জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-৩৬+৩৭

0
7

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৬]

হাসপাতালে নিয়ে আসার আধ ঘণ্টা পর ঊষাকে মৃত ঘোষণা করল ডাক্তাররা। হাতের শিরা কাটার ফলে অতিরিক্ত রক্তপাত এবং সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু না ঘটায় একাধিক ঘুমের ওষুধ সেবন করায় হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বেই তার মৃত্যু ঘটেছে। নিজ কানে মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে হার্ট অ্যাটাক করার মতো অবস্থা হয়ে গেলো কেয়া বেগমের। জ্ঞানশূন্য হয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়ে ফাটিয়ে ফেললেন মাথা। রায়হান কবীর কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন মেঝেতে।

উৎসর মাথা কাজ করছে না। গতকালও মেয়েটা কত স্বাভাবিক ছিলো! নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অঘটন মেনে নিয়ে সব দুঃখ ভুলতে চাইছিল। অথচ সে-ই কিনা এক রাতের ব্যবধানে আ’ত্মহ’ত্যা করে ফেললো? এ কী করে সম্ভব? নাহ, আর কিছু ভাবতে পারলো না সে। প্রচন্ড মাথা ঘুরাচ্ছে। নিজ হাতে কোলে করে বড়ো করা সেই ছোট্ট ঊষার লাশটা সামনে পড়ে আছে। শকুনের মতো খুবলে খাওয়া মুখশ্রীতে বিষাদ ছুঁয়েছে। তার সামনে দিয়েই একজন নার্স এসে সাদা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দিলো মৃতর। বলে গেলো,“সুইসাইড কেস তাই লাশের পোস্ট মর্টেম হবে। আপনি রিসেপশনে যান। ওখানে কিছু কাজ রয়েছে সেগুলো সেরে আসুন।”

উৎস সেসব শুনলো না। শোনার মতো পরিস্থিতিতে সে নেই। শুধু শ্রবণালীতে গিয়ে আঘাত হানলো একটি শব্দ ‘পোস্ট মর্টেম’। এই অল্প বয়সী মেয়েটিকে তারা কাটা ছেঁড়া করবে? একটুও কী কষ্ট হবে না?

মেঝেতে পড়ে আছে রক্তমাখা লাল ধারালো ছুরি। সবজি কাটার ছুরি। কয়েক মাস আগেই উৎসকে দিয়ে কিনিয়ে আনিয়েছিল রিনিতা। মাত্র দুবার এই ছুরি দিয়ে সে সবজি কেটেছিল। কেয়া আর চুমকি বটি দিয়েই কাটাকুটি করে। ছুরি ব্যবহারের প্রয়োজন তাদের হয় না। এই ছুরি কখন ঘরে নিয়ে এলো মেয়েটা? এমন একটি ভয়ংকর সিদ্ধান্ত কী তবে সে আগেই নিয়েছিল? তাই মনে হচ্ছে রিনিতার। অথচ গতকাল তার সাথে বসে হেসে হেসে কত গল্পই না করল সে! কিন্তু তার মাথায় যে এমন একটি ভয়ংকর সিদ্ধান্ত ঘুরছিল তা এক মুহূর্তের জন্যও টের পেলো না রিনিতা।

মেঝেতে এখনো ভেসে আছে লাল রক্ত। এলোমেলো বিছানায়ও কয়েক ফোঁটা শুকিয়ে আছে। বালিশের নিচে রাখা ঘুমের ওষুধের কৌটা। সেসব দেখে শরীরটা ঘেমে গিয়েছে রিনিতার। ভেতর থেকে সব উল্টে আসছে। একসময় আর থাকতে না পেরে মুখ চেপে ধরে বাথরুমে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডেই সব উগড়ে দিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেললো সে। তার ওয়াক ওয়াক শব্দে দৌড়ে এলো চুমকি। ভয়ে, আতঙ্কে, চিন্তায় সে এতক্ষণ ধরে বসে ছিলো ড্রয়িং রুমের মেঝেতে।

রিনিতাকে ধরে অস্থির হয়ে শুধালো,“আমনের আবার কী হইলো ভাবী? দেখি ঘরে চলেন।”

চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছলো রিনিতা। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“ঘরের রক্তগুলো পরিস্কার করে বিছানা চাদর বদলে দাও চুমকি। মা এসে আবার এসব দেখলে কান্নাকাটি শুরু করে দিবেন।”

মাথা নেড়ে তাকে নিয়ে ঘরে এলো চুমকি। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে পা দুটোও তুলে দিলো উপরে। কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। চুমকি তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো দরজা খুলতে। রিনিতার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তার চোখের অন্তরালে শুধু ভেসে আছে ঊষার রক্তাক্ত সেই হাত।

“রিনি মা!”

কারো ডাকে হুঁশ ফিরলো রিনিতার। সামনে তাকাতেই মুখ ছাপিয়ে উঠলো বিষ্ময়ে। এ অসময়ে মা এখানে? কীভাবে? বললো,“মা! তুমি?”

আছিয়া বেগম বড়ো বড়ো কদম ফেলে এগিয়ে এসে বসলেন বিছানায়। মেয়ের বাড়ন্ত পেটে হাত রাখলেন। দৃষ্টিতে একঝাঁক মায়া ঢেলে বললেন,“জামাই বাবা ফোন করেছিল। ঊষার খবরটা দিয়ে বললো, আমি যেনো তোর কাছে চলে আসি। তুই বাড়িতে একা। তনি নানু উথমীর কাছে। তাই আর দেরি করলাম না। হাতের কাজ ফেলে রেখে চলে এসেছি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো রিনিতা। আজ অনেকদিন পর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। প্রেগন্যান্সির চার মাসে পা দেওয়ার পর থেকে বাপের বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি তার। মায়ের সাথে যা সাক্ষাৎ হয়েছে তাও ফোনকলের মাধ্যমে।

কেয়া বেগমের এখনো জ্ঞান ফিরেনি। রায়হান কবীরের অবস্থাও সূচনীয়। এই বয়সে এসে জীবনে তিন তিনটে ধাক্কা খেয়েছেন! প্রথমবার কন্যা সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায়, দ্বিতীয়বার ধর্ষিতা কন্যার স্বরূপ দেখে, আর তৃতীয়বার সেই কন্যার আত্মাহুতি দেখে। মেয়েটা কেনো এমন করল? সবাই তো সবটা মেনে নিয়েছিল।

উথমীকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তৈমূরের দেরি হলো। ঊষাকে নিয়ে এম্বুল্যান্সে উঠেই প্রথমে শাশুড়ি আর তারপর তৈমূরকে ফোন করে সবটা জানিয়ে দিয়েছিল উৎস। কিন্তু উথমী সেসব জানে না। জানে না দুদিন আগেও সামনাসামনি বসে যে বোনের সাথে কথা বলেছিল, সে বোন এখন মৃত।

হাসপাতালে প্রবেশ করেই জরুরি বিভাগে কথা বলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো উথমী। বড়ো ভাইকে কোথাও নজরে না পড়লেও বিমূঢ় দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা বাবাকে সে ঠিকই দেখতে পেলো। শুকনো ঢোক গিলে বুড়ো আঙুলের সাহায্যে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে পাশে বসলো। চিন্তিত, শঙ্কিত হয়ে শুধালো,“ঊষার কী অবস্থা? অপারেশন চলছে? হঠাৎ করে ও এমন করল কেনো? আর মা? মা কোথায় বাবা?”—-একনাগাড়ে প্রশ্নগুলো করে আশেপাশে মায়ের খুঁজে তাকালো সে।

রায়হান কবীর অশ্রুসিক্ত নয়নে মাথা তুলে মেয়ের পানে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ক্রন্দনরত স্বরে বলে উঠলেন,“নেই! ও নেই! এতো আদরে বড়ো করা আমার সেই ছোট্ট ঊষা আর নেই! সব শেষ হয়ে গেছে। সব শেষ!”

শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি। উথমীর বুক কেঁপে উঠলো। বাবাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। তাই বাবার কষ্ট কিছুতেই তার সহ্য হয় না। কথার অর্থদ্বার সঠিকভাবে বুঝতে না পারলেও সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙিতে অশান্ত কণ্ঠে বললো,“সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। এভাবে কেঁদো না তো।”

“কিচ্ছু ঠিক হবে না রে মা। কিচ্ছু না। ডাক্তার বললো, ও নাকি মরে গেছে! আমি কত করে বললাম, আমার মেয়েটা এখনো ছোটো। লেখাপড়াটাও শেষ হয়নি। কাল রাতে আমায় বাবা বলে ডাকলো। বললো, বাবা! তোমরা যা বলবে আমি তাই শুনবো। আর কখনো তোমাদের দুঃখের কারণ হবো না। সে মেয়ে কীভাবে মরে যেতে পারে? ডাক্তার আমার প্রশ্নের জবাব দিলো না। আমার কথা শুনলো না। আমি এই বয়সে কীভাবে মেয়ের লাশের খাটিয়া কাঁধে বইবো? কীভাবে?”

হতভম্বের মতো ফ্যালফ্যাল নয়নে পিতার পানে তাকিয়ে রইলো উথমী। ঊষা নেই? সত্যিই ঊষা নেই? কথাগুলো বুঝতেই চোখ জোড়া ভিজে উঠলো তার।কিন্তু হাউমাউ করে কাঁদতে পারছে না সে। বাবার মতো তারও বিশ্বাস হচ্ছে না এ কথা। মেয়েটির বাঁচার স্বপ্ন ছিলো। অনেক বছর বাঁচতে চেয়েছিল সে। অথচ!

তৈমূর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্বশুরের দিকে। সদ্য সন্তানহারা পিতার কষ্ট সম্পর্কে যদি ঊষা জানতে পারতো, অনুভব করতে পারতো তাহলে কী আদৌ সে এমন জঘন্য একটি কাজ করতে পারতো? পারতো এতো মূল্যবান একটি প্রাণ শেষ করে দিতে? মেয়েটা সারাজীবন বোকাই রয়ে গেলো। ভুলে ভুলেই তার জীবনের সমাপ্তি ঘটলো।

উথমী দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও অক্ষম হলো। পায়ে ঝিম ধরেছে। উঠার মতো শক্তিটুকু আর শরীরে অবশিষ্ট নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর পানে তাকিয়ে কোমল স্বরে নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করে বললো,“আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে। বসা থেকে উঠতে পারছি না। কিন্তু ঊষাকে দেখবো। নিয়ে যাবেন?”

জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে এগিয়ে এলো তৈমূর। দু হাত আঁকড়ে ধরে স্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। পথিমধ্যে একজন নার্সকে ডেকে বিস্তারিত সব বলতেই নার্সটি দেখিয়ে দিলো কেবিন। তৈমূর আর দাঁড়ালো না সেখানে। এক হাত দিয়ে স্ত্রীকে আগলে নিয়ে এগিয়ে চললো নির্দিষ্ট স্থানে।

বরফের মতো ঠান্ডা একটি কেবিনের বিছানায় সাদা চাদরে মোড়ানো ঊষার প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে। পোস্ট মর্টেমের সকল জোগাড় যন্ত্র শেষ। অনুমতিপত্র এলেই যেনো আর এক মুহূর্তও দেরি না করে লাশ কাটার কাজ শুরু হয়ে যাবে। উথমী ঘামছে, ভয়ে আত্মা শুকিয়ে আসছে। শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তৈমূরের এক হাত সে শক্ত করে ধরে এগিয়ে এলো। লাশের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে কোমর পর্যন্ত এনে রাখলো নার্সটি। হাতের কাটা স্থানে লাগানো সাদা ব্যান্ডেজটি লাল টুকটুকে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। তবে এখন আর সেখান থেকে রক্ত পড়ছে না। থেমে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই।

উথমী ছোঁয়ার জন্য সেদিকে হাত বাড়ালো কিন্তু তৎক্ষণাৎ নার্সটি বাঁধা দিলো তাকে। জ্বলন্ত মেজাজ নিয়ে বললেন,“ধরা যাবে না। দূর থেকে দেখুন।”

তৈমূর ভদ্রমহিলার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। শীতল কণ্ঠে বললো,“এই মরদেহ কী আপনার ব্যক্তিগত সম্পদ যে ধরা ছোঁয়া যাবে না? ইনি মৃতর বড়ো বোন হয়।”

“কিন্তু স্যার তো…..”

“আপনার স্যারের কথায় কিছু চলবে না। সুইসাইড কেস দেখলেই আপনাদের ধান্দা শুরু হয়ে যায় তাই না? সরুন সামনে থেকে।”

আমতা আমতা করে পিছিয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। তেজ কমে এসেছে উনার। ভেতরে অধীর সাহস সঞ্চয় করে হাত বাড়িয়ে বোনকে ছুঁয়ে দিলো উথমী। শরীর তার বরফের মতো ঠান্ডা। চোখের নিচে জমেছে হতাশার নিদ্রাহীন কালি‌। ফর্সা মুখশ্রীর বিভিন্ন স্থানে টুকরো টুকরো কালো দাগ। সেসব দেখে ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে উথমীর। নিঃশ্বাসের গতি হ্রাস পায়। ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। অসাড় হয়ে আসা কণ্ঠস্বরেই অভিযোগের সুরে বলে ওঠে,“কেনো এমনটা করলি? কেনো? একবারও কী বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ল না তোর? তাদের ভালোবাসার কোনো মূল্য ছিলো না?”

