গল্প #জুলিয়েট
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
১২.
শোহরাবের ঘুম ভেঙেছিল বেলা আটটা নাগাদ।এতো আগে তার ঘুম ভাঙে না।আজ ভেঙেছে।কারণ আজ তার ঘরে আরো একটি মেয়ে আছে।যাকে বলা যায় ক্ষেপা বাঘিনী।উহু।একটু সংশোধন প্রয়োজন।ক্ষেপা এবং ঘায়েল বাঘিনী।সে শোহরাব কে দেখা মাত্রই বিকট স্বরে গর্জন করে উঠে।
শোহরাব ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে।পুরোপুরি চোখ খুলতেই সে খানিকটা তাজ্জব হলো।রূপসা দুই হাত হাঁটুর উপর রেখে বসে আছে।তার দৃষ্টি শান্ত,সামনে কোথাও একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে।শোহরাব চোখ খোলার পর একবারও তার পলক পড়ে নি।
শোহরাব দ্রুত উঠে বসলো।চোখ ডলতে ডলতে মনোযোগ সহকারে তার দিকে তাকালো।রূপসার দৃষ্টি তখনও স্থির।শোহরাব উঠলো,নাকি বসলো,এই নিয়ে তার মাঝে কোনো হেলদোল নেই।তার চোখ একদম খটখটে শুকনো,কিন্তু টকটকে লাল।আশ্চর্য! কাঁদতে কাঁদতে পানি ফুরিয়ে এলো নাকি?শোহরাব ভয়ে ভয়ে ডাকে,’মিস রূপসা! আর ইউ ওকে?’
জবাব এলো না।শোহরাব কন্ঠস্বর আরো নমনীয় করে ডাকলো,’রূপসা?শুনতে পাচ্ছো?আচ্ছা আমি সরি।কাল তোমায় তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাবো প্রমিজ।জাস্ট বাসার পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হতে দাও।’
মেয়েটা এখনো নির্বিকার।পলক ফেলল না,সামান্য একটু নড়ে নিজের জীব স্বত্তার জানান দিলো না।শোহরাবের তাকে স্রেফ কাঁচামাটির পুতুলই মনে হলো।সে আস্তে করে তার ডান হাত ধরে ডাকে,’রূপসা! আমি….’
এক ঝাড়ায় হাত সরিয়ে নিলো রূপসা।মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল,’হাত ধরবি না।সর।’
শোহরাব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।যাক।সব ঠিকই আছে।তার কেমন হাসি পেল।এই প্রথম এমন ধমক খেয়েও তার ভালো লাগছে।সে চাপা হাসি গোপন করে মুখ তুলে রূপসার দিকে তাকালো।তার পরনে কালকের সেই পোশাক।চোখ মুখের অবস্থা করুণ।কিন্তু তা স্বত্তেও এক জোড়া চমৎকার চোখ শোহরাব কে টানলো ভীষণ।শোহরাবের অনুমান সানজানার চোখ এর চেয়ে বেশ ছোট।রূপসার চোখ সুন্দর।হ্যাহ্।এইটুক প্রশংসা তার প্রাপ্য।খেলার ছলেই হোক,বউ কিন্তু শোহরাব ভালোই পেয়েছে।
এক,দুই,তিন।।।আচমকা সপাটে দরজায় কড়াঘাত পড়লো।শোহরাব কেমন ধড়ফড়িয়ে উঠল।সেই বুক ধড়ফড়ানি আরো বাড়লো,যখন দরজার অন্য পাশের মানুষটা ক্ষেপাটে সুরে চেঁচিয়ে উঠল,’শোহরাব!শোহরাব।দরজা খোলো।’
শোহরাব আশ্চর্য হয়ে দরজার দিকে তাকায়।বাবা এসেছে।এত্ত আগে! মা বলেছিল সন্ধ্যার দিকে আসবে।এখন এলো কেন?ডাক শুনে তো সুবিধার লাগছে না।কিছু জেনে গেল নাকি?
