জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-৪৬ এবং শেষ পর্ব

0
6

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
#উপসংহার

গোধূলির শেষ লগ্নে ফুলকুঞ্জ বাড়িটির মূল ফটকে এসে থামলো চিরচেনা নীল রঙের গাড়িটি। মিনিট দুয়েক সময় অতিক্রম করে বাচ্চাসমেত গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো তৈমূর। পার্শ্ব দ্বার খুলে দিতেই অতি সাবধানে উথমীও নামলো তার পরে। তোয়ালেতে মোড়ানো ছোট্ট উমায়ের তখন মায়ের কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

দুতলার বারান্দা থেকে চাচা-চাচীকে গেইটের সম্মুখে দেখতে পেয়ে ছোট্ট জোহানের আনন্দ যেনো আর ধরছে না। দৌড়ে এসে বাড়ি শুদ্ধ মানুষকে সেই আগমনী সংবাদ জানিয়ে ছুটলো সে দাদীর ঘরে।উথমীকে নিয়ে যে আজই তৈমূর বাড়ি ফিরবে তা কারোর অজানা নয়। তাই তো সুসংবাদটি পাওয়ামাত্র তাদেরকে বরণ করে নিতে দরজার সামনে এসে হাজির হলো জেবা, করবী, মালতী ফুফুসহ বাড়ির বাকি নারী সদস্যরাও। শাহানার ফোনকল পেয়ে গতকাল রাতেই পুরো পরিবারসহ ফুলকুঞ্জে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন মঈনুদ্দিন। আলাদা থাকলেও এ বাড়ি আর বাড়ির মানুষদের জন্য টান উনাদের কম নয়। একই বংশের লোক বলে কথা!

সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ঢালা থেকে তাদের দিকে ফুলের পাপড়ি ছুঁড়লো জেবা। আনন্দিত কণ্ঠে বলে উঠলো,“ফুলকুঞ্জে নতুন সদস্যদের স্বাগতম। সাথে তাদের বাবা-মাকেও।”

আকস্মিক ঘটনায় চমকে গেলো উথমী। উপস্থিত সকলকে দেখে অধরে চমকের রেশ বিলীন হয়ে ঠাঁই পেলো মিষ্টি হাসি। আজ এক সপ্তাহ পর বাড়িতে ফিরে সারাদেহে প্রশান্তি বয়ে গেলো তার। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে সবার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে স্বামীর সাথে চললো শাশুড়ির ঘরের উদ্দেশ্যে।

হাসপাতাল থেকে পুত্র, পুত্রবধূর ফেরার সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই অধীর আগ্রহ নিয়ে বিছানায় বসে ছিলেন শাহানা। তাদের দেখে ভেতরে বহমান উত্তেজনা কমলো উনার। হাস্যোজ্জ্বল মুখে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে উঠলেন,“ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এদিকে এসো। আমার তো আর তড় সইছে না।”

তৈমূর সর্বপ্রথম এগিয়ে এসে মায়ের কোলে তুলে দিলো নিজের মেয়েকে। শাহানা গভীর দৃষ্টিতে নাতনির মুখ পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপালে বসালেন গাঢ় চুম্বন। গাড়ির ঝাঁকুনিতে উমায়েরের মতো তাইয়্যেবাও এতক্ষণ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো বাবার কোলে। তবে দাদীর ছোঁয়া পেতেই তার পাতলা ঘুমটা চট করে ভেঙে গেলো।কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল নয়নে অপরিচিত মুখপানে তাকিয়ে থেকে আচমকাই গগণ কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো সে। নাতনির কান্নায় হকচকিয়ে গেলেন শাহানা। অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কান্না থামানোর সকল প্রচেষ্টাই তিনি করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। এতগুলো বছরেও যা হয়নি তাই আজ হলো। যিনি ছোটো বাচ্চা সামলাতে এক্সপার্ট উনার কোলেই কিনা এই প্রথম কেঁদে উঠলো নিজেরই নাতনি? মুখ ভার করে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,“তোর মেয়ের বোধহয় দাদীকে ঠিক পছন্দ হয়নি। চোখ মেলেই কীভাবে কেঁদে দিয়েছে, দেখলি? ওকে নিয়ে এবার আমার নাতিকে কোলে দাও দেখি বউমা।”