এতোটুকু বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। চোখের থেকে কয়েক ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল মৃত ঊষার প্রাণহীন দেহে। তৈমূর অতি কষ্টে স্ত্রীকে টেনে তুলে সঙ্গে করে বাইরে নিয়ে এলো।

তবুও উথমীর কান্না থামছে না। চোখের সামনে আপন মানুষের লাশ দেখে কী শান্ত থাকা যায়? কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি ওঠে গিয়েছে। তৈমূর স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলো। পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত করার চেষ্টা করল। নাক টেনে ক্রন্দনরত স্বরে বিলাপ করে উথমী বললো,“আমি কখনো ওর কোনো ক্ষতি চাইনি। কখনো না। সবসময় ওর ভালোর জন্য কতকিছু বলেছি, সাবধান করেছি কিন্তু ও বোঝেনি। কীভাবে পারলো ও নিজের জীবন এভাবে দিয়ে দিতে?”

তৈমূর আদুরে গলায় তাকে সায় দিয়ে বললো,“জানি আমি। আপনি কখনো কারো ক্ষতি চাইতে পারেন না। একটু শান্ত হন।”

শান্ত হলো না উথমী। বরং আহ্লাদ পেয়ে দুঃখ তার বেড়ে গেলো। সাথে বাড়লো কান্না।
______________

ঊষাকে আর শেষ গোসল দেওয়া হলো না। পড়ানো হলো না তার জানাজা। আর না সে মাটি পেলো গ্ৰামের পারিবারিক কবরস্থানে। বরং পোস্ট মর্টেম শেষে স্থানীয় এক গোরস্থানে তার প্রাণহীন, কাটাছেঁড়া দেহ যেনো কোনোমতে মাটির নিচে পুঁতে দিয়ে দায়মুক্ত হলো সকলে।

কেয়া বেগমকে জ্ঞানহীন অবস্থাতেই নিয়ে আসা হয়েছে বাড়িতে। সাথে আনা হয়েছে উনাকে দেখভালের জন্য একজন নার্স। হাসপাতালে উনাকে রেখে আসা সম্ভব নয়। বাড়ির সকলেই ডুবে আছে শোকের ছায়ায়। কে এই অবস্থায় হাসপাতালে উনার কাছে পড়ে থাকবে? আর বাড়িতেই বা সামলাবে কে?

ঊষার মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে রিনিতাও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বাঁধিয়ে ফেলেছে ঠান্ডা, জ্বর। আছিয়া এসেই চুমকিকে নিয়ে দুপুরের রান্না সেরে পরিষ্কার করিয়েছেন ঊষার ঘর। মেয়েটির মৃত্যু সংবাদ শুনে উনারও খুব কষ্ট হচ্ছে। মেয়ের বিয়ের পর বেশ কয়েকবার রিনিতার সাথে ঊষাও গিয়েছিল উনাদের বাড়িতে। এমনকি এ বাড়িতে আছিয়া এলেই দৌড়ে এসে মাওই মাওই বলে কি আহ্লাদ! অথচ সেই মেয়েটার সাথে এতোকিছু ঘটে গেলো? কিন্তু মেয়ে রিনিতার সামনে তা প্রকাশ করতে পারলেন না তিনি। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে সাথে ননদ দুজনকেও সে বড়োই ভালোবাসে। ছোটো বোনের মতো স্নেহ করে। কষ্ট তো তার হওয়ারই কথা। তাই নিঃশব্দে মেয়েকে সামলান আছিয়া।

রায়হান কবীর খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন। চোখের পানি শুকিয়ে গেলেও ভেতরের কষ্ট ঠিকই রয়ে গিয়েছে। উৎস তৈমূরের সাথে সোফায় বসা। বিষণ্ণতা তার মুখশ্রী দখল করে নিয়েছে।মানুষ মরার সাথে সাথে বাড়িতে শোক চলে আসা যেনো একটি নিয়ম। আছিয়া ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হলেন। একবার নিজ জামাতা আরেকবার উথমীর স্বামীর পানে তাকিয়ে শুধালেন,“উথমী কোথায়?”

শাশুড়ির প্রশ্ন শুনেও নড়চড় হলো না উৎসর। তাই তৈমূর উত্তর দিলো,“ঊষার ঘরের দিকে যেতে দেখলাম।”

উত্তর শুনে আর সেখানে দাঁড়ালেন না আছিয়া। হন্তদন্ত পায়ে ছুটে গেলেন সেদিকে। উথমী আর চুমকি মিলে তখন সারা ঘরজুড়ে চিরুনি অভিযান চালিয়ে কিছু খুঁজছে। আছিয়া দরজা পর্যন্ত এসে থামলেন। তাকিয়ে তাকিয়ে সেসব দেখলেন কিছুক্ষণ। প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“কী করছো তোমরা? কী খুঁজছো?”

চুমকি জবাব দিলো,“মরার আগে মানুষ সুইসাইড নুড লেইখা যায় শুনছিলাম। সেইডাই খুঁজতাছি। আমি নিশ্চিত ছুডু আফায় মরার আগে কিছু লেইখা গেছে।”

তাদের কথা শুনে অবাক হলেন আছিয়া। কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে ডেকে বললেন,“উথমী! রিনি খুব কান্নাকাটি করছে। সকাল থেকে না খাওয়া। কিচ্ছু খেতে চাইছে না। শুধু তনিকে দেখতে চাইছে। তনি কোথায় মা?”

উথমী থেমে গেলো। কিছু একটা মাথায় আসতেই ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা মায়ের মোবাইলটি হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। চঞ্চল কণ্ঠে আছিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিলো,“তনিকে আমার শাশুড়ির কাছে রেখে এসেছি। ও ওখানে ভালো আছে।”

“কিন্তু তোমার ভাবীকে থামানো যাচ্ছে না মা। এই অবস্থায় কান্নাকাটি করতে থাকলে, না খেয়ে থাকলে পেটের বাচ্চারও তো ক্ষতি হয়ে যাবে।”

টনক নড়লো উথমীর। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিজের মোবাইল খুঁজলো কিন্তু পেলো না কোথাও। মাথায় একটু চাপ প্রয়োগ করতেই মনে পড়ল, তার মোবাইল তৈমূরের কাছে।হাসপাতালে প্রবেশকালে তার পকেটেই ঢুকিয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আচ্ছা।”

বসা থেকে উঠে হনহনিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে থামলো। স্বামীর উদ্দেশ্যে বললো,“ভাবী তনিকে দেখতে চাইছে। নিয়ে আসুন।”

স্ত্রীর শান্ত, মলিন মুখশ্রীতে তাকিয়ে বলে উঠলো তৈমূর,“এখন?”

