জুলিয়েট পর্ব-১৯

0
57

গল্প #জুলিয়েট
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

১৯.

শাহাবুদ্দীন কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হলেন।যেই একটা আশংকা তিনি ভেতরে ভেতরে করছিলেন,সেটা সত্যি হোক তিনি চান না।অথচ বারবার মনে হচ্ছে সেই আশংকাই যেন সত্যি হবে।এই ভয়ে তিনি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছিলেন না।তার কোমল দৃষ্টি ছড়িয়ে ছিলো রূপসা নামের মেয়েটির সমস্ত মুখে।

তিনি দেখলেন,রূপসার দুই চোখ একটু পর পর ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।চোখ ঘোলা হতেই সে তাড়াহুড়ো করে সেটা মুছে নেয়।মুছতেই গিয়েই সে অনুভব করে,তার হাত কাঁপছে।

রূপসা আস্তে করে মাথাটা ডেস্কে ঠেকালো।দুর্বল হাতটা নিস্তেজ হয়ে কোলের উপর গিয়ে পড়তেই সে একটু নড়ে উঠল।জীবনের পথচলায় কতোকিছু ঘটে গেল।কতো কি হয়ে গেল! রূপসা শুধু সেসবের সাক্ষী হয়েই বেঁচে থাকল।সাথে বেঁচে থাকল তার এই ভয়াবহ মানসিক ব্যথি।যা তাকে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত একটু একটু করে গ্রাস করছিল।
__________________________________________

শোহরাবের মৃ’ত্যু হয়েছিল ক্যান্সারে সাথে পরাজয় মেনে নিয়ে।বোন ম্যারো ক্যান্সার।বাঁচার সম্ভাবনা ঝড়ো বাতাসে জ্বলতে থাকা প্রদীপের মতোই ক্ষীণ।সে ছিলো দমকা হাওয়ার অপেক্ষায়।সময় হতেই সে দমকা হাওয়ার তান্ডবে তার আটাশ বছরের ক্ষুদ্র জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।

সে বিদেশ যাওয়ার বছর দেড়েকের মাথায় এই খবর রূপসার কানে এলো।সেই দিনটা রূপসার এখনো স্পষ্ট করে মনে আছে।মণিকে কেউ ফোন দিয়েছিল।মণি ফোন ধরার দু’মিনিটের মধ্যেই কেমন অস্থির হয়ে উঠল।রূপসা তার কাছে এসে দাঁড়ালেও সে কিছুই বলতে পারে নি শুরুতে।

রূপসা যখন তার কাঁধে ঝাঁকি মেরে প্রশ্ন করল,’মণি! মণি! কি হলো?বলো আমাকে।’

জেসমিন তখন বুজে আসা করুণ স্বরে বললেন,’রূপসা!শোহরাব নাকি মা’রা গেছে।আজ সকালে তার লা’শ দেশে ফিরেছে।’

রূপসা স্তব্ধ হয়ে যাওয়া পাথরের মতোই কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল।মণিকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস তার হয় নি।তার মনে হলো তার শরীরে আচমকাই একটা তড়িৎ খেলে গেছে।সেই তড়িৎের প্রভাবে পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।রূপসা টের পেল সে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার ভেতরও দরদর করে ঘামছে।

একটা অপ্রত্যাশিত,অনিচ্ছায় হওয়া বিয়ে।সেই বিয়ে কে কেন্দ্র করে আরো কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা।তারপর সবকিছুর শেষে বিচ্ছেদ।বিচ্ছেদ টা কাগজে কলমের ছিলো না।বিচ্ছেদ টা ছিলো শরীরের।বিচ্ছেদ টা ছিলো নিঃশ্বাসের।শোহরাব আর কোনোদিন নিঃশ্বাস ফেলে নি।আর কোনোদিন গভীর রাতে ফোন দিয়ে নিরেট স্বরে ডাকে নি,’মিস! ফোনটা কিন্তু কাটবেন না প্লিজ।’

এই খবর শোনার পর রূপসা এক প্রকার ছুটতে ছুটতে অর্কিড প্যালেসে গিয়েছিল।সিএনজি চালক গাড়ির আয়নায় তার মুখ দেখেই অবাক হয়ে শুধালেন,’আপা সব ঠিক আছে?আপনি এমনে কান্দেন কেন?’

