জুলিয়েট পর্ব-০১

0
715

#জুলিয়েট [সূচনা পর্ব]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

১.

রূপসা লক্ষ্য করলো,ইদানিং সে খুব অল্পতেই রেগে যাচ্ছে।চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বিশ ঘন্টাই তার কপাল কোঁচকানো থাকে।আয়নার দিকে চোখ পড়তেই ব্যাপারটা সে খেয়াল করলো।তারপরই সাথে সাথে কপালের রগগুলো শিথিল করে নিল।

এখন সময় বিকেল চারটা আঠারো।রূপসা বসে আছে অর্কিড প্যালেসের দোতালার একটি ঘরে।তার সামনে আরিবা বই খাতা খুলে বসে আছে।রূপসা ভয়ে ভয়ে গনিত বইটা হাতে নেয়।সে মনে মনে প্রার্থনা করছে।আজ যেন বই খোলার পর ভেতর থেকে কোনো কিছু বেরিয়ে না আসে।

ইদানিং আরিবাকে পড়াতে আসা তার জন্য একটা আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।তার পেছনে কারণ অবশ্য দুইটা।প্রথম কারণ-আরিবাদের বাড়ি আবাসিক এলাকার ভেতরে।ভিআইপি এরিয়া।রিকশায় করে আসার নিয়ম নেই।একেবারে মেইন রোডে রিকশা থেকে নামতে হয়।তারপর বাকি রাস্তা হেঁটে হেঁটে আসতে হয়।এতোখানি পথ হেঁটে আসতে রূপসার খুব ক্লান্ত লাগে।

আর দ্বিতীয় কারণ টা সবচেয়ে ভয়ংকর।রূপসা কাঁপা হাতে গনিত বইটা খুলল।খুলতেই তার মুখে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে এলো।বরাবরের মতো আজও সেখানে একটা চিরকুট রাখা।রূপসা আড়চোখে একবার আরিবার দিকে তাকায়।আরিবা খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন খাতায় লিখছে।সে আর তাকে ডাক দেয় না।উল্টা কম্পমান হাতে চিরকুট টা হাতে নেয়।

“মিস রূপসা,
এই নিয়ে পাঁচ পাঁচ বার আপনাকে চিরকুট দিয়েছি।আপনি পাঁচ বারই আমাকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে গিয়েছেন।আমাকে একটা কথা বলুন তো,আপনি কি আমাকে ছ্যাঁচড়া ভাবেন?নাকি ভাবেন আমার চরিত্রে দোষ আছে?আজ আমি শেষ বারের মতো আপনাকে চিঠি দিচ্ছি।পরের বার আর লিখে লিখে কিছু করতে বলবো না।ঠিক আপনার মুখোমুখি এসে দাঁড়াবো।তখন আপনি কি করবেন আমি দেখতে চাই।

এখন পর্যন্ত আপনার সাথে যথেষ্ট নমনীয় আচরণ করছি।আমাকে কঠোর হতে বাধ্য করবেন না।আজ আরু কে পড়ানো শেষে আপনি বাড়ির পেছনের বাগানে এসে দাঁড়াবেন।আপনার সাথে আমার কথা আছে।”

দখিনের জানালা থেকে নাতিশীতোষ্ণ বাতাস এসে রূপসার সমস্ত শরীর ছুঁয়ে দিলো।বাতাসের দাপটে গনিত বইয়ের দু’টো পাতা উল্টে গেলো।রূপসা সেই শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেল।তার কপালে চিকন ঘাম জমেছে।হুশ আসতেই সে সবার প্রথমে ওড়নার এক প্রান্ত দিয়ে কপাল মুছলো।

