জুলিয়েট পর্ব-০৮

0
250

গল্প #জুলিয়েট
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

৮.

জোহরা খাতুন দীর্ঘদিন যাবত মাইগ্রেনের সমস্যায় জর্জরিত।গতকাল তিনি তিন তিনটে ঔষধ খেয়ে শুয়েছেন।তবুও তার ঘুম হয়েছে ছাড়া ছাড়া।

রোজকার মতো আজও তিনি শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলেন।চোখে একটু খানি ঘুম নেই।মারুফ সাহেব এখনো অফিস থেকে আসে নি।জোহরা জোরপূর্বক চোখ মেলে পুরোটা ঘর একনজর দেখার চেষ্টা করলেন।চোখও পুরোপুরি খুলছে না।টেনে টেনে খুলে রাখাও সম্ভব হচ্ছে না আর।

এমন সময় তার ঘরের দরজার লক ঘুরিয়ে কেউ একজন তার ঘরে প্রবেশ করলো।তারপর খুব আস্তে করে দরজা ভিড়িয়ে দিলো।জোহরা চমকে উঠে বললেন,’কে?’

শোহরাব ধীর পায়ে হেঁটে মায়ের কাছে গেল।তার চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ।সেই সাথে ঠোঁটে এক টুকরো হাসির মিশ্রণ।জোহরা দুই আঙুল চোখে চেপে অস্ফুটস্বরে বললেন,’শোহু এসেছিস?’

শোহরাব বসলো মায়ের শিয়রে।তার মাথায় একটা হাত রেখে বলল,’কেমন আছো মা?’

‘আছি।ভালোই।মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা।’

শোহরাব কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বসে থাকে।ভেতরটা খচখচ করছে।অথচ মা তিনদিন ধরে অসুস্থ।এই অসুস্থতায় শোহরাব আসল কথাটা বলতে পারছে না।সে একটু গলা খাকারি দিয়ে বলল,’মা! আমার কিছু কথা ছিলো।তুমি কি শুনবে?নাকি শরীর বেশি খারাপ?’

জোহরা চট করে চোখ খুললেন।সর্বোচ্চ যতোখানি খোলা সম্ভব,ঠিক ততখানি।তার আঁতকে উঠা দৃষ্টি দেখেই শোহরাব ভড়কে গেল।জোহরা তড়িঘড়ি করে বললেন,’কি কথা?আবার কি গন্ডগোল পাকিয়েছো তুমি?’

পুরো মুখ বিরক্তিতে ছেয়ে গেল শোহরাবের।সে কপাল কুঁচকে বলল,’উফফ! সমস্যা কি তোমাদের?সবসময় উল্টা পাল্টাই কেন ভাবো তোমরা?’

জোহরা এলোমেলো শ্বাস ছাড়লেন।ক্লান্ত স্বরে বললেন,’তুমি কি আমাদের কম জ্বালিয়েছো?তৌকিও তোমার চেয়ে বেশি বুঝদার।’

জোহরা টেনে টেনে কয়েক দফা শ্বাস নিলেন।মাথা ব্যাথা কিছুটা কমেছে।এক হাতে ভর দিয়ে তিনি কোনোরকমে উঠে বসলেন।খাটের সাথে হেলান দিয়ে ছেলের দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,’কি হয়েছে আবার?তুমি তো কারণ ছাড়া আমার কাছে আছো না।আবার কি ঘটনা ঘটিয়েছো?’

শোহরাব মনে মনে কথা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো।অথচ সবকিছুই কেমন এলোমেলো লাগছে।সে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে নিরেট স্বরে বলল,’মা,আমি একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।’

জোহরা হতভম্ব হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন।বিস্ময়ে তার চোখ জোড়া কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।তিনি হতচকিতে হয়ে কেবল ছেলের মুখটা দেখে গেলেন।সে কি সত্যি বলছে?তিনি কাঁপা স্বরে বললেন,’কি বললি?কি করতে চাস তুই?’

বার বার একই প্রশ্নে শোহরাব কপাল কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বলল,’বিয়ে করতে চাই মা।তুমি কিছুদিনের ভেতরই সম্বন্ধ পাঠাও তার বাড়িতে।’

জোহরা আঁতকে উঠলেন।নিশ্বাস আটকে বললেন,’তোর বাপ যে এক জায়গায় তোর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে।তুই সেটা জানিস না শোহু?’

