জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-৩০+৩১

0
202

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩০]

হাসপাতালের ঝকঝকে সাদা বিছানায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে আছে একটি যুবতী মেয়ে। হাতে-পায়ে, কপালে তার ব্যান্ডেজ করা। বিছানার পাশে দাঁড়ানো লম্বা একটি স্টেনে ঝুলছে স্যালাইন। মুখের উপর অজস্র নখের আঁচড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন আঘাতের দাগও স্পষ্ট, সাথে কপালের ব্যান্ডেজের উপর ভেসে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। ফর্সা গলায় পাঁচ আঙুলের কালসিটে দাগটাও প্রথম দর্শনেই খুব ভালো করে চোখে পড়ছে। কোমল ঠোঁট দুটোর অবস্থাও একদম বিচ্ছিরি। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, কেউ জানোয়ারের মতো খুবলে খেয়েছে।

মেয়ের এমন করুণ, মুমুর্ষু অবস্থা কষ্মিনকালেও ভাবনাতে আনতে পারেননি যেই পিতা, সেই পিতাই সামনাসামনি এমন বিভৎস রূপ দেখে সেখানেই মূর্ছা গেলেন। তৎক্ষণাৎ ওয়ার্ড বয়কে ডেকে এনে ফাঁকা একটি কেবিনে বাবাকে নিয়ে শুইয়ে দেয় উৎস। ডেকে আনে ডাক্তার।

জ্ঞানহীন বাবার পানে একপলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উৎস। নিঃশব্দে কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে বসলো একটি চেয়ারে। আরেকবার যে বোনকে গিয়ে দেখে আসবে সেই সাহসটাও তার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। তাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন মধ্য বয়সী ওসি। পাশে এসে বসলেন। উনার উপস্থিতি টের পেয়ে একপলক উনার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো উৎস। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কোথায় পেলেন ওকে? এমন অবস্থাই বা কেমন করে হলো? কে করলো জানোয়ারের মতো এমন নিকৃষ্ট কাজ?”

“রেললাইনের ধারে বস্তাবন্দি করে কেউ ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। সর্বপ্রথম কোনো এক টুকাইয়ের নজরে সেই বস্তাটা পড়ে। তারপর সেই ছেলেই বস্তা খুলে অজ্ঞাত মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে আশেপাশের লোক জড়ো করে। এলাকাবাসী প্রথমে ভেবেছিল হয়তো মারা গিয়েছে তাই তৎক্ষণাৎ তারা আমাদের খবর দেয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি অবস্থা খুবই মর্মান্তিক। পরনে পোশাকের কোনো ছিটেফোঁটাও ছিলো না। আমাদের মহিলা কনস্টেবল চেক করে নিশ্চিত হন যে মেয়েটি তখনো জীবিত তাই আর দেরি না করে নিকটস্থ হাসপাতালে এনে ভর্তি করাই। ওখানে একদিন রেখে পরেরদিনই ওখানকার ডাক্তার ট্রান্সফার করে দেন এই বড়ো হাসপাতালে। এর তিনদিন পর অর্থাৎ গতকাল দুপুরে উনার জ্ঞান ফিরে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর কোনোমতে নাম আর ফোন নাম্বারটা জানতে পেরেই আপনাদের আজ খবর দিয়েছি।”

ওসি থামেন। আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে ক্ষীণ স্বরে ফের বলেন,“মেয়েটিকে একটানা রেপ করা হয়েছে। গ্যাং রেপ। প্রাণে মেরে ফেলার জন্য ভারি বস্তু দিয়ে মাথায় আঘাত করে গলাও টেপা হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে শেষ পর্যন্ত বেঁচে গিয়েছে। তারচেয়ে বড়ো কথা বাড়ির মেয়ে উধাও আর আপনারা তাকে খোঁজার চেষ্টা পর্যন্ত করেননি?”

ভয়াবহ কথাগুলো শুনে চমকে উঠলো উৎস। কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম আঙুলের সাহায্যে মুছে বললো, “নিখোঁজের তিন সপ্তাহ চলছে অফিসার। বাড়ি থেকে সবকিছু নিয়ে পালিয়ে এসেছে। সেদিনই সমস্ত জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে শেষমেশ থানা থেকে পর্যন্ত ঘুরে এসেছি কিন্তু পুলিশ কেস ফাইল করেছে তার ঠিক পরেরদিন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আর না পেয়ে পুলিশ নিজেরাই কেস ক্লোজড করে দেয়। এরপর আমাদের আর কী করার থাকে বলুন তো?”

মনটা খারাপ হয়ে গেলো ভদ্রলোকের। দুঃখ নিয়ে বললেন,“আমরা ওই থানার ওসির সঙ্গে তবে কথা বলছি। আপনারা গিয়ে জোরালো একটা মামলা দায়ের করে দিয়ে আসবেন। এভাবে তো আর অপরাধীদের পার পেয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েটি আদৌ বাঁচবে কিনা, বাঁচলেও সুস্থ হবে কিনা তাও তো নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না।”

প্রত্যুত্তর করে না উৎস।মেঝের দিকে একদৃষ্টিতে নিরবে তাকিয়ে থাকে। তার নিরবতায় পুলিশ আর বসে থাকে না সেখানে। তারাও ত্যাগ করে স্থানটি। তার কয়েক মিনিট বাদে সেখানে এসে উপস্থিত হয় একজন নার্স। গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,“দু’শো তিন নম্বর কেবিনের পেশেন্ট আপনার কী হয়?”

প্রশ্নটি শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় উৎস। উদ্বিগ্ন হয়ে উত্তর দেয়,“আমার বাবা।”

“উনার জ্ঞান ফিরেছে। আপনি একবার ডাক্তারের সঙ্গে গিয়ে কথা বলে আসুন। চাইলে আজই উনাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন।”

নিজের কথা শেষে অন্য কেবিনের দিকে চলে গেলো নার্সটি। উৎস আর সেখানে দাঁড়ালো না। সর্বপ্রথম গেলো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। এই মুহূর্তে বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার নেই। আগে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবে তারপর না হয় আজকের মতো বাড়ি ফিরে যাবে।

আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত হাতে চুলে বেনুনী করছে উথমী। ঘরে প্রবেশ করে দরজা আটকে আশেপাশে তাকাতেই তৈমূরের দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো তার পানে। বড়ো চাচীর মৃত্যু থেকে শুরু করে পারিবারিক বিভিন্ন বিভ্রাটের কারণে মেয়েটির সঙ্গে ভালো করে দুটো কথা বলারই ফুসরত পাচ্ছিল না সে। তবে আজ সন্ধ্যা থেকেই তার মনটা বেশ ফুরফুরে। তাই আর বিলম্ব না করে এগিয়ে এলো তৈমূর। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো স্ত্রীকে। কিন্তু আজ আর উথমী চমকালো না, নড়াচড়াও করল না। পূর্বের ন্যায় নিজের কাজ করতে করতে আয়নার ভেতর দিয়েই মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্বামীর পানে। মুখ ভার করে বলে উঠলো,“আপনি এতো লম্বা কেনো বলুন তো? আপনার এই উচ্চতা আমার একদম সহ্য হয় না।”

আচমকা স্ত্রীর কাছ থেকে এমন একটি কথা শুনে মুখভঙ্গি বদলে গেলো তৈমূরের। কিছুক্ষণ নিরব থেকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তো? আমার হাইট নিয়ে ইদানিং আপনার একটু বেশিই আফসোস হচ্ছে মনে হয়?”

