জায়া ও পতি পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
4

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৩৬ [ অন্তিম পর্ব ]
#ইসরাত_ইতি

“দাম্পত্য আসলে ঠিক কিভাবে পূর্ণতা পায়? একটু মানিয়ে নেয়া। একটু মেনে নেয়া। একটু বোঝাপড়া। একটু ঝামেলা, একটু সমঝোতা। এসবের মিশ্রণে একটি দাম্পত্য পূর্ণতা পায়। এটাই বাস্তব। তবে সব কিছুর বাইরে গিয়ে তোমার খেদ নেই তো কোনো জান্নাতুল?”

কড়াইয়ে বড় বড় চিংড়ি গুলো ভাঁজতে ছেঁড়ে দিয়ে জান্নাতুল মাথায় ঘোমটা টানে, মেধার প্রশ্নে ওর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে,
বলে,“আরেকটি বাস্তবতা শিখেছি যে!”

_কি?

_খেদ জিনিসটা সংসারের সাথে যায়না। খেদ নিয়ে আর যাই হোক সংসার হয়না। আমি আমার স্বামীর সাথে সংসার করতে চাই। সবকিছুর উর্ধ্বে,আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি। সব মানিয়ে নিয়েছি। ওসব তিক্ত কটু কথা যদিও ভুলিনি, ওগুলো ভোলা যায়না, ওগুলো আসলে শুকিয়ে নিতে হয় যেমন করে এই পাতিলের মসলা থেকে পানিটা শুকিয়ে নিচ্ছি,ঠিক এভাবে।

বলেই জান্নাতুল হাসলো খিলখিল করে,সরল হাসি। মেধা ওকে দেখতে লাগলো মূক দৃষ্টিতে। কত ছোটো মেয়েটির কত বড় বুঝ! নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার এই বুঝ টুকু কজন মেয়ের থাকে? তার তো ছিলো না, সেজন্য ডিভোর্স নিলো!

বাস্তবতা নিয়ে এতো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না জান্নাতের। বাস্তবতা তো সে রোজ টের পাচ্ছে, এই যে এই মাত্রও টের পেলো যখন হাতা খুঁজে না পেয়ে খালি হাতে চুলা থেকে কড়াই নামাতে গিয়ে ছ্যাঁকা খেলো হাতে। এসব নিয়ে আর কথা বলে,ভেবে কি হবে? শামির চৌধুরী একটু বকা দেবে, পরবর্তীতে ঐ লোকটাই এমন আদর দেখাবে যে জান্নাত ভেসে যাবে মায়ায়। যেটা হয়ে এসেছে,যেটা হতে থাকবে। কারণ এগুলো বাস্তবতা। বাস্তবতার বিকল্প জান্নাতের জীবনে কিচ্ছুটি নেই।

বাড়িভর্তি মেহমান। রুহীর শ্বশুরবাড়ি,শামিরের শশুরবাড়ি আর রাজনের শশুরবাড়ির লোকদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে দুপুরে। রান্নাঘরে বিশাল আয়োজন। তিনজন হেল্পিং হ্যান্ড নিয়ে রিজিয়া চার সের চালের রুটি পিঠা, গোরুর মাংস, নারকেলের ঝোল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাকে সাহায্য করছে সুহানা, জান্নাত আর রুহীও। বিয়ের পর রুহী কাজকম্মে খুব পাকা হয়েছে, তেরোটা রুটি গোল বানিয়ে প্রশংসা নিচ্ছে সবার।

শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে বাকি রান্নাটা দেখছে জান্নাত, ঠিক তখন দোতলা থেকে ওর শমন এলো,“অ্যাই জান্নাতুল!”

জান্নাতুল যেন ছুটতে ছুটতে উঠলো, আজ সাহেব বাড়িতে আছন। তার মাথায়ই ছিলো না, নিশ্চয়ই এখন চিবিয়ে চিবিয়ে বলবে,“কোথায় ঢুকে বসে থাকো? আমি বাড়িতে থাকলে একটু পাত্তা পাইনা। অথচ খুব তো নিজে আমার ওপর আঙুল তোলো ‘আমি আমার ইচ্ছেতে তোমাকে সময় দিই!”

ঘরে ঢুকলো জান্নাত, তবে ওসব কিছু বললো না শামির। ওয়াশ রুমে দাড়িয়ে সে শেভ করছিলো। জান্নাত ধোঁয়া শুকনো তোয়ালে বের করে ওকে দেবে তখনই শামির গমগমে স্বরে বললো,“তখন রাস্তায় নেমে ঐ লোকের সাথে কি কথা বলছিলে এতো? ঐ সবজি ওয়ালার সাথে?”

জান্নাত মৃদু চমকালো, ঢোক গিললো, এই লোক দেখে নিয়েছে তবে? মিনমিনে স্বরে জান্নাত বললো,“আসলে, শাপলা ফুলের আটি চল্লিশ টাকা বললো,এখন সিজন শেষ তাই দাম বেশি। আমি একটু কমিয়ে আনতে চাইলাম আরকি।”

শামির ও কথার জবাব না দিয়ে বলে,“বিকেলে সবাই মেহমান নিয়ে ঘুরতে যাবে বেলস পার্কে শুনছি। যদি সবার সাথে ঢ্যাংঢ্যাং করে গিয়েছো তবে পরে যা হবে সেসব নিয়ে আক্ষেপ করো না কেমন?”