শাশুড়ির কোল থেকে ক্রন্দনরত তাইয়্যেবাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামানোর জন্য সারাঘর জুড়ে হাঁটতে লাগলো জেবা। উথমী এসে উমায়েরকে এবার শাহানার কোলে দিয়ে বিছানার একপাশে বসলো। দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভীষণ কষ্ট হয়। কদিন আগেই তো অপারেশন হলো! তলপেটের ক্ষতটা এখনো শুকায়নি। ঘরের ভেতর এতো এতো মহিলাদের ভিড়ে অপ্রস্তুতবোধ করায় তৈমূর আপাতত প্রস্থান করেছে সেখান থেকে। শাহানা নাতির দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠলেন,“মাশাআল্লাহ! তুরাগের প্রথম ছেলে হওয়ায় এবার আমার একটা নাতনির শখ ছিলো। কিন্তু নাতি, নাতনি দুটোই যে একসাথে পেয়ে যাবো তা তো আমার কল্পনারও বাইরে ছিলো। তোমার ভাগ্য কিন্তু সত্যিই খুব ভালো বলতে হয় বউমা। আল্লাহ আমাদের বংশ রক্ষা করেছেন। তাই তোমার আর তোমার মেয়ের জন্য আমি উপহার রেখে দিয়েছি।”

“উপহার?”—-প্রশ্ন করল উথমী।

শাহানা মাথা নাড়ালেন। বোনের কান্নায় উমায়েরের ঘুমটাও এতক্ষণে ভেঙে গিয়েছে। তবে ছেলেটা বোনের মতো অপরিচিত মুখ দেখে কাঁদলো না। বরং মুখে বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখতে লাগলো। শাহানা একহাতে উমায়েরকে আগলে রেখে অপর হাতে বালিশের নিচ থেকে বের করলেন একটি চাবির গোছা। বড়ো পুত্রবধূর উদ্দেশ্যে বললেন,“চাবিটা ধরো। ওই লকারের ভেতরে সোনালী রঙের একটা বাক্স আছে। নিয়ে এসো সেটা।”

তাইয়্যেবাকে উথমীর কোলে দিয়ে বাধ্য বউয়ের মতো চাবির গোছা নিয়ে লকার থেকে সেই সোনালী রঙের বাক্সটা বের করে শাশুড়ির হাতে তুলে দিলো জেবা। শাহানার মুখে আজ প্রশান্তির ছাপ সুস্পষ্ট। এতো খুশি তিনি ঠিক কবে হয়েছিলেন তা যেনো উনার জা আর ছেলেদের পক্ষেও বলা মুশকিল। বাক্সটি খুলতেই তাতে আরো তিনটে বিভিন্ন সাইজের গহনার বাক্সের দেখা মিললো। তার মধ্য থেকে একটা ছোটো বাক্স খুলে তিনি বের করলেন অত্যন্ত সুন্দর ছোটো ছোটো সোনার এক জোড়া চুড়ি। নাতনির দু হাতে সেই চুড়ি পরিয়ে দিতে দিতে শাহানা বললেন,“ওরি জন্মানোর পর এমনই এক জোড়া চুড়ি দিয়ে আমি আর তোমার শ্বশুর মিলে ওর মুখ দেখেছিলাম। গহনার দোকানে গিয়ে পছন্দ হয়েছিল বিধায় শখের বশে অনেক আগেই কিনে এনেছিলাম। তার কয়েক বছর পর আবার জন্মালো মিলি। কিন্তু নাতনির মুখ দেখবো তাও খালি হাতে? দেওয়ার মতো কোনো উপহারও তো নেই। তাই ওর সময় চুড়ি বানানোর জন্য আবারো আমাকে ছুটতে হলো। ওরিকে দিয়েছিলাম কিন্তু মিলিকে না দিলে কী আর হয়? পরে আরো অনেক কিছু ভেবেই একেবারে তিন তিনজোড়া বানিয়ে আনলাম। একজোড়া মিলিকে দিয়েছিলাম আর বাকি দুই জোড়া রেখে দিয়েছিলাম তুরাগ আর তৈমূর জন্য। ভেবেছিলাম ওদের যখন মেয়ে হবে তখন ওদেরও উপহার হিসেবে এটা দিবো। বাচ্চাদের হাতে এগুলো বেশি মানায়। আর এটাই হচ্ছে তৈমূর মেয়ের ভাগের চুড়ি।”