“হ্যাঁ, মাওই কিছুদিন এখানে থাকবেন। তনিকে নিয়ে আসুন।”

“আচ্ছা।”

“আমার মোবাইল কোথায়?”

বসা থেকে উঠে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে এসে পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার হাতে তুলে দিলো তৈমূর। গালে হাত রেখে চাপা স্বরে বললো,“নিজের খেয়াল রাখবেন। ঠিক আছে?”

“হু।”

তারপর আর দাঁড়ালো না সে। নিরবে সেখান থেকে প্রস্থান করল। সে যেতেই আছিয়া সদর দরজা আটকে চলে গেলেন মেয়ের কাছে। মায়ের মোবাইলটি ঊষার ঘরে দেখে ভীষণ অবাক হলো উথমী। মায়ের মোবাইল ঊষার ঘরে কী করছে? পালিয়ে যাওয়ার সময় সবকিছু সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল ঊষা। আর যখন তাকে পাওয়া গেলো তখন সেসব তো দূরে থাক পরনের পোশাকও তার সাথে ছিলো না। এই জন্যই কী মায়ের মোবাইল ব্যবহার করছিল সে? তাই হবে হয়তো।

রাতে মায়ের নাম্বার থেকে বেশ কতগুলো ম্যাসেজ এসেছিল উথমীর মোবাইলে। যা রাতে না দেখলেও সকালে সে ঠিকই স্ক্রিনের উপরে ভাসমান দেখেছিল। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় অতো ভালো করে সেসব আর চেক করা হয়নি তার। ফ্রেশ হয়েই ছুটেছিল রন্ধনশালায় সকালের নাস্তা তৈরি করতে। এমন একটি সময়ে এসে মনে সন্দেহ জমা হলো উথমীর। ম্যাসেজগুলো ঊষা করেনি তো? অমন একটি নৃশংস কাজ করার আগে ও-ই উথমীকে ম্যাসেজ দিয়েছিল? কিন্তু কেনো?

উথমী ম্যাসেজ ওপেন করল। যেখানে স্পষ্ট লেখা, ‘হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভয়েস ম্যাসেজ পাঠিয়েছি। সময় পেলে একটু শুনিস। উপকার না হলেও ক্ষতি হবে না। আর পারলে আমায় মাফ করে দিস।’

ভিতু মনে ওয়াইফাই অন করতেই হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বেশ কয়েকটা নোটিফিকেশন এলো মোবাইলে। উথমী প্রবেশ করল মায়ের অ্যাকাউন্টে। গতকাল রাতে আসা অডিও রেকর্ডিং চালু করতেই ভেসে এলো আপন ছোটো বোনের কম্পিত, অনুশোচনার কণ্ঠস্বর,“তুই যখন এই রেকর্ডটা শুনবি তখন হয়তো আমি আর এই পৃথিবীর কোথাও থাকবো না। থাকবে না আমার কোনো অস্তিত্ব। শুধু আমার মৃত্যু শোক ঘেরাও করবে চারিদিক। কেউ কেউ বিদ্রুপ করে বলবে,আহা মেয়েটি কি বোকা! হ্যাঁ আমি বোকা। সত্যিই আমি বোকা আপু। সারাজীবন নিজের কথা ভাবতে গিয়ে নিজেরই কতশত ক্ষতি করে বসলাম! ভাবছিস তো হঠাৎ করে তোকে কেনো বলছি এসব? কারণ এই শেষ সময়ে এসে আমার মনে হচ্ছে তুই ছাড়া আমার কথা শোনার মতো এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কেউ আমায় বুঝবে না। জানিস? আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। সুন্দর একটা জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলাম। আর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই হয়তো রাফান আমার জীবনে এসেছিল ভালোবাসা নিয়ে। ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল সেই এডমিশন কোচিংয়ে। ও ওখানে বেশ কয়েকবার ক্লাস নিতে এসেছিল। ওখান থেকেই খোলা হয় স্টুডেন্টদের প্রবলেম সলভিং এর জন্য কোচিং গ্ৰুপ। তারপর ওর সাথে ফ্রেন্ডলিস্টে এড হই, পড়ার বিষয়ে কথা বলতে বলতে একসময় সম্পর্কের মোড় ঘুরে অন্যদিকে । কোচিং শেষে শুরু হয় ঘোরাঘুরি। দেখতে আহামরি না হলেও রাফানের কথাবার্তার ধরণ খুব সুন্দর। সেই সুন্দর কথা দিয়েই ও আমায় ফাঁসিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে আমার লেখাপড়ার ক্ষতি হতে লাগলো। কিন্তু সেসব ভাবার মতো সুবুদ্ধি তখন আমার ছিলো না। আমি ভালোবাসার মোহে খুব বাজেভাবে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। এডমিশনে কোথাও চান্স হলো না। রাফানের বুদ্ধিতে মাকে আজেবাজে বুঝিয়ে বাবাকে রাজি করালাম আমাকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য। ধীরে ধীরে আমাদের সম্পর্ক আরো গভীরে যেতে লাগলো। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সারা শহর ঘুরতে ঘুরতেই কখন যে নিজেকে ওর কাছে সঁপে দিলাম তাও সঠিক জানি না। বেশ কয়েকবার অবশ্য তোর কাছে ধরাও পড়ে গিয়েছিলাম! তবে কখনো স্বীকার করিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই রাফান আমায় বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শুরু করল। অথচ তার পরিবারের অবস্থা তেমন ভালো নয়। ভাড়া বাসায় থাকে। যা একটা চাকরি করতো তারও বেতন খুবই কম।এ অবস্থায় বাবাকে ওর কথা জানালে বাবা কিছুতেই রাজি হতো না। আমি রাফানকে বুঝিয়ে বললাম, তুমি নিজের ক্যারিয়ারে মন দাও। আমি আছি তো! কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু সে মানলো না। পালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে লাগলো। তবে আমি তার কথায় কিছুতেই রাজি হলাম না। একপর্যায়ে সে হার মেনে নিয়ে শুরু করল আমায় ব্ল্যাকমেইল করা। আমাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিওগুলো স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখালো। আমি সেদিন ওকে দেখে খুব অবাক হয়েছি, কখন এসব করল সে? কীভাবেই বা করতে পারলো? সেই মুহূর্তে আমার আর কিছু করার ছিলো না। অসব পাবলিক হলে আমার সাথে সাথে যে তোদের মানসম্মানও নষ্ট হবে! আমি রাজি হলাম। পালানোর জন্য অনেক প্লান করে ভার্সিটির ব্যাগে বইয়ের বদলে ভরলাম সব জামাকাপড়। রাফান ফোন করল। বললো, ওর টাকা লাগবে। খালি হাতে যেনো না যাই। আমি টাকা কোথায় পাবো? বলাতেই সে রেগে গিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করল, ভয় দেখালো। জানতে পারলাম, জুয়া খেলতে গিয়ে লস খেয়েছে। সাথে জমে আছে অনেক ধারদেনা। পাওনাদাররা টাকার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য সবার চিন্তা বাদ দিয়ে আমি মায়ের ঘরে ঢুকলাম। মা তখন বাথরুমে গোসল করছে। অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে লকার খুলে সব টাকা ব্যাগে ভরলাম। গহনাগুলোও ছাড়লাম না। তার ঠিক পরেরদিনই ভার্সিটির নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাফানের সাথে পাড়ি দিলাম অজানা গন্তব্যে। বাসে চড়লাম, ট্রেনে চড়লাম তারপর গেলাম ওর এক বন্ধুর বাড়ি। সে আমাদের আশ্রয় দিলো পুরোনো একটি অচল গ্যারেজে। যেখানে থাকার মতো রয়েছে ছোট্ট জায়গা। মানুষও চলাচল করে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমায় কখন বিয়ে করবে রাফান? রাফান বললো, সময় হলে করবো। এখন নিশ্চয়ই তোমার বাড়ির লোক তোমায় খোঁজাখুঁজি করবে? তাই এই মুহূর্তে বিয়ে করা রিস্ক। আমি মেনে নিলাম। আমরা একসঙ্গে বেশ কয়েকদিন থাকার পর বিয়ের জন্য ওকে অনেক চাপ দিতে লাগলাম। কিন্তু সে নিত্য নতুন বাহানায় এড়িয়ে যেতে লাগলো সেসব। আর আমার থেকে সব টাকা, গহনা নিজের করে নিতে চাওয়ার ফন্দি আঁটলো। কিন্তু আমি ওকে দিলাম না। স্পষ্ট করে বলে দিলাম, বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এসব কিছুই তুমি পাবে না। ধীরে ধীরে ওর ভয়ানক রূপ আমার সামনে আসতে লাগলো। সারাদিন খোঁজ না থাকলেও মাতাল হয়ে রাতে ফিরে আমার গায়ে হাত দেওয়া শুরু করল। আমি প্রতিবাদ করলাম। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে যখন ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম তখনি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠলো সে। একদিন ওর বন্ধুদের নিয়ে এলো ওখানে। আমায় আটকে রেখে ওরা কীসব খেয়ে দিন দুনিয়া ভুলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল!”