‘ঐ মেয়েকে আমার ভালো লাগে না মা।’

‘সেটা তোমার বাবা কে গিয়ে জানাও শোহরাব।আমাকে এসব কেন বলছো?’

মায়ের কন্ঠটা হঠাৎই কেমন কঠোর শোনালো।শোহরাব অনুনয় করলো,’মা! প্লিজ।’

‘তোমার বাবার সাথে আলোচনা করো।’

‘প্লিজ,মা।তুমি বাবাকে বলো।আমি বলতে পারবো না।’

জোহরা কঠিন মুখে বললেন,’আমিও পারবো না।’

শোহরাব তার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বলল,’মা! ও মা! প্লিজ মা।আমি জীবনে কিচ্ছু চাই নি তোমার কাছে।এটাই প্রথম।এটাই শেষ।আর কোনোদিন কিছু চাবো না।’

জোহরা চোখ গরম করে ছেলের দিকে তাকালেন।কন্ঠে আগুন ঝড়িয়ে বললেন,’প্রতি মাসে এক কথা বলো তুমি।আর কিছু চাই না,আর কিছু চাই না বলে এই পর্যন্ত কতো কিছু আদায় করেছো তুমি আমার থেকে,তার কোনো হিসেব আছে?’

‘প্লিজ মা।’

‘গত মাসে তুমি এমন করে বাইক কিনেছো।বলেছিলে বাইক দিলে আর কিছু চাইবে না।এর কয়েকমাস আগে তুমি বলেছিলে ছাদের চিলেকোঠায় তোমাকে একটা ছোট ঘর বানিয়ে দিতে।দিলে তুমি আর কিচ্ছু চাইবে না।এখন তুমি রীতিমতো বিয়ের মতো সেনসিটিভ ইস্যু নিয়ে ছেলে খেলা করছো।’

‘ছেলে খেলা না মা।সিরিয়াস আমি।’

শোহরাবের তীব্র অনুনয়ে জোহরা খানিকটা দমে গেলেন।কোনো উত্তর না দিয়ে শান্ত চাহনিতে কয়েক পলক ছেলেকে দেখলেন।শোহরাব মায়ের সেই শীতল মেজাজ টের পেতেই শক্ত করে তার হাত দু’টো চেপে ধরে বলল,’মা তুমি প্লিজ তাদের বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ পাঠাও।বাবাকে রাজি করাও।আমি বিয়ে করলে তাকেই করব।’

জোহরা দম ফেললেন।বললেন,’মেয়ে কে?কোন মেয়ের জন্য এমন পাগল হয়েছো তুমি?’

শোহরাব একটু নড়েচড়ে বসলো।গলা খাকারি দিয়ে ঝকঝকে কন্ঠে বলল,’রূপসা।’

জোহরা কপাল কুঁচকে বললেন,’রূপসা কে?’

‘আরুর হোম টিউটর।’

জোহরা চোখ কপালে তুলে বললেন,’কি?আরুকে যে পড়াতে আসে মেয়েটা,সে?’

‘হুম।’

শোহরাব মাথা তুলে বলল,’খুব সুন্দর না মা?’

জোহরা থতমত খেলেন।পরক্ষণেই কটমট করে উঠে বললেন,’ঐ মেয়ে তো দেখতাম মাথা নিচু করে ঢুকতো,আবার মাথা নিচু করেই বের হতো।’

‘হু’

‘তাহলে প্রেম করেছিস কখন?’

শোহরাব তপ্তশ্বাস ছেড়ে বলল,’প্রেম এখনো করিনি।বিয়ের পর করবো।’

জোহরার বিস্ফারিত নয়ন।শোহরাব কিছুটা অপ্রস্তুত হলো।আলতো করে মায়ের হাতটা চেপে ধরে বলল,’মা আমি তাকেই বিয়ে করবো।আর কাউকে না।’

ঘরের ভেতর ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এসি চলছিলো।তবুও জোহরা ধীরে ধীরে হাঁশফাঁস করতে শুরু করলেন।শোহরাব এসির তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি তে নামিয়ে আনলো।জোহরা ভীতু স্বরে বললেন,’তোমার বাবা কে আমি কি বলবো শোহু?সে তো আরেক জায়গায় তোমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে।যদি শুনে আরিবার টিচারের সাথে তুমি বিয়ে করতে চাও,তবে কেলেঙ্কারি কান্ড হবে একটা।’

শোহরাব বলল,’তুমি সামলে নিও।’

জোহরার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো।তিনি খানিকটা চেঁচিয়ে উঠে বললেন,’কয়দিক সামলাবো আমি?’