গত কয়েকদিন যাবত আরিবার গনিত বইয়ের ভেতর রূপসা নিয়ম করে কিছু চিরকুট পাচ্ছে।প্রত্যেকটা চিরকুটের মূল কথা একটাই।কেউ তার সাথে দেখা করতে চায়।তাও আবার অর্কিড প্যালেসের পেছনের বাগানে।রূপসা জানে না এই চিরকুটের মালিক কে।জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার ভেতর কাজ করে না।কিন্তু একটা চাপা আতঙ্ক তাকে সবসময় তটস্থ করে রাখে।

রূপসার টিউশন মোট মিলিয়ে চারটা।এর মাঝে সবচেয়ে বেশি বেতন সে পায় আরিবাকে পড়িয়ে।আরিবার বয়স সাত।সে ক্লাস টু তে পড়ে।ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট বলে তার বেতন একটু বেশি।মাসে ষোলো দিন সে আরিবাকে পড়ায়।বিনিময়ে মাস শেষে কড়কড়ে সাতটা হাজার টাকার নোট পায়।

এই টিউশনটা রূপসা বেশ আগ্রহের সাথে নিয়েছিল।সে সচরাচর এতো ছোট ক্লাসের বাচ্চাদের পড়ায় না।তবে বেতনের অংকটা হিসেব করেই সে এই টিউশনটা নিতে রাজি হয়েছে।বিগত এক মাস সে বেশ নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে টিউশনটা চালিয়ে গেছে।বিপত্তি বেঁধেছে এই মাসে এসে।রোজ রোজ এমন অজ্ঞাত ব্যক্তির চিরকুট পেয়ে রূপসা বিরক্ত,সেই সাথে কিছুটা ভীত।সে চায় না এই টিউশন হাতছাড়া করতে।অথচ এই ব্যাপারটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সে বাধ্য হবে টিউশনটা ছেড়ে দিতে।

ধূসর রঙের চিরকুট টা দুমড়ে মুচড়ে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে রূপসা আরিবার দিকে মনোনিবেশ করে।

‘আরিবা! কাল যে মিস হোমওয়ার্ক দিয়েছিলাম,সেগুলো করেছো?’

আরিবা মাথা নাড়ে।হোমওয়ার্কের খাতাটা রূপসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে রিনরিনে স্বরে বলে,’করেছি মিস।এই যে নোটবুক।’

রূপসা একগাল হেসে খাতাটা হাতে নেয়।আরিবা বেশ শান্ত প্রকৃতির বাচ্চা।পড়ার জন্য তাকে খুব বেশি বলতে হয় না।হোমওয়ার্ক পুরোটা শেষ করতে না পারলেও কিছুটা অন্তত নিজ থেকে করে রাখে।রূপসার তাকে ভীষণ আদর লাগে।

আরিবাকে দু’টো অংক করতে দিয়ে রূপসা দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলো।পাঁচটা বেজে গেছে।তাকে চল্লিশ মিনিটের মধ্যে বের হতে হবে।আরিবা খুব মনোযোগ দিয়ে ম্যাথ করছে।

রূপসা এক ফালি চুল কানের পেছনে গুজে সামান্য সামনে ঝুকলো।তার আগে একবার চঞ্চল চোখে ঘরের চারপাশ দেখে নিলো।আপাতত আশেপাশে কারো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।সে কিছুটা অপ্রস্তুত কন্ঠে ডাকলো,’আরিবা! একটু শুনবে?’

আরিবা পেনসিল থামিয়ে চোখ উপরে তুলল।তার ডাগর ডাগর দু’টো চোখ বেশ কৌতূহলী হয়ে রুপসার পানে তাকালো।রূপসা অত্যাধিক চাপা স্বরে বলল,’আচ্ছা আরিবা।তোমাদের বাড়িতে কে কে থাকে একটু বলো তো।’

আরিবা পেনসিল টা গালের সাথে চেপে ধরে সিলিংয়ের দিকে তাকায়।একটু ভাবুক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবে।তারপর বাচ্চা বাচ্চা গলায় উত্তর দেয়,’আমি,পাপা,মামনি,দিদুন,বড় চাচ্চু,মনি মা,আরিয়ান ভাইয়া,আয়রা,ছোট চাচ্চু,শোহু,মিলু,দেলোয়ার কাকা,মোমেনা আন্টি,সানজানা ফুপ্পি,খালেদ আঙ্কেল,,,,’

