জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-১৪+১৫

0
7

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৪]

আকাশে সূর্য হাসছে। অতিষ্ঠ গরমে ট্যাংকের পানিও ধারণ করেছে ফুটন্ত গরম পানির রূপ। মাথার উপরে ঘূর্ণায়মান ফ্যানের বাতাসও মনে হচ্ছে এক কুন্ড আগুনের গা ঝলসানো উত্তাপ। খাবার টেবিলের একটি চেয়ারে বসে আছেন শাহানা। গরম সহ্য করতে না পেরে একটু পরপর ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি বের করে চালান করছেন নিজের মুখে। মাথার উপর ঘুরন্ত ফ্যান থাকার পরেও ঘেমে নেয়ে অবস্থা উনার বেগতিক।

উথমী রন্ধনশালায় দাঁড়িয়ে রান্না করছে। মালতী ফুফু মেঝেতে বসে কুটছেন মাছ। কী মনে করে যেনো আজ সকাল সকাল আরদে গিয়ে মায়ের পছন্দের পাবদা, পোয়া আর নদীর পাঙ্গাশ মাছ নিয়ে এসেছিল তৈমূর। যদিও শুক্রবার ছাড়া বাজারে সে যায় না। তবুও কী মনে করে যেনো হাঁটতে হাঁটতে সেদিকে চলে গিয়ে করে নিয়ে এলো বাজার। সেসবই বসে বসে কুটছেন মালতী ফুফু। ফ্রিজ থেকে মশলার বাটিটা নিতে এলো উথমী।তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিগোচর হলো এক ঢোকে ঠান্ডা পানি গিলতে থাকা শাশুড়িকে। দৃশ্যটি তার মোটেও ভালো লাগলো না। ভারিক্কি কণ্ঠে বললো,“এভাবে সরাসরি কেনো ঠান্ডা পানি খাচ্ছেন? পরে তো ঠান্ডা লেগে যাবে। নরমাল পানির সাথে ঠান্ডা পানি অথবা বরফ মিক্সড করে খান।”

কথাটি শ্রবণাতীত হতেই পুত্রবধূর পানে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকান শাহানা। প্রত্যুত্তর না করে থম মেরে বসে থাকেন। উথমী ফ্রিজ খুলে নিজের কাজ করতে করতে পুনরায় বলে,“বোতলে করে পানি দিয়ে দিচ্ছি। এই গরমের মধ্যে এখানে আর বসে থাকতে হবে না। ঘরে গিয়ে এসির নিচে শুয়ে থাকুন।”

“আমি বুঝে নিবো কী করবো আর কী করবো না।”

“এসব ত্যাড়ামি করে লাভ কী? উল্টো অসুখ বিসুখ বাঁধিয়ে নিজেকেই ভোগতে হবে। বুড়ো বয়সের অসুখ কিন্তু মারাত্মক।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই তেঁতে উঠলেন শাহানা। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,“বুড়ো! কে বুড়ো? কাকে বুড়ো বললে তুমি?”

“কেনো? আপনি।”

এবার যেনো অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন তিনি। শুধালেন,“কিহ! আমি বুড়ো? আমাকে দেখতে বুড়ো বুড়ো লাগে? তোমার সাহস হয় কীভাবে আমাকে বুড়ো বলার?”

“মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সী আমাকে যদি আপনি বয়স্ক মেয়েমানুষ বলতে পারেন তাহলে ষাটোর্ধ্ব আপনি তো বুড়োই হবেন, তাই না? শুধু আপনি কেনো? আপনার মেয়ে, মেয়ে জামাই, দুই ছেলে সব বুড়ো।”

কথাটি বলা শেষ করে আবারো চুলার ধারে চলে গেলো উথমী। পুত্রবধূর এহেন কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন শাহানা। রাগে রীতিমতো কাঁপছেন তিনি। তারপর কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।

সেসবে আর কর্ণপাত করল না উথমী। ভাতের মাড় গালতে গালতে মুচকি হাসলো সে।

আজ বৃহস্পতিবার। তৈমূরের কথা মোতাবেক আজই বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা উথমীর। সেই আনন্দেই তার মনটা আজ ফুরফুরে। এমনকি এই জন্য শাশুড়ির কথা তেমন একটা গায়ে লাগাচ্ছে না সে। করতে চাচ্ছে না কোনো অশান্তি। অবশ্য শাহানা তার বাপের বাড়ি যাওয়ার কথাটা ঠিকই জানেন। তৈমূর নিজেই গতকাল মাকে জানিয়েছে কথাটি। তবে এবার আর এই সামান্য বিষয়ে দ্বিমত করেননি শাহানা।

রান্নাঘরে বসে পুঁইশাক কাটছেন কেয়া বেগম। ভাতের পাতিলটা চুলা থেকে নামাতেই দুপুরের রান্নাবান্নার সমাপ্তি ঘটলো রিনিতার।পিছু ফিরে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করে বললো,“বসে বসে এখন আবার এসব কাটতে আপনাকে কে বলেছে মা? রেখে দিন। বিকেলে আমি কেটে রাতের জন্য না হয় রান্না করবো।”

“আমি করতে পারলে তোমার সমস্যা কী? সারাদিন বাচ্চা সামলে কম কাজ তো আর করো না। তার উপর আরেকটা এখন পেটে। এই সময় বেশি বেশি বিশ্রামের প্রয়োজন।”

“মাত্র মাস চারেক হলো এতেই আপনি যেমন করছেন তাতে তো মনে হচ্ছে এটাই যেনো প্রথমবার।”

“তো কী করবো? তনি হওয়ার সময় কী হয়েছে মনে নেই? এমন হেলাফেলা আর অবহেলার কারণে মরার মতো অবস্থা হয়েছিলো। ভাগ্যিস খারাপ কিছু হয়নি। আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। এবার আর আমি কোনো ধরণের ঝুঁকি নিতে চাই না। খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। যাও গোসল সেরে গিয়ে খেয়ে নাও।”

“এখন?”

