গল্প #জুলিয়েট[অন্তিম পাতা]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
২০.
PTSD-পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার।শাহাবুদ্দীন আহমেদ ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে মেয়েটির দিকে তাকালেন।তার হাত দু’টো মৃগী রোগীদের মতোন কাঁপছিল।সে এককোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসা।শাহাবুদ্দীন ডাকলেন,’রূপসা! আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?’
রূপসা তাকালো না।কাঁপা স্বরে দুই দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,’আমি বাসায় যাবো।বাসায় যাবো আমি।’
শাহাবুদ্দীন হিমশীতল কন্ঠে বললেন,’ইটস ওকে রূপসা।ভয় পাচ্ছ কেন?আমি তো বললাম,আমি তোমার বন্ধুর মতো।শোনো রূপসা! এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।মৃ’ত্যুতে আমাদের কারো হাত নেই।’
রূপসা মাথা তোলে।অপ্রকৃতস্থের মতো করে বলে,’মৃ’ত্যুতে কেন হাত থাকবে?কিন্তু আচরণে তো হাত থাকে।
আমি যদি জানতাম সে অতো কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাবে,তাহলে কোনোদিন তার সাথে ওমন ব্যবহার করতাম না।আমি কোনোদিন এতো কঠোর হতাম না।আমি….’
রূপসার নিঃশ্বাস আটকে আসে।শাহাবুদ্দীন তার দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,’পানি খাও রূপসা।ধীরে সুস্থে কথা বলো।আমি সব শুনছি।তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেন?’
রূপসা বড় বড় করে শ্বাস ফেলে।তারপর ঢক ঢক করে গ্লাসে থাকা পুরোটা পানি শেষ করে।তার চোখের পাতার অস্বাভাবিক পলক ফেলা শাহাবুদ্দীন খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন।তিনি বুঝতে চাইলেন রূপসা আসলে মানসিকভাবে কতোখানি বিপর্যস্ত।
রূপসা নিজের শরীরটা বেড়াল শাবকের মতোন গুটিয়ে নিয়ে দুই পাশে মাথা নেড়ে বলল,’আমি যদি জানতাম,তার শরীরে এই জঘ’ন্য অসুখ বাসা বেঁধেছে।তাহলে আমি জোর করে হলেও তার সংসার করতাম।তাকে খুশি করার জন্য হলেও আমি ভালো বউ হয়ে উঠতাম।’
‘কথা সেই এক ই রূপসা।এক পর্যায়ে গিয়ে কষ্ট টা তুমিই পেতে।’
‘কিন্তু তার কষ্ট তো লাঘব হতো।’
‘মিছে মোহ তে কাউকে জড়িয়ে নিয়ে তার কষ্ট লাঘব করা যায় না রূপসা।যা হয়েছে,ভালোই হয়েছে।’
রূপসা চট করে মাথা তুলল।এলোমেলো দৃষ্টি।শাহাবুদ্দীন কে দেখতেই কেমন রেগে গেল।সেই রাগে তার চোখ মুখ ক্রমশ শক্ত হয়ে এলো।সে এক খাবলায় টেবিলের উপর থাকা পেপার ওয়েট টা শূন্যে তুলে নিয়ে শাহবুদ্দীন কে প্র’হার করতে উদ্যত হলো।
শাহাবুদ্দীন নির্বিকার হয়ে বসে থাকেন।শুধু এক হাতে খপ করে রূপসার হাতটা ধরে নিলেন।তারপর খুব শান্ত চোখে তার দিকে তাকালেন।রূপসা গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল,’ভালো হয়েছে মানে?আমার হাসবেন্ড ম’রে গেছে।আর তুই বলিস ভালো হয়েছে?’
‘কাম ডাউন রূপসা।’
‘হাত ছাড়।’
‘রূপসা! আমার চোখের দিকে তাকাও।আমি তোমার বন্ধু।তুমি কি তোমার বন্ধুকে মারবে?’
