জৈষ্ঠ্যের প্রেম পর্ব-১৪

0
320

#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-১৪)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

২৯.
বর্ষা বেশ বিচক্ষণ মানুষের মতো নাহুলকে পর্যবেক্ষণ করছে। লোকটা তার সামনেই বসে আছে বাবু সাহেব হয়ে। টিপটপ ভদ্রলোক বলা চলে তাকে। ফুল হাতা ধবধবে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরনে তার। চোখে খুবই সুন্দর ফ্রেমের চশমা। ঠোঁটে আছে কেমন এক ভালো মানুষি হাসি। না! লোকটা ম’ন্দ নয়। নিঃসন্দেহে সুপুরুষ বলা চলে। তবে বাহ্যিক রূপে ভোলা যাবে না। ভেতরে কি আছে জানতে হবে। রুমে আপাতত সে নাহুল আর মৌসন্ধ্যা রয়েছে। মৌসন্ধ্যা বর্ষাকে কথা বলতে দিয়ে নিজে ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলটা টেনে বর্ষার থেকে এক হাত পেছনে বসেছে। নাহুল সিঙ্গেল সোফাটায় আর বর্ষা তার মুখোমুখি পড়ার টেবিলের চেয়ারটা টেনে এনে বসেছে। নাহুল কিছুক্ষণ পর পরই মৌসন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে দেখছে আর মুঁচকি হাসছে। ইশ! এত ল’জ্জা তার! মৌসন্ধ্যা মনে মনেই তাকে বলছে,
-‘এতই ল’জ্জা যখন তো বিয়ে করতে চাস কেন বেকুব!’

বর্ষা গলা ঝেরে নাহুলের মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করল। নাহুল তার দিকে তাকাতেই বেশ গাম্ভীর্য ভাব নিজের মধ্যে এনে প্রশ্ন করল,
-‘আপনার নাম?’
-‘নাহুল শিকদার।’
-‘আর কোনো নাম নেই? শুধু নাহুল!’
-‘আসলে আরেকটা নাম আছে। বাড়িতে ডাকা হয়।’
কথাটা বলেই একটু ল’জ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল নাহুল। বর্ষা এই লাজুকলতা পুরুষকে দেখে হতভম্ব না হয়ে পারছেনা। এ সত্যিই ডাক্তার?

-‘আরেকটা নাম বলুন।’
-‘বলব?’
-‘হ্যাঁ! বলতেই তো বলছি।’
-‘বাবু।’
-‘কি বললেন!’
-‘না না আপনি রা’গ করবেন না। আপনাকে আমি এটা বলিনি যেটা বুঝছেন। আমার নামই বাবু।’
-‘ওহ আচ্ছা। তা বাবু বাবু, আপনার বয়স কত?’
-‘বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই।’

বর্ষা মৌসন্ধ্যার দিকে তাকালো। দুজনেই ইশারায় কথা বলল। যার ভাবার্থ হলো, দেখতে বোকা মনে হলেও আসলে চতুর। এমন লোক সাং’ঘা’তি’ক। বর্ষা নাহুলের দিকে তাকিয়ে বেশ শক্ত গলায় বলল,
-‘আমার বোনের বয়স আপনি জানেন?’
-‘জানি।’
-‘তবে তারও নিশ্চয়ই আপনার বয়স জানা দরকার।’
-‘ওহ হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। মা বলে আমার বয়স বেশি না। থার্টি থ্রী।’

বয়স শুনে বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা দুজনেই বিষম খেল। তার মানে এই লোক আবিরেরও বড়। দেখে আসলেই বোঝা যায় না। মৌসন্ধ্যা বিড়বিড় করে বলল,
-‘আহাগো, মার তেঁত্রিশ বছরের বুইড়া খোঁকা! না না সে তো বাবু। বাবু বাবু।’

নাহুল বুঝতে পারছে মেয়ে দুইটা তাকে আসলে কীভাবে ট্রিট করতে চাইছে। তবুও সে শক্ত থাকার প্রত্যয় গ্রহণ করেছে। এর আগেও এমন নার্ভাস হয়ে শেষমেষ বিয়ে গুলোর দফারফা অবস্থা করেছিল। এবারও তেমন হলে চলবেনা।
বর্ষা পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
-‘আপনি সত্যিই ডাক্তার তো? কোন হসপিটাল?’

