জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-৪৪+৪৫

0
5

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৪৪]

প্রেগন্যান্সির সময়টা খুব দ্রুতই যেনো পেরিয়ে যাচ্ছে উথমীর। সাড়ে আট মাসের বাড়ন্ত পেটটা হাত দিয়ে আগলে ধরে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো সে। ক্লান্ত দেহে সাবধানে বসে পড়ল সোফায়। আশেপাশে কেউ নেই। রন্ধনশালা থেকে হাঁড়ি পাতিলের টুং টাং শব্দ ভেসে আসছে। জোহানের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্বামী সন্তান নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে চলে এসেছে জেবা। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ফ্ল্যাটে তারা আর ফিরবে না। জোহানকে এখানকার একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এবার থেকে সবার সাথে একসঙ্গেই থাকবে।

শরীরটা উথমীর বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগেই তার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তারপরেই অতি কষ্টে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিচে নেমে এলো সে। হাতের মোবাইলটা চোখের সামনে ধরে স্বামীর নাম্বারে কল দিলো। সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করল তৈমূর। প্রেগন্যান্সির পর থেকে স্ত্রীর প্রতি খুবই তৎপর সে। কখন কী হয়ে যায় কে জানে? হাত ঘড়িতে একবার তাকালো, সবে সন্ধ্যা সাতটা বেজে পনেরো মিনিট। ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“কী বলবেন বলুন।”

“কোথায় আপনি?”

মুখশ্রী থমথমে হয়ে গেলো তার। চাপা স্বরে বিরক্তি নিয়ে বললো,“সবসময় ফোন করার পর ঠিক এই প্রশ্নটাই আপনি করেন। এই সময়ে অফিসে না থেকে কোথায় থাকবো আমি?”

“বিরক্তি দেখাচ্ছেন কাকে? সহজ প্রশ্নের উত্তর তো সহজভাবেই দেওয়া যায়। পেটের মধ্যে বাচ্চা ঢুকিয়ে দিয়ে এখন বিরক্তি প্রকাশ করা হচ্ছে? ভালো লাগছে না আমায়, তাই না? লাগবে কীভাবে? এখন তো আমি মোটা হয়ে গিয়েছি, চোখের নিচে কালি জমেছে। থাকুন আপনি আপনার অফিসে। বসে বসে সুন্দরী কলিগ দেখুন।”—-রাগান্বিত স্বরে কথাগুলো বলে দ্রুত কল কেটে দিলো উথমী।

হতভম্ব হয়ে গেলো তৈমূর।থমথমে মুখে কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলো। মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললো,“যা! এটা কী হলো? হঠাৎ করে রাগ দেখালো কেনো? আমি আবার কখন বললাম আপনাকে আমার ভালো লাগে না? মেয়ে মানুষ এমন কেনো?”

বিড়বিড় করতে করতেই পুনরায় কল দিলো তৈমূর। কিন্তু বিপরীত পাশ থেকে তা আর রিসিভ হলো না। তবে হার মানার পাত্র তৈমূর নয়। যতক্ষণ না রিসিভ হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে কল দিতেই থাকবে। চতুর্থ বারে এসে কল রিসিভ হলো। উথমী ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,“ধরছি না যখন বারবার কল দিচ্ছেন কেনো?”

“স্যরি।”

“স্যরি বলেই পার পেয়ে যাবেন ভাবছেন?”

“রেগে আছেন কেনো?পেটে থেকেই আবার কী অঘটন ঘটিয়েছে আমার বাচ্চা?”

নাকের পাটাতন ফুলে গেলো উথমীর। রাগে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। এ আর নতুন নয়। গত পাঁচ মাস ধরে স্ত্রীর এই বাচ্চামো সহ্য করতে হচ্ছে তৈমূরকে। পেটে হালকা ব্যথা কিংবা মাথা গরম হয়ে গেলেও সব দোষ গিয়ে পড়ে এখনো দুনিয়াতে না আসা তৈমূরের বাচ্চাদের উপর। উথমী ভারি কণ্ঠে উত্তর দিলো,“আমি বিকেলে ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার বাচ্চা আমার পেটে লাথি মেরেছে। খুব জোরে জোরে। ওদের জন্য আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। পেটে ব্যথা করছে। বমি হয়েছে।”

মন খারাপ হলো তৈমূরের। ইদানিং ধরে এই সমস্যাটা বেড়েছে। যখন তখন হুটহাট বাচ্চা লাথি মারছে। কিন্তু এতে তার কী করা উচিত? বুঝতে পারে না তৈমূর। কোমল স্বরে বললো,“ভাবী কোথায়? ভাবীকে গিয়ে বলুন। নিশ্চয়ই উনি কোনো হেল্প করতে পারবেন।”

“ভাবীকে কেনো বলবো? বাচ্চা কী ভাবীর? আপনার বাচ্চা তাই যা করার আপনি করুন। বাড়িতে আসুন। এক্ষুনি।”

“মাত্র সন্ধ্যা। ছুটি নিয়ে আসা সম্ভব নয়। বোঝার চেষ্টা করুন।”

“অতো বোঝাবুঝির মধ্যে আমি নেই। আমার অফিস থেকে ছুটি দিতে পারলে আপনাকে কেনো দিবে না?”

“কারণ আপনি প্রেগন্যান্ট। মা হতে চলেছেন।”

“তো? প্রেগন্যান্ট তো আপনিই বানিয়েছেন। আপনিও তো বাবা হতে চলেছেন।”

“দূর, দূর। আর জীবনেও বানাবো না। অলরেডি আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। আমার বোঝদার বউ এক ধাক্কায় অবুঝ হয়ে গিয়েছে। রাখছি।”—-গলার টাই আলগা করে হাতের মোবাইলটা টেবিলের উপর রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো তৈমূর। কী এক মুসিবতে পড়ল সে? কথায় কথায় মেয়েটা তার উপর দোষ চাপাচ্ছে। এতে তার কী দোষ? আজব! বিয়ে করাটাই উচিত হয়নি।এর থেকে অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করলেই হয়তো ভালো হতো। কিছু বললেই দু গালে দুটো দিয়ে থামিয়ে দেওয়া যেতো। কিন্তু একে তো একটা ধমকও পর্যন্ত দেওয়া যায় না। উল্টো সে-ই তৈমূরকে ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৈমূর। এসব মনেও আনা যাবে না। বউ নামক প্রাণী জেনে গেলে আবার সমস্যা!

