জুলিয়েট পর্ব-১৬

0
36

গল্প #জুলিয়েট
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

১৬.

শাহাবুদ্দিন কিছুটা বিচলিত হলেন।রূপসা খুব নির্বিকার ছিলো।কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলো না।তার চোখে শাহাবুদ্দীন বেদনার প্রতিফলন আশা করেছিলেন।ভেবেছিলেন,রূপসা হয়তো কাঁদবে।ভেঙে পড়বে।অথচ রূপসা তেমন কিছুই করে নি।শক্ত পোক্ত,অনুভূতির লাগাম টানা লৌহ মানবীর মতো রূপসা পিঠ শক্ত করে বসে রইল।

তবে তার কন্ঠনালি কাঁপছিলো।শাহাবুদ্দীন স্পষ্ট সেই কম্পন দেখতে পেলেন।তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল।বলতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলো না সে।শাহাবুদ্দীন জানতে চাইলেন,’সে কি তোমায় সত্যি সত্যি মুক্তি দিয়েছিল রূপসা?’

রূপসার দৃষ্টি ভীষণ উদাসীন।সে দেয়ালে ঝুলানো একটা ফ্রেম দীর্ঘসময় যাবত দেখে যাচ্ছিলো।শাহাবুদ্দীন আহমেদ পুনরায় গলা খাকারি দিতেই সম্বিত ফিরে পেল।কেঁপে উঠে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,’জ্বী?’

‘তারপর কি হয়েছিল রূপসা?শোহরাব কি তোমায় মুক্তি দিয়েছিলো?’

রূপসার মুখে তৎক্ষনাৎ কোনো স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠেনি।বরং তাকে কেমন যেনো গা ছাড়া মনে হলো।উন্মনা,এলোমেলো দৃষ্টি।কোথাও যেন কোনো প্রত্যাশা কিংবা চাঞ্চল্য অবশিষ্ট নেই।চোখের নিচে কালি জমেছে।মুখটা বরাবরের মতোই রক্ত শূন্য।অথচ তাকে এমনটা মানায় না।এতো কম বয়সী একটি মেয়ের এমন ছন্নছাড়া পাগলপ্রায় রূপ মানায় না।

শাহাবুদ্দীন নিজ থেকে কিছু বললেন না।এই ধরনের পেশেন্ট দের সময় দিতে হয়।তারা নিজ থেকেই সবটা বলে।বলার আগে সবটা মনে করতে হয়।সমস্যা ঐটাই যে তাদের কিছু মনে থাকে না।তারা একটু পর পর ভুলে যায়।

রূপসা অবশ্য পুরোপুরি ভুলে নি।তার আবছা আবছা কিছু স্মৃতি মনে পড়লো।সে ডেস্কে মাথা ফেলে নিষ্প্রভ কন্ঠে বলল,’মুক্তি বলতে আপনি কি বোঝেন?’

শাহাবুদ্দীন ভড়কে গেলেন।আমতা আমতা করে বললেন,’মুক্তি মানে মুক্তি।একজন কে দায়মুক্ত করা।অসুস্থ সম্পর্ক থেকে পরিত্রান দেওয়া।অদৃশ্য শেকল খুলে একজন কে সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা দেওয়া।’

রূপসা বলল,’আমার কাছে সেটা মুক্তি না।আমার জন্য মুক্তি মানে হৃদয় থেকে কাউকে অব্যাহতি দেওয়া।সেখানে শরীর,কিংবা শারিরিক এপিয়ারেন্স মুখ্য না।বরং মন থেকে কাউকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টিই বেশি প্রয়োজন।যে মানুষ আমাদের মন আর মস্তিষ্ক দখল করে ক্রমাগত হাতুড়ি পেটা করে,তার থেকে কি আমরা কখনো মুক্তি পাই?’

