জায়া ও পতি পর্ব-৩৫

0
186

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৩৫
#ইসরাত_ইতি

চাঁদের ঝকঝকে আলোটা জানালার কাঁচ গলিয়ে ভেতরে ঢুকে কামরাটাকে আলোকিত রেখেছে। কেবিনের দু’টো বাতি নিভিয়েছে জান্নাত কিছুক্ষণ আগেই,তবুও সবকিছু বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। শামির ঘুমোয়নি, চুপচাপ আধো আলোতে জান্নাতকে দেখছিলো। একটা বই নিয়ে বারবার জান্নাতকে এপাশ ওপাশ হতে দেখে হঠাৎ করেই বলে উঠলো,“আলো চাই? জ্বেলে নাও, মাথার কাছের ল্যাম্পটা।”

_আপনার অসুবিধা হবে।

_আমার এমনিতেও ঘুম আসছে না স্যালাইন চলছে তাই।

জান্নাত উঠে চুপচাপ বসল,মানুষটাকে দেখলো একপলক, মানুষটার কথায় ভরসা পেয়ে বাতিটা জ্বেলে একটা বই হাতে নিলো।

শামির পলক ফেলেনা, সামান্য একটু কাত হয় উৎসুক ভঙ্গিতে নিচুগলায় বলে,“কি ওটা?”

_উপন্যাস।

_নাম কি?

_জোৎস্ন্যা ও জননীর গল্প।

মৃদু শ্বাস ফেলল শামির,
_বেশ ভালো, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। গল্পে গল্পে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এগুলো পড়া ভালো।

শামির সমর্থন জানায় বেশ ফুরফুরে মেজাজে। জান্নাত বলে ওঠে,“এসব পড়লে পেকে যাবো নাতো আবার আমি? শাহবাগী হয়ে যাবো নাতো?”

আবার শামির মেজাজ হারালো জান্নাতের খোঁচা মেরে বলা কথায়, তবে মেজাজী হলো না,বলল,“না এই গল্পটা নারীর স্বাধীনতা নিয়ে নয়,দেশের স্বাধীনতা নিয়ে। তবে হ্যা, এই গল্পে আসমানী নামে একটা অতি ফাজিল মহিলা আছে, যে তার স্বামীর সাথে অতিরিক্ত বেয়াদবি করে ঝগড়া করে বারবার বাড়ি থেকে বান্ধবীর বাড়িতে চলে যায় রাগ করে। শেষটায় তো পঁচিশে মার্চের পর রাগ করে মেয়েকে নিয়ে বান্ধবীর বাসায় গিয়ে ফেসেই গিয়েছিল, পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়টা স্বামীর মুখ দেখতে পারেনি। তখন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে স্বামী কি জিনিস আর নিজের বাড়াবাড়ির জন্য পস্তিয়েছে। বেয়াদব মেয়ে!”

কথাগুলো কেমন মেজাজী বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে শামির। জান্নাত হঠাৎ হেসে ফেলে, খিলখিলিয়ে হাসতেই থাকে দীর্ঘসময়। শামির অবাক চোখে তাকাল, বললো,“হাসার কি হলো?”

_আপনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আসমানীকে এক্ষুনি হাতের কাছে পেলে গলাটা টিপে ধরতেন শাহেদের সাথে ঝগড়া করার জন্য।

কথা বলে না শামির, চুপ হয়ে যায়। জান্নাত হঠাৎ চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকায়। বই রেখে অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে বলে,“ইয়া আল্লাহ আপনার রাতের ওষুধটা তো দেইনি! এমা! ওটা তো শেষ। ছোটো দাদাকে দিয়ে আনিয়েও রাখিনি। ইয়া আল্লাহ,এখন কি হবে!”

বড় বড় শ্বাস ফেলছে জান্নাত। শামির বললো,“আচ্ছা এতো উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি।”

_ওটা তো মিস দিতে বারণ করেছে ডাক্তার, আপনার বুকের পাঁজরের জন্য। না না, হায় আল্লাহ! এ আমি কি ভুল করলাম! এখন কি হবে? আচ্ছা নিচতলায় মেডিসিন কর্ণার আছে না? প্রেসক্রিপশন নিয়ে গেলে পাবো না এখন? রাত দেড়টা অবধি তো খোলা থাকে। আমি যাই?

