জুলিয়েট পর্ব-০৪

0
366

#জুলিয়েট
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

৪.

রূপসার ভার্সিটিতে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।রূপসা প্রথমে ভাবলো যাবে না।পরে আবার কি একটা ভেবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

বাড়িতে তার যে আলমারি আছে,সেটা শাড়িতে ভর্তি।নানা রঙের নানারকম শাড়ি।অধিকাংশই মায়ের।মা শাড়ি খুব ভালোবাসতো।সেই স্বভাব আর শখ রূপসার মধ্যেও আছে।সে শাড়ি পরে,অবিকল মায়ের মতো করে।বাবা তখন অপলক তাকিয়ে তাকে দেখে।বাবার চোখ ঝাপসা হয়।বাবা সেই ঝাপসা চোখ নিয়েই বলে,’একি! এ তো পুরা প্রীতি দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।’

রূপসা শুধু লাজুক হাসে।শাড়ি পরার পরে নারী কায়ার যেই নিগুঢ় সৌন্দর্য ফুটে উঠে,সেটা আয়নায় দেখতে বেশ ভালো লাগে।

রূপসা সকাল থেকেই আলমারি ঘেটে চার পাঁচটে শাড়ি বের করলো।জেসমিন তখন খাবার ঘরে।নাস্তার প্লেট গুলো টেবিলে রাখছিলো।রূপসা তার সামনে গিয়ে হাতে থাকা শাড়ি গুলো দেখিয়ে বলল,’এ্যাই মণি! কোনটা পরবো বলো তো?’

জেসমিন হাত থামালেন।মনোযোগ দিয়ে পাঁচটা শাড়ি দেখলেন।অফ হোয়াট পারের জলপাই রঙের শাড়িটা তার নজর কাড়লো।তিনি সেটাতে তর্জনী রেখে বললেন,’এটা ভালো হবে রূপ।’
রূপসা নিজেও এক দুই বার নেড়ে চেড়ে শাড়িটা দেখলো।নাহ,,ভালোই লাগবে মনে হচ্ছে।

তাকে শাড়ি পরাতে সাহায্য করলো জেসমিন।পরানো শেষেই আগাগোড়া দেখে বললেন,’মাশাআল্লাহ রূপ! পুরাই নতুন বউ লাগছে।’

রূপসা হাসলোও নতুন বউ দের মতো করেই।মাথা নামিয়ে,নাকের ডগায় লালচে ভাব ফুটিয়ে।মণি খুব সুন্দর শাড়ি পরাতে জানে।রূপসার মনে হলো এই শাড়ি পরে সে আধঘন্টা দৌড়ালেও কিছু হবে না।

সে সেদিন সকালের নাস্তা করে নি।মণি খুব বলছিলো।সে গায়ে মাখেনি।এক প্রকার দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।অনুষ্ঠান শেষে তার আবার দুই দুইটা টিউশন।প্রথম টিউশন নিয়ে রূপসা বিচলিত না।সে বিচলিত শেষ টিউশন নিয়ে।যেটার জন্য তাকে আরিবাদের বাড়ি যেতে হবে।

কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হলো দু’টো নাগাদ।পুরোপুরি শেষ হয়ে নি।নাচের পর্ব বাকি ছিলো।রূপসার পক্ষে এতোক্ষণ থাকা সম্ভব না।সে অনুষ্ঠানের মাঝে বিরতি দিতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।প্রথম টিউশন শেষ করে আরিবাদের বাড়ি পৌঁছাতে তার খুব বেশি সময় লাগলো না।

আজ হাত ঘড়িতে সময় দেখে সে তুষ্ট।কারণ আজ সে পাঁচ মিনিট আগে বাড়িতে এসেছে।সে সদর দরজার সামনে এসে কলিং বেল বাজায়।দরজা খুলল দেলোয়ারা কাকা।রূপসার সাথে দেখা হতেই তিনি চওড়া করে হাসলেন।বিনিময়ে রূপসাও তাকে একগাল ঝকঝকে হাসি উপহার দিলো।

___

আরিবা ঘুমুচ্ছিলো।রূপসা গিয়ে তার দরজায় পর পর দু’টো ধাক্কা দিলো।তারপর স্বাভাবিকের তুলনায় খানিকটা উঁচু স্বরে বলল,’আরিবা! শুনছো আরিবা?মিস এসেছি।ওপেন দ্য ডোর।’