নাহুল নিজের ভিজিটিং কার্ড বের করে দিল। বর্ষা হাতে নিয়ে দেখল। বাবা! এ তো বড় মাপের ডাক্তার। মনে হচ্ছেনা একে চাকমা দেওয়া যাবে। সে কার্ডটা মৌসন্ধ্যার দিকে পাস করে। মৌসন্ধ্যাও দেখল তবে আহামরি ভাবল না। সে বিয়ে করবেনা। এখন পাত্র রাজপুত্র হলেও সে ফিরিয়ে দিবে।

আবির আর সাবাব রুমে এসে নাহুলকে ডেকে নিয়ে গেল। নিচে খাবার খেতে ডাকছে সবাইকে। বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা রুমে খাবে বলল। তাদের খাবারটা সাবাব নিজে রুমে এসে দিয়ে গেল। এতে দুই বোন খুবই অবাক হলো। সাবাব কখনোই তাদের কোনো কাজ করে দেয় না আর দিত না। কিন্তু এখন সে নিজেই চাইছেনা মৌসন্ধ্যা নাহুলের আশেপাশে থাকুক। লোকটাকে তার বি’র’ক্ত লাগছে।

দুপুরে মৌসন্ধ্যার বাবা আর ভাই এলো। তাদের মা মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সবাই অনেক সাধার পরেও তাদের থাকার জন্য রাজি করাতে পারেনি। মূলত মৌসন্ধ্যা চাইছে যত জলদি পারে এখান থেকে বিদায় হতে। বর্ষা এত ক’ষ্ট পেল। সে মৌসন্ধ্যার বাবাকে বলল,
-‘ফুপা ও তো ঢাকা যাবে। আমরাও পরশু যাচ্ছি। আমাদের সাথেই যেতে পারবে। তাছাড়া একা একা যাওয়াটা ভালো হবে না।’
-‘না মা। একা নয়। মৃন্ময় বাড়িতে এসেছে। আগামীকাল চলে যাবে। এয়ার টিকেট কেটেও রেখেছে ছেলেটা। আজ ওদের নিয়ে যাচ্ছি কারণ ওর জেঠা অসুস্থ। তাকে একবার দেখে গেলে ভালো হয়। পরে কি হয়ে যায় বলা তো যায় না।’

এই কথার উপর আর কথা বলা যায় না। বর্ষা মন খা’রা’প করে ছাদে গিয়ে বসে থাকে। নাহুল ছাদেই ছিল। ছোট্ট গাছে এতগুলো আমড়া বিস্ময় নিয়ে দেখছিল। বর্ষাকে দেখতেই এগিয়ে গিয়ে বলল,
-‘আপনাদের ছাদটা দারুন। না শুধু ছাদ নয় পুরো বাড়িটাই দারুন। এই গাছটা কি সবসময় এমন ফল দেয়?’

বর্ষার জবাব দিতে ইচ্ছে করেনা তবুও ভদ্রতার খাতিরেই বলল,
-‘আমি জানিনা। আমরা ঢাকা থাকি। বাড়িতে আসা হয় না তেমন একটা। তবে আপনি সাবাব বা শরৎ ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। এগুলো বোধ হয় তারা কেউ লাগিয়েছে।’
-‘ওহ আচ্ছা।’

নাহুল তার পাশেই সিমেন্টের সোফাটায় বসল। বর্ষার এবার রা’গ হচ্ছে। লোকটা যাচ্ছে না কেন? সে বলল,
-‘আপনি এই গরমে ছাদে কি করছেন?’
নাহুল হেসে বলল,
-‘কি আর করব? একা একা ভালো লাগছেনা। কেউ কথা বলার মতো নেই। তাই আমি ছাদেই ঘুরঘুর করছি।’