কথা গুলো বলতে গিয়ে কেমন ছটফট করছে জান্নাত, ওর গলার কাছে কান্না চেপেছে, শামিরের মনে হলো।
দু চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে শামির, হঠাৎ অস্ফুটে বললো,“তাতে এভাবে করার কি আছে? একটা বেলাই তো!”

জান্নাত তাড়াহুড়ো করে পার্স হাতে নিয়ে বললো,“না, এক বেলাও মিস দেওয়া যাবে না। এন্টিবায়োটিকের ডোজ। মিস দিলে কাজ করবে না, আবার ঐ অত পাওয়ারি ওষুধ শুরু থেকে গিলতে হবে আপনাকে । আমি যাই।”

জান্নাত প্রেসক্রিপশন নেয় হাতে। শামির কপাল কুঁ’চ’কে বলে,“তুমি কোথাও যাবে না জান্নাতুল। তুমি লিফটে চড়তে পারো না।”

_লিফটম্যান আছে। আমি পারবো। প্লিজ যাই! আপনি টাকা দিন।

শামিরের টাকা দেওয়ার অপেক্ষা জান্নাত করে না, নিজেই ওয়ালেট বের করে পাঁচশ টাকার দুইটা নোট পার্সে ঢুকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। হাতে ক্যানুলা লাগিয়ে শুয়েই শামির ডেকে চলেছে ওকে পেছন থেকে রাগী গলায়। অতঃপর ধীরে ধীরে শামিরের গলার তেজ কমে আসে, মুখটা গম্ভীরতা সরিয়ে সহজ হয় ধীরে ধীরে। ধীরে ধীরে শামির চৌধুরী হঠাৎ শ্বাস ফেলল স্বস্তির, এবং ধীরে ধীরেই বদমেজাজি মুখটাও স্মিত হাসলো।

ওষুধটা কিনতে পেরেছে জান্নাত ঠিকঠাক ভাবে। লিফটে নামতেও কোনো অসুবিধা হয়নি তবে ওপরে উঠতে গিয়ে যত বিপত্তি হলো। মোট চারটা লিফট, দু’টো বন্ধ। পশ্চিমের লিফটাতে উঠতে যাবে তক্ষুনি এক লোক বলে উঠলো,“মিস এটা ডক্টরসদের লিফট। কাইন্ডলি ওপাশের টাতে যান।”

জান্নাত বিব্রত ভঙ্গিতে আরেকটার সামনে যেতেই দেখলো দাঁড়িয়ে আছে উঠতি বয়সী কয়েকজন ছেলে আর দু’জন পুরুষ। এক পলক সবার চোখের দিকে তাকিয়ে জান্নাত ভয় পেলো, এভাবে এতো গুলো পুরুষের সাথে তাকে উঠতে হবে লিফটে?

শ্বাস ফেলল জান্নাত, মেডিসিন কর্ণার ব্যতীত আশপাশটা ফাঁকা, প্রতিটি তলাও নিশ্চয়ই এখন লোকসমাগমহীন। এদের সাথে লিফটে ওঠার সাহস ওর হয়না, জান্নাত ছুটতে ছুটতে সিঁড়ির কাছে যায়। ছয় তলা তো, জান্নাত পারবে।

রুদ্ধশ্বাসে যখন জান্নাত সিঁড়ির দিকে ছুটলো, হঠাৎ টের পেলো লিফটের ওখান থেকে দু’টো ছেলেও সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। আচমকা থেমে গিয়ে জান্নাত ঘাবড়ায়, তবে ঘাড় ঘোরায় না। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে। তেমনি ভাবে জান্নাতের মনে হলো ঐ আগন্তুকেরাও উঠছে, এটা অবশ্য মনের ভ্রম ছিলো জান্নাতের। তার হঠাৎ কান্না পাচ্ছে, স্বভাবত সে খুবই ভীতু প্রকৃতির মেয়ে, পার্স হাতরে ফোনটা বের করলো তবে ফোন করলো না শামিরকে, সে ছুটতে ব্যস্ত।