রূপসা তাড়াহুড়ো করে তাকে থামিয়ে দিলো।
‘থাক থাক আরিবা।আর বলতে হবে না।আমি বুঝেছি।তুমি ম্যাথ করো।’

রূপসা মাথায় হাত চেপে চুপচাপ বসে থাকে।আরিবাদের যৌথ পরিবার।বাড়িভর্তি মানুষ।তাদের বাড়িটা সাধারণ বাড়ির মতো না।প্রকান্ড একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি।প্রথমদিন আসার পর রূপসা রীতিমতো বের হওয়ার পথ হারিয়ে ফেলেছিল।পরে বাড়ির কেয়ার টেকার দেলোয়ার তাকে বের হতে সাহায্য করলো।উনি বের হওয়ার রাস্তা না দেখালে রূপসা সেদিন নির্ঘাত পুরো বাড়িতে কয়েক চক্কর খেতো।

‘মিস।হয়েছে।’

রূপসা চোখের উপর থেকে হাত সরায়।আরিবার অংক করা শেষ।সে খাতাটা হাতে নিয়ে উত্তরগুলো তে নজর বুলায়।তারপর সামান্য হেসে বলে,’ভেরি গুড আরিয়া।সবগুলো আনসার কারেক্ট হয়েছে।’

আরিবা দুই ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো।অথচ রূপসার মুখ সময়ে সময়ে মলিন থেকে মলিনতর হতে শুরু করলো।তার মাথা ব্যাথা হচ্ছে।এই চিরকুটের বিষয়টা তাকে খুব বেশি বিব্রত বোধ করাচ্ছে।টাকার অংকটা বেশ চওড়া বলেই রূপসা এই টিউশনটা চালিয়ে যাচ্ছে।নয়তো সেই কবেই ছেড়ে দিতো।

সেদিন বিকেলে ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামলো।রূপসা জানালা দিয়ে বাইরে দেখে উৎকন্ঠা মেশানো স্বরে বলল,’আয়হায়! আমি তো সাথে ছাতা আনিনি।যাবো কেমন করে?’

সেই মুহূর্তে দরজায় একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো।রূপসা তাকে দেখতেই স্মিত হাসলো।দু’জন স্বল্প পরিচিত মানুষ পরস্পরের সাথে দেখা হলে যেমন করে হাসে,অনেকটা এমন।রূপসা তাকে চেনে।তার নাম সানজানা।সম্পর্কে সে আরিবার ফুফু হয়।সানজানা বয়সে রূপসার চার বছর জুনিয়র।

সানজানা ঘরে এসেই একগাল হেসে বলল,’রূপসা আপু।বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।চলো না আমরা ছাদে যাই।’

প্রস্তাব শুনতেই রূপসা আঁতকে উঠে।দ্রুত দুই দিকে মাথা নেড়ে আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠে,’না না।আমি যাবো না।তোমরা যাও।’

‘প্লিজ আপু।চলো না।’

রূপসা তার কথায় অনড়।নিজের রোগা পাতলা শরীরটা শক্ত করে চেয়ারের সাথে এটে ধরে বলল,’না সানজানা।আমার আজ শরীর ভালো না তোমরা যাও।আমার বাড়ি যেতে হবে।’

‘বাড়ি তো এখন যেতে পারবে না।বাইরে বৃষ্টি।চলো না একটু ছাদে গিয়ে বৃষ্টি দেখি।’

সানজানা বেশ অনুনয় করে কথাটা বলল।রূপসা কোনো প্রতিক্রিয়া না দিয়ে চুপচাপ বসে রইল।সানাজানা অনুরোধ করল আরেকদফা।
‘প্লিজ আপু।বেশিক্ষণ না।শুধু পাঁচ মিনিটের জন্য।’