উথমীর রাগ হলো। তার সাথে হলো অভিমান। স্বামীর উপর ভীষণ অভিমান। কিন্তু মেয়েটি তো এমন ছিলো না কখনো। কারো উপর সহজে তার অভিমান জন্মাতো না। কে কী করল তাতে কিছু যায় আসতো না। অথচ মাতৃত্ব জেগে ওঠার পর থেকেই কত বদলে গেলো সে! বদল হলো তার মনোভাব। মনটা বড্ড বেয়াদব। হুটহাট নিজের অজান্তেই অভিমান করে বসে।

শাহানার ঘরে প্রবেশ করল সে। নিজের ঘরের পর এই ঘরটিই বাড়ির মধ্যে এখন স্বস্তির জায়গা তার। শাহানা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। উথমী এসে বিছানায় বসলো। ডাকলো,“ঘুমিয়েছেন আম্মা?”

পুত্রবধূর কণ্ঠস্বরে চোখ মেলে তাকালেন শাহানা। সময় নিয়ে উঠে বসলেন,“না, এমনি শুয়ে ছিলাম। কখন এলে?”

“এখনি।”

“এভাবে দৌড় ঝাঁপ করতে নিষেধ করেছিলাম না তোমায়? বারবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করো। যদি আমার মতো অবস্থা হয়ে যায়?”

“হবে না কিছু।”

মেয়েটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। শুধালেন,“মন খারাপ?”

আঁখি পল্লব ভারি হয়ে উঠলো উথমীর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,“ওরা আবার আমার পেটে জোরে জোরে লাথি মেরেছে।”

“এদিকে এসো দেখি।”—-নিজের কাছে তাকে ডাকলেন শাহানা।

উথমী এগিয়ে গিয়ে বসলো। পোশাকের উপর দিয়েই পুত্রবধূর উঁচু পেটে হাত বুলিয়ে দোয়া দরুদ পাঠ করে বেশ কয়েকবার ফু দিলেন শাহানা। টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,“এই সময় এমনটা হয়। গর্ভে জায়গা কম। বাচ্চা বড়ো হচ্ছে তাই নড়াচড়া করতে গেলে লাথি লাগে। এইতো আর কটা দিন। একটু সহ্য করো। নাও পানি খাও।”

বাধ্য মেয়ের মতো পানি পান করল উথমী। জেবা এলো নাস্তা নিয়ে। ইদানিং শাশুড়ির ভালো আচরণে ভীষণ আশ্চর্য মেয়েটা।
_____________

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে বিছানায় বসে একটি ফাইলে কাগজপত্র গোছাচ্ছে উৎস। রিনিতা স্বামীকে ডাকতে ঘরে এলো। রায়হান কবীর এশার নামাজ আদায় করেই খেয়ে ওঠেন। এখন কেয়া বেগমও প্রায় সময় স্বামীকে সঙ্গ দিতে উনার সাথেই বসে পড়েন খেতে। তবে রিনিতা খায় না। শ্বশুর-শাশুড়ি আর মেয়েকে খাইয়ে স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষায় বসে থাকে। স্বামীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,“এসব কীসের কাগজপত্র?”

একপলক স্ত্রীর পানে তাকিয়ে আবারো কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো উৎস। উত্তর দিলো,“ঊষার কেসের কাগজপত্র। কাল হাজিরা না?”

“তোমার কী মনে হয়? জিততে পারবে? এতগুলো দিন পেরিয়ে গেলো অথচ সব প্রমাণ সামনে থাকার পরেও প্রসাশন কিছু করছে না। ওদিকে ওরা কিন্তু ঠিকই জামিনে খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

“অপরাধীদের মধ্যকার একজনের চাচা হচ্ছে মেয়র। তার উপর এটা বাংলাদেশ। বোঝোই তো? তবে আমি নিশ্চিত আমরাই জিতবো। কারণ ভরসা তো আল্লাহর উপর করেছি।”

ঘোলাটে দৃষ্টিতে আনমনে তাকিয়ে কিছু ভাবতে থাকে রিনিতা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলে,“হে আল্লাহ, অপরাধীরা যেনো শাস্তি পায়। ভয়ংকর শাস্তি।”

উৎস প্রশ্ন ছুঁড়ে,“তনি কোথায়?”

“বাবা-মায়ের ঘরে। বাবার কাছে গল্প শুনতে শুনতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“বাবা-মা খেয়েছে?”

“হ্যাঁ, তুমিও এখন খেতে এসো। খাওয়া শেষে এসব না হয় গোছগাছ করো।”

“তুমি যাও আমি আসছি‌। আর পাঁচ মিনিট।”

বিপরীতে আর কিছু বললো না রিনিতা। দোলনায় ঘুমিয়ে থাকা রিক্তকে একবার দেখে নিরবে প্রস্থান করল।

আজও বাড়ি ফিরতে দেরি হলো তৈমূরের। ভিতু মনে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই চমকালো। আশেপাশে কোথাও তার আকাঙ্ক্ষিত স্ত্রীয়ের অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো তৈমূরের। সেই সন্ধ্যায় ফোন করে তাকে বাড়ি ফেরার কথা জানিয়েছিল উথমী। কিন্তু কাজের চাপ আর রাস্তায় জ্যামের কারণে ফিরতে দেরি হয়েছে তার। কপালে যে দুর্ভোগ লেখা আছে তা তৈমূর ভালো করেই জানে কিন্তু সেই দুর্ভোগ ঘটানোর মানুষটি কোথায়? সেটাই তো বুঝতে পারছে না।

খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো তৈমূর। ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে নিচে নেমে উঁকি দিলো রন্ধনশালায়। মালতী ফুফু তাকে দেখে বললেন,“ভাত বাড়ছি। খাইয়া লও তাড়াতাড়ি।”

“ফুফু, উথমী কোথায়?”