ততক্ষণে শামির তাকে সাতটা কল দিয়েছে, মেজাজটা ভীষণ গরম হয়েছে শামিরের। একে তো লাফিয়ে লাফিয়ে গেলো নিষেধ সত্ত্বেও, এখন কল ধরছে না? অস্থির আর অধৈর্য শামির হঠাৎ স্যালাইনের নল খুলে উঠলো। ক্র্যাচ টা নিলো একহাতে, উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে কেবিনের দরজার কাছে যায়, মাথায় আসছে না সে করবে টা কি! আবারও যখন ফোনটা তুলে কল করতে নিলো,দেখলো করিডোরের অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে দৃশ্যায়িত হচ্ছে একটা ঘাবড়ে যাওয়া আতঙ্কিত ছোটোখাটো মানুষ। সে ছুটতে ছুটতে আসছে, যেন উড়ে উড়ে আসছে। কোনো কথা নেই, এসেই ধরেছে শামিরকে, শক্ত করে খামচে ধরেছে শামিরের পিঠের কাছের টি-শার্ট। মুখটা ঠেকিয়ে রেখেছে বুকে, ক্রমাগত হাপাচ্ছে সে। শামিরের মনে হলো যেন কাঁদছেও মেয়েটা।

শামির উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে উঠল,“আরেহ! জান্নাতুল! এ্যাই কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”

জান্নাত বলে না কিছু, চোখ থেকে পানি ঝড়ে অবিরত, হঠাৎ একটা অদ্ভুত রকমের উপলব্ধি হয় তার মাঝে। এই এতো কিছুর মাঝেও এই লোকটার এই জায়গাটাই তার কাছে সবথেকে সুরক্ষিত ঠেকেছে, সবথেকে। শামির এবার ভীষণ ব্যস্ত হাতে ওর থুতনি তুলে বলে,“কে কি করেছে বলো! কেউ বাজে কথা বলেছে?”

দু’পাশে মাথা ঝাঁকিয়ে জান্নাত অস্ফুটে বলে,“ওদিকটায় অন্ধকার ছিলো তাই ভূতের ভয় পেয়েছি। আর কিছু না! আর কিছু না।”

শামির ধরলো এক হাতে মেয়েটাকে,নরম গলায় বলল,“এসো ভেতরে। ভূত আবার কি? ভূত বলতে কিছু হয়না।”

জান্নাত সত্যিটা বলেনি ভয়ে, আবার ঐ ছেলেকে খোঁজাখুঁজি করতে যদি লোক লাগিয়ে দেয় শামির? তাই মিথ্যা বলে দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে কাঁপতে কাঁপতে সদ্য আনা ওষুধটা শামিরকে দেয় খেতে, শামির ওষুধটা খেয়ে বললো,“ভয় কমেনি?”

ওপর নিচে মাথা ঝাঁকায় জান্নাত। শামির গিয়ে শুয়ে আবার স্যালাইনের নলটা হাতে সেট করে বলে,“এখন শুয়ে পরো, রাত হয়েছে খুব।”

জান্নাত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে লোকটাকেই দেখে। কি এই লোক? কেন এতকিছুর পরেও জান্নাতের সর্বোচ্চ দৌড় এই লোকই হলো? কেন হলো?

“পুঁটি মাছের মতো কলিজা তোমার। ভূতেও ভয় পাও?”

হ্যা পুঁটি মাছের মতোই কলিজা জান্নাতের। যতই ঠাটবাট দেখাক,ভেতরে ভেতরে সে কতটা নাজুক তা জান্নাত জানে। বাজারে লোকসম্মুখে একটা ছেলেকে দু কথা শোনানো আর নির্জনে একটা ছেলেকে প্রতিহত করার মাঝে বিস্তর ফারাক। অমন শক্তিশালী হয়তো জান্নাত কখনোই হতে পারবে না, কারণ জান্নাতের মতো মেয়েদের দৌড় শামির চৌধুরীর বুক পর্যন্তই।

ঢোক গেলে জান্নাত। শামির ওকে ওভাবে নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,“ভয় কমেনি? আসো আমার বেডে শোও।”