আরিবা গোল গোল চোখে ফুপ্পির মুখটা দেখে।তারও ভীষণ ছাদে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।সে এগিয়ে যায় রূপসার নিকট।ছোট ছোট হাতে তার হাতটা ধরে মিনমিন করে বলে,’মিস! চলো না প্লিজ।একটু থেকেই আবার চলে আসবো।’

রূপসার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল আচমকা।কপালে,নাকের ডগায়,ঠোঁটের উপরে পুনরায় চিকন ঘাম এসে জমা হলো।এই বাড়িতে সে বেশিক্ষণ থাকতে চায় না।বাড়ির চৌকাঠে পা দেওয়ার পর থেকে সে ভীষণ আতঙ্কে থাকে।মনে হয় এখনই একটা অঘটন ঘটে যাবে।রূপসার ভয় চিরকুটের মালিকের মুখোমুখি হওয়া নিয়ে না।সে এসবে ভীত না।তার ভয় সাত হাজার টাকা নিয়ে।ঐ টাকা সে হাতছাড়া করতে চায় না।সে কোনোক্রমেই আরিবার টিউশনটা বাদ দিতে চায় না।

একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে রূপসা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।একেবারে নিরাসক্ত কন্ঠে বলল,’আচ্ছা চলো।কিন্তু পাঁচ মিনিটই।এর বেশি থাকতে পারবো না বলে দিচ্ছি।’

সানজানার দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।সে শক্ত করে রূপসার একটা হাত চেপে ধরে ঘর থেকে বের হতে হতে বলল,’ঠিক আছে পাঁচ মিনিটই।এখন চলো।’

****

বৃষ্টির তেজ সামান্য একটু বেড়েছে।ছাদের দরজায় দাঁড়ালেই বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ছটা এসে শরীর ভিজিয়ে দিয়ে যায়।চারপাশে ভেজা মাটি আর ভেজা পাতার সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে।ছাদের গাছ গুলো আসল বলে মনে হচ্ছে না।মনে হচ্ছে কোনো তুখোড় শিল্পী রং তুলির আঁচড়ে এই দৃশ্য টুকু ফুটিয়ে তুলেছে।

রূপসা তাজ্জব হয়ে পুরোটা ছাদ দেখে।বড়লোকদের বড়লোকি কাজ কারবার।ছাদের পেছনে এতো খরচা কে করে?তার মনে হলো এটা কোনো ছাদ না,বরং কোনো নামিদামি রিসোর্টের আউটডোর।কি সুন্দর গোছানো চারপাশ! বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয়ে সেই সৌন্দর্য বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন।

সানজানা কিছুক্ষণ ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে শেষে এক পা এক পা করে ভেতরে প্রবেশ করে।তার পেছন পেছন আরিবাও ছাদে এলো।রূপসা আর ভেতরে গেল না।সে যন্ত্রের মতো স্থির,নিশ্চল হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো।ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানিতে তার মুখ ভিজে গেছে।সে ওড়না দিয়ে মুখ মুছলো।

সানজানা পেছন ফিরে বলল,’রূপসা আপু।এসো না ভেতরে।ঐদিকে দাঁড়িয়ে কিছুই দেখতে পাবে না।’

রূপসা পরনের ওড়না টা ঠিকঠাক মতো গায়ে চাপায়।আজ সে তাড়াহুড়োয় কোনোরকমে একটা বেণী করে এসেছে।দুই তিন ঘন্টায় সেই বেণীর অর্ধেকই খুলে গেছে।তাকে কেমন এলোমেলো দেখাচ্ছে।ছাদে পা রাখার আগে সে তার এলোমেলো কেশগুচ্ছ কানের পেছনে ঠেলে দিলো।তারপর খুব সাবধানী পা ফেলে ছাদে প্রবেশ করলো।