“ঘরে মনে হয়।”

“আমি তো ঘর থেকেই এলাম। নেই ওখানে।”

“তাইলে তোমার আম্মার ঘরে। সারাদিন তো এহন ওই ঘরেই পইড়া থাকে।”

বিপরীতে কথা না বাড়িয়ে খেতে বসলো তৈমূর। ভীষণ খিদে পেয়েছে তার। শেষ সেই দুপুরে খেয়েছিল তারপর বিভিন্ন ব্যস্ততায় পেটে আর কিছু পড়েনি।

সেই সন্ধ্যা থেকে শাশুড়ির ঘরে অবস্থান করতে করতে তার পাশে শুয়েই ঘুমে ঢলে পড়েছে উথমী। শাহানা আলগোছে তার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। সবে খাওয়া শেষ করে মায়ের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখেই তৈমূরের সারাদেহ বিষ্ময়ে ছাপিয়ে গেলো। চোখ থেকে চশমা খুলে পরনের টি-শার্ট দিয়ে তা মুছে পুনরায় চোখে লাগিয়ে তাকালো সামনে। না ভুল কিছু সে দেখছে না। এটা কী তার নিজের মা? হ্যাঁ, হ্যাঁ নিজেরই তো। কিন্তু উথমীর সাথে এতো ভাব হলো কবে? কয়েক মাস আগেও তো কেউ কাউকে দুচোখে সহ্য করতে পারতো না। দুজনের মাঝখানেই পিষ্ট হতে হচ্ছিল তাকে। অথচ এখন কিনা?

প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল তৈমূর। আজ আর অনুমতি নেওয়ার মতো শিষ্টাচার দেখানোর কথা মাথায় এলো না। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ডেকে উঠলো,“আম্মা!”

ছেলের ডাকে সম্মুখে ফিরে তাকালেন শাহানা। মৃদু হেসে বললেন,“কখন এলি? খেয়েছিস?”

“হ্যাঁ, খেয়েই এখানে আসলাম। উনি কী ঘুমিয়ে পড়েছেন?”

“হুম, শুয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল?”

প্রশ্ন করতে গিয়েও প্রশ্নটা করল না তৈমূর। মায়ের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো হলে তারই লাভ। বাড়ির অশান্তি কমবে আর সবচেয়ে বেশি শান্তি পাবে তৈমূর। বললো,“রাত অনেক হয়েছে। জাগিয়ে দিন উনাকে, ঘরে নিয়ে যাই।”

“ঘুমের মানুষকে জাগিয়ে দিবো? এখানেই থাকুক আজ।”

তৎক্ষণাৎ বিপরীতে কিছু বলতে পারলো না তৈমূর। তবে ভেতরে ভেতরে তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, বউ ছাড়া ওই একা ঘরে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয় আম্মা! দয়া করে আমার বউ আমাকে দিয়ে দিন। কিন্তু মায়ের সামনে ছেলের এমন মনোভাব প্রকাশ পেলে নির্ঘাত শাহানা তাকে বড়ো ভাইয়ের মতো বউ পাগলা উপাধি দিয়ে দিবেন! যে উপাধি তৈমূরের মতো শান্তশিষ্ট মহাপুরুষের সঙ্গে বেমানান। কিন্তু ঘুমন্ত বউকে কোলে করে যে ঘরে নিয়ে যাবে তাও তো তার পক্ষে সম্ভব নয়। মেয়েটির ওজন অনেক বেড়েছে। তাই তৈমূর নিজের বুদ্ধি খাটালো, “এখন একে শান্তশিষ্ট মনে হলেও এ কিন্তু শান্তশিষ্ট নয় আম্মা। রাতবিরেতে বাচ্চা লাথি মারলে কান্নাকাটি করে, হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে। আরো কত বদঅভ্যাস যে আছে! আপনারই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে। তাই জাগিয়ে দিন আমি নিয়ে যাই। এ সময় কত কী হয় বোঝেনই তো?”

ছেলের কথা ফেলে দিলেন না শাহানা। বললেন, “আচ্ছা নিয়ে যা তবে। খেয়াল রাখিস বউয়ের।”

তৈমূর উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে জাগিয়ে তুললো উথমীকে। তারপর অনেক কষ্টে নিয়ে এলো ঘরে।

রাত বারোটা ছুঁইছুঁই।চোখ থেকে সব ঘুম মিলিয়ে গেলো উথমীর। বিছানায় অর্ধশোয়া সে। তৈমূর দরজা আটকে সুইচ বোর্ডে হাত রাখতেই বাঁধা দিয়ে বললো,“আলো নেভাবেন না।”

হাত গুটিয়ে পিছু ফিরলো তৈমূর। শুধালো,“কেনো?”

“এমনি।”

“আলো না নিভিয়ে ঘুমাবো কীভাবে?”

“জানি না।”

তাকে আর না ঘাঁটিয়ে আলো না নিভিয়ে বিছানায় এসে বালিশ ঠিক করে বসলো তৈমূর। কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,“রেগে আছেন?”

“না।”

“রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো তাই ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছে, স্যরি।”

প্রত্যুত্তর করল না উথমী। তার এই নিরবতায় তৈমূর বুঝে গেলো, স্ত্রী তার উপর অভিমান করেছে। তাই সেই অভিমান ভাঙতে একহাতে জড়িয়ে ধরে ফটাফট স্ত্রীর গালে দুটো চুমু দিলো সে। কিন্তু উথমী আজ আর চমকালো না। বরং ভ্রু কুঁচকে লোকটির দিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তৈমূর বললো, “একটা কথা বলুন তো, আম্মার সাথে কবে কবে আপনার এতো ভাব হলো? এইতো কয়েকদিন আগে দুজন দুজনকে দেখতে পারতেন না। গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকতো। বাড়িতে এলেই নালিশ আর নালিশ। তাহলে হঠাৎ এতো মিল?”

“আপনার মা মানুষটা খারাপ নন। সব নষ্টের মূল হচ্ছে আপনার বড়ো বোন। এতকাল ভাই বউদের নামে আম্মার কান ভারি করে মন বিষিয়ে দিয়েছিল। মায়েরা নিজেদের মেয়েকে বিশ্বাস করবে এটাই তো স্বাভাবিক? এখন বাড়িতে আপনার বোনেরও আসা কমে গিয়েছে তার উপর প্রেগন্যান্ট আমি, এই অবস্থায় উনার সেবা যত্ন করছি, কলেজে ছুটি পেয়ে সারাদিন বাড়িতে থাকি তাই সম্পর্কে উন্নতি হয়েছে।”

“যাক শান্তি অবশেষে! এবার শুয়ে পড়ুন। খুব ঘুম পাচ্ছে।”

“কথা ছিলো আমার।”

“হুম বলুন।”—-শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তৈমূর।

উথমী তার অমনোযোগী ভাব দেখে দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের সুরে বললো,“বলেছি না কিছু বলার আছে আমার?”

