জায়া ও পতি পর্ব-৩৪

0
201

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৩৪
#ইসরাত_ইতি

রাত নটায় ওদের লঞ্চ। জান্নাতুল সকাল দশটার দিকেই সবকিছু গোছাতে বসলো। জামাকাপড় থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র,সবকিছু। খুব সাবধানে রাখতে হবে সব গুছিয়ে, যদি কিছু একটা ভুল করে রেখে যায়,তবে বিপদ।

ওর কাজ কম্মে ভীষণ তাড়াহুড়ো ভাব লক্ষ্য করছে শামির, বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে বসে আছে সে । ভর সকালে জানালা থেকে আসা কড়া মিঠা রোদের উষ্ণতা নিতে নিতে হঠাৎ জান্নাতুলকে বলে উঠলো,“তাড়াহুড়োতে আবার কিছু ফেলে রেখে যেয়ো না।”

জান্নাত চটপটে জবাব দেয়,“আমার মনে আছে। সব নিয়েছি।”

শামির জানে জান্নাত কাজে কর্মে চালু মেয়ে, এসব বলার প্রয়োজন নেই, তবুও বললো। আসলে ইদানিং মেয়েটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বলতে তার ভালো লাগছে। নয়তো মেয়েটা এক শব্দ প্রয়োজনের বাইরে খরচ করে না।

একটা ‘বোবা বৌ’ শামির অবশ্য চেয়েছিলো। যে বাড়তি, অহেতুক কথা বলবে না। তবে যে শামিরকে একাকিত্বে ভোগাবে,এমন বৌ সে চায়নি। শামির সংসার করতে চেয়েছিল, নিড়িবিলি একটা সংসার। বোবার সংসার তো নয়।

ছুটে ছুটে জান্নাত যখন সব গুছিয়ে নিচ্ছিল তখন শামিরের ফোনে হঠাৎ একটা কল আসে। রিসিভ করে দশ সেকেন্ড কথা বলেই শামির বললো,“একটা পার্সেল এসেছে নিচে। একটা মেয়ে এনেছে। একটু রিসিভ করে আনো তো দরজা থেকে।”

ইয়া বড় একটা বক্স। জান্নাত সই করে দু’হাতে আগলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিজিয়া বণিক রান্নাঘর থেকে জানতে চাইলেন,“ওতে কি জান্নাত?”

_জানি না আম্মা, আপনার ছেলে অর্ডার করলো।

_ও আচ্ছা,যাও ওকে দাও। আর শোনো,শামিরের সবকিছু গুছিয়ে নাও। আমি একবার চেক করে দেখবো যাওয়ার আগে।

ঘাড় কাত করে জান্নাত দোতলায় উঠলো, বক্সটা এনে শামিরের কাছে রাখতেই শামির খুব একটা ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের মনযোগী দৃষ্টি ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ রেখে বললো,“খোলো ওটা।”

জান্নাত খুললো বক্সটা। এক এক করে বের করে আনলো দু’টো ঘরে পরার সুতি শাড়ি, স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট, মেন্সট্রুয়াল কাপ, জান্নাতের শ্যাম্পু, সুগন্ধি এবং কিছু চকলেট। গলির মাথায় যে বড় সুপার মার্কেট আছে, সেখান থেকে অর্ডার করে নিয়েছে শামির।

ওসব ধরে রেখেই আয়ত চোখজোড়া জান্নাতের শামিরের গম্ভীর মুখটা দেখে। শামির ফোনের নোটপ্যাডে অফিসের কিছু ডেডলাইন লিখতে লিখতে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,“কি শাড়ি পরে থাকো বাড়িতে হ‌্যা? চোখে দেখো না? ভিখারিকেও দেওয়া যায়না এমন হয়েছে রং উঠে গিয়ে। আজ ধুয়ে মাকে দিয়ে দেবে ও দু’টো। কাঁথা সেলাই করার মতোও যোগ্য না গাঁয়ের শাড়িটা।”

জান্নাত দৃষ্টি জোড়া নত করে চুপচাপ ঢোক গিললো, শামির খিটখিট করেই চলেছে,“শ্যাম্পু নেই এটা আমার বোতল ঝাঁকিয়ে দেখতে হয় কেন? আমার কি আর কোনো কাজ নেই? সারাদিন ঘরে কোথায় কি নেই সেসব খুচবো মহিলা মানুষের মতো? আশ্চর্য মেয়ে তুমি!”