ঠান্ডা হুমকি ছিল এটা। মেজাজটা তো কমই দেখায় শামির। তবে আজকের এই ঠান্ডা হুমকিতেও জান্নাতের কান্না পেলো। ঘুরেফিরে তার জীবনটা সেই চার দেয়ালের মাঝে এই লোকের শাসনের সাথে বন্দী হলো। কিন্তু এটাই যে বাস্তবতা,যা জান্নাতুল মেনে নিয়েছে খুব স্বাভাবিক ভাবে। শামির চৌধুরীরা নিজের বিশ্বাসেই অটল থাকে, শামির চৌধুরীরা এমনই থাকে। জান্নাতুলরা টুকটাক কষ্ট পাবে, তবে পরে রান্নাঘরে ঢুকে পাঁচ মিনিট ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে আবার বরের বুকে ঝাঁপাবে।

চোখের পানি লুকিয়ে ফেলতে কত চেষ্টা জান্নাতের। একটু না হয় বেলস পার্ক যেত সবার সাথে! এটা কি খুব বেশি কিছু হয়ে যেত? এই লোকটার চোখে হতো হয়তো।

চুপচাপ বিছানা গোছায় জান্নাত। আর কি করার? নিম গাছ না সে? নিমগাছ বেলস পার্কে যায়?
শামির আড়চোখে ওকেই দেখছিলো। খানিক বাদে মুখটা ধুয়ে,তোয়ালেতে মুছে এলো জান্নাতের কাছে, তেরছা নজরে কিছুপল জান্নাতের শুকনো মুখটা দেখে ধরলো ওর হাত, বিছানায় বসে একটানে জান্নাতকে বসিয়ে নিলো কোলে। জান্নাতের ডান হাতটাকে উল্টেপাল্টে দেখে শামির বেশ গম্ভীর হয়ে বলে,“নিমগাছ কি হাতে ছ্যাঁকা খেলেও মলম লাগায় না?”

জান্নাত চুপচাপ। ও যে রেগে আছে সেটুকু তো শামির চৌধুরী বোঝেই, তবে বরাবরের মতো সেই রাগকে পাত্তা না দেওয়ার প্রয়াশ তার। নিজের গলায় রাখা আধ ভেজা তোয়ালে টা দিয়ে জান্নাতের ঘর্মাক্ত মুখটা মুছিয়ে দিয়ে বললো,“এই নিমগাছ! যাও তো, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো।”

“যথা আজ্ঞা” ভঙ্গিতে জান্নাত উঠে দাঁড়ায় তৎক্ষণাৎ । গিয়ে চুপচাপ দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসে। শামির ওকে প্রথমে মলমটা লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,“নিমগাছ হয়েছো, বলেছো যাতে বকাবকি না করি, তুই তোকারি না করি,গালি না দিই, তাতেই নাকি চলবে। নিমগাছের নাকি এতেই হয়! তবে এখন মুখ ভার কেন? বেলস পার্ক না যেতে পারার কষ্টে?”

জান্নাত জবাব দেবেই না। ঘোরাঘুরির শখ মরে ভুত হয়ে গিয়েছে। এখন উল্টাপাল্টা কথা বলে কথাকাটাকাটি করে দাম্পত্যে আর ঝামেলা বাধাতে চায়না সে।

শামির ওকে দেখে, হঠাৎ থুতনিতে হাত রাখে জান্নাতের। গোলগাল ছোটখাট ফর্সা মুখটা উঁচুতে তুলে চোখে রাখে চোখ,নিরেট ঠাণ্ডা স্বরে বলে,“নিমগাছ, বেলস পার্ক যাওয়া হবে না তোমার ধেইধেই করে।”

_শুনলাম তো, ক’বার বলবেন?

অভিমানী স্বর জান্নাতের। মনে মনে সামান্য হাসে শামির, পর পর বলে,“কেন যাওয়া হবে না জিজ্ঞেস করবে না? তুমি তো বেশ প্রতিবাদী হয়েছো, তোমার বেলসপার্ক যাওয়ার স্বাধীনতা কেন হরণ করলাম জানতে চাইবে না?”

খুব কাছাকাছি দুজন, লোকটার ভারি শ্বাস জান্নাতের মুখে আছড়ে পরে। জান্নাত কেঁপে কেঁপে উঠছে শিহরণে। এবার ক্ষীণ স্বরে বললো,“কেন যেতে পারবো না?”

ওর কপালে এবার কপাল ঠেকায় শামির। খুব সহজ ভঙ্গিতে বলে,“আজ নিমগাছ নিয়ে আমি শাপলা বিল যাবো তাই!”

অবাক বিস্ময়ে জান্নাত তাকিয়ে আছে। শামিরের মুখটা চিরায়ত গম্ভীর। ওর কপালে চুমু খেয়ে বলে,“দেখবো ক আঁটি শাপলা তুলতে পারো তুমি।”

_সত্যিই?