বর্ষা ল’জ্জিত হলো। আসলেই তো। লোকটা একা হয়ে আছে। কথা বলার মতো কেউ নেই। ভাইরা সবাই বড় রাস্তার মোড়ে গেছে। সামুদ্রিক মাছ আনতে। আজ নাকি কক্সবাজার থেকে সব মাছ আনা হয়েছে। নাহুল গেস্ট বলে তাকে নেয় নি সাথে। আবিরও গিয়েছে। আসলে সেটা নয়। বর্ষা বুঝতে পারছে তার ভাইয়েরা ইচ্ছাকৃত ভাবেই লোকটাকে নেয়নি। যদিও কারণটা সে জানেনা। বর্ষা বলল,
-‘আমড়া মাখা খাবেন?’
নাহুল আনমনে গাছপালা দেখছিল। বর্ষার কথা শুনে চমকে বলল,
-‘কি’!’
-‘বললাম আমড়া মাখ খাবেন? শুকনা মরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে?’
-‘আপনি মাখাবেন?’
-‘আর কে করবে?’
-‘খাব।’

বর্ষা হেসে বলল,
-‘বসুন। আমি যাব আর আসব। একদম নড়বেন না এখান থেকে।’

চার পাঁচটা আমড়া ছিড়ে নিয়ে গেল বর্ষা। নাহুল মুঁচকি হাসে। মেয়েটাকে সে ভেবেছিল বেশ ম্যুডি। কিন্তু আদৌতে তা নয়। মেয়েটা ছটফটে। আর সে যা ভেবেছিল তা ভাবার কারণ একটা আবরণ। আবরণের জন্য আসল বর্ষা সে প্রথমে চিনে উঠতে পারেনি।

বর্ষা অল্প সময় লাগবে বললেও দশ মিনিট লাগিয়ে দিল। তবে আমড়া মাখাটা দুর্দান্ত হয়েছে। নাহুলের এত ভালো লাগল!

দুপুরের খাবার খেয়ে মৌসন্ধ্যারা চলে গেল। যাওয়ার আগে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে তার রা’গ ভাঙায়। বর্ষাও আর কিছু মনে রাখেনা। বলল ঢাকায় ফিরে দেখা করবে সবার আগে।

ছেলেরা সবাই যখন বাড়ি ফিরল তখন তিনটা বাজে। মৌসন্ধ্যারা চলে গেছে শুনে গ্রীষ্মর ভীষণ খা’রা’প লাগে। বিকেলে জুন, আবির আর নাহুল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যাওয়ার আগে নাহুল বর্ষাকে বলল,
-‘আমি আপনাকে কল দিলে আপনি কি কিছু মনে করবেন?’
-‘না।’
-‘একটা কথা বলব?’
-‘বলুন।’
-‘জানিনা বলা ঠিক হবে কিনা তবুও আমার মনে হচ্ছে না বললে শান্তি পাব না।’
-‘একটা কথা বলবেন বলে বেশিই বলে ফেলছেন।’
-‘ওহ সরি। আসলে বলতে চাইছি আপনি বেশ ভালো।’

বর্ষা ঠোঁট টিপে হাসল।
-‘তাই?’
-‘হ্যাঁ।’

নাহুল হঠাৎ করেই পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বর্ষার হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর দ্রুত বেগে গাড়িতে গিয়ে বসে। বর্ষা কাগজটা খুলেই চমকে উঠল। তাতে লেখা,

“বর্ষা,

প্রিয় বলে সম্মোধন করব কিনা এটা ভেবেই আমি বেশ সময় পার করে দিয়েছি। শেষে কিছু না পেয়ে শুধু নামটাই রাখলাম। আপনার হাতের আমড়া মাখার মতো মজাদার আমড়া মাখা আমি আর কোথাও, কখনো খাইনি। আপনার স্বামী যিনি হবেন তিনি নিঃসন্দেহে লাকি। আমার ধারণা আপনার রান্নার হাতও ভালো।

বর্ষা? আমার মনে হচ্ছে আমি একটা সুযোগ পেয়েছি। আর আমি সেই সুযোগের যথাযথ ব্যবহার করতে চাইছি।

বর্ষা, আপনি কি সারা জীবন আমার জন্য আমড়া মাখা বানানোর দায়িত্ব নিবেন?