জান্নাত তখনও নিশ্চুপ হয়ে থাকে, শামির কথা থামিয়ে আড়চোখে ওকে একপলক দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,“এ মাসের স্যানিটারিজ গুলো গুছিয়ে নিও। পিরিয়ডের ডেট তো কাল পরশু। ওখানে গেলে এসব কে কিনে দেবে? আমি পারবো না, শায়নকে তো বলতে পারবে না, নিজেও কিনতে পারবে না। তাই আগেভাগেই আনিয়ে দিলাম, ব্যাগে ভরো। সবকিছু ব্যাগে ভরো যাতে ঝামেলায় না পরতে হয়।”

জান্নাত চুপচাপ তাই করলো, তবে হাতের জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে লোকটার দিকে একটিবার তাকালোও না, চোখ সে তুললোই না। ব্যগ্র কন্ঠে “আসছি” বলে একপ্রকার লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। শামির আবারো নিজের কাজে মনযোগী হয়, খিটখিট করেই বলে,“লাফ দেওয়ার স্বাধীনতা পেয়েছে তাই কথায় কথায় লাফ দেয়। আশ্চর্য মেয়ে মানুষ।”

জান্নাত এক ছুটে নেমে এলো নিচে, ভেতরে ভেতরে হাপাচ্ছে মেয়েটা। মাইমুনা ওকে বললেন,“এমন করতাছো ক্যা? মোর নাতি চাইপ্যা ধরছেলে তোরে?”

জান্নাত জবাব না দিয়ে ঢকঢক করে একগ্লাস পানি খায়। মাইমুনার কৌতুহলী, চকচকে দৃষ্টি, জানতে চাইলো,“বাক্সে কি আছিলো? খাওন দাওন?”

জান্নাত বুঝিয়ে বলার পরে মাইমুনা ছেঁচে রাখা পানটা মুঠি থেকে মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে আয়েশী ভঙ্গিতে বললেন,“তুই যত যাই কও,আমার নাতীডা ভালোই।
কত ব্যাডা মানুষ আছে বৌয়ের সাবান আচে কি নাই চাইয়াও দ্যাহে না, কিন্তু রাইতে ধারে আইয়া কাপড় খোলার সময় কয় তোমার শাড়ির আঁচলে গোনে রোসনের ঘেরান আয় ক্যা? ধূর পরিষ্কার থাকতে পারো না?

পরতি যদি অমন ভাতারের আতালে তয় বুজতি মাগী। এখন তো শুকরিয়া নাই।”

জান্নাত দাদী শাশুড়ির কথার জবাব না দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে শামিরের জন্য ফল কেটে নেয়। থালা ভর্তি ফল কেটে দোতলায় উঠে দেখলো শামির বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে রোদে মুখের সামনেই আয়না ধরে কিছু একটা করছিলো। জান্নাত থালা রেখে এগিয়ে গিয়ে দেখলো ছোটো সিজার দিয়ে কানের কাছে কিছু চুল ছাটকাট করছে। এই কমাসে খুব বেশি সেলনে যায়নি শামির পায়ের জন্য। হেয়ারস্টাইল নিজে নিজেই করেছে।

লোকটার অসুবিধা হচ্ছে দেখে জান্নাত বললো,“আমি করে দেবো? এখান থেকে জিরো করতে হবে তো?”