আপ্লুত স্বর জান্নাতের। এই এতটুকু খুশি দেখে শামিরও অবাক এবং আপ্লুত দুটোই হয়। চোখ চিকচিক করছে জান্নাতের। শামির বলে,“কি? বেলস পার্ক যাওয়ার স্বাধীনতা চাই নাকি আমার বন্দীনি হয়ে শাপলা বিল যেতে চাও? কোনটা?”

পেলব দু’হাতে জরিয়ে ধরে শামিরকে জান্নাত, বুকে ঠেকায় মাথা, ছটফটিয়ে বলে,“শাপলা বিল,শাপলা বিল।”

হাসে শামির নিশ্চুপ। আলিঙ্গন দৃঢ় হয়। শামির বলে,“সিজন শেষ জান্নাতুল ফেরদৌস। বড্ড দেরি করলাম নাহ?”

জান্নাত তিরতির করে কাঁপছে,বলে,“হোক দেরী। হোক দেরী। শাপলা ফুল নাও থাকুক। আপনি শুধু আমাকে নিয়ে যান।”

পৌষের শুরুতে, অলস দুপুরে শামির চৌধুরীর কাছে পেতে ইচ্ছে করলো স্ত্রীকে হঠাৎ। তবে মায়াময় মুখটার দিকে আবেদন ভরা দৃষ্টিতে যখন তাকালো তখন মনে পরলো অনুমতি নেওয়ার কথাটি। আচ্ছা অনুমতি কিভাবে নেয়? এই মেয়ে যে বারবার বলেছে শামির অনুমতি নেয়না, অনুমতিটা নেবে কিভাবে শামির? এসব নেওয়া যায়? অত লুতুপুতু ব্যাপার তো শামির পারেনা,জানে না। সে সহজ,তার চাহিদা সহজ, সেসবের প্রকাশ সহজ। নারী মনটাই জটিল, কত কি যে চাহিদা ওনাদের। না পেলে কষ্টে মরে যায়। নারী মনের কামনা-বাসনা সে অত বুঝবে কিভাবে? এ তো মহা মুশকিল হলো!

শ্বাস ফেলে শামির। যাই হোক, তাকে এসব শিখতে হবে। বৌ রাখতে হলে একটু লুতুপুতু করা শিখলে পুরুষের জাত যায়না। পুরুষের মান কমে না এই অবলা জাতকে একটু আহ্লাদ করলে। বদ্ধ ঘরের ভেতরেই তো, বাইরের লোক থোরাই দেখছে শামির চৌধুরী তার বৌয়ের কাছে ভিক্ষা চায়?

চুমুতে চুমুতে ভিজে উঠলো জান্নাতের দুই গাল। ততক্ষণে তার চাপা রাগটাও ভিজে গলে গিয়েছে শাপলা বিলের কথা শুনে। কত কি যে দেখছে কল্পনায়। একটা নৌকায়,সে আর শামির। সে শাপলা তুলছে, শামির ছবি তুলছে।
অনুভূতির জোয়ারে যখন উথাল পাথাল ভাসছিল,তখন শুনলো ঐ লোকটা হঠাৎ বললো,“নিমগাছ, যদি অনুমতি না থাকে এক্ষুনি উঠে দৌড়ে নিচে যাও। আমি পরে ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে পারবো না। না শুনতে পারবো কোনো অভিযোগ!”

নিমগাছ হাসে হঠাৎ, দু’চোখ বুজিয়ে নিয়ে জরিয়ে ধরে বরের গলা, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,“যেতে পারবে না নিমগাছ, শেকড় অনেক দূর অবধি চলে গিয়েছে।”

__________

আকাশ কেমন মেঘাচ্ছন্ন। তবে বৃষ্টি নামতে ঢের দেরী। পৌষের শুরুতে বৃষ্টি নাও হতে পারে,ঠিক বলা যায়না। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে বাড়ির মেহমান নিয়ে ঘুরতে বেরুলো সবাই। তবে জান্নাত যায়না। এক রাশ ছটফটানি নিয়ে একটা নতুন শাড়ি নামিয়ে তৈরি হয়। আনন্দ উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে তার। ঐ কাঁপুনি থামলো যখন শামিরকে দেখলো সে।

শামিরের হাতে একটা নীল ফাইল। ওটা দেখেই মুখটা ফ্যাকাশে হয় জান্নাতের। শাপলা বিলের কথা বলে আবার অফিসে যাবে নাকি?

জান্নাতের মলিন মুখ দেখে শামির বুঝলো ওকে, ফাইলটা উল্টেপাল্টে নিতে নিতে বলল,“এটা একটা দরকারি ফাইল, চলো আগে তোমাকে শাপলা বিল থেকে ঘুরিয়ে আনি। তারপর এটার কাজ করবো।”

ষাট কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে একেবারে বাগধা গ্রামে পৌঁছেই থামলো ওদের গাড়ি। বড় বিল থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা দূরত্বে গাড়ি থামিয়ে ওরা নামলো।
জান্নাত অবাক হয়, শামির গাড়ি থেকে নামার সময় হাতের ফাইলটা নিয়েও নামছে, এটা দেখে।

বেশি প্রশ্ন করে না জান্নাত, এই লোক অহেতুক কোনো কাজ করে না। নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটা, নয়তো এভাবে সাথে রাখবে কেন?