“তো কখন? আর হ্যাঁ নামাজ পড়তে ভুলো না কিন্তু।”

“আজ উথমী আর তৈমূর আসবে মা।”

“জানি, তোমার শ্বশুর বলেছে।”

“আর রাতের রান্নাবান্না?”

“ও আমি আর ঊষা মিলে করে নিবো। তোমার চিন্তা করতে হবে না। যাও এখন।”

শাশুড়ির গম্ভীর একরোখা আদেশে আর সেখানে দাঁড়াতে পারলো না রিনিতা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

বিছানার মাঝখানে আড়াআড়িভাবে শুয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তনি। তার পাশেই তার গায়ে গা ঘেষে ঘুমাচ্ছে আরেকটি প্রাণ আইসক্রিম। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই ঘুম থেকে উঠে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলাই হচ্ছে এ দুটো ছানাপোনার প্রধান কাজ। সাথে লণ্ডভণ্ড করে ফেলে ঘর থেকে শুরু করে ঘরের সকল জিনিসপত্র। আর তারপর গোসল সেরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমঘুম চোখে দুয়েক লোকমা খেয়েই পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে। এ যেনো তার দৈনিক এক রুটিনের অন্তর্ভুক্ত।
________

দুপুরের রোদ কমে এসেছে। অফিস থেকে তৈমূরের বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেজে গেলো প্রায় তিনটা। নানা ধরণের চিন্তা ভাবনা মাথায় নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই তাকে সম্মুখীন হতে হলো উথমীর। তৎক্ষণাৎ সেখানেই থমকে দাঁড়ালো সে। থমথমে আহত স্বরে সাফাই দেওয়ার ভঙিতে চটজলদি বলে উঠলো, “বিশ্বাস করুন উথমী, আমি ঘড়ি দেখে একদম ঠিক সময়ে অফিস থেকে বেরিয়েছিলাম কিন্তু রাস্তায় এত্ত জ্যাম! কীভাবে বোঝাবো আপনাকে? তার উপর মাঝরাস্তায় এসেই দেখি ট্রাকের ধাক্কায় ঘটেছে বাইক এক্সিডেন্ট। পুলিশও সঙ্গে সঙ্গে আটকে দিয়েছে রাস্তা! তাই একটু দেরি হয়ে গিয়েছে।”

উথমীর মুখভঙ্গি একেবারে শান্ত। খুব স্বাভাবিক স্বরেই বললো,“ফ্রেশ হয়ে নিন। খাবার বাড়বো নাকি খেয়ে এসেছেন?”

“উহুম, খাইনি।”

“আচ্ছা, আমি তাহলে নিচে গেলাম। আপনি ফ্রেশ হয়ে চলে আসুন।”

তারপর সেখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না উথমী। নিজের কথা শেষ করে কয়েক সেকেন্ডেই বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে সেদিকে তাকালো তৈমূর। হুটহাট তার অভিমান করে, রাগ করে অগ্নিমূর্তি ধারণ করা বউটা আজ আর রাগ অভিমান করল না কেনো? ব্যাপার কী? এসব তো মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। ভাবতে ভাবতেই ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো তার।

দুপুরের ভোজনের পর থেকে শুরু করে একেবারে আছরের আগ পর্যন্ত ফুলকুঞ্জ বাড়িটি থাকে নিরব, নিস্তব্ধ। পুরোনো দিনের মতো হৈ হুল্লোড় এখন আর হয় না এ বাড়িতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কতকিছুই না বদলে গিয়েছে! যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজ সত্তায়। টেবিলে দুটো প্লেটে খাবার বেড়ে কিছুক্ষণ স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতেই তৈমূর এসে চেয়ার টেনে বসলো। স্ত্রীর পানে চেয়ে শুধালো,“আপনি এখনো খাননি?”

“না।”

“আম্মা কিছু বলেছেন?”

“না, কী বলবে?”

“ওহ।”

“আজ কী তবে যাওয়া হবে না?”

“কোথায়?”

“আমার বাবার বাড়ি।”

“কেনো হবে না? কথা তো ছিলো আজ যাবো তারপর কাজ শেষ করে রাতে ফিরে আসবো।”

“তা আর কখন যাবেন শুনি? সাড়ে তিনটের বেশি বাজে। যাওয়া আসা করতেও তো কম সময় লাগে না।”

“গাড়ি তো নিজেদের তাই যখন ইচ্ছে তখনি যাওয়া যাবে। আপনি খেয়ে গিয়ে তৈরি হয়ে নিন।”

“অফিস থেকে এলেন অথচ বিশ্রাম না নিয়ে এখন শ্বশুরবাড়ি ছুটবেন? তখন তো আবার আপনার মা আমায় এসে দোষারোপ করবে।”

থতমত খেয়ে গেলো তৈমূর। আমতা আমতা করে বললো,“তা অবশ্য নেওয়া উচিত কিন্তু সমস্যা নেই। আপনি খেয়েদেয়ে গিয়ে তৈরি হয়ে নিন।”

ভালো কথায় কাজ দিলো না। বরং চটে গেলো উথমী। চোয়াল শক্ত করে বললো,“মনে এক অথচ মুখে আরেক এমন দ্বারার মানুষদের আমি একদম সহ্য করতে পারি না। যাবেন না তা সোজাসাপ্টা বলে দিলেই হয়। এতো বাহানা দিতে হবে কেনো? আর যে কথা রাখতে পারবেন না সেকথাই বা দিতে আসেন কেনো?”