বর্ণনা দিতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ঊষা কিন্তু থামলো না সে। বলতে থাকলো,“সবকিছু তারা কেড়ে নিলো। সারারাত তারা আমায় খুব অত্যাচার করেছে জানিস? খুব কষ্ট হয়েছে আমার। মনে হয়েছে এই যেনো মরে যাবো। ওদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আমি জ্ঞান হারালাম। ওরা হয়তো ভেবেছিল মরে গিয়েছি! তাই হয়তো রেললাইনে ফেলে দিয়ে এসেছিল। আর মনে করেছিল, ট্রেনে কাটা পড়লে আর কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না। আমি ভালোবেসে ঠকে গেলাম রে আপু! নিষ্ঠুরভাবে ঠকে গেলাম। কাউকে কষ্ট দিয়ে নাকি মানুষ বাঁচতে পারে না। আজ তার প্রমাণ পেলাম নিজেকে দিয়ে। এতোকিছু বলার কারণ হচ্ছে, আমি চাই না ওরা ভালো থাকুক। ওসব গহনা, টাকা পয়সা হয়তো এখনো রাফানের কাছেই আছে। ওকে ছাড়বি না তোরা। সবকিছু আদায় করে নিবি। আবারো মাফ চাইছি তোদের কাছে। আমি অনেক ভেবেছি, কিন্তু এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমার আর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এই পৃথিবী ধর্ষিতাদের জন্য নয়। জানিস, নিজেকে দেখলে আমার খুব ঘৃণা হয়। সেই জঘন্য মুহূর্তগুলো চোখের অন্তরালে ভেসে ওঠে। এতো কষ্ট নিয়ে তো আর বেঁচে থাকা যায় না। তাই জীবনে এতো এতো পাপের মধ্যে নিজেকে শেষ করে দিয়ে আরো একটি পাপ না হয় করেই ফেলি। আমার জন্য কষ্ট পাস না। মাকে তুই সামলে নিস। বলে দিস, তার এই নির্মল, পবিত্র ভালোবাসার যোগ্য আমি নই। ভাইয়াকে বলিস, আমায় যেনো মাফ করে দেয়। আর বাবাকে বলিস, তাকে আমি খুব ভালোবাসি। স্বামী, সংসার নিয়ে ভালো থাকিস। তোর জীবনটা ফুলের চেয়েও সুন্দর হোক।”

চলবে _________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৭]

“দুদিন পরপর বউ নিয়ে এতো শ্বশুরবাড়ি দৌড়ানোর কী আছে? গতকাল ইদ গেলো আর আজই বলা নেই কওয়া নেই সকাল সকাল সেখানে চলে যেতে হবে? তা তোর বউয়ের কী কোনো কান্ড জ্ঞান নেই? গেলো তো গেলো অথচ ফেরার সময় স্বামীর সাথে না এসে তাকে একা পাঠিয়ে দিলো কোন আক্কেলে? তুই এখন ছোটো বাচ্চাটাকে নিয়ে আবার অতোদূর ছুটবি?”