পর্যটকদের ভিড় যে খুব একটা নেই তেমনটা নয়, আছে গুটি গুটি, ছড়ানো ছিটানো।

শামির জান্নাতুলকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েই এক মাঝি ঠিক করলো। তবে একটা কান্ড করলো শামির, মাঝিকে বললো মাঝি থাকতে পারবে না বিলে তাদের সাথে নৌকাতে। নৌকাটা তারা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। শামির ইচ্ছুক নয় তাদের কথোপকথন মাঝি শুনুক।

মাঝি লোকটা বাড়তি কিছু টাকা পেয়ে রাজি হয়। আরেক মাঝিকে সাথে নিয়ে ওরা বিলে নামে। জান্নাত জানতো এমন কিছুই হবে, এই পাগলামি গুলো তার স্বামীর সাথেই যায়। বৃদ্ধ এক মাঝির সাথেও হিংসে পনা।

আকাশ আবার রৌদ্রজ্জ্বল হয়ে উঠলো। নৌকা নিয়ন্ত্রণ করা খুব ঝক্কির কাজ যদিও। মাঝিকে অবশ্য বলা আছে ইশারা করলে যেন তাদের সাহায্য করতে আসে। বিলের মাঝ অবধি যায়না শামির। কিছুটা ভেতরে গিয়েই থামিয়ে দেয় নৌকা। দু’পাশে দু’টো শাপলার ঘন ঝাড়। শামির সহজ ভঙ্গিতে জান্নাতুলকে বলে,“এখান থেকেই তুলতে পারো।”

জান্নাত ফুরফুরে মেজাজে দু’টো শাপলা তুলে আহ্লাদী সুরে বলল,“আরো ভেতরে চলুন না।”

শামির দেখছে জান্নাতের ঠিকরে পরা খুশি। দাঁড় উঠিয়ে আবারও টানতে শুরু করে সে! তবে খানিক বাদেই একটু ধমকের সুরে বললো,“ঘোমটা কই হ্যা?”

জান্নাত তড়িঘড়ি করে ঘোমটা টানলো ভয়ে। এভাবে ধমকটা দিয়ে শামির ঠিক করেনি বুঝলো, পর পর বললো,“রোদ লাগে না? ঘোমটা ফেলো না।”

জান্নাত মাথা নেড়ে আবার শাপলা তুলে নেয়। শামির হঠাৎ থামে, দাঁড় থামিয়ে হঠাৎ পকেট থেকে ফোনটা বের করে বলে,“দাঁড়াও তোমার ছবি তুলি। পোজ দাও।”

পোজ কিভাবে দেয় জান্নাত জানে না। তবে শামির তার ছবি তুলছে দেখে তার বুক ঢিপঢিপ করছে, সে মুখ হাসি হাসি করে ফেলে।

শামির গম্ভীর স্বরে বলে,“ছবিগুলো আমার জন্য তুলছি। সোস্যাল মিডিয়ার জন্য না।”

জান্নাত চুপচাপ মাথা নাড়ে। শামির কপাল কুঁচকে বলে,“ওদিকে কাকে দেখো? আমার দিকে তাকিয়ে হাসো। এক কাজ করো, তুমি ভান করো তুমি শাপলা ফুল দেখছো…..হ্যা ঠিক এভাবে……আরে এতোটা নুয়ে যাচ্ছো কেন? আচ্ছা ঘোমটা খসছে তোমার,এক হাতে ঘোমটা ধরে রেখে আরেক হাতে শাপলা ফুল ধরে একটু হাসো।”

লোকটার গুরুগম্ভীর পাগলামিতে বুকের মাঝখান থেকে ভারি পাথরটা ধীরে ধীরে সরে জান্নাতের। ঠিক এতটাই সহজ হোক লোকটা,এ তো জান্নাতের সবসময়ের বাসনা।

শামির হঠাৎ ছবি তোলা নিয়ে খুব সিরিয়াস হলো,ধমকে উঠলো জান্নাতকে,“আবার আঁকাবাঁকা তাকায়! আরে ওদিকে কি দেখছো? কোন ব্যাটাকে দেখছো? আর কাউকে দেখো না,চোখ দু’টো আমার দিকে রাখো! তোমার স্বামীর দিকে।”

জান্নাত থমকায়। লাজুক দৃষ্টি নামিয়ে বসে থাকে হঠাৎ। হঠাৎ শামিরের খুব মনে ধরে জান্নাতের ঐ হাসিটা, বলে ওঠে,“ওয়েট ওয়েট ওয়টে, হ্যা এভাবেই লজ্জা পেয়ে হাসো। কি হলো, আবার হাসো!”