“হওয়ার কথা নয়? একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখুন তো, আমার মাথাটা কোনোমতে গিয়ে আপনার বুকে ঠেকেছে।”

নিঃশব্দে হেসে ওঠে তৈমূর। তাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় এসে বসতে বসতে বললো,“এটা তো জটিল সমস্যা! এক কাজ করলে কেমন হয়?”

“কী কাজ?”

“কাল গিয়েই আপনার জন্য কমপ্ল্যান আর হরলিক্স কিনে নিয়ে আসবো। সাথে নিয়ে আসবো চার ইঞ্চি উঁচু হাই হিল। যতদিন না ওসব খেয়ে লম্বা হচ্ছেন ততদিন না হয় হাই হিল পায়ে দিয়েই আমার কাছে আসবেন।”

স্বামীর এমন বিদ্রুপে ভীষণ রাগ হয় উথমীর। বেনুনীর আগায় ঝুঁটি বেঁধে পেছনে ঠেলে দিয়ে জলন্ত দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকায়। তৈমূর সহাস্যে টের পেয়ে যায় স্ত্রীর রাগ। হাতের ইশারায় তাকে নিজের কাছে ডাকে। উথমী চেয়েও সেই ইশারা আর উপেক্ষা করতে পারে না। বাধ্য মেয়ের মতো এগিয়ে এসে দাঁড়ায় স্বামীর সম্মুখে।অধরে এখনো মুচকি হাসি ঝুলে আছে তৈমূরের। হাসিটা তার চওড়া হয়। জড়িয়ে ধরে উথমীর কোমর। বিস্মিত হওয়ার ভান ধরে বলে ওঠে, “এই যা?এবার তো আপনি অনেক লম্বা হয়ে গেলেন উথমী! একবার ভালো করে দেখুন। আমার মাথাটা কোনোমতে গিয়ে আপনার বুকে ঠেকেছে।”

মুহূর্তেই রাগ গলে গেলো উথমীর। খানিকটা লজ্জা পেলো কী? জোরজবরদস্তি করে পুরুষালি বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দূরত্ব রেখে বসে পড়ল পাশে। কিন্তু তৈমূরের যেনো এই দূরত্ব একদম সহ্য হলো না। এগিয়ে গিয়ে সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে মেয়েটিকে টেনে নিলো নিজের অতি নিকটে। গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,“হাইট কোনো ব্যাপার নয়। মনের মিলই আসল। বুঝেছেন ম্যাডাম?”

“হু।”

“তা আপনার সমস্ত অসুখ ভালো হয়েছে?”

“হয়েছে।”

“মন খারাপ?”

“নেই।”

“আর আমার উপরে হুটহাট চলে আসা রাগ?”

“আপাতত তাও নেই।”

“তাহলে এখনো বসে আছেন কেনো? যান দ্রুত গিয়ে আলো নিভিয়ে আমার খুব কাছে আসুন দেখি।”

“খুব কাছে কেনো?”

“ঘুমাবো তাই।”

“এখন? ঘুমাবো?”

ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকায় তৈমূর। ফিসফিস করে বলে, “তো? ঘুমের বদলে অন্যকিছু করতে চাইছেন? আমার কিন্তু আজ আর কোনো আপত্তি নেই।”

ইঙ্গিতপূর্ণ কথার অর্থদ্বার বুঝতেই শরীরের লোমকূপ জাগ্ৰত হয়ে গেলো উথমীর। স্বামীর শক্ত বাহুতে কিল বসিয়ে লাইটের সুইচ বোর্ডের দিকে যেতে যেতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“অভদ্রলোক কোথাকার! শুরুতে ভেবেছিলাম একদম সাদাসিধে, আনরোমান্টিক। কিন্তু এখন তো দেখছি ঠিকই আসল রূপ বেরিয়ে যাচ্ছে।”

“শুরুতে ভুল কিছু ভাবেননি। আমি সত্যিই সাদাসিধে, আনরোমান্টিক পুরুষ।”

“একদম চুপ।”

তবুও থামলো না তৈমূর। বললো,“যতটুকু অভদ্র হয়েছি তাও আপনার জন্য।”

“বলেছি না চুপ করতে?”

“আচ্ছা করলাম।”

অসুস্থ বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হলো উৎসের। সদর দরজা খুলে স্বামীর এমন বিমূঢ় অবস্থা দেখে মেয়ের চিন্তায় বুঁদ হয়ে এতোবেলা অপেক্ষারত কেয়া বেগম যেনো অবাক হলেন। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“কী হয়েছে তোর বাবার?”

উত্তর দেয় না উৎস। রায়হান কবীরকে দুই হাত দিয়ে ধরে একেবারে নিয়ে গেলো শোবার ঘরে। কেয়া বেগমও ছেলের পিছুপিছু এলেন। শুইয়ে দেওয়া স্বামীর মাথায় হাত রেখে পুনরায় শুধালেন,“কী হয়েছে তোমার? বাড়ি থেকে তো সুস্থ মানুষ বের হলে অথচ ফিরলে অসুস্থ অবস্থায়?”

অজানা এক ঘোরে ডুবে আছেন রায়হান কবীর।কোথাও কোনো হুঁশ নেই উনার।দৃষ্টির অন্তরালে এখনো ভাসছে কন্যার ওই ভয়ংকর রূপ। আপনা আপনিই চোখ দিয়ে উনার গড়িয়ে পড়ল অশ্রু, যা দৃষ্টি এড়ালো না স্ত্রী কেয়ার। উৎস ক্লান্ত কণ্ঠে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,“বাবা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল মা। এখন তুমি আর কোনো প্রশ্ন করো না তো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি কাল সকালে দিবো। তার আগে বাবার পোশাক বদলে খাবার খাইয়ে দাও। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, খাবারের পর ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে। বাবার এখন পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন।”

কথাটা শুনে আঁতকে উঠলেন কেয়া বেগম। কিছুক্ষণ বরফের মতো শক্ত হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই বলে উঠলেন,“আর ঊষা? কোথায় ও? সাথে করে নিয়ে এলি না কেনো?”