শ্রবণালী পর্যন্ত কথাগুলো প্রবেশ করলেও বিপরীতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না উথমী। সে তাকিয়ে আছে নিজের মেয়ের দিকে। তাইয়্যেবার কান্না থেমে গিয়েছে। চুড়ি পরিয়ে দিতেই হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে তা মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে। চুড়িতে লাগানো ঝুনঝুনির রিনিঝিনি শব্দে দাঁতহীন চোয়ালে খিলখিলিয়ে হাসছে। শাহানা অবশিষ্ট চুড়ির বাক্সটা জেবার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,“এটা তোমার কাছেই আপাতত রেখে দাও। মেয়ে যদি হয় তাহলে তাকে পরিয়ে দিও। আর না হলে আমার মতো নাতনিদের দিয়ে দিও।”

বলেই হাসলেন শাহানা। তারপর আরো দুটো গহনার বাক্স খুলে বের করলেন সোনার মোটা একটি চেইন আর একজোড়া বালা। এবার উথমীর দিকে তাকিয়ে সেসব দেখিয়ে বললেন,“এই বালা দুটো তোমার শ্বশুর আমায় উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর এসব আর কখনো পরা হয়নি। যেখানে স্বামীই বেঁচে নেই সেখানে গয়না পরে আর লাভ কী? তাই এসব এখন তোমাদেরই। হাত দুটো দাও দেখি এদিকে।”

দ্বিমত না করে হাত বাড়িয়ে দিলো উথমী। শাহানা তার বাম হাতে চুড়ি পরিয়ে দিতে গিয়ে থামলেন। বললেন, “একসাথে দু ধরণের দুটো বালা মানাবে না। এগুলো বরং খুলে ফেলি।”

কথাটায় যেনো আঁতকে উঠলো উথমী।দু হাতে পরিহিত বালা দুটো বিশেষ এবং প্রথম বৈবাহিক রাতে তৈমূর উপহারস্বরূপ তার হাতে পরিয়ে দিয়েছিল। সেদিনের পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বালা জোড়া হাতছাড়া করেনি উথমী। এমনকি অপারেশনের সময় নার্স তার অজান্তে খুলে নিলেও জ্ঞান ফেরার পর এ নিয়ে কম ঝামেলাও সে করেনি। অথচ এখন কিনা শাশুড়ির কথায় খুলে ফেলবে? কখনোই না। আমতা আমতা করে বললো,“থাক তবে। ওগুলো না হয় আমি বিশেষ বিশেষ দিনে পরবো আম্মা। আপাতত আপনার স্মৃতি হিসেবেই থাকুক।”

জোর করলেন না শাহানা। গলায় চেইনটা পরিয়ে দিয়ে বালা জোড়া বাক্সবন্দী করে তার হাতে তুলে দিলেন। আজ তিনি খুবই খুশি। একসঙ্গে দু দুটো নাতি, নাতনির দাদী হয়েছেন। খুশি না হয়ে পারা যায়?

শাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে অতিকষ্টে সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে নিজেদের কক্ষে চলে এলো উথমী। চাপানো দরজা মেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই অবাক হলো ভীষণ। ঘরের কারুকার্যের পালঙ্কটির বদল ঘটে সেখানে ঠাঁই পেয়েছে নতুন এবং তার থেকেও কিছুটা বড়ো আরেকটি পালঙ্ক। তার পাশেই সেন্টার টেবিলের উপর রাখা বাচ্চাদের ফিডার, বেবি মিল্কের কৌটা, ডায়াপারসহ প্রয়োজনীয় আরো অনেক কিছু। পালঙ্কের সাথে মেলানো দু দুটো সুন্দর সুন্দর দোলনা। তাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিটিমিটি হাসলো জেবা। উমায়েরকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে এগিয়ে এসে উথমীর কোল থেকে তাইয়্যেবাকেও নিয়ে অপর আরেকটি দোলনায় শুইয়ে দিলো। বললো,“ওদের আপাতত শুধু মাতৃদুগ্ধ পান করাতে হবে। এসব গুঁড়ো দুধ খাওয়াতে দেরি আছে। এখন বরং ওরা ঘুমাক। তুমি এই সুযোগে ফ্রেশ হয়ে নাও। পাকামো করে আবার এই রাতে গোসল করতে যেও না। খাবার আমি ঘরে দিয়ে যাচ্ছি। খেয়ে বিশ্রাম নিবে।”