জান্নাত হাসলো। চ কারন্ত শব্দ করে উঠে শামির বললো,“উহুম হচ্ছে না। ওভাবে লজ্জা পেয়ে হাসো।”

জান্নাত চুপ করে রইলো মিনিট খানেক, পরপর বললো,“আপনি আবার ঐ কথাটা বলুন তবে।”

থমকালো শামির, দু’জনে চেয়ে রইল দুজনের চোখে, ধীরে ধীরে শামির বললো,“আর কাউকে দেখো না,চোখ দু’টো আমার দিকে রাখো! তোমার স্বামীর দিকে।”

ভীষণ নমনীয় ছিলো সে স্বর, জান্নাত দফায় দফায় আপ্লুত হয় আজ, তার চোখ চিকচিক করে। দৃষ্টি থেকে নামায়না সে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি, কন্ঠে নিদারুণ কোমলতা ঢেলে জবাব দেয়,“জি! আর কাউকে দেখবো না তো! আপনাকেই দেখবো।”

শামিরও থমকায়। এরপর দু’জনে চুপ হয়ে যায় দীর্ঘসময়ের জন্য। ওরা একটা নির্জন কিনারায় আছে, আশেপাশে অন্য কোনো নৌকা ছিলো না। শামির এবার তুলে নেয় হাতের ফাইলটা, জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,“বেশ মেঘ করছে আকাশে জান্নাতুল। এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। এই ফাইলটা দেখো তো, সব ঠিক আছে কিনা। আমাদের এখন কম্পিউটারের দোকানে যেতে হবে।”

চোখের পাতা প্রশস্ত করে জান্নাত তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ফাইলটা নিয়ে খুলে দেখতে পায় তার একাডেমিক সব কাগজপত্র। কাঁপা কাঁপা দৃষ্টি ওসব দেখে ছটফটিয়ে উঠে আবার শামিরকে দেখে, হঠাৎ ধাক্কার মতো খায়। আজ সারাদিন পর লোকটাকে বেশ অন্যরকম লাগছে।

শামিরের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়েই থেমে থাকে জান্নাত। শামির এবার বেশ ধীরে ধীরে বলে,“আর কাউকে দেখো না। শুধু আমাকেই দেখো কেমন? আমি তোমার প্রাপ্য স্বাধীনতা টুকু তোমাকে দিয়ে দিলাম, বাড়তি কিছুই দিতে পারবো না। তুমিও আমার প্রাপ্য বিশ্বস্ততা টুকু ফিরিয়ে দিও?”

আকাশে যেমন কালো মেঘ করেছে, জান্নাতের চোখে নামে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। নীল ফাইল ধরে রাখা তার হাতটা কাঁপছে, তার ঠোঁট কাঁপছে। শামির শ্বাস ফেলে বলতে থাকে,“মহিলা কলেজ ফার্স্ট চয়েজ দিই? সাইন্স পারবে? আমি বাইরে টিউশন নিতে যেতে দিতে পারবো না। ঘরে টিচার ঠিক করে দেবো, মহিলা টিচার। কলেজে বান্ধবী থাকবে মোটে একজন, দল পাকানো যাবে না। গাড়ি ছাড়া যাওয়া যাবে না কলেজে, আর সর্বোপরি, শালীন হয়ে থাকতে হবে।”

জান্নাতের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে, খুব সুন্দর কোনো স্বপ্ন। হ্যা এটা হয়তো স্বপ্নই, বাস্তবে এমন হবে বলে আশা তো রাখেনি জান্নাত। শামির মেয়েটার অদ্ভুত ভঙ্গিতে নড়াচড়া আর কাপাকাপি দেখে এগিয়ে বসে নৌকায়, জানতো সে এই মেয়ে এই ধাক্কা সামলাতে পারবে না। তার পরিকল্পনা ছিলো আজ গাড়িতে খুব কাছে টেনে বুঝিয়ে সুজিয়ে এসব বলার। দাম্পত্যের সব তিক্ততা ভুলে গিয়ে মেয়েটাকে একটু ভরসা দেওয়ার। কিন্তু জীবন তো এতোটা সাজানো পরিকল্পিত হয়না। মুখ ফসকে নৌকাতেই বলে ফেলেছে সে।

শামির আরেকটু এগোয়, এবার নৌকা দুলে ওঠে। জান্নাত থ হয়েই বসে আছে, চোখ থেকে পানি ঝরছে অবিরত। খুলে পরেছে ঘোমটা, সেদিকে তার খেয়াল নেই। শামির এক হাতে ঐ ঘোমটা টেনে দিয়ে নমনীয় গলায় বলে,“সাইন্স নেবে? দেখো ভাবতে হবে এখুনি, আজ আবেদনের শেষ দিন। আজ না হলে আবার সামনের বছর, এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।”

ঝাপসা চোখ দু’টো তুললো জান্নাত,লোকটাকে নতুন রূপে পেয়ে বিগত এক বছরের সব অভিমান বালিকার পুতুল হারানো ক্ষোভের মতো বেরিয়ে আসে। লাই পায় জান্নাত, কেঁদে ফেলে, বলে,“ আর আমার বিগত একটা বছর যে নষ্ট করলেন সেটা?”

আকাশ কালো,ঘোলাটে হয়। ঠিক ততটাই উজ্জ্বল আর স্বাভাবিক হয় শামির চৌধুরীর মুখটা। আজ সে বৌয়ের অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা যুক্তি দাঁড় করায় না। চোখে চোখ রেখে ঠিক ততটাই কোমল স্বরে বলে,“ওয়েল জান্নাতুল……আমি তোমার ঐ একটা বছর তো ফিরিয়ে দিতে পারবো না, তবে সম্ভবত, সম্ভবত সামনে কিছু সুন্দর সুন্দর বছর দিতে পারবো।”

একটু ভরসা। একটু সামান্য ভরসা। বোকা সরল জান্নাত‌ সেকথা বানীর মতো গ্রহণ করেই হুহু করে কেঁদে দিয়ে এগোলো । ও নিজেকে সামলাতে পারছে না। শামির ওকে থামালো,“উহু! আমি জানি তুমি কি করবে! এটা পাবলিক প্লেস জান্নাতুল, এখানে নয়।”

জান্নাত শুনলোই না, এসে শক্ত করে ধরলো শামিরকে, তড়পাতে তড়পাতে বললো,“সত্যি তো?”