শামির ওর কথায় ভরসা পেয়ে তবেই কাচিটা দিলো, কাঁচি হাতে নিয়ে জান্নাত বলে উঠলো,“এমা আপনার এই চুল গুলো তো পেকে গিয়েছে।”

জান্নাতের হঠাৎ বলা এই কথাটাতে ইতস্তত বোধ করলো শামির, মিনমিনে স্বরে বলল,“ওটা হরমোনাল একটা সমস্যার কারণে অমন। বুড়ো হয়ে যাওয়ার পাকা চুল নয়।”

জান্নাতের হঠাৎ ভীষণ হাসি পেল, দাঁতে ঠোঁট চেপে চুপ করে আছে। শামিরের তেরছা নজর ওসব দেখে গম্ভীর হয়ে বলে,“কেউ ঊনত্রিশ বছরে বুড়ো হয়না। বুঝতে হবে।”
জান্নাত হাসি চেপে রেখেই মাথা নাড়ে, নিচু স্বরে বলে,“আমি জানি এটা কিসের চুল। গ্রামে এটাকে আমরা বলি জোনাকি চুল।”

খুকখুক করে কাশলো শামির, বললো,“হ্যা ঐ জোনাকি মোনাকি ওটাই সম্ভবত। এটা বার্ধক্যের পাকা নয় বুঝেছো? সে দেরী আছে।”

গলায় বেশ জোর শামির চৌধুরীর, বেশ আত্মবিশ্বাসী সে, তার বার্ধক্য এতো তাড়াতাড়ি আসছে না তাই। চুল ছাটতে ছাটতে জান্নাত অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে জবাব দেয়,“দেরী নেই খুব একটা, এই চার-পাচ বছরের মাথায় দেখবেন শুরু হয়েছে, বয়স তো আপনার কম হয়নি।”

জান্নাত কথাটা বলেছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। মনে কোনো কুটিলটা ছিলো না, তবে শামির চোখ সরু সরু করে বললো,“আমার বয়স কম হয়নি মানে? মাত্র ঊনত্রিশ। আমি বুড়ো?”

_না বুড়ো কে বললো? আর পাঁচ বছর গেলে বুড়ো হতে থাকবেন সেটা বলেছি।

মুখটা জুড়ে অন্ধকার নামলো শামিরের। কপাল কুঁচকে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে জান্নাতের মুখটাতে, জান্নাত শামিরের খুব কাছে ঝুঁকে কাঁচির কাজ চালাচ্ছে। শামির হঠাৎ বললো,“তোমার আর আমার বয়সের পার্থক্য কত জান্নাতুল?”

_এইতো,এগারো বছর। কেন?

গলা খাঁকারি দিলো শামির,“অতটা বেশি পার্থক্য নেই। এটা সুন্দর। এমন এইজ গ্যাপের বিয়েতে শান্তি থাকে। স্বামীর বুদ্ধি বিবেচনা এবং স্ত্রীর সরলতা, দু’টোর সংমিশ্রণে শান্তি থাকে। আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো হয়।”

একপলক তাকালো জান্নাত, তাচ্ছিল্য নিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বললো,“হ্যা খুব আন্ডারস্ট্যান্ডিং!”

জান্নাত যে তাচ্ছিল্য করছে সেটা বুঝেও শামির প্রতিবাদ করেনা। দশ মাসের সংসারে “আন্ডারস্ট্যান্ডিং” নামের ইংরেজি শব্দটা বাদে তাদের দাম্পত্যে যে বাকি সব কিছু ছিলো সেটা অতি চালাক শামির চৌধুরীর থেকে কে বেশি জানে? ফাকা আওয়াজ দিয়ে তো এখন আর এই মেয়ের ব্রেইন ওয়াশ করা যায়না, তাই সে চুপ থাকলো কিছুক্ষণ। খানিক বাদে আবার বলে উঠলো,“আচ্ছা বিয়ের সময় আমার বয়স নিয়ে তোমার মাথাব্যথা ছিলো না?”

