#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-১১)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
২৩.
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। বর্ষা আর চৈত্র বকবক করছে। কখন পৌঁছাবে, পরদিন সকালে বিলে যাবে, তেঁতুল আর পেয়ারা দিয়ে ভর্তা করবে এই সেই নানান কথা বলছে। মৌসন্ধ্যার মনটা একটু খা’রা’প। সে পেছনে থাকা তিন মানবের জন্য একটু ফ্রী হতে পারছেনা। তার বিশেষ ইন্দ্রীয় বলছে তার দিকে গভীর চোখে কেউ তাকিয়ে আছে। একটা অন্যরকম অ’স্ব’স্তি নিয়েই সে এখন বসে আছে।
হাসনাহেনা বেগম শোয়া থেকে উঠে বসেছেন। তিনি কাঁশি দিচ্ছেন একের পর এক। মৌসন্ধ্যা পেছন ফিরল। প্রথমেই দৃষ্টি পড়ে তার বরাবর বসে থাকা আষাঢ়ের দিকে। সে মাথা হেলিয়ে রেখেছে সিটে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে সে তার খালামণির দিকে তাকায়। বলল,
-‘তোমার কি ঠান্ডা লাগছে খালামণি?’
একটু স্থির হয়ে হাসনাহেনা বেগম জবাব দিলেন,
-‘না গলাটা খুচখুচ করছে। একটু গরম পানি থাকলে ভালো হইত রে।’
মৌসন্ধ্যা কপট রা’গ দেখিয়ে বলল,
-‘গরম পানি নানুর ব্যাগেই তোমার জন্য আম্মু রেখেছিল। তোমার তো সেইসবে ধ্যান থাকেনা। তোমার ধ্যান জ্ঞান বলতে শুধু পান আর পান!’
হাসনাহেনা বেগম হাসলেন। আষাঢ় মৌসন্ধ্যার গলা শুনতে পেয়ে আরো আগেই সোজা হয়ে বসেছিল। মৌসন্ধ্যার রা’গী মুখটা দেখে সে মৃদু হাসল। গাড়িতে থাকা স্বল্প আলোতে তার হাসিটা ছিল খুব মোহনীয়। মৌসন্ধ্যা দ্রুত সামনে ফিরল। ধুর! আষাঢ়ের হাসির দিকে এভাবে তাকিয়ে দেখার কি কোনো মানে হয়?
হাইওয়েতে ওঠার আগেই মৌসন্ধ্যা আশ্বিনকে বলল,
-‘ভাইয়া! সামনে গেলে মোটর পাম্পের সামনে একটা ছোট টং দোকান পড়বে। সেখানে গাড়ি থামাতে বলবে।’
আশ্বিন পেছন ফিরে মুচকি হেসে বলল,
-‘চা খাবি?’
-‘হুম। খালামণিরও চা খাওয়া দরকার। এইখানে একটা রং চা পাওয়া যায় কালো জিরা দেয় সাথে। খুব মজা। এইদিক দিয়ে আসা যাওয়া করলে সবসময় খাওয়া হয়।’
-‘তুই একা একা টং দোকানে চা খাস?’
-‘না একা না তো। মৃন্ময় সাথে থাকে তো।’
-‘মৃন্ময় কে?’
মৌসন্ধ্যা বিরক্ত হয়ে আশ্বিনের দিকে তাকালো। মৃন্ময় কে সেটা ভালো ভাবেই জানে। তবুও এখন ভং ধরছে ছেলেটা। বর্ষাও একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
-‘এই মৌ! মৃন্ময় আবার কে? ব য় ফ্রে ন্ড!’
শেষের কথাটা টেনে বেশ ঢং করেই বলল। মৌসন্ধ্যা আলতো হাতে বর্ষার মাথায় চাটি দিল। পেছন থেকে আষাঢ় বেশ ক্ষী’প্ত স্বরে বলল,
-‘এই তোর বয়ফ্রেন্ড আছে?’
মৌসন্ধ্যা পেছন ফিরে বলল,
-‘আরে না। মৃন্ময় আমার ফুফাতো ভাই। আমরা এক ভার্সিটিতেই। আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র।’
-‘তোর ফুফাতো ভাই? বয়সে বড়!’
-‘হুম।’
-‘ভাইয়া বলিস না কেন?’