রূপসা কোনোরকম জবাব দেয় নি।সে দুই হাতে শক্ত করে নিজের মাথাটা চেপে ধরে পর পর দু’টো শ্বাস ফেলল।সেই শ্বাসের সাথে বি’ষ বেরিয়ে এলো।যেই বি’ষ প্রতি মুহূর্তে তার ভেতরে একটু একটু করে জমা হচ্ছিল।রূপসা প্রতিদিন একটু একটু করে ম’রছিল।

অর্কিড প্যালেসে যেতেই সে সবার আগে জোহরা কে দেখল,তারপর দেখলো গলা পর্যন্ত সাদা কাপড় টানা একটা ম’রদে’হ।রূপসা শুধু তার পায়ের অংশটাই দেখল।দুই পা এগিয়ে একটা বারের জন্যও তার মুখ দেখতে চাইলো না।কেন যে ইচ্ছে হয় নি দেখার।মাঝে মাঝে আমাদের মস্তিষ্ককে বাজে স্মৃতি থেকে মুক্তি দিতে হয়।ঐ স্মৃতিগুলো কেবল আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত।রূপসা ভাবলো সে আজ শোহরাবের মুখ দেখবে না।ঐ কৃৎসিত দৃশ্য তার মানসপটে ভেসে উঠুক,সে চায় না।

খুব ক্লান্ত বিকেলে কিংবা কিংবা কর্মব্যস্ত কোনো দুপুরে রূপসা যখন ধপ করে চেয়ারে বসে চোখ বুজবে,তখন সে চায় না তার চোখের পাতায় ঐ কৃৎসিত দৃশ্য ভেসে উঠুক।নি’থর হয়ে পড়ে থাকা শোহরাব কোনোদিনই তার স্মৃতিতে জায়গা না পাক।স্মৃতির খাতায় শোহরাব চিরকালই জীবিত থাকুক,প্রাণবন্ত হয়ে হাসতে থাকুক।

বাবার মৃ’ত্যুর পর সে খুব কাছ থেকে বসে বাবাকে দেখেছিল।তারপর সেই ঘুমন্ত মুখটা একটা লম্বা সময় তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।সে ঘুমাতো পারতো না কিছুতেই।চোখ বন্ধ করলেই দেখতো বাবা কথা বলে,বাবা সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে।তারপর সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে,সে আর কখনোই পরিচিত কারো মৃ’ত লা’শ দেখবে না।

বিদেশে যাওয়ার পর শোহরাবের সাথে তার দুই দিন কথা হয়েছিল।শোহরাব ফোন দিয়ে চুপচাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলতো।কখনো টুকটাক কথা বলতো।রূপসা কন্ঠে আগুন ঝড়িয়ে বলতো,’ডিভোর্স না দিয়ে বিদেশ গেলেন কেন?মানুষকে ভোগাতে আপনার এতো ভালো লাগে?’

শোহরাব শুধু হাসতো।সেদিন খুব অদ্ভুত কন্ঠে সে জানতে চাইলো,’আচ্ছা রূপসা! তুমি কি কখনো তারাদের দেশে গিয়েছো?’

রূপসা ভড়কে গিয়ে বলেছিল,’কোন দেশে?’

‘তারাদের দেশে।ঐ যে আকাশে আমরা যাদের দেখি,তাদের দেশে তুমি গিয়েছো?’

রূপসা মহাবিরক্ত হয়ে বলল,’নাহ্।যাই নি।’

‘কিন্তু আমি যাবো।সেখানে আমি একটা ছোট্ট কুটির বানাবো।সেই পৃথিবী খুব সুন্দর হবে রূপসা।সেখানে আমি জোর করে না,বরং অনুমতি নিয়ে তোমায় বিয়ে করতাম।তোমাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলার কষ্ট আমার চিরকাল থাকবে।’

রূপসা কি বিনিময়ে কোনো প্রতিউত্তর করতে পেরেছিল?মুঠোফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে সে কেমন যে অন্যমনস্ক হয়ে গেল।শোহরাব কোনোদিন তার থেকে জবাব চায় নি।সে শুধু নিজের শব্দগুলো বলে যেত।রূপসার জানা হতো না,কেমোথেরাপির প্রভাবে তখন তার শরীর কতোখানি বি’ষিয়ে থাকতো।ঠিক কতোখানি শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রনায় অসাড় হয়ে সদূর আমেরিকা থেকে সেই কলটা তার কাছে আসতো!