ছাদে পা রাখার পর তার মনে হলো ছাদে এসে সে ভালোই করেছে।আজ এখানে না আসলে এতো সুন্দর চোখ ধাঁধানো ছাদটা তার দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যেত।রূপসা চোখ মেলে সবটা দেখে।ছোট ছোট টবে কি সুন্দর গাছ লাগানো হয়েছে! এক পাশে একটা বড় দোলনা।ছাদের উত্তর পাশে নানা রঙের বাগান বিলাশের বাহার।সেগুলো ছাদ থেকে শুরু করে দোতালা পর্যন্ত ঝুলছে।

অতি সাবধানে একটা একটা পা ফেলে রূপসা ফুল গাছগুলোর দিকে এগিয়ে যায়।নীল গোলাপের গাছ থেকে একটা গোলাপ ঝরে নিচে পড়ে আছে।সম্ভবত ঝড়ো হাওয়ায় সেটা ডাল থেকে খুলে এসেছে।

রূপসা ঝুকলো।তিন আঙুলের সাহায্যে ফুলটা হাতে নিল।নীল গোলাপ সে এর আগে দুইবার দেখেছে।তবে কখনো হাতে নেয় নি।আজই প্রথম সে নীল গোলাপ ছুঁয়ে দেখেছে।বৃষ্টিতে ভেজা সেই নীল গোলাপ রূপসার কাছে ভীষণ স্নিগ্ধ বলে মনে হলো।

সুন্দর কোনো ফুল হাতে পেলেই কানে গোজার স্বভাবটা মেয়েদের ক্ষেত্রে চিরন্তন।রূপসা তার ব্যতিক্রম না।কিছুক্ষণ গোলাপটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করার পর সে সেটা কানের পেছনে গুজে নিল।এই কাজটা তার বয়সের সাথে বেমানান।তবে রূপসা তার জন্য মোটেও লজ্জিত না।

হঠাৎই তার মনে হলো ছাদের দক্ষিণ দিকের ছোট্ট ঘরটার দরজায় কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে।রূপসা সেরকম কিছু একটা অনুভব করতেই চকিতে পেছন ফিরল।

বৃষ্টি থেমেছে দু’মিনিট আগে।এখন চারপাশ পরিষ্কার,একেবারে স্বচ্ছ।ছাদের এক পাশে থাকা ঘরটার দরজায় দাঁড়ানো মানুষ টার মুখও রূপসার নিকট স্পষ্ট।

লোকটা দুই হাত বুকে বেঁধে চৌকাঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার পরণে সাদা শার্ট।কলার তোলা।চোখের দৃষ্টি তুখোড়,রূপসার উপরই আটকে আছে।মুখটা থমথমে।দুই দাতের পাটি এক করে চোয়ালটা কেমন শক্ত করে রেখেছে।পুরো মুখ জুড়ে চাপা রাগ আর কঠোরতার আভাস।রূপসা তার অতিমাত্রায় গম্ভীর মুখটা দেখেই কেমন বিচলিত বোধ করলো।দ্রুত তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এপাশ ঐপাশ দেখলো।

পুরো ছাদ খালি।আরিবা আর সানজানাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।রূপসার শরীর হিম হয়ে এলো।একটা শুকনো ঢোক গিলে সে আড়চোখে ছাদের দরজা খোঁজার চেষ্টা করলো।

সাদা শার্ট পরা লোকটা তার দিকে এগিয়ে এলো।রূপসা সেটা টের পেতেই নিশ্বাস বন্ধ করে নিল।সাথে সাথে দুই কদম পিছিয়ে গেল।মাথা নামিয়ে সে নিজেকে সাহস দিলো।ভয়ের কিছু নেই রূপসা।শান্ত থাক,স্থির থাক।