স্ত্রীর কথায় রাগের আভাস পেলো তৈমূর। আমতা আমতা করে বললো,“আমি আবার না করলাম কখন? বলেছি তো যাবো।”

“আর প্রয়োজন নেই। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি, আমরা যাবো না। আপনি নিশ্চিন্তে খেয়ে গিয়ে বিশ্রাম করুন। ভেতরে ইচ্ছে থাকলে সবই করা যায়। আর ইচ্ছে না থাকলে কিছুই করা যায় না। রাস্তায় যে কেমন জ্যাম তা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। সব বাহানা।”—-কথাগুলো বলা শেষ করে নিজের খাবারের প্লেট নিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো উথমী। বড়ো বড়ো কদম ফেলে চলে এলো অন্দরমহলে। একপর্যায়ে সোফায় বসেই খেতে আরম্ভ করল সে।

তার এহেন কাজে ভড়কে গেলো তৈমূর।গলায় আটকে গেলো খাবার। ঢকঢক করে গ্লাসের পানি শেষ করে গলার স্বর নামিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল,“এই মেয়ে এমন কেনো? এর এতো রাগ আসে কোত্থেকে? আমি কী ইচ্ছে করে দেরি করে এসেছি? নাকি না যাওয়ার জন্য অযুহাত তৈরি করেছি?”

কিন্তু প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজে পেলো না তৈমূর। উদাস হয়ে খাবার খেয়ে উঠে চলে গেলো ঘরে। উথমী এলো তার ঠিক পাক্কা দশ মিনিট পর। খোঁপা করা চুলগুলো খুলে পিঠ জুড়ে ছেড়ে দিলো। ড্রেসিং টেবিলের উপরে অযত্নে পড়ে থাকা লো চার্জের মোবাইলটা হাতে নিতেই স্ক্রীনে দেখতে পেলো ভাবী নামে সেভ করা নাম্বার থেকে আসা মিসড্ কল। তখনি কল ব্যাক করল সে। সাথে সাথে রিসিভ হয়ে অপরপাশ থেকে ভেসে এলো রিনিতার কণ্ঠস্বর,“কতবার কল দিলাম তোমায়? ধরলে না কেনো?”

“শুনিনি, মোবাইল সাইলেন্ট ছিলো।”

“ওহ, তা রওনা দিয়েছো তোমরা? এখন কোথায় আছো?”

“বাড়িতে।”

“বাড়িতে? এখনো? তাহলে বেরোবে কখন?”

“আজ আর আসছি না ভাবী।”

“সে কি? আসছো না মানে? আজই তো তোমাদের আসার কথা ছিলো।”

“ছিলো তবে আসছি না। ওগুলো তুমি গুছিয়ে আমার আলমারিতে লক করে রেখে দিও। যেদিন আসতে পারবো সেদিন নিয়ে আসবো। আচ্ছা রাখি তবে। মাকে জানিয়ে দিও।”

রিনিতাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো উথমী।এতক্ষণ চুপচাপ স্ত্রীর ফোনালাপ শুনছিল তৈমূর। এবার যেনো ভারি অবাক হলো সে। বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এটা কী হলো? আপনি না তখন বললেন, বাড়িতে নাকি বলে দিয়েছেন যাবেন না। তাহলে?”

মোবাইলটা চার্জে বসালো উথমী। স্বামীর পানে ফিরে তাকালো না একবারও। জবাবে‌ বললো,“হুম, তো?”

“তো মানে? আপনি আমায় মিথ্যে বলেছেন। আগে জানিয়েছেন বললেও সত্যি সত্যি তো এইমাত্র বাড়িতে না যাওয়ার কথা জানালেন।”

“সেসব আমার ব্যাপার। আপনাকে কেউ শুনতে বলেছে?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈমূর। মিনমিনে গলায় বলে,“অযথা সামান্য কারণে রেগে যাওয়া, ত্যাড়ামি করা কী আপনি বংশানুক্রমে পেয়েছেন? আমার অর্ধেক জীবন তো গেলো লেখাপড়া আর ভালো চাকরি জোগাড় করতে করতে। বাকি অর্ধেক তো দেখছি আপনার রাগ সহ্য করতে করতেই চলে যাবে। কী হবে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের?”

“কিছুই হবে না। আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনার আর আপনার মায়ের স্বভাব নিয়েই জন্মাবে। তারপর তাদের জীবনসঙ্গী আর পুত্রবধূর হাড় মাংস জ্বালিয়ে খাবে।”

রাগে গজগজ করতে করতে বারান্দায় গিয়ে বসলো সে। বিয়ের পর থেকে যেনো উথমীর নিকট সবকিছুই অসহ্য লাগছে। বিশেষ করে অসহ্য লাগছে চরম এই অভদ্র লোকটিকে।

তনির যখন ঘুম ভেঙেছে তখন সময় বিকেল চারটা। ঘুম থেকে জেগেই ড্রয়িং রুমের বিভিন্ন জায়গায় খেলনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে খেলনা ঘোড়ায় চেপে বসে আছে সে। দাদী কেয়া মেঝেতে বসে রূপকথার গল্প শোনাতে শোনাতে তাকে‌ খাইয়ে দিচ্ছে খাবার। রিনিতা তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সোফায় বসলো। শাশুড়ির উদ্দেশ্যে চাপা স্বরে বললো, “উথমীরা আজ আর আসছে না মা।”

“সে কী? কেনো?”