বাবার অবস্থা দেখে মাকে আর সত্যটা জানালো না উৎস। শুধু উত্তরে বললো,“ও অসুস্থ তাই হাসপাতালেই রেখে এসেছি। সব চিন্তা বাদ দিয়ে আজ রাতে শুধু বাবার খেয়াল রেখো। কাল সকালে না হয় ঊষার কাছে নিয়ে যাবো তোমায়।”

ছেলের কথাই মেনে নিয়ে মাথা নাড়ালেন কেয়া। উৎস বাবার ঘর থেকে চলে এলো নিজের ঘরে।জাগ্ৰত স্ত্রীকে বিছানায় আধশোয়া দেখে ললাটে তার ভাঁজ পড়ল। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল,“ঘুমাওনি এখনো?”

“তুমি আর বাবা বাইরে, কীভাবে ঘুমাই বলো তো?”

“তনি কখন ঘুমিয়েছে?”

“এশার আজানের পর।”

“খেয়েছো?”

“হ্যাঁ, তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো আমি খাবার বাড়ছি।”

“তুমি ঘুমাও, এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“কেনো? আর ঊষা? পেলে ওকে? কোথায় ও?”

প্রশ্নটি শুনে বিছানায় বসে পড়ল উৎস। মুখভঙ্গি তার বদলেছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে বেশ কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরো সত্যটাই জানিয়ে দিলো স্ত্রীকে। এমন একটি সংবাদ শুনে যেনো আঁতকে উঠলো রিনিতা। অতি কষ্টে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো শব্দ,“কী বলছো!”

“মাকে এখনো জানাইনি। বাবা ওকে দেখেই জ্ঞান হারিয়েছে একবার। মা জানলে, দেখলে কী হবে কে জানে? কী করবো আমি কিচ্ছু মাথায় আসছে না রুনি। কয়েকদিন পর ইদ, কোরবানি দিতে হবে। ওদিকে ঊষা কতগুলো টাকা, সোনার গয়না নিয়ে চলে গেলো? বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তোমার ডেলিভারির সময়ও ঘনিয়ে আসছে। আবার ঊষার এমন অবস্থা! মামলা লড়তে, চিকিৎসা করাতে কত অর্থ যাবে? যতই ওর উপর আমার রাগ থাকুক, বড়ো ভাইয়ের দায়িত্ব তো আর এড়িয়ে যেতে পারি না। আমার নৈতিকতা, বিবেক আমায় বাঁধা দিচ্ছে। এখন আমি কী করবো রিনি? কী করা উচিত? মাথা কাজ করছে না আমার।”

কীভাবে স্বামীর সমস্যার সমাধান দিবে বুঝে উঠতে পারে না রিনিতা। তবুও ভরসার হাত রাখে স্বামীর কাঁধে। আশ্বস্ত করে বলে,“চিন্তা করো না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। তিনি হয়তো আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন।”

স্ত্রীর কথায় মনকে শক্ত করতে চেয়েও পারে না উৎস। ক্লান্ত দেহখানা এগিয়ে নিয়ে মাথাটা ঠেকায় স্ত্রীর কাঁধে। রিনিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই হাত দিয়ে আগলে নেয় তাকে। চুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে রবের নিকট আকুল হয়ে মনে মনে প্রার্থনা করে।
____________

বশির উদ্দিনের কন্যারা গতকাল দুপুরে ভোজন না সেরেই রেগেমেগে চলে গিয়েছে স্বামীর বাড়ি। বাড়ির সদস্যরা ছাড়া অতিরিক্ত তেমন কেউই এখন আর নেই এ বাড়িতে। সকালের নাস্তা শেষে বাড়ির পুরুষেরা অন্দরমহলে এসে বিভিন্ন শলা পরামর্শ করছে। তার মধ্যেই সেখানে এসে উপস্থিত হলেন মঈনুদ্দিনের ডেকে আনা পরিচিত উকিল সাহেব।

উনার আগমনের কথা শাহানার কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই তিনিও এসে উপস্থিত হলেন সেখানে। মাকে দেখতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তুরাগ। মায়ের বসার জন্য ছেড়ে দিলো জায়গা। শাহানা সেখানে বসলেন। নিরবে তাকিয়ে রইলেন কাগজ নড়াচড়া করতে থাকা উকিলের হাতের দিকে। তিথিয়া এসে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়ালো ঠিক মায়ের পেছনে। আজ যেনো সে ভীষণ আনন্দিত। চোখেমুখে উপচে পড়ছে খুশি।

মঈনুদ্দিন গতকাল রাতেই মি. আফজালকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ঘটনার কিছু অংশ। আজ সামনাসামনি বসে বাকিটাও বুঝিয়ে বললেন। মি. আফজাল তা চুপচাপ শুনলেন। শেষে মাথা নাড়িয়ে বোঝালেন যে তিনি বুঝেছেন। বশির উদ্দিনের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,“তা কার নামে লিখে দিতে চাইছেন?”

বশির উদ্দিনের স্পষ্ট জবাব,“আমার মরহুম মেজো ভাইয়ের বউয়ের নামে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। এতে তেমন একটা ঝামেলা নেই। আমি দলিল বানিয়ে এনে তারপর না হয় আপনার স্বাক্ষর নিয়ে যাবো। বাদ বাকি কাজ আমার।”

মঈনুদ্দিন বিপরীতে বললেন,“নিজেদের মানুষ মনে করে একটু তাড়াতাড়ি কাজটা করে দিলে ভালো হতো আফজাল।”

“সেসব তুমি চিন্তা করো না।”

সন্তুষ্ট হলেন মঈনুদ্দিন। এবার নিরবতা ভাঙলেন শাহানা। বললেন,“দলিল যেহেতু হবেই তাহলে অযথা আমার নামে করে লাভ কী? আমি বলছি কী ভাইজান, আপনি আমার নামে না দিয়ে একেবারে আমার ছেলেদের মধ্যেই না হয় সঠিকভাবে ভাগ করে দলিল করে দিন। আমার বয়স বাড়ছে, কবে বুবুর মতো আমারও ডাক চলে আসে তারও তো ঠিক নেই।”

শাহানার কথায় সকলের দৃষ্টি এসে স্থির হলো উনার পানে। মঈনুদ্দিন কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর কথাটায় সায় জানিয়ে বললেন,“আমিও এটাই ভেবেছিলাম ভাবী। নইলে পরবর্তীতে আবার ঝামেলা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়ায় আমি আর জানাইনি।”

“তখন তো আর আমার মাথায় আসেনি। ব্যাপারটা নিয়ে কাল রাতে আমি অনেক ভাবলাম! তখনি মাথায় আসলো। বারবার দলিলের ঝামেলায় গিয়ে লাভ নেই। এর থেকে এখনি যেহেতু দলিল হবে তাহলে না হয় ওদের নামেই রেজিস্ট্রি হয়ে যাক।”

সবটাই শুনলেন বশির উদ্দিন।প্রত্যুত্তর করলেন,“তুমি যেমনে কইবা হেমনেই তবে হোক। আমি শুধু এই বোঝা থাইক্কা মুক্তি চাই।”

সবার কথার সমাপ্তি ঘটতেই মি. আফজাল পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“এবার নিশ্চিতভাবে বলুন, কার নামে দলিল হবে?”