রূপসার হাতটা আচমকা শিথিল হয়ে এলো।সে ধপ করে পেছনে থাকা চেয়ারে গিয়ে বসল।তার মাথা নিচের দিকে ঝুঁকানো।বিড়বিড় করে কি যেন একটা বলল সে,শাহবুদ্দীন শুনতে পেলেন না।তারপরই রূপসা মেঝের দিকে ঢলে পড়ল।শাহাবুদ্দীন ছুটে গিয়ে তাকে ধরতেই টের পেলেন সে জ্ঞান হারিয়েছে।
.
.
.
.
রূপম চেয়ার টেনে শাহাবুদ্দীনের মুখোমুখি বসল।রূপসা আজ তার সাথে আসে নি।তাকে শতাব্দীর কাছেই রেখে এসেছে সে।জেসমিন আর শতাব্দী এখন সারাক্ষণই তার সাথে সাথে থাকে।
শাহাবুদ্দীন বললেন,’রূপসা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে ভুগছে।তার ব্রেইন এখনো অতীতের সেই কিছু ঘটনায় আটকে আছে।’
রূপম দীর্ঘশ্বাস ফেলল।বলল,’জানি।সেটাই তো সমস্যা।শোহরাব ভাই মা’রা যাওয়ার পর শুরুতে দিদিয়া তেমন অস্বাভাবিক কিছু করে নি।কিন্তু ঐ চিঠি গুলো পড়ার পর দিদিয়া কেমন যেন হয়ে গেছে।সারাদিন এমন উন্মনা হয়ে হাঁটাহাঁটি করে।দিদিয়ার আর কোনো কিছুতেই মনোযোগ নেই।সে সারাক্ষণ ফোন হাতে বসে থাকে।তার ধারণা,শোহরাব ভাই তাকে কল দিবে।তারপর তারা কথা বলবে।’
‘রূপসা একটা লুপ হোলে আটকে গেছে রূপম।ঐ লুপ হোলে আটকে সে আসলে একটু একটু করে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে।এই সমস্যা গুলোর শেষ পরিনতি কি জানো?’
রূপম জবাব দেয় না।শাহাবুদ্দীন নিজ থেকেই বললেন,’একটা পর্যায়ে গিয়ে সে পা’গল হয়ে যাবে।তার সব লক্ষণ এমনই বলছে।তার দৃষ্টির অস্থিরতা,হাত পায়ের অস্বাভাবিক মুভমেন্ট,কথা বলতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলা-এগুলো সেই ইঙ্গিতই করছে।’
রূপম ক্লান্ত হয়ে গায়ের ভার সিটের উপর ছেড়ে দিলো।ভেঙে আসা কন্ঠে জানতে চাইলো,’এখন?এখন তাহলে আমি কি করতে পারি?’
শাহাবুদ্দীন গম্ভীর হয়ে বললেন,’মুভ অন।তুমি রূপসা কে মুভ অন করতে সাহায্য করবে।তার জন্য যদি তোমাকে তার সাথে দু একবার দুর্ব্যবহারও করতে হয়,তাহলে করবে।এভাবে তো একটা মানুষকে চলতে দেওয়া যায় না রূপম।কাউকে পা’গল হওয়ার পথে ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে কখনো কখনো তাকে জীবনের পথে নিয়ে আসার জন্য একটু আধটু কঠোর হতে হয়।তুমি কি চাও না,তোমার বোন টা ভালো থাকুক?সেই ভালো থাকার জন্য তাকে সুস্থ হতে হবে।সুস্থ হওয়ার জন্য তাকে শোহরাবের স্মৃতিটুকু মুছে জীবনে এগিয়ে যেতে হবে।নয়তো রূপসার অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকেই যাবে।আমি তার রিপোর্ট দেখেছি।সে ঠিক নেই।তার একটা শক্ত অবলম্বন প্রয়োজন।তার একটা মানুষ প্রয়োজন।তুমি তাকে সাময়িক কষ্ট দিয়ে হলেও তার চিরস্থায়ী দুঃখ দূর করার ব্যবস্থা করো রূপম।শি নিডস আ পারসন।শি নিডস আ হ্যান্ড অফ ডিপেন্ডেনস,আ হ্যান্ড অফ লাভ,আ হ্যান্ড অফ বিলিভেন্স।’
___________________________________________
**পনেরো বছর পর**
বিদীশা আজকাল ভীষণ চিন্তায় থাকে।তার চিন্তার কারণ তার নতুন পাওয়া টিউশন।সে নওমি নামের একটি মেয়ে কে পড়াতে রোজ বিকেলে জামান ভিলায় আসে।নওমি ক্লাস সিক্সে পড়ে।সমস্যা সেটা না।সমস্যা হলো নওমির বইয়ের ভাঁজে থাকা চিরকুট।যেটা নওমিকে পড়াতে গেলেই বিদীশার হাতে উঠে আসে।
রোজকার মতো আজও সে তার বইয়ের ভাঁজে একটা চিঠি পেল।বিদীশা সেটা হাতে নেয়।চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নওমিকে দেখে জিজ্ঞেস করে,’এসব কি নওমি?এগুলো কার কাজ?’
নওমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়।চোখ গোল গোল করে বলে,’আমি জানি না তো মিস।’
কিন্তু তার অভিনয় কাঁচা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে,সে ভান ধরেছে।বিদীশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’আচ্ছা।জানতে হবে না।পড়ায় মন দাও।’
নওমি গণিত বইটা হাতে নিয়ে প্রশ্নের উপর চোখ বুলায়।বিদীশা ঐ ফাঁকে চিরকুট টা খুলে দেখে।
মিস বিদী,
আপনি কি কোনোদিনই আমার সাথে কথা বলবেন না ভেবে রেখেছেন?আমি কিন্তু রোজ আপনাকে দেখি।আপনার মুখটা কি এমনই?নাকি ইচ্ছে করে এমন করে রাখেন?কেমন যে লটকানো মুখ।
আমি বলি কি,আপনার হাসি অনেক সুন্দর।আপনি একটু হাসিখুশি থাকবেন কেমন?আপনাকে হাসিতে দেখতে ইচ্ছে হয় আমার।আরেকটা কথা,যদি কোনোদিন এই অধমকে পাত্তা দেওয়ার ইচ্ছে হয়,তবে ছুটির পর ইয়ার্ডে এসে দাঁড়াবেন।আমি আশেপাশেই থাকি।আপনি এসে দাঁড়ালে তখন আমি আপনার সামনে আসবো।আমাকে ছ্যাচড়া ভেবে ভুল করবেন না।আমি ছ্যাচড়া নই।
বিদীশা ফ্যাকাশে মুখে চিঠিটা পড়ে।তারপর ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে কপালে লেগে থাকা ঘাম মুছে।১৯ ডিগ্রিতে চলা এসির মধ্যেও সে দরদর করে ঘামছে।
***
রূপসার বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ বছর আগে।তার স্বামী নাফি পেশায় একজন আইনজীবী।রূপসার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক ভাবে।নাফির মা তাকে প্রথম দেখাতেই ভীষণ পছন্দ করেছিলেন।
নাফি তখন বিপত্নীক পুরুষ।তার স্ত্রী গত হয়েছিল তারো চার বছর আগে।তার একটা সাত বছরের ছেলে ছিল।নাম নওরোজ।সে তার মা কে হারিয়েছিল তিন বছরের মাথায়।নওরোজের বেড়ে উঠার সাথে সাথেই একজন মায়ের প্রয়োজন প্রকট হয়ে উঠল।তখন মিসেস রুমানা হন্য হয়ে একটা সংসারী মেয়ের খোঁজ করছিলেন।অবশেষে পেয়েও গেলেন।রূপসা ছিলো তার মনের মতোই একটা মেয়ে।
তারপর বেশ সাদামাটাভাবে রূপসা আর নাফির বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল।সেবার কবুল বলার সময় রূপসাকে কেউ চেপে ধরল না।কেউ তার দম আটকে দিলো না।কেউ তাকে সম্মানের ভয় দেখালো না।রূপসা সুযোগ পেয়েছিল খুব দায়সারা হয়ে একজন কে কবুল করে নেওয়ার।
নাফির সাথে তার সংসার জীবন একটা স্বপ্নের মতোই কাটলো।তার মতো সুপুরুষকে জীবনে পেলে চারপাশ এমনিতেই অপার্থিব হয়ে উঠে।তার দায়িত্ববোধ,চিন্তাধারা,ব্যক্তিত্ব সবকিছু ছিলো চোখে পড়ার মতো।তাকে রূপসা সবসময়ই কলকল করে বয়ে যাওয়া নদীর সাথে তুলনা করে।তার মাঝে কোনো তাড়াহুড়ো,কোনো হঠকারিতার লেশমাত্র নেই।সে খুব ঠান্ডা মাথায় কাজ করে।