-‘ভাইয়া বলব কেন? আমরা বন্ধুর মতো। একসাথে বড় হয়েছি। এক বছরের ডিফারেন্টস্ মাত্র। ছোট থেকেই একে অন্যের নাম ধরে ডাকি।’
-‘তুই এত পথ ওর সাথে আসা যাওয়া করিস? একা একা?’
মৌসন্ধ্যার রা’গ হলো। আষাঢ় কি মৃন্ময়কে বা’জে ছেলে ভাবছে? মৃন্ময় তার আপন ভাইয়ের মতো। দুজনের একটা সুন্দর বন্ডিং রয়েছে। সবসময় আসা যাওয়া করে একসাথে। বরং তার বাবা বলে রেখেছেন মৃন্ময়কে যে সবসময় মৌসন্ধ্যাকে সাথে নিয়ে আসা যাওয়া করতে। মৃন্ময় হলো তাদের ভরসাস্থল।
-‘আব্বু মৃন্ময়কে বলেছে আমাকে সাথে করে আনতে আর নিয়ে যেতে। ও আমার ভাই। ওর সাথে চলাফেরা করতে আমার ভালো লাগে। ও সবার মতো না।’
আষাঢ় ভাবল একবার বলবে ‘সবার মতো না’ বলতে মৌসন্ধ্যা কি বুঝিয়েছে। তার আগেই মৌসন্ধ্যা আশ্বিনকে বলল,
-‘ওই তো দোকানটা। গাড়ি থামাতে বলো।’
আশ্বিনের বলা লাগল না। ড্রাইভার শুনেছে। সে নিজে থেকেই গাড়ি সাইড করে রাখল। আশ্বিন এবং ড্রাইভার দুজনেই গাড়ি থেকে নামল। বর্ষা বলল,
-‘আমরাও একটু নামি? একটানা বসে থাকতে ভালো লাগেনা। পা ধরে গেছে অলরেডি।’
আশ্বিন গাড়ির দরজা খুলে বলল,
-‘নাম।’
বর্ষা একা নামেনি। সবাই গাড়ি থেকে নামল। বসে রইল শুধু গ্রীষ্ম আর হাসনাহেনা বেগম। গ্রীষ্মের নামতে ইচ্ছা করছিল না। আশ্বিন জানালার পাশে এসে বলল,
-‘ভাই? নামবে না!’
মৌসন্ধ্যা তখন গাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। সে শুনতে পেল গ্রীষ্ম বলছে,
-‘মাথা ব্যথা করছে। তোরা চা খা। টাকা নিয়ে যা।’
মানিব্যাগটা বের করে দিতেই আশ্বিন বলল,
-‘পাগল তুমি? চায়ের টাকা আমার কাছে নেই বুঝি?’
গ্রীষ্ম হেসে বলল,
-‘তোরা সবকয়টা আমার ছোট ভাইবোন। আমি থাকতে নিজেরা কেন টাকা খরচ করবি?’
-‘আহ! তোমার মতো ভাই হয় না। তবে এখন টাকাটা তোমার দেওয়া লাগবেনা। আষাঢ় ভাইও তো বড়। দেখি ওর পকেট ফাঁকা করা যায় কিনা!’
আশ্বিন চলে গেলে গ্রীষ্ম বাহিরে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করল। আজ আকাশে একটা সুন্দর চাঁদ উঠেছে। এক ধ্যানে সেদিকে চেয়ে থেকেই গ্রীষ্ম মৃন্ময়ের কথা ভাবল। ছেলেটাকে মৌসন্ধ্যা ভরসা করে। ভাবতেই তার কাছে একটু অন্যরকম লাগল। সে জানে, এতটা ভরসা মৌসন্ধ্যা তাকে করেনা। তার মন উতলা হয়ে উঠছে মৌসন্ধ্যার ভরসাযোগ্য হয়ে ওঠার জন্য। এরকম অদ্ভুত অনুভূতি হওয়াতে সে নিজেই অবাক। নিজের মধ্যে একটা ব্যাপক ব্যবধানের পরিবর্তন লক্ষ্য করে সে চুপসে গেল। সে তো কখনোই এমন ছিল না। তার কখনো এমন কারো প্রতি হিং’সা বি’দ্বে’ষ কাজ করেনি। তবে আজ কেন এমন হচ্ছে?
