জোৎস্না রাতে তুমি আর আমি পর্ব-০৪

0
2

#জোৎস্না_রাতে_তুমি_আর_আমি — [৪]
লেখনীতে;- #রুদ্রিকা_বেদী

দ্যূতির গন্তব্য এসে থেমেছে চৌধুরী ইন্ড্রাস্ট্রির বিশাল বিলাসবহুল ভবনটির সামনে। আজ তার কাজের প্রথম দিন। দ্যূতির চাকরিতে জয়েন করার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না। নিজেকে নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করিয়ে এখানে এসেছে। তার কাজ এখানে চাকরি করা, কাজ শেখা এবং তার বেস্টটা দেওয়া আর প্রতি মাসে বেতন ঘরে নিয়ে যাওয়া।

দ্যূতি আজ বেবি ব্লু কালারের একটা কুর্তি পড়েছে। চুলগুলো আজ কেন জানি খুলেই রেখেছে। হাতে ওয়াচ। চোখে হালকা কাজল,বেশি নয়। ঠোঁটে পিংক লিপস্টিক হালকা করে আঙ্গুল দিয়ে ঘষে দেওয়া। দ্যূতি ভিতরে ঢোকার আগে লম্বা করে শ্বাস নিলো। যতই হোক, কাজের জায়গায় প্রথম দিন আজ তার, ভয় একটু একটু হচ্ছে তার মধ্যে। আসার আগে সে পিউয়ের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। পিউ দ্যূতিকে যথাযথ মনোবল দেওয়ার প্রচেষ্টা করেছে। দ্যূতি সেই মনোবল ধরেই এক কদম বাড়ালো কাঁচের মুখ্যদ্বারের দিকে……
.
__”মিস্ দেবাদৃতা দ্যূতিকে মিস্টার খানের আন্ডারে দেন।”

অফিসের নিজের কেবিনে নিজের আরামদায়ক চেয়ারে মাথা হেলিয়ে বসে আছে আরুশ চৌধুরী। পিছনে শিহাব হাতে ট্যাবলেট নিয়ে দাঁড়িয়ে। আরুশের টেবিলের অপর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মিস্টার খালেদ। আজ তার মুখে কোনো হাসি নেই রয়েছে এক আকাশ ভর্তি অবাক করে দেওয়া বিস্ময়কর চাহনি।

__”কিন্তু স্যার,, মিস্টার খান একজন রগচটা মানুষ! আমরাই তার সাথে কাজ করতে যেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠি সে জায়গায় মেয়েটা তো বাচ্চা! প্রথম দিনেই কাজ রেখে পালিয়ে যাবে….!”

আরুশ সোজা হয়ে বসে। খালেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,

__”আপনার কথা মানছি কিন্তু মিস্টার খান যে নিজের সেক্টরে সর্বশ্রেষ্ঠ সেটা তো মানছেন?”

__”মানছি স্যার কিন্তু….”

__”মানছেন যেহেতু আর কিন্তু নয়, নিজেকে বেস্ট করে তোলার জন্য ওমর একজন শিক্ষকের প্রয়োজন সবার! তাই এই বিষয়ে আর আলোচনা নয়।”

__”ওকে স্যার….?”

মিস্টার খালেদ কাচুমাচু মুখে জবাব দিলো। আরুশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দরজার কাছে পৌঁছাতে আরুশ পুনরায় ডাক দিলো,

__”মিস্টার খালেদ!”

মিস্টার খালেদ পিছনে ফিরে তাকাই। মুখে হাসি আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল,

__”জ্বী স্যার….!”

আরুশ কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে শেষমেশ বলে,

__”মিস্ দেবাদৃতা দ্যূতি অফিসে আসলে আমার কেবিনে যেন পাঠানো হয় তাকে….”

মিস্টার খালেদ সহজ সরল লোক। তিনি কারো আগেও থাকে না কারো পিছনেও থাকে না কিন্তু আরুশের এহেন ধরনের আচরণ তার মনে সন্দেহ তৈরি করছে। তিনি জীর্ণ কন্ঠে বলল,

__”ওকে স্যার…”

বলে চলে গেলেন। শিহাব নিঃশব্দে দুই কদম এগিয়ে এসে আরুশের সামনে দাঁড়ালো। মুখে একটা সন্দেহ ভাব রয়েছে। আরুশ সেই দিকে লক্ষ্য করে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

__”কি সমস্যা?”

শিহাব একগাল হাসে, কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বলে,

__”স্যার কিছু মনে না করলে পাঁচটা কথা বলি…?”

__”মানুষ দুইটা কথা বলে তুই পাঁচ কথা বলবি?”

__”যারা দুইটা কথা’র কথা বলে তারা আসলে বোকা বানাই। আমি মানুষটা সরল সোজা তাই আমি সোজাসুজি পাঁচ কথা বললাম….!”

মুখের হাসি বজায় রেখেই কথা গুলো বলে। আরুশ শিহাবের দিক থেকে চোখ সরিয়ে টেবিলের উপর রাখা সবুজ ফাইলের উপর রাখল। সেটা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে দেখতে বলল,

__”তুই অলরেডি পাঁচ কথা বলে ফেলেছিস যাইহোক যা বলবি বলে ফেল!”

আরুশের অনুমতি পেতেই শিহাব কাঠ কাঠ হয়ে