খুব উৎসুক শামির জানতে, একথা সে কখনো জানতে চায়নি। জান্নাত ম্লান হেসে বললো,“যখন বুঝে গিয়েছি বিয়েটা আমার করতেই হবে। মাথাব্যথা আমার কিছু নিয়েই ছিলো না। না বয়স, না আপনার আগের বৌ, না আপনার মেজাজের গুজব।”

ওর কন্ঠে পুরনো সেই মনখারাপ ফুটে ওঠে। শামির আবারো কথা হারায়। চেয়ে চেয়ে দেখে জান্নাতকে। আচ্ছা সে এই মেয়েকে পছন্দ করে তখন খুব বেশি ক্ষতি করে দিয়েছিল এই মেয়ের? হয়তো মেয়েটির চোখে দিয়েছিল, তবে বাস্তবিক ভাবে ভাবা হলে তো দেয়নি। শামির তো একরাতেই খোজ নিয়ে জেনে নিয়েছিল কত জায়গায় সম্বন্ধ দেখছিলো ওর মামীরা। প্রবাসী অর্ধশিক্ষিত পেটমোটা, গ্যারেজের অর্ধশিক্ষিত মালিক, গঞ্জের দোকানের মহাজন। এসবের ভেতর থেকে কেউ বিয়ে করে নিলেই খুব ভালো হতো মেয়েটির? কারণ বিয়ে তো ওকে বসতেই হতো। এই মেয়েকে দেখার পর শামিরের মনে হয়েছে এই মেয়ে তার ঘরে একটা সভ্য পরিবেশে এসে ওঠার মতোই উপযুক্ত। হ্যা এটাই তো ভেবেছিল শামির! খুব কি খারাপ নিয়ত ছিল শামিরের?

শামিরের এমন আচানক নির্লিপ্ততা হঠাৎ জান্নাতকে ওর দিকে তাকাতে বাধ্য করলো, কাঁচির কাজে হাত দুটোকে ব্যস্ত রেখে এবার জান্নাত বলে উঠলো,“আচ্ছা আপনি কেন এতো ছোট একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন? শুধুমাত্র আমার ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে বেশি পারবেন সেই লোভেই?”

মেজাজটা যেন বিগড়োতে চাইলো শামিরের তৎক্ষণাৎ। তবে না, সে খুব শান্ত। মুখটা তার স্বাভাবিক। সেদিন রাতে জান্নাতের কান্না খুব কাছ থেকে ওভাবে দেখে ভেতরের স্বৈরাচারী রূঢ় সত্তা নিজে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে, মেজাজ খুব কম দেখাবে সে। জান্নাতের ঐ বাঁকা কথার জবাবটা শামির খুব নিরীহ উপায়ে দিলো, বললো,“জি। তবে আরেকটা কারণ আছে।”

_কি কারণ?

_ছোটো একটি মেয়েকে বিয়ে করেছি কারণ,আমার সংসারে কুটিলতা ছাড়া একটি কচি ব্রেইনের প্রয়োজন ছিলো যে আমার ওয়ালেট থেকে টাকা সরানোর ধান্দায় থাকবে না সারাদিন, কিংবা অত সাংসারিক জটিলতা তার মাঝে থাকবেই না। যে থাকবে আমার কাছে শুধু শান্তির পরিপূরক!