রাগত স্বরে ছেলের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে থামলেন শাহানা। তনিকে জেবা নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে তৈরি করে দিতে। তৈমূর বসে আছে মায়ের ঘরে ঠিক মায়ের সামনে। ছেলের নিরবতায় রাগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো শাহানার। দাঁতে দাঁত চেপে ফের বললেন,“তোর বাবা তো মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে। আর আমাকে রেখে গিয়েছে তোদের এমন অধঃপতন দেখার জন্য। দিন দিন আম্মাকে খুব অসহ্য লাগছে তাই না? কথার উত্তর দিতে মুখ ব্যথা করে?”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৈমূর। মনটা তার ভীষণ খারাপ। বিয়ের বেশ কয়েক মাস পার হলেও অন্যসব শালী দুলাভাইয়ের মতো ঊষার সাথে তেমন একটা সখ্যতা গড়ে ওঠেনি তার। সৌজন্যতার খাতিরেও তার সাথে কখনো দুটো কথা বলতে আসেনি ঊষা। কেমন যেনো অহংকারী অহংকারী একটা ভাব ছিলো মেয়েটার মধ্যে। তবুও মেয়েটার নির্মম পরিণতির জন্য খুব খারাপ লাগছে তৈমূরের। তবে মা যে তার উপর রেগে গিয়েছে তা বুঝে গেলো সে। হুট করেই বলে উঠলো, “উথমীর ছোটো বোন ঊষা মারা গিয়েছে আম্মা। আজ পোস্ট মর্টেম শেষে তাকে দাফন করা হয়েছে।”

ছেলের কথায় ভড়কে গেলেন শাহানা। সজাগ দৃষ্টিতে তার পানে তাকালেন। শুধালেন,“কী বললি? মারা গিয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

মুহূর্তেই ভেতরটা কেঁপে উঠলো উনার। মৃত্যু সংবাদ শুনলেই শাহানার কষ্ট হয়। ভেতরে ভয় জমে। মৃত্যু ভয়! দেহের সাথে কণ্ঠস্বরেও কম্পন ধরলো,“ছোটো বোন! তাহলে তো মেয়ের বয়স খুবই কম। হঠাৎ করে মারা গেলো? কীভাবে?”

পূর্ণ দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকালো তৈমূর। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো,“আগে আমায় কথা দিন আম্মা, এই বিষয়ে কখনো আপনি উথমীর সামনে কিছু বলবেন না? ওকে হেয় প্রতিপন্ন করবেন না? কাউকে জানাবেন না? অন্যের মুখে এসব শুনলে উনি আরো বেশি কষ্ট পাবেন।”

“তাকে কেনো হেয় করবো? আমি এতোটাও খারাপ নই যে মানুষের দুর্বলতা নিয়ে খোঁটা দিবো।”

“আত্মহত্যা করেছে। সকালে বাড়ির কাজের মেয়ে ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে দেখে ফ্লোরে রক্ত ভেসে আছে। তার চিৎকারেই সবাই ওখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর হাসপাতালে নিতেই মৃত ঘোষণা করে ডাক্তাররা।”

চমকে গেলেন শাহানা। প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“কী বলছিস তৈমূ! অতোটুকু একটা মেয়ে এমন নির্মম কাজ করল? কিন্তু কেনো?”

শুরু থেকে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনাই মাকে খুলে বললো তৈমূর। সেসব শুনে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো শাহানার। চোখ দুটোও ভিজে উঠেছে। ভারাক্রান্ত মনে বললেন,“এইটুকু একটা মেয়ের জীবনে এতোকিছু ঘটে গেছে? কীভাবে সহ্য করল এসব? আল্লাহ এই অবুঝ মেয়েটাকে মাফ করে দিও।”

থেমে পুনরায় শুধালেন,“মেয়ের বাবা-মায়ের কী অবস্থা? নিশ্চয়ই খুব ভেঙে পড়েছে? এতো বছর ধরে একটা মেয়েকে বড়ো করা তো আর কম ঝক্কির কাজ না। সেই মেয়ের হঠাৎ এভাবে মৃত্যু! মেনেও তো নেওয়া যায় না।”

“হ্যাঁ ভেঙে পড়েছে। বাবা তো কবরের উপরেই কাঁদতে কাঁদতে শুয়ে পড়লেন। অনেক কষ্টে বাড়িতে নেওয়ার পর একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন। কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছেন। আর শাশুড়ি মা দাঁড়ানো অবস্থাতেই জ্ঞান হারিয়ে শক্ত মেঝের ওপর পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছেন। এখন বাড়িতে উনার জন্য আলাদা নার্স রাখা হয়েছে।”

“এমন একটা অবস্থায় তনিকে নিয়ে যাওয়া কী ঠিক হবে? কে সামলাবে ওকে?”

“বাসায় ওর নানু এসেছে। ওখানেই থাকবে কিছুদিন। ভাবীও খুব কান্নাকাটি করছে। না নিয়ে গেলেই নয়।”

সম্মতি প্রকাশ করলেন শাহানা। সব রাগ, ক্ষোভ উবে গিয়ে সেখানে ঠাঁই পেলো কষ্ট, আফসোস। মেয়েটা বৌ ভাতের অনুষ্ঠানে এসেছিল কিন্তু শাহানার স্পষ্ট তার চেহারা মনে নেই। ছেলের বিয়ে শুরুতে মেনে না নেওয়ায় তার শ্বশুরবাড়ির কারো সাথেই খুব একটা পরিচিত নন তিনি।

জেবা তনিকে নিয়ে শাশুড়ির ঘরে এলো। বললো, “এই যে নিয়ে এসেছি উনাকে।”

ভাবীর আগমনে উঠে দাঁড়ালো তৈমূর। এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলো তনিকে। তারপর সকলের থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো নিচে গাড়ির কাছে। গন্তব্য শ্বশুরবাড়ি।

উথমী বাবার পাশে এসে বসেছে দুয়েক মিনিট হবে। বিকেলের রোদে ধরণীর লাবণ্য যেনো বৃদ্ধি পেয়েছে। বারান্দার ছোটো ছোটো গাছগুলো বাতাসের সাথে হেলেদুলে নাচছে। ঘাড় ঘুরিয়ে বাবার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উথমী। হাতে খাবারের প্লেট। চিংড়ি মাছ ভুনা, সরিষা ভর্তা, মুরগির ঝোল আর ভাত রেঁধেছে আছিয়া। উথমী সরিষা ভর্তা দিয়েই কিছু ভাত মাখলো। বাবার উদ্দেশ্যে বললো, “খাবার এনেছি। সেই সকাল থেকে না খাওয়া তুমি। শরীরে তো অসুখ বাসা বাঁধবে বাবা। হা করো দেখি! আজ আমি তোমায় নিজ হাতে খাইয়ে দিবো।”