ভড়কে গেলো তৈমূর। মেয়েটা তাকে ধমক দিচ্ছে! মারাত্মক ব্যাপার। মিনমিনে স্বরে বললো,“শুনছি তো।”

“মনোযোগ দিয়ে শুনুন।”

“আচ্ছা।”

সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উথমী। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“এসব আপনে আজ্ঞা করে আমায় আর ডাকবেন না।”

“হ্যাঁ?”—-বোকা বনে গেলো তৈমূর।

“আপনার কী মনে হচ্ছে না আমাদের সম্পর্কটা কেমন এক গুরুজন গুরুজন ভাইবে আটকে রয়েছে? কদিন পর আমাদের বাচ্চা হবে। সে যখন দেখবে তার বাবা তার মাকে আপনি আজ্ঞা করছে তখন কী প্রভাব পড়বে তার উপর? কী ভাববে সে? মনে করবে তার বাবা-মায়ের সম্পর্কে সমস্যা আছে।”

“কিন্তু আমাদের সম্পর্কে তো কোনো সমস্যা নেই।”

“তাহলে নিজের বউকে আপনি আপনি সম্বোধন কেনো করেন? এমন সম্মানের প্রয়োজন নেই আমার। সেদিন হাসপাতালে চেকআপ করতে গিয়ে আপনি আমায় আপনি বলে সম্বোধন করলেন। তখনি ডাক্তার সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এমনকি সিরিয়ালে বসে থাকতে এক মহিলা তো জিজ্ঞেসই করে বসলেন, উনি কী আপনার দেবর? কি লজ্জার ব্যাপার! স্বামীকে দেবর বানিয়ে দিলো? সব দোষ আপনার।”

“কই সেদিন তো বললেন না? তাছাড়া মানুষের ভাবনা দিয়ে কী আসে যায়?”

“আপনার না গেলেও আমার আসে যায়। এসব দেবর ভাবীর সম্পর্কে আমি থাকতে পারবো না।”

“আশ্চর্য!”

কড়া দৃষ্টিতে স্বামীর পানে তাকালো উথমী। তৈমূর ভড়কে গেলো। বোকা হেসে বললো,“আপনিও তো আমায় আপনি সম্বোধন করেই কথা বলেন।”

“আমি আর আপনি এক হলাম? আমি নারী, আপনি পুরুষ। আমি পেটে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছি আর আপনি আমার পেটে বাচ্চা দিয়ে আয়েশ করছেন। তাহলে আমার সাথে আপনার কী জোড়া? বাচ্চার চাচা যদি হতে না চান তাহলে গুরুজনের মতো ট্রিট করবেন না বলে দিলাম।”

“এতদিন ধরে ডাকছি। এখন হঠাৎ আপনাকে তুমি করে কীভাবে ডাকি?”

“আরেকবার আপনি বললে আমি বাপের বাড়ি চলে যাবো বলে দিলাম। বাচ্চার মুখ দেখতে দিবো না।”

“উথমী!”

“বড়ো হলে চাচা ডাক শিখাবো।”

মুখশ্রী মলিন হয়ে গেলো তৈমূরের। এ মেয়েকে মোটেও বিশ্বাস নেই। বলেছে যেহেতু করেই ছাড়বে। উথমী তার হাবভাব দেখে বললো,“অন্য জায়গায় কিছু চলছে? নইলে বউকে তুমি বলতে তো এতো ভাবার কথা নয়।”

“আস্তাগফিরুল্লাহ! এসব মুখে আনাও পাপ।”

“তাহলে বলা শুরু করেন। বউ বউ ফিল নিতে ইচ্ছে করছে।”

“এতদিন তবে কী ফিল করলেন?”

পুনরায় উথমী চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আমতা আমতা করল তৈমূর,“না মানে এতদিন কী ফিল করলে তুমি?”

চিকচিক করে উঠলো উথমীর মুখশ্রী। স্বামীর বাহু জড়িয়ে ধরে সেখানে গাল ঘষে বললো,“এইতো এবার ঠিক আছে। বাচ্চাকে প্রথমে বাবা ডাকটাই শিখাবো।”

“অথচ নিজে ঠিকই আপনি আপনি করছো।”

“আমি আপনি আপনিই বলবো। অতো তুমি তুমি করে ফর্মালিটি পালন করতে পারবো না।”

আড়চোখে তার পানে তাকিয়ে রইলো তৈমূর।
__________

আজ ফজরের নামাজ ঘরেই আদায় করে নিলো তৈমূর। ভোরের আলো ফোটতেই চা বানিয়ে মালতী ফুফুকে দিয়ে সবাইকে ডাকতে পাঠালো জেবা। তৈমূর নিচে নেমে সর্বপ্রথম মায়ের খবরাখবর নিয়ে এসে বসলো অন্দরমহলের সোফায়। গতকাল সকালে বড়ো ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল তার। এরপর সারাদিনেও আর বিভিন্ন ব্যস্ততায় দেখা হয়নি তাদের। চা খেতে খেতে দুজনের মধ্যে কথা চলছে। তখনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দুতলার সিঁড়ির কাছে থামলেন মালতী ফুফু। চিৎকার করে বিচলিত কণ্ঠে বললেন, “তৈমূর বাবা! তোমার বউয়ের বিষ উঠছে। তাড়াতাড়ি আহো।”

উনার কথায় চায়ের কাপ ধরা হাতটি থেমে গেলো তৈমূরের। উপরে তাকিয়ে বললো,“আমি তো ঠিকই দেখে এলাম। এর মধ্যে আবার কী হয়ে গেলো?”

বলতে বলতেই চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলের উপর রেখে ছুটে ঘরে চলে এলো তৈমূর। প্রচন্ড ব্যথায় হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল উথমীর। অতিকষ্টে ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরোতেই আর যেনো সামনে কদম ফেলার শক্তিটুকুও পেলো না দেহে। পেট চেপে ওখানেই বসে পড়ল। চোখ দিয়ে সে অন্ধকার দেখছে। প্রচন্ড ব্যথায় শুরু হয়ে গিয়েছে রক্তপাত। তৈমূর দৌড়ে এসে স্ত্রীকে আগলে ধরলো। মাথাটা বুকে ঠেকিয়ে হাত ঢলতে ঢলতে উদ্বিগ্ন, চিন্তিত কণ্ঠে শুধালো,“রক্ত কেনো এখানে? কী হয়েছে উথমী?”

উথমী শুনলো কিনা কে জানে? মারাত্মক যন্ত্রণা নিয়েই কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা ভাঙা বাক্যে বললো, “খুব ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে মরে যাবো।”

তার পিছুপিছু জেবা, তুরাগ এসেও দরজার কাছে থেমেছে। জায়ের এমন অবস্থা দেখে কিছু একটা আঁচ করল জেবা। বলে উঠলো,“এখনো তো ডেলিভারির সময় হয়নি তাহলে হঠাৎ করে এই অবস্থা হলো কীভাবে?”