তার ধ্যান ভাঙে মৌসন্ধ্যার গলার আওয়াজে। মৌসন্ধ্যা একদম তার নিকটে এসে বলল,
-‘চায়ে লেবু খাবেন?’
গ্রীষ্ম চমকে গেল। আকস্মিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। মৌসন্ধ্যাকে সে আশা করেনি এই মুহূর্তে। উত্তর না পেয়ে পুনরায় মৌসন্ধ্যা জিজ্ঞেস করল,
-‘লেবু দিতে বলব চায়ে?’
গ্রীষ্ম কোনো মতে নিজেকে সামলে বলল,
-‘দিতে বলো।’
মিনিটের মধ্যেই মৌসন্ধ্যা হাজির হলো দু’টো ওয়ান টাইম কাপ নিয়ে। একটা গ্রীষ্মকে দিয়ে বলল,
-‘খালামণিকে দিন তো!’
গ্রীষ্ম হাতে নিয়ে হাসনাহেনা বেগমের দিকে দিল কাপটা। তিনি হাতে নিয়ে বলল,
-‘আহা! কি সুন্দর গন্ধ। লেবু দিসে?’
মৌসন্ধ্যা একটু জোরে বলল,
-‘না তোমার কাপে লেবু দিতে মানা করেছি। তুমি তো লেবু খাওনা।’
হাতের অন্য কাপটা এবার গ্রীষ্মকে দিয়ে সে বলল,
-‘চা টা খান। দেখবেন মাথা ব্যথা সেড়ে গেছে।’
মৌসন্ধ্যা চলে যেতেই গ্রীষ্ম হাসল। তার মাথা ব্যথা ছিল মৌসন্ধ্যার জন্যই। সেটা সত্যিই এখন সেড়ে গেছে। মৌসন্ধ্যার একটু সান্নিধ্যেই সে স্বস্তি অনুভব করছে। বর্ষা এসে হাসনাহেনা বেগম আর গ্রীষ্মকে বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে গেল। গ্রীষ্ম খেল না। সে তার ফুফুকেই দুইটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল।
২৪.
গাড়ি এখন হাইওয়েতে। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলায় ব্যস্ত। আষাঢ় আর শরৎ কানাডার আবহাওয়া নিয়ে কথা বলছে। আশ্বিন কথা বলতে বলতে ড্রাইভারের গোত্র ঠিকানা বের করে নিচ্ছে। তিন বোন চা ওয়ালার চায়ের প্রশংসা করছে। দশ মিনিট আগে শুরু করেছে। এখনও সেই কথা চলছে। অবশ্য এই চা ওয়ালার সাথে অন্য চা ওয়ালার চায়ের তুলনা করা হচ্ছে আপাতত। গ্রীষ্ম তাদের এইসব মেয়েলি কথা বার্তা না চাইতেও শুনছে। কি আর করার! এখান থেকে সরে যাওয়ার তো পথ নেই। পেছন ফিরে দেখল হাসনাহেনা বেগম আবারও গায়ে চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
তখনিই তার ফোনটা বেজে উঠল। সে দেখল তার বাবা কল করেছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তার বাবা বললেন,
-‘গ্রীষ্ম তোর বড় ফুফু কি তোদের গাড়িতে আছে?’
-‘হ্যাঁ বাবা। ফুফু আমাদের সাথেই।’
-‘আমরা আরো ভাবলাম বাড়িতেই রেখে আসছি। আচ্ছা শোন, তোরা কোথায় আছিস এখন!’
-‘হাইওয়েতে।’
-‘এখনও হাইওয়েতে? কি বলিস! রওনা হয়েছিস কখন?’
-‘তোমাদের যাওয়ার আধা ঘন্টা পরে।’
-‘আহ হা! এখন এতক্ষণ অপেক্ষা করব নাকি!’
-‘অপেক্ষা করবে মানে? তোমরা কোথায়?’
-‘আমরা তো মাহমুদের হোটেলে। খাবার খেতে বসেছি।’
-‘আমাদের সেখানে যেতে আরো চল্লিশ মিনিট লাগবে। ততক্ষণ তোমরা বসে থেকো না। দাদা দাদু বয়স্ক মানুষ। এভাবে এতক্ষণ জার্নি করলে অসুস্থ হয়ে যাবে। তোমরা খেয়ে চলে যাও। আমাদের জন্য অপেক্ষা করা লাগবেনা।’
-‘ঠিক আছে। তাহলে তোরা বাচ্চাগুলোর খেয়াল রাখিস।’
-‘বাচ্চা?’