সে পাশ ফিরে রূপসার দিকে তাকালো।রূপসা তখন যন্ত্রের মতো বসা।মুখে বুলি নেই।রাগ,দুঃখ,হতাশা কিচ্ছু নেই।একদম অনুভূতি শূন্য মুখ।শোহরাবের কি সামান্য মায়া হলো তার জন্য?ঐ যে বুকের ভেতর টা কেমন যেন করে উঠল তার।মেয়েটা রাগছে না,কিছু বলছে না।কেমন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।এটা তো তার আচরণের সাথে যায় না।
দরজার আরেকবার ধাক্কা দিতেই শোহরাব গম্ভীর স্বরে বলল,’কে?’
‘দরজা খোলো।’
শোহরাব গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।চোয়াল শক্ত,চোখ দু’টো শান্ত।তারপর একেবারে নির্বিকার হয়ে সামনে হেঁটে গেল।লক ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই মারুফ সাহেবের সাথে তার চোখাচোখি হলো।মারুফ সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন,’আরু এসব কি বলে তোমার নামে?’
শোহরাব ঠোঁট বাঁকা করে শুধায়,
‘কি বলে?’
‘তুমি নাকি বিয়ে করেছো?’
‘হু।’
একদম গা ছাড়া জবাব।যেন বিয়ে কোনো নিত্যদিনের কাজ।মারুফ সাহেব ধমকের সুরে বললেন,’মানে কি?বিয়ে কোনো ছেলে খেলা?’
‘নাহ্।’
মারুফ সাহেবের চোখে মুখে উপচে পড়া ক্রোধ।দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,’তাহলে কোন সাহসে এই কাজ করেছো?’
শোহরাব হালকা হাসলো।ঘাড়ের পেছনে হাত নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,’যেই সাহসে তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করেছো,ঐ সাহসেই আমি এই কাজ করেছি।তোমার পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করতে আমি বাধ্য নই।’
জোহরা ততক্ষণে দোতালার খোলা করিডোরে এসে দাঁড়িয়েছেন।বাবা আর ছেলের কথপোকথন শুনতেই তিনি একহাত বুকে চাপলেন।প্রচন্ড উৎকন্ঠায় তার গলা বসে আসছিলো।
মারুফ সাহেব ক্ষুদ্ধ চোখে ছেলের দিকে কয়েক পলক তাকালেন।প্রচন্ড রাগে তার হাত কাঁপছিল।অনেক সময় রাগে মানুষের কথা গুলিয়ে যায়।মারুফ সাহেবের কথা গুলিয়ে যাচ্ছিলো।কোনো কসরত ছাড়াই তিনি ঘামছিলেন,প্রচন্ড রকম হাপাচ্ছিলেন।
‘স্ক্রাউন্ড্রেল কোথাকার! তোমার বিয়ে আমি ঠিক করে রেখেছি।তুমি কোন সাহসে অন্য কাউকে বিয়ে করো?’
শোহরাব বুকে হাত বঁধে দাঁড়ালো।ভাবলেশহীন হয়ে বলল,’আমি কি করেছি বাবা?আমি আমার মন মতো কাউকে বিয়ে করতে পারবো না?তুমি কি জোর করে বিয়েটা পর্যন্ত চাপিয়ে দিবে?’
মারুফ সাহেব থতমত খেলেন।বাড়িতে আর কেউ তার সাথে এমন করে কথা বলে না।একমাত্র শোহরাব ছাড়া।সে নিঃসংকোচে অপরাধ করে,তারপর বুক চিতিয়ে কথা বলে।
মারুফ সাহেব গজরাতে গজরাতে বললেন,’তোমার যা রুচি! সেজন্যই চাপিয়ে দেওয়া লাগে।কাকে বিয়ে করেছো তুমি শুনি?’
শোহরাব ব্যাঙ্গাত্মক হাসলো।তাচ্ছিল্য করে কেবল বলল,’তোমার ঐ পাত্রীর চেয়ে ঢের গুণ ভালো মেয়ে বিয়ে করেছি।’
সে কথা শেষ হতেই পুনরায় তাড়াহুড়ো করে বলল,’চিন্তা নাই।তোমার সাথে দেখা করাবো।ঘরে যাও।সে একটু পর তোমার জন্য চা নিয়ে আসবে।’
তানিয়া চোয়াল ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তৌকি আর সানজানা ততক্ষণে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।তৌকি ভয়ে ভয়ে বলল,’ও ভাবি! জল কতোদূর?’
তানিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে কেবল উপর নিচ মাথা নাড়লো।মারুফ সাহেব তর্জনী তুলে হুংকার দিলেন,’তুমি আজ থেকে আমার ছেলে না।’
‘থ্যাংক ইউ।মাই প্লেজায়।’
শোহরাব কোনো বিকার দেখালো না।দুঃখ,কষ্ট,অনুতাপ কোনোটাই তার চোখে মুখে ফুটলো না।তাকে দেখে মনে হলো,মারুফ সাহেব এখান থেকে গেলেই তার শান্তি।
কতোক্ষণ পাথরের মতো অবিচল দাঁড়িয়ে থেকে শেষে মারুফ সাহেব হনহনিয়ে তার ঘরে চলে গেলেন।যেতে যেতে শূন্যে বুলি ছুড়লেন,’ছেলেমেয়ে সব লায়েক হয়ে গেছে।এতো এতো সুপাত্রী ফেলে সে কিনা ঐ হোম টিউটর কে বিয়ে করেছে।বাহ্! আমার ছেলের রুচি!’
শোহরাব উত্তর দিলো না।চোয়াল শক্ত করে কেবল তার জন্মদাতার প্রস্থান দেখলো।সে তার ঘরে যেতেই শোহরাব স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।তারপর আস্তে করে ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে রূপসার দিকে তাকালো।রূপসা বাবার কথা শুনেনি বলেই তার ধারণা।
মারুফ সাহেব চলে যেতেই জোহরা চঞ্চল পায়ে শোহরাবের দিকে এগিয়ে এলেন।তার মুখে উৎকন্ঠা,কন্ঠে আতঙ্ক।দিশাহীন হয়ে বললেন,’শোহু!তোর বাবা তো খুবে রেগে আছেন।কি করবি?আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।’
শোহরাব হাসলো।
‘ঐ লোক তো রোজই রেগে থাকে।এটা আবার নুতন কি?’
তৌকি এগিয়ে এসে বলল,’তুমি যে বললে,আরিবার মিস বাবাকে চা দিবে এটা কি সত্যি?’
শোহরাব চোখ বাঁকা করল।প্রচন্ড অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল,’আরিবার মিস আবার কি?তোর ভাবি হয় না?বল ভাবি।’
তৌকির মুখ চুপসে গেল।মুখ নামিয়ে বিড়বিড় করলো,’ঐ আরকি।ভাবি।তো ভাবি কি তার শ্বশুর কে চা বানিয়ে খাওয়াবে?’
শোহরাব আরেকবার ঘরের ভেতরে দেখলো।তারপর তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,’জানি না।’
____
রূপসা মাথা নামিয়ে খাটের এক কোণায় বসেছিল।শোহরাব ঘরে আসতেই সে তাড়াহুড়ো করে বলল,’আমি বাড়ি যাবো।’
‘আজ না।কাল পরশু যেও।’
‘আমার বাবা চিন্তা করছে আমাকে নিয়ে।’
‘তোমার বাবাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’
রূপসা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।বিক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,’আমার বাবাকে আমিই জানাতে পারবো।মোবাইল দে আমায়।’
শোহরাব জবাব দিলো না।নির্বিকার হয়ে হেঁটে খাটের এক মাথায় গিয়ে বসলো।হাই তুলতে তুলতে বলল,’শান্ত হও।কুল ডাউন।বাড়ির পরিস্থিতি এমনিতেই গরম।তুমি আর চেঁচামেচি করে আগুনে ঘি দিও না।’
রূপসা সরোষ চাহনিতে তার দিকে তাকায়।মুখ জুড়ে তার রাগের আভাস।শক্ত চোয়াল,দেখে মনে হলো পারলে এক্ষুনি শোহরাবকে গিলে খাবে।শোহরাব বলল,’রান্না পারো তুমি?’
রূপসা কপাল কুঁচকে অন্যদিকে ফিরল।বিড়বিড় করে কি যেন বলল।শোহরাব পায়ের উপর পা তুলে বলল,’রান্না না আসলে।চা বানাতে পারো মিস?’
