জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-৩২+৩৩

0
15

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩২]

দুপুর সাড়ে বারোটা। সকাল থেকে আদরের কন্যার পছন্দসই খাবারগুলো নিজ হাতে রান্না করে টিফিন বক্স হাতে হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছেন কেয়া বেগম। রায়হান কবীর আজ আর আসেননি। উৎস ইচ্ছে করেই বাবাকে সঙ্গে করে আনেনি। গতকাল যা হলো! আজও যে তা হবে না তার নিশ্চয়তা কী?

কেবিনের দরজা ঠেলে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ভেতরে প্রবেশ করে সামনে আগ্ৰহভরা লোচনে তাকাতেই আত্মা কেঁপে উঠলো কেয়ার। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা ক্ষত-বিক্ষত, বিভৎস চেহারার মেয়েটিকে দেখে বিস্মিত হলেন। এগোনোর মতো সাহস পেলেন না। উৎস এগিয়ে এসে দাঁড়ালো মায়ের পাশে। কাঁধে হাত রেখে চাপা স্বরে শুধালো, “কি হলো? এখানে দাঁড়িয়ে পড়লে কেনো?”

ছেলের কণ্ঠস্বর শ্রবণালীতে পৌঁছাতেই অশ্রুসিক্ত নয়নে তার মুখপানে তাকালেন কেয়া। অনেক কষ্টে ঢোক গিলে শুধালেন,“কে এটা? আমার ঊষা কোথায়?”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো উৎস। ঘুমন্ত বোনের পানে তাকিয়ে উত্তর দিলো,“এটাই ঊষা।”

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কেয়া বেগমের। সেই অবিশ্বাস থেকেই হয়তো পুত্রের কাছে ভিন্ন কোনো উত্তর আশা করেছিলেন! কিন্তু উনার সেই আশা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে চোখের দেখাটাই সত্য প্রমাণিত হলো। মেয়েটির মলিন মুখশ্রীতে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলেন কেয়া বেগম। পরম মমতায় আঘাতপ্রাপ্ত কপালে হাত রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ক্রন্দনরত চাপা স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“আমার এতো সুন্দর মেয়েটার একি হাল? কীভাবে হলো? কে করল এমন?”

মায়ের প্রশ্নের কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারে না উৎস। তখনি নার্স এসে উপস্থিত হলো সেখানে। এগিয়ে গিয়ে স্যালাইনের পাওয়ার একটু কমালো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“ইনভেস্টিগেশনের জন্য পুলিশ এসেছিল। পেশেন্টের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কিছুক্ষণ আগেই চলে গেলেন। তারপর থেকেই উনার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হওয়ায় ডক্টরের কথায় ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। এখন চাইলেও আপনারা উনার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না।”

উৎস প্রশ্ন করল,“সব বলে দিয়েছে ঊষা?”

“সেসব জানি না। ভেতরে পুলিশ থাকাকালীন আমাদের ভেতরে থাকার অনুমতি ছিলো না বিধায় আমরা বাইরে ছিলাম।”—-বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন নার্স মেয়েটি।

তাদের মধ্যে চলমান কথার অর্থদ্বার বুঝতে পারলেন না কেয়া বেগম। তবে মেয়ের সঙ্গে যে অত্যন্ত খারাপ কিছু হয়েছে তা খুব ভালো করেই তিনি আঁচ করতে পারলেন। শেষ কবে মেয়ের গায়ে হাত তুলেছিলেন কেয়া? সেসব মনে করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। যতদূর মনে পড়ে, ছোটো কন্যার গায়ে তিনি কখনোই হাত তুলেননি। তার অন্যায়ের জন্য অধিকাংশ সময় উথমীকেই তিনি শাস্তি দিতেন, দোষারোপ করতেন। লেখাপড়া ব্যতীত মেয়েকে অবশ্য ধমকটাও তিনি দেননি। এমনকি কখনো যেতে দেননি রান্নাঘরের ধারে কাছে। সেই মেয়ের দেহে এতো ক্ষত? কোনো পাষন্ডের অত্যাচার ছাড়া তো এমনটা হওয়ার কথা নয়। এসব অত্যাচার কীভাবে সহ্য করেছে মেয়েটা? ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসে কেয়ার। মেয়ের যন্ত্রণা অনুভব করার চেষ্টা করতেই ভয়ে দেহের লোমকূপ জাগ্ৰত হয়ে ওঠে।

উৎস মাকে ডাকলো,“মা! শুনলে তো নার্স কী বলে গেলো? ওকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। এখন আর ওর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়। আমাদের বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত।”

ফিরে যাওয়ার কথা শুনতেই ধ্যান ভাঙলো কেয়ার। অধৈর্য হয়ে প্রত্যুত্তরে বললেন,“যাবো না আমি। ওর ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত, ওর সঙ্গে কথা না বলে কোথাও যাবো না। কতগুলো দিন পর আমি আমার মেয়েকে পেয়েছি!”

মাকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল উৎস কিন্তু ব্যর্থ হলো। কেয়া বেগম নাছোড়বান্দা। একবার যখন বলেছেন তিনি যাবেন না তার মানে কিছুতেই এখান থেকে যাবেন না। শেষমেশ মায়ের কথার পিঠে হার মেনে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো সে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন করল স্ত্রীকে। বাড়িতে যেতে দেরি হবে, সেটা তো জানাতে হবে!

শাহানার মনটা ভালো নেই। এ বয়সে এসে সামান্য সম্পত্তি নিয়ে ছেলে-মেয়েদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তিনি আর নিতে পারছেন না। আজ মেয়ের আচরণ দেখে বড়োই আশ্চর্য হয়েছেন তিনি। যেই মেয়ে ভাইদের চেয়ে বয়সে দ্বিগুণ বড়ো, ভাই অন্ত প্রাণ তার! সেই কিনা বাড়ির একটি অংশ ভাগের জন্য ঝগড়া করে চলে গেলো? কিছুতেই যেনো তা বিশ্বাস হচ্ছে না শাহানার। স্বামীর মতো চিরকালই তিনি চেয়ে এসেছেন ছেলে-মেয়েদের মধ্যকার সুন্দর, সমঝোতার সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক দেখে এতোকাল অবধি সন্তুষ্টও থাকলেও আজ যা হলো! এরপরেও সেই সন্তুষ্টি কী আর থাকে?

ছেলেরা বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে আসার পর থেকেই মাঝেমধ্যে অবশ্য তিথিয়া রাগ করতো তবে সেসব ভাই বউদের উপর কিন্তু আজ সে কীভাবে পারলো ভাইদের হিংসে করতে? ভেবে পান না শাহানা। মেয়েকে আজ বড্ড অচেনা লাগলো উনার নিকট। যার চোখে উনি ক্রোধ আর হিংসে দেখেছেন।

“আম্মা আসবো?”

কারো ডাকে হুঁশ ফিরলো শাহানার। বেখেয়ালি স্বরে অনুমতি দিলেন,“হ্যাঁ, এসো।”

শাশুড়ির অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করল জেবা। সঙ্গে নিয়ে আসা খাবারের প্লেটটা বিছানায় রাখলো। শাহানা খাবারের দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। জেবা বললো,“খাওয়ার জন্য আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম আম্মা। কিন্তু এসে দেখি আপনি নামাজ পড়ছিলেন।”

“হ্যাঁ, আজ একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল।”

“খেয়ে নিন।”

“সবাই খেয়েছে? তুরাগ, তৈমূর?”