তার মতো ধৈর্যশীল পুরুষ রূপসা খুব কমই দেখেছে।রূপসা তাকে পেয়ে ভালোবাসতে শিখলো।সুস্থ পারিবারিক জীবনের সংজ্ঞা তাকে নাফিই শিখিয়েছে।রূপসা ক্ষণে ক্ষণে ক্ষয়ে যাচ্ছিল খুব করে।কিন্তু স্রষ্টা হুট করেই নাফিকে তার জীবনে পাঠালেন।নাফি তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখালো।জীবনের সবচেয়ে স্বচ্ছ অনুভূতি রূপসার জীবনে এসেছিল নাফির আগমনের সাথে সাথেই।সেই অনুভূতিতে দম বন্ধকর কোনো যন্ত্রনা ছিলো না।শুধু ছিলো সুখ সুখ কতোগুলো স্মৃতি।
বিয়ের পর রাজিব মাস্টারের একমাত্র মেয়ের জীবনটা শত ডানার প্রজাপতির মতোই রঙিন হয়ে উঠল।নাফি ভালোবেসে রূপসা কে দু’টো ডানা এনে দিয়েছিল।রূপসা সেই ডানায় ভর দিয়ে মুক্ত পাখির মতো দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ালো।সুইজারল্যান্ড,ফ্রান্স,ইন্দোনেশিয়া,মালদ্বীপ,নেপাল,ভুটান,অস্ট্রেলিয়া,ডেনমার্ক-প্রায় পনেরোটার অধিক দেশ সে নাফি,নওরোজ আর নওমিকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলো।সেখানে রূপসা দু’হাত মেলে প্রকৃতির সাথে মিশে গেল।জীবনের সমস্ত বিষাদ পেছনে ফেলে রূপসার জীবনে একটা রঙিন ভোরের সূর্য উঠেছিল।নাফি তাকে এমন করেই আগলে রাখল,যেন সে কোনো দশ বছরের ছোট শিশু।নাফি,নওরোজ আর নওমিকে পেয়ে রূপসা মন খারাপদের ছুটি দিয়েছিল চিরতরে।
উফফ! নওমির কথা তো বলাই হয় নি।নওমি তার আর নাফির একমাত্র মেয়ে।বিয়ের দুই বছর পরে তার ঘর আলো করে নওমি এসেছিল।নওমি হচ্ছে ভাইয়ের ন্যাওটা।ভাই ছাড়া সে কিছুই বোঝে না।দুই ভাইবোন সারাক্ষণ এক জায়গায় বসে গুজুরগুজুর ফুসুরফাসুর করে।রূপসা মানতে চায় না যে তারা আপন ভাই বোন না।তার মনে হয় তারা দু’জনই রূপসা রূপম,তারা দু’জনই অর্ক শতাব্দী।এবং তারা দু’জনই হলো শোহরাব আর সানজানা।
অর্ক খুব বড় ডাক্তার হয়েছে।দু’দিন আগে বলেও তার সিরিয়াল পাওয়া যায় না।রূপসা কিংবা রূপমের জন্য অবশ্য ছাড় আছে।তারা তাকে বললেই সে সব ফেলে তাদের কাছে ছুটে আসে।
রূপমের একটা মেয়ে হয়েছে।রূপন্তি নাম।কি যে মিষ্টি হয়েছে দেখতে! রূপসা কে সে মামনি ডাকে।রূপসা মাসে এক দুইবার তাদের বাড়ি যায়।আগে আরো বেশি যেতো।এখন আর যাওয়া হয় না।রুমানা গত হয়েছেন তিন বছর আগে।তারপর থেকে সংসারের সমস্ত ভার রূপসার কাঁধে।এতো বড়ো সংসার সামলে রূপসার আর বাবার বাড়ি বেড়ানো হয় না।
_____
সেদিন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো।রূপসা যখন খাটের সাথে আধশোয়া হয়ে ম্যাগাজিন পড়ছিল,তখন নওমি তার কাছে ছুটে এলো।এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’মা! মা! লেপার্ড….লেপার্ড….!’