_তুমি জানো জান্নাতুল শামির চৌধুরী অত আশা দেয়না! দিলেও মিথ্যা আশা দেয়না।

চোখ মুছলো জান্নাত, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“আর কি কি শর্ত আছে, বলে ফেলুন।”

শামির ওকে একটা অমায়িক হাসি উপহার দিয়ে তীরে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ মাঝিকে ডাকলো নৌকা টেনে নিতে।

তীরে পৌঁছেই ওরা পরলো বৃষ্টির কবলে। জান্নাতের পেলব হাতটা টেনে নিয়ে শামির বসালো গাড়িতে, নিজেও উঠে বসে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে জান্নাতের দু কাঁধ ধরে কাছে আনে, বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে বলে,“শর্ত নেই আর,মানবে তো?”

উপর নিচে মাথা ঝাঁকায় জান্নাত। পর পর বলে,“মানবো তো, আমি খুব মানিয়ে নিতে পারি জানেন না?”

ওর কপালে কপাল ঠেকায় শামির, বলে,“জানি। নিমগাছ।”

দু’জনে অস্থির অনুভূতি সামলাতে পারে না। এই সুখ সুখ অনুভুতি জান্নাতের অসহ্য ঠেকে। নীল ফাইলটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলে,“কবে আনলেন?”

_আজই হাতে এলো।

ফাইলটা রেখে জান্নাত চোখ ঘুরিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখে, শামির বলে,“ভিজবে তুমি? ভেজো! এপাশটায় ভেজো, বটগাছের আড়াল। লোক দেখবে না।”

লোকটা অদ্ভুত, ভীষণ অদ্ভুত। জান্নাত লাফিয়ে নামলো গাড়ি থেকে। গায়ে মাখালো ঠান্ডা বৃষ্টির পানি। জানালা থেকে শামির ওকে দেখছে, হঠাৎ বলে ওঠে,“হ্যা হ্যা,দুহাত এভাবে মেলে ধরো। আমি ছবি তুলি।”

জান্নাত তাই করলো।

_এই তোমার ঘোমটা পরলো কেন?

আবারো ধমকে উঠলো শামির। হেসে ফেলে জান্নাত। আবার চোখের কোণে জ্বল জমে, লোকটাকে বলে,“আপনি এসে টেনে দিয়ে যান না!”

_না না, পৌষের বৃষ্টিতে ভেজার শখ নেই আমার।

_আসুন না। আমরা তো কখনো একসাথে বৃষ্টিতে ভিজিনি!

খুব জোর খাটিয়ে আবদারটা করলো জান্নাত। শামির ওকে খানিকক্ষণ দেখে ফোন রেখে ধীরে ধীরে নামলো গাড়ি থেকে, কাছে এগিয়ে গিয়ে সম্মুখে দাঁড়িয়ে জান্নাতের মাথার ঘোমটা টেনে দিয়ে বলল,“এক সাথে ভিজিনি তাইনা?”

দু’পাশে মাথা নাড়ে জান্নাত। শামির আশেপাশে তাকায়, ঝুম বৃষ্টিতে কারো উপস্থিতি দেখতে না পেয়ে জান্নাতকে জরিয়ে ধরলো। হিম ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে দু’জন। শামির বললো,“আর কি কি একসাথে করিনি?”

_একসাথে জ্বর বাধাইনি, এন্টি বায়োটিক নিইনি।

বলতে বলতে মলিন হলো স্বর। শামির থমকাল, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,“জান্নাতুল।”

_জি!

_ওটা তোমারও বেবি ছিলো। ঐ তোমার আমার বেবির কথা মনে করে হুটহাট এভাবে মন খারাপ করো না কেমন? আল্লাহর দেওয়ার ছিলো দিয়েছেন, নেওয়ার ছিলো নিয়েছেন। ওতে তোমার দোষ ছিলো না।

বৃষ্টিতেও শামির দেখে জান্নাতের চোখের পানি, ঐ বৃষ্টিতেই ঐ পানি মুছিয়ে দেয়। জান্নাত নাকি সুরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,“হঠাৎ ওর কথা তুললেন কেনো?”

ছোটো মাথাটাকে শক্ত করে বুকে চেপে রাখে শামির, বলে,“আমরা তো একসাথে দুঃখও করিনি ওকে নিয়ে তাইনা।”

বৃষ্টির ঝাপ বাড়ে, বাড়ে দু’জনের দুঃখ। সে দুঃখ বিলাস হয় নিশ্চুপে। বৃষ্টির ঝাপ কমার সাথে সাথে সে দুঃখ কমে আসে।

জান্নাত মুখ তোলে শামিরের বুক থেকে, বলে,“আরো অনেক কিছুই তো করিনি আমরা একসাথে,সেসব এবার থেকে করবেন?”