“হ্যাঁ, তৈমূর খেয়ে বেরিয়েছে।”

“এই অবেলায় বেরিয়েছে? কোথায়? বললো না তো কিছু।”

“বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছে। উথমীর ভাবীর তো কয়েকদিন পর বাচ্চা হবে তাই হয়তো অসুস্থ। তৈমূর আপনাকে জানাতে এসেছিল কিন্তু ওই যে আপনি নামাজ পড়ছিলেন? তাই আমিই ওকে আসতে নিষেধ করেছি।”

“ওহ।”—-আর কিছু বললেন না শাহানা। সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির পর থেকেই তিনি নিরব। সেই নিরবতা পালন করেই হাত ধুয়ে প্লেটটি হাতে তুলে নিয়ে খাবার খেতে লাগলেন।
____________

দুপুরের ভোজন শেষে বাড়ি থেকে রওনা দিলেও তৈমূর এবং উথমীর হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয়ে গেলো সন্ধ্যা। কেয়া বেগম তখনও মেয়ের শিউরে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগেই ঊষার ঘুম ভেঙেছে। মাকে চোখের সামনে দেখে নিঃশব্দে কখন ধরেই কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটি। চরম লজ্জায় চোখে চোখ মেলাতে পারছে না। উৎস অনেকবার চেষ্টা করেও কিছুতেই মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এখনো বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেনি।

হাসপাতালের রিসেপশনিস্টের থেকে কেবিন নাম্বার জেনে নিয়ে সোজা উপরে চলে এলো উথমী। তৈমূর ঠিক তার পেছনে। হাঁটার গতি খুবই ধীর। নাম্বারের সাথে মিলিয়ে সঠিক কেবিনের সামনে আসতেই বড়ো ভাইয়ের দেখা পেয়ে গেলো উথমী। এগিয়ে এসে ডাকলো,“ভাইয়া!”

ঊষাকে চেকআপ করতে আসা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিল উৎস। কারো ডাকে পিছু ফিরে তাকালো। আরেক বোনকে দেখতে পেয়ে ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো তার। ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে এসে বিস্মিত স্বরে শুধালো,“তুই! এখন এখানে?”

“হু, আজ সকালেই ঊষার খবরটা পেলাম। এবারো তুমি কিংবা বাবা কেউ আমায় একবারও এ বিষয়ে জানাওনি। বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে এতোটা পর হয়ে গেলাম আমি? ঊষার জন্য কী আমার এতোদিন চিন্তা হয়নি?”

“কাল বিকেলে পুলিশের থেকে বাবা খবরটা পেয়েছে। তৎক্ষণাৎ সুস্থ বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে এলাম কিন্তু ফিরে গেলাম অসুস্থ বাবাকে নিয়ে। এতো চাপের মধ্যে জানানোর কথা মাথায়-ই ছিলো না। তোর ভাবী তো জানিয়েছে তাই না?”

“বাবা-মা কোথায়?”

“বাবাকে আনিনি। মা এসেছে, ভেতরে এখন।”

“আচ্ছা, আমি দেখে আসি।”—-বলেই আর সেখানে দাঁড়ালো না উথমী। দরজা ঠেলে প্রবেশ করল ভেতরে।

তৈমূর স্ত্রীর পিছুপিছু এসে কেবিনের সামনে দাঁড়ালো। তাদের ভাই-বোনের কথা সে কিছুই শুনতে পায়নি। দাঁড়িয়ে থাকা উৎসকে দেখেই সালাম দিলো। তৎক্ষণাৎ সালামের জবাব নিলো উৎস। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সঙ্গে কথা বলায় মশগুল হয়ে পড়ল।

মুখে অক্সিজেন মাস্ক থাকায় ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না ঊষা। কেয়া বেগম সেই কখন থেকেই মেয়ের মাথায় যত্ন সহকারে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ভেতরে প্রবেশ করে নিরবে সেসবই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলো উথমী। তারপর এগিয়ে এসে বিছানার উপরে তাকাতেই চমকে গেলো সে। বিষ্ময় প্রকাশ পেলো কণ্ঠে,“ঊষা!”

রায়হান কবীর বিছানায় পড়ে ঘুমাচ্ছেন। গতকাল রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে খাওয়া ঘুমের ওষুধের ডোজ এখনো কাটেনি। যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকেন ততক্ষণই যেনো শান্তি। জেগে উঠলেই চোখের অন্তরালে ভেসে ওঠে মেয়ের বিভৎস মুখ।

তনি তার বিড়াল ছানা নিয়ে সারা ফ্ল্যাট জুড়ে ছুটছে। রিনিতা অসংখ্যবার মেয়েকে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত। পেটটা তার অস্বাভাবিক রকমের বড়ো হয়েছে। উঠতে, বসতে অসম্ভব কষ্ট হয়। হাঁটতে গেলেই মাথা ঘুরায়। দিন যত যাচ্ছে ডেলিভারির ডেইট তত এগিয়ে আসছে। এই অবস্থায় সংসার তো দূরে থাক এমন বাঁদর মেয়েকে সামলাতেই তার হিমসিম খেতে হয়। শাশুড়ি আছে বলেই যা একটু রেহাই পাচ্ছে সে।

রান্নাঘর থেকে কিছু ফলমূল কেটে এনে সেন্টার টেবিলের উপরে রাখলো বুয়া চুমকি। বললো,“আমনে আবার এনে আইয়া বইয়া রইছেন ক্যান? ভাইজান ঘর থাইক্কা বারোইতে আমনেরে নিষেধ কইরা গেছে।”

“কীভাবে ঘরে বসে থাকি বলো তো? তনিটা ঘুম থেকে উঠতে পারলেই সারাক্ষণ ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। পরশুও পড়ে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছে। রাতে কি জ্বর তার! সেই ক্ষত স্থানই এখনো ভালো হয়নি অথচ উনার দুষ্টুমি কিছুতেই কমে না। আমি কী করি বলো তো? শরীর ভালো যাচ্ছে না। ওদিকে মা তো এখন ঊষাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। এই অবস্থায় সব সামলানো কী আমার পক্ষে সম্ভব? সব বিপদ যেনো একসঙ্গে এসে হাজির হয়েছে দোরগোড়ায়।”

চুমকি মলিন মুখে সেসব শুনে মুখ দিয়ে অল্প শব্দ বের করার মাধ্যমে দুঃখপ্রকাশ করে। রিনিতা পুনরায় বললো,“তনি কিংবা আইসক্রিম দুটোর মধ্যে যেকোনো একটাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এসো তো। তাহলেই আরেকটা সুরসুর করে চলে আসবে।”

কথাটাকে আদেশ হিসেবে মেনে তনির খোঁজে এ ঘর থেকে ও ঘরে চলে যায় চুমকি। এই ছোট্ট পাকা মেয়েটিকে তার পক্ষে ধরা অসম্ভব। চুমকির মনে পড়ে, নতুন যখন এ বাড়িতে কাজ করতে এসেছিল তখন কেয়া বেগমের কথায় গোসলের জন্য তনিকে ধরতে গিয়েছিল সে। মেয়েটা এতোটাই বিচ্ছু যে তার হাতে কামড় বসিয়ে দিলো? সেই ভয়ে তনিকে না ধরে আইসক্রিমকেই ধরে ফেললো চুমকি। তনি তা দেখে ফেললো। রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলো,“অ্যাই! তুমি আমাল আইতকিলিমকে ধরেছো ক্যানো? ছাড়ও ওকে।”

কথাটা শুনে আঁতকে উঠলো চুমকি। কোনোদিকে না তাকিয়ে একদৌড়ে চলে এলো রিনিতার কাছে। তার হাতে বিড়াল ছানাটিকে দিয়ে কেটে পড়ল রান্নাঘরে। তার পিছুপিছু তনিও দৌড়ে এসে থামলো মায়ের সামনে। অভিযোগের সুরে বললো,“ও আবাল আমার আইতকিলিমকে ছুঁয়েছে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো রিনিতা। বিড়ালকে ছেড়ে আহ সূচক শব্দ করে উঠলো। হাত বাড়িয়ে মেয়েকে ডাকলো,“কোথায় ছিলে তুমি? আমার মাথা আর পেটটা খুব ব্যথা করছে। তোমার দাদীও তো বাড়িতে নেই। কী করবো এখন?”