রূপসা চোরা চোখে চারপাশ দেখে।তার গা ছমছম করছে।দেলোয়ারা কাকা বললেন আজ নাকি বাড়িতে তেমন কেউ নেই।সবাই বনানী গিয়েছেন।আরিবার পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিযেছে বিধায় তাকে রেখে গেছেন।সাথে নাকি শোহরাব আর তৌফও বাড়িতেই আছে।তৌফ থাকায় রূপসার বিকার নেই।তবে শোহরাব আছে,এটাই সবচেয়ে বড়ো চিন্তার বিষয়।

রূপসা ঢোক গিলে।প্রার্থনা করতে করতে তার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে।আজ যেন কোনো ঘটনা না ঘটে।রূপসা একটু শান্তি চায়।নির্বিঘ্নে টিউশন চালিয়ে যেতে চায়।সে আরো দুই বার দরজা ধাক্কায়।
‘আরিবা! দরজা খুলো।মিস এসেছি।তুমি পড়বে না?’

খ্যাট খ্যাট করে দরজা খোলার শব্দ হলো।কিন্তু আরিবার ঘরের না।শব্দটা এলো ডান পাশ থেকে কোথাও।
রূপসা দ্রুত চোখ তুলে।নিমিষেই মুখজুড়ে আতঙ্ক ছড়ালো তার।সে আড়ষ্ট হয়ে দুই হাত চেপে নিলো।

পাশের ঘর থেকে শোহরাব ধীর কদমে বেরিয়ে এলো।তার চুল ভেজা।একটু আগে শাওয়ার নিয়েছে বোধ হয়।গলায় সাদা রঙের তোয়ালে ঝুলানো।রূপসা তাকে দেখলো আড়চোখে,পুরোপুরি চোখ তুলে নি,তুলতে ইচ্ছে হয় নি।

শোহরাব দাঁড়িয়ে রইল ঠায়।একটুও নড়লো না,এক কদম সামনেও এগোলো না।কেবল নির্নিমেষ চাহনিতে সামনে দাঁড়ানো রমণীকে দেখে গেল।জলপাই রঙের শাড়িটা খুব শালীনভাবে গায়ে জড়ানো।এতো সুন্দর করে আঁচলটা কাঁধে তুলেছে,শরীরের কোনো অংশ দেখা যাচ্ছে না।কি স্নিগ্ধ সেই রূপ! শোহরাবের নিশ্বাসের গতি মন্থর হয়।হার্টবিট বোধ হয় মিস হলো কয়েকটা।কে জানে! সেই খবর সে রাখেনি।সে দেখলো মেয়েটা নিজের সুডৌল তনু গুটিয়ে নিয়েছে।কেমন আড়ষ্ট হয়ে মিশে আছে দরজার সাথে।

শোহরাব দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়ায়।আরো একবার আপাদমস্তক মেয়েটিকে দেখে।চিরায়ত বাঙালি নারীদের এই সহজ সরল বেশভূঁষা তাকে টানলো ভীষণ।আজকাল মেয়েরা শাড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছে।অথচ শাড়ির মতো শৌখিন পোশাক আর দু’টো আছে?

শোহরাবের একটা অদ্ভুত ইচ্ছে জাগলো।নিষিদ্ধ ইচ্ছা।মনকে তৎক্ষণাৎ শক্ত রশিতে বেঁধে নিল।একটা শুকনো ঢোক গিলে সুপ্ত বাসনাদের সিন্দুকে তালাবদ্ধ করলো।রূপসা দুই ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে ডাকলো,’দরজা খোলো আরিবা।পরীক্ষা না তোমার সামনে?মিস দাঁড়িয়ে আছি।’

আরিবা দরজা খুলল।রূপসা সাথে সাথে ভেতরে ঢুকলো।আরিবা ঘুমু ঘুমু চোখে ঢুলছিলো।রূপসা চেয়ারে বসে ঘাম মুছতে মুছতে বলল,’দরজা লাগিয়ে কেউ ঘুমায় আরিবা?এইটুকু বাচ্চা তুমি।দরজা লাগানোর কি দরকার?’

আরিবা উত্তরে কেবল বড়ো বড়ো করে হাই তোলে।ঘুম জড়ানো কন্ঠে অলস ভঙ্গিতে বলে,’মিস! তুমি আজকেও তাড়াতাড়ি এসেছো।’

‘পাঁচ মিনিট আগে এসেছি।তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সাত মিনিট নষ্ট করেছো।এখন আসো,পড়তে বসবে।’

আরিবার চোখে তখনও ঘুম।কলমটাও শক্ত করে ধরতে পারছিলো না।রূপসা মুখ থমথমে করে তাকে দেখলো।তারপর কড়া গলায় বলল,’যাও আরিবা।মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে আসো।’