মাথা নেড়ে, শ্বাস ফেলে আশ্বাস দেয় মেয়েটাকে শামির,বলে,“করবো।”

_সত্যি তো?

ম্লান হাসে শামির, অস্ফুট স্বরে বলে,
_শামির চৌধুরী অত আশা দেয়না জান্নাতুল। তবে দিলেও মিথ্যা আশা দেয়না তুমি জানো।

দূরে কোথাও হঠাৎ একটা বাজ পরে। শামিরকে এবার আকরে ধরে জান্নাত। শামির বলে,“চলো এবার যাই এখান থেকে। বজ্রপাত হচ্ছে। একসাথে মরার সময় হয়তো হয়নি। একসাথে সংসার তো করতে হবে।”

হেসে ফেলে জান্নাত, শক্ত বুকটাতে নাক ঘষতে ঘষতে বলে,“আরো কিছুক্ষণ একসাথে ভিজে নিই। আমার পা আটকে আছে এখানে, আপনি আমাকে শক্ত করে সাপোর্ট দিয়ে ধরে রাখুন।”

গল্পটি নিয়ে লেখিকার কিছু কথা :

প্রিয় পাঠকেরা, গল্পটি ছিলো জায়া এবং তার পতির গল্প। এই গল্পের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো তাদের মধ্যে বোঝাপড়ার বিষয়টা। শামির চৌধুরী মেয়েদের স্বাধীনতা নিয়ে কি ভাবে,আর সেটি কতটা ভুল এসব দেখানো ও পর্যালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য ছিলো না। এমন কোনো ঘটনা আমি গল্পে দেখাইনি যে বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা শামিরের এমন মানসিকতার হঠাৎ বিরাট পরিবর্তন আসবে। ও জান্নাতুলকে একটু বুঝতে চেয়ে ওর প্রতি ভরসা এনেছে এটাই আমি দেখিয়েছি। গল্পের এন্ডিং টা কিন্তু আমি ওপেন রাখলাম। নারীর স্বাধীনতা ভালো নাকি পুরোটাই খারাপ সেটা না হয় জান্নাত কখনো বুঝিয়ে দেবে ভবিষ্যতে। ও যেভাবে ওর নমনীয়তা দিয়ে শামিরের ভরসা অর্জন করেছে,ঠিক ওভাবেই না হয় আরো ভরসার জায়গা হবে শামিরের।

এবং যারা শামির চৌধুরীর ডেভেলপমেন্ট দেখতে চেয়েছেন তাদের বলছি, ওর একটু নমনীয় হওয়াটাই ছিল ওর ডেভেলপমেন্ট। বিগত পাঁচ-ছয়টি পর্বে বিন্দু বিন্দু আমি দেখিয়েছি শামিরের থিতু হওয়া। এতেও যারা সন্তুষ্ট হননি,তারা গল্পটির এন্ডিং স্যাড ধরতে পারেন। কারণ বাস্তবতার নিরিখে শামির চৌধুরীরা হুট হাট বৌকে দুই একটা থাপ্পড় আর দুর্ব্যবহার করার মতো বর্জনীয় কাজ করে জেলে যায়না, বৌয়ের পা ধরে ক্ষমাও চায়না। বাস্তবতা বড়ই জটিল এবং বিতর্কিত। এটা গল্প ছিল বলেই লেখিকা শান্তি ছিটাতে পারলো।
তবে হ্যা, বাস্তবেও কখনো কখনো এভাবে হুট করে একদিন নরম হয়ে যায় শামির চৌধুরীরা। হুট করেই। সংখ্যায় খুব কম। এই কারণ অজানা, এই বিষয়টি রহস্যমণ্ডিত। এই বিষয়টি জায়া ও পতির। 🖤

পুনশ্চ :

ঘুম ঘুম চোখে, হাই তুলতে তুলতে জান্নাত সদর দরজা খুললো। দেখলো দাঁড়িয়ে আছে শক্তপোক্ত গম্ভীর মেজাজী মানুষটা, তার সারাদিনের জমিয়ে রাখা ক্লান্তি নিয়ে।

আজ বেশ রাত করে ফিরেছে শামির। লঞ্চের স্টাফরা বেতন বাড়ানোর আন্দোলন করছে, তাদের সামলাতে সামলাতে এতো রাত হলো। অত রাতে জান্নাতকে সজাগ দেখে শামির বললো,“ঘুমিয়ে পরতে বললাম তো ফোন করে ! সকালে ক্লাস আছে না?”

লোকটা ভেতরে ঢুকলে জান্নাত দরজা লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,“পড়ছিলাম।”

মেজাজ দেখালো শামির, বিরক্তির সুরে বলে,“সারা বিকাল কি করো?”