বোন ম্যারো ক্যান্সারের কথা সে পুরো বাড়িতে কাউকে জানায় নি।শুধু সানজানা কে জানিয়েছিল।তাও আবার বিদেশ যাওয়ার পরে।মৃ’ত্যুর আগে সে তার আশেপাশে থাকা প্রতিটা মানুষের জন্য কিছু না কিছু লিখে গেছে।সেই লিখা,সেই স্মৃতি,সেই আবেগ অতি অবহেলায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এলো।রূপসা অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো,সেখানে একটা ছোটো বক্স তার নামেও ছিলো।

শেষবারের মতো অর্কিড প্যালেস ছাড়ার আগে শুধু ঐ বক্সটাই রূপসা সাথে এনেছিল।আর কিছু না।শোহরাবের স্ত্রী হিসেবে ঐ বাড়িতে সে আর কোনোদিন ফিরে নি।তাদের সাথেও তার আর যোগাযোগ হয় নি কখনো।

ভালোবাসা তো ছিলো না।পুরো সম্পর্কের কোথাও তো সেটার অস্তিত্ব ছিল না।তাহলে কেন তার মৃ’ত্যু রূপসা মানতে পারেনি?কেন বার বার তার মন বলতো বিদেশ থেকে আরেকটা কল তার কাছে আসবে।তারপর অন্য পাশ থেকে কেউ তাকে বলে উঠবে,’মিস! ফোনটা কাটবে না প্লিজ।আমার আজকে তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।তুমি আজ অন্তত আমার সাথে কথা বলো।’

অথচ সেই ফোন কলটা আর কোনোদিন রূপসার কাছে আসেনি।শোহরাব নামের মানুষটা বন্দি হয়েছিল ঐ বক্স আর বক্সভর্তি কাগজের কালিতে।যেখানে শোহরাব,একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী তার জীবনের সমস্ত গল্প খুব যত্ন করে লিখে গিয়েছিল।রূপসার সংসার জীবন মূলত সেই কাগজের ভাঁজেই আটকে ছিলো।রূপসা মাঝে মাঝেই সেসব পড়তো,ছুঁয়ে দেখতো বার বার।মনে হতো শোহরাব সামনে দাঁড়ানো।হাসছে,কথা বলছে।মাঝে মাঝে আবার তাকে ডাকছে।

শোহরাবের সেই বক্সে থাকা কাগজগুলো অনেকটা চিরকুটের মতোই ছিলো।যেখানে বিভিন্ন দিনে শোহরাবের দিনলিপি বন্দি হয়েছিল তার জবানিতে।রূপসা প্রতি সপ্তাহে সেগুলো পড়ে।খুব যত্ন করে পড়ে।পড়ার সময় কাউকে তার ঘরে আসতে দেয় না।পড়া শেষে তার আর শোহরাবের কথা হয়।দু’জন অনেক রাত করে আলাপ করে।রূপসার তখন তাকে একটুও বিরক্ত লাগে না।

~~

১৮ই জানুয়ারি ২০২২
নিউইয়র্ক,আমেরিকা।

জুলিয়েট,

তোমার থেকে বারো হাজার ছয়শত বাহাত্তর কিলোমিটার দূরে নিউইয়র্ক শহরের একটা হসপিটাল বেডে আধশোয়া হয়ে তোমার রোমিও এই প্রথম তোমার জন্য কিছু লিখছে।আসলে প্রথম লিখছি না।বিয়ের আগে আরো অনেকবার তোমাকে নিয়ে লিখেছিলাম।তবে সেটা রোমিও হয়ে না।নিছকই মজার ছলে।

ফাহিমের সাথে আমি একটা ডেয়ার নিয়েছিলাম।’ট্রুথ এন্ড ডেয়ারে’ ডেয়ার থাকে না?অনেকটা ওমন।ফাহিম তোমার ভার্সিটির সিনিয়র।সে বলল,’রূপসা ওমন মেয়েই না।সে জীবনেও প্রেমে পড়বে না।’
আমি বললাম,’সে অবশ্যই প্রেমে পড়বে।আর সে আমাকে বিয়েও করবে।’