রূপসা ঠোঁট বাঁকা করলো।
‘পারলে?’
তার চাহনি দেখেই শোহরাবের হাসি পেল।মশকরা করে বলল,’তোমার শ্বশুর আব্বাকে এক কাপ চা করে খাওয়াবে বুঝলে?তুমি না বাড়ির নতুন বউ?’
শোহরাব কথা শেষ করেই আড়চোখে পাশে তাকায়।তার ধারণা,তার ঘরনী তার কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে।হলোও তাই।আচমকাই রূপসা খ্যাক করে উঠল।তেড়ে এসে বলল,’এই বিয়ে আমি মানি না।মা বাপের অনুমতি ছাড়া কোনো বিয়ে হয় না।তুই একটা ক্রিমিনাল,সাইকো।এটাকে বিয়ে বলে না।’
‘ঐ আরকি।তোমার না বলাতে কিছু যায় আসে না।কাগজে কলমে এটাই বিয়ে।তুমি সাইন করো নি কাগজে?’
রূপসা নির্বিকার হয়ে খাটের এক কোণায় বসে।মাথাটা ভার ভার লাগছে।কাল সারাদিনে সে যে পরিমান চিৎকার করেছে,পুরো জীবনেও অতো চিৎকার তরে নি।শোহরাব কপাল কুঁচকে বলল,’তোমার কি খারাপ লাগছে?’
‘আমার খারাপ তোকে ভাবতে হবে না।’
‘আচ্ছা।’
‘তুমি কি বাবার ঘরে চা নিয়ে যাবে?’
রূপসা চোখ কটমট করে বলল,’না।’
‘আচ্ছা।ঠিক আছে।’
শোহরাব উঠে গেল ঘর থেকে।আরিবা তখন কালার পেনসিল দিয়ে কি যেন রং করছিলো খাতায়।শোহরাব তার কাছে গেল।তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে বলল,’আরু।শোহুর একটা কাজ করে দিবে?’
আরিবা চোখ তুলল।শোহরাব স্মিত হেসে বলল,’মিস কে গিয়ে একটা ব্রেড খাইয়ে দিবে কেমন?’
আরিবা বলল,’মিস তো রেগে আছে শোহু।’
‘তোমার সাথে তার কোনো রাগ নেই আরু।’
‘কাল যে আমি তার কাছে গেলাম।সে তো আমাকেও ধাক্কা দিলো শোহু।’
‘কাল বেশি রেগে ছিল।আজ রাগ একটু কম।আজ কিছু করবে না।তুমি যাও।শোহু তোমাকে চকোলেট দিবো।’
আরিবা ভয়ে ভয়ে খাট থেকে নামলো।পরক্ষণেই আবার শোহরাবের দিকে ছুটে গিয়ে তার হাত ধরে বলল,’তুমিও আমার সাথে যাবে কিন্তু শোহু।’
‘এহহহ।আমি যাবো না।আমাকে দেখলেই সে সাপ হয়ে যাবে।তুমি যাও আরু।তোমাকে খুব পছন্দ করে সে।’
আরিবা পিটপিট চোখে তার কথা শুনে।শোহরাব তার গালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,’এদিকে থাকো।শোহু ব্রেডে স্প্রেড মাখিয়ে আনছি।’
_____
‘মিস!’
রূপসা ঘাড় ঘুরায়।আরিবা এসেছে।হাতে একটা প্লেট।রাগ করতে গিয়েও করতে পারলো না।আদ্যোপান্ত বাচ্চাটাকে দেখে ঠান্ডা স্বরে বলল,’এসো আরিবা।’
আরিবা ভেতরে এলো।চোখে মুখে তার তখনও ভীতি।রূপসা বুঝলো বোধহয়।বুঝতেই অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলো।
আরিবা কাছাকাছি এসে ডাকলো,’মিস! তুমি আমার সাথে রেগে আছো?’