শাহাবুদ্দীনের মুখ বেশ গম্ভীর।কিছু বললেন না।কেবল ধৈর্যশীল শ্রোতার মতো শুনলেন।তার হাত দু’টো ডেস্কের উপর আড়াআড়ি করে রাখা।রূপসা সামান্য হাসল।

‘শোহরাব আমায় মুক্তি দেয়নি।অব্যাহতি অবশ্য দিতে চেয়েছিল।তবে কাজ হয় নি।’
.
.
.
.
অর্কদের বাড়িটা আজ ভয়াবহ নিস্তব্ধ।বাইরে থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো না।রূপম কিছুটা বিব্রত বোধ করলো।কড়া নাড়বে নাকি বুঝে এলো না।তারপর অবশ্য তার কিছু করতে হয় নি।অর্ক’র মা ই দরজা খুলেছিলেন।

রূপম কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে ঘরে এলো।অর্ক তখন জানালা ঘেঁষে দাঁড়ানো।রূপমকে দেখামাত্র জোরপূর্বক হাসলো।রূপম বলল,’কি হয়েছে তোর?’

‘কই?কিছু না তো।’

‘তুই নাকি আর পড়াশোনা করবি না?’

অর্ক স্পষ্ট করে বলল,’হুম।’

‘কেন?’

‘ইচ্ছে নাই।’

‘অদ্ভুত কথা!’

অর্ক জানালা থেকে একটু সরে দাঁড়ালো।খুবই নির্লিপ্ত তার চাহনি।দেখে ভীষণ নির্ভার,দায়মুক্ত মনে হচ্ছে।
সে কিঞ্চিৎ হেসে বলল,’পড়াশোনা আসলে লস প্রজেক্ট।ইটের ভাটায় কাজ করা এর চেয়ে ঢের ভালো।’

‘অর্ক! পাগল তুই?’

‘নাহ্।’

রূপম এগিয়ে এলো।কঠিন গলায় বলল,’কি হলো তোর?বল আমাকে।’

‘কিছুই হয় নি রূপম।’

‘তাহলে এমন করছিস কেন?’

‘কেমন করছি?’

রূপমের ধৈর্যচ্যুতি হলো।বেশ ধমকের সুরে বলল,’পড়াশোনা ছাড়বি মানে?ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে হলে এতো দিন পড়লি কেন?’

‘এতোদিন লাভ লোকশানের কথা মাথায় আসেনি।এখন আসছে।’

‘অর্ক!’

‘কি খাবি বল?’

অর্ক ভীষণ গা ছাড়া।যেন এই প্রসঙ্গে কোনো কিছুই সে শুনতে চায় না।কন্ঠে স্থিতি এনে বলল,’তুই বস।আমি কিছু একটা নিয়ে আসি।’

রূপম তখনো তাজ্জব হয়ে দাঁড়ানো।অর্ক হুট করেই জানালো সে আর পড়াশোনা চালিয়ে যাবে না।অথচ পড়াশোনার প্রতি তার কি তীব্র অনুরাগ ছিলো! রূপম তার সবটা জানে,বোঝে।তবুও এতো নির্লিপ্ততার অর্থ কি?

অর্ক বেরিয়ে গেল কিছু একটা কিনে আসার উদ্দেশ্য।অথচ রূপম প্রশ্নাত্মক চোখে তখনও দাঁড়িয়েছিল।এতো পরিশ্রম,এতো কষ্টের শেষে কি না মিল কারখানায় কাজ করবে! এটা কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কাজ হতে পারে?

শতাব্দী দরজায় এসে দাঁড়ালো।ম্লান সুরে বলল,’আসি?’

রূপম তাকায়।শতাব্দীর মুখও স্বাভাবিক না।কেমন যে তীব্র বিষাদের ছাপ।অভিমানী দৃষ্টি।শতাব্দী কি কোনো কিছু নিয়ে অভিমান করেছে?কিসের এতো অভিমান?সে তো মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকার মেয়ে না।রূপম তাকে চিরকালই প্রাণোচ্ছল আর দুরন্ত হিসেবে দেখে এসেছে।অথচ আজ আর তার চোখ দু’টোতে আনন্দ ছলকে উঠছে না।রূপম পুরু স্বরে বলল,’কি হয়েছে শতাব্দী?সব ঠিক আছে?’