তিনি কয়েক দফা টেনে টেনে শ্বাস নিলেন।শেষে মৃদুস্বরে বললেন,’মেয়ে রাজি?’

‘নাহ্।’

জোহরা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,’তুই আমার ঘর থেকে যা শোহরাব।’

শোহরাব উঠে দাঁড়ালো।পকেটে হাত গুজে নির্বিকার হয়ে বলল,’যাচ্ছি।তবে শুনো মা।বিয়ে আমি রূপসাকেই করবো।তুমি বাবাকে বলে রেখো।আরেকটা বিষয়,প্রস্তাব কবে পাঠাবো,সেটা আমিই বলে দিবো।পাত্রী খুব সুন্দরী।তাই বলে তোমরাই আগ বাড়িয়ে সব করতে যেও না।আমি বললে তারপর করো।’

সে কথা শেষ করে আর জোহরার উত্তরের অপেক্ষা করলো না।একটা হাত পকেটে গুজে গুন গুন করতে করতে সে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল।তার কাজ শেষ।মায়ের মাথায় বীজ ঢোকানো হয়ে গেছে।এবার মা ই সবটা করবে।

জোহরা হতবাক চোখে তার বেরিয়ে যাওয়া দেখে।তার গা ছাড়া,লাপরোয়া ভাব জোহরার বুকের ধড়ফড়ানি বাড়িয়ে দিলো সামান্য।তিনি মাথায় হাত চেপে দুই চোখ বুজলেন।এই ছেলে ঘরে আসামাত্র তিনি বুঝেছিলেন,সে এমনকিছু বলবে যেটাতে জোহরার মাথাব্যথা আরো বাড়বে।হয়েছেও তাই।জোহরার মনে হলো যন্ত্রনায় তার মাথা ফেটে যাচ্ছে।না মেয়ে রাজি,না প্রেমের সম্পর্ক।তবুও বলছে তাকেই বিয়ে করবে।কি অদ্ভুত! জোহরা এতো দিক সামাল দিবে কিভাবে?

—-

শোহরাব ইজিচেয়ারে বসে অল্প অল্প দোল খাচ্ছিল।ঠিক তখুনি নাফিসের ফোন এলো।ফোনটা রিসিভ হতেই নাফিস তড়িঘড়ি করে বলল,’কিরে?খবর কি?আন্টি কি বলল?’

শোহরাব সূক্ষ্ম হেসে বলল,’বলেছি না তোকে?মা আমার কথা ফেলতে পারে না।এখন পর্যন্ত আশি পারসেন্ট পজেটিভ।’

‘যদি তোর মা রাজিই হতো,তাহলে এতো কাহিনি করলি কেন?সোজা প্রস্তাব পাঠালেই পারতিস।খামোখা কাগজ পত্রের ঝামেলাই গেলি।’

শোহরাব মুখটা থমথমে করে বলল,’তোর কি মাথায় সমস্যা?রূপসার বিয়ে অলরেডি ঠিক হয়ে ছিল।ঐ অবস্থায় মা কিভাবে সম্বন্ধ পাঠাতো?আগে তো আগের বিয়ে ভাঙতে হবে।ঐ মগা সাইফ যদি বিয়ে না ভাঙে,তাহলে তো মা আর আগ বাড়িয়ে সম্বন্ধটা পাঠাতে পারতো না।’

নাফিস ঠোঁট গোল করে বলল,’ওহহ আচ্ছা।বুঝেছি।’

শোহরাব পুনরায় মাথা এলিয়ে দেয় পেছনের দিকে।নাফিস বলল,’সম্বন্ধ তাহলে কবে পাঠাবি?’