_কাজ থাকে না? আজ মেহমান ছিল রাত অবধি।

মুখ হাত ধুয়ে এসে শামির রাতের খাবারটা খায়, পুরোটা সময় জান্নাত পাশে দাঁড়িয়ে থাকে ওর। ঘরে এসে বিছানায় যখন গা এলিয়ে দেয় শামির, জান্নাত তখন আবার পড়ার টেবিলে বসে।

শামির অবশ্য ওকে কিছু বলেনা, তবুও জান্নাত সারাদিন পরে লোকটার সান্নিধ্যে না যাওয়ার অপরাধ বোধে ভোগে, পড়ায় আর মন বসে না ওর। তেরছা নজরে শুধু মানুষটাকেই দেখে। যে কিছুক্ষণ ফোন ঘেটে বিছানায় বারবার এপাশ ওপাশ করছে। তবে সংকেত দিচ্ছে না জান্নাতকে বিছানায় যেতে, চুপচাপ গম্ভীর হয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আজ ব্যবসার হিসাব কষছিলো মনে মনে।

খানিক বাদে, লোকটার নির্লিপ্ততা দেখে জান্নাতই উঠলো তার বাংলা বইটা হাতে নিয়ে। পড়ছিল একটা গল্প।
বিছানায় শুয়ে পড়তেই শামির গলা খাঁকারি দিয়ে মিনমিনে স্বরে বলল,“পড়া শেষ না হলে এলে কেন? আমি তো কিছুই বলিনি।”

জান্নাত বই নিয়ে ওপাশে কাত হয়ে শুয়ে মুচকি হাসলো। সে তো জানে, লোকটার অভ্যাস তার গাঁয়ে গা লাগিয়ে ঘুমানো। তাকে ধরে রেখে ঘুমানো।

জবাব জান্নাত দেয়না, গভীর মনোযোগে বইটা দশ মিনিট ধরে পড়ার পর টের পেলো শামির ওকে ধরছেও না। কেমন শক্ত হয়ে শুয়ে আছে। জান্নাত এবারো নিশ্চুপ হাসে, অতঃপর খানিক বাদে উঠে বসে জান্নাত ঘুরে শামিরকে দেখে। শামির বলে,“কি? আমি কিন্তু কিছুই বলিনি।”

এবার বেশ শব্দ করে হেসে উঠল জান্নাত, পর পর সে হাসি থামিয়ে বইটা একপাশে রেখে শক্ত করে ধরলো শামিরকে, ওর পেটের কাছের টিশার্ট টেনে ঢিলে করে জান্নাত শামিরের টি-শার্টের মধ্যেই ঢুকে পরে। গলার কাছটা টেনে ঢিলে করে মাথা বের করে বরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। একই টিশার্টের মাঝে দু’জন, জান্নাতের পিঠ ঠেকেছে শামিরের বুকে।

গোল্লা গোল্লা চোখে চেয়ে আছে শামির। জান্নাত বললো,“ আপনি তো কিছুই বলেননি। আমার আসলে বিছানায় একটা খুব বদ অভ্যাস হয়েছে জানেন? আপনার সাথে গাঁয়ে গা লাগিয়ে আপনাকে ধরে না শুলে খালি খালি লাগে। এবার আপনার সাথে মিশে শুয়ে থাকাও হবে, আর পড়াও হবে ।”

দু’জন চেয়ে আছে দু’জনের চোখে। শামির হঠাৎ স্মিত হেসে বললো,“বিগড়ে যাওয়া মেয়ে! এতো কিছু কই শিখলে?”

গলায় জোর জান্নাতের,হেসে বললো,“যেভাবেই শিখি, বই পড়ে এসব শিখিনি কসম!”

সারাদিন পর হাসলো দু’জন শব্দ করে খানিকক্ষণ। শামির ওকে ধরে রেখেছে শক্ত করে, জান্নাত ছোটো ছোটো হাত দুটো বের করে বইটা নিয়ে পড়তে লাগলো। একটু বিড়বিড় করেই পড়ছে। শামির শুনছে সেসব মন দিয়ে। একেবারে চুপ হয়ে, হঠাৎ পড়া থামায় জান্নাত। বলে ওঠে,“শুনছেন?”

_হু?

লাজুক মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে জান্নাত বললো,“আজ পড়া শেষ হতে একটু বেশিই রাত হবে। আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন না কেমন?”

শামির নিশ্চুপ হাসে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,“আজ অফিসে রিতা আপার বেবিটা এসেছিল। কি যে কিউট! আমি কোলে নিয়ে বিশ মিনিট রাখলাম।”

জান্নাত পড়া থামায়, মুখটা ঘুরিয়ে লোকটার চোখে চোখ রেখে কিছু পল তাকিয়ে থাকে। পর পর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলে,“আমার এইচএসসি পরীক্ষার পরে আমরাও বেবী নেবো?”

শামির চুপ হয় মিনিট খানেকের জন্য, তারপর বলে,“আর পড়াশোনা করবে না?”

_করবো তো। বেবী নিয়েও কত মেয়ে পড়াশোনা করে!

একটু বেশিই জোর ঢেলে কথাটা বললো জান্নাত। শামির হঠাৎ বেশ ভরসা পেলো, বললো,“আচ্ছা,এটা করা যায়! আমি আছি! বেবী পালতে জানিনা, তবে শিখে নেবো!”

মৃদু হাসে জান্নাত লোকটার স্বপ্নালু দৃষ্টি দেখে, বেশ আবেগী হয়ে বলে,“বেবী পেলে পুষেই দেবেন? সত্যি তো?”

শামিরও হাসে,বলে,“শামির চৌধুরী অত আশা দিতে জানে না জান্নাতুল, তবে যেটুকু দেয় সেটুকু মিথ্যা নয় তুমি জানো।”

সমাপ্ত…….