‘নাহ।কিচ্ছু ঠিক নেই।’

শতাব্দী কয়েক কদম এগিয়ে এলো।চোখে যন্ত্রনার ছাপ।বাইরে থেকে পাখির কিচির মিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে।বাড়ির ভেতরটা নিরব।শতাব্দী বলল,’বাবা বলেছে,ভাইয়াকে আর পড়তে দিবে না।’

‘কেন?’

‘কারণ পড়াশোনা করে কোনো আয় হয় না।’

রূপম বিস্মিত হলো।চোখ বড় বড় করে বলল,’আয়ের তো এখনো বয়সই হয়নি।’

‘সে কথা তো আর বাবা বোঝে না।বাবার একটাই কথা।এতো বড়ো ছেলে।অথচ এখনও আয় রোজগার করছে না।এই নিয়ে খুব তর্কাতর্কি হলো দু’জনের।শেষে ভাইয়া পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

শতাব্দী খুবই নির্বিকার।বলতে গিয়ে তেমন দ্বিধায় পড়েনি।পারিবারিক বিষয়টি খুব অবলীলায় বলে দিলো।অর্ক এদিকে ভিন্ন।সে সহজেই বাড়ির বিষয়গুলো খোলাসা করে না।

রূপম ধীর কন্ঠে বলল,’দেখি! কি করা যায়।’

অর্ক’র সাথে যখন তার দেখা হলো,তখন সে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,’দেখ অর্ক।ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিস।রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নিলে সেই সিদ্ধান্তে ভুলই বেশি থাকে।চূড়ান্ত ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবটা একটু বিবেচনা করে দেখ।’

অর্ক কিছু বলেনি।বরাবরের মতোই সৌজন্যসূচক হাসলো।পারিবারিক এবং একান্ত বিষয় গুলো গোপন রাখা উচিত।সেটা মানুষ কে জানিয়ে মানুষের সিম্পেথি নেওয়া খুবই ব্যক্তিত্বহীন একটি কাজ।

রূপম সেদিন চলে যাওয়ার পরেও অর্ক ভাবলো।অনেকটা সময় নিয়ে ভাবলো।একটা কথা বারবার মাথায় আসছে।সে তো চাইলে দু’টোই সামলাতে পারে।সকালে কলেজ,দুপুর থেকে বিকেল কারখানার কাজ,আর রাতে বাড়িতে বসে পড়াশোনা।এমন করেও তো একটা রুটিন বানানো যায়।

অর্ক উদ্যোমী হলো সহসা।তার মনে হলো সে পারবে।চাইলেই সে দু’টো সামলে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে।হাল ছেড়ে দেওয়া তো কোনো সমাধান না।বাবার প্রয়োজন অর্থ।অর্ক যে করেই হোক,সেই অর্থের জোগান দিবে।

অজানা অচেনা পাখিরা সুর মিলিয়ে ডেকে যাচ্ছিল দূর থেকে।অর্ক চট করে একটা রুটিন করতে বসলো।তার মনে হলো,হেমন্ত তার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে।
.
.
.
.
রূপম আজকাল বুঝদার হয়েছে ভীষণ।সহজেই আর কোনোকিছুতে প্রতিক্রিয়া দেখায় না সে।জেসমিনের সাথেও তার সম্পর্ক স্থবির হয়েছে।সে তাকে খুঁচিয়ে কোনো কথা বলে না।উল্টো মনের অজান্তেই একটা সহানুভূতি আর সহনশীলতার প্রাচীর গড়ে উঠেছে তাদের মাঝে।রূপম তাকে মেনে নিয়েছে,সচেতন এবং অবচেতন,উভয় মনে।

আজকাল এই বাড়িটা বড়ো ফাঁকা লাগে।কেমন যেন কর্তৃত্বহীন মনে হয় বাড়িটা।তিনজন মানুষ যার যার মতো করে বাড়িতে থাকে।মাঝে কোনো মেলবন্ধন নেই।সুর,তাল,লয় কিছুই নেই।আছে কেবল দীর্ঘশ্বাস।অপ্রাপ্তি,হতাশা,তীক্ষ্ম একটা যন্ত্রনা।