সে গুরুগম্ভীর স্বরে উত্তর দেয়,’পাঠাবো।আগে সাইফ বিয়েটা ভাঙুক।তারপর পাঠাবো।’
.
.
.
.
রূপসার ভার্সিটি শেষ হয়েছে বিশ মিনিট আগে।সে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলো মুখ কুঁচকে।এটা তার জন্য স্বাভাবিক।দিনের অধিকাংশ সময় তার কপালের রগ দু’টো কুঁচকেই থাকে।

বাইরে সূর্যের উত্তাপ কম না।ভ্যাপসা গরমে শরীরটা ভিজে উঠছে একটু পর পর।ব্যাগের ভেতর টিস্যু রাখা ছিলো।রূপসা সেই টিস্যু দিয়ে মুখ মুছলো দুইবার।

কিছুদূর সামনে যেতেই আচমকা তার দুই পা থেমে গেল।রূপসা আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করল,তার সামনে সাইফ দাঁড়ানো।এই অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎে সে কেমন ভড়কে গেল।সে প্রশ্নাত্মক চাহনি নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।

সাইফ নিজেও কিছুটা ব্যাকুল ছিলো।রূপসা তার সামনে দাঁড়াতেই সে আরো একটু অস্থির হলো।রূপসা স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনি এখানে?’

সাইফ চট করে চোখ তুলল।কোনো রকম সূচনা কিংবা ভূমিকায় না গিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন করলো,’আপনি কি ম্যারিড রূপসা?’

চমকের পিলে সামনে তাকায় রূপসা।বিস্ফারিত চাহনি,অবিশ্বাস্য দৃষ্টি।প্রশ্নটা শুনেই শরীর কেমন থ হয়ে গেল।রূপসা হতবাক হয়ে বলল,’কিহ্?’

সাইফের কন্ঠ মোলায়েল।রূপসা থামতেই জবাব দিলো,’কাল আমাকে কয়েকটা ছেলে তুলে নিয়ে গিয়েছিল রূপসা।’

রূপসা আঁতকে উঠে বলল,’সেকি কথা! এরপর?’

‘এরপর তারা বলল আমি যেন আপনার সাথে বিয়ে টা ভেঙে দেই।কারণ আপনি অলরেডি ম্যারিড।অন্য ব্যক্তির স্ত্রী আপনি।’

রূপসার পায়ের নিচের মাটিটা কেমন নড়বড়ে ঠেকালো।শরীরটাও দুর্বল বোধ করল খানিকটা।সে উদভ্রান্তের মতো করে শুধালো,’এরপর?আপনি বিশ্বাস করে নিয়েছেন সবটা?’

সাইফ শব্দ করে শ্বাস ছাড়লো।মাথা তুলে স্পষ্ট করে বলল,’ম্যারিজ সার্টিফিকেট দেখার পর তো অবিশ্বাস্যের কোনো কারণ নেই রূপসা।’

রূপসার মাথাটা একটা চক্কর দিয়ে উঠল।সে তাল হারিয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেল।ম্যারিজ সার্টিফিকেট এলো কোথা থেকে?সে তো বিয়েই করে নি।সে বহু কষ্টে বিড়বিড় করলো,’আমার বিয়ে হয়নি।ম্যারিজ সার্টিফিকেটের প্রশ্নই আসে না।’

‘জানি।ঐটা একটা ভুয়া সার্টিফিকেট ছিলো।’

সাইফের কন্ঠ পরিষ্কার।কোনো জড়তা নেই।রূপসা মাথা তুলে তার দিকে তাকায়।তার মলিন মুখটা দেখেই সাইফ হাসি হাসি মুখে বলল,’ভয় পাওয়ার কিছু নেই রূপসা।আমি দেখেই বুঝেছি ঐ টা একটা নকল সার্টিফিকেট।কিন্তু ছেলেটার সাথে ঝামেলা বাঁধাতে ইচ্ছে হয় নি।তাই কিছু বলি নি।’

রূপসা উত্তর দিলো না।তার মাথা ঝিম ঝিম করছে।রাগ হচ্ছে নাকি কষ্ট হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছে না।কেমন যে অদ্ভুত অদ্ভুত লাগছে।নিজের কাছেই কেমন বিব্রতবোধ হচ্ছে।সাইফ পুনরায় নিজ থেকে বলল,’ছেলেটা সম্ভবত আপনাকে পছন্দ করে।আর আমি যতোটুকু বুঝলাম,সে ভীষণ ডেস্পারেট আপনার জন্য।’