তৈমূর গুরুত্ব দিলো না সেসব কথায়। স্ত্রীকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেই ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,“এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এম্বুল্যান্সে কল দাও। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”

কী করবে বুঝতে পারছিল না তুরাগ। ভাইয়ের কথায় মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো তার। যেতে যেতে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে গেলো,“ওকে বলো উথমীকে নিয়ে নিচে আসতে। এতো সকালে এম্বুল্যান্স পাওয়া যাবে কিনা কে জানে? আমি গাড়ি বের করছি।”

চলবে _________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৪৫]

বাইরে গা ঝলসানো রোদ। নীলাম্বরে নেই শুভ্র মেঘের ছাউনি। তবুও অন্যদিনের তুলনায় আজকের দিনটি অদ্ভুত সুন্দর। ও.টিতে উথমীর অপারেশন চলছে। করিডোরে স্ত্রী-বাচ্চার জন্য অপেক্ষারত তৈমূরের অবস্থা ভীষণ নাজেহাল। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে সে। প্রেশার ক্রমশ বাড়ছে। তুরাগ পাশে বসে ছোটো ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দিচ্ছে,“আহা একটু শান্ত হয়ে বোস।এমন করছিস যেনো অপারেশন তোর বউয়ের নয় বরং তোর হচ্ছে।”

সেসব কথা তৈমূরের শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালেও মস্তিষ্কে তেমন ছাপ ফেলতে পারলো না। চোখের সামনে ব্যথায় কাতর স্ত্রীকে দেখে শরীর তার এখনো কাঁপছে। হন্তদন্ত হয়ে সকালেই পাশের একটা হাসপাতালে নিয়ে আসার পর সেই যে তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো, তুরাগের মাধ্যমে আনানো হলো রক্ত! এরপর থেকে আর কোনো খবর নেই।

মিনিট দশেক বাদে ভেতর থেকে ভেসে এলো বাচ্চাদের গগন বিদারী চিৎকারের শব্দ। একজন নার্স বেরিয়ে এসে আনন্দিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “অভিনন্দন! জমজ সন্তান হয়েছে।”

এমন একটি সুসংবাদে উপস্থিত সকলে চমকে গেলো। রায়হান কবীর, কেয়া বেগম থেকে শুরু করে উৎস, তুরাগ, জেবা সবাই। হাসপাতালে পৌঁছে স্বামীর মোবাইল থেকে জেবা নিজেই খবরটা উৎসকে দিয়েছিল। সেই খবর রায়হান কবীর পর্যন্ত পৌঁছাতেই স্ত্রী আর ছেলেকে বগল দাবা করে এখানে হাজির হয়েছেন তিনি। তৈমূর বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।অন্তরাত্মা যেনো কেঁপে উঠলো তার। সারাদেহ বরফের মতো জমে গিয়েছে। খড়খড়ে ওষ্ঠদ্বয় জিভ দিয়ে ভিজিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,“বাচ্চা! আমার জমজ বাচ্চা?”

নার্স মুচকি হেসে প্রত্যুত্তর করলেন,“হ্যাঁ।”

জেবা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“ছেলে নাকি মেয়ে?”

“একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে।আগে আল্ট্রাসনোগ্রাম করেননি?”

দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দিলো তৈমূর। প্রেগন্যান্সির শুরুতে যখন ভ্রুণ অনেক ছোটো ছিলো তখন একবার করলেও পরবর্তীতে উথমী আর কিছুতেই এসবে রাজি হয়নি। এমনকি তৈমূর বলার পরেও না। আগেই যদি জেনে যায়, বাচ্চা ছেলে হবে নাকি মেয়ে? তাহলে আনন্দ থাকলো কোথায়? তৈমূর বিচলিত হয়ে এবার জিজ্ঞেস করল,“উথমী! আমার ওয়াইফ? ও কেমন আছে?”

“প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে উনার। জ্ঞান এখনো ফিরেনি। দু দুটো বাচ্চা হয়েছে, বুঝেনই তো? আল্লাহকে ডাকুন।”

মুহূর্তেই তৈমূরের মুখশ্রীর সকল আনন্দ বিলীন হয়ে তাতে ঠাঁই পেলো মলিনতা। এমন একটি সময়ে এসে সে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারলো উথমী নামক নারীটি তার জীবনে ঠিক কতটুকু জায়গা দখল করে রয়েছে।

কিছু সময় বাদে যখন শুভ্র কাপড়ে মুড়িয়ে ফুলের মতো নিষ্পাপ বাচ্চা দুটোকে বাইরে নিয়ে আসা হলো। তখন সকলেই ব্যস্ত হয়ে গেলো তাদের নিয়ে। শুধু ব্যস্ত হতে পারলো না তৈমূর এবং রায়হান কবীর। দুজনেই বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে জ্ঞানহারা মেয়েটির চিন্তায় মশগুল। আহা! উথমী যদি একবার এই দৃশ্যটি নিজ চোখে দেখতে পেতো তাহলে হয়তো নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন নারী মনে হতো তার। যার চিন্তায় বাইরে বসে অস্থির হয়ে আছে এক পিতা এবং স্বামী।

তুরাগ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,“তুই তো কেল্লাফতে করে দিয়েছিস ভাই আমার। দু দুটো বাচ্চা! তাও আবার ছেলে, মেয়ে একসাথে! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।এখনো ওখানে বসে আছিস কেনো? বাচ্চাদের দেখে যা। কোলে নে।”

অন্য কোনো সময় হলে হয়তো নাজুক তৈমূর লজ্জা পেতো কিন্তু এখন সেসব তার সাথে বেমানান। মাথায় স্ত্রীর চিন্তা নিয়েই এগিয়ে এসে দাঁড়ালো বাচ্চাদের কাছে। মেয়ে বাচ্চাটি জেবার কোলে আর ছেলে বাচ্চাটি কেয়া বেগমের কোলে। দৃষ্টিতে মায়া নিয়ে তাদের পানে তাকাতেই ভেতরে পিতৃসত্তা জেগে উঠেলো তৈমূরের। একে একে দুজনকেই কোলে নিয়ে চুমু দিলো কপালে। একেবারে মায়ের মতো গায়ের রঙ নিয়ে জন্মেছে তারা। তৈমূর তপ্ত শ্বাস ফেললো। শুরু থেকেই সে চেয়েছিল, চেহারা যেমন তেমন হোক কিন্তু গায়ের রঙ যেনো তারা মায়ের মতোই পায়। সৃষ্টিকর্তা তার দোয়া কবুল করেছেন।