বাচ্চা হলেও পরিবার অন্ত প্রাণ ছোট্ট তনি। মায়ের ব্যথা শুনে দৌড়ে এসে সোফায় উঠে দাঁড়ালো সে। ছোটো ছোটো হাত দিয়ে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,“অনেক ব্যতা করছে আম্মু?”

“হ্যাঁ অনেক। তুমি কোথাও যেও না। আমার পাশে বসো দেখি।”

“বসলে ব্যতা সেরে যাবে?”

“হ্যাঁ যাবে।”

বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের পাশে বসলো তনি। এবার যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো রিনিতা। ফলের বাটিটা হাতে নিলো। টিভি ছেড়ে এক টুকরো আপেল মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরেক টুকরো গুঁজলো নিজের মুখে।
___________

সন্ধ্যা পেরিয়ে ধরণীতে রাতের আঁধার নেমেছে। রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে হাসপাতালের ভিড়ও কিছুটা কমে এসেছে। উথমীর মুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট। ছোটো বোনের যে এমন নৃশংস অবস্থা হবে তা যেনো কষ্মিনকালেও ভাবতে পারেনি সে‌। তারপর ভাইয়ের মুখ থেকে ডাক্তার আর পুলিশের বলা সমস্ত কথা শোনার পর থেকেই শরীরে কাঁপন ধরেছে তার। সেসব ভেবেই মস্তিষ্কে ভয়ংকর সব কৃত্রিম দৃশ্য ফোটে উঠছে। উথমী আবারো কেবিনে প্রবেশ করল। একটা চেয়ার টেনে বসলো। ঊষার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “যার সাথে পালিয়েছিলি সে তোর এই অবস্থা করেছে তাই না?”

বড়ো বোনের প্রশ্নটি শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই কেঁপে উঠলো ঊষা। ছোটো থেকেই শক্তপোক্ত কোনো কারণ ছাড়াই বড়ো বোনকে খুব হিংসে করতো সে। বোনকে কষ্ট পেতে দেখলে পৈশাচিক আনন্দ পেতো ঊষা। অথচ অন্যের ক্ষতি চাইতে গিয়ে আজ তার নিজেরই কত বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে গেলো! যেই ক্ষতি আর কখনো কোনো কিছুর দ্বারাই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। প্রশ্নের বিপরীতে মাথা নাড়ায় ঊষা। উথমী ফের প্রশ্ন ছুঁড়ে,“নাম কী ছেলেটার?”

চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। সঠিক কোনো উত্তর দেয় না ঊষা। মুখে কুলুপ এঁটে শুয়ে থাকে। উথমী জোর করে না। বরাবরই দুই বোনের মনের দূরত্বটা অনেক। যেই দূরত্ব এই স্বল্প সময়ে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো উথমী। মাথায় হাত দিতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে দিলো না। গুটিয়ে নিলো নিজ হাত। চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই এলোমেলো শব্দে, ভাঙা কণ্ঠে পেছন থেকে বলে উঠলো ঊষা,“চচলে যাচ্ছিস?”

কথার পিঠে থেমে দাঁড়ালো উথমী। ঘাড় ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করল,“হ্যাঁ, রাত হয়ে গিয়েছে। তোর দুলাভাই বাইরে অপেক্ষা করছে। যেতে হবে।”

“ভেতরে এলো না যে দুলাভাই?”

“আমিই নিষেধ করেছি। ভেতরে এসে তোকে এমন অবস্থায় দেখলে তুই নিজেই অপ্রস্তুত হতি।”—-বলে থামলো সে। পুনরায় বললো,“আজ তবে আসি।”

“কাল আবার আসবি?”

কথাটায় ভীষণ চমকালো উথমী। জিজ্ঞেস করছে নাকি সে চাইছে, উথমী আবার আসুক তাকে দেখতে? বুঝতে পারে না উথমী। শুধায়,“বাবা-মা, ভাইয়া তো আছেই। আমার আসা না আসাতে কী আসে যায়?”

হতাশ হলো ঊষা। চোখ চিকচিক করে উঠলো অশ্রুতে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে চোখ বুঁজলো। উথমী তা খেয়াল করল। কিন্তু তার মতিগতি কিছুই বুঝতে পারলো না। ঊষার কী পরিবর্তন হচ্ছে? কে জানে? নরম হলো উথমীর মন। ভাবুক কণ্ঠে বললো,“আসার চেষ্টা করবো। দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠ। আবার বাড়ি ফিরতে হবে তো নাকি?”

এবার কী খুশি হলো ঊষা? তাও জানে না উথমী। জানার চেষ্টাও করল না। নিজের কথার ইতি টেনে এদিক ওদিক না তাকিয়ে বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে।

কেয়া বেগম কেবিনের সামনের আসনে বসে আছেন। উৎস, তৈমূর ওখানেই দাঁড়ানো। উথমী ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতেই তাদের মুখোমুখি হলো। তৈমূর এগিয়ে এসে স্ত্রীকে শুধালো,“এখন বাড়ি ফিরবো তো?”

“হ্যাঁ।”

“আমি নিচে যাচ্ছি। আপনি আসুন তবে।”

একপাশে ঘাড় হেলিয়ে সায় জানায় উথমী। তৈমূর আর দাঁড়ায় না সেখানে। শাশুড়ি আর স্ত্রীর বড়ো ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় নিচে। উথমী ছোটো ছোটো কদম ফেলে মায়ের পাশে এসে বসে পড়ল। নিজেকে ধাতস্থ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে মা। আমরা চাইলেও এখন আর কিছু বদলাতে পারবো না। এমন ঘটনার পরেও যে মেয়েটা বেঁচে আছে এটাই তো অনেক। কষ্ট পেও না তা তোমায় বলবো না। কিন্তু নিজেকে সংযত করো। ভাইয়ার কথা শুনে বাড়িতে ফিরে যাও। তুমি দুর্বল হয়ে পড়লে বাবার কী হবে বলো তো?”

অশ্রুসিক্ত নয়নে বড়ো মেয়ের পানে তাকালেন কেয়া। নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, “যেই মেয়েকে জীবনেও একটা ফুলের টোকা লাগতে দেইনি সেই মেয়ের কী অবস্থা হলো?জানোয়ারগুলোর কষ্ট হলো না ওর গায়ে আঘাত করতে? ওদের ঘরে কী মেয়ে মানুষ নেই? কীভাবে পারলো খুবলে খেতে?”