মেয়ের পানে তাকালেন রায়হান কবীর। চোখে এখনো অশ্রু চিকচিক করছে উনার। মুখশ্রী শুকিয়ে গিয়েছে। ভাঙা কণ্ঠে বললেন,“ঊষা যে মরে গিয়েছে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না রে মা। বাবা হিসেবে নিজেকে খুব অপদার্থ মনে হচ্ছে। তোদের সবাইকে আমি একসাথে, এক নিয়মে বড়ো করেছি। অথচ ও কীভাবে বিগড়ে গিয়ে নিজের জীবনটা শেষ করে দিলো? পরিবারে এতো আপনজন থাকতে কখনো কাউকে কিছু জানালো না। সবসময় নিজের জীবন নিয়ে নিজেই ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিলো। ওর অমন খারাপ অবস্থাতেও আমরা সব মেনে নিয়েছি‌। তারপরেও কেনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিলো বল তো? ও তো মরে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু এদিকে দুনিয়ার সামনে নিজের বাবাকে অপদার্থ বাবা হিসেবে দায়ী করে রেখে গেলো। মাকে করে দিয়ে গেলো অর্ধ পাগল।”

“এভাবে নিজেকে দোষারোপ করো না বাবা। তোমার জীবনে তুমি সর্বদাই সঠিক ছিলে। তুমি সঠিক না থাকলে ভাইয়া আর আমি এতোদূর পর্যন্ত কীভাবে পৌঁছালাম? হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান হয় না তেমনি সংসারের সকল সন্তান একরকম হয় না, ভালো হয় না। ও ওর জীবনের সবচেয়ে বড়ো বড়ো সিদ্ধান্ত নিজে নিয়ে নিয়েছে। যা চাইলেই আমরা আর শুধরে দিতে পারবো না। মৃত মানুষকে ফেরানোর শক্তি যে আমাদের নেই। বরং আমরা শুধু পারবো ওর জন্য রবের নিকট দোয়া করতে। নিজেকে কষ্ট দিও না বাবা। আমার জীবনে তো তুমি, ভাইয়া, তৈমূর সাহেব ছাড়া আর কেউ নেই। তোমাদের মধ্যে কারো কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে? তোমাকে অনেকদিন বাঁচতে হবে বাবা। হা করো দেখি।”

মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন রায়হান কবীর। উথমীর তুলে দেওয়া লোকমা মুখে নিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। উথমী কিছু বললো না। প্রিয় মানুষদের কান্না দেখলে সে নিজেকে কখনো সামলাতে পারে না। তারও যে খুব কান্না পায়!
________________

কেয়া বেগমের অবস্থা পাগলপ্রায়। উনার মুখ বেঁকে গিয়েছে। স্পষ্টভাবে কথা বলতে না পারলেও পাগলামি কিছুতেই কমছে না। সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙার পর থেকেই আশপাশের সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করছেন,“ঊষা! আমার ঊষা কই? আমার মেয়েকে তোমরা আমার কাছে এনে দাও। ঊষা!”

অনেক চেষ্টার পরেও উনাকে থামাতে না পেরে ব্যর্থ হলেন নার্স। ঘুমের ইনজেকশন দিতে না পেরে সিরিঞ্জ হাতেই দরজার কাছে এসে গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, “কেউ একটু এ ঘরে আসুন প্লিজ! উনি খুব পাগলামি করছেন। কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ঘুমের ইনজেকশন না দিলে পাগলামি আরো বাড়বে।”

ডাক শুনে উথমী নিজেই এসে উপস্থিত হলো সেখানে। নিঃসংকোচে এসে বিছানায় মায়ের সম্মুখে বসলো। আদুরে গলায় ডাকলো,“মা!”

চিৎকার চেঁচামেচি থামলো কেয়া বেগমের। বড়ো কন্যাকে দেখে মুখশ্রীর ভাবভঙ্গি বদলালো। উৎসুক হয়ে পাগলাটে ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,“এই তো উথমী! আমার ঊষা কোথায়? ডাক না ওকে।”

মায়ের বাঁকানো মুখে বলা কথার ধরণ দেখে শরীরটা অবশ হয়ে আসার উপক্রম হলো উথমীর। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলো।আচমকা সে মাকে জড়িয়ে ধরলো। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,“এমন করছো কেনো মা? সারাজীবন তোমাকে দেখে এসেছি কঠিন একজন মানুষ হিসেবে অথচ আজ তুমি এভাবে ভেঙে পড়ছো? সত্যটা তো তুমি জানো মা।ঊষা আর নেই। ও মারা গিয়েছে। সবাই মিলে সেই দুপুরে ওকে অন্ধকার কবরে রেখে এসেছে। ও নেই মা। তুমি দয়া করে এমন করো না।”

রেগে গেলেন তিনি। কথাটা শোনার পর বড়ো কন্যাকে আর কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। রাগত স্বরে বলে উঠলেন,“একদম আমার মেয়ের নামে মিথ্যা বলবি না। আমি জানি, তুই ওকে একদম সহ্য করতে পারিস না। এই জন্য ওকে মৃত বানিয়ে দিলি?”

শব্দ করে কেঁদে উঠলো উথমী। কিন্তু মাকে সে কিছুতেই ছাড়লো না। একসময় সেই কান্নার শব্দে নিভে গেলেন কেয়া। ক্রোধ লুপ্ত হলো। মেয়ের রক্তাক্ত নিথর দেহ, ডাক্তারের বলা কথা মনে পড়তেই তিনিও কাঁদতে লাগলেন। ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,“এতো ভালোবাসা দেওয়ার পরেও এভাবে চলে গেলো ও? এটাই কী আমাদের ভালোবাসার প্রতিদান? ওর রেখে যাওয়া এই শুন্য স্থান কীভাবে পূরণ হবে? বাকি দিনগুলো আমি বাঁচবো কীভাবে? ও আল্লাহ!”

কেঁদে কেঁদে বিলাপ করতে করতেই দেহখানা ঘুমে নেতিয়ে পড়ল কেয়ার। নার্স সুযোগ পেয়ে উনার দেহে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছে। ঘুমিয়ে যেতেই নার্স ঠিকমতো শুইয়ে দিলো উনাকে। উথমীর উদ্দেশ্যে বললো,“আর চিন্তা নেই। আপাতত আজ রাতে আর ঘুম ভাঙছে না উনার।”

উথমী অতিকষ্টে ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না থামালো। মায়ের মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।

বাড়ি থেকে তনিকে নিয়ে ফিরেই আছিয়ার কোলে তাকে হস্তান্তর করে সোফায় বসে পড়ল তৈমূর। গাড়িতে এসি থাকলেও ভীষণ ক্লান্তিবোধ হচ্ছে তার। এখান থেকে বাড়ির দূরত্ব তো আর কম নয়! বারবার আসা যাওয়া কী কম ঝক্কি ঝামেলার কাজ? চুমকি এসে বিষণ্ণ মুখে শরবতের গ্লাস সেন্টার টেবিলের উপর রাখলো। তেষ্টার চোটে গ্লাসটি হাতে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে শরবতটুকু পান করে তৈমূর শুধালো,“উথমী কোথায়?”

“বড়ো আপা? আপায় তো….”