ইতি
বাবু বাবু।”

বর্ষার চোখের কোণে অশ্রু জমাট বাঁধে। বেকুব লোকটা চিঠিও সুন্দর করে লিখতে পারেনা। এক চিঠিতে তিনবার বর্ষা বলল। চিঠির কথা গুলোও বোকা বোকা। তবুও! এত ভালো কেন লাগছে?

সে ছুটে গেল নিচে। গাড়ি স্টার্ট দিবে এই সময়ে সে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নাহুল একটু ভ’য় পেয়ে গেল। বর্ষা কি এবার তাকে অ’প’মা’ন করবে? এক বোনকে দেখতে এসে আরেক বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটা নিশ্চয়ই ভালো কাজ নয়। বর্ষা ইশারায় তাকে গাড়ি থেকে নামতে বললে সে নামল। বর্ষা এগিয়ে এসে বলল,
-‘আপনি এত বেকুব কেন?’
-‘সরি। ক্ষ’মা করবেন। আমার খুব বড় একটা ভুল হয়েছে। আপনি চাইলে আমি আর কখনো কিছুই বলব না।’

বর্ষার হাসি পেলেও দমিয়ে রেখে বলল,
-‘আমি আমড়া মাখা ভালো বানালেও রান্নায় লবডঙ্কা। কিচ্ছু পারিনা। আপনার প্রেডিকশন তো দেখছি ভালো না। যাই হোক। রান্না নাহয় পরে শিখে নিব। চলবে?’

নাহুল বুঝতে পারল না বর্ষা হ্যাঁ বলল নাকি না। বর্ষা নাহুলের হাত ধরে তার বাবার কাছে নিয়ে গেল। বলল,
-‘বাবা উনি আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন। তোমার মত কী!’

বর্ষার বাবা হতভম্ব হয়ে গেল আর নাহুল বড় ধরনের ল’জ্জা পেল। হাফিজ মির্জা পাশেই ছিলেন। তিনি বললেন,
-‘তোমার কি মতামত বর্ষাকাল!’
-‘আমি রাজি।’

অতঃপর বর্ষা আর নাহুলের বিয়ে ঠিক হলো। নাহুলের মা আপত্তি করলেন না। তার বর্ষাকেও পছন্দই বলা যায়। তবে ছেলের কাজে তিনি ল’জ্জিত। এক জনকে দেখতে পাঠালেন আর তার ছেলে পছন্দ করে ফেলল আরেকজনকে। একেই হয়তো বলে নিয়তি। আশ্চর্যরকম ভাবে বর্ষার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর নাহুল বাড়ির ছেলেদের থেকেও এক্সট্রা যত্ন আত্মি পেল। সাবাব পারে না যেন তার পা ধুঁয়েই পানি খেয়ে ফেলে এমন করছে।

বর্ষার বিয়ে দুই মাস পর হবে। এখন সবাই ব্যস্ত। বিয়ের অনুষ্ঠান বড় করে করবেন বর্ষার বাবা। তাই তাড়াহুড়ো করলেন না। নাহুলের মা সেদিনই প্লেনে চট্টগ্রামে আসে সেখান থেকে গাড়ি করে ফেনীতে। এসে বর্ষার হাতে রিং পরিয়ে দিলেন। মৌসন্ধ্যা চট্টগ্রামে বসে সেই খবর পেয়ে চমকে উঠল। তবে তার ভালোও লাগল। বর্ষা যে ভীষণ খুশি তা তার কথা শুনেই মনে হচ্ছিল। তবে মৌসন্ধ্যা এটাও ভাবল হঠাৎ করে এত ভালোবাসা কীভাবে তৈরি হলো! ব্যাপার কী?’

৩০.
সেদিন নাহুলরা সবাই চলে যাওয়ার পর গ্রীষ্ম তার মায়ের রুমে গেল। তার বাবাও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সে ভণিতা ছাড়াই বলল,
-‘বাবা! আমার একটা কথা বলার ছিল।’
-‘হ্যাঁ বলো।’
-‘বাবা আমি বিয়ে করতে চাই।’
গ্রীষ্মের বাবা হেসে বললেন,
-‘বাহ! বেশ ভালো কথা। পছন্দ আছে তোমার?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘কে?’
-‘জৈষ্ঠ্য।’
-‘জৈষ্ঠ্য?’
-‘মৌসন্ধ্যা।’
-‘মানে? কি বলছ?’