আরিবা উঠে দাঁড়ালো।রূপসা তার গনিত বইটা হাতে নিয়ে বলল,’আসার সময় মিসের জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।প্রচন্ড পিপাসা লেগেছে।’

আরিবা চলে গেল আগের মতোই ঢুলতে ঢুলতে।রূপসা তার হোমওয়ার্কের খাতা হাতে নিয়ে হোমওয়ার্ক চেক করছিলো।আচমকা দরজা বন্ধ করার শব্দ হলো।রূপসা খাতা থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,’ভালোই হয়েছে দরজা বন্ধ করেছো।দরজা খোলা থাকলে মনোযোগ নষ্ট হয়।’

দরজা বন্ধ করার পর ঘরে আর কোনো শব্দ হলো না।রূপসার খটকা লাগলো।সে চোখ তুলে সামনে তাকালো।তাকাতেই কেমন তব্দা খেয়ে গেল।

শোহরাব দাঁড়িয়ে আছে দরজার সাথে ঠেস দিয়ে।খুবই সাবলীল ভঙ্গি।চোখে মুখে কোনো বিকার নেই।তবে চোখ জোড়া একেবারে শান্ত,রূপসাকে দেখছে,তাও আবার কোনো জড়তা কিংবা সংকোচ ছাড়াই।

রূপসার মেজাজ তুঙ্গে।গলা ছেড়ে বলল,’এটা কেমন অসভ্যতা?’

শোহরাব কেবল বাঁকা হাসলো।চওড়া আওয়াজে বিচলিত বোধ করলো না একদমই।উল্টো হেঁটে এসে রূপসার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলো।তার চুল তখনও ভেজা।গোসল থেকে বের হওয়ায় চোখ মুখ কিছুটা অন্যরকম দেখাচ্ছে।

রূপসা চোখ রাঙিয়ে বলল,’দরজা খুলুন।’

শোহরাব অতিশয় শান্ত সুরে বলল,’খুলে দিবো।আগে কথা শুনো।’

‘কি কথা?’

সে অধৈর্য হয়।কেমন ব্যাকুলতা ঝরে কন্ঠের মাঝে।নিশ্বাসের গতি বাড়িয়ে আবার বলে,’আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।’

‘কিন্তু আমার তোমার সাথে কথা আছে।’

এইবার তার কন্ঠ জোরালো শোনাল।কিছু একটা নিশ্চয়ই ছিলো তার কন্ঠে।রূপসা মাথা তুলে সহসা।দেখে তার চোয়াল শক্ত।চোখের ভাষা দুর্বোধ্য।একটা হাত টেবিলে রেখে সে রূপসার দিকে ঝুঁকলো।গুরুগম্ভীর স্বরে স্পষ্ট করে বলল,’মিস রূপসা।আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই।আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ।’

রূপসার পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।সে হতভম্ব,মনে হলো আকাশ থেকে কিছু একটা তার মাথার উপর এসে পড়েছে।সেই বিস্ময়ে কখন যে তার দুই ঠোঁট আলাদা হয়েছে,সে টের পায় নি।তার বিস্ফারিত চোখ জোড়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শোহরাব সোজা হয়ে বলল,’ইউ ক্যান টেইক টাইম।কোনো তাড়াহুড়ো নেই।তবে বিয়ে আমি তোমাকেই করবো।’

রূপসার স্থির হতে সময় লাগলো।তবুও পুরোপুরি ঠিক অবশ্য হলো না।তবে যতখানি ঠিক হলে নিজের কথাটুকু বলা যায়,অতোখানি স্বাভাবিক অবশ্য হয়েছিলো।একটা হাত টেবিলে রেখেই সে ধমকের সুরে বলল,’ফাইজলামি হচ্ছে?’

‘অফকোর্স নট।আমাকে তোমার এমন মনে হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে তোমার ভুল মনে হচ্ছে।’

রূপসা কেমন থম মেরে গেল।অতি বিস্ময়ে মানুষ যেমন কথা হারিয়ে ফেলে,অনেকটা এমন।কতোকিছু কন্ঠনালি অব্দি উঠে আসছিলো,অথচ মুখ ফুটে বেরুলো না।সে কেমন যেন তাল হারিয়ে ফেলল।তবুও কন্ঠের তেজ বিলীন হলো না।সে কেমন চাপা ক্রোধ ঢালা কন্ঠে বলল,’আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না।’

‘অনুমতি চাই নি রূপসা।সিদ্ধান্ত জানিয়েছি।’