“আমার দুই ছেলে তুরাগ আর তৈমূরের নামে।” —-উত্তর দিলেন শাহানা।

মি. আফজাল চটজলদি একটি ডায়েরির সাদা পৃষ্ঠায় নামসহ আরো কিছু তথ্য লিখে ফেললেন। তুরাগ আর তৈমূর একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করল। মায়ের সঙ্গে এই বিষয়ে এখনো কথা হয়নি তাদের। ভেবেছিল আজই বলবে কিন্তু এর আগেই যে উনার সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে তা ভেবেই ভেতরে ভেতরে আশ্চর্য হলো দুই ভাই। তবে কথাটি শেষ হতে না হতেই তিথিয়া এবং শামীমের মুখখানি অমাবস্যার রাতের মতো কালো হয়ে গেলো। মলিন মুখে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো তিথিয়া,“এটা কী বললেন আম্মা? আপনাকে এতো করে বলার পরেও আপনি এই সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারেন? বাবা নাকি ওদের নামে আগেই বাড়ির প্রথম দুই তলা থেকে শুরু করে পুরো বাগানসহ সবটা লিখে দিয়ে গিয়েছেন।এরপরে আবার তিনতলাও ওরা পাবে?”

প্রত্যুত্তর করলেন শাহানা,“সম্পত্তি ভাগের কিছু নিয়ম- কানুন আছে। সেসব তো আর তোর অজানা নয়। তোর বাবা তুরাগের বিয়ের পরপরই সব ভাগ বাটোয়ারা সঠিকভাবে করে দিয়ে গিয়েছেন যাতে উনার অবর্তমানে তোদের ভাই-বোনদের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি না হয়। তোকে তোর ওয়ারিশও ঠিকভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। বলতে গেলে এরপরেও তুই একটু বেশিই পেয়েছিস। এতে তো আর তোর ভাইদের কোনো আপত্তি নেই তাহলে তুই আপত্তি করছিস কেনো?”

“আপত্তি করার মতো কিছু রেখেছেন? সব তো আগেই না জানিয়ে বাবা দলিল করে গিয়েছেন। ছেলেদেরটা ছেলেদেরকে বুঝিয়েও দিয়ে গিয়েছেন। সেসব বাদ, এতো কিছু আমি জানি না। ওই তিনতলা আমার চাই। আমার নামে লিখে দিন।”

“এ সম্ভব না। তোর বাবা মরার আগেই আমায় বলে দিয়ে গেছে, ভিটে বাড়িতে যেনো এই বংশের ছেলে ব্যতীত অন্য কাউকে মালিকানাসত্ত্বে না ঢুকানো হয়। এতে পরবর্তীতে ঝামেলা বাঁধবে।”

“তো আমি কী এই বংশের নই আম্মা?”

“তুই এই বংশের মেয়ে হলেও বিয়ের পর থেকে তুই পরের বাড়ির বউ। তোর আলাদা সংসার রয়েছে। তুই অযথা এই ভাগ নিয়ে কী করবি? তোদের তো আর কম নেই।”

মঈনুদ্দিন বললেন,“তুই আবার ঝামেলা শুরু করলি কেনো? ভাইদের থেকে বয়সে অনেক বড়ো তুই। এই সামান্য একটা বিষয় বুঝছিস না? তাছাড়া বাড়ির মেয়েরা ভিটে বাড়িতে ঢুকবে বলেই তো বড়ো ভাইজান সম্পত্তি হস্তান্তর করতে চাইছেন। তুই আর এসবের মধ্যে কথা বলিস না। তোর পাওনা তুই পেয়ে গিয়েছিস। আফজাল তোমাকে যেভাবে বলেছি সেভাবেই দলিল তৈরি করে আমায় জানিও।”

মাথা নাড়লেন আফজাল। আরো কিছু কথা বলে বিদায় নিলেন সেখান থেকে। কিন্তু তিথিয়া কিছুতেই চুপ রইলো না। লোকটি যেতেই পুনরায় বলা শুরু করল,“আপনাকে আমি এতো ভালোবাসি আম্মা। সবার ঊর্ধ্বে আপনাকে রাখি, আর আপনিই কিনা আমায় পর বানিয়ে দিলেন? হ্যাঁ সবটাই আপনার ছেলেদের নামে লিখে দিন। পরে বাপের বাড়িতে আসতেও আমায় ভাই বউদের অনুমতি নিয়ে আসতে হবে।”

বড়ো বোনের কথায় বিরক্ত হলো তুরাগ। বললো,“তুমি সবসময় কথার মধ্যে ভাই বউদের টানো কেনো বুবু? এই যে আট সাড়ে আট বছর ধরে জেবা এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে, কখনো কী তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে? আমার জানামতে করেনি। এমনকি তুমি করলেও সে মুখ বন্ধ করে সহ্য করেছে। তৈমূরের বিয়ের দিনও কম ঝামেলা করোনি তারপরেও তারা কেউ তোমার চোখের দিকে তাকিয়েও কথা বলেনি অথচ বারবার শুধু ওদের নামে নিন্দা।”

“তুই চুপ থাক, বউয়ের গোলাম। মুখে না বললেও তোর কান ভাঙিয়ে ঠিকই তো আলাদা হয়ে গেছে। ওসব বোঝ আমায় দিতে আসিস না।”

কথাটায় ভীষণ রাগ হলো তুরাগের কিন্তু বিপরীতে কিছুই বলতে পারলো না। মা-বোনের মুখের উপর সে বরাবরই কঠিন কথা বলতে পারে না। তবে তার হয়ে উত্তর দিলো তৈমূর,“আমরা বউয়ের গোলাম হলে দুলাভাই কী বুবু? দুলাভাইয়ের মতো তো বউকে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে আমরা ওয়ারিশও আনতে পারলাম না। আর বাবা-মা, ভাই-বোনের দায়িত্ব এড়িয়ে বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরের দেওয়া ফ্ল্যাটেও উঠতে পারলাম না। আবার বউয়ের কথায় উঠবসও করতে পারলাম না। তাহলে আমরা কীভাবে গোলাম হলাম বুবু?”

শামীম, তিথিয়া থেকে শুরু করে কথাটায় সকলেই যেনো স্তম্ভিত হয়ে গেলো। শাহানা রুষ্ট কণ্ঠে ছেলের উদ্দেশ্যে চাপা ধমকে বললেন,“তৈমূর! এ কী ধরণের বেয়াদবি?”

“তো? ভুল কিছু তো বলিনি আম্মা। বড়ো বোন হয়েও বুবু কী করে পারলো ছোটো ভাইদের উদ্দেশ্যে এমন সস্তা শব্দ প্রয়োগ করতে?”