জান্নাত হঠাৎ চোখ নামিয়ে নেয়, এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে নড়েচড়ে ওঠে। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ওভাবে ঝুঁকে চুল ছাটতে গিয়ে পিঠ ব্যথা হয়ে এলো ওর। কোমরে হাত চেপে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা চেয়ার টেনে আনলো। কিন্তু অসুবিধা হলো এই বারান্দায় দু’টো চেয়ার পাশাপাশি রাখা যায়না।

শামির ওকে দেখছিলো মনোযোগী দৃষ্টিতে, হঠাৎ বললো,“বসতে চাও? কোলে বসো! কাজটা করতে বেশি সুবিধা হবে।”

জান্নাত মৃদু চমকালো, দৃষ্টি জোড়া পায়ের নখে নামিয়ে আইঢাঁই করতে থাকে। ওকে ওভাবে আড়ষ্ট হতে দেখে শামির হঠাৎ এক কাজ করে বসলো, এক হাতে হ্যাঁচকা টান মেরে মেয়েটাকে বসিয়ে নিলো কোলে। শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্নাত আগলে ধরলো শামিরের গলা, কাঁপতে থাকলো তিরতির করে বধূ সুলভ লাজে,সংকোচে।
এতক্ষণে শামির হাত বাড়িয়ে আলতো করে চেপে ধরলো জান্নাতের চোয়াল, ধমকের সুর গলায় তবে নিচু স্বরে বললো,“কেন? আগে খুশিমনে বসোনি এখানে? নাকি সেটাও আমার অত্যাচার ছিল? আমার স্বৈরাচারীতা ছিলো? আমার জুলুম ছিলো?”

জান্নাত না কিছু বলে,না চোখ তোলে। কাঁচি ধরে রাখা হাতটা কাঁপছে মৃদু। শামির বৌয়ের রাঙা মুখটা অপলক দেখতে দেখতে কোমর চেপে নিজের বাহুতে আরেকটু মিশিয়ে নিয়ে বলতে থাকে,“ছেড়ে যাবে? যখন যাবে,তখন যাবে। এখন এভাবেই কাজটা করবে তুমি। তোমার মন জ্বলুক, তবুও।”

জান্নাত হাঁসফাঁস করতে করতে আবার তার কাজে মনোযোগী হয়। শামির বাঁকা হেসে মুগ্ধতা ভরা নয়নে নির্নিমেষ দেখতে থাকে ওকেই, জান্নাত তাকায় না আর ঐ চোখে। জান্নাত টের পায় ঐ চোখে আপাতত কোনো অত্যাচার, কোনো জুলুম নেই। যা আছে, জান্নাত দেখতে পেলেই নিজেকে ভেঙেচুরে কেঁদে ফেলবে এক্ষুনি।

“তোমার গাঁয়ের স্বাভাবিক ঘ্রাণটা খুব সুন্দর জান্নাতুল,একদম ল্যাভেন্ডার ফুলের মত‌। তুমি ছেড়ে গেলে এটা খুব মিস করবো।”

ঘনিষ্ঠ হওয়ার দরুন শামির দু’চোখ বন্ধ করে মস্করা করে কথাটা বলে উঠলো হঠাৎ। জান্নাত তখন শামিরের চুলের আরেক পাশ ছাটছিলো, সেও গম্ভীর স্বরে মস্করা করে ওঠে,“তখন বেলী,কনক,চাপা এসে আপনাকে ভুলিয়ে দেবে।”

কঠিন হলো শামিরের মুখটা, চোখ খুলে নেয় ত্বরিৎ, রাগী চোখে জান্নাতকে সেকেন্ড দুয়েক দেখছিলো যখন তখন ওর চোখ পরলো জান্নাতের ঠোঁটে। এতক্ষণে শামির একটু অস্থির হয়ে মেয়েটাকে ধরে ফেললো হাতে পেঁচিয়ে, জান্নাত জানে লোকটা কি করতে চাইছে। বাঁধা সে দেয়না, উল্টো চোখ বন্ধ করে নেয়। ভেতরের নিরীহ স্ত্রী সত্তা তার তথাকথিত আত্মসম্মান, তার রাগ, তার অভিমান, তার ক্ষোভ, তার অভিযোগ সব ভুলে ডুবতে চায় স্বামীর ঠোঁটের আশ্লেষে। তার ঐ সত্তা জানে, তার ঠোঁট জানে, সে এটুকুতে আপ্লুত হতোই।