রূপসা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়।এই কথাগুলো তাকে আরো বেশি হীনমন্যতায় ফেলে দেয়।সে মাথা নিচু করেই ক্লান্ত স্বরে বলল,’আমি বহুবার তাকে প্রত্যাখ্যান করেছি।সে কিছুতেই পিছ পা হচ্ছে না।’

‘আপনি যতোদিন না বিয়ে করছেন,ততদিন সে পিছ পা হবে না রূপসা।’

রূপসা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,’হু,জানি।’

সাইফ সামান্য ঝুকল।বলল,’আপনি কি সত্যি সত্যি এই সমস্যা থেকে মুক্তি চান?তবে আমার কাছে একটা উপায় আছে।সেটা করতে পারলে ঐ ছেলে আর কোনো ঝামেলা করতে পারবে না নিশ্চিত।’

চট করে মাথা তুলল রূপসা।তারপর ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলো,’কি?কি উপায়?’

‘আপনি আমায় বিয়ে করে নিন রূপসা।সেটাও আজই।’

রূপসার হতভম্ব হওয়ার যেটুকু বাকি ছিলো,সেটাও পূরণ হলো।সে বোকা বোকা হয়ে বলল,’জ্বী?’

সাইফ দুই হাত বগলদাবা করে বলল,’দেখুন।আপনার আর আমার এমনিতেও কিছুদিন পর বিয়ে হচ্ছে।কিন্তু আমার ধারণা,ঐ ছেলে এই কিছুদিনেও ঝামেলা করতে চাইবে।তবে বিয়ে হয়ে গেলে,আর ঝামেলার সুযোগ নেই।এবার বাকিটা আপনার হাতে।’

‘তাই বলে বাবা কে না জানিয়ে বিয়ে করবো?’

‘তাহলে আপনার বাবাকে ঐ ছেলের কথা জানিয়ে দিন।’

রূপসা চেঁচিয়ে উঠল,’অসম্ভব।’

‘তাহলে আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই।’

রূপসা দমে গেল হঠাৎ।কেমন যেন গ্যাস বেলুনের মতো চুপসে গেল।ফ্যাকাশে মুখ করে একবার দুই পাশে তাকালো।একটা শুকনো ঢোক তার গলা বেয়ে নিচে নেমে এলো।ঘামে জবজব করে উঠল কপাল টা।

রূপসা অতিকায় ক্ষীণ কন্ঠে শুধু বলল,’আমার ভয় হচ্ছে।’

_________________________________________

পুরো ঘর জুড়ে পিনপতন নিরবতা।নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট।এছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।ঘরের দেয়াল জুড়ে নানারকম ওয়াল পেইন্টিং।কৃত্রিম আলোর অভাবে ঘরটা কেমন আবছা দেখাচ্ছে।যদিও এখন বিকেল,তবে এই ঘরে এখনো সূর্যের আলো এসে পৌঁছায় নি।

রূপসা ঝুঁকে ছিলো মেঝের দিকে।মাথাটা নামিয়ে রাখা।চোখ দু’টো বন্ধ।তারপর ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সে খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো।ক্লোরোফর্মের ধোঁয়াশা কাটিয়ে অচেতন রমণীর তেইশ বছর বয়সী শরীরটা ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে পেল।

রূপসা চোখ খুলতেই আবিষ্কার করলো,সে একটা বন্ধ গুমোট আর চাকচিক্যময় একটি ঘরে।ঘরের ভেতর যেই আবছা আলো প্রবেশ করছে,সেই আলো তে বোঝা যাচ্ছে,ঘরটা দামি আসবাবপত্রে ঠাসা।

রূপসা শ্বাস টানতে টানতে দুই পাশে তাকায়।তার হাত দু’টো এক সাথে করে বাঁধা।পা দু’টোও বাঁধা।একটা কাঠের চেয়ারে তাকে বসানো হয়েছে।নিজের অবস্থান উপলব্ধি করতেই শরীর জমে এলো তার।একটা হিমশীতল ধারা শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো তৎক্ষণাৎ।

রূপসা চিৎকার ছুঁড়ল,’দরজা খোলো।প্লিজ দরজা খুলো।সাইফ।আপনি কি আমায় শুনতে পারছেন?’