কোনো উত্তর দিতে পারলেন না শাহানা। মায়ের এই নিরুত্তরতায় রাগ বৃদ্ধি পেলো তিথিয়ার। অপমান মুখ বুজে সহ্য করার মেয়ে সে নয়। তাই পাল্টা উত্তর দিলো। তার এসব উত্তরেই ঝামেলা যেনো বৃদ্ধি পেতে লাগলো।

চলবে __________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩১]

ভাবী রিনিতার কাছ থেকে ঊষার খবরটি শোনার পর থেকেই চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে উথমী। সারা ঘর জুড়ে পায়চারী করতে করতে কী করবে, না করবে কিছুই যেনো বুঝে উঠতে পারছে না সে। সকালের সেই ঝামেলার পরপর রাগ করে স্বামী, সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছে তিথিয়া। তৈমূরও আর সেখান থেকে ঘরে আসেনি। সেই যে এহসানকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো তারপর কে জানে কোথায় গিয়েছে?

এবার আর থাকতে না পেরে সরাসরি স্বামীর নাম্বারে কল দিলো উথমী। কিন্তু হতাশ হলো! বিপরীত পাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর জানান দিলো, মোবাইল যে সুইচ অফ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটা থামিয়ে বিছানায় বসে পড়ল সে। ভাবী ফোনকলে শুধু এতোটুকুই বলেছে, ‘ঊষাকে পাওয়া গেছে। হাসপাতালে ভর্তি ও। বাবা আর তোমার ভাই মিলে গতকাল রাতে তাকে দেখে এসেছে। আজও তারা যাবে তবে মাকে সঙ্গে নিয়ে।’ এরচেয়ে একটা কথাও আর বেশি বলেনি রিনিতা।

উথমী কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না, ঊষা হাসপাতালে ভর্তি কেনো? কী হয়েছে ওর? বড়ো বোন হিসেবে এই মুহূর্তে একবার ওখানে যাওয়া উচিত তার। এতোগুলো দিন মেয়েটা কোথায় কীভাবে ছিলো তাও তো জানা প্রয়োজন। কিন্তু তৈমূরকে ছাড়া সকলের সামনে দিয়ে অতোদূরেই বা কী করে যাবে সে? ভাবতেই খুব রাগ হলো উথমীর। এখনি এই লোকটাকে মোবাইল বন্ধ করে বাড়ি থেকে উধাও হতে হলো?

আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে উথমীর দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো বিছানার পাশের টেবিলে। যেখানে পড়ে আছে তৈমূরের কালো রঙের মোবাইলটা। সেটা দেখেই ভীষণ অবাক হলো সে। হাত বাড়িয়ে মোবাইল ধরতেই বুঝতে পারলো যে তা চার্জে লাগানো। চার্জ থেকে খুলে সুইচ অন করে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল,“এই লোক তবে মোবাইল ঘরে ফেলে রেখেই চলে গিয়েছে?”

পরপর আরো কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো উথমীর ভেতর থেকে। মোবাইল অন হতে না হতেই ম্যাসেজের ঝড় উঠলো। হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে কয়েকটা ম্যাসেজ পড়েই উথমী বুঝতে পারলো অফিস থেকে আসা জরুরি ম্যাসেজ। জয়নবের মৃত্যুর কারণে বেশ কয়েকদিন তৈমূরের অফিসে যাওয়া হয়নি। তাই হয়তো এতো ম্যাসেজ। মুখ ভার করে নিচের দিকে স্ক্রল করে যেতে যেতেই হাত থেমে গেলো উথমীর। শামীম নামের অ্যাকাউন্ট আর প্রোফাইলের ছবিটা দেখেই বুঝতে পারলো এটা যে দুলাভাইয়ের অ্যাকাউন্ট। যার উপর দিয়ে ভাসমান একটি ম্যাসেজ, ‘প্রমাণ দেওয়ার পরেও আমার কথা বিশ্বাস করলে না তো! একদিন….’

ম্যাসেজটি দেখে বেশ খটকা লাগলো উথমীর। ভেতরে ঢুকে ম্যাসেজগুলো পড়বে কী পড়বে না দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে শেষমেশ ম্যাসেজ বক্স ওপেন করল সে। তৎক্ষণাৎ তার নজর গিয়ে আটকালো একটি ছবিতে। যা দেখে খুব বাজেভাবে চমকে গেলো উথমী। কেঁপে উঠলো তার বুক। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, একটি টেবিলে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে বর্ষ আর উথমী। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ সামনে নিয়ে দুজনার দৃষ্টি একে অপরের উপরেই নিবদ্ধ। সেই ছবিটির নিচেই দেওয়া একটি লাগোয়া কুৎসিত ম্যাসেজ,“কতবার করে তোমার বোন তোমায় বলেছিল, বেশি শিক্ষিত চাকরি করা মেয়ে সংসারের জন্য ভালো না তৈমূর। তার প্রমাণ মিললো তো এবার? চাকরির নাম করে তোমার অগোচরে তোমার বউ পরপুরুষের সাথে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়, নোংরামি করে।”

ম্যাসেজটি পড়ে মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেলো উথমীর। এসির নিচে থেকেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এসেছে। অসাড় হয়ে আসছে দেহ। এ তো সেদিনকার ঘটনা! বর্ষের অনুরোধে কাছেপিঠে একটি ক্যাফেতে গিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য বসেছিল উথমী। কিন্তু সেসব ক্যামেরা বন্দি হলো কীভাবে? আর দুলাভাই! উনিই বা কোথায় পেলেন ছবিটা? তবে উনিই কী তুলেছিলেন? কিন্তু কীভাবে?

আঁচলে ঘাম মুছে বড়ো বড়ো কয়েকটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে পুনরায় স্ক্রিনে দৃষ্টি রাখলো উথমী। তৈমূরের করা রিপ্লাই ম্যাসেজটা পড়ল,‘হয়তো পরিচিত কেউ হবে। কারো সঙ্গে সৌজন্যতার খাতিরে কথা বললেই তা আর নোংরামো হয়ে যায় না দুলাভাই।”

দমলো না শামীম। পাল্টা রিপ্লাই দিলো,‘এসব আমাকে শেখাতে এসো না তৈমূর। বয়স তো আর কম হলো না! এসব অন্ধ বিশ্বাস করা ছাড়ো।’
‘প্রমাণ দেওয়ার পরেও আমার কথা বিশ্বাস করলে না তো! একদিন ঠিকই এর জন্য তোমায় খুব পস্তাতে হবে। আমি নিজ চোখে ওদের নষ্টামি দেখেছি। লজ্জায় সবটা বলতেও পারছি না। তাই সাবধান করে দিচ্ছি, সময় থাকতে এসবের ব্যবস্থা নাও।’