-‘বর্ষা, চৈত্র, মৌ ওদের খেয়াল রাখিস।’
গ্রীষ্ম আড়চোখে তার বাবার বলা বাচ্চা গুলোর দিকে তাকালো। আহারে! বাচ্চা! সে বলল,
-‘চিন্তা করো না। বাচ্চাগুলোর খেয়াল রাখব।’
গাড়িতে বসে থাকা সবাই কথাগুলো শুনল। আষাঢ় বলল,
-‘কিরে বাচ্চারা! তোরা চকোলেট খাবি?’
আশ্বিন সামনে থেকে হাসতে লাগল। শরৎকেও দেখা গেল মুখ টিপে হাসছে। না হেসে উপায় আছে? এত বড় জোকস্!
গাড়ি যথাসময়ে হোটেলের পাশে থামানো হয়। সবাই ভাত খেয়ে নেয়। পৌঁছাতে আরো দেড় ঘন্টা। বর্ষা আর চৈত্র খেয়ে এসে আর বকবক করতে পারল না। ঘুমিয়ে পড়ল। মৌসন্ধ্যার শরীর ও ঘুম চাইছিল। তাই কিছু সময় পর সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল। ছেলেরা সবাই জেগেই রইল। শুনশান রাস্তায় তারা সবাই সতর্ক হয়ে ছিল। বলা তো যায় না কোথায়, কোন বি’প’দ উৎ পেতে আছে।
মৌসন্ধ্যার গাড়ির ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখল প্রবল বেগে গাড়ি চলছে। সে ভ’য় পেয়ে গেল। এত দ্রুত গাড়ি চললে তার বুক ধড়ফড় করে। সে আচানক চেঁচিয়ে বলল,
-‘এই আরেকটু ধীরে চালান।’
শরৎ এর চোখ লেগে আসছিল। মৌসন্ধ্যার কথা শুনে তার ঘুমটা উড়ে গেল। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ভাই! স্পীড কমান একটু।’
গ্রীষ্ম মৌসন্ধ্যার দিকেই সারা রাস্তা তাকিয়ে ছিল। তার ঘুমিয়ে পড়া, ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে ওঠা, আ’ত’ঙ্কিত হয়ে গাড়ির গতি কমানোর কথা বলা সবটাই সে দেখল। গাড়ির গতি কমেছে। তবুও তার মনে হলো মৌসন্ধ্যা ভ’য় পাচ্ছে। সে মৌসন্ধ্যার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল। বলল,
-‘জৈষ্ঠ্য! পানি খাও। ভ’য় পাচ্ছো কেন এত? ভ’য় পেও না।’
মৌসন্ধ্যা পানির বোতল নিল। পানি পান করার পরেও সে আর ঘুমাতে পারল না। বাকি রাস্তাটুকু জেগেই রইল। আবার যদি গতি বাড়িয়ে দেয়, সেই ভ’য়ে।
রাত বেশ গভীর। গাড়ি এসে থামে হাফিজ মির্জার দোতলা বাড়ির সামনে। সেখানে আরো কয়েকটা গাড়ি আগে থেকেই দাঁড় করানো। সবাই আরো আগেই এসেছে। একে একে সবাই গাড়ি থেকে নামল। হাসনাহেনা বেগমকে শরৎ ধরে নামায়। তাকে নিয়েই সে ভেতরে চলে গেল। যাওয়ার আগে মৌসন্ধ্যাকে বলল,
-‘এই ভীতুর ডিম! আমার ব্যাগটা নিয়ে আসবি।’
গেটের সামনে শ্রাবণ আর আহরার আগে থেকেই দাঁড়ানো ছিল। মৌসন্ধ্যাকে দেখেই আহরার এক গাল হাসে।
-‘ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি!’
-‘হ্যাঁ, একটু চোখ লেগে গিয়েছিল।’
গ্রীষ্ম দেখল মৌসন্ধ্যার চোখ একটু ফুলে আছে। দেখতে ভারি আদুরে লাগছে।
#চলবে।