হাঁপানির কারণে নওমি পুরো কথা শেষ করতে পারে নি।রূপসা ম্যাগাজিন বন্ধ করে উঠে বসলো।নওরোজ কে নওমি লেপার্ড ডাকে।আর নওরোজ তাকে ডাকে রেবিট।রূপসার চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা।সে এক আঙুলে সেটা পেছনে ঠেলে বলল,’কি হয়েছে নওরোজের?আবার কি অঘটন ঘটিয়েছে সে?’
‘লেপার্ড আমার বিদী মিস কে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।’
রূপসা ম্যাগাজিনটা খাটের উপর ছুঁড়ে মেরে এক লাফে উঠে দাঁড়ালো।প্রায় চিৎকার করে বলল,’কি?’
নওমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’হ্যাঁ মা।মিস খুব কান্না কাটি করছে।’
রূপসা ছুটে গেল দরজার দিকে।লিভিং রুমের কাছাকাছি আসতেই সে তাজ্জব হলো।দেখলো নওরোজ একটি মেয়েকে কোলে তুলে রেখেছে।মেয়েটা তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য এলোপাতাড়ি হাত পা ছুড়ছে।কিন্তু নওরোজের দুই হাতের শক্ত আলিঙ্গন উপেক্ষা করে বাঁধনমুক্ত হওয়ার সাধ্যি তার নেই।সে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তেই আচমকা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিল।
রূপসা হতবিহ্বল হয়ে এগিয়ে যায়।হতবুদ্ধি হয়ে প্রশ্ন করে,’এসব কি নওরোজ?তুই এটা কি করেছিস?’
নওরোজ তার দিকে তাকালো।অতিশয় ঠান্ডা গলায় বলল,’মা! আমি মিস বিদী কে বিয়ে করেছি।’
রূপসার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।বিদীশা রাগে গির গির করে কেঁদে উঠল।বলল,’আমি মানি না এই বিয়ে।আমি তোকে মানি না।তুই একটা কু’ত্তা।’
‘ঠিক আছে।আমি কু’ত্তা।আর তুমি কু’ত্তার বউ।এখন চুপচাপ বসে থাকো।’
রূপসা দুই কদম পিছিয়ে গেল।তার চোখ ঘোলা হয়ে এসেছে।বহুদিন পুরোনো জ’খমটা আজ পুনরায় দগদগে ঘা হয়ে ফিরে এসেছে।রূপসা আর্তনাদের মতো করে বলল,’কেন এমন করলে নওরোজ?কেন মেয়েটার জীবন নষ্ট করলে?তোমার বাবাকে আমি এখন কি উত্তর দিবো?’
নওরোজ দায়সারা হয়ে বলল,’বাবাকে তুমি সামলে নিও মা।প্লিজ।’
রূপসা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না।তার মাথা ঘুরছে।মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।এতো বিশাল হট্টগোলেও সে থাকতে পারল না বেশিক্ষণ।যা হবার,সব নাফি বাড়ি আসলে তারপর হবে।রূপসা আর এসবে থাকতে পারবে না।সে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে তার ঘরে এলো।এসেই সশব্দে দরজা বন্ধ করে মুখে হাত চাপলো।
পনেরো বছর! পনেরো বছর কি যথেষ্ট সময় ছিলো না কাউকে ভোলার জন্য? রূপসা কেন তাকে ভুলতে পারে নি?যেই জ’খমে আগেই মলম দেওয়া হয়েছে,সেটা কেন সময়ে অসময়ে দগদগে হয়ে উঠবে?কেন চারপাশের ছোট বড় অগণিত ঘটনা রূপসাকে তার অতীত মনে করিয়ে দিবে?