মিনিট দুয়েক শুধু নৈঃশব্দ্যে শ্বাস প্রশ্বাসের গান শোনা যায়, জান্নাতের হাতের কাঁচি মেঝেতে পরে ঝনঝন শব্দ করলো যখন, শামির তখন থামলো, ঘোলাটে দৃষ্টি জোড়া স্থির হলো জান্নাতের বুজিয়ে রাখা চোখ দুটোতে। অস্থির শ্বাস ফেলতে ফেলতে ওর কপালে কপাল ঠেকায় শামির। এক হাত পিঠে আলতো বুলিয়ে দিয়ে থেমে থেমে বলে,“আজ…. আমার পা…..ঠিক থাকলে…..তুমি হয়তো…..এই ভর সকালে…. আরেকবার….. আমার নামে….তোমাকে….অনুমতি না নিয়ে ছোঁয়ার….. নালিশ নিয়ে বসে যেতে জান্নাতুল ফেরদৌস..! ইশ তোমার সৌভাগ্য… আমার পা ঠিক নেই….আমারো সৌভাগ্য, অনুমতি ছাড়া তোমাকে ছোঁয়ার অপবাদ থেকে বেঁচে গেলাম… কারণ আমার পা ঠিক নেই।”

জান্নাত চোখ খোলেই না, লোকটার ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো তার পা-মাথা জমিয়ে রেখেছে,গোটা শরীর হিম হয়ে আছে,শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। তবে এ বিষের অনুভূতি নয়।

দু’জনের ঘোর কাটেনা, না একে অপরকে ছাড়ে। তবে খানিক বাদে যখন ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক চলে আসায় জান্নাতের ফোনের নোটিফিকেশনের টুং টাং আওয়াজ হলো তখন জান্নাত নড়ে উঠলো। শামির ভ্রু কুঁচকে জান্নাতের ফোনটা ওঠালো হাতে, মেসেঞ্জারে কেউ মেসেজ করে রেখেছে সেটা ওপর থেকেই পড়লো, কেউ লিখে রেখেছে “ওয়াও জান্নাতুল! তোকে ভীষণ সুন্দর লাগছে নীল শাড়িতে।”

চোখ জোড়া শামিরের কোটর হতে বেড়িয়ে আসতে চাইলো। কুচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে গেলো। সুন্দর লাগছে মানে? জান্নাতের বান্ধবী কিভাবে দেখে নিলো জান্নাতের নীল শাড়ি পরিহিতা ছবি? কিভাবে দেখে নিলো? ব্যস্ত হাতে মেসেজ টা খুললো শামির। যা দেখলো, রীতিমতো চোখ দুটো লাল হলো তার।

জান্নাত ভীষণ স্বাভাবিক, সে জানে সে কোন অন্যায় করেনি, মেসেঞ্জার স্টোরিতে তার আর রুহীর একটা ছবি দিয়েছে। জান্নাতের মুখটা স্টিকার লাগিয়ে ঢেকে রেখেছে। কিন্তু শামিরের মেজাজ হারানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো ওটুকুই, চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,“এই ছবি কেন দিয়েছো?”

_ভালো লেগেছে তাই, সবাই তো দেয় । আমি তো স্টিকার দিয়ে ঢেকে রেখেছি মুখটা।

_হ্যা, এখন ঢেকে রেখেছো। দুদিন পরে এই স্টিকার সরে যাবে, কারণ সবাই মুখ দেখায় সোস্যাল মিডিয়ায়।

ঝড়ের পূর্বাভাস, জান্নাত চুপচাপ শামিরের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো,“আমার মনে কোনো পাপ চিন্তা নেই এটুকু বলতে পারি…”