এবার গ্রীষ্মের মা বেশ ক্ষি’প্ত হয়ে ওঠেন। বললেন,
-‘তোমার ছেলের মাথায় ভূত চেপেছে। সে ঐ চামেলির মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে। আমি বারণ করা স্বত্তেও আবার সে কি করে ওই মেয়েকে বিয়ে করার কথা ভাবে?’
-‘গ্রীষ্ম! মৌ তোমার বোন হয়।’
-‘বাবা, সে আমার আপন বোন হয় না। আমাদের বিয়ে ইসলামে জায়েজ আছে।’

বর্ষা তখন রুমে ঢুকল। সে এসেছিল গ্রীষ্মর মাকে ডাকতে। কিন্তু তখনই একটা কথা শুনে সে থেমে যায়। গ্রীষ্মের মা বসা থেকে উঠে বললেন,
-‘জায়েজ নাজায়েজ তোমার থেকে আমাদের শিখতে হবে নাকি? তোমাকে যা বলছি তুমি তা-ই শুনবে। ওই চামেলির মেয়েকে আমি পুত্রবধূ হিসেবে মানব ন। কি আছে ওর মধ্যে! তোমার জন্য কত ভালো ভালো ঘরের মেয়ে অপেক্ষা করছে আর তুমি কিনা এরকম মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছ! আমি আগেই বলছি আর এখনও বলছি ওদের সাথে আমাদের ক্লাস মেইনটেইন করা যাবেনা।’

গ্রীষ্মের বাবা চুপ করে রইলেন। তার মুখে কোন কথা নেই। গ্রীষ্ম বলল,
-‘মা আমি ওকে ভালোবাসি।’
-‘কীসের ভালোবাসার কথা বলছ তুমি? আর তোমার ভালোবাসা এত সস্তা নাকি! যে অপাত্রে দান করছ!’
-‘মা!’

গ্রীষ্মের চোখ গেল বর্ষার হাতের ফোনের স্ক্রীনে। মাত্রই সেখানে হঠাৎ মৌসন্ধ্যার ছবি জ্ব’ল’জ্ব’ল করে উঠে আবার সরে গেল। অর্থাৎ এতক্ষণ মৌসন্ধ্যা কলে ছিল। তারমানে সে সব শুনে ফেলেছে! সে অসহায় চোখে বর্ষার দিকে তাকালো। বর্ষাও ঘাবড়ে গেল। সে মৌসন্ধ্যার কথা ভুলেই বসেছিল। সে নিজেও ভাইয়ের দিকে তাকালো অনুতপ্ত হয়ে। পেছন ফিরে চলে আসতেই দেখল দরজায় শরৎ দাঁড়িয়ে। তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। বর্ষা ভ’য় পেয়ে গেল। লক্ষণ ভালো নয়। ক্ষ্যা’পা রে’গেছে। ভীষণ ভাবে!

শরৎ রুমে প্রবেশ করল। বর্ষা তা দেখেই দৌঁড়ে গেল সাবাবদের ডাকতে। শরৎ রুমে ঢুকেই বলল,
-‘প্রথমেই দুঃখীত যে আমি আপনাদের কথা গুলো শুনে ফেলেছি। আড়ি পাতা আমার স্বভাব নয়। তবে আমার কানে যে কথা গুলো এসেছে সেগুলো ফেলে দিয়ে চলে যাওয়ার মতো নয়। বড় আব্বু! এই মাত্র বড় আম্মু বললেন যে ফুফুদের সাথে আপনাদের ক্লাস ম্যাচ করেনা। আমি জানতে চাইছি এই ফুফু কি আপনার বোন নয়? এক মায়ের পেট থেকেই কি আপনারা জন্ম নেন নাই? না মানে ভাই বোনের তো কোনো ক্লাস থাকেনা। তারা সবাই সমান। তবে? আপনি কীভাবে এমন একটা কথা শুনেও চুপ করে রয়েছেন যেখানে আপনারই মায়ের পেটের ছোট বোনকে আর তার পরিবারকে অ’প’মা’ন করে কথা বলা হচ্ছে!’