_না তার আর দরকার নেই, আপনি ঘুমান।

জান্নাত প্রস্তাব নাকোচ করেছে শামিরের অসুবিধা হবে তাই, কিন্তু শামির কপাল কুঁচকে ফেললো হঠাৎ অপমানিত বোধ করে। কিছুক্ষণ ওভাবে চেয়ে থাকার পরে শামিরের মাথায় হঠাৎ একটা অদ্ভুত চিন্তা এলো এই মেয়েটাকে নাস্তানাবুদ করার। বললো,“তবে বুঝেছো জান্নাতুল, হসপিটালে ভূত প্রেতাত্মা থাকলেও থাকতে পারে। বোঝোই তো প্রতিদিন কেউ না কেউ মরেই। তাই এসব যায়গা সুবিধার না।”

নিড়িবিলিতে শামিরের গম্ভীর স্বরে বলা কথাগুলো শুনে জান্নাত মৃদু আঁতকে উঠলো, তার গা হিম হয়ে আসলো নিমিষেই। গোল গোল ভীত চোখে শামিরকে দেখতেই শামির একপাশে কিছুটা সরে বললো,“যাও নিজের বেডে গিয়ে শোও। তোমাকে তো মাঝে মাঝে বোবায় ধরে, আজ কি করে সামলাবো তোমাকে?”

বোবায় ধরার কথা মনে পরাতে জান্নাত আরো ঘাবড়ে গেলো। এটাও তার কাছে একটা ভীষণ আতঙ্কের ব্যাপার। পর পর কতেক ফাঁকা ঢোক গিলে এবার গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে শামিরকে বললো,“আপনার পাশে শুই?”

মনে মনে হাসলো শামির, মুখে বললো,“নাহ। আমার যদি অসুবিধা হয় মাঝরাতে!?”

_হবে না, আমি এক পাশে দম আঁটকে শুয়ে থাকবো একদম!

আকুল অনুরোধ ছিলো জান্নাতের কন্ঠস্বরে, শামিরের ভীষণ মায়া হলো, মেয়েটার প্রতি তার লুক্কায়িত অগাধ যে মায়া মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তা, নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে নমনীয় স্বরে বলল,“দম আঁটকে শুতে হবে না জান্নাতুল। তুমি নিঃশ্বাস নিও। এসো শোও। আমি তোমাকে আটকাতে চেয়েছিলাম, তোমার নিঃশ্বাস নয়। চেয়েছিলাম নিঃশ্বাস নাও,শুধু আমার জন্য নাও। এটুকুই চেয়েছিলাম, হয়তো বেশি চেয়ে ফেলেছিলাম। বা হয়তো চাওয়ার পদ্ধতিটা ভুল ছিলো।”

আচমকা এমন অপ্রাসঙ্গিক কথায় চমকালো জান্নাত। ভীষণ নরম হয়ে বলা কথাগুলোতে জান্নাত চমকালো। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে নিস্পন্দ চোখে, দীর্ঘ রজনী ওভাবেই কাটলো ওদের চেয়ে চেয়ে।

কথার মর্মার্থ খুব খতিয়ে না বুঝলেও জান্নাত বুঝলো ওর স্বামী কিছু বলে ফেলেছে ওকে হঠাৎ খেয়াল খুশিতে, যা ওর স্বামী আগে কখনো বলেনি।

_________

ডক্টর ডগলেস হারপার। ছ ফুটের বেশি লম্বা এবং ধবধবে সাদা একজন মানুষ। জান্নাত বিদেশি মানুষ খুব কাছ থেকে এই প্রথম দেখেছে। দু’চোখ ভরা বিস্ময় তার, কেবিনের এককোণে দাঁড়িয়ে ঘোমটার নিচের দু’টো কৌতুহলী চোখের দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে ডক্টরের মুখটাতে।

ডক্টর হারপার শামিরের এক্সরে রিপোর্ট দেখছিলেন এবং কথা বলছিলেন শামিরের সাথে। শামির ডাক্তারের করা প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিতে থাকলেও তার দৃষ্টি ডক্টরের পাশে দাঁড়ানো মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট মুন্নার দিকে, শুঁয়োপোকাটা তার জান্নাতুলকে আড়ে আড়ে দেখছে।
মুখটা ভীষণ কঠিন শামিরের, ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে একটা চটকনা মেরে দিয়ে আসতে মিইয়ে যাওয়া মুড়িটাকে।

এক ফাঁকে মুন্না শামির কে বলে উঠলো,“শেষ কি খেয়েছিলেন ভাইয়া?”