“আচ্ছা, কিন্তু এসব? এসব কে করেছে? ঘরের চেহারা তো একেবারে বদলে গিয়েছে।”

“কে আবার? তোমার গুণধর স্বামী করেছেন।”

“তৈমূর সাহেব!”

“হ্যাঁ, দুদিন আগেই খাট বদলেছে। জিজ্ঞেস করতেই জানালো, বাচ্চাসমেত বাচ্চাদের মায়ের নাকি এই খাটে ঘুমাতে অসুবিধে হবে। কারণ ওটা তো ডাবল বেড ছিলো। আর এই দোলনা থেকে শুরু করে ওদের জন্য পোশাক-আশাক এবং বাচ্চাদের জন্য যা যা লাগে সব তোমার ভাসুরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কিনে এনে আমাকে দিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। যাতে তার বউকে কষ্ট করে বিছানা থেকে নামতে না হয়। কী স্বামী পেলে উথমী? আমি তো এতগুলো বছর প্রেম করে প্রেমিককে বিয়ে করেও এমন ভালোবাসা, যত্ন পাইনি। জোহানের সময় তোমার ভাসুরকে বলে বলে এগুলো আনাতে হয়েছে। সত্যিই তোমার ভাগ্যটা ভালো। নইলে কী আর স্বামী হিসেবে আমার দেবরকে পেতে?”

প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো উথমী। কথাগুলো শুনে আনন্দে চোখে অশ্রু জমলো তার। নিজের কথা শেষ করে জেবা চলে গিয়েছে নিচে। তার মিনিট দুয়েক বাদে ভেতরে এলো তৈমূর। গোসল শেষে সে বাইরে গিয়েছিল কয়েক দিনের জন্য আশফাককে ছুটি দিতে। স্ত্রীকে এভাবে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুধালো,“কী ব্যাপার? রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এই না কিছুক্ষণ আগে বললে, দাঁড়িয়ে থাকতে তোমার কষ্ট হয়?”

ধ্যান ভঙ্গ হলো উথমীর। আলগোছে চোখের পানি মুছে মুখশ্রীতে কৃত্রিম রাগ ফুটিয়ে বললো,“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার কান্ড কারখানা দেখছি। ডাক্তার পইপই করে আমাদের দুজনের সামনেই তো বলে দিলো আগামী ছয় মাস মাতৃদুগ্ধ ব্যতীত আর কিছুই ওদের খাওয়ানো যাবে না। তাহলে আপনি বেবি ফুড কেনো এনেছেন?”

তৈমূর দোলনার কাছে চলে এলো। পকেটে হাত গুঁজে ঘুমন্ত বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বললো,“এসব আমি গতকাল এনেছিলাম কিন্তু ডাক্তার জানালো আজ। আমার কী দোষ?”

“না জিজ্ঞেস করে আনতে গেলেন কেনো? এখন এসব তো নষ্ট হয়ে যাবে।”

“মেয়াদ না দেখেই কিনে এনেছি নাকি? এখনো দেড় বছরের মেয়াদ আছে। প্যাকেট না খুলে নিরাপদ কোনো স্থানে রেখে দিলেই হবে। বোকা উথমী, বোঝে না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো উথমী। কথা না বাড়িয়ে আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে বাথরুমের দিকে হাঁটা ধরলো। তৈমূর পেছন থেকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“একসঙ্গে দুটোকে কোলে নিবো কীভাবে উথমী?”