শেষের কথাটা এত জোরে বলা হলো তার ফলে বোধ হয় ঘরটাই কেঁপে উঠল। তখন রুমে শ্রাবণ, মুকিত আর সাবাব হাজির। তারা শরৎকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। শরৎ এবার গ্রীষ্মের দিকে তাকালো,
-‘এই! তুমি কোন আক্কেলে মৌসন্ধ্যার দিকে নজর দাও! ও না তোমার বোন হয়? তবে কেন? আর পছন্দই যখন হলো তখন তোমাদের ক্লাসের কথা ভাবলে না কেন? গুলশান বনানীতে রয়েছ বলে কি তোমাদের ক্লাস বেড়ে গিয়েছে? গোড়া ভুলে গেছ? কোথা থেকে জন্ম সেটা ভুলেছ?’

সবাই বুঝতে পারছে গ্রীষ্মের মাধ্যমে শরৎ কথাগুলো গ্রীষ্মের মায়ের উদ্দেশ্যেই বলছেন। তিনি এত রে’গে গেলেন! এদিকে চেঁচামেচি শুনে সবাই হাজির। হাফিজ মির্জা আসতেই গ্রীষ্মের মা বিচার দিয়ে বসলেন শরৎ এর নামে। শরৎ এর বাবা এসে ছেলেকে জোরে এক থা’প্প’ড় মা’রেন। যদিও তিনি জানেন ছেলে ভুল নয় তবুও বে’য়া’দ’বি হয়ে গেছে। গ্রীষ্ম সহ বাকিরা শরৎকে সেখান থেকে নিয়ে গেল। আষাঢ় বাড়িতে নেই। সে বিকেলে ঢাকা রওনা হয়েছে সাথে অবশ্য আশ্বিনকেও নিয়ে গেছে। এমার্জেন্সী কানাডা ব্যাক করতে হবে তাকে। আর সে থাকলে হয়তো ঘটনা আরো বাড়ত।

শরৎকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে শ্রাবণ আর সাবাবরা বোঝালো। শরৎ রে’গে লাল হয়ে আছে এখনো। সে চিৎকার করে বলল,
-‘মৌ আমাদের বোন! বোনের দিকে এইরকম নজর ও কীভাবে দেয়? আর তার পছন্দের জন্য মৌ কে কেন কথা শুনতে হবে? সে কি বলেছিল যে তাকে পছন্দ করতে? কীভাবে পারে ছোট বোনের দিকে ওইরকম নজর দিতে!’

শ্রাবণ কখনো রা’গে না। বরাবরই খোশ মেজাজের সে। তবে আজ সেও রে’গে গেল। বেশ জোরে ধ’ম’কে বলল,
-‘তুই বোন ভাবিস বলে আর সবাইকে বোন ভাবতে হবে তা নয় শরৎ। সে কিন্তু আমাদের কারো আপন বোন হয় না। মামাতো ফুপাতো ভাই বোনের বিয়ে নতুন কিছু নয়। তুই মৌকে বোনের নজরে দেখিস গ্রীষ্ম ভাই দেখে না। এটা দো’ষের তো নয়!’

সাবাবও সায় জানালো।
-‘ভাই গ্রীষ্ম ভাই সত্যি সত্যি মৌকে ভালোবাসে। আমাদের উচিত তাদের এক করা।’

শরৎ কিছু বলল না। চুপ করে রইল। শ্রাবণ সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। শরৎ এর ছোট বোনের খুব শখ ছিল। সাবাব যখন পেটে সবাই তখন শরৎ আর আশ্বিনকে বলল বোন হবে। বোন হওয়ার খুশিতে দুই ভাই আত্মহারা হয়ে ওঠে। দিন যায় তারাও জানতে পারল বোন নয় ভাই হবে। সে কি কান্না দুই ভাইয়ের! সাবাব হলো। কিন্তু তাদের মায়ের নানান জটিলতা দেখা যাওয়াতে বলা হলো আর বাচ্চা হবে না। এই কথাটা শরৎ কোনো ভাবে শুনে ফেলে। বিছানায় পড়ে কত কান্না করল সে। তার কয়েক মাস পরের ঘটনা। একদিন সকালে বাবা তাকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠায়। তিনি ছেলেকে বললেন,
-‘তোমার জন্য উপহার আছে আব্বু। ঝটপট তৈরি হও তো। এক জায়গায় যাব আমরা।’