“জানি না। জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু কারণটা আর জানায়নি।”

“এটা আবার কেমন কথা? আসবে বললো আবার এখন বলছে আসবে না? কী হলো মেয়েটার? আমার সাথে তো বিয়ের পর থেকে তেমন একটা কথাও বলে না। যা কথা আছে সব শুধু তোমাদের সাথে।”

“আমাদের সাথেও নিজ থেকে বলে না মা। আমরাই বারবার ফোন করে খোঁজ নেই। আর আপনি তো বাড়িতে থাকতেও কখনো ওর খোঁজ নেননি। আমি অন্তত এতো বছরেও তা দেখিনি।”

কথাটা শুনতেই থমথমে হয়ে গেলো কেয়ার মুখশ্রী।পুত্রবধূর পানে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে নাতনিকে অবশিষ্ট লোকমাটা খাইয়ে উঠে চলে গেলেন রান্নাঘরে।
__________

দিনের আলো বিলীন হয়ে ধরণীতে সন্ধ্যে নামার প্রস্তুতি চলছে।সূর্যি মামা পশ্চিমাকাশে ডুব দিয়েছে তার মিনিট দশেক আগে। ধীরে ধীরে ছাই রঙা অম্বরে মেঘের ভেলা সরে গিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে চাঁদের অস্তিত্ব। চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো উথমী। বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে প্রবেশ করল কক্ষে। তারপর বিছানায় দৃষ্টি যেতেই পানসে হয়ে এলো তার মুখ। সাথে ভাঁজ পড়ল ললাটে।

তৈমূর বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে মোটা একটি ইংরেজি উপন্যাসের বই পড়তে ব্যস্ত। আশেপাশে যেনো কোনো খেয়াল নেই তার। আর তার এই দশা দেখেই বিরক্তবোধ করল উথমী। মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে উদ্ধার করল তার গোষ্ঠী। মাথায় ঘোমটা টেনে দরজার পথে পা বাড়ালো। তখনি পেছন থেকে ডাক এলো,“উথমী!”

শুনেও না শোনার ভান ধরে নিজের মতোই এগিয়ে যেতে থাকলো উথমী। তৈমূর পুনরায় জিজ্ঞেস করল, “যাচ্ছেন কোথায়?”

এবার সে থামলো। গরম তেলের উপর পানি পড়লে যেমন ছ্যাৎ করে ওঠে ঠিক তেমনভাবেই সেও ছ্যাৎ করে উত্তর দিলো,“জাহান্নামে।”

মুচকি হাসলো তৈমূর। দুষ্টুমির ছলে বললো,“আচ্ছা যাওয়ার আগে আমায় এক কাপ চা দিয়ে যেয়েন তো। এক্সট্রা মিল্ক, উইদাউট সুগার।”

মুখশ্রীর ভাবভঙ্গি মুহূর্তেই বদলে গেলো উথমীর। এবার ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। এই লোকটা ঠিক কোন ধাঁচের মানুষ কিছুতেই যেনো বুঝতে পারছে না সে। কিন্তু তৈমূরের সেসবে খেয়াল নেই। তার দৃষ্টি পূর্বের মতোই নিজের হাতের মস্তবড়ো বইয়ের মধ্যে নিবদ্ধ। তাতেই যেনো রাগটা তড়তড় করে বৃদ্ধি পেলো উথমীর। আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।

চলবে _________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৫]

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আলাদাই একটা উৎসব উৎসব ভাব থাকে। অন্যসব দিনের তুলনায় শুক্রবারে বাড়িতে পড়ে রান্নার হিরিক। তবে আজকের এই দিনটিতে এসে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেলো উথমীর। ঘড়ির কাঁটায় তখন কড়ায় কড়ায় আটটা বেজে বত্রিশ মিনিট।সূর্যের কড়া রোদ এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। এতেই যেনো মনে মনে নিজের প্রতি বেশ ক্ষুব্ধ হলো উথমী। তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে ছুটে এলো রন্ধনশালায়। শাহানা তখন চুলার আঁচে দাঁড়িয়ে ডিম বাজছেন। আর সেই ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। অন্যদিকে মালতী ফুফু কাটছেন লেবু আর শসা। ছোটো বধূর উপস্থিতি টের পেতেই তিনি মুচকি হেসে বলে উঠলেন,“ওই তো বউমা আইসা পড়ছে। তা আইজকা ঘুম থাইক্কা উঠতে বুঝি দেরি হইয়া গেছে?”

কথাটিতে খানিকটা লজ্জা পেলো উথমী। মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো,“হ্যাঁ আসলে জাগনা পাইনি। রান্নাবান্না শেষ হয়ে গিয়েছে?”