তার কন্ঠ শেষে এসে কিছুটা ভীত শোনাল।কারণ সে সত্যিই ভয়ে আছে।সে জানে না আজ তার সাথে কি হবে।

সাইফের কথা মতো তারা কাজি অফিস গিয়েছিলো।গিয়েছিলো বললে ভুল হবে,যেতে চেয়েছিল।তবে যেতে পারেনি।পথেই বিশালাকার একটা গাড়ি এসে তাদের পথ আটকে দাঁড়ালো।রূপসা কিছু বুঝে উঠার আগেই এক হ্যাঁচকা টানে তাকে আর সাইফ কে গাড়িতে তোলা হলো।

রূপসা চিৎকার করতে গিয়েও চিৎকার করতে পারলো না।শোহরাব ততক্ষণে তার মুখ চেপে ধরেছে।সে শোহরাবের দিকে তাকাতেই শোহরাব তার দিকে সামান্য ঝুকলো।তার হৃদস্পন্দন তখন রূপসার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছুলো।সে স্পষ্ট শুনলো,তার বুকটা কেমন ধুক ধুক করছে।

রূপসা চোখ তুলতেই শোহরাব তাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করলো।ক্লোরোফর্মের বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রভাবে রূপসার যখন জ্ঞান যায় যায় অবস্থা,ঠিক তখনি শোহরাব তার কানের কাছে এসে হিসহিসিয়ে বলল,’কাজটা তুমি ভালো করো নি রূপসা।যতোই তোমার সাথে মোলায়েম হই,তুমি টেনে হিঁচড়ে আমার মন্দ রূপটা বের করে আনো।যাক গে,সেটা সমস্যা না।আমি তোমায় বিয়ে করার জন্য মন্দ হতেও রাজি আছি।’

____

দরজার লক ঘোরানোর ঘচঘচ শব্দ কানে আসতেই রূপসার ধ্যান ভাঙলো।সে ইষৎ কেঁপে উঠে দরজার দিকে তাকালো।

শোহরাব ঘরে এসেই বাতি জ্বালালো।রূপসার সমস্ত মুখ তখন অজানা দুশ্চিন্তায় আঁধায় হয়ে আছে।এই মলিন,মূর্ছে যাওয়া মুখখানা দেখতেই শোহরাব কিঞ্চিৎ হাসলো।তারপর একটা চেয়ার টেনে তার সামনে বসলো।

রূপসা উঁচু স্বরে বলল,’হাত পায়ের বাঁধন খুলুন।’

‘খুলব।একটু অপেক্ষা করো।’

‘কিসের অপেক্ষা?’

‘হুশশশ।এই অবস্থায় এতো তেজ দেখানো ভালো না ম্যাডাম।বন্দিদের সাথে তেজ শব্দটা ঠিক যায় না।’

রূপসা দমে গেল ঠিকই।অথচ ভেতরে ভেতরে চাপা ক্রোধে ফেটে পড়ছিলো বারংবার।

খনিক বাদেই নাসিফ আর টুটুল মিলে সাইফ কে টেনে এনে ঘরের মেঝেতে ফেলল।রূপসা সেই শব্দে চমকে উঠল।অবাক হয়ে দেখল,সাইফের কপাল,ঠোঁট আর গালের কিছু অংশ কেটে আছে।সে আঁতকে উঠে বলল,’এসব কি?সাইফের সাথে এসব কেন করেছেন আপনি?’

শোহরাব দায়সারা হয়ে বলল,’তোমার সাইফ কে ভালো করে বুঝিয়েছি।কাজ হয় নি।তাই এই ব্যবস্থা।পরের বার থেকে অন্যের বউয়ের সাথে বিয়ের চিন্তা করলে দশবার ভেবে নিবে।’

রূপসা তেঁতেঁ উঠে বলল,’আমি আপনার বউ নই।’

‘এই তো।আর দশ মিনিট।তারপর আর এই কথা বলতে পারবে না।’

রূপসা আহাম্মক হয়ে তার কথা শুনে।শোহরাব পেছন ফিরে বলল,’তানভীর।কাজি সাহেবকে নিয়ে আয় তো।’

এক কথাতেই রূপসার সমস্ত শরীর পাথর হয়ে গেল।মনে হলো মাথার উপর সশব্দে কোনো কিছু ধড়াস করে পড়লো।কাজি সাহেব কে আনবে মানে?আতঙ্কে,উৎকন্ঠায় তার হাত পা কাঁপছিলো ঘন ঘন।সেই প্রকম্পন শোহরাবের দৃষ্টি এড়ালো না।

