাতের মতো হয়। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ভেতরে ভেতরে আবেগী হলো শামির।
জান্নাত অদূরে বসেই লোকটাকে দেখছিলো। বুঝলো, লোকটা বাচ্চাদেরও আদর করে তার নিজের স্টাইলে। কিন্তু একটু হাসলে কি হয়? একটু হাসলে বুঝি মান কমে যাবে তার? সে বুঝি শামির চৌধুরী থাকবে না?
তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, জান্নাত দেখেছে এর আগেও, বাচ্চারা এই লোকটার সাথে খুব ভালো মেশে। শামিরের কোলে সব বাচ্চা ভদ্র হয়ে বসে থাকে। কে জানে? হয়তো ওরাও ভয় পায় লোকটাকে, হয়তো ভাবে “তিড়িং বিড়িং করলে এই লোক চাটি মারবে, তাই চুপ থাকি! আদর নিই!”
ভাবতে ভাবতে আপনমনে হেসে ওঠে জান্নাত, পরপর মুখটা ফ্যাকাশে হলো নিজের বাচ্চাটার কথা মনে করে। একদিন এভাবেই দেখতো না সে শামির আর তাদের বাচ্চাকে?
হঠাৎ কক্ষে ঢুকলো সুহানার ছোটো বোন সুজানা, তার বরকে নিয়ে নেমন্তন্ন খেতে এসেছে। জান্নাতের সাথে দুয়েকবার কথা হয়েছিল, বয়সেও জান্নাতের বয়সী। বরিশাল মহিলা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে। মাধ্যমিকে থাকতেই চাচাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করেছিলো, চাচাতো ভাই নেভি অফিসার। বাড়ির লোকজন মিলে দু’জনের বিয়ে দিয়ে দেয়।
সুজানা মেয়েটা স্বভাব সুলভ খুব হাসিখুশি একটি মেয়ে। শামির জান্নাতের সাথে নিজের বরের পরিচয়পর্ব শেষ করে হাসতে হাসতে জান্নাতকে বলে,“এই জানো কাল আমার এক্সাম আছে, অথচ আমি বিয়ে খেতে এলাম। তবে যাই বলো,এই পড়াশোনা করতে আমার একটুও ভালোলাগে না। গলার কাঁটা মনে হয়। তবে এই যে আমার বরমশাই, তার ইচ্ছে আমি পড়ালেখা করে কিছু একটা হই। সবসময় এই ব্যাপারে খুব শাসন তার।”
শামির চুপ করে আছে। জান্নাত হাসতে হবে তাই মলিন হাসলো। সুজানা ছটফটিয়ে বললো,“তুমি কেন পড়াশোনা করছো না জান্নাত ভাবী? আপু বললো তুমি মেধাবী ছাত্রী ছিলে!”
জান্নাত হঠাৎ শামিরের দিকে তাকায়, শামিরও চেয়ে আছে। ওর দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখেই জান্নাত সুজানাকে নিচু স্বরে বললো,“আমারো পড়তে ইচ্ছে করে না। তাই বাদ দিয়েছি।”
সুজানা হাসলো,“ওমা তাই? শামির ভাইয়া শুনলো তোমার কথা? জোর করলো না পড়াশোনা করতে?”