উথমী যেতে যেতেই উত্তর দিলো,“একজন একজন করে নিবেন।”

“তা কী করে হয়? আমি হচ্ছি বাবা। বাবা হয়ে নিজের সন্তানদের মধ্যে বৈষম্য কীভাবে করি? একজনকে কোলে নিলে অপরজন যদি কষ্ট পায়?”

“কষ্ট পেলে ওদের রেখে ওদের মাকে কোলে নিয়ে বসে থাকবেন।”—বলেই সশব্দে বাথরুমের দরজা আটকে দিলো উথমী। তৈমূর থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
____________

সকাল থেকে ঘটা করে বাড়িতে রান্নাবান্নার আয়োজন শুরু হয়েছে। বাড়ির বউয়েরা নাস্তা সেরেই রন্ধনশালায় হয়ে গিয়েছে ব্যস্ত। নতুন বংশধরদের আগমনে বাড়িতে এলাহী কান্ড বাঁধিয়েছেন শাহানা। মঈনুদ্দিন, তুরাগকে দিয়ে গতকালই নিকটীয় আত্মীয় থেকে শুরু করে দুই ছেলের শ্বশুরবাড়ির সকলকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ফুলকুঞ্জে। সেই উপলক্ষ্যে জেবা, মালতী ফুফু, করবী, সূচি মিলে রান্নার দিকটা সামলাচ্ছে। দুপুরে এখানেই তো সবাই খাবে।

উথমী বিশ্রামে আছে। বাচ্চাদের কান্নাকাটির শব্দে সেই ভোরে ঘুম ভেঙেছে তার। আধ বোজা চোখে তাকিয়ে দেখে পাশে তৈমূর নেই।দুই দোলনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঝুনঝুনি নাড়িয়ে ছেলে-মেয়েদের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তার কোনো কাজে ছেলে-মেয়েদের কান্না থামার নয়। বেচারা যে তাদের কোলে নিয়ে একটু ঘুরবে তাও সম্ভব নয়। দুটো ছোটো ছোটো বাচ্চাকে তার একার পক্ষে কোলে নেওয়া অসম্ভব! স্বামীর কান্ড দেখে উথমী হতবাক। জিজ্ঞেস করে,“কী করছেন আপনি?

তৈমূরের প্রচেষ্টা থামলো না। নিজের কাজ করতে করতেই বললো,“কান্না থামানোর চেষ্টা করছি কিন্তু থামছে না।”

“ওই কান্না থামানো আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। ওদের খিদে পেয়েছে। একটা একটা করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হন।”

“আমি বের হবো কেনো? বউ আমার, বাচ্চা আমার অথচ আমি বেরিয়ে যাবো?”

ভেতরে ভেতরে লজ্জায় ফেটে পড়ল যেনো উথমী। কিন্তু সেই লজ্জা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ না করে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ভড়কে গেলো তৈমূর। কথা বাড়ালো না আর। বিছানার মাঝখানে বাচ্চাদের পাশাপাশি শুইয়ে দিয়ে সেই যে ঘর থেকে সে বের হলো তারপর বাগানে বড়ো ভাইয়ের সাথে দেখা হতেই তাকে বগলদাবা করে সঙ্গে নিয়ে বাজারে চলে গিয়েছিল তুরাগ।

বেলা বাড়তেই ধীরে ধীরে বাড়িতে আগমন ঘটতে লাগলো অতিথিদের। সর্বপ্রথম এসে উপস্থিত হলেন জেবার বাবা-মা। তারপর একে একে উথমীর বাবার বাড়ির সবাই। সাথে তিথিয়া আর তার মেয়েরাও। বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে এখন আর শামীমকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। এ এলাকায় পা দেওয়াই তার জন্য নিষিদ্ধ। সামান্য লালসায় বেচারা একূল ওকূল সবই হারিয়েছে।সাথে হারিয়েছে এতো বছরের প্রাপ্য সম্মান।

জেবার কথায় তৈরি হয়ে বাচ্চাদের নিয়ে অন্দরমহলে এসে বসেছে উথমী। রিক্তকে শাশুড়ির কোলে দিয়ে রিনিতা এসে একজন একজন করে দুজনকেই কোলে নিয়ে আদর করল বেশ কিছুক্ষণ। নিজের দু দুটো বাচ্চা সামলে হাসপাতালে আর ননদকে দেখতে যেতে পারেনি সে। শেষে তাইয়্যেবাকে কোলে নিয়ে কনুই দিয়ে আলতো করে ননদকে গুঁতা মেরে ফিসফিসিয়ে বললো,“ননদীনি! তুমি তো ছক্কা মেরে দিয়েছো।একসাথে দু দুটো? সামলাবে কীভাবে?”