তৎক্ষণাৎ একটা ধ’ম’ক লাগায় শামির, ধমকটা এমন জোরালো ছিল যে জান্নাতের হাতের ফোনটা পরলো নিচে, মেয়েটা গোল্লা গোল্লা চোখে শামিরকে দেখতে লাগলো, বুক কাঁপছে তার, চোখও টলটলে হয়েছে। শামির হঠাৎ নিজেকে সামলে নিলো,সে সেদিন রাতে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়েছে “তুই তোকারি আর গালাগালি” আর নয়। মেয়েটাকে সামলাতে হবে নিরীহ পন্থায়। কিন্তু মুখটা চুলকাচ্ছে শামিরের, কি করবে সে? কি করা যায়? একটা তাৎক্ষণিক উপায় বের করলো শামির নিজের অন্তর ঠান্ডা করার, মুখটাকে হঠাৎ ভীষণ হাসিহাসি করে রেখে বললো,“একটা এমন আছাড় মারবো ঘিলু ছিটকে রাস্তায় গড়াগড়ি খাবে। প্লিজ ছবিটা ডিলিট করো, প্লিজ!”

জান্নাত হঠাৎ দারুণ ভয় পেলো, বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ সে লোকটার অদ্ভুত পদ্ধতিতে শাসন দেখে। চুপচাপ বিনা বাক্য ব্যয়ে ছবিটা ডিলিট করে দিলো।

_________

এ নিয়ে দুইবার ঢাকা নগরীতে আসা হলো জান্নাতের। এই বার দু চোখে বিস্ময় নেই তার। উদাস চোখে দেখে নগরীর উঁচু উঁচু দালান। দৃষ্টিতে মনযোগ নেই, আছে শামিরের জন্য দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা।

ওরা আছে অ্যাপোলোতে। সিঙ্গাপুর থেকে ডগলেস হারপার নামের সেই বিশেষজ্ঞ এসেছেন। তার স্ক্যাজিওল মোতাবেক শামিরের অপারেশনের সময় বুধবার বিকালে। আজ মঙ্গলবার, ওদের নিয়ে শায়ন আজ সকালে সদরঘাট পৌঁছেছে। শামিরের ঢাকা নিবাসী বন্ধুরা এতক্ষণ ওদের সাথেই ছিলো। বিকেলে যখন এক এক করে সবাই সাক্ষাৎ শেষে চলে গেলো তখন শামির জান্নাতকে দেখে, জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। শায়ন গিয়েছে এখানে করা এক্সরের রিপোর্ট গুলো সংগ্রহ করতে।

লম্বা জার্নিতে বেশ কয়েকবার পায়ে ব্যথা পেয়েছে শামির, সেই থেকে চিনচিনে ব্যথা অবিরত হচ্ছে । শ্যামলা সুদর্শন মুখটা এখানে আসার পর থেকেই লাল, জান্নাত ঘুরে লোকটাকে দেখে উৎকণ্ঠা নিয়ে এগিয়ে এসে বলে,“কফি বানিয়ে দেবো? খাবেন?”

ওয়ার্ড বয় ঢুকেছে ভেতরে,সাথে একজন অল্পবয়সী ডাক্তার। উনি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডক্টর সম্ভবত। রোগীর সুবিধা অসুবিধা গুলো জানতে এসেছে এই নিয়ে আজ তিনবার।

শামিরের এই চিমসে ডাক্তারটাকে দেখলেই মেজাজ গরম হচ্ছে। সকাল বেলা এখানে এডমিট হবার পরে এসেই জিজ্ঞেস করে,“আঙ্কেল আপনি ডক্টর আনিস ভুঁইয়ার রেফারেন্সে এসেছেন না?”

জান্নাতের সামনে ওকে আঙ্কেল বললো এই চামচিকাটা! শামির আঙ্কেল? কোনদিক থেকে আঙ্কেল? ব্যাটা তোর থেকে বড়জোড় দুই বছরের বড়। আর তুই কোন “হনুরে” ?