একটু জান্নাতের দিকেও ঘুরলো এবার,মিহি স্বরে বললো,“আপু ভাইয়া শেষ কি খেয়েছিলো?”

চোয়াল শক্ত হলো শামিরের, জান্নাতকে এই বদটার আপু ডাকতেই হবে তাই শামিরকে ভাইয়া সম্বোধন করছে! কি বদের বদ! দাঁত কিড়মিড় করে মনে মনে বরিশালের যত প্রকার গালি আছে সব দিলো শামির, অতঃপর মনে মনেই বললো,“শা’লা বিন্নি ধান, জায়গামতো এমন একটা লাত্থি মারবো যে বল খুলে পরে পিংপং বলের মতো লাফাতে লাফাতে বাউন্ডারির বাইরে চলে যাবে! উজবুক কোথাকার!”

হারপার শামিরের সাথে কথা শেষ করে জান্নাতের দিকে তাকায়, এবার তাকে কিছু প্রশ্ন করে ইংরেজিতে। শামিরের খাওয়াদাওয়ার ব্যপারে,ওর ওষুধের ব্যপারে।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে জান্নাত। লোকটার উচ্চারণ সে কিছুই ধরতে পারছে না, কথা বুঝবে কি? জান্নাত ইংরেজিতে ততটাও ভালো নয়, গ্রামাটিক্যাল রুলস মুখস্থ রেখে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র সলভ করে তো এ প্লাস আনতো তবে তার “স্পিকিং স্কিলস” জঘন্য বললেই চলে। সে শুধু বিব্রত ভঙ্গিতে থেমে থেমে ভেঙে ভেঙে বললো,“একটু ধীরে বলুন, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।”

শামির দেখলো জান্নাতের অপ্রস্তুত ভাব, দেখলো মুখটা ছোটো হয়ে আছে। জান্নাতের হয়ে সে ডক্টরকে সব উত্তর দিলো। ডক্টর চলে যেতেই জান্নাত আড় চোখে শামিরকে একপলক দেখে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো,“আসলে আমি ইংরেজিতে দক্ষ নই। কথা বলতেই পারিনা।”

শামির হাত বাড়িয়ে ডাকলো ওকে,“এসো।”

জান্নাত এগিয়ে যায়,বসে গিয়ে শামিরের পাশে। ওর পেলব হাতটা এক হাতে আগলে নিয়ে শামির বলে,“কোনো ব্যাপার না! একটা মানুষকে যে সব জেনে বসে থাকতে হবে এমন কোনো কথা তো নেই জান্নাতুল। না-ই জানতে পারে একটা মানুষ সব।”

অসুস্থতার পরে জান্নাত যদিও ধীরে ধীরে লোকটার নমনীয়তা উপলব্ধি করেছে, তবুও আজ এই প্রথম জান্নাত টের পেয়েছে তার সেই স্বামীকে, মনের অগোচরে কিশোরী জান্নাত তার যেই স্বামীকে বাসনা করতো। এই এতটুকু কথা,এই নরম হয়ে বলা, এই সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গি খুব কাঙ্ক্ষিত ছিলো জান্নাতের। কিশোরীর বধূ মন আপ্লুত হলো, কিংবা হঠাৎ এতো লাই পেলো যে পুরনো অভিমান মাথাচাড়া দিয়ে উঠে বরের থেকে এভাবেই স্বান্তনা নেওয়ার ফন্দি আটলো। কাঁপল ঠোঁট, কাঁপল গলা, বললো,“সেটাই তো, সব মানুষকে যে সব জানতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সব মানুষকে যে জেনে বসে থাকতে হবে এন্টি বায়োটিক নিলে পেটের বাচ্চার ক্ষতি হয় এমনও তো কথা নেই! সবাই সব জানে না।”

কথাগুলো বলতে বলতে হুহু করে কেঁদে ওঠে জান্নাত। শামির অপলক ওকে দেখে, ওর কান্না দেখে। আচমকা একহাতে ওকে পেঁচিয়ে ধরে বলে,“এ্যাই! কান্না থামাও।”