‘নাহ্।’
‘তোমার জন্য ব্রেড।’
রূপসা তাকালো।তারপর ছোট করে বলল,’লাগবে না।খাবো না।’
আরিবার চোখ ছলছল করে উঠে।কাঁদো কাঁদো হয়ে অনুরোধ করে,’প্লিজ মিস।একটু খাও।’
এমন মায়া করে কথা বললে কেউ কাউকে ফেরাতে পারে?রূপসা তো পারে না।সে আরিবার মুখের দিকে তাকালো।তারপর দু’টো ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে ব্রেড টা হাতে নিল।আরিবা হাসি মুখে বলল,’থ্যাংকু মিস।’
সে বসলো মিসের গা ঘেঁষে।মিস জানতে চাইলেন,’তুমি খেয়েছো আরিবা?’
‘হ্যাঁ।অনেক আগে।’
‘আচ্ছা মিসের সাথে আরো একটু খাও।’
রূপসা স্প্রেড লাগানো পাউরুটিটা আরিবার দিকে বাড়িয়ে দিলো।আরিবা বোধ হয় দুই বারের মতো খেল।রূপসার খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না।তবুও বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে রূপসা খাবারটা শেষ করলো।
শোহরাব ছিলো ঘরের বাইরে।উঁকি দিয়ে একবার ভেতরের দৃশ্য দেখেই ঘুরে দাঁড়ালো।যাক,মেয়েটা কিছু অন্তত খেয়েছে।শোহরাব ঘরে গিয়ে তার মন খারাপ করতে চায় না।তার ধারণা,মেয়েটা তাকে ভয়ংকর রকমের ঘৃণা করে।আগন্তুকের কাছেও সেই ঘৃণা বরদাস্ত করা যায় না।সেখানে স্বীয় স্ত্রীর চোখে নিজের জন্য এই আকাশ পরিমান বিতৃষ্ণা দেখা কোনো আনন্দের বিষয় না।শোহরাবের অন্তত আনন্দ অনুভব হয় না।
.
.
.
.
মারুফ সাহেব ঘরের ইজিচেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসে ছিলেন।ইজিচেয়ারটা ছন্দোময় গলিতে অল্প অল্প দুলছিলো।মারুফ সাহেবের চোখ দু’টো তখন বন্ধ।ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়েছে এগারোর ঘর।
আজ সারাদিন তিনি ঘর থেকে বের হন নি।মাথার রগ দু’টো দপ দপ করে লাফাচ্ছিল। শরীরটাও একটু খারাপ খারাপ লাগছে।তার বড় ছেলে আর ছোট ছেলেকে মানুষ করতে তার বেগ পেতে হয় নি।এরা বাবার কথায় চলেছে,বাবার শিক্ষায় মানুষ হয়েছে।বিপাকে পড়েছেন তিনি মেঝো জন কে মানুষ করতে গিয়ে।সে হয়েছে বাড়াবাড়ি রকমের ত্যাড়া।
মারুফ যদি তাকে ডানে যেতে বলেন,তবে সে ইচ্ছে করে বামে যাবে।মারুফ যদি বলেন,লাল রং সুন্দর।তাহলে সে ইচ্ছে করে মারুফের বিরোধিতা করে বলবে,লাল রং একদমই সুন্দর না।ছোট বয়স থেকে সে এভাবেই যন্ত্রনা দিয়ে আসছে।তার সব সন্তান এক কথায় তার হুকুম মেনে নিয়েছে।কিন্তু গো ধরেছে শোহরাব।সবকিছুতে তার ত্যাড়ামো বাধ্যতামূলক।
এই বিয়েটা করে সে তার ত্যাড়ামোর প্রমাণ দিয়েছে আরো একবার।
শোহরাব ঘরে এলো।ঘাড়ের কাছে তুলে রাখা কলারটা নামাতে নামাতে হাস্কি গলায় বলল,’ডেকেছো কেন?তাড়াতাড়ি বলো।’
মারুফ সাহেব চোখ খুললেন।শোহরাবের দিকে তাকালেন না।সিলিং দেখতে দেখতে বললেন,’বসো।’
শোহরাব বসলো।ড্রেসিং টেবিলের সামনে যে বসার টুল ছিলো,সেটা টেনে এনে তার উপর বসলো।
মারুফ সাহেব বললেন,’তোমার রুচি কতো জঘন্য তুমি জানো?’