তোর থেকে অন্তত ইয়াং লাগে এই শামির চৌধুরীকে,ম্যানলি লাগে। বডি দেখেছিস শামিরের? তোর মতো মিইয়ে যাওয়া মুড়ি নয় শামির। তোর মতো অপুষ্টিতে ভোগা কুঁচকুচে চিকন লম্বা বিন্নি ধান নয় শামির। কতবড় সাহস এই শুয়ো পোকার,ওর পিচ্চি বৌটার সামনে ওকে আঙ্কেল ডেকে বেইজ্জত করে। যাওয়ার আগে এর নামে ফিডব্যাক দিয়ে যাবে শামির হসপিটালের কম্প্লেইন বক্সে, বলবে এই ডক্টর ‘মদন’।

সবথেকে মেজাজ খারাপের কথা হলো ঐ চিমসে শুঁয়োপোকাটা শামিরকে আঙ্কেল ডেকে জান্নাতকে আপু ডাকে। সাহস চিন্তা করো! শামিরের ইচ্ছা করে ঠাটিয়ে এক থাপ্পরে ও চিমসানো মুখটা আরো ভেঙে দিতে।

ডক্টরের নাম মুন্না। এবার কেবিনে ঢুকে শামিরকে নয়, জান্নাতকে বললো,“আপু! আজ আঙ্কেলের একটা স্যালাইন চলবে। এনেছেন ওটা?”

শামির দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। বহুকষ্টে গালি আটকে রাখছে নিজের ভেতরে। জান্নাত এক পলক নিজের স্বামীকে দেখলো, জান্নাত তো বোঝে সবটাই। লোকটার ফুলিয়ে রাখা মুখটা দেখে মিনিট খানেক মনে মনে হেসে ঐ ডক্টরকে বললো,“আপনি আমাকে আন্টি বলতে পারেন। আমি আপনার ঐ আঙ্কেলের বৌ।”

শামির চোখ তুললো হঠাৎ। ডক্টরও থতমত খেলো, বললো,“জি আচ্ছা। তো মেডিসিনটা আনা হলে প্লিজ ইনফর্ম করবেন।”

লোকটা চলে গেলে শামির আড়চোখে জান্নাতকে দেখতে থাকে, মনটা তার ভীষণ রকমের খুশি হয়েছে হঠাৎ। মেজাজটাও হয়েছে ফুরফুরে। জান্নাত তিনটা বই এনেছে সাথে,ওখান থেকে একটা তুলে কেবিনের সোফাতে গা এলিয়ে বসে।

শায়ন আসে সন্ধ্যায় রিপোর্ট আর হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে শামিরদের জন্য রাতের খাবারটা নিয়ে। কিছু সালাদ এবং স্যুপ।

শামির ওকে বলে,“আচ্ছা তুই এখন নিলয়দের বাসায় গিয়ে ঘুম দে। কাউকে কল করতে হলে আমি ডেকে নেবো বেল টিপে। আর ওতে কি এনেছিস?”

_তোমাদের ডিনার, সালাদ আর চিকেন স্যুপ।

থমথমে হলো শামিরের মুখটা হঠাৎ ভাইয়ের কান্ডে, একটা ধ’ম’ক দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,“ধূর কল করবি না? তোর ভাবী ভাত ছাড়া কিছু খেতে পারে? এই স্যুপ টুপ সে খায়? আশ্চর্য তুই!”

_আমি কি জানি?

_আচ্ছা যা গিয়ে ভাত নিয়ে আয়। এক্ষুনি যা।

জান্নাত হঠাৎ উঠে দাঁড়াল বই রেখে । ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার স্বামীর দিকে। একেবারে নিশ্চল নিশ্চুপ, নিস্পন্দ চোখে। শামির তখনো ভাইয়ের সাথে খিটখিট করে চলেছে,“কি যে করিস! আচ্ছা শোন কাল সকালে আসার সময় নিলয়ের বাসা থেকে ঘরের খাবার নিয়ে আসবি।”

চলমান……