রূপম বাড়ি ফিরেই আবিষ্কার করলো,বসার ঘরে কেউ একজন বসে আছে।সে খুব বেশি অবাক হলো না।সে জানে কে এসেছে।শোহরাব।দিদিয়ার তথাকথিত বর।

রূপম যে কথায় কথায় প্রতিক্রিয়া দেখানো ছেড়ে দিয়েছে,তার একটা বড়ো উদাহরণ সে শোহরাব কে কখনই কিছু বলেনি।চাইলেই মুখের উপর কতো কথা বলা যেত।রূপম বলেনি।বলতে ইচ্ছে হয়নি।বড্ড নিরাসক্ত লাগে আজকাল! কোনোকিছুই এখন আর আবেদন জাগাতে পারে না।শোহরাবকে দেখেও সে ভাবুক হলো না,বিচলিত হলো না।উল্টো দুইবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

ছেলেটা একটু অদ্ভুত।রূপমের তাকে অদ্ভুতই মনে হয়।সে বাড়ি আসে মাঝে মাঝে।এসে এক কাপ চা খায়।জেসমিনের সাথে কথা বলে।কখনো আবার রূপসাকে এক ঝলক দেখার জন্য ছটফট করে।ডিভোর্স সংক্রান্ত কথাবার্তা বলার ছলে রূপসার সাথে তার দীর্ঘ আলাপ হয়।
রূপমের ধারণা,ঐসব ডিভোর্স টিভোর্স হলো ছুঁতো।সে আসলে দিদিয়ার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার জন্যই বাড়িতে আসে।তার চোখে সে তৃষ্ণা দেখে,অসহায়ত্ব দেখে।দিদিয়ার সাথে কথা বলার জন্য সে ভীষণ উদগ্রীব।রূপমের বয়স খুব একটা কম না।সেই চোখের ভাষা রূপম বোঝে।

শোহরাব নামের ছেলেটাকে তার অপছন্দ।একেবারে এক শব্দে অপছন্দ।তার কিছু সিদ্ধান্তের কারণে আজ জীবনটা এমন বাজেভাবে এলোমেলো হয়েছে।রূপম ঘৃণা আর বিতৃষ্ণায় কখনো তার সামনে যায়নি।বাবা যেদিন মারা গেল,সেদিন বোধহয় সামান্য কথা হয়েছিল।এরপর আর কোনোদিন কথা হয়নি।

শোহরাবের কিছু বিষয় রূপম খেয়াল করেছে।খেয়াল করার পর তার মনে হলো সে সত্যিই রূপসাকে পছন্দ করে।তবে পাওয়ার ধরণটা জঘন্য।

সে আজকাল তাদের বাড়ির বাইরে আনাচে কানাচে দাঁড়িয়ে থাকে।রূপসা যখন ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হয়,তখন আড়াল থেকে তাকে দেখে।হয়তো অপরাধবোধ তাকে সামনে যেতে দেয় না।সে দূর থেকেই এক ঝলক দেখে।তারপর মাথা নামিয়ে সরে যায়।রূপসার সাথে কথা বলার জন্য সে অদ্ভুত অদ্ভুত বাহানা বানায়।রূপম বোঝে।তোয়াক্কা করে না।

___

রূপসা বিরক্ত হয়ে বলল,’আবার কি?’

শোহরাব চোরা চোখে তার দিকে তাকালো।তারপর আবার মাথা নামিয়ে বলল,’কিছু না।’

‘তাহলে কেন এসেছেন বাড়িতে?’