তৎক্ষণাৎ কড়াইয়ে দৃষ্টি রেখেই রুষ্ট কণ্ঠে শাহানা উত্তর দিলেন,“তো কী তোমার অপেক্ষায় চুলা বন্ধ করে বসে থাকবো? বয়স বাড়তে পারে কিন্তু শরীরের জোর এখনো কমেনি। জোয়ান কালেও বিশ পঁচিশ জনের রান্না একাই করতে পেরেছি এমনকি এখনো পারি।”

শাশুড়ির কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়া রাগের আভাস সহসাই টের পেলো উথমী। আমতা আমতা করে বললো, “আমি তবে টেবিলে নিয়ে যাই সব। খাবার বেড়ে ফেলি।”

বলা শেষ করে ঘুরে সেদিকে পা বাড়ালো সে। পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন শাহানা,“কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই তোমার? একেই তো ঘুম থেকে দেরি করে উঠেছো তার উপর গোসল না করে হেঁশেলেও ঢুকে পড়েছো। এখন আবার খাবার জিনিস ছুঁবে?”

“সকাল সকাল গোসল করতে যাবো কেনো? আমি তো হাতমুখ ধুয়েই এসেছি। প্রতিদিন তো গোসল না করেই নাস্তা দেই আপনাদের।”

“লজ্জা শরমের কোনো বালাই নেই। নির্লজ্জ মেয়ে মানুষ। বয়স তো কম হলো না তবুও ফরজ গোসল সম্পর্কে জানে না। এখন কী আমি ভেঙে ভেঙে সব বুঝিয়ে দিবো তোমায়? অসভ্য।”

শাহানার কথার অর্থদ্বার বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো উথমীর। বোঝার সাথে সাথেই যেনো শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠলো তার। লজ্জায় নত হলো দৃষ্টি। খুক খুক করে দুবার কেশে আসছি বলেই স্থান ত্যাগ করে কক্ষের পথে হাঁটা ধরলো। মালতী ফুফু কাটাকাটি শেষে বঁটিটা ধুয়ে রাখলেন। টেবিলের পথে যেতে যেতে মুখ ভার করে বললেন,“আপনে না অযথাই বউডারে বকলেন মেজো ভাবী।”

প্রত্যুত্তর করলেন না শাহানা। এই ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে চান না তিনি। এমনিতেই শরীরটা রাগে জ্বলে যাচ্ছে উনার।

ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই লজ্জাটা রাগে পরিণত হলো উথমীর। সময় নিয়ে গোসল সেরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। চুল শুকাতে শুকাতে বিড়বিড় করল,“এ কি এক হারে বজ্জাত শাশুড়ি আমার কপালে রাখলে আল্লাহ? এই মহিলার মুখে কী কিচ্ছু আটকায় না? এভাবে সাতসকালে কেউ কী নিজের ছেলের বউয়ের সাথে এমন আচরণ করে? কোনো ভালো মানুষ যে অন্তত এমনটা করে তা আমার জানা নেই।”

“কেমন করে? কে আবার কী করল?”

প্রশ্নটি শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই থতমত খেয়ে গেলো উথমী। হেয়ার ড্রায়ার সমেত থেমে গেলো তার হাতটি। তৈমূর পকেট থেকে টুপিটা বের করে রাখলো টেবিলের উপর। পরনের পাঞ্জাবি বদলে টি শার্ট গায়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল,“কী ব্যাপার এই সাতসকালে গোসল করলেন যে?”

প্রশ্নটি খুব নিখুঁতভাবে এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো উথমী,“আপনি আজ আমায় ডাকলেন না কেনো?”

“ডেকেছি কিন্তু ওঠেননি।”

“উঠিনি?”

“হ্যাঁ ওঠেননি, তাছাড়া আমারও আজ উঠতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাহাজ্জুদ মিস করেছি। ফজরের আজানে ঘুম ভেঙেছে। আপনাকে অনেকবার ডাকাডাকি করার পরেও আপনি আর ওঠেননি।”

“তাই বলে হার মেনে নিবেন? আমি মানছি আমি একটু অলস, সহজে কারো ডাকে ঘুম থেকে উঠি না তাই বলে আপনার হার মেনে নেওয়া একদম চলবে না তৈমূর সাহেব।”

“আচ্ছা? তারপর?”

“ডাকাডাকিতে কাজ না হলে পানি ছিটাবেন।”

“ঘুমন্ত বউয়ের মুখে পানি ছিটাবো? এমন অন্যায় কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নয় উথমী। তবে অন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি।”

“অন্য পদ্ধতি?”

“হুম।”

“যেমন?”

“আদর, সোহাগ।”

“কিহ!”

“বড়ো বড়ো লেখকদের উপন্যাসে পড়েছি, বউ হচ্ছে তুলোর মতো নরম এবং ফুলের মতো সুন্দর। এদের বশে আনতে হলে, ঘুম ভাঙাতে হলে, কাজ করাতে হলে আদরের থেকে বড়ো কোনো ওষুধ আর নেই।”

“আপনি আর আপনার বই দুটোই অকাজের।”

“অকাজের? আমি?”

“হ্যাঁ। ঝগড়াঝাঁটি বন্ধ করে খেতে আসুন।”

“আমি ঝগড়াঝাঁটি করছি?”

কথার বিপরীতে উথমী চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই হেসে ফেললো তৈমূর। হাতের সাহায্যে চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

খাবার নিয়ে পুত্রের অপেক্ষায় টেবিলে বসে আছেন শাহানা। সাথে কারো সঙ্গে উচ্চস্বরে আহ্লাদী হয়ে গল্প করছেন। খাবার ঘরে এসে বড়ো বোনকে দেখে কিছুটা চমকালো তৈমূর। শুধালো,“তুমি আবার কখন এলে বুবু?”