“উত্তর তো তোমার কথার মধ্যেই আছে। ওরা জানোয়ার। জানোয়ারদের তো বিবেক থাকে না। ওরা মা, বোন, পরনারী কিচ্ছু মানে না।”

“সব দোষ আমার। আমিই ওকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি। মানুষ চেনাতে পারিনি। ছোটো থেকেই যদি একটু শাসন করতাম, সেদিন তুই বলার পরেই যদি একটা থাপ্পড় মারতাম, তোর বাবার করা অভিযোগের পর লাগাম টানতাম! তাহলে হয়তো আজ আমাকে এই দিন দেখতে হতো না। আমার মেয়েটার জীবনটা নষ্ট হতো না।”

জীবনের এতগুলো বছরে এই প্রথম মায়ের দুঃখ সামনে থেকে দেখছে উথমী। হঠাৎ করেই মাথায় প্রশ্ন জেগে ওঠে,“ঊষার জায়গায় আমি হলেও কী মা এমন করে কাঁদতো?”

ভাবনাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এমন সময়ে এমন একটি ভাবনা কীভাবে মাথায় আসে? উথমী ধিক্কার জানায় নিজেকে। মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। কী বলে সান্ত্বনা দিবে সে? পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায় উথমী। যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে সরে আসে সেখান থেকে। উৎস বোনের পাশে এসে দাঁড়ালো। বললো,“বেশ রাত হয়েছে। ভিজিটিং আওয়ার শেষ। আমিও মাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে এখনি বের হবো। তুইও রওনা দিয়ে দে।”

ভাইয়ের পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো উথমী। প্রসঙ্গ বদলে বললো,“তুমি অনেক টেনশনে আছো, তাই না ভাইয়া?”

অবাক হয় উৎস। শুধায়,“টেনশন? কীসের টেনশন?”

“এই যে তোমার জমানো কষ্টের টাকাগুলো নিয়ে ঊষা পালিয়ে গেলো। তোমার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। তার উপর আস্ত একটা সংসারের দায়িত্ব তোমার উপর। ভাবীর প্রেগন্যান্সির গুরুত্বপূর্ণ সময় চলছে। তার পেছনেও তো আর কম টাকা খরচ হচ্ছে না। সামনে আরো বেশি খরচ হবে। পরিবারে একজন সদস্য বাড়বে। তার উপর ঊষার এই অবস্থা। দায়িত্বের বেড়াজালে পড়ে ওর চিকিৎসার খরচও তোমার উপরেই বর্তায়। তোমাকে তো আমি চিনি। যত যাই হোক, মন থেকে না চাইলেও দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার মতো মানুষ তুমি নও।”

শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উৎস। লুকাতে চেয়েও আর কিছুই লুকাতে পারে না সে। অজ্ঞতা স্বীকার করে বলে,“গত দেড় বছর ধরে প্রমোশন আটকে আছে। এর জন্য অবশ্য আমি নিজেই দায়ী। ঠিকমতো কাজে মন দেই না, কয়েকদিন পরপর অফিস বন্ধ দিতাম। সুদ আসবে বলে জমানো টাকাগুলো কখনো ব্যাংকে রাখিনি। যা বেতন পাই তার অর্ধেকটাই সংসারের পেছনে খরচ হয়ে যায়। তাই একটু চিন্তায় আছি তবে আশা হারাইনি। আল্লাহ আছেন। তিনিই একটা না একটা পথ নিশ্চয়ই দেখাবেন।”

“কিন্তু আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“কী সিদ্ধান্ত?”

“ঊষার চিকিৎসার যাবতীয় সব খরচ আমি নিজে বহন করবো। বাবা-মা, বোনের প্রতি আমারও তো কিছু দায়িত্ব আছে তাই না?”

অবাক হলো উৎস। দ্বিমত পোষণ করে বললো,“কী বলছিস উথমী? এ সম্ভব নয়। তুই এখন বিবাহিতা। তুই কীভাবে?”

“আমি ভালো একটা চাকরি করি ভাইয়া। কলেজ, ভার্সিটিতে থাকাকালীন বাবা-মায়ের আড়ালে কম হাত খরচ তো তুমি দাওনি আমায়? বিয়েটাও তুমিই নিজ দায়িত্বে দিয়েছো‌। এতোকিছুর পরেও কীভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে যাই বলো তো?”

“কিন্তু?”

“কোনো কিন্তু নয়। মাস শেষে আমার টাকাটা অলস পড়ে থাকে। সব খরচ তৈমূর সাহেবই দেয়। আমার টাকা নিয়েও উনার কোনো মাথাব্যথা নেই। টাকা যদি কাজে না আসে সেই টাকা উপার্জন করে লাভ কী? তুমি আর কোনো বাঁধা দিও না ভাইয়া। এই দায়িত্বটা আমার। তুমি শুধু একটু হলেও চাপমুক্ত থাকো।”

ছোটো বোনের কথায় আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে উৎসের মন। চোখে অশ্রু জমে তার। ভাগ্যিস এই বিপদে এসে পাশে দাঁড়ালো বোনটা! নইলে কী হতো? কীভাবে সব সামাল দিতো উৎস?

চলবে __________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৩]

সকালের নাস্তায় নিজের বানানো পুডিং পরিবেশন করে একটি চেয়ার টেনে বসলো উথমী। তা দেখতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো তনি। আনন্দিত কণ্ঠে শুধালো,“পুদিং! এটা কখন বানালে পুপি?”

“হুহুম ম্যাজিক! এখন খেয়ে বল কেমন হয়েছে।”

বলতে দেরি হলেও চেখে দেখতে দেরি হলো না তনির। মিষ্টি জাতীয় খাবার বরাবরই মেয়েটির খুব পছন্দের। গত রাতেই মোবাইলে দেখে মায়ের কাছে পুডিং খাওয়ার বায়না ধরেছিল সে। সেই বায়না ভুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতেই অনেক রাত হয়ে গেলো রিনিতার! কিন্তু সেকথা উথমীর কান পর্যন্ত সেই রাতেই পৌঁছে গিয়েছিল। যতই হোক ভাইঝির আবদার বলে কথা! না মেটালে কী আর হয়? তাই আর বিলম্ব না করে রাতে উঠেই পুডিং তৈরি করে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল সে। বিয়ের আগেও বাপের বাড়িতে থাকতে রোজ রোজই বাড়িতে কিছু না কিছু তৈরি করতো উথমী।

চামচ দিয়ে একটু একটু মুখে পুরে শব্দ করে খেতে খেতে তনি বলে উঠলো,“উমম অনেক তেস্টি হয়েছে পুপি!”