ম্যাসেজটি দেখলেও বিপরীতে কোনো রিপ্লাই তৈমূরের থেকে আর যায়নি। তবে কী তৈমূরের মনেও তাকে নিয়ে সন্দেহ জন্মেছে? সে কী জেনে গিয়েছে তার আর বর্ষের অতীতের সম্পর্কের কথা? না তা কী করে হয়? যদি জানতো তাহলে এই এক সপ্তাহ ধরে সবসময়কার মতোই এতো সুন্দর ব্যবহার আদৌ কী করতে পারতো? ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত হলো উথমীর মন। অন্য পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর ছবির সাথে এমন কুৎসিত মন্তব্য শোনার পরেও কিনা তৈমূর তাকে কোনোরূপ প্রশ্ন করল না, জবাব চাইলো না? ভাবতেই ভয়ের চোটে আত্মা কেঁপে ওঠে উথমীর। তার সাথে হঠাৎ করেই মস্তিষ্কে উদয় হয় নতুন আরেকটি বার্তা,‘সেদিন রাতে এই জন্যই কী তবে শুরুতে তার প্রতি অনাগ্রহ ছিলো তৈমূরের?’ চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসে উথমীর। তৈমূর তাকে ভুল বুঝুক সে চায় না। স্বামীর চোখে খারাপ হতেও চায় না। অতীতে করা ভুল বর্তমান, ভবিষ্যতে প্রভাব ফেলুক সেটাও সে চায় না। বিয়ের পর থেকেই প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী তৈমূর নামক পুরুষটির উপর প্রতি পদে পদে সে দুর্বল। সেদিন রাতের পর থেকে তৈমূরকে যে সে ভালোবাসে তাও তার অজানা নয়।

মোবাইলটা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে নিজ হাতের আঁজলে মুখ ঢাকলো উথমী। বিভিন্ন শঙ্কায় মস্তিষ্ক তার শূন্য হয়ে পড়েছে। মাথা কাজ করছে না। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে,“সবসময় আমার সঙ্গেই কেনো এমনটা হয়? বর্ষ আমার ভুল অতীত। বিয়ের অনেক আগেই তাকে আমি মন থেকে দূর করেছি। তারপরেও কেনো এটা আমার বর্তমানে প্রভাব ফেলছে?” কিন্তু তা আর বলতে পারে না সে। গলায় এসেই আটকে যায় বাক্যগুলো। উথমীর মনে পড়ে, কলেজে পড়াকালীন সময়ে বাবার বন্ধুর মেয়ে রুনা আপুর বিয়ে হয়েছিল তার থেকেও বয়সে দ্বিগুণ একজন বয়স্ক লোকের সাথে। কিন্তু বিয়ের দুদিন পেরোতে না পেরোতেই সংসারটা তার ভেঙে গিয়েছিল। ‘বিয়ের আগে কারো সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো কিনা?’ স্বামীর করা এমন প্রশ্নে অতি আহ্লাদী হয়েই স্বামীকে সবটা জানিয়ে দিয়েছিল কিশোরী রুনা আপু। যার কারণে স্বামী তাকে তালাক দেয়। কারণ হিসেবে বলে,‘মেয়ের চরিত্র ভালো না। বিয়ের আগেই যেই মেয়ে পরপুরুষের সাথে নোংরা সম্পর্কে জড়াতে পারে তাকে নিয়ে আমার পক্ষে সারা জীবন একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়।’ রুনা আপুর বাবা কতভাবেই না বুঝাতে চাইলেন মেয়ে জামাইকে কিন্তু লোকটা কিছুই শুনলো না। রুনা আপুকে ডিভোর্স দিয়ে তার পনেরো দিনের মাথায় নতুন করে আবারো বিয়ে করলেন।

ঘটনাটির কথা মাথায় আসতেই ধীরে ধীরে ভয় বৃদ্ধি পেতে লাগলো উথমীর। মনে মনে আওড়ালো,“আমার সাথেও কী তবে এমনটা হবে? তৈমূর সাহেবও কী আমায় ছেড়ে দিবেন? এমনটা হলে আমি বাঁচবো কীভাবে?” যত যাই ভাবছে ততই যেনো ভয় বাড়ছে তার।

“কী ব্যাপার? আমার বউ আজ এই অসময়ে ধ্যানে বসেছে যে? এটা তো ভালো লক্ষণ নয়।”

পরিচিত পুরুষালি থেকে নিঃসৃত বাক্যগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই আঁতকে উঠলো উথমী। মুখ থেকে হাত সরিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তৈমূর সেদিকে তেমন একটা খেয়াল করল না। সোজা এগিয়ে এসে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকালো। বললো, “মোবাইল তো বন্ধ ছিলো। খুলে গেলো কীভাবে?”

শুকনো ঢোক গিললো উথমী। মনের অজান্তেই হাত দুটো তার কাঁপছে। ঘেমেনেয়ে শরীর ভিজে গিয়েছে। কম্পিত কণ্ঠে বললো,“আআমি খুলেছি। আসলে কল দিয়েছিলাম আপনাকে কিন্তু ধরেননি। পরে দেখি মোবাইল বন্ধ, এখানে চার্জ দেওয়া।”

“রাতে চার্জ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। সকালে একটু ব্যবহার করতেই দেখি চার্জ শেষ হয়ে আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাই চার্জেই রেখে গিয়েছি।”

“কোথায় গিয়েছিলেন?”

“কোথাও যাইনি তো। বাগানেই ছিলাম।”

বিপরীতে ‘ওহ’ বলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস চালায় উথমী। কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক রাখতে পারে না। নিষ্পলক দৃষ্টিতে আপাদমস্তক পরখ করে স্বামীকে। হাবভাব বুঝার চেষ্টা করে। তবে ব্যর্থ হয়। হাত থেকে মোবাইল রেখে স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি পড়তেই ললাটে ভাঁজ পড়ে তৈমূরের। ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে শুধায়,“কী হয়েছে?”

উত্তর দিলো না উথমী। হঠাৎ করেই তার খুব কান্না পাচ্ছে। সামনের মানুষটিকে হারানোর ভয় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আর কোনো কিছুই ভাবতে পারলো না উথমী। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আচমকাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো স্বামীকে। তার কাজে তৈমূর চমকালো, থমকালো। পকেট থেকে হাত বের করে স্ত্রীর মাথায় রাখলো। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কেউ কিছু বলেছে?”

নিরুত্তর রইলো উথমী। মুখ ঘষলো পুরুষালি শক্তপোক্ত বুকে। মেয়েটির এমন আচরণে বিষ্ময় যেনো কিছুতেই কাটছে না তৈমূরের। শুধালো,“কে বলেছে?”

এবার আর তাকে নিরাশ করল না উথমী। জড়ানো গলায় বললো,“কেউ না।”

“তাহলে?”

আবারো নিরব রইলো সে। তৈমূর তাকে সময় দিয়ে মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিলো। সন্তর্পণে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের থেকে স্ত্রীকে ছাড়িয়ে তাকে নিয়ে বসিয়ে দিলো বিছানায়। তারপর নিজে হাঁটু গেড়ে বসলো মেঝেতে। মেয়েলি নরম হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে কোমল স্বরে বললো, “সমস্যা কী? না বললে বুঝবো কী করে?”