মাঝবয়সী লোকটা ভয়ে ভয়ে রূপসার মুখোমুখি এসে বসলেন।তার চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।এমন জোর জবরদস্তির বিয়ে তার ভয় লাগে।তার উপর মামলা মোকদ্দমার চক্কর তো থাকেই।তিনি ফ্যাকাশে মুখে রূপসার দিকে তাকালেন।

শোহরাব ঝুকে সবার প্রথমে রূপসার হাতের বাঁধন খুলল।রূপসা ধমকের সুরে বলল,’আমি তোকে বিয়ে করবো না।ছাড় আমাকে।’

শোহরাব সেই কথা গায়ে মাখলো না।দুই হাত খোলার পর দুই পায়ের বাঁধনও খুলে দিলো।রূপসা কন্ঠে ক্ষোভ ফুটিয়ে বলল,’আমি তোকে বিয়ে করবো না।না না না।’

শোহরাব তার ঠোঁটে এক আঙুল চেপে বিরক্ত স্বরে বলল,’অনেক হয়েছে।অনেক কাহিনি করেছো এবার চুপচাপ কবুল বলো।আর আমাকে চিন্তামুক্ত করো।’

সে উঠে গিয়ে রূপসাকে টেনে এনে খাটের এক দিকে বসালো।তারপর নিজে গিয়ে তার পাশটায় বসলো।রূপসা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তার কার্যকলাপ দেখে।হাত পায়ের বন্ধন মুক্ত হতেই সে এক পায়ের জুতো হাতে তুলে নিলো।তীব্র ক্রোধে গির গির করে উঠে বলল,’তোকে আমি জুতো পেটা করবো।’

শোহরাব খপ করে তার হাতের কবজি চেপে ধরল।তারপর হাতে থাকা জুতোটা দূরে কোথাও ছুড়ে মেরে কড়া গলায় বলল,’খবরদার! এই দুঃসাহস আর দেখাবে না।’

‘দেখাবো।কি করবি তুই?’

‘আমি তোমায় আদর দিবো।’

রূপসা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।শোহরাবের ঠোঁটের কোণে তখন দুর্বোধ্য হাসি।রূপসা চেঁচিয়ে উঠে বলল,’আমি বিয়ে করবো না।মরে গেলেও করবো না।’

‘তুমি অবশ্যই বিয়ে করবে।এখনই করবে।’

‘তুই বললেই হবে?তুই একটা কুত্তা।’

‘থ্যাঙ্কস।আর তুমি কুত্তার বউ কুত্তি।এবার চুপচাপ বসো।’

শোহরাব তার দুই হাত চেপে ধরল।রূপসা পুরো শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে বলল,’ছাড় বলছি।একটা চড় দেব ধরে অসভ্যতা করলে।অনেক সহ্য করেছি তোকে।আর না।’

শোহরাব হাসি মুখে বলল,’বাকি জীবনও সহ্য করে নিও।’

রূপসা তখন আঘাত প্রাপ্ত বাঘিনীর মতো।ক্রোধের অগ্নিশিখায় দাউ দাউ করে জ্বলছিলো।সমস্ত শরীর কেমন পুড়ে যাচ্ছিলো।মনে হচ্ছিল শোহরাবকে দু’টো চড় দিতে পারলে সেই আগুনে পানি পড়বে।সে নিজেকে বন্ধনমুক্ত করতে করতে চেঁচিয়ে উঠল,’আমি তোকে কিছুতেই বিয়ে করবো না।তুই আমাকে মেরে ফেললেও না।আমি বিয়ে করবো না মানে করবো না।তুই একটা জানোয়ার।’

শোহরাব নরম গলায় বলল,’আচ্ছা।অনেক খুনশুটি হয়েছে।এখন ভালো মেয়ের মতো চুপ হয়ে বসো।’

রূপসা বসলো না।হাত পা ছুড়ে বলল,’কুত্তার বাচ্চা।ছাড় বলছি।’

শোহরাবের ধৈর্য ফুরিয়ে এলো।সে আচমকাই বিকট স্বরে গর্জন করে বলল,’নাসিফ!! সবাই কে নিয়ে ঘর থেকে বের হ তো।রূপসার সাথে আমার আলাদা কথা আছে।’

সেই সুস্পষ্ট হুঙ্কারে রূপসা নিজেই অল্প স্বল্প কেঁপে উঠলো।তোতলানো গলায় বলল,’ক কী?কী কথা তোর আমার সাথে?’