আরো ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর উথমীর জ্ঞান ফেরার খবর জানান দিয়ে গেলেন আরেকজন নার্স। সেই খবর শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তৈমূর কিন্তু তার পথে বাঁধ সাধলেন রায়হান কবীর। মেয়ের চিন্তায় বুঁদ হয়ে জামাতার দিকে খেয়াল করার কথা মনে রইলো না উনার। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলেন,“জ্ঞান ফিরেছে! আমার মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে? আমি দেখা করবো ওর সাথে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পূর্বের ন্যায় বসে পড়ল তৈমূর। এখন গিয়ে কী আর শ্বশুরকে বাঁধা দিয়ে, ‘আগে আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবো’ বলা যায়? কী মনে করবেন ভদ্রলোক? মনে হচ্ছে এবার যেনো ছোটো খাটো একটা স্ট্রোক করে বসবে সে।

রায়হান কবীর আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ছুটলেন ভেতরে। কেয়া বেগম সেই কখন থেকেই জামাতাকে লক্ষ্য করছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো সন্তানদের জন্য বেচারা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে। প্রথমবারের মতো বাবা হচ্ছে বলে কথা! কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই উনার ধারণা বদলে গেলো। শুধু বাচ্চা নয় বরং তাদের পাশাপাশি এতক্ষণ ধরে উথমীর চিন্তাতেই তার এই অবস্থা। তাই ছেলেটার জন্য ভীষণ মায়া হলো উনার।

নড়াচড়ার মতো দেহে কোনো শক্তি পাচ্ছে না উথমী। হাতে তার স্যালাইন ঝুলছে। রক্তের বোতল খালি হয়েছে মিনিট দুয়েক আগে। যার কারণে তা খুলে দেওয়া হয়েছে। পেটের দিকটাও অবশ লাগছে। মাথায় অনুভূত হচ্ছে চিনচিনে ব্যথা। জ্ঞান ফিরতেই আশেপাশে মানুষ বলতে নার্স আর ডাক্তার ছাড়া কাউকেই দেখেনি সে। রায়হান কবীর হন্তদন্ত পায়ে ভেতরে ছুটে এসে একটি চেয়ারে বসলেন। মেয়ের মাথায় পরম মমতায় হাত রেখে কোমল স্বরে বললেন, “মা আমার।”

বাবাকে দেখে বিষণ্ণ মুখে হাসি ফোটে উঠলো উথমীর। অস্পষ্ট শব্দে ডাকলো,“বাবা!”

“এখন কেমন লাগছে মা?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

আশানুরূপ উত্তরে রায়হান কবীর মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনেই তিনি বুঝে গেলেন, মেয়ে উনার ভালো নেই। এমন সময় ভালো থাকা সম্ভবও নয়। বাচ্চা জন্ম দেওয়া তো আর কম কষ্টের কাজ নয়। সেখানে নিজের কোলে করে বড়ো করা আদরের সেই ছোট্ট মেয়েটি কত বড়োই না হয়ে গেলো? মাসের পর মাস বেদনা সহ্য করে দু দুটো জমজ সন্তানের জননী হয়ে উঠলো। সেই বিষয়টি ভাবতেই চোখ জোড়া ভিজে উঠেছে রায়হান কবীরের। নিরবে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। উথমী শুধালো,“আমার বাচ্চা কোথায় বাবা? একবার কানে এসেছিল, ছেলে হয়েছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।”

“জমজ বাচ্চা হয়েছে মা। একজন ছেলে আরেকজন মেয়ে।”

চমকে গেলো উথমী। কয়েক সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে রইলো পিতার পানে। বিস্ময় নিয়ে বললো,“সত্যি বাবা!”

“হ্যাঁ, মা।”

“আর তোমাদের জামাই? উনি কোথায়?”

“বাইরে আছে হয়তো।”

“ওহ।”—-মন খারাপ হলো উথমীর। লোকটা কী জানে না যে তার জ্ঞান ফিরেছে? নইলে এখনো এলো না কেনো ভেতরে? নাকি বাচ্চাদের কাছেই ব্যস্ত?

কেয়া বেগম তখনি ভেতরে প্রবেশ করলেন। স্বামীর উদ্দেশ্যে চাপা এবং কড়া গলায় বললেন,“তোমার কী কোনো কান্ডজ্ঞান বলে কিছু নেই? সকাল থেকে ওর চিন্তায় জামাই বাইরে অপেক্ষা করছে। তুমি এভাবে এখানে বসে থাকলে ও এসে দেখা করবে কীভাবে?”

“তো আমি আমার মেয়েকে দেখবো না? আমার চিন্তা হয় না? ওকে আসতে বলো।”—-রায়হান কবীর অবুঝের মতো বলে বসলেন কথাটি।

স্বামীর আচরণে রেগে গেলেন কেয়া। চোয়াল শক্ত করে বললেন,“দেখা শেষ এবার চলো। পরে না হয় আবার এসে দেখা করবে।”

বাধ্য হয়েই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন রায়হান কবীর। মেয়ের দিকে একপলক তাকিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলেন বাইরে। উনাকে বেরোতে দেখেই আর বসে না থেকে ভেতরে প্রবেশ করল তৈমূর। জাগ্ৰত স্ত্রীকে দেখে যেনো প্রাণ ফিরে পেলো দেহে। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে উত্তেজনা কমানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। উথমী স্বামীর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। পরনে বাসায় পরা নরমাল ট্রাউজার আর মেরুণ রঙের টি-শার্ট। ঘামের কারণে যা দেহের সাথে একেবারে মিশে গিয়েছে। চুলগুলো উস্কো খুস্কো। অনেকক্ষণ ধরে যেনো চিরুনির ছোঁয়া পায়নি। চোখের চশমাটাও ঘোলাটে।

তৈমূরের অশান্ত চোখের মণি ঘুরেফিরে স্ত্রীকে দেখতে ব্যস্ত। একপর্যায়ে মুখশ্রী ছেড়ে তা স্থির হলো নীল কাপড়ে ঢাকা পেটের উপর। ইচ্ছে করল সেখানটা ছুঁয়ে দিতে কিন্তু মস্তিষ্ক জানান দিলো অন্যকিছু। মন খারাপ নিয়ে নম্র কণ্ঠে বললো,“এতটুকু একটা পেটে দু দুটো বাচ্চা! খুব কষ্ট হয়েছে তাই না উথমী?”