শোহরাব ইতস্তত করে বলল,’লয়্যার বলেছেন ডিভোর্সের আগে ছয়মাস অন্তত স্বামী স্ত্রীর একসাথে থেকে সবটা মিটমাটের চেষ্টা করা উচিত।’

‘আমি কোনোকিছু মিটমাট করতে চাই না।’ রূপসার কাটকাট জবাব।
কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল,’এতো সমস্যা শুধু আমাদের ডিভোর্সের বেলায়ই হচ্ছে?দেশে রোজ এতোগুলো ডিভোর্স হয়।এতো সমস্যা তো কারো শুনিনি।’

‘সবাই তো আর জনে জনে গিয়ে সমস্যার কথা বলবে না।’

‘সে যাই হোক।’

‘রূপসা!’

‘কি?’

‘তুমি কি আমার সাথে একটু কথা বলবে?’

রূপসা চোখ তুলল।শোহরাবের কন্ঠের আকুতি সে টের পেয়েছে।বেশ শান্ত হয়ে বলল,’কথাই তো বলছি।’

‘সেভাবে কথা না।ভালো কথা।’

‘ভালো কথা কোনটা?’

‘এই তো।স্বামী স্ত্রীরা যেমন করে বলে।’

‘আমি ঐসব মানি না।আপনি দয়া করে যান।’

শোহরাব তক্ষুনি যায় না।খচখচ করতে করতে বলে,’মিস! একটা কথা বলি?’

‘কি?’

‘আই এম সরি।’

‘আপনার সরি তে আমার বাপ ফিরে আসবে?পাড়া প্রতিবেশীদের লাঞ্ছনা বঞ্চনা থেমে যাবে?জীবনটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে?’

‘তা হবে না।তবে আমার নিজেকে দায়মুক্ত লাগবে।’

‘আপনি দায়মুক্ত।আপনার উপর আর কোনো ক্ষোভ বিদ্বেষ রাখছি না।যা হয়েছে,সব কপালের দোষ বলে মেনে নিয়েছি।’

‘রূপসা!’

‘আবার কি?’

‘প্লিজ একবার আমার পাশে এসে বসো।আমার খারাপ লাগছে কেন জানি।’

রূপসা বিরক্ত হলো।
‘আশ্চর্য মানুষ তো আপনি।শুনুন শোহরাব,শান্ত আর ভালো আচরণ করছি মানে এই না যে সবটা মেনে নিয়েছি।শরীর খুব ক্লান্ত।তাই আর জোর খাটিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না।আপনি দয়া করে যতো দ্রুত সম্ভব আমায় ডিভোর্স দিন।মুক্ত করুন আমায়।’

শোহরাব আচমকা মাথা তুলল।গভীর স্বরে বলল,’তুমি কি ডিভোর্সের পর আবার বিয়ে করবে রূপসা?’

রূপসা তার দিকে তাকালো।তার চোখ দু’টো অবলীলায় কতো কথা বলে দিচ্ছিলো! রূপসা সেই চোখে চাপা যন্ত্রনা দেখলো।শোহরাবের মুখটা সেদিন বড়ো মলিন দেখাচ্ছিল।মনে মনে কতো আকুতি সে করেছে! রূপসা শুনলো নাকি কে জানে?

রূপসা বলল,’বাড়ি যান শোহরাব।যতো দ্রুত সম্ভব ডিভোর্সের কাজটা শেষ করুন।’

‘তুমি তো উত্তর দিলে না।আরেক বিয়ে করবে?’

‘জানি না।অতোদূর ভাবিনি।’

শোহরাব চুপ করে বসে থাকলো।দখিনা হাওয়া তার গা ছুঁয়ে যাচ্ছে।সেই বাতাস শোহরাবের কাছে প্রশান্তির মনে হলো না।মনে হলো সমস্ত শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ছে।গাঢ় নীল রঙের বিষ।শোহরাব হাঁসফাঁস করতে করতে বলল,’আমি আর কখনো কাউকে বিয়ে করতে পারবো না রূপসা।কখনো না।’