হাসলো উথমী। তার মতোই ফিসফিস করে বললো, “তোমরা তো আছোই। বড়ো করার দায়িত্ব তোমাদের।”

হাসি চওড়া হলো রিনিতার। বললো,“তাহলে এক কাজ করলে কেমন হয়? বড়ো হলে তোমার মেয়েকে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো। ভবিষ্যতে মনের মতো পুত্রবধূ পাবো কিনা তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

বিপরীতে শব্দ করে হেসে উঠলো উথমী। উৎস বোনের পাশে এসে বসলো। ননদ, ভাবীর হাসাহাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে শুধালো,“কী নিয়ে হাসছো তোমরা?”

রিনিতা হাস্যোজ্জ্বল মুখে উত্তর দিলো,“কী আবার? তোমার ভাগ্নিকে আমার পুত্রবধূ বানানোর পাকা কথা চলছে। তাই নিয়েই।”

“তুমিও না রিনি? পারোও বটে।”—-মৃদু হেসে বললো উৎস। রিনিতা তাইয়্যেবাকে নিয়ে চলে গেলো বাকি বাচ্চাদের দিকে। উৎস বোনের উদ্দেশ্যে এবার নিচু স্বরে বললো,“ঊষার কেইসটা আমরা জিতে গেলাম রে উথমী।”

উথমীর চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললো,“সত্যি!”

তৃপ্তির হাসি হেসে উপরনিচ মাথা নাড়ালো উৎস। সব প্রমাণ আসামিদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় আদালত উৎসদের পক্ষে রায় দিতেই বাধ্য হয়েছে।

তনি ঘুরে ঘুরে ফুফাতো ভাই-বোনদের দেখতে ব্যস্ত। রিক্ত হাঁটতে না পারলেও বসতে অবশ্য ঠিক পারে। হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে চলে এ ঘর থেকে ও ঘর। মাঝেমধ্যে অস্পষ্ট উচ্চারণে ডেকে ওঠে ‘পাপপা, তাতা, আমা।’ তারও উচ্ছ্বাসের যেনো শেষ নেই। একবার উমায়ের তো আরেকবার তাইয়্যেবার দিকে হাত বাড়িয়ে আউ আউ শব্দ করতে করতে মাথা দুলাচ্ছে। তাদের সাথে সঙ্গ দিয়েছে জোহান। ওরি, মিলি, তনিকে ভাব দেখিয়ে বলছে,“এই দেখো, এটা আমার বোন আর এটা হচ্ছে আমার ভাই। এবার থেকে আমি ওদের সাথেই খেলবো। তোমাদের আর লাগবে না।”

তনিও কম যায় না। কোমরে দু হাত গুঁজে রিক্তকে কোলে নিয়ে বললো,“আর এটা আমার ভাই।”
__________

বিকেলের সোনালী রোদে গাছের সবুজ পাতা ঝিলমিল করছে। সেই রোদ গায়ে মেখে এ গাছ হতে ও গাছ দাপড়ে বেড়াচ্ছে কয়েক জোড়া চড়ুই পাখি। বারান্দায় বসে মনোযোগ দৃষ্টিতে সেসব দেখছে উথমী। হাতে তার বেগুনী রঙের ডায়েরি আর একটি কলম।আজ অনেক দিন বাদে সে লিখতে বসেছে। অসমাপ্ত ডায়েরির পাতা সমাপ্ত করার ইচ্ছে জেগেছে মনে। এটা সেই ডায়েরি যেথায় অর্ধেক জুড়ে রয়েছে শুধু বেদনা, অবহেলা আর বিচ্ছেদের কাব্য।