জান্নাত চোখ নামায়, পর পর মিষ্টি করে হেসে সুজানাকে বলে,“না, উনি আমার মনের ওপর জোর করেন না কখনো।”
জবাব টা দিয়ে জান্নাত হাঁসফাঁস করে উঠলো। প্রসঙ্গ পাল্টানোর তাড়া কাজ করছে তার মাঝে। নির্বাক তাকিয়ে আছে শামির, শামিরের দিকে আর একটিবারও তাকালো না জান্নাত। সুজানার হাত ধরে বললো,“বাদ দাও,চলো তোমাকে সুহানা ভাবীর কাছে নিয়ে যাই।”
হলভর্তি ছেলে ছোকরার দল। বর কনে নিয়ে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই শামির বাড়িতে যাওয়ার তাড়া দেখালো। সে আসার পর থেকেই দেখেছে, এমন কোনো অল্পবয়সী ছেলেটি নেই যার দৃষ্টি জান্নাতের মুখে আটকায়নি। ঘন্টার পর ঘন্টা ধৈর্য্য ধরেছে শামির আজ। আর পারছিলো না।
তবে অনুষ্ঠানের শেষেও একটা কান্ড ঘটল। তন্ময়ের একজন খালাও জান্নাতের পরিচয় জানতেন না সঠিক ভাবে, শুধু জানতো এই মেয়েটি চৌধুরী বাড়ি থেকে। অনুষ্ঠানের ভিড়ের মধ্যে এতো নম্র ভদ্র বাচ্চা বাচ্চা দেখতে চমৎকার একটি মেয়ে তন্ময়ের বড় খালা পারুলের নজর কাড়লো। শামির তখন ড্রাইভারকে খুঁজছিল জান্নাতকে নিয়ে বাড়িতে যাবে তাই, গিয়ে শামিরকেই ভদ্রমহিলা বললো,“শামির এই কি তোমার ছোট বোনটি? তা তোমার এই ছোটোবোনের বিয়ে দেবে কবে? আমাকে বলো, আমার হাতে পাত্র আছে। সৈকতের নাম শুনেছো? মহিমা আপার ছেলে, বিমানবাহিনীতে আছে। মস্ত বড় অফিসার।”
শামির থমথমে মুখে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে থাকে। জান্নাত মাথা নিচু করে নেয়। ভদ্রমহিলা আরো কিছু বলবে তখন শামির জলদগম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,“বৌ আমার এটা, ছোটো বোন নয়।”
ভদ্রমহিলা জিভ কাটলেন, ক্ষমা চেয়ে পরিচিত হয়ে নিলো জান্নাতের সাথে। জান্নাত তখন থেকে খেয়াল করছে ছোটো অভিমানী বাচ্চা ছেলেদের মতো মুখ ফুলিয়ে আছে শামির। পুরো রাস্তায় কিছু বললো না, বাড়িতে পৌঁছে জান্নাত যখন ওর ব্লেজার খুলতে সাহায্য করতে গেলো তখন গম্ভীর হয়ে বললো,“পারবো আমি।”
জান্নাত দেখলো মানুষটাকে। বুঝলো সবটাই, হঠাৎ অবচেতন মনটা জান্নাতের খুব মজা পেলো। এই লোকের এখানেও বাড়াবাড়ি,খুব হিংসুটে। ভীষণ হিংসুটে জান্নাতকে নিয়ে। মৃদু শ্বাস ফেলল জান্নাত, বললো,“রেগেছেন কেনো? বুঝতে পারেনি মহিলা গুলো, প্রস্তাব দিতেই পারে। আমি তো আর ওই অফিসার পাত্রের কাছে দৌড়ে যাইনি! আপনাকে কখনো কখনো একটা বাচ্চা ছেলের মতো লাগে।”
শামির জবাব না দিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে জান্নাতকে দেখছিলো। কেন জানি এই একটা বিষয় জান্নাতের খুব ভালো লেগেছে আজ। একটা কঠিন পুরুষ মানুষ তাকে নিয়ে হিংসা করে বাইরের ছেলেদের সাথে, মেয়েদের মতো হিংসুটে লোকটা।
জান্নাত ওর ব্লেজার খুলে শার্টের বোতামে আঙ্গুল রেখে হঠাৎ কৌতুক করে বললো,“আচ্ছা আমি যদি না থাকি, তবে আরেক নারী এলেও আপনি তাকে নিয়ে এভাবে হিংসে পনা করবেন তাইনা? কারণ আমি বৌ তাই আমাকে আগলে রাখেন, এমনিতে আলাদা করে “জান্নাতুলের” কোনো বিশেষত্ব নেই আপনার কাছে। আমার যায়গায় সেই নারী এলেও তাকে নিয়ে এভাবে হিংসা করবেন? তার জন্যেও বিয়ের প্রস্তাব এলে এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর করে,ছোটো বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে রাখবেন?”
কথাগুলো শেষ করতেই গলা কেঁপে উঠলো জান্নাতের। আচমকা রেগে জান্নাতের হাতটা সরিয়ে দেয় শামির। এমনিতেই মেজাজ গরম ছিলো,এই মেয়ে সীমা ছাড়ালো। ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে শামির বললো,“যাও এসব তোমাকে করতে হবে না। তুমি চলে গেলে নতুন যে নারীটা আসবে সে করবে। তোমার কি?”