বিপরীতে মুচকি হেসে আরেক টুকরো তার প্লেটে তুলে দিলো উথমী। বাবার বাড়িতে সে এসেছে আজ নিয়ে তিনদিন। বাবা, বোন, ভাবী তিনজনেই অসুস্থ। উৎস সারাদিন কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকে। ফিরতে ফিরতে তার রাত হয়। ওদিকে ছোটো কন্যাকে পেয়ে সংসারের সব দায় দায়িত্ব ভুলে বসেছে মা কেয়া। যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন ততক্ষণই থাকেন অন্যমনস্ক। এই দুরাবস্থায় কাউকে না কাউকে তো সংসারের হাল ধরতে হবে নাকি? সেসব চিন্তা করেই সেদিন রাতে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে ঠান্ডা মাথায় উথমী সিদ্ধান্ত নেয়, যতদিন না সব ঠিক হচ্ছে ততদিন সে বাবার বাড়িতেই থাকবে। জোহানের স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়ায় তুরাগ, জেবা বেশ কয়েকদিন আপাতত ফুলকুঞ্জেই আছে। ইদ পালন করে তারপর তারা ফিরে যাবে। তাই এখন বাড়ি থেকেই অফিসে যাতায়াত করছে তুরাগ। যার কারণে উথমী কয়েকদিন না থাকলেও সেখানে কারো কোনো অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু কথাগুলো তৈমূরকে জানাতেই সে বেঁকে বসলো। কিছুতেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বাবার বাড়িতে বউকে সে ছাড়বে না। এ নিয়েই দুজনার মধ্যে পুরো দুই রাত একদিন মনমালিন্য চলার পর শাহানার কান পর্যন্ত কথাটা কীভাবে যেনো পৌঁছে গেলো। সবচেয়ে বড়ো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজিও হয়ে গেলেন। ছেলেকে ডেকে নিয়ে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়ে তারপর পুত্রবধূকে কয়েকদিনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন বাবার বাড়ি।

সে বিষয়ে যে এখনো তৈমূর রেগে আছে তা উথমীর অজানা নয়। গতকালও লোকটা একবারের জন্যও তাকে কল দেয়নি। এমনকি রাতে উথমী নিজে কল দিলেও সেই কল সে রিসিভ করেনি। এসব কী মানা যায়? মোবাইল হাতে নিলো উথমী। উৎস বেশ কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। কেয়া বেগম চলে গিয়েছেন হাসপাতালে ঊষার কাছে।আজকেই তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। তার মানে তৈমূরও নিশ্চয়ই অফিসের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছে? যদি বের হয় তাহলে তো এখন সে রাস্তায়।

সকল ভাবনার অবসান ঘটিয়ে আর দেরি না করে কল দিলো স্বামীর নাম্বারে।কয়েক সেকেন্ড রিংটোন বাজতে বাজতেই কল কেটে দিলো তৈমূর। স্বামীর এমন কাজে বিস্মিত হলো উথমী। মুখ ভার করে মোবাইল রাখতে যাবে এমন সময় সেই একই নাম্বার থেকে কল ব্যাক এলো। লোকটির মতো কল রিসিভ করতে উথমী মোটেও বিলম্ব করল না। রিসিভ করে চুপচাপ কানে ধরে রাখলো মোবাইলটি। বিপরীত পাশ থেকে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠস্বর,“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়া আলাইকুমুসসালাম।”

“কেমন আছেন?”

প্রশ্নটির উত্তর দিলো না সে। নিজ থেকে তো একবারও কল দিলি না। যেই আমি কল দিলাম সেই কেমন আছেন জিজ্ঞেস করছিস? ব্যাটা বজ্জাত! মনে মনে কথাগুলো আওড়ালেও মুখে বলার সাহস দেখালো না উথমী। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“গতকাল রাতে আমি আপনাকে দুবার কল দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তা রিসিভ করা তো দূরে থাক একবারও ব্যাক দেননি। টেক্সট দিয়েছিলাম কিন্তু সিন করেননি। হুয়াই? রাতে কোথায় ছিলেন? সত্যি করে বলুন।”

একনাগাড়ে করা এতোগুলো প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেলো তৈমূর। উত্তর দেওয়ার জন্য সময় নিলো কিন্তু বিপরীত পাশ থেকে অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে পুনরায় উথমী বলে উঠলো,“মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা করবেন না। কাল রাতে আপনি অনেক দেরি করে বাড়ি ফিরেছেন তা আমি জানি। এমনকি পরশু রাতেও ফিরতে আপনার দেরি হয়েছে।”

“আজ রাতেও হবে।”

স্পষ্ট উত্তরে ভীষণ অবাক হয় উথমী। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“কেনো? বউ বাড়িতে নেই বলে কী অন্য কোথাও অভার টাইম করে পুষিয়ে দিতে হচ্ছে?”

হাসবে নাকি অবাক হবে? দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে শব্দ করে হেসে উঠলো তৈমূর। তার হাসিতে যান্ত্রিক ফোনের অপরপাশে বসে থাকা রমণীর শরীরটা যেনো রাগে জ্বলে উঠলো। কিন্তু কিছু বললো না। উত্তরের আশায় নিরব রইলো। তৈমূর নিজেকে ধাতস্থ করে কোমল স্বরে বললো,“চাচীর মৃত্যুতে যে অফিসে কয়েকদিন যেতে পারিনি সেই কাজের কী হবে? আমার কাজ নিশ্চয়ই অন্য কেউ করে দিয়ে যাবে না? তাছাড়া আজ অফিসে ইদের জন্য ছুটি দিয়ে দিবে তাই আজও ফিরতে দেরি হবে।”

কিছুটা শান্ত হলো উথমী। ছোট্ট করে বিপরীতে বললো,“আচ্ছা।”

“মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় ফোনকল দেখতে পাইনি। বাড়িতে ফিরেও আর মোবাইল চেক করা হয়নি, স্যরি।”

শেষ শব্দটিতে প্রশান্তি অনুভব করল উথমী কিন্তু তা বুঝতে না দিয়ে শুধালো,“বিকাশে দেখলাম টাকা এসেছে। এতোগুলো টাকা কীসের জন্য? কেনো পাঠিয়েছেন?”

“কেনো আবার? ইদের শপিং এর জন্য। শপিং করবেন না?”

“কোরবানি ইদে কে আবার শপিং করে?”

শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৈমূর। বললো,“বিয়ের পর আমাদের প্রথম ইদ হওয়ায় বউকে শপিং করে দেওয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব। নইলে পরে তো আবার আমায় কিপটে বলবেন।”

“আপনি তো কিপটেই। যাই হোক, তাই বলে শপিং এর জন্য এতোগুলো টাকা?”

“আপনার একার জন্য নয়। আমার শ্বশুরবাড়ির সবার জন্য পাঠিয়েছি। যেহেতু আপনি এখন ওখানে আর আমিও ব্যস্ত তাই শপিং এ যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া কে কেমন পোশাকে কমফোর্টেবল তাও আমি জানি না তাই আপনি নিজ দায়িত্বে সবার জন্য কেনাকাটাটা করে ফেলবেন প্লিজ। আর হ্যাঁ বিকেলের আগেই আরো কিছু পাঠাবো। সেসব দিয়ে আম্মা, বুবু, ভাবী আর ছোটো চাচীর জন্য মোট চারটি শাড়ি কিনবেন।”

“আমি?”

“হ্যাঁ, বললাম না আমার সময় নেই। দেরি করবেন না বলে দিলাম। আজই মলে যাবেন। দুদিন পরই তো ইদ।”

উত্তর দিলো না উথমী। তৈমূর রয়েসয়ে জিজ্ঞেস করল,“ইদ ওখানেই করবেন?”

“যদি করি?”

“আচ্ছা।”

“আপনার আপত্তি আছে?”

“আমার আপত্তি দিয়ে আপনার কী? যা ইচ্ছে করুন গিয়ে। পরে কিছু বলতে গেলে সব দোষ হয়ে যাবে আমার। রাখছি এখন। আল্লাহ হাফেজ।”

নিজের কথাটুকু শেষ করেই কল কেটে দিলো তৈমূর। তার এহেন কাজে নিঃশব্দে হেসে উঠলো উথমী।এখনো যে ব্যাটা রেগে আছে তাও সে খুব সহজেই বুঝতে পেরে গেলো। ফুফুর হাসি দেখে খাওয়া থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো তনি। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“হাসছো ক্যানো?”