উথমী অবাক নয়নে ভদ্রলোকের মুখপানে তাকিয়ে আছে। তৈমূর নিজে নিজেই বললো,“খুব ব্যথা করছে?”

“বুঝতে পারছি না। জায়গাটা অবশ লাগছে।”

ভীষণ মায়া হলো তৈমূরের। ভাবতেই কেমন লাগছে তার। এতগুলো দিন কীভাবে এই যন্ত্রণা সহ্য করল মেয়েটা? উথমী প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এখন কয়টা বাজে?”

নিজের হাতে তাকালো তৈমূর। কিন্তু হাতঘড়িটা মিসিং। পকেটে মোবাইলেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। সকালে হঠাৎ অমন ঘটনায় আধ খাওয়া চা ফেলেই তো স্ত্রীর কাছে ছুটে গিয়েছিল সে। তারপর আলমারি থেকে শুধু ক্যাশ টাকাগুলো পকেটে ভরে মেয়েটাকে একাই কোলে করে নিচে নেমে গাড়িতে উঠে হাসপাতালে পৌঁছালো। তাই সেসব বাড়িতেই পড়ে রয়েছে। ওই বিপদের সময় এতকিছু মাথায় থাকে নাকি? তবুও তাকে নিচ পর্যন্ত নিয়ে আসার শক্তিটুকু যে ঠিক কোথায় পেলো তৈমূর তাই অজানা। উত্তরে বললো,“বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে।”

তাদের কথার মধ্যেই দুজন নার্স বাচ্চা কোলে নিয়ে ভেতরে এলেন। উথমীকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে বাচ্চা দুটোকে পাশাপাশি শোয়ালেন। উথমী জিজ্ঞেস করল, ”ওদের মধ্যে বড়ো কে?”

“ছেলে পাঁচ মিনিটের বড়ো আর মেয়ে ছোটো।”

প্রত্যুত্তর করে চলে গেলেন উনারা। উথমী বাচ্চাদের ঘুমন্ত মুখশ্রীতে দৃষ্টি স্থির করে স্বামীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তা তৈমূর সাহেব, বাবা হয়ে কেমন অনুভূতি হচ্ছে?”

প্রশ্নটির বিপরীতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে মুচকি হাসলো তৈমূর। বাচ্চাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কোমল স্বরে উত্তর দিলো,“আমি তো এই সাড়ে আট মাস ধরে শুধু জেনে এসেছি আমি বাবা হবো। ছোট্ট একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করবো। কিন্তু আমার ভাবনার থেকেও আল্লাহ আমায় এতো বড়ো দুটো উপহার দিয়ে দিলেন উথমী? একসঙ্গে দু দুজন ছেলে-মেয়ে! ঠিক কী অনুভূতি যে ভেতরে কাজ করছে আমি সঠিক বুঝতে পারছি না।”

নিঃশব্দে হাসলো উথমী। খোঁচা মেরে বললো,“আপনি খুবই ধুরন্ধর লোক তৈমূর সাহেব। আপনাকে আমি কত ভালো, হাবাগোবা মানুষ ভেবেছিলাম অথচ সেই আপনি আমার ছোট্ট পেটে দু দুটো বাচ্চা দিয়ে দিলেন? ছিঃ!”

এমন এক অবস্থায় থেকেও মেয়েটি তাকে বিদ্রুপ করা ছাড়লো না? শব্দ করে হেসে উঠলো তৈমূর। এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীর কপালে আর ঠোঁটে‌ নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বললো,“আমি দিয়ে দিলাম আর আপনি নিয়ে নিলেন? খুব বাধ্য মেয়ে তো!”

লজ্জা পেয়ে মিইয়ে গেলো উথমী। গাল দুটোতে লাল আভা ফোটে উঠলো যেনো। তার লজ্জাটাকে আরো বাড়িয়ে দিতে তৈমূর আচমকাই বলে উঠলো, “আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে উথমী।”

বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে স্বামীর পানে তাকালো উথমী।‌ আমতা আমতা করে বললো,“সুন্দর লাগছে! সিরিয়াসলি? এমন অবস্থায় সুন্দর লাগছে?”

“হ্যাঁ, সত্যি বলছি।”

“মাথা ঠিক আছে?”

“হুম, একদম। এইতো গত বছর এক বৃষ্টিমুখর দিনে সিঙ্গেল তকমা ঘুচিয়ে আপনাকে বউ করে বাড়িতে নিয়ে এলাম। আর এই বছরই আপনি আমায় চারজন বানিয়ে দিলেন?”

মুচকি হাসলো উথমী। কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললো, “আবার আপনি আপনি সম্বোধন করছেন?”

“পুরোনো অভ্যাস। ঠিক করতে একটু সময় তো লাগবেই।”

“তা বাচ্চাদের নাম কী রাখলেন শুনি? আমি নামটাম রাখার ব্যাপারে অজ্ঞ। ফটাফট সুন্দর সুন্দর দুটো নাম রেখে ফেলুন তো।”

“মেয়ের নাম, উম্মে ইজরা হাসান তাইয়্যেবা। ছেলের নাম, উমায়ের হাসান ইমাদ। ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে তখন তো আর তা জানতাম না তাই আগেই নাম দুটো ভেবে রেখেছিলাম। এখন তো দেখছি দুটোই কাজে লেগে গেলো। তা পছন্দ হয়েছে?”

তৃপ্ত হলো উথমী। জ্বলজ্বলে চাহনিতে প্রত্যুত্তর করল, “হুম হয়েছে। নামগুলো সুন্দর কিন্তু! ম্যাচিং ম্যাচিং।”

তাদের কথার মধ্যে বাকিরা এসেও প্রবেশ করল ভেতরে। বাচ্চাদের ঘুম ততক্ষণে ভেঙে গিয়েছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার তারা কাঁদছে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বাবা-মাকে দেখছে। কি নিষ্পাপ তাদের মুখশ্রী! কি নিষ্পাপ তাদের চাহনি!
____________

হাসপাতাল থেকে বড়ো পুত্রবধূর ফোনকলের মাধ্যমে আসা সুসংবাদটি শ্রবণাতীত হতেই উত্তেজনা ভর করেছে শাহানার মনে। এই প্রথম বংশে জমজ বাচ্চা হয়েছে তাও আবার ছেলে, মেয়ে একসাথে! খবরটা পাওয়ার পর থেকে আনন্দ যেনো আর ধরছে না উনার। তবে ঘরে বসে খুব কষ্টও পাচ্ছেন শাহানা। এমন একটা সময় ঘরে পঙ্গু হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে উনাকে। চেয়েও পারছেন না নাতি নাতনিদের গিয়ে কোলে নিয়ে আদর করতে। কবে হাসপাতাল থেকে তারা ফিরবে আর তিনি দুচোখ ভরে দেখবেন?