জান্নাত ধাক্কা খেয়ে মলিন হাসে, আবারো এগিয়ে যায় লোকটার কাছে। হাতটা লোকটার শার্টের বোতামে রেখে বলে,“যাবো তো, আপনি সুস্থ হলেই। ততদিন এই বোতাম গুলো আমিই খুলি..”
জান্নাতের ত্যাড়া কথায় শামির হঠাৎ এক কান্ড করে বসলো, মেয়েটার কোমর চেপে ধরে কাছে টেনে আবার ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেললো। জান্নাত চমকালো না, লোকটাকে তো সে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনেছে। তালাকের কথা শুনতে পারে না। জান্নাত বিছানায় পরার পরেই শামির ওর ওপর চড়াও হলো উত্তপ্ত মেজাজ নিয়ে। যদিও পায়ে ব্যথা পেলো, সেটুকু সহ্য করলো দাঁতে দাঁত চেপে। সময় নিয়ে রক্তচক্ষু স্বাভাবিক হলো।
মুহুর্ত যায় দু’জনের মাঝে, হঠাৎ শামিরের শক্ত হাতটা ছু’লো জান্নাতের গাল। নিরেট গম্ভীর স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“বিশেষত্ব আছে। জান্নাতুলের এই সরল গাল দুটোর বিশেষত্ব আছে আমার কাছে,আমার চোখে। জান্নাতুলের এই চোখ দু’টো, কেঁদে দিলে যে আমার মেজাজ পরে যায়, সেটাই চোখ দুটোর বিশেষত্ব। এই ঠোঁট,কি চমৎকার কোরআন তেলাওয়াত করে, সেটাই এই ঠোঁট দুটোর বিশেষত্ব । এই নাক, বিয়ের চিহ্ন হিসেবে যে নাকফুল পরেছে, নাকে ব্যথা হলেও পরে থেকেছে দিনের পর দিন, সেই নাকটারও বিশেষত্ব আছে আমার কাছে। এই যে হিংসেপনা করছি, সব এই জিনিস গুলো বিশেষ বলেই করছি। আর এই জিনিসগুলো ওই পাড়া গা থেকে কাদামাখা পায়ে আমার ঘরে আসা জান্নাতুল ফেরদৌসের বলেই করছি। বুঝলে তুমি?”
অনিমেষে চেয়ে রইল জান্নাত লোকটার দিকে। এই স্বীকারোক্তি জান্নাতের অপ্রত্যাশিত, এই স্বীকারোক্তি শামির কখনো দেয়নি, কখনো প্রেমময় কথা বলেনি জান্নাত লাই পাবে তাই। আজ বললো। এই স্বীকারোক্তি সুন্দর তবে রূঢ়। জান্নাতের চোখ ঝাপসা হলো হঠাৎ। নিজেকে সামলায় না মেয়েটা, ঝরতে দেয় চোখের পানি, পরমুহূর্তেই হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে ম্লান হাসে। শামিরের কপাল কুঁচকে যায় জান্নাতের চোখে পানি দেখে। জান্নাত ফুঁপিয়ে ওঠে হঠাৎ,নাক টেনে বলে,“জি, শুধুমাত্র এসবেরই বিশেষত্ব আপনার কাছে আছে।”
এটুকু বলে থামে জান্নাত। পর পর এক হাতে শামিরের ডান হাতটা টেনে নিজের বুকের বা পাশে রাখে, বলে,“আর এখানে কয়েকটা জান্নাতুল আছে। সে জান্নাতুলদের ছোঁয়া যায়না , তাদের মধ্যে যে জান্নাতুলকে গালিগালাজ করে ওঠেন হঠাৎ হঠাৎ সেই জান্নাতুলের কোনো বিশেষত্ব নেই। আরো একটা জান্নাতুল আছে, তুই তোকারি করেন যাকে। তার কোনো বিশেষত্ব নেই আপনার চোখে। আরো একটা আছে, যার বাপ মা তুলেও কখনো গালি দিয়ে ওঠেন,তারও কোন বিশেষত্ব নেই আপনার কাছে। এবং আরো আছে, তাদের কথা আর নাই বলি।”
শামির তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। জান্নাত নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছলো, কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,“বিশেষত্ব নেই, তাই ওদের নিয়ে আপনার মাথাব্যথাও নেই। আপনার মাথাব্যথা এই জান্নাতুলের গাল,চোখ, ঠোঁট আর নাক নিয়েই।”
শেষের কথাগুলো ক্ষীণ আওয়াজে গলা থেকে বের করে জান্নাত। হঠাৎ কি হলো শামিরের। সে কথা হারিয়ে ফেললো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই যেন। দু’জন দু’জনের দিকে চেয়ে আছে। না জান্নাত শামিরকে ওর ওপর থেকে সরতে বলছে, না শামির সরছে। হঠাৎ যখন ঘড়ির ঘন্টা বাজলো, তখন শামির হুশে ফিরলো। তার ভেতরটা কেন জানি তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে, তবুও হঠাৎ কি মনে করে ধীরে ধীরে বলে উঠলো,“আজ সুজানাকে কেন বলে দাওনি আমিই তোমাকে পড়তে দিইনি?”