মুখ তুলে ঝাপসা, ভেজা চোখে তাকালো উথমী। স্ত্রীর চোখে পানি দেখে অবাক হয় তৈমূর। ঘরের দরজা খোলা। যখন তখন যে কেউ চলে আসতে পারে। তাই মেঝে থেকে উঠে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে এলো সে। বিছানায় স্ত্রীর পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল। উথমীকে নিজের দিকে ঘুরালো। ডান হাতটা ফর্সা গালে ঠেকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কী হয়েছে? বলুন আমায়।”

মিষ্টি কথায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না উথমী। নিজের শক্ত খোলস ছেড়ে পূর্বের মতো স্বামীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শব্দ করে কেঁদে ওঠলো সে। এই মুহূর্তে কী করা উচিত বুঝতে পারলো না তৈমূর। এই উথমীকে সে চিনে না। শেষ এমনভাবে মেয়েটিকে সে কাঁদতে দেখেছিল বিয়ের দিন। বাবাকে জড়িয়ে ধরে কি কান্না তার! এরপর যত রূপ দেখেছে সবই কঠিন রমণীর। সেই মেয়ে আজ কাঁদছে? কিন্তু কেনো? চুপ থাকে সে। নিরবে উথমীর দুই বাহু ধরে তাকে সোজা করে বসিয়ে তার চোখের পানি মুছে দেয় তৈমূর। কয়েক সেকেন্ড তার মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে আচমকাই ঠোঁট জোড়া নিয়ে নেয় স্বীয় ঠোঁটের দখলে।

স্বামীর এহেন কান্ডে ক্রন্দনরত অবস্থাতেই কেঁপে ওঠে উথমী। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই থেমে যায় তার কান্না। নিজের কাজ শেষ হতেই ঠোঁট ছেড়ে গালে চুম্বন বসিয়ে দিলো তৈমূর। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, “কান্নাকাটি আমার পছন্দ নয়।”

থমকে গেলো উথমী। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, তৈমূর তাকে ভুল বুঝতে পারে না। কখনোই না। তাই এমন একটি সময়ে এসে সে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলো, অতীতের সব কথা সে তৈমূরকে জানিয়ে দিবে। এরপর যা হওয়ার হোক। সম্পর্কে ধোঁয়াশা, সন্দেহ রাখা উচিত নয়। যা হবে তা আয়নার মতো স্পষ্ট হবে। তাই আর বিলম্ব না করেই নাক টেনে মিনমিনে স্বরে বললো,“বিশ্বাস করুন তৈমূর সাহেব, আপনি ব্যতীত আমার জীবনে আর কেউ নই। আমি সত্যিই আপনাকে ঠকাইনি।”

বোকা বনে গেলো তৈমূর। কথাটির অর্থদ্বার বুঝতে পারলো না সঠিক। উথমী ফের বললো,“বর্ষের সাথেও এখন আর আমার কিচ্ছু নেই।”

“বর্ষ?”

“আমার প্রাক্তন।”

“প্রাক্তন?”

“হু, সেই ভার্সিটি লাইফে তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। একসময় যেই সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটেছিল ওখানেই। বিভিন্ন সময়ে তার খারাপ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ও আমার সাথে চিট করে। মাঝপথেই সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেয়। এরপর থেকে ওর সাথে সব যোগাযোগই আমার বন্ধ ছিলো। সাক্ষাৎ এর সাথে সাথে মন থেকেও অনেক আগেই মুছে গিয়েছিল ওর সমস্ত স্মৃতি। কিন্তু সেদিন কলেজ শেষে রিক্সার জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করার সময় হঠাৎ করেই তার সঙ্গে দেখা হয়। সে নিজ থেকে আমার সাথে কথা বলতে এসেছিল। আমি অনেকবার তাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও বর্ষ যেনো কোনোভাবেই ছাড়ার পাত্র নয়। বারবার তার কথা শোনার জন্য আমায় অনুরোধ করছিল। তাই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই আমি আর না করতে পারিনি। তার কথাতেই পাশের একটা ক্যাফেতে গিয়ে বসি। এর বেশি কিছু আমাদের মধ্যে হয়নি। আপনি ফোন দেওয়ার পরপরই আমি সেখান থেকে সোজা বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই সামান্য ব্যাপার যে এতো বড়ো আকার ধারণ করবে তা আমি কষ্মিনকালেও ভাবতে পারিনি। দুলাভাই কোত্থেকে ওই ছবিটা পেলেন তাও আমি জানি না। কিন্তু ছবিটা সত্য হলেও উনার বলা ওসব নোংরা মন্তব্য ভিত্তিহীন। আপনি নিজেই তো রোজ আমায় কলেজ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসেন আবার কলেজ শেষে গেট থেকে বের হতেই আশফাক ভাই গাড়ি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে যান। তারপরেও আমি কীভাবে পথেঘাটে নোংরামি করবো বলুন তো?”

শেষটুকু বলতে গিয়ে যেনো দমবন্ধ হয়ে এলো উথমীর। নিরবে এতক্ষণ ধরে স্ত্রীর বলা কথাগুলো শুনলো তৈমূর। এবার পুরো বিষয়টিই তার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। সামনে চলে আসা ছোটো ছোটো চুলগুলো উথমীর কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,“জানি আমি।”

চমকায় উথমী। মুখ তুলে তাকায় স্বামীর পানে। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে শুধায়,“কী জানতেন?”

“এই যে আমার বউ অনুচিত কোনো কাজ করতে পারে না।”

“আর বর্ষের কথা শুনে? আপনার খারাপ লাগেনি? ছবিটা দেখে আপনার সন্দেহ হয়নি?”

“সন্দেহ হয়নি তবে খারাপ লেগেছিল। পরপুরুষের থেকে নিজের স্ত্রীর নামে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য শুনে চরম অপমানিত হয়েছিলাম। আমার আগেও আমার ব্যক্তিগত নারীর জীবনে অন্য কেউ ছিলো, যাকে সে নিজ থেকে ভালোবেসেছিল, যার নামে যৌবনের সমস্ত অনুভূতি অর্পণ করেছিল। এসব জানার পরেও কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারে? আমার জায়গায় আপনি হলে কী করতেন? মেনে নিতে পারতেন?”