দুপুরের ভোজন শেষে আমন্ত্রিত অতিথিরা বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছে। যাওয়ার আগে দিয়ে গিয়েছে বাচ্চাদের বুক ভরা দোয়া। তারা যেতেই তৈমূর ছেলে-মেয়েদের দিয়ে এসেছে মায়ের ঘরে। এই ফাঁকে খুব করে নিজের একাকিত্বকে উপভোগ করছে উথমী। আঁখি পল্লবে ভেসে উঠছে পুরোনো সব স্মৃতি। ফুলকুঞ্জে বধূ বেশে পা রাখার দিন থেকে শুরু করে বর্তমান মুহূর্ত! সব দ্রুত হাতে লিখে ফেললো সে।

বড়ো বড়ো কদম ফেলে কোত্থেকে যেনো এসে হাজির হলো তৈমূর। গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তুমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছো?”

“হ্যাঁ‌।”

“হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত? কিন্তু কেনো?”

উথমী নড়লো না। নিজের মতো করেই ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় এসে গটগট করে কিছু লিখে হাফ ছাড়লো। মাটির উপর বিস্তর ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জারুল গাছটির দিকে আপনাআপনিই তার দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো। খেয়াল করল, গাছে নতুন ডাল গজিয়েছে। যা বারান্দার শেষ প্রান্তের দেয়াল ছুঁইছুঁই। সবুজ পাতার চেয়ে বেগুনী ফুলের সংখ্যাই তাতে বেশি। হাত বাড়িয়ে ফুল ছিঁড়লো উথমী। শান্ত স্বরে প্রত্যুত্তর করল,“আমি মনোযোগ দিয়ে সংসার করতে চাই, ভালো মা হতে চাই। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।”

অবাক নয়নে স্ত্রীর গা ছাড়া হাবভাব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে তৈমূর। শুধায়,“চাকরি করে ভালো মা হওয়া যায় না? সংসারী হওয়া যায় না? কিন্তু এতদিন তো চাকরি করেও তুমি সংসার করেছো।”

“মা হওয়া যায়, সংসার করা যায় কিন্তু ভালো মা বা সংসারী বউ হওয়া যায় না। যা আমি এ কয়েক মাসে খুব ভালো করেই উপলব্ধি করেছি। কাক ডাকা ভোরে উঠে রান্নাবান্না সেরে অফিস ছুটলে বাচ্চাদের সময় দিবো কখন? ক্লান্ত দেহ নিয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সবার পছন্দ অপছন্দ দেখতে গিয়ে বাচ্চাদের মন বুঝবো কখন? একজন সন্তানের জীবনে মায়ের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। মায়ের সাথে ছেলে-মেয়েদের দূরত্ব তৈরি হলে তাদের মানসিক বিকাশে সমস্যা হয়। বেসিক শিক্ষায় ঘাটতি হয়। একাকিত্বে ভোগে তারা। যা আমার চেয়ে ভালো হয়তো কেউ জানে না। তাই আমি চাই না আমার সন্তানরা কখনো একা অনুভব করুক। আমি চাই না তারা ভুল মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে যাক। ভুল রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হোক। চাই না কখনো দুঃখ পেলে বিশ্বস্ত কাঁধের অভাবে তারা আফসোস করুক। আমি চাই ভালো মা হতে। আর তার জন্য এই চাকরি ছাড়াটা ছোট্ট একটা ত্যাগ। মায়েরা এমন ছোটোখাটো আত্মত্যাগ কতই তো করে তাই না?”

“এটা তোমার শখ ছিলো। কিন্তু আমার সংসারের জন্য আজ তোমার শখ এভাবে….”

কথাটিকে সমাপ্ত করতে দিলো না উথমী। এগিয়ে এসে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। ঘোলাটে দৃষ্টিতে চশমার ওপাশে বন্দী সরল পুরুষালি চোখে তাকিয়ে কোমল স্বরে বললো,“আপনার জন্য নয়, আমি নিজের জন্য চাকরি ছেড়েছি তৈমূর সাহেব। আর হ্যাঁ, চাকরিটা আমার শখ ছিলো না বরং চাকরিটা ছিলো আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করার একটি হাতিয়ার। স্বাধীন মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াবার একটি সুযোগ মাত্র। যা আর আমার জীবনে প্রয়োজন নেই। এখন তো আমার আপনি আছেন। দু দুটো জীবন্ত ফুল আছে। যার ভেতরে আলাদা স্বাধীনতার প্রয়োজনবোধ করছি না। আমি সুখ আর শান্তি চাই। যেচে এতো দায়ভার কাঁধে নেওয়ার ইচ্ছে আমার আর নেই। এসবে আমি খুব ক্লান্ত।”