ম্লান হাসলো জান্নাত, জবাব দিলো,“কেন বলবো?”
_না, বলাই তো উচিত। একটা অন্যায় হয়েছে তোমার সাথে, নালিশ করবে না?
নিমেষ হীন কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো জান্নাত, অতঃপর ধীরে ধীরে বললো,
_কেন নালিশ করবো? বৌকে পড়ালেখা করতে দেয়া তো বিয়ের শর্তের মধ্যে আসে না। ওগুলো স্বামীর মর্জি, স্বামীর খুশি। ওগুলো তো আমার ভরণপোষণ নয়, ওগুলো আমার স্বপ্ন আর আবদার ছিলো। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তো বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণ করলাম সরকারের কৃপায়, পরে মাধ্যমিক স্যার ম্যাডামদের কৃপায়। যথেষ্ট হয়েছে। আপনি তো আর কাবিনের কাগজে সই করে লিখে দেননি আমাকে পড়ালেখা করানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনার কোনো দায় তো রইলো না। আপনি না মানলে নাই।
এই দেশে এমন কোনো আইন আছে যে রানীর মতন ভরণপোষণ দেওয়ার পরে বৌয়ের বাড়তি স্বপ্ন,আবদার পূরণ না করলে স্বামীর শাস্তি হবে? নেই তো। তাহলে সুজানার কাছে নালিশ করে,আপনাকে অপরাধী সাজিয়ে কি হতো? ও তো সাধারণ একটা মানুষ!
আর আমার অভিযোগ করার জায়গা, নালিশ করার জায়গা বাইরের মানুষ নয়, আপনিই ছিলেন। পড়ালেখা তো আমার জীবনের ফোর্থ সাবজেক্ট হয়েই রইলো। বাকি যে সাবজেক্ট গুলো, তাতেই আপনি গড়িমসি করেছেন, সেই ন্যায়বিচারই তো আমি পাইনি। পড়ালেখা দিয়ে আবার কি করবো আমি? পড়ালেখা না করতে পারার নালিশ, ফরিয়াদ করে কি হবে?
বলতে বলতে জান্নাত একটা কান্ড করে বসলো। মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠলো অসহায়ের মতো। কিশোরী থেকে তরুণী হতে চলেছে, তবুও কাঁদল বাচ্চাদের মতো, এবং বিছানার চাদর খামচে ধরে শুধু কেদেই চললো। এই চোখের জল বৃথা, তবুও ঝড়াতে লাগলো।
এইবার এই কথাগুলো কানে যেতেই শামির বোবা হলো। এইবার ওভাবে জান্নাতকে ডুকরে কাঁদতে দেখে শামির নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল। এবং এইবার শামির হয়তো একটু হলেও বুঝলো, জান্নাতুলেরা খুব বেশি কিছু চায়না, যেটুকু চায় সেটুকু না পেলেও সই। কেঁদে কেটে ধুয়ে মুছে সাফ হয়েই যায় জান্নাতুলদের অপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ না হবার যন্ত্রণা।
চলমান…..