ছেলেটা সামনে এসেই একবার আপাদমস্তক তাকে পরোখ করল।তারপর একপেশে হেসে চাপা কন্ঠে বলল,’টেরেসে অবশেষে সত্যি সত্যি ফুলের দেখা পাওয়া গেল মিস।’

একরাশ অস্বস্তিতে রূপসার শরীর বিষিয়ে উঠলো।পরনের কুর্তির দুই প্রান্ত খাঁমচে ধরে সে মেঝের দিকে দৃষ্টি নামায়।তারপর একটা শ্বাস ছেড়ে ছেলেটাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করে।

সে একটু সামনে যেতেই লোকটা পুনরায় তার পথ আটকে দাঁড়ালো।রূপসা এবার সাহস করে তার চোখের দিকে তাকালো।মানুষটার চোখ আগের তুলনায় আরো বেশি কঠোর দেখাচ্ছে।রূপসা অনুমানে তার বয়স আন্দাজ করে।কতো হবে?সাতাশ?আটাশ?নাকি উনত্রিশ?

সে চোখ তুললেই লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছো কেন?আমাকে তোমার ফাতরা ছেলে মনে হচ্ছে?’

রূপসা উত্তর দিলো না।কেবল উসখুস করতে করতে ছাদের দরজার দিকে তাকালো।আপাতত এখান থেকে বের হতে পারলেই তার শান্তি।

ছেলেটা তীক্ষ্ণ চোখে তার আচরণ লক্ষ্য করল।তারপরই মেঘের মতো গমগম করা স্বরে বলে উঠল,’তোমাকে এই নিয়ে পাঁচটা চিঠি দিয়েছি।উত্তর না দেওয়ার কারণ?’

সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎের ঝলকানির মতো কিছু একটা ঘটে গেল।শিরদাঁড়া বেয়ে একেবারে ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে এলো।রূপসা নিশ্বাস বন্ধ রেখে তার কথাটা হজম করে নিল।এই ছেলে তাকে রোজ রোজ চিঠি দিতো?কে এই ছেলে?তার পরিচয় কি?

রূপসা তড়িঘড়ি করে বলল,’আ…আজ আমার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।আমি আসি।’

বলে সে আর দাঁড়ায় না।লোকটাকে পাশ কাটিয়ে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে ছাদ থেকে বেরিয়ে আসে।দোতালায় পা রেখেই সে প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়।এতোক্ষণ তার নিশ্বাসটা গলার কাছে এসে আটকে ছিলো।রূপসা বুকে হাত চেপে কতোক্ষণ টেনে টেনে শ্বাস নেয়।তারপর ওড়না দিয়ে মুখ মুছে হনহনিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

তার মেজাজ গরম হয়ে আছে।সেই সাথে হাজার সাতেক হারানোর দুঃখে বুকটা কেমন চিনচিন করছে।এই লোক যদি আরেকবার এসব চিরকুট দেয় তাকে,তবে রূপসা আর কোনোদিন এই বাড়িতে আসবে না।সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।এই ভয়ংকর ঝামেলায় রূপসা কিছুতেই জড়াবে না।

তিনতালার কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়ানো যুবক এক মনে মনোযোগ দিয়ে তার প্রস্থান দেখে।তার ছটফটে আচরণ দেখেই তার হাসি পেল।রেলিংয়ে হাত রেখেই সে আরো কিছুক্ষণ তাকে দেখলো।কি অদ্ভুত!সে তাকে না কিছু বলল,না সে তার সাথে ভালো মন্দ কিছু করলো।এর আগেই এই মেয়ে এমন করে পালাচ্ছে কেন?মাথায় সমস্যা নাকি?সে অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করল,’মিস রূপসা! এভাবে তুমি কতোদিন পালাবে?আমি যখন তোমার সাথে কথা বলবো বলে মনস্থির করেছে,তার মানে আমি অবশ্যই অবশ্যই তোমার সাথে কথা বলব।তুমি যতোই পালাও,কাজের কাজ কিছু হবে না রূপসা।’

চলবে-