কথাটুকুর সমাপ্তি টেনে চমৎকার হাসলো উথমী।হাতের বন্ধ ডায়েরিটা তৈমূরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে খোলা চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে দরজার দিকে পা বাড়ালো। বলে গেলো,“আপনার টাকা মানেই আমার টাকা। শাশুড়ি আম্মা বলেছেন, স্বামীর টাকা পয়সার হিসাব রাখতে। তাই পরের মাসের স্যালারি চুপচাপ আমার হাতে তুলে দিবেন বলে রাখছি। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে খরচ করবো।”

তৈমূর তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। এ যেনো এক অন্য উথমী। যে আর শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে না। কথায় কথায় রাগ দেখায় না। স্ত্রীর ধরিয়ে দিয়ে যাওয়া ডায়েরিটার পানে তাকাতেই ভ্রু যুগলের মাঝখান কুঁচকে গেলো তৈমূরের। ডায়েরিটা সে চিনে। যার অর্ধেক জুড়ে স্ত্রীর জীবনের বিষাদময় গল্প। তার পর থেকে পড়া শুরু করল তৈমূর। কুঁচকে যাওয়া ভ্রু ধীরে ধীরে সমান হতে লাগলো। ডায়েরির ভাবধারার বদল ঘটেছে। যেখানে সবটা জুড়ে এখন শুধু সুখ, ভালোবাসা, মান অভিমান আর তৈমূর।

শেষ পাতায় এসে থমকে গেলো তৈমূর। দৃষ্টি আটকে গেলো একটি লেখায়,
“প্রিয় তৈমূর সাহেব! আপনাকে ভালোবাসি। যতোটা ভালোবাসি ওই মেঘাচ্ছন্ন আকাশকে? তার থেকেও বেশি। জারুল ফুলের চেয়েও বেশি।
আপনি আমার গল্প নন, আপনি আস্ত পরিপূর্ণ এক কাব্য। যার সূচনা আছে কিন্তু সমাপ্তি নেই।”

অধরে এক চিলতে হাসি ফোটে উঠলো তৈমূরের। দ্রুত কদম ফেলে ছুটে এলো সে কক্ষের বাইরে। রেলিং ধরে নিচে তাকাতেই দেখা মিললো প্রিয় নারীর। পরনে তার বেগুনী রঙের শাড়ি। মেঝের সাদা টাইলসে গড়াগড়ি খাওয়া আঁচল জুড়ে রং তুলিতে বোনা শুভ্র ফুলের কাজ। চুলের খোঁপায় আস্ত কয়েক জারুল ফুল। হঠাৎ করেই তৈমূরের মনে হলো, সে যেনো সাধারণ কোনো নারী নয় বরং সে হচ্ছে এক জারুল কন্যা। স্থানটি থেকে সেই জারুল কন্যার অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো তৈমূর। সিঁড়ির দিকে কদম ফেলে বন্ধ ডায়েরির উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখাটা বিড়বিড় করে পড়ল,‘জারুল ফুলের কাব্য!’

যে কাব্য মনুষ্য জীবনের প্রতিচ্ছবি। যাতে রয়েছে ভুল, ফুল, হিংসা-বিদ্বেষ, রেষারেষি। আছে পূর্ণতা, ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের লীলাখেলা। যার সমাপ্তিতে কারো জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ আবার কারো বা জারুলের মতো স্বচ্ছ, সুন্দর। অন্যকে ঠকালে নিজেকেও ঠকতে হয়। অন্যের অনিষ্ট চাইলে নিজের অনিষ্ট হয়। হিংসা, লোভের ফল মৃত্যু। ভালোবাসার বিনিময় শুধু ভালোবাসা দিয়েই হয়। বেগুনী কারো জন্য সুখ আবার কারো জন্য বা দুঃখ।

(~সমাপ্ত~)