ব্যাস।এইটুকু সস্তা ডেয়ারে আমি তোমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম।তোমাকে চিরকুট লিখতাম।তোমার উপর নজর রাখতাম।তুমি আসার সময়টাতে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম।তুমি যখন আরুকে পড়াতে তখন চট করে একনজর তোমাকে দেখতাম।তোমাকে পাওয়ার জন্য তোমার বাড়ির ঠিকানা,ফোন নম্বর সব জোগাড় করেছিলাম।একটা ডেয়ারে জেতার জন্য তোমার কাছাকাছি আসতে গিয়েই আমি ধাম করে তোমায় ভালোবেসে ফেললাম।

কিছু ভালোবাসা পরিকল্পনা করে হয়ে থাকে।ঐ ভালোবাসা গুলো আসলে ঠিক আছে।কিন্তু ঠিক নেই আমাদের মতো লোকদের ভালোবাসা।যারা আটঘাট বেঁধে ভালোবাসতে নামে না।যারা এক অঘটন ঘটাতে গিয়ে অন্য অঘটন ঘটিয়ে ফেলে।এই আমাদের ভালোবাসাটাই যতো সমস্যা।আমি যে তোমায় ভালোবেসেছি,সেটা আমি বুঝেছি আমাদের বিয়ের দিন রাতে।যখন তোমার স্তব্ধ,মুর্ষে পড়া রূপ আমার ভেতরে একটা তীব্র অপরাধ বোধের জন্ম দিয়েছিল।অপরাধ বোধ সবার জন্য কাজ করে না মিস।কিছু বিশেষ মানুষের জন্যই সেটা কাজ করে।তুমি আমার সেই বিশেষ মানুষ।

_____________

১৯শে জানুয়ারি ২০২২
নিউইয়র্ক,আমেরিকা।

জুলিয়েট,

তুমি কি আমার উপর খুব রেগে আছো?তোমায় একটা সত্য কথা বলি?আমি আসলে কোনোদিন তোমায় ধরে বেঁধে ওমন করে বিয়ে করতে চাই নি।বিশ্বাস না হলে তুমি মা কে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।আমি মা কে বলেছি যে তোমাদের বাড়িতে যেন প্রস্তাব পাঠায়।কিন্তু তুমি সেই সুযোগ দিলে কোথায়?তুমি ঐ সাইফের কথা মেনে নিয়ে তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে।কেন তুমি এমনটা করলে রূপসা?তুমি যদি সেদিন একটু অপেক্ষা করতে,তাহলে কি আমাদের গল্পটা অন্যরকম হতো না বলো?

এই যে এই দূর দেশে আমার দিন গুলো এতো খারাপ যাচ্ছে।তুমি যদি এই অধমকে মেনে নিতে,সাইফের পরিবর্তে আমাকে সুযোগ দিতে,তাহলে কি এই ছিমছাম একা কেবিনে আমি একজন চমৎকার মানুষকে নিজের কাছে পেতাম না বলো?
কেন তুমি একটুও আমায় বোঝো নি মিস?

___________

২৩ শে মার্চ ২০২২
নিউইয়র্ক,আমেরিকা।

জুলিয়েট,

বিয়ের পর তোমার জীবনটা ভীষণ ভাবে পাল্টে দিয়েছি আমি তাই না?তোমার বাবাকে চলে যেতে হলো পৃথিবী ছেড়ে।এই পুরো ঘটনায় কোনো না কোনো ভাবে আমি দায়ী।জানি,দোষটা আমার।বাবার আচরণ আর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমি আগে থেকেই অবগত ছিলাম।কিন্তু বাবা যে আমার উপর থাকা রাগের বহিঃপ্রকাশ এতো বাজে ভাবে করবে,আমি সেটা কখনো ভাবি নি।

তোমার বাবার মৃ’ত্যুর পর থেকে আমি খুব করে চাইতাম যেন তুমি মুক্তি পাও।তুমি যেন খুব ভালো থাকো।দিন দিন শুধু ভেতরের অপরাধবোধ বাড়ছিল।বার বার মনে হচ্ছিল,তুমি একটা সুন্দর নির্মল জীবন ডিজার্ভ করো।এই বিচ্ছিরি জীবন তোমার জন্য না।তুমি কখনোই এতো করুণ জীবনের যোগ্য না।যখন মন থেকে তোমায় অনুভব করতে শুরু করলাম,তখন তোমার মুক্তি তোমার চেয়ে বেশি আমিই চাইছিলাম।কিন্তু একটা সুতো বার বার আমাকে টেনে ধরছিলো রূপসা।আমাদের বিবাহিত সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটাতে আমার কষ্ট হতো।কিন্তু তবুও,তোমার ভালো ভেবে আমি সবটা শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।সব গল্পের শেষেই কি নীল রঙের গোলাপ থাকে?কিছু গল্প না হয় ক্যাকটাসেই শেষ হোক।