কথাটি শেষ করার আগেই উথমীর আগমন ঘটলো সেখানে। চুমকি তাকে দেখতেই বলে উঠলো,“ওই যে আপায় আইয়া পড়ছে।”

চুমকির কথায় সেদিকে ফিরে তাকালো উথমী। স্বামীকে দেখতেই এগিয়ে এসে পাশে বসলো। জিজ্ঞেস করল,“তনিকে এনেছেন?”

চুমকি সেখান থেকে গ্লাস নিয়ে চলে গেলো। তৈমূর উত্তর দিলো,“হ্যাঁ, তার নানু নিয়ে গেলো।”

“ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিন। খিদে পেয়েছে না? আমি খাবার আনছি।”

“এখন খাবো না।”

“কেনো? খেয়ে এসেছেন?”

“আপনাকে ছেড়ে কীভাবে খাই? বাড়িতে ফিরবেন না?”

স্বামীর কাঁধে মাথা রাখলো উথমী। এক হাত জড়িয়ে ধরে নরম কণ্ঠে বললো,“আজ এখানে থাকি? মায়ের ঘুম ভেঙে গেলেই পাগলামো করছে। বাবাও নিরবে শুধু চোখের পানি ফেলছে। ফেরার পর থেকে বসে আছে বারান্দায়। অনেক কষ্টে অল্প কিছু খাইয়েছি বিকেলে। এই মুহূর্তে কীভাবে চলে যাই বলুন?”

দ্বিমত করল না তৈমূর। সায় দিলো,“তাও ঠিক। আপনি তবে দুটো দিন এখানে থেকে যান। আমি বাড়ি ফিরি। সমস্যা হলে জানাবেন।”

বাঁধন শক্ত হলো উথমীর। শার্টের হাতায় মাথা ঘষে আহত স্বরে বললো,“না, আপনি কোথাও যাবেন না। আমি কিছুতেই একা একা ঘুমাতে পারবো না। আজ থেকে যান এখানে।”

“তা কী করে হয় উথমী?”

“হয়, আমি যা বলেছি তাই। আপনি এখানে থাকছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা একসাথে বাড়ি ফিরবো।”

তৈমূর আর স্ত্রীর বিপরীতে কিছু বলতে পারলো না। ভেবে দেখলো, সত্যিই এই মুহূর্তে এখান থেকে তার চলে যাওয়া উচিত হবে না। তারও তো একটা দায়িত্ব আছে!

রাতে আটটা বাজতেই কাজ শেষ করে চুমকি চলে গেলো। আছিয়া এবং নার্স দুজনেই শুয়ে পড়লেন ঊষার ঘরে।
_______________

অত্যন্ত খারাপ, বিষাদময় একটি দিন পেরিয়ে আকাশে সূর্য উদিত হয়ে জানান দিলো নতুন দিনের আগমনী বার্তা। আছিয়ার হাতে হাতে সকালের নাস্তা তৈরি করে আগে বাবা-মাকে খাওয়ালো উথমী। তারপর বাকি সবার খাওয়া শেষ হতেই সোফায় এসে বসলো। ঊষার রেখে যাওয়া কল রেকর্ডটা গতকাল রাতেই সে তৈমূরকে শুনিয়েছে।

কোনোমতে ক্ষুধা নিবারণ করে সোফায় এসে বসেছে উৎস। ছোটো বোনকে দেখতেই বললো,“ভাবছি মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসবো। মুখের একপাশ বেঁকে গিয়েছে দেখেছিস?”

“হ্যাঁ, গতকালই করে দেওয়া উচিত ছিলো।”

“ভেবেছিলাম একবার কিন্তু হাসপাতালে একা একা তো আর রেখে দেওয়া যায় না। কাউকে না কাউকে সঙ্গে থাকতে হবে। তাই আর!”—–থামলো সে।

আমতা আমতা করে উথমী বললো,“তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো ভাইয়া।”

“কী?”

সময় নিলো না উথমী। সেই রেকর্ডটা সম্পূর্ণ শোনালো ভাইকে। রেকর্ডটি শুনতেই পিলে চমকে উঠলো উৎসর। বললো,“ঊষার কণ্ঠস্বর! এই রেকর্ড তুই কোথায় পেলি?”

“হোয়াটসঅ্যাপে। মৃত্যুর আগে মায়ের মোবাইল দিয়ে আমায় পাঠিয়েছে ও। গতকাল বিকেলেই পেলাম।”

থামলো উথমী। পুনরায় বললো,“তোমার আজই থানায় যাওয়া উচিত ভাইয়া। সব প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। এভাবে তো আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। অপরাধীদের কিছুতেই খোলা আকাশের নিচে ছেড়ে দেওয়া যায় না। কাউকে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। তুমি সেই ওসির সঙ্গে কথা বলো। এই সব কিছু আমি তোমাকে পাঠিয়েছি দেখো। এগুলো নিয়ে তাদের দেখাও।”

“কিন্তু?”

“সবকিছুতে কিন্তু কিন্তু করো না তো ভাইয়া। মনে আছে পুলিশ যখন রাফান নামের সেই ছেলেটাকে ধরে এনেছিল তখন সে কী বলেছিল? পুরো দোষ ঊষার চরিত্রের সাথে লেপ্টে দিয়ে নিজে বেঁচে গিয়েছিল। অথচ সব নষ্টের মূল সে। তার জন্যই তোমার সব টাকা-পয়সা, মায়ের গহনাগাটি হারাতে হলো। এমনি এমনি তো আর তাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এর শেষ আমরা দেখেই ছাড়বো। একটা মেয়েকে ঠকিয়ে, ইজ্জত নষ্ট করে তাকে মেরে ফেলেছে। খুনিকে এভাবে খোলা আকাশের নিচে ছেড়ে দিলে হবে না। যতদূর যাওয়া প্রয়োজন আমরা যাবো।”

নিরবে সেসব শুনলো উৎস। বোন তার ভুল কিছু বলেনি। তৎক্ষণাৎ সে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। যা করার এখনি করতে হবে। তাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। যেতে যেতে বললো,“ঠিক বলেছিস তুই। আমরা এর শেষ দেখে ছাড়বো। আমার পরিচিত উকিল আছে। ভার্সিটির বড়ো ভাই। আগে তার সঙ্গে কথা বলবো পরে থানায় যাবো। দরজা বন্ধ করে দে। বাবা-মা আর তোর ভাবীকে আগেই কিছু জানাস না।”

দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো উৎস। উথমী নিরবে দেখলো ভাইয়ের প্রস্থান। রবের নিকট প্রার্থনা করল। খুব শীঘ্রই যেনো এই কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)