খুশিমনে শরৎ তৈরি হলো। উপহার পেতে তার ভালো লাগে। বাবা তাকে নিয়ে গেলেন হসপিটালে। এই হসপিটালে সাবাব হয়েছিল। তার মনে আছে। সে বাবার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। বাবা তাকে একটা কেবিনে নিয়ে গেল। সেখানে তার দাদু ফুফুরা ছিল। চামেলি ফুফু শুয়ে আছেন। পাশেই ছোট্ট একটা বাচ্চা। এত সুন্দর! সে হা করে তাকিয়ে ছিল। বাবা তাকে সোফায় বসিয়ে তার কোলে সেই ছোট্ট বাচ্চাটাকে দিল। বলল,
-‘বাবা এই নাও। তোমার বোন।’

ছোট্ট বোন পেয়ে শরৎ আবারও কাঁদে। দিন যেতেই আবার আরেকটা বোন হলো। সেই বোনটাও তাকে দিয়ে বলা হলো তোমার আরেকটা বোন। সেই দুই বোন তার অতি আদরের। আজ পর্যন্ত সেই দুই বোনকে সে চোখে হারায়। তাদের এত এত ভালোবাসে। অথচ গোপনে। মুখ ফুঁটে বলেনা এমনকি বুঝতেও দেয় না। বোনগুলো তাকে ভ’য় পায়। আড়ালে ক্ষ্যা’পা ডাকে সেটাও সে জানে। তবুও কিছু বলে না। তার ভীষণ ভালো লাগে। বর্ষা যখন সেদিন বলল,
-‘নিজের ভাই বলে তাকে বকো না। বুঝি তো সব।’
কথাটা শুনে সে আ’হ’ত হয়েছিল। বারবার তার মনে হতে লাগল সত্যিই কি সে বৈষম্য করছে? ভেতরে ভেতরে একটা য’ন্ত্র’নায় সে ছটফট করতে থাকে।

আর আজ! আজ তার আরেকটা বোনকে বলা হলো ক্লাস নেই তার। কীসের ক্লাস! কোথাকার ক্লাস! তার বোনদের ক্লাস নিয়ে কথা বলা মানুষ কোনো মানুষেত কাতারেই পড়ে না। সা’হ’স কত বড়! গ্রীষ্মের জন্য মৌকে এত কথা শুনতে হলো। তাই তার সব রা’গ গিয়ে পড়ল গ্রীষ্মের উপর।

মৌসন্ধ্যা তার রুমের বারান্দায় বসে আছে। আজকের আকাশে চাঁদ নেই। একলা আকাশ! সে একমনে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। একটু আগে যা শুনল তা শোনার পর থেকেই ক্ষণে ক্ষণে তার চোখ ফেঁটে জল পড়ছে। আদৌ কি সে এসব কথা শোনার যোগ্য! গ্রীষ্ম! গ্রীষ্ম কেন এলো তার জীবনে? আজ তার মাকে, তার বাবাকে, তার পরিবারকে এত কথা শুনতে হলো কেবল গ্রীষ্মের ভালোবাসা নামক অনুভূতির জন্য। আজ এই মুহূর্ত থেকে গ্রীষ্মকে সে ঘৃণা করে এবং তারই সাথে তার মামা আর মামীকেও।

বর্ষা একের পর এক কল দিচ্ছে। মৌসন্ধ্যা ফোনটা সাইলেন্ট করে বিছানায় ছুড়ে মারল। সে যে ল’জ্জায় আর অ’প’মা’নে ম’রে যাচ্ছে। বারবার দূরে থাকা গ্রীষ্মকেই আপনমনে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘আপনি এমনটা না করলেও পারতেন। আপনাকে আমি অপছন্দ করি। আপনি আমার পছন্দের তালিকায় ছিলেন না আর থাকবেনও না কখনো। আজ এখন থেকে আপনাকে আমার জীবন থেকেও বাতিল করলাম। আপনি বাতিলুন, বাতিলুন, বাতিলুন।’

#চলবে।