জান্নাত কান্না থামায় না, অবিরত ঝড়ায় চোখের জল। দু’পাশে মাথা নেড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,“সবাই আসলেই সব জানে না। কিন্তু দুঃখটা দু’জনের হলে সেটা ভাগ করে নিতে হয় দু’জনকে। এই সহজ স্বাভাবিক সত্যটা সবার জানার কথা ছিলো। আপনি কেন জানলেন না? কেন আমার দুঃখ নিতে এলেন না? কেন নিজের দুঃখ দিতে এলেন না? কেন অমন হয়েছিলো? কেন তালাকের কথা আমাকে মুখে উচ্চারণ করতে হয়েছিল? বলেন তো কেন! ”

___________

ভ্যাপসা গরম আবার খানিক বাদে হিমেল হাওয়া। প্রকৃতি দ্বিধান্বিত। বছর ঘুরে আবার সেই হেমন্ত আসবে আসবে করছে। যে হেমন্তে জান্নাতকে এ বাড়িতে এনেছিল শামির। রুপাতলী গ্রাম থেকে বরিশালের “ঝকঝকে কমলা রঙের রোদে” কাদা মাখা পায়ে ওঠার পর বছরখানেক গড়িয়ে গেলো জান্নাতের ।

পুরোপুরি ভাবে সুস্থ না হলেও শামির এখন বেশ সুস্থ। অপারেশনের পরে পায়ে আর কোনো জটিলতা থাকেনি, একটা বড় এবং খুব বিশ্রী দাগ অবশ্য থেকে গিয়েছে সবসময়ের জন্য। হাঁটাহাঁটি নির্বিঘ্নে করতে পারে সে, মাঝে সাঝে তাও খুব কম সময় দুয়েকবার চিলিক মেরে ওঠে ভেতরের কোষ,বেতাল হয়ে মেঝেতে পা ফেললে। হাঁটতে হয় টেনে টেনে। যদিও ডাক্তার বলেছে সময়ের ব্যবধানে এবং মেডিসিন ও এক্সারসাইজের মাধ্যমে এই ত্রুটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

শামির পনেরো দিন হয় বাড়িতে ফিরেছে, ঢাকাতেও পনেরো দিন ছিলো। এসে এক সপ্তাহ বিশ্রাম নিয়ে নিয়মিত অফিস করার চেষ্টা করছে, খাটনি আগের মতো না দিলেও যথেষ্ট দিচ্ছে। আসলে পুরুষ মানুষ যারা কর্মঠ তারা কখনো আরামের বাহানায় হলেও বসে থাকতে পারে না। উপার্জন এবং পুরুষ, দুটি শব্দ একে অপরের পরিপূরক , এটা পুরুষ বিশ্বাস করে।

এক দুপুরে জান্নাত রান্নাঘরে ছিলো তখন, যখন বাড়িতে হঠাৎ শামির এলো অফিস থেকে। মানুষটার জন্য সেই সাবেকি আবেগ, আনুগত্য নিয়েই জান্নাত নারকেলের দুধ দিয়ে হাঁস রাধছিলো। টানা দুমাস পরে হাঁসের মাংস খাবে শামির।
কলিং বেল বাজতেই, জান্নাত গিয়ে খুলো দরজা। শামিরের সাথে ছিলো রুপাতলীর সেই কাজী। যে তাদের বিয়ে পরিয়েছিল।

জান্নাত ফ্যাল ফ্যাল করে মানুষ দু’জনকে দেখলো, একদৃষ্টে কিছুক্ষণ। তার মনে পরে গিয়েছে হঠাৎ তার বলা সেই কথাটা,“আপনি সুস্থ হলেই তালাক নেবো। নেবোই নেবো।”

জায়া ও পতির এই গল্পে রুপাতলী গ্রামের সেই বোকা সরল জান্নাত তখন কি করেছিল জানেন?
হঠাৎ, আচমকা কেঁদে ফেলে এক ছুটে উঠে গিয়েছিল দোতলায়। কেউ কিছু বুঝলো না, শামির বিস্ময়ে হতবাক। পা টেনে টেনে ধীরে ধীরে জান্নাতের পিছু পিছু উঠলো দোতলায়। ঘরে জান্নাত যায়নি, ছুটে গিয়ে ঢুকে পরেছে ছাদের চিলেকোঠায়। গিয়ে কাঁদছে মুখ চেপে, কাঁপছে মুহুর্মুহু। শামির ওকে অনুসরণ করে উঠলো।