‘সেটা সবাই গেলেই বুঝবে।’

শোহরাব শার্টের প্রথম দু’টো বোতাম খুলল।রূপসা চিৎকার করে বলল,’উল্টা পাল্টা কিছু করলে জানে মেরে দিবো।তুই কুত্তা না।কুত্তাও তোর চেয়ে ভালো।তুই শুয়োর।’

‘আচ্ছা।তুই তাহলে শুয়োরের বউ।’

রূপসা হিংস্র শ্বাপদের মতো ফুসতে ফুসতে এদিক সেদিক তাকায়।কাজির বেশে থাকা লোকটার সাথে চোখাচোখি হতেই সে গর্জে উঠল কিছুটা।

‘এ্যাই! তোর বাড়িতে মেয়ে নেই?এমন করে জোর জবরদস্তির বিয়ে পড়াতে তোর ভয় করে না?’

কাজি লোকটা নিরুত্তর,নির্বিকার।ভয়ের চোটে আরো একবার গলা ভিজিয়ে নিল।তার নিস্তেজ মুখটা দেখেই রূপসা বুঝল,তার আসলে কোনো কিছু করার ক্ষমতাই নেই।
সে আচমকাই শোহরাবের দিকে ফিরে করুণ কন্ঠে বলল,’প্লিজ।আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না।প্লিজ এই কাজটা করবেন না আমার সাথে।’

শোহরাব সে কথা পাত্তা দিলো না।বরং আরেকটু এগিয়ে এসে রূপসার ঘাড়ের কাছে দু’টো শ্বাস ছেড়ে বলল,’আমার তো তোমাকে চাই ই রূপসা।এখন বলো,বিয়ে করে হালাল ভাবে আমার হবে।নাকি এখন এইমুহূর্তে আমি তোমার সাথে এমন কিছু করবো,যেটা তুমি নিতে পারবে না।’

রূপসার সমস্ত শরীর ভেঙে গেল।পূর্বের তেজ,শক্তি,কন্ঠের জোর,সব কেমন ফুরিয়ে এলো।সে হাত পা ছেড়ে দিয়ে ধপ করে খাটের এক পাশে গিয়ে পড়লো।তার চোখ মুখ বিবর্ণ দেখাচ্ছে।আচমকাই দুই চোখের কোটরে মুক্তদানার মতো চিক চিক করে পানি জমে উঠল।রূপসা শেষ একবার অনুনয় করল,’প্লিজ।আমি আপনার কোনো ক্ষতি করিনি।’

‘ক্ষতি করলে কি কেউ কাউকে বিয়ে করতে চায়?আমি জানি তুমি আমার ক্ষতি করো নি।’

রূপসা এলোমেলো হয়ে খাটের এক প্রান্তে গিয়ে বসলো।শরীর টা কেমন ভর ছেড়ে দিচ্ছে বারবার।কন্ঠ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে বার বার।

কাজি সাহেব কে পুনরায় ঘরে আনা হলো।তিনি সমস্ত নিয়ম মেনে বিয়ে পড়ালেন।কবুল বলতে গিয়েই রূপসার কন্ঠ রোধ হয়ে এলো।শোহরাব তার কাঁধে একটা হাত রেখে কাঠিন্য ভরা মুখে বলল,’কবুল বলো রূপসা।আর তামাশা করো না।’

রূপসার ভেতর তখন অনুভূতি সব ভোঁতা হয়ে গেছে।সে জানে না কি হচ্ছে,কেন হচ্ছে।সে কিছুই জানে না।তার মনে হলো সে একটা পুতুল।শোহরাবের কেনা পুতুল।শোহরাব চাবি ঘোরাচ্ছে।আর সে ঠিক ঠিক তার কথাই শুনছে।

একটা তপ্তশ্বাস ছেড়ে চাবি ঘোরানো পুতুলের মতো করেই সে বলল,’কবুল।’

‘আবার বলুন মা।’

রূপসা ঠোঁট ভেঙে বাচ্চাদের মতো বলল,’ক-ক বু ল।’

‘আরো একবার।’

রূপসার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ।সে খাটের চাদরটা খাঁমচে ধরে হাউমাউ করে উঠে বলল,’কবুল।’

চলবে-