খেতে খেতেই উত্তর দিলো তিথিয়া,“এইতো এলাম যে মিনিট পাঁচেক হয়েছে। আম্মার হাতের রান্না খিচুড়ির গন্ধে আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে খেতে বসে পড়লাম।”

“তা দুলাভাই, ওরি মিলি ওরা কোথায়?”

“তোর দুলাভাই দোকানে। একেবারে দোকান বন্ধ করে জুম্মার নামাজ পড়ে তারপর আসবে। আর ওরি মিলি ওরা ঘরে গিয়েছে।”

“থাকবে তো কয়েকদিন?”

“দেখি, আম্মার কথা মনে পড়ছিল তাই চলে এলাম।”

উথমী দাঁড়িয়ে শুনছিল সেসব কথা। শাহানা গম্ভীর কণ্ঠে তার উদ্দেশ্যে বললেন,“দাঁড়িয়ে থেকো না। তুমিও খেতে বসো পড়ো।”

শাশুড়ির আদেশ অমান্য করল না উথমী। তৈমূরের পাশের চেয়ারটিতে বসে পড়ল। তিথিয়ার যেনো মোটেও ভালো লাগলো না এই দৃশ্যটি। ভেতরে ভেতরে চরম ঈর্ষান্বিত হলো সে।

তৈমূর খাবার খেতে খেতে মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলে উঠলো,“কতদিন পর আপনার রান্না করা খিচুড়ি, ডিম ভাজি খাচ্ছি আম্মা! এখনো সেই পুরোনো স্বাদ। এই রান্নার কাছে রেস্তোরাঁর বড়ো বড়ো শেফদের রান্নাও তুচ্ছ।”

সকলের সামনে পুত্রের নিকট থেকে প্রশংসা পেয়ে আনন্দিত, পুলকিত হয়ে উঠলো শাহানার মন।যার রেশ উনার মুখশ্রীতেও ফোটে উঠলো সহাস্যে। আরেক চামচ প্লেটে দিতে দিতে বললেন,“আমি তো আরো ভয়ে ভয়ে ছিলাম, কোনো ভুল না হয়ে যায় আবার। তোর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তো আর রান্নাবান্না তেমন একটা করাই হয়না। যা একটু চা টাই শুধু বানাতাম।”

“কী যে বলেন না আম্মা? আপনার হাতে জাদু আছে। খুন্তি ছুঁয়ে দিলেই তা সুস্বাদু হয়ে যাবে।”

“পাজি ছেলে। খা চুপ করে।”—লাজুক কণ্ঠে বললেন তিনি।

কিন্তু তৈমূর মোটেও থামলো না। কথার ফাঁকেই বলে উঠলো,“আপনার রান্না ছাড়া আমার পেট ভরলেও মন কখনো ভরে না আম্মা। খেয়েও তৃপ্তি পাই না। উথমীকেও আপনার রেসিপিগুলো একটু শিখিয়ে দিয়েন তো। আমার জন্য ভালো হয়। রোজ রোজ তবে এমন সুস্বাদু রান্না খেতে পারতাম।”

বাক্যগুলো শ্রবণাতীত হতেই অধরের হাসি মিলিয়ে গেলো মা-মেয়ের। গলা ঝাড়লেন শাহানা। মুখখানা গম্ভীর করলেও পুত্রবধূর সামনে ছেলের এমন প্রশংসা আর নির্দ্বিধায় বলা কথাগুলো উনার ভেতরের গর্ববোধ বাড়িয়ে দিলো। এদিক দিয়েই তো উনার জয়। যেখানে বড়ো পুত্র কখনোই স্ত্রীর সম্মুখে মায়ের প্রশংসা করতে পারেনি সেখানে ছোটো ছেলে তা করে দেখিয়েছে। বাঁকা চাহনিতে উথমীর পানে তাকিয়ে পুত্রের উদ্দেশ্যে বললেন,“তোর বউয়ের কী আর আমার রান্না ভালো লাগবে?”

কথাটা শুনে খাওয়া থামিয়ে শাশুড়ির মুখশ্রীতে দৃষ্টি স্থির করে উথমী। তৎক্ষণাৎ টেবিলের নিচ দিয়ে তৈমূর তাকে কনুই দিয়ে গুঁতা মারতেই সে অপ্রস্তুত হেসে বলে ওঠে,“ভালো লাগবে না কেনো? এতো সুস্বাদু রান্না কারো ভালো না লেগে কী আর পারে? আপনার আপত্তি না থাকলে আমি শিখতেই পারি।”

সন্তুষ্ট হলেন শাহানা। মাথা নাড়িয়ে বললেন,“ঠিক আছে তবে শেখানো যায়।”

মায়ের সন্তুষ্টিতে খুশি হলো তৈমূর। কিন্তু খুশি হতে পারলো না তিথিয়া। রুক্ষ স্বরে বললো,“এই বয়সে তোর বউকে আম্মা রান্না শেখাবে? তোর কাণ্ডজ্ঞান কী লোপ পেয়েছে তৈমূ? তোর বউ বাপের বাড়ি থেকে রান্নাবান্না শিখে আসেনি?”

“শেখালে সমস্যা কী? আম্মার তো কোনো অসুবিধে নেই। তাছাড়া বাপের বাড়ির শিক্ষা বাপের বাড়িতে। আর শ্বশুরবাড়ির শিক্ষা শ্বশুরবাড়িতে। ঠিক বলেছি না আম্মা?”