*
‘রূপসা!’
কন্ঠস্বরটা বেশ পরিচিত।কিন্তু অনেক বছর ধরে আর শোনা হয় না।রূপসা মাথা তুলে।ম্লান হেসে বলে,’হুম?’
‘তুমি কাঁদছো?’
‘না তো।’
শোহরাব তার সামনে এসে বসল।রূপসা যন্ত্রের মতো করে বলল,’নওরোজ একটা মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করেছে শোহরাব।’
‘সেটা দেখে তোমার আমার কথা মনে হলো?’
রূপসা আস্তে করে বলল,’হুম।’
শোহরাব হাসে।
‘দেখলে,পৃথিবীর সব অপ্রীতিকর ঘটনার স্মৃতিতে আমি মিশে আছি।’
রূপসা একহাতে মাথা চেপে বলল,’তুমি চলে যাও শোহরাব।নাফি খুব রাগ করবে যদি দেখে তুমি এখানে এসেছো।চলে যাও তুমি।’
‘আমি কিভাবে যাবো মিস?তুমি আমায় ডেকেছো।আমি তো নিজ থেকে আসি নি।’
‘আমি তোমায় ডেকেছি?’
রূপসা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
‘হুম।আমি নিজ থেকে আসতে পারি না।তুমি আমায় ডাকো বলেই আমি আসি।’
‘কিন্তু আমি তো তোমায় ডাকতে চাই না।তবুও কেন ডেকে ফেলি?’
‘জানি না রূপসা।’
শোহরাব ডাকলো,’মিস!’
‘কি?’
‘নাফিকে ভালোবাসো?’
‘খুব।নিজের চেয়েও বেশি।নাফি ছাড়া দুই কদম ফেলতেও আমার ভয় হয়।সে আমায় খুব যত্ন করে।’
শোহরাব আবার ডাকে,’মিস?’
‘হু?’
‘চিরকুট গুলো ছিঁড়ে ফেলো।’
রূপসা ক্ষেপা বাঘিনীর মতো গর্জে উঠল,’অসম্ভব।’
‘ঐ চিঠি গুলো যে আমায় মুক্তি দিচ্ছে না।’
‘পেতে হবে না মুক্তি।’
রূপসা রক্তিম চোখ মেলে তার দিকে তাকায়।
‘আমিও তো মুক্তি পাই নি শোহরাব।সবাই তো দিন শেষে মুক্তি পায় না।’
‘এই যে তোমার কতো সুন্দর একটা সংসার হয়েছে! তুমি তো মুক্তি পেয়েছো জুলিয়েট।’
রূপসা সাফাই দিয়ে বলল,’রূপম আমায় বাধ্য করেছে জানো?আমি নাকি তার সংসারে বোঝা বাড়াচ্ছিলাম।’
‘সে তোমার ভালোই চেয়েছে রূপসা।’
‘আমি জানি।তাই তো রাগ রাখি নি মনে।’
‘তোমার সংসার টা খুব সুন্দর রূপসা।দেখলেই ঈর্ষা হয় আমার।’
রূপসা তাচ্ছিল্য করে হাসল।
‘আর আমার দোটানায় ভুগতে থাকা জীবন?সেটা দেখলে তোমার করুণা হয় না?’
‘মানুষ এক জীবনে সব পায় না মিস।’
‘তুমি যদি একবার একটা কল দিতে,তবে সব না পাওয়ার জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়ে যেতাম।তোমার ক্যান্সারের কথা জানলে আমি দাঁতে দাঁত কা’মড়ে তোমার স্ত্রী হয়ে পড়ে থাকতাম।’
রূপসা হাত পা ছড়িয়ে খাটের উপর শোয়।তার নিঃশ্বাসের গতি মন্থর।শোহরাব বলল,’আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী রূপসা।আজকের দিন অন্তত কাঁদতে নেই।’
রূপসা দ্রুত চোখ মোছে।পাশ ফিরে জানতে চায়,’তুমি আজ রাত টা থেকে যাও শোহরাব।’
শোহরাব স্মিত হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’পা’গল হয়েছো তুমি?দ্বিচারিতা হতে চাও নাকি?’