মাথা নত করে নেয় উথমী। উত্তর না দিয়েও বুঝিয়ে দেয়, এমনটা সে কখনোই মেনে নিতে পারতো না। তৈমূর পুনরায় বললো,“বর্ষের কথা আগে থেকেই আমি জানি। সাথে আপনার প্রতি আপনার মা-বোনের আচরণ সম্পর্কেও মোটামুটি জানি। এসব পুরোনো খবর।”

কথাগুলো শ্রবণাতীত হতেই ভীষণ অবাক হলো উথমী। জিজ্ঞেস করল,“জানতেন? আমি তো বলিনি।”

দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তৈমূর। উত্তর দিলো,“আম্মার অসুস্থতার খবর পেয়ে যেদিন আপনাদের বাড়ি থেকে চলে এলাম ঠিক তার পরেরদিন সকালেই টেবিলের উপর আপনার ব্যক্তিগত ডায়েরিটা পেয়েছিলাম আমি। শুরুতে বুঝতে পারিনি ডায়েরিটা যে আপনার। সেদিন রাতেই পুরোটা পড়ে সব জানতে পেরেছিলাম। তার জন্য স্যরি। আমার বিশ্বাস মতে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যক্তিগত, গোপনীয় কিছু থাকতে পারে না বা থাকা উচিত নয়। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। যার মধ্যে কোনো লিমিটেশন, লজ্জা, স্বার্থ, নিজস্বতা বলতে কিছু নেই। যদি এই চারটের মধ্যে কোনো একটা বিষয় সম্পর্কের মাঝখানে চলে আসে তাহলে সেই সম্পর্ক আর পবিত্র থাকতে পারে না, সম্পর্কে ভালোবাসা থাকে না। বেশিরভাগ সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কারণও এটাই। সেসব ভেবেই ডায়েরি পড়ার আগে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। সামনে পেয়েছি তাই পড়েছি। তবে সেসব নিয়ে এখন আর আমার ভেতরে কোনো আফসোস, খারাপ লাগা নেই।”

“নেই? সত্যিই নেই? কখনো আমার প্রতি বিরক্তি কাজ করেনি? রাগ হয়নি?”

“না, বিয়ের আগেই যখন অতীত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি তাহলে বিয়ের পর সেই অতীত জানার পর খারাপ লাগা পুষে রেখে লাভ কী?মন নেওয়া-দেওয়াই তো শুধু হয়েছে। এর বেশি কিছু তো আর নয়। তাছাড়া বিয়ের পর কখনো আপনার সাথে আমি খারাপ আচরণ করেছি? রাগ দেখিয়েছি? সারাদিন অফিসের কাজ করে রাতবিরেতে বাড়ি ফিরে আপনাকে নিয়ে মা-বোনের করা অসংখ্য অভিযোগ শোনার পরেও কখনো আপনার কাছে এসে সেসব নিয়ে কৈফিয়ত চেয়েছি? যত রাগ, বিরক্তি সব আপনি দেখিয়েছেন। আমার উপর, আমার পরিবারের উপর।”

একটু থামে তৈমূর। কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে পুনরায় বলা শুরু করে,“একটা মানুষের উপর তখনি রাগ, অভিযোগ করা যায় যখন কিনা সেই মানুষটির মনে নিজের জন্য ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারা যায়। কিন্তু কেনো যেনো এতোদিনেও আমি তা উপলব্ধি করতে পারিনি। শুরু থেকেই আমি চেয়েছিলাম আমাদের সম্পর্ক আগে মানসিকভাবে সুন্দর হোক, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস বাড়ুক। শারীরিক চাহিদা তো যখন তখনই পূরণ করা যাবে। অতীত সম্পর্কে জানার পর সেই সময়টা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। অথচ আমি চাইলে আপনার সাথে কত কিছুই করতে পারতাম। তার বিপরীতে আপনি কিন্তু আমায় বাঁধা দিতে পারতেন না উথমী। বাধ্য মেয়ের মতো আমার কথা শুনতে বাধ্য হতেন। এই যে আপনার চাকরি নিয়ে আমার পরিবারের এতো সমস্যা! বিয়ের আগে আপনার ভাই কী বলেছিল জানেন? বিয়ের পর উথমীর অভিভাবক তুমি। তোমার বউকে তুমি চাকরি করতে দিবে কি দিবে না সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার। আর ও চাকরি করেই বা কী করবে? স্ত্রীর সমস্ত দায়িত্ব তো স্বামীরই।”

“ভাইয়া এসব বলেছে?”—-কণ্ঠে তার বিষ্ময়।

“হ্যাঁ, বিশ্বাস না হলে নিজেই জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আশা করি, আপনার বাবা-মাও সেম কথাই বলবে।”

কথাটা বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে উথমীর। কিন্তু তৈমূরকে অবিশ্বাস করার মতো কোনো কারণ তার কাছে নেই। তৈমূর পুনরায় বললো,“কীভাবে দুলাভাইয়ের ম্যাসেজটা আপনার চোখে পড়ল তা আমি জানি না কিন্তু উনার কথা বিশ্বাস করে মনের ভেতরে আপনার জন্য রাগ, ক্ষোভ, সন্দেহ জমিয়ে রেখেছি এমন চিন্তা করা উচিত হয়নি উথমী। রাগ, ক্ষোভ, সন্দেহ জমিয়ে রাখার মতো মানুষ আমি নই। যা বলার তা আমি সরাসরি বলি। কাউকে ভালো না লাগলে তাকে আমি আমার জীবনের আশেপাশেও রাখি না। এই সামান্য একটা কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার মতো কাপুরুষ আমি নই। তাহলে তো আমার মা-বোনই জিতে যাবে। আপনার ধারণা আপনার রূপে পাগল হয়ে আমি বিয়ে করেছি। ছেড়ে দিলে এই মিথ্যা কথাটাও কিন্তু সত্য প্রমাণিত হবে। মিথ্যে কীভাবে সত্যি হতে দেই বলুন তো? আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। এই জীবনে আপনাকে আমি ছাড়ছি না। সে যাই হয়ে যাক না কেনো। আপনি নিজেও যদি আমাকে ছেড়ে যেতে চান তবুও না। তাই বলে আবার বিশ্বাস ভাঙতে যাবেন না কিন্তু।”

ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে উথমী। একজন পুরুষ মানুষ এতোটা ভালো হয় কী করে? ভেবে পায় না সে। ক্লান্ত শরীরের সব ভার ছেড়ে পূর্বের ন্যায় মুখ গুঁজে স্বামীর বুকে। এটাই যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ, দুঃখ লুকানোর জায়গা। এবারো তৈমূর বাঁধা দেয় না। বিয়ের পর থেকেই রমণীটির প্রতি কীভাবে যেনো খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে তার পুরুষ মন। রাগ করতে চেয়েও রাগ করতে পারে না, কড়া গলায় কথা বলতে চেয়েও বলতে পারে না। কোথাও একটা বাঁধা অনুভব করে।

এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পেরোলো। দুজনার মধ্যেই পাল্লা দিয়ে চলছে নিরবতা। উথমী নিজেই নিরবতা ভাঙলো,“ভাবী ফোন করেছিল। ঊষাকে নাকি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও। নিয়ে যাবেন আমায়? হাসপাতালের ঠিকানা আমার কাছে আছে।”

“পাওয়া গিয়েছে? কবে, কোথায়?”

“জানি না। সেসব কিছু বলেনি। খুব চিন্তা হচ্ছে ওর জন্য। বাবাও নাকি তাকে দেখার পর থেকে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

“আচ্ছা।”

“কখন যাবো?”

“দুপুর তো প্রায় হয়ে এসেছে। এখন বের হওয়া সম্ভব নয়। সাড়ে তিনটে বাজলে না হয় রওনা দিবো।”

সন্তুষ্ট হলো উথমী। তৈমূরকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চোখমুখ ভালো করে মুছে দরজার দিকে কদম ফেলে বললো,“আমি এখন নিচে যাচ্ছি।”

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)