প্রশ্নটি শুনতেই ভাতিজির মুখপানে তাকায় উথমী। খেতে খেতে সারামুখে খাবার মাখিয়ে ফেলেছে তনি।পরনের পোশাকেও চিনির রসে টইটম্বুর। চেয়ারের উপর থেকে হাত মুছার তোয়ালেটা নিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে উথমী বললো,“তোকে দেখে। কী অবস্থা করেছিস মুখের? চল গোসল করিয়ে আনি।”

“এখন না।”

“এখনি করতে হবে, চল।”—-বলেই তনির হাত ধরে চেয়ার থেকে নামিয়ে বাথরুমের দিকে হাঁটা ধরলো উথমী।
______________

বাড়িতে ইদের তোড়জোড় শুরু হয় গিয়েছে। মালতী ফুফুসহ আরো দুজন ছুটা মহিলা মিলে পুরো বাড়ি ঝাড়ু দিচ্ছেন। জেবা আর সূচি মিলে করছে ফ্রিজ পরিষ্কার। প্রতিবারের মতো এবারও মঈনুদ্দিনরা এখানেই পালন করবেন ইদ।

করবী ড্রয়িং রুমে বসে বাজারের ফর্দ লিখছেন। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে সোফায় বসলেন শাহানা। হাঁক ছেড়ে বললেন,“ফ্রিজ পরিষ্কার করা শেষ হলে স্টোর রুম থেকে বড়ো বড়ো হাঁড়িগুলো ফজলুলকে দিয়ে বের করিয়ে বাগানে নিয়ে রেখো। ওগুলোতেই তো রান্না হবে।”

কথাগুলো শুনতেই হাতের কাজ ফেলে রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে অন্দরমহলে উঁকি দিলো জেবা। প্রত্যুত্তরে বললো,“ওগুলো একেবারে কাল বের করবো আম্মা। যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে। এখন বাইরে বের করে রাখলে আরো ময়লা হবে। এর থেকে কাল বের করে পরিষ্কার করাবো। ইদ তো পরশু।”

পুত্রবধূর কথাই মেনে নিলেন শাহানা। ভুল কিছু সে বলেনি। তাই বিপরীতে মাথা নাড়ান। শাশুড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে জেবা চলে গেলো নিজের কাজে। করবী তখনো কলম দিয়ে কাগজটিতে লিখে যাচ্ছে। লিখতে লিখতেই জায়ের উদ্দেশ্যে বললো, “কাল বাদে পরশু ইদ। তা আপনার ছোটো ছেলের বউ কবে আসবে? নাকি প্রথম ইদ ওখানেই করবে?”

“জানি না। তবে যাওয়ার আগে বলে দিয়েছি, ইদের আগেই যেনো বাড়ি চলে আসে।”

“তা হঠাৎ বউকে বাপের বাড়িতে ছাড়তে রাজি হলেন যে? আপনি তো মোটেও আমার মতো ভালো শাশুড়ির কাতারে পড়েন না।”

কথাটা শুনে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন শাহানা। করবী আড়চোখে তা দেখলো কিন্তু পাত্তা দিলো না। পুনরায় বললো,“উত্তর দিচ্ছেন না যে?”

“ওর ভাই বউ নাকি পোয়াতি। তার উপর সেই মেয়ের আবার ছোটো একটা বাচ্চাও আছে। ওদিকে ছোটো বউয়ের বোনও অসুস্থ। শুনলাম কী একটা দুর্ঘটনা নাকি হয়েছে। যার কারণে তার বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ছোটো মেয়ের দেখভাল করতে করতেই তার মা হিমশিম খাচ্ছে। সংসারের অমন অবস্থায় কাউকে না কাউকে তো হাল ধরতেই হতো নাকি? যদিও তৈমূর রাজি ছিলো না কিন্তু আমার খুব খারাপ লেগেছে। যতই হোক এমন দুর্দিন তো আমিও পেরিয়ে এসেছি। তাই আর না করতে পারিনি।”

“তাহলে তো মনে হয় না ছোটো বউ এখন এখানে আসতে পারবে। কি এক ঝামেলা! পরিবারের সবার একসঙ্গেই অসুস্থ হতে হলো?”

উত্তর দিলেন না শাহানা। ছেলের ঘরে কী একটা প্রয়োজনে যেনো গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভেতরে প্রবেশের আগেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছেলে আর ছেলে বউয়ের কিছু কথোপকথন শুনে হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়ে গেলো ভদ্রমহিলার। তারপর আর এক মুহূর্তও দেরি না করে সেদিন রাতেই ছেলেকে নিজ ঘরে ডেকে এনে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে পরেরদিন পুত্রবধূকে বাপের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলেন তিনি।

লুঙ্গির এককোণ ডান হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে বাড়িতে প্রবেশ করলেন মঈনুদ্দিন। ক্লান্ত দেহ নিয়ে সোফায় বসে হাঁক ছেড়ে বললেন,“বউমা! এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়ে যেও তো।”

করবী স্বামীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“হাটে গিয়েছিলে? এহসান কোথায়?”

“হ্যাঁ, সেখান থেকেই তো এলাম। দু দুটো গরু কিনেছি বুঝলে? মাশাআল্লাহ কি সুন্দর গরু দুটো! এহসান এখন ওখানেই আছে।”

“তা কত দাম পড়ল? বাড়িতে আনছো কবে?”—- শাহানা জিজ্ঞেস করলেন।

“দাম আলহামদুলিল্লাহ ভালোই পড়েছে ভাবী। ফজলুলকে বলে দিয়েছি, গ্যারেজের সামনের জায়গাটা পরিস্কার করে রাখতে। রাতে তুরাগ ফিরলেই এহসানের সাথে গিয়ে নিয়ে আসবে না হয়।”

“যাক গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই শেষ হলো। বাদ বাকি কাজ ভালোভাবে মিটলেই হয়।”—বলতে বলতে বসা থেকে উঠে প্রস্থান করলেন শাহানা।
___________

প্রকৃতি আজ ভীষণ শান্ত। নিয়মমাফিক ধরণীতে রাত নেমেছে। অন্ধকার পথে সোডিয়ামের আলো জ্বলে সেই অন্ধকারও নিঃশেষ হয়েছে। মাগরিবের নামাজ শেষে বাড়িতে এসে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে সোফায় কেবল বসেছিলেন রায়হান কবীর! তখনি অধৈর্য হয়ে কলিং বেলটা বেশ কয়েকবার বেজে উঠলো। চুমকি হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে এসে দরজা খুলতেই বেশ অবাক হলো। চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম প্রায়। দরজার সম্মুখে এভাবে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেগে গেলেন কেয়া। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলেন,“সামনে থেকে সরছিস না কেনো?”

তেজস্বী ধমকে নড়েচড়ে উঠলো চুমকি। আর এক মুহূর্তও সময় ব্যয় না করে সরে দাঁড়ালো দরজার সামনে থেকে। সে সরতেই মা-ছেলে একসঙ্গে ধরাধরি করে ঊষাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। চুমকি গিয়ে দরজা আটকালো। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,“আয়হায়! ছুডু আফার এমন অবস্থা ক্যা?”

তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না কেউ। রায়হান কবীর হাত থেকে চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এসে অশান্ত হয়ে বললেন,“ওকে বাড়িতে নিয়ে এলি যে? হাসপাতাল থেকে এতো তাড়াতাড়ি রিলিজ দিয়ে দিলো?”

উৎস আর কেয়া বেগম মিলে ঊষাকে তারই ঘরের বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলো। চুমকিকে দিয়ে সকালেই ঘরটা পরিস্কার করিয়েছিলেন তিনি। উৎস প্রত্যুত্তর করল,“ডাক্তার ওকে আরো কয়েকদিন রাখার জন্য বলেছিলেন কিন্তু মা এমন পাগলামো শুরু করল না? এমনকি ঊষাও ওখানে আর থাকতে চাইছিল না তাই!”

“ওহ।”—-মেয়ের মাথায় হাত রেখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন রায়হান কবীর। তারপর সেখানে আর না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে।

ছোটো মেয়েকে বিছানায় শুইয়েই কেয়া বেগম হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,“উথমী! উথমী!”

উনার ডাক শুনে চুমকি এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে। বললো,“বড়ো আফায় বাড়িত নাই। আসরের নামাজ পইড়াই তনিরে লইয়া বাইরে গেছে।”

“বাইরে গেছে? বাইরের কোথায় গেছে?”

“তা জানি না। আমারে কিছু কয় নাই। ভাবীরে জিগান।”

“আচ্ছা এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আয় গিয়ে।”

মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো চুমকি। উৎস ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে গেলো,“আগে হাত-মুখ ধুয়ে এসো মা। তারপর ওর পোশাকও বদলে দাও। পরে যা খাওয়ানোর খাইয়ে দিও।”

ঘরের ভেতরেই বাইরের কিছু কথাবার্তা কান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে রিনিতার। ছোটো ননদের ফেরার সংবাদ শুনতেই আর ঘরে বসে থাকতে পারলো না সে। অতি কষ্টে বিছানা থেকে নেমে দরজা ঠেলে ঘর থেকে বেরোতেই মুখোমুখি হলো স্বামীর। স্ত্রীকে দেখে ললাটে ভাঁজ পড়ল উৎসের। শুধালো,“কোথায় যাচ্ছো?”

“ঊষা এসেছে না? একটু দেখে আসি।”

“সাবধানে যেও।”

উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে দেয়াল ধরে ধরে সামনে এগোতে লাগলো রিনিতা। পেছন থেকে উৎস পুনরায় শুধালো,“তনিকে নিয়ে কোথায় গিয়েছে উথমী? শুনেছি বিকেলে বের হয়েছে অথচ এখনো ফেরেনি?”

যেতে যেতেই উত্তর দিলো রিনিতা,“আইসক্রিম খাবে বলে তোমার মেয়ে বিকেল থেকেই বায়না করছিল তাই তোমার বোন ভাতিজির বায়না মেটাতে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ফোন করেছিলাম, বললো চলে আসবে।”

চিন্তামুক্ত হয়ে ঘরে পা রাখলো উৎস। ছেলের কথা মেনে নিয়ে পোশাক বদলে হাত-মুখ ধুতে ঘরে চলে গেলেন কেয়া। চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে ঊষা। মুখের আঁচড় প্রায় শুকিয়ে আসছে। গলায় পাঁচ আঙুলের দাগটাও প্রায় অস্পষ্ট। ঘরে প্রবেশ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেসবই কিছুক্ষণ দেখলো রিনিতা। তারপর বিছানার ফাঁকা স্থানে গিয়ে নিরবে বসলো। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে তাকালো ঊষা। ভাবীকে দেখতেই মলিন হাসলো। জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছো ভাবী?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

“আমায় জিজ্ঞেস করবে না কেমন আছি?”

কথাটায় এতোই মায়া ছিলো যে চোখ জোড়া ভিজে উঠলো রিনিতার। কী বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। বাইরে পুনরায় কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। সেই শব্দে দুজনের কানই খাঁড়া হয়ে উঠেছে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে দরজা খুলে দিলো চুমকি। ভেসে এলো উচ্ছ্বসিত বাচ্চা কণ্ঠস্বর। বাড়িতে প্রবেশ করতে না করতেই শুরু হয়ে গেলো ডাক,“আম্মু! কুতায় তুমি?”

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রিনিতা। ঊষার উদ্দেশ্যে বললো,“ওই যে তনি আর উথমী চলে এসেছে! তুমি বিশ্রাম নাও ঊষা, আমি গিয়ে দেখে আসি। নইলে তনি আবার এখানেই চলে আসবে।

দুহাত ভর্তি শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সোফায় বসে পড়ল উথমী। চুমকি দরজা আটকেই দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে তার সামনে ধরে বললো,“হায় আল্লাহ আফা! আমনে দেহি পুরা মার্কেট তুইল্লা আনছেন?”

মুচকি হেসে গ্লাসটি হাতে নিয়ে পানি পান করল উথমী। তারপর টেবিলের ওপর গ্লাসটি রেখে মেঝেতে লাইন ধরে রাখা ব্যাগগুলো থেকে একটি ব্যাগ হাতে তুলে নিলো। চুমকির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “এইটা তোর ইদের উপহার। নে ধর।”

মুখশ্রীতে হাসি ফোটে উঠলো চুমকির। আনন্দিত হয়ে বলে উঠলো,“কি কন আপা! রোজার ইদেও না কাপড় দিলেন? এই ইদেও আবার?”

“আমি দিচ্ছি না। এটা তোর দুলাভাইয়ের তরফ থেকে ইদের উপহার।”

“তাইলে দুলাভাইরে আমার তরফ থাইক্কা থাঙ্কু দিয়া দিয়েন।”

“আচ্ছা দিয়ে দিবো। এবার সবাইকে ডেকে নিয়ে আয় তো।”

ব্যাগটা রান্নাঘরের একপাশে রেখে চুমকি দৌড়ে চলে গেলো সবাইকে ডাকতে। রিনিতা ধীর পায়ে এসে সোফায় বসলো। উৎস, রায়হান কবীর, কেয়াসহ একে একে সবাই বেরিয়ে এসে উপস্থিত হলো ড্রয়িং রুমে। তনি দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো বাবার কাছে। হাতের বেশ বড়ো পুতুলটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখিয়ে বললো,“পাপা দেখো দেখো টেডিটা সুন্দর না? পুপি কিনে দিয়েছে।”

“হ্যাঁ সুন্দর।”—-বলেই মেয়েকে কোলে তুলে নিলো উৎস। বোনের উদ্দেশ্যে বললো,“এসব কী করেছিস উথমী? এতোগুলো শপিং ব্যাগ! তুই শপিং করতে গিয়েছিলি?”