শাহানা মাথা নাড়ান। মেয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,“ঠিক বলেছে তৈমূ।”

ছেলের কথায় সায় জানানোতে রাগে ক্ষোভে জর্জরিত হয়ে উঠলো তিথিয়া। চুপচাপ গিলতে লাগলো খাবার।কিছুক্ষণ পর সেখানে এসে উপস্থিত হলো ওরি আর মিলিও। মুহূর্তেই যেনো গমগমে পরিবেশটা উল্লসিত হয়ে উঠলো।
__________

খাবার খেয়ে টেবিল গুছিয়ে ঘরে এসে আলমারি থেকে নতুন বিছানার চাদর বের করল উথমী। পুরোনোটা বদলানোর জন্য লেগে পড়ল কাজে। তৈমূর ঘরে এসে স্ত্রীকে কাজটি করতে দেখে শুধালো, “চাদর বদলাচ্ছেন কেনো? এটা তো নতুন চাদর‌।”

“নতুন চাদর? কিন্তু আমি এসে থেকে তো এই চাদরটাই বিছানায় দেখছি।”

“তো? আপনি এসেছেন যে মাসও তো পেরোয়নি।”

“পেরোতে আর বাকিও নেই? তাছাড়া মালতী ফুফুই বললেন এগুলো নিয়ে যেতে। উনি নাকি আজ সব ঘর পরিষ্কার করবেন আর বিছানা চাদর, বালিশ কভারও ধুয়ে দিবেন।”

ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলে বুকশেলফ থেকে একটা বই নিয়ে আবারো চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় তৈমূর। তৎক্ষণাৎ উথমী কাজ করতে করতে তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে,“আপনার বড়ো বোন কী বেশিরভাগ সময় এ বাড়িতেই পড়ে থাকে?”

ললাটে ভাঁজ পড়ে তৈমূরের। পাল্টা প্রশ্ন করে,“এ বাড়িতে পড়ে থাকে মানে?”

কিছুটা অপ্রস্তুত হলো উথমী। আমতা আমতা করে বললো,“আসলে বোঝাতে চেয়েছি এখানেই থাকেন নাকি? কদিন আগেই না চলে গেলেন তাহলে আবার এলেন যে?”

“বুবু আম্মাকে খুব ভালোবাসে। উনাকে ছাড়া বেশিদিন থাকতে পারে না তাই যখন ইচ্ছে হয় চলে আসে আবার যখন ইচ্ছে হয় চলে যায়।”

“ওহ, তা বাচ্চাদের লেখাপড়ায় সমস্যা হয় না? আর আপনার দুলাভাই? উনার খাওয়া দাওয়ায়?”

“না, বাড়িতে কাজের লোক রয়েছে। দুলাভাইয়ের বাড়িও তেমন একটা দূরে নয়। এই ধরুন আধ ঘণ্টার পথ। আর ওরি মিলি নিজেদের কাজ নিজেরাই করতে পারে। ওদের স্কুলও বাড়ির কাছাকাছি।”

“তার মানে আপার বিয়ে তো কাছাকাছিই হয়েছে, তাই না?”—–আগ্ৰহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

তৈমূর আর গেলো না। দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে চেয়ারে বসলো। বললো,“না। বুবুর শ্বশুরবাড়ি মাওনা। তাদের ছিলো যৌথ পরিবার। ওখানেই সবার বাস।”

“তাহলে? আলাদা থাকে?”

“হ্যাঁ, বুবুর বিয়ে হয়েছিল কৈশোরে। তখন মনে হয় সে নবম শ্রেণীতে পড়ে। বিয়ের এক বছরের মাথায় আম্মার জোরাজুরিতে আর না পেরে বাবা নিজেই বুবুর জন্য কাছাকাছি একটা প্লট কিনেন।তারপর ওখানকার কাজকর্ম হয়ে যাওয়ার পর দুলাভাই আর বুবু মাওনা থেকে শিফট করে ওই ফ্ল্যাটে। আর তখন থেকে ওখানেই তাদের বসবাস। একসময় দুলাভাইও চাকরি বাকরি ছেড়ে শুরু করেন রেস্তোরাঁর ব্যবসা। এখন অবশ্য সেই ব্যবসা বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে।”

“উনার শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ, দেবর কেউ ছিলো না?”

“ছিলো তবে মিলির জন্মের আগেই দুলাভাইয়ের বাবা-মা মারা গেছেন। আর ননদ, দেবরদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা এখন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়া তাদের সাথে আর তেমন একটা দেখা হয় না।”

চাদর বিছিয়ে আয়েশ করে বসলো উথমী। কিছু একটা মুখ ফসকে বের হতে গিয়েও হলো না। জোরপূর্বক নিজেকে দমিয়ে রেখে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো। পুনরায় শুধালো,“আপনাদের ভাই- বোনদের মধ্যকার বয়সের পার্থক্য অনেক তাই না?”

“অনেক বলতে?”

“না মানে আমার ভাইয়া আর আমার বয়সের পার্থক্য ছয় আবার আমার আর ঊষার বয়সের পার্থক্য তিন। কিন্তু আপনার আর আপার বয়সটা মিলছে না।”

দম ছাড়ে তৈমূর। স্লান হেসে বলে,“আমি হচ্ছি আমার বাবা-মায়ের শেষ বয়সের সন্তান।বলেছিলাম না আমার আম্মার বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে?তখনকার মেয়েদের তাড়াতাড়িই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। আর বিয়ের বছর দুয়েক পরেই আমার বুবুর জন্ম। তখন আম্মার বয়স হবে হয়তো পনেরো, ষোলো। তারপর বুবুর জন্মের ঠিক বারো বছর পর জন্ম হয় আমার ভাইয়ের। এর চার বছর পর আবার আমার জন্ম।”

ভীষণ অবাক হয় উথমী। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলে,“তার মানে আপনার আর আপার বয়সের পার্থক্য ষোলো!”