রূপসা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে।কথা ফুরিয়ে এসেছে তার।আর দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করল না সে।চুপচাপ হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেল।
.
.
.
.
শোহরাবের মনে হচ্ছিল,সে পাগল হয়ে যাবে।কবুল শব্দে যে এতো জোর থাকতে পারে,সে জানতো না।কবুল বলার আগেও রূপসা স্রেফ তার জেদ ছিলো।অথচ তিন কবুল বলতেই কি থেকে কি হয়ে গেল,শোহরাব মেয়েটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লো।সেই দুর্বলতা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শুধু বেড়েই গেল।

রূপসা তার কন্ঠনালিতে কাঁটার মতো বিঁধে থাকা এক যন্ত্রনার নাম।রূপসা তার ক্লান্ত বিকেলের দীর্ঘশ্বাস,নিকষ কালো রজনীতে দম হওয়ার বিচ্ছিরি অনুভূতির নাম।
মাঝে মাঝে তার মন চায় হাঁটু গেড়ে বসে রূপসার পা জড়িয়ে ধরতে।খুব করুণ সুরে বলতে,’আমায় মাফ করো রূপসা।আরো একটা সুযোগ দাও আমায়।আমি কিন্তু খুব খারাপ মানুষ না।একবার সুযোগ দাও।শুধু একবার।’

অথচ কোনো কথাই বলা হয় না।শোহরাব দিনে দিনে উন্মনা হলো।কেমন যেন উদাসীন,ছন্নছাড়া,দিশাহীন।

জোহরা যেন সচক্ষে ছেলের পরিবর্তন দেখছিলেন।এক রাতে ছেলের পাশে বসে ডাকলেন,’বাবা!’

শোহরাব চোখ তুলল।জোহরা বললেন,’খারাপ লাগে বাবা?’

‘জানি না মা।’

‘আমি রূপসার বাড়ি যাবো?’

‘কোনো দরকার নেই।’

‘একবার অনুরোধ করি।’

‘দরকার নেই মা।তুমি আর নতুন করে ঝামেলা করো না।’

জোহরা তবুও ছেলের অবাধ্য হয়ে একদিন রূপসাদের বাড়ি গেলেন।রূপসা তার কথা শুনেই বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল,’মাফ করবেন আন্টি।এইসব কথা বলে আপনি আমার হৃদয়ে নিজের অবস্থান নড়বড়ে করবেন না প্লিজ।এই কথা আমি রাখতে পারবো না।’

জোহরা শূন্য হাতেই ফিরে এলেন।অথচ ছেলের এই ভবঘুরে অবস্থা তাকে খুব বেশি বিচলিত করে তুলল।এক বিকেলে খবর এলো,শোহরাব বাইক এক্সিডেন্ট করেছে।অবস্থা খুব একটা ভালো না।জোহরা যেন পাথর হয়ে গেলেন।দম আটকে আসছিলো বার বার।সেই খবর হাওয়ায় ভেসে রাজিব মাস্টারের বাড়িতেও পৌঁছালো।

রূপসা তখন জানালার ধারে বসে চা খাচ্ছিল।খবরটা কানে যেতেই আচমকা কাঁচের কাপটা হাত খসে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো।রূপসা হতবিহ্বল হয়ে এদিক সেদিক তাকালো।তার কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছিলো সবকিছু।

সে ভয়ে ভয়ে ফোনের মেসেজ অপশনটা ওপেন করলো।শোহরাব কাল রাতে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল।রূপসা সেটা খুলে দেখেনি একবারও।আজ দেখলো।
সেখানে লিখা-

“মিস!
অপরাধ মার্জনা করবেন।তবে আমার দ্বারা একটা সাংঘাতিক ভুল হয়েছে।আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।ভালোবাসলে খুব একটা সমস্যা হতো না।কিন্তু সমস্যা হলো আমি আপনাকে ভয়ানকভাবে ভালোবেসে ফেলেছি।ভয়ানক ভালোবাসাটা আসলে সমস্যা।সেটা আমি চাইছিলাম না।অথচ হয়ে গেল।

কাল বিকেলে তোমার কাছে আসবো।পা ধরে মাফ চাইবো।তুমি কি আমায় মাফ করবে রূপসা?”

চলবে-