হতভম্ব শামির ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে এক হাতে জান্নাতের হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ঘুরিয়ে নিতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো জান্নাত, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“আমি রাগ থেকে বলেছিলাম,আপনার জেদ বাড়াতে নয়। আমি তালাক চাইনি, চাইনি তালাক।”

শামির গোল গোল চোখে মেয়েটাকে দেখছে। হঠাৎ জান্নাত একটা কান্ড করে বসলো, লাফিয়ে শামিরের গায়ে পরে জরিয়ে ধরলো গলা, চেঁচিয়ে বললো,“চাইনা আমি তালাক। আপনি কাজী কেন আনলেন? আমি চাইনা। আপনাকে শুধরাতে হবে না, যেমন থাকার থাকবেন। যেমন ভাবার ভাববেন, শুধু গালি দেবেন না আমাকে, কথার আঘাত সহ্য করা যায়না, একদম যায়না। কথার আঘাত ভোলা যায়না।”

শামির স্থির হয়ে রইল, জান্নাত ফোপাচ্ছে ইচ্ছে মতো। জান্নাতরা এমনই হয়,এমনই। আর কে পারে কি না পারে, জান্নাতুল ফেরদৌসেরা পারেনা। ওদের সংকীর্ণ মনস্তাত্ত্বিক দুনিয়ায় , ওদের দৌড় এই স্বামী অবধিই। শেষটায় ওরা পারে না এর বাইরে যেতে।

শামির একেবারে নিশ্চুপ,মেয়েটা কাঁদার ছলে খামছে যাচ্ছে তাকে, নাকের সর্দি গায়ে মাখছে তার,আর ভেঙে ভেঙে বলছে,“ঐ যে বনফুলের নিমগাছ পড়েছি না? আমি ওটা হয়েছি। এর বাইরে আর কিছু হতে পারিনি। শুধু একটু কথা বলেছি। আমি নিমগাছ হয়েই থাকতে চাই। এর বাইরে আমার আর সাধ্য নেই কিছু হওয়ার। আপনি যত্ন নিয়েন, শুধু গালি দিবেন না, অহেতুক দোষারোপ করবেন না। আর যা কিছু মানিয়ে নেবো।

ওর কান্নার দাপটে কেঁপে কেঁপে উঠছে শামিরের শক্তপোক্ত শরীরটাও, কাঁপছে ঐ পুরুষ মনটাও। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে তার শক্ত দু’টো হাত রাখলো জান্নাতের পিঠে, জান্নাত থামছেই না।

হঠাৎ ম্লান হাসলো শামির, বললো,“নিমগাছ হয়েছো?”

_জি।

_শেকড় কতদূর অবধি চলে গিয়েছে?

_ততদূর অবধি, গৃহকর্তা নিজে থেকে না কাটলে ঝড়বৃষ্টি যে গাছটাকে উপ্রে ফেলতে পারে না। গাছটা নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে থাকে একই স্থানে।

এতো ছোটো মানুষটার মুখে এতো বড় বড় কথা অদ্ভুত লাগে,তবে শামির মন দিয়ে ছোটো মানুষটার কথা গুলো শোনে। কিছুপল বাদে বলে,“কাজী এসেছে বিয়ের কাগজটা দিতে আমাদের,অফিসে এসেছিলো। ভাত খাওয়াতে এখানে নিয়ে এসেছি। তালাক দিতে নয়!”

জান্নাত শান্ত হয়না, সব আবেগ উপচে পরে, কাঁপতে কাঁপতে বলে,“একটু বকা টা কম দিয়েন, গালিগালাজ কম করেন। আল্লাহর দোহাই লাগে।”

ম্লান হাসে শামির, বলে,“নিমগাছের এতেই হয়?”

ওর বুকে মাথাটাকে ঠুকছে জান্নাত পাগলামি করে, যেন দেয়ালে কপাল ঠুকছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,“এতেই হয়, বিশ্বাস করুন এতেই হয়।”

চলমান……