শরীরটা টলমল করে উঠল রূপসার।এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে দুর্বলও মনে হলো কিছুটা।পরে অবশ্য দুর্বলতা কাটিয়ে নিয়েছিলো।তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে সে নিজেই দরজা খুলেছিলো।শোহরাব ছিলো চেয়ারে বসা।রূপসা উঠে যাওয়ার পরেও সে আগের মতো করেই বসেছিল।উঠে যাওয়ার কি কোনো প্রয়োজন আছে?নাহ্।

আরিবার হাতে পানির গ্লাস।রূপসা জোরপূর্বক হেসে সামান্য পানি খেয়ে গ্লাসটা তার হাতে ফিরিয়ে দিলো।দুর্বল হাতে আরিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’আজ আর পড়াতে পারবো না আরিবা।আমার শরীর খারাপ লাগছে।তুমি ঘুমাও।’

তারপরই সে বড় বড় পা ফেলে অর্কিড প্যালেস থেকে বেরিয়ে এসেছে।তার হৃদস্পন্দন তখন বেড়ে গিয়ে দ্বিগুণ হয়েছে।সে নিজেই নিজের বুকের ধুকধুক শব্দ শুনলো।তার ভয় হচ্ছিল।একটা অপ্রত্যাশিত দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়।

সে আরিবার শিক্ষক।শুধুমাত্র টিউশন পারপাসেই এই বাড়িতে তার আসা।এর বেশি কিছু না।একেবারে কিচ্ছু না।কিন্তু শোহরাবের বিষয়টা যদি লোক জানাজানি হয়,তবে তার সম্মানহানি হবে।তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে।সমাজের অলিগলি রূপসা চেনে।সবার আগে আঙুল যে তার উপরই উঠবে,এতে কোনো সন্দেহ নেই।অথচ লোকটাকে সে তিল পরিমান পছন্দ করে না।ঐ লোক আর তাকে নিয়ে কথা উঠলে রূপসা ভীষণ কষ্ট পাবে।

সারারাস্তা সে ভাবতে ভাবতে এলো।বড় বড় শ্বাস টেনে একটা পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিলো।সে মনঃস্থির করেছে আরিবাকে সে আর পড়াবে না।জল এমনিতেও অনেক দূর গড়িয়ে গেছে।আর না।

***

আরিবা হাঁটতে হাঁটতে ধপ করে খাটে গিয়ে শোয়।শোহরাব তখনও চেয়ারে বসা।তাকে বিচলিত দেখাচ্ছে না একদমই।উল্টো তার মুখে লেপ্টে ছিলো সূক্ষ্ম এক চিলতে হাসি।তার ধারণা রূপসা এই টিউশনটা ছেড়ে দিবে।আজ অথবা কাল সে ভাবিকে ফোন দিয়ে বলবে আরিবাকে পড়ানো তার পক্ষে সম্ভব না।

এই সিদ্ধান্তে শোহরাবের দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই।বিয়ের আগে বউয়ের বার বার শ্বশুরবাড়ি আসার বিষয়টা একটু দৃষ্টিকটু।না আসলে বরং বেশি ভালো হয়।রূপসা বিয়ের আগে কিছুদিন না হয় বাবার বাড়িতেই থাকুক।তারপর তো সে আটঘাট বেঁধে শোহরারের বাড়ি আসছেই।এতো অস্থির হওয়ার কি আছে?

***

রূপসা দুইদিন পরেই তানিয়া অর্থাৎ আরিবার মা কে ফোন করে জানালো এই টিউশনটা তার পক্ষে করানো সম্ভব না।তার ইদানিং পড়ার চাপ বেড়েছে।এতো কিছু সামলে সে আসলে টিউশনটা চালিয়ে যেতে পারছে না।

তানিয়া শুধু বলল,’দুই একদিনের মধ্য একবার অন্তত এসো রূপসা।বেতনও তো বাকি তোমার।’

রূপসা বলল,’বেতন লাগবে না।আমার কোনো দাবি নেই।’

‘সে কেমন কথা?না না।টাকাটা তোমায় না দিলে আমার মন খচখচ করবে।আর তাছাড়া আরিবা তো তুমি বাদে কারো পড়ানো এতো সুন্দর করে বুঝে না।তুমি তাকে কয়েকটা ম্যাথ অন্তত করিয়ে দিয়ে যেয়ো।’

রূপসা তপ্তশ্বাস ছেড়ে একেবারে ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলো,’আচ্ছা।ঠিক আছে।সামনের দু’দিনের ভেতর একদিন আসবো।’

তার মাথা ইদানিং ভার ভার লাগে।এসব উটকো ঝামেলায় সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় না।অথচ এই বিষয়গুলো কিছুতেই তার মাথা থেকে যায় না।বার বার তাকে ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়।এই বুঝি কিছু হয়ে গেল।এই বুঝি কেউ তার উপর চড়াও হলো।