‘তোমার চেয়ে যথেষ্ট ভালো।’
মারুফ সাহেব রাগ দেখালেন না।উল্টো কিঞ্চিৎ হেসে বললেন,’তোমার মা কিন্তু আমার স্ত্রী।’
‘সেটা তোমার পছন্দে না।দাদির পছন্দে বিয়ে হয়েছে তোমাদের।’
সূক্ষ্ম খোঁচা,জেনেবুঝেই অপমান করেছে।মারুফ সাহেব সেই অপমান গায়ে মাখলেন।উল্টো ঠেস দিয়ে বললেন,’সেই তো।আমার মায়ের কপাল ভালো।সন্তানের জন্য নিজে দেখেশুনে বউ পছন্দ করেছে।সবাই তো আর সেই ভাগ্য পায় না।’
শোহরাব থম মেরে বসে থাকলো।মাথায় রাগ চাপছে তার।সময়ে সময়ে তির তির করে রাগটা বেড়ে গেল।চাপা কন্ঠে বলল,’আমি আমার কাজের জন্য লজ্জিত নই।’
‘সেটা তোমার কাছে আমি আশাও করি না।কিন্তু তোমার চিন্তাভাবনায় আমি লজ্জিত।তুমি কি আর মেয়ে পাও নি?আরিবার টিচারকেই বিয়ে করতে হলো তোমার?’
শোহরাব কপাল কুঁচকে মাথা তুলল।
‘কেন?রূপসার ভেতর সমস্যা কি? তোমার আনা সেই স্পয়েলড কিড থেকে রূপসা যথেষ্ট ভালো।এটলিস্ট রূপসা বাপের টাকায় ফুটানি করে না।আর না হাঁটু সমান কাপড় পরে ঘুরে।’
মারুফ সাহেব এবার শব্দ করে হাসলেন।সরাসরি শোহরাবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,’পুরো মিডেল ক্লাস একটা মেয়েকে বিয়ে করেছো তুমি।ঐ মেয়ের কোনো যোগ্যতা আছে আমার পুত্রবধূ হওয়ার?’
শোহরাবের বিক্ষিপ্ত মেজাজটা চূড়ান্ত মাত্রায় বিগড়ে গেল।সহসা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’তোমার কি যোগ্যতা আছে,তার শ্বশুড় হওয়ার?তোমার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পরিশ্রম তো রূপসাই করে।আর তুমি কে হ্যাঁ?যে তোমার ছেলের বউ হতে যোগ্যতা লাগবে?’
‘শোহরাব!’
‘ধমক দিয়ে লাভ নেই।’
‘তুমি এমন হাইপার হচ্ছো কেন?’
শোহরাব তাজ্জব হলো।
‘হাইপার হবো না বলছো?আমি একজন কে বিয়ে করেছি।তুমি বলছো তার কোনো যোগ্যতা নেই।এসব কেমন কথা?বউ হয় সে আমার।’
‘এভাবে কোনো বিয়ে হয় না শোহরাব।একটা ক্ষতিপূরণ দিয়ে মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও।’
শোহরাবের চোখ মুখ ক্রমশ শক্ত হয়ে এলো।দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জ্বল জ্বল চোখে বলল,’মরে গেলেও এই কাজ করবো না।রূপসার সাথে বিয়ে হয়েছে আমার।আমি বেঁচে থাকতে তাকে ছাড়ছি না।এবার তোমাদের যা করার করো।’
যেমন শান্ত পায়ে সে ঘরে এসেছিলো,তার চেয়েও বেশি অশান্ত হয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।মারুফ সাহেব তার প্রস্থান দেখলেন।আশ্চর্যও হলেন ভীষণ।প্রথমত এই বিয়েটা স্বাভাবিক ছিলো না।দ্বিতীয়,তার কাছে খবর এসেছিল,শোহরাবও মেয়েটাকে সেরকম ভালোবাসে না।তাহলে সে এমন অদ্ভুত আচরণ করলো কেন?মেয়েটাকে নিয়ে সামান্য কটু কথায় এমন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল কেন?আজব ব্যাপার!
চলবে-