____________

১১ই মে ২০২২
নিউইয়র্ক,আমেরিকা।

জুলিয়েট,

আমার শরীরে একটা খুব বাজে অসুখ বাসা বেঁধেছে।আমার ক্যান্সার হয়েছে রূপসা।বোন ম্যারো ক্যান্সার।যেই ক্যান্সারে বাঁচার সম্ভবনা তোমার আর আমার সুখী সংসারের সম্ভাবনার মতোই।নেই বললেই চলে।

ক্যান্সারের কথা কখন জানলাম জানো?যখন এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি হলাম,তখন।পুরো বডি চেক আপ করাতে গিয়ে ধরা পড়লো সেটা।নয়তো আরো অনেক পরে জানতাম।

ক্যান্সারের কথাটা জানার পরেই কেমন যে হয়ে গেলাম রূপসা।যতোই হোক।মানুষ তো।মৃ’ত্যু ভয় কার না আছে?ডাক্তার কে বললাম,মা বাবাকে যেন এটার কথা না জানায়।জানিয়ে আসলে কোনো লাভ নাই।কারণ যেই জায়গায় আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম,সেখান থেকে ফিরে আসা আর সম্ভব না।আগে কেউ ফিরে আসে নি,আমিও আসবো না,ভবিষ্যতেও কেউ আসবে না।

তোমার সাথে যখন হাসপাতালে দেখা হতো,তখন আমার অদ্ভুত লাগতো।আমি সবই বুঝতাম।তোমার সাথে আর কখনোই আমার পথ এক হতো না।তাই শেষ সময়টাতে তোমার কাছে অনেক বায়না ধরেছি রূপসা।অনেক অন্যায় আবদার করেছি।বলতে পারো,এই কঠিন দিন গুলো পার করার জন্য কিছু স্মৃতি জমিয়েছি।

সেই ভরা পূর্ণিমার রাতে,যখন আমরা রাতভর কথা বলেছি,তখন মনে মনে আমি একটি ছবি এঁকেছি।সেই ছবিতে আমি দেখলাম আমরা দু’জন একটা নৌকায় বসা।তুমি একটা নীল শাড়ি পরেছো।আমরা দু’জন বেশ গম্ভীর হয়ে আলোচনা করছিলাম।পূর্ণিমা না জোৎসনা?এই প্রশ্নের জবাবে আমরা বরাবরই আলাদা হয়ে যাচ্ছিলাম।এক সময় সে দূরত্ব বাড়লো,আর আমরা পরস্পর থেকে যোজন যোজন দূরে সরে এলাম।

তুমি থেকে গেলে পূর্ণিমার সেই ঝলমলে আলোতে।আর আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো,অমাবস্যার ঘুটঘটে অন্ধকার।সেই অন্ধকার থেকে আমায় টেনে তুলবে কে?কেউ না।

__________

১৭ই আগস্ট ২০২২
নিউইয়র্ক,আমেরিকা।

জুলিয়েট,

আমার জীবন প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু।তবুও কোথায় যেন বেঁচে থাকার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা।আমি তাই কাউকে না জানিয়ে এখানে এসেছি কেমোথেরাপির উদ্দেশ্যে।আসলে মনের কাছে স্বচ্ছ থাকতে চাই।এইটুকু স্বান্তনা আসলে নিজেকে দিতে চাই যে আমি চেষ্টা করেছি।

মা কে কিছু জানাই নি।মা ভীষণ ভেঙে পড়বে।আমি মায়ের প্রিয় বাচ্চা তো।তাই।

তুমি জানো রূপসা?কেমো দেওয়ার পর আমার খুব খারাপ লাগে।শরীর ভেঙেচুড়ে আসে আমার।হাত পা খুব কাঁপে।দম বন্ধ লাগে ভীষণ।তখন আমি টের পাই, আমি আসলে কতো একা।আমার কেউ নেই।হাসপাতালের জানালা দিয়ে আমি নিউইয়র্কের ব্যস্ত পথঘাট দেখি।পথিকের এই অবিরাম ছুটে চলা।কোথাও কোনো বিরাম নেই।আমার মতো মৃ’ত্যুর অপেক্ষায় থাকা মানুষের জন্য তাদের কাছে সময় কোথায়?