‘দ্বিচারিতা কেন হবো? তুমি আমার স্বামী না? নাফি কি তার প্রথম স্ত্রীকে ভুলে গেছে?’
‘আমাকে রাখার জন্য তুমি এতো যুক্তি দাঁড় করাচ্ছো?’
‘যুক্তি দিচ্ছি না।যা সত্য তাই বলছি।আমরা দু’জনই দু’জনের অতীতকে সম্মান করি।’
শোহরাব হাসলো।বলল,’আচ্ছা।থেকে গেলাম।’
রূপসা বলল,’মেঘের দেশ কেমন শোহরাব?’
‘খুব সুন্দর।সেখানে তুলোর মতো করে মেঘ ভেসে বেড়ায়।দেখতে খুব মনোরম লাগে।’
‘জীবনের পরে কি আছে শোহরাব?’
‘উমমম,সেটা খুব জটিল প্রশ্ন।উত্তরটা আরো জটিল।তুমি ফিলোসোফির ছাত্রী হলে বুঝতে।’
‘থাক।জটিল জিনিস শুনতে ভালো লাগে না।’
রূপসা ডাকলো,’শোহরাব!’
‘হুম।’
‘আমাদের বিয়ের কতো বছর হলো?’
‘আঠারো।’
‘আঠারো! ‘ বলতে গিয়েই রূপসা বিস্মিত হয়।
‘তুমি তো খুব সুন্দর গান করো শোহরাব।আজ একটা গান গাও।’
‘উহু।আমি গান গাইলে পরে তুমি খুব কান্না করো।’
‘একটু গাও না।আজ আমার কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব।তুমি কি আমাদের বিবাহ বার্ষিকীতে আমার এই ছোট্ট অনুরোধ শুনবে না?’
শোহরাব থেমে গেল।একবার চোখ ভরে রূপসার বিবর্ণ মুখটা দেখলো।ষোলো বছর! তার মৃ’ত্যুর ষোলো বছর হয়ে গেছে।অথচ সেই চিরকুট গুলো এখনো কতো সতেজ! রোজ রাতে নাফি ঘুমানোর পর রূপসা সেগুলো পড়ে দেখে।পড়ার পর তার প্রশান্তি অনুভব হয়।ঐ একটা ফোনকল বাদে রূপসার জীবনে আর কোনো আক্ষেপ নেই।কিন্তু যতোবারই সে চিঠিগুলো পড়ে,আনমনে সেসব বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে।আচ্ছা,শোহরাব কি এতো বেশি অমরত্ব চেয়েছিল এই জীবনে?
বাইরের খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস পর্দা ঠেলে ঘরের ভেতর প্রবেশ করছিল।রূপসা দুই চোখ বুজে একটা হাত বুকের উপর রাখলো।শোহরাব হেঁটে গেলো জানালার কাছে।তারপর পর্দা টেনে ঘরের আবছা ভাবটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলো।
কোথা থেকে যেন একটা বিষাদময় সুর পুরো ঘরজুড়ে ছেয়ে গেল।মনে হলো,সেই সুর ভায়োলিনের সুরের থেকেও করুণ।
“কখনো আকাশ বেয়ে চুপ করে,
যদি নেমে আসে ভালোবাসা খুব ভোরে।
চোখ ভাঙ্গা ঘুমে তুমি খুঁজো না আমায়,
আশেপাশে আমি আর নেই।
আমার জন্য আলো জ্বেলো না কেউ,
আমি মানুষের সমুদ্রে গুনেছি ঢেউ।
এই স্টেশনের চত্বরে হারিয়ে গেছি,
শেষ ট্রেনে ঘরে ফিরবো না, না-না”
_______________সমাপ্ত______________