সবার জন্য আনা নির্দিষ্ট ব্যাগগুলো একে একে সবার হাতে তুলে দিতে দিতে উথমী উত্তর দিলো,“হ্যাঁ। গত রাতেই তোমাদের জামাই সবার জন্য কেনাকাটা করতে টাকা পাঠিয়েছে। অফিসের কাজ প্লাস কোরবানির ইদ! একটু চাপ যাচ্ছে, বোঝোই তো? তাই আমাকেই শপিং করার কথা বলে দিলেন। কাল আমি চলে যাচ্ছি তাই আজই গিয়ে করে নিয়ে এলাম।”

“তুইও না একটু বেশিই বুঝিস। জামাই বলেছে বলেই তুই গিয়ে এতোকিছু কিনে নিয়ে এলি? কতগুলো টাকা নষ্ট!”—-কেয়া বেগম কিছুটা রাগ দেখিয়েই মেয়ের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললেন।

মায়ের কথায় পাত্তা দিলো না উথমী। ভাই-ভাবীরটা ভাবীর হাতে তুলে দিলো‌। রায়হান কবীর মন খারাপ করে বললেন,“নিজেকে খুব অপারগ লাগছে, লজ্জা করছে। বিয়ের পর এই প্রথম শ্বশুরবাড়িতে তোর ইদ অথচ আমি কিছুই দিতে পারলাম না।”

বাবার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো উৎস। মিনমিনে স্বরে বললো,“এবারের ইদ নিয়ে কত আশা ছিলো! কিন্তু কী হয়ে গেলো? কোরবানি না দিলেও তো আর হয় না। তাই এবার নিচ তলার ফ্ল্যাটের বাবুল, আশিক আঙ্কেলদের সাথে ভাগে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব বিপদ একসাথেই আসতে হলো।”

বাবা, ভাইয়ের কথা শুনে চুপ রইলো না উথমী। বললো,“যেমন আছি তাতেই আলহামদুলিল্লাহ বলো। তোমরা যতটুকু ভালো আছো অনেক মানুষ ততটা ভালোও নেই। বরং ভালো থাকা তো দূরে থাক তাদের অবস্থা এরচেয়েও খুব খারাপ। কোরবানি মানে রবের সন্তুষ্টি অর্জন করা। ভাগে দিচ্ছো নাকি পুরোটা দিচ্ছো সেটা বিষয় নয়। তাছাড়া ইদে যে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এই সেই পাঠাতে হবে এমন কোনো ধরা বাঁধা নিয়মও নেই। আমার স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির মানুষদের মন মানসিকতা যথেষ্ট ভালো।”

রায়হান কবীর আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন, “আমি ওসব ভেবে বলিনি মা‌। তারপরেও সামাজিক একটা নিয়ম আছে!”

বাকি কথাটুকু বাবাকে শেষ করতে দিলো না উথমী। বাঁধা দিয়ে বলে উঠলো,“এসব নিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাই না বাবা। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগে সেটা শোনো।”

“কী সিদ্ধান্ত?”

“তনিকে কাল আমার সাথে নিয়ে যাবো। এবারের ইদ না হয় ও আমার সাথে ওখানেই করবে।”

কথাটা শেষ হতেই উৎস অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বললো, “এটা সম্ভব নয়। আমরা ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”

“সামলাতেও তো পারবে না। সারাদিন ব্যস্ত থাকো, ভাবী তো নড়তে চড়তেই পারে না। তার উপর ঊষাও তো বাড়িতে ফিরে এসেছে। ওকে এই অবস্থায় দেখলে তনির মানসিক বিকাশে সমস্যা হবে। এর থেকে আমার সাথেই চলুক। ওখানে অনেক মানুষ আছে, আমার জায়ের ছোটো ছেলে আছে, আবার আমার কাছে তনি সবচেয়ে শান্তও থাকে। কোনো সমস্যা হবে না। বাচ্চা মানুষ, কয়েকদিন বেড়ানো শেষ হলে না হয় আবার দিয়ে যাবো। আমার কাছে তো আর খারাপ থাকবে না।”

কথাটা শুনে সকলে ভাবনায় পড়ে গেলো। উথমী বাকি ব্যাগগুলো নিয়ে নিজের ঘরে হাঁটা ধরলো। বললো,“ফ্রেশ হয়ে এসে ঊষার সঙ্গে দেখা করবো।”
____________

মেয়েকে গরম গরম এক গ্লাস দুধ খাইয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে এসেছেন কেয়া বেগম। ফ্রিজ থেকে মুরগীর মাংস বের করে ভিজিয়ে রেখে স্যুপ তৈরি করার জন্য সবজি কাটছেন। উথমী দুটো ব্যাগ হাতে প্রবেশ করল ছোটো বোনের ঘরে। বিছানায় এসে বসে ডাকলো,“জেগে আছিস?”

চোখ মেলে চাইলো ঊষা। উঠে বসার ব্যর্থ চেষ্টা করতেই উথমীকে তাকে সাহায্য করল। পিঠের পেছনে বালিশ উঁচু করে দিয়ে বসিয়ে দিলো। তারপর ব্যাগ দুটো খুলে ভেতর থেকে বের করল সুন্দর একটি থ্রি পিস সেট আর জুতা। বললো,“এগুলো তোর দুলাভাইয়ের তরফ থেকে। এবারের ইদের নতুন কালেকশন! কেমন হয়েছে? এবার কিন্তু নাক সিঁটকানোর সুযোগ পাবি না। একেবারে তোর প্রিয় কালো রঙেরটাই দেখে এনেছি।”

মলিন দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো ঊষা। বেখেয়ালি কণ্ঠে বললো,“খুব সুন্দর কিন্তু আমার গায়ে এসব মানাবে না আপু। আমার দেহ যে নোংরা, অপবিত্র হয়ে গিয়েছে। এই নোংরা গায়ে আর কিচ্ছু মানাবে না।”—-কথাটা বলতে বলতেই তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা পানি।

উথমী দেখেও না দেখার ভান ধরলো। কীভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় তা তার জানা নেই। শুধু বললো,“যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। সেসব ভুলে নতুন করে তোর সব শুরু করা উচিত।”

বড়ো বোনের পানে তাকালো ঊষা। আচমকাই প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তুই কী আমার উপরে রেগে আছিস আপু?”

এহেন প্রশ্নে হতচকিত হলো উথমী। জিজ্ঞেস করল, “হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”

“না মনে হলো।”—-থামলো ঊষা। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে মোলায়েম কণ্ঠে বললো,“পারলে আমায় মাফ করে দিস। এই জীবনে তোকে হিংসে করে কত অপমানই না আমি করেছি? সুযোগ পেলেই মায়ের সামনে ছোটো করেছি, তোর প্রাক্তন প্রেমিক নিয়েও অপমানজনক কথা বলেছি। অথচ দেখ! সেই শাস্তি আমি দুনিয়াতেই পেয়ে গেলাম। ভালোবেসে খুব বাজে ভাবে ঠকে গেলাম। অথচ সেই তুই! কী সুখেই না আছিস? ভালো চাকরি করছিস, ভালো স্বামী পেয়েছিস, মন দিয়ে সংসার করছিস। আবার তোকে সারাজীবন হিংসে করে আসা বোনের সব দায়িত্বও নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিস। আমার এই মুহূর্তে কেমন অনুভূতি প্রকাশ করা উচিত? কী করা উচিত? লজ্জায় মরে যাওয়া উচিত নাকি কৃতজ্ঞতায় তোর পা ধরে মাফ চাওয়া উচিত? বল না।”

অপ্রস্তুত হয়ে ফ্যালফ্যাল নয়নে বোনের পানে তাকিয়ে রইলো উথমী। কী বলবে বুঝতে পারলো না সে। বোনের এমন কোমল আচরণে বাকরুদ্ধ হলো। মেয়েটির সাথে একটু বেশিই কী খারাপ হয়ে গেলো না? পাপের শাস্তি তো অন্যরকমভাবেও হতে পারতো!

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)