হঠাৎ করেই ঘরে আগমন ঘটলো তিথিয়ার। কন্যাকে দেখে বেশ অবাক হলেন শাহানা। অস্ফুট স্বরে বললেন,“তুই?”

হাস্যোজ্জ্বল মুখে বিছানায় এসে বসলো তিথিয়া। প্রত্যুত্তর করল,“হ্যাঁ, শুনেছি তৈমূরের জমজ বাচ্চা হয়েছে। তাই সোজা হাসপাতালে গিয়ে বাচ্চা দেখে তারপর এখানে চলে এলাম।”

“কেমন দেখতে হয়েছে রে? দাদার মতো? আমাদের জোহান তো একেবারে দাদার সব পেয়েছে।”

“না, আপনার আর আপনার পুত্রবধূর গায়ের রঙ পেয়েছে। তবে নাক-মুখ অবিকল তৈমূরের মতো।”

“এতদিন পর আমার মনে হচ্ছে তৈমূর একেবারে ঠিক একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে। মেয়েটা সঙ্গে করে বাড়িতে বরকত নিয়ে এসেছে।”—-বুক ফুলিয়ে কথাটা বললেন শাহানা।

তিথিয়া প্রত্যুত্তর করল না। আগের থেকে অনেকটা বদলেছে সে। পুরোনো সেই হিংসাত্মক মনোভাবটাও কমেছে। তাই তো এই মুহূর্তে মায়ের মুখে অন্যের প্রশংসা শুনেও রাগ দেখালো না সে। শাহানা জিজ্ঞেস করলেন,“একা এলি কেনো? ওরি, মিলিকেও সাথে করে নিয়ে আসতে পারতি। বলেছিলাম না? মেয়ে মানুষদের একা ছেড়ে দিতে নেই।”

মুখ মলিন হয়ে গেলো তিথিয়ার। বললো,“ওদের বাবা এসেছে মেয়েদের সাথে দেখা করতে। তাই আমি এখানে চলে এসেছি। তৈমূররা বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত কয়েকদিন এখানেই থাকবো।”

হাস্যোজ্জ্বল মুখখানায় বিরক্তি ফোটে উঠলো শাহানার। বললেন,“দেখা করতে চাইলো আর তুইও দেখা করতে দিয়ে দিলি? তাছাড়া মেয়েরা বাপকে দেখেই গলে পড়ল?”

“বাদ দেন আম্মা। বেচারা খুব চাপে আছে। শুনলাম দ্বিতীয় পক্ষের ছোটো ছেলেটা বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। নিষেধ করে দিয়েছে। বড়ো ছেলেটাই টিউশন, পার্ট টাইম জব করে সংসার চালায়। বউ খুব অসুস্থ। তার অপকর্ম সম্পর্কে জেনে মেয়েটার সংসারেও অশান্তি। আর এদিকে ওরিও খুব রেগে আছে। বাবার মুখদর্শন সে করতে চায় না। কিন্তু আমিই বলেছি ভালো ব্যবহার করতে। আমার সাথে যাই করুক সন্তানদের ও খুব ভালোবাসে।”

শাহানা নিরব হয়ে গেলেন। মেয়েটা উনার সবার ক্ষেত্রে কঠোর হলেও এখানে এসে খুব দুর্বল। তুরাগ এতবার মামলা দিতে চাওয়ার পরেও কিছুতেই রাজি হলো না। এই বয়সে থানা পুলিশ সে চায় না। এসব করলে নাকি মেয়েদের ভবিষ্যতে প্রভাব পড়বে। বাবা জেলখাটা আসামি শুনলে হয়তো বিয়েই হবে না। মাঝখানে এহসান, মঈনুদ্দিন দুবার এসেছিল। ওরাই শামীমকে ভয় দেখিয়ে রেস্তোরাঁ দুটো লিখিয়ে নিয়েছে তিথিয়ার নামে। এসব কিছু তো আর তার নয়। এসবি তিথিয়ার বাবার দেওয়া। বিনিময়ে কথা ছিলো, তিথিয়াকে কখনো সে কষ্ট দিতে পারবে না। কিন্তু সেকথা তো শামীম রাখেনি। এতকাল স্ত্রীকে সে ঠকিয়েছে। খুব বাজেভাবে ঠকিয়েছে। বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনকে লুকিয়ে রেখে তা নিয়ে খেলা করেছে। যা অন্যায়। মারাত্মক অন‌্যায়!

সেসবের জন্য রবের কাছেই নালিশ জানিয়ে রেখেছে তিথিয়া। দুনিয়ার বিচার যেমন তেমন কিন্তু রবের বিচার যে খুবই ভয়ানক! যেই বিচারের কাছে সকল বিচার তুচ্ছ। মিনমিনে স্বরে বললো,“ওরির জন্য ভালো একটা সম্বন্ধ এসেছে আম্মা। ছেলে সরকারি চাকরি করে। এমনকি ওরা বলেছে, বিয়ের পরেও লেখাপড়া করাবে। তাই ভাবছি বিয়েটা দিয়েই দিবো।”

ললাটে ভাঁজ পড়ল শাহানার। তৎক্ষণাৎ দ্বিমত পোষণ করে বলে উঠলেন,“কোনো প্রয়োজন নেই। বাড়িতে মেয়ে থাকলে বিয়ের সম্বন্ধ আসতেই থাকবে। কিন্তু বিয়ের পরে যে লেখাপড়া হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই মেয়েকে লেখাপড়া করা। লেখাপড়ায় তো বরাবরই ও খুব ভালো।”

“এ কথা আপনি বলছেন আম্মা?”

“হ্যাঁ বলছি। তোর অবস্থা দেখে আমার শিক্ষা হয়েছে। এবার আর কোনো ভুল আমি করবো না। আমি চাই আমার নাতনিরা অনেক লেখাপড়া করুক। ছোটো বউয়ের মতো আগে নিজের পায়ে দাঁড়াক। যাতে ভবিষ্যতে কারো উপর তাদের নির্ভরশীল হতে না হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার বদলে ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নিরব থাকতে না হয়।”

মায়ের কথায় ভীষণ আশ্চর্য হলো তিথিয়া।

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)