রূপসা! আমাদের কি আর কখনোই দেখা হবে না?কখনোই হবে একটি স্বচ্ছ আর বিশুদ্ধ আলিঙ্গন?যেখানে আমাদের হৃদয় সিক্ত হবে বিশুদ্ধ আবেগ আর স্বচ্ছ ভালোবাসার অনুভূতিতে।

______________

৪ঠা নভেম্বর ২০২২
নিউইয়র্ক,আমেরিকা।

জুলিয়েট,

একে একে প্রত্যেকটা কেমো নেওয়া শেষ।আমার দিক থেকে সব চেষ্টার শেষ হলো।এখন যা হবে,সবটাই উপরে যে বসে আছেন,তার ইচ্ছে।শোনো রূপসা! আমি এখন ভালো হয়ে গেছি খুব।রোজ ওয়াক্ত থাকতেই নামাজ পড়ি।তুমি কিন্তু আমাকে নিয়ে মনে মনে কোনো কষ্ট রেখো না।আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও তুমি আমায় ক্ষমা করো রূপসা।

আমি তোমায় ইচ্ছে করেই ডিভোর্স দেই নি রূপসা।যদি তোমায় ডিভোর্স দিতাম,তবে এতো অবলীলায় তোমাকে এসব লিখতে পারতাম না।তুমি হতে পরনারী।পরনারী কে চিঠি লিখা যায় না মিস।তাই তোমাকে নিজের বৈধ নারী রেখেই জীবনের পথচলা শেষ করলাম।কে জানে?আরেকটা মূলাকাত হলেও তো হতে পারে।

আমি আসলে বাঁচবো না রূপসা।তবে তুমি হয়তো তোমার দুঃসহ স্মৃতিতে আমায় খুঁজে পাবে বার বার।তোমার সুন্দর স্মৃতি না হয়ে কুৎসিত স্মৃতি হওয়ার আফসোস আমার চিরকাল থেকে যাবে।

সাইফের উপর রাগ হচ্ছে ভীষণ।সে কেন আমার আগে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তোমার বাড়ি গেলো?সে তোমার বাড়ি না গেলে আজ তুমি আমার হতে।আমরা একটা সুন্দর ছাদের নিচে একসাথে থাকতাম।তখন আমার জীবনের অন্তিম মুহূর্তটা খুব রঙিন হতো।তুমি আর আমার জুলিয়েট হয়ে থাকতে না।আমাদের জীবনটা অপূর্ণতায়ও পূর্ণতা পেত মিস।

________

২১শে ডিসেম্বর ২০২২
নিউইয়র্ক,আমেরিকা।

জুলিয়েট,

জীবনের অন্তিম মূহুর্তে দরজায় এসে কড়া নাড়ছে।ডাক্তার রা আমায় মিছেমিছি আস্বস্ত করছে।আমি জানি,আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে।আমার রিপোর্ট গুলো চিৎকার করে সেই কথাই বলছে।আমার ইদানিং খুব খারাপ লাগে।কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় ভীষণ।

মায়ের সাথে কথা হয়েছিল কাল।মায়ের সাথে প্রায়ই কথা হয়।তাকে অসুখের কথা বলিনি।মা খুব কষ্ট পাবে,প্রচন্ড ভেঙে পড়বে।আমি মায়ের ভেঙে পড়া রূপ দেখতে চাই না।

তোমায় আজ ফোন দিয়েছিলাম।তুমি খুব বিরক্ত হলে ফোন ধরে।যাক গে।সমস্যা নেই।তোমার এই বিরক্তিকর স্মৃতিতে আমি বেঁচে থাকতে চাই।আচ্ছা রূপসা! আমি মা’রা গেলে কি তুমি একটুও কাঁদবে না?একবারও কি তুমি অনুভব করবে না,আমি তোমায় কতোটা চাইতাম?

আমাদের বিয়েটা ভুল না রূপসা।ভুল ছিলো আমাদের দেখা হওয়ার সময়।হয় আরো কিছুদিন আগে দেখা হতো,নয়তো আরো কিছুদিন পরে।কিন্তু আমাদের দেখা হলো খুবই বাজে একটা সময়ে।দোষটা মূলত সময়ের।আমরা দু’জনই এর ভুক্তভুগী।

আকাশে আজ চাঁদ নেই।এই অমানিশার চাদরে ঢাকা আকাশ আজকাল আমার ভেতর ভয়ের উদ্রেক করে।এই ঘন কালো অন্ধকার একসময় আমার সঙ্গী হবে।আমি সেই অন্ধকার সহ্য করবো কিভাবে জুলিয়েট?