___

তিনদিন পর রূপসা গিয়েছিলো আরিবাদের বাসায়।অর্কিড প্যালেসে তার শেষ দিন।সাত হাজার টাকা হারানোর দুঃখে বুকের বা পাশ চিন চিন করছিলো।অথচ শোহরাব নামের আধপাগল লোকের খপ্পড় থেকে বাঁচার আনন্দ সেই কষ্টকে ধূলোয় মিশিয়ে দিলো।

আরিবাকে সে সেদিন বিশ মিনিট বেশি পড়িয়েছে।তার মন ফুরফরা।এই অদ্ভুত ঝামেলা থেকে মুক্তির আনন্দে তার ভেতরটা হালকা লাগছিলো ভীষণ।তানিয়া খামে মুড়িয়ে বেতনের টাকা টা দিতেই সে সৌজন্যসূচক হাসলো।
আরিবার সাথে হয়তো তার আর দেখা হবে না।সে ব্যাগ থেকে একটা চকোলেট বের করে আরিবার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’নাও।এটা মিসের পক্ষ থেকে তোমার জন্য।ভালো করে পড়াশোনা করবে।কেমন?’

আরিবা দুই দিকে মাথা নাড়ে।রূপসা মহা আনন্দে অর্কিড প্যালেসের চৌকাঠ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।এসেই একটা বড়ো করে শ্বাস নিলো।শেষ।সব সমস্যা শেষ।কি শান্তি! কি শান্তি!

‘মিস রূপসা!’

স্বল্প পরিচিত একটা পুরুষ কন্ঠ।স্বল্প পরিচিত হলেও রূপসার জন্য একটা আতঙ্কের মতো।সে দ্রুত পেছন ফিরে।শোহরাব বাড়ির মূল দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল।রূপসা পেছন ফিরতেই শম্বুক গতিতে সামনে এগিয়ে এলো।এসেই স্মিত হেসে জানতে চাইলো,’শুনলাম তুমি নাকি টিউশন ছেড়ে দিচ্ছো?’

রূপসা গোমড়া মুখ করে জবাব দেয়,’জ্বী।’

‘ভালো। গুড ডিসিশন।’

রূপসা এবার তার দিকে তাকালো।কিছুটা কটাক্ষের সুরে বলল,’ভালো থাকবেন।আর আরিবার নতুন টিচারের সাথে দয়া করে ঐ ধরনের আচরণ করবেন না।’

শোহরাব নাক ছিটকায়।
‘ছিহ! তাদের সাথে করবো কেন?আমি ভীষণ লয়্যাল।কোনো সন্দেহ আছে তোমার?’

রূপসা পাত্তা দিলো না।দায়সারা হয়ে বলল,’আল্লাহ হাফেজ,ভালো থাকবেন।’

শোহরাব কপাল কুঁচকে বলল,’এমন করে বলছো যেন আর দেখা হবে না আমাদের?’

রূপসা থতমত খেয়ে তার দিকে ঘাড় ঘুরায়।
‘বলছেন আবার দেখা হবে?’

শোহরাব কেবল সামান্য হাসলো।হাত দু’টো পকেটে গুঁজে রূপসার দিকে একটু ঝুকে এসে বলল,’সুবাস মিত্র সড়ক।চার নম্বর লেন।একেবারে শেষ মাথায় রাজিব মাস্টারের বাড়ি।বাড়ির পূর্ব দিকের ঘরে এখন সবুজ আর সাদা রঙের পর্দা টানানো।তুমি তো সেই ঘরেই থাকো তাই না?’

রূপসার চোখ আপনাআপনি বড়ো হলো।চোয়াল ঝুলে গেল নিজ থেকে।কেমন ভূত দেখার মতো চমকে উঠে সে শোহরাবের দিকে তাকালো।তার অবিশ্বাস্য দৃষ্টি,পলক ফেলল না দীর্ঘসময়।কি সাংঘাতিক! এই লোক তার থাকার ঘর পর্যন্ত চিনে নিয়েছে।

তার তাজ্জব মুখখানা দেখে শোহরাব আরেকদফা হাসলো।কিছুটা ফিসফিসে স্বরে বলল,’বেহুদা টিউশনটা ছাড়লে তুমি।বিয়ের পর তো এমনিতেও আরুকে ফ্রিতেই পড়ানো লাগতো।এখন যা একটু আয় হচ্ছিল,সেটাও নিজের মোটা বুদ্ধিতে বন্ধ করলে।সো সেড।’

চলবে-