“ক্যালকুলেশন তো তাই বলছে।”

“তাহলে উনার বিয়ে তো আপনার জন্মের আগে হয়েছে।”

“না, জন্মের পর হয়েছে।”

“কীভাবে? নবম শ্রেণীতে থাকতে বিয়ে হলে তো চৌদ্দ পনেরোতে হওয়ার কথা।”

“বুবু লেখাপড়ায় তেমন একটা ভালো ছিলো না। বলতে গেলে ফাঁকিবাজ ছিলো।কোন ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় যেনো দু বার ফেইল করেছিলো।”

“ওহ, তাহলে ওরি মিলি এতো ছোটো কেনো?”

স্ত্রীর এতশত প্রশ্ন হেসে ফেললো তৈমূর। বললো, “একের পর এক উদ্ভট সব প্রশ্ন আপনার ঠোঁটের আগায় থাকেই তাই না?”

“তো? আমি জানতে চাইবো না?”

“বুবুর বিয়ের তিন বছরের মাথায় একটা ছেলে সন্তান হয়েছিল কিন্তু সেই ছেলে জন্মেছিল হার্টের সমস্যা নিয়ে। চিকিৎসা চলছিল কিন্তু শেষমেশ আর তাকে বাঁচানো যায়নি। পাঁচ বছর বয়সেই মারা যায় সে। সেই শোকে ধীরে ধীরে বুবুর অবস্থা খুবই খারাপ হয়। খারাপ বলতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। চোখের সামনে সন্তানের মৃত্যু কতটা কষ্টদায়ক ভাবুন তো? এরপর বাবা তাকে বাড়িতে এনে কত বড়ো বড়ো ডাক্তার দেখিয়ে, চিকিৎসা করিয়ে যে ঠিক করেছেন! আর তার বেশ কয়েক বছর পর শূন্য কোল আলো করে পৃথিবীতে আসে ওরি। ওরির এই আগমনেই যেনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে বুবু। আর তার সাড়ে পাঁচ বছর পর আসে মিলি। তার উপর বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান বুবু। বুবুর জন্মের প্রথম বারো বছর পর্যন্ত সেই বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলো। তাই বাবা, আম্মা বুবুকে একটু বেশিই ভালোবাসেন। আর ওই ঘটনার পর থেকে তো আম্মা একটু বেশিই গুরুত্ব দেন।”

কথাগুলো শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে ওঠে উথমী। ঢকঢক করে গ্লাসের পানিটুকু খেয়ে বলে,“এতো হিস্ট্রি? আমার তো মাথা পুরো আউলাঝাউলা হয়ে গিয়েছে তৈমূর সাহেব।”

“এতোটুকুতেই? পুরো পরিবার সম্পর্কে জানলে তো তবে আধ পাগল হয়ে যাবেন।”—বলেই হাসে তৈমূর।

চোখ রাঙিয়ে তাকায় উথমী। পুনরায় বলে,“একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন আপনি?”

“কোন ব্যাপার?”

“আপনার বোনও কিন্তু নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে সংসার করতে পারেনি। বরং তাদের রেখে বিয়ের পরপরই স্বামীকে নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আর আপনার বাবা-মাও এতে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করেছিল তাকে। অথচ আপনার সেই মা এখন আর আপনার ভাবীকে সহ্য করতে পারেন না। কেনো বলুন তো? শুধুমাত্র উনি উনার স্বামীকে নিয়ে আলাদা থাকেন বলে? এদিকে বিয়ের পর বাবার বাড়িতে গিয়ে দুদিনও আমি থাকতে পারিনি কিন্তু আপনার বোন তার স্বামী সন্তান ফেলে, নিজের দায়িত্ব পালন না করে যখন তখন এখানে এসে থাকতে পারে। কেনো থাকে? মায়ের কথা মনে পড়ে বলে? কী এক সমাজে বাস করি আমরা, তাই না? যেখানে নিজের মেয়ে যা করবে সব ঠিক আর ছেলের বউয়ের হাঁটায় চলায়ও দোষ? শাশুড়ির মেয়েরই একমাত্র বাবা-মা আর বাপের বাড়ি আছে কিন্তু আমাদের তা নেই? মেয়ে জামাই বউয়ের আবদার মেটালে সুপুরুষ আর ছেলে তার বউয়ের আবদার পূরণ করলে কাপুরুষ, অবাধ্য, বউ ভক্ত? সমাজের এসব আজেবাজে নিয়ম বদলানো উচিত। মানুষের চিন্তাধারা বদলানো উচিত। তারও আগে বদলানো উচিত মা ভক্ত কাপুরুষদের। তাহলেই সমাজে শৃঙ্খলা ফিরবে। পারিবারিক অশান্তি কমবে।”

কঠোর গলায় কথাগুলো বলে তুলে রাখা চাদর আর বালিশের কভারগুলো নিয়ে চলে গেলো উথমী। কিন্তু তৈমূর ঠাঁয় বসে রইলো নিজ স্থানে। কথাগুলো পূর্বে কখনোই তার মাথায় আসেনি। কখনো ভাবার প্রয়োজন মনে করেনি। তবে স্ত্রীর থেকে শুনে টনক নড়ে উঠলো তার। ভাবতে বসলো সেসব নিয়ে।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)