_________

জুলিয়েট,

আজকের দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন গুলোর একটি।সকাল থেকে র’ক্ত বমি হচ্ছে।একটু পর পর মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছি।ডাক্তার রা রিপোর্ট দেখেই কেমন অদ্ভুত মুখ করছে।শেষে একজন জানতে চাইলো,’আপনার কি কিছু খেতে মন চায় শোহরাব?অথবা এমন কোনো স্পেশাল জায়গা,যেখানে আপনার যেতে ইচ্ছে হয়?’

শুনে আমি ফ্যাকাশে হাসি হাসি।মৃ’ত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়ানো ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সে কোথায় যেতে চায়।আমি যদি ঘুরিয়ে জবাব দেই যে আমি জীবনের পথে ফিরতে চাই,তবে তারা কি প্রতিউত্তর করবে?তারা কি পারবে এই মুক্ত বাতাসে আমাকে আরো কিছুক্ষণ থাকার ব্যবস্থা করে দিতে?

সন্ধ্যা থেকে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে।মা কে ফোন দেই নি।মা তাহলে বুঝে যেত শরীরের অবস্থা।তোমাকে দিয়েছিলাম ফোন।কেন যেন মনে হচ্ছে এটাই আমাদের শেষ কথা।আর কথা হবে না রূপসা।আর কোনোদিন না।অভিনন্দন! তুমি মুক্তি পেয়েছো রূপসা।একটা মানসিক পীড়া দেওয়া জীবন তোমাকে চূড়ান্ত পর্যায়ের মুক্তি দিয়েছে।

তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী রূপসা।আমাদের সবকিছুর অর্ধেক আমি তোমায় দিলাম।যদিও বা আনন্দের অর্ধেক তোমায় দেওয়া হয়নি,তবে দুঃখের অর্ধেক তোমায় দিলাম।আমার হৃদয়ে জমা সমস্ত বিষাদের মেঘ তোমাকেও একইভাবে স্পর্শ করবে জানি।কারণ তুমি ভীষণ কোমল হৃদয়ের মেয়ে।

এই কথা গুলো মা কে লিখিনি।শুধুই তোমাকে লিখেছি।কারণ আমার এই যন্ত্রনার সাক্ষী আমি তোমাকেই রাখতে চেয়েছি।ঐ যে বললাম না।তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী।তোমাকে আমি যন্ত্রনা ছাড়া কিছুই দেই নি রূপসা।তবুও আমায় ক্ষমা করো।সকালের মিঠে রোদের মতো একটা ঝলমলে সুন্দর জীবন তোমার হোক সেই প্রার্থনা করছি।তুমি খুব ভালো থেকো মিস।সম্ভব হলে আমাকে ক্ষমা করো।

রাত ফুরিয়ে আসছে।সেই সাথে ফুরিয়ে আসছে আমার নিভু নিভু জীবনের প্রদীপ।আমার এই গল্পগুলো তোমার কাছেই জমা থাকুক রূপসা।জীবনের পরে হলেও যেন তোমার সামান্য সহানুভূতি আমি পাই।যেন কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে তোমার মন খারাপের ভীড়ে আমি থাকি।আমি একটুখানি থাকতে চাই রূপসা।পুরোপুরি বিলীন হতে আমার ভীষণ ভয় হয়।

আবার হয়তো কখনো দেখা হবে আমাদের।হয়তো হবে।যদি হয়,তবে আমি সবার সামনে তোমায় বিয়ে করতাম।সেই বিয়ে তুমি সম্মান হারানোর ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে করতে না।সেই বিয়েতে তুমি এক টুকরো স্নিগ্ধ হাসি মুখে মেখে আমায় কবুল করে নিতে।আমাদের তারপর একটা সুন্দর গল্প হতো মিস।

বুকের ব্যাথা ক্রমশ বাড়ছে।নাক কান দিয়ে ক্রমাগত র’ক্ত বের হচ্ছে।আর লিখা সম্ভব না।এই জীবনের জন্য “আল বিদা”।

ইতি,
শোহরাব
১৮ই ফেব্রুয়ারী ২০২৩
নিউইয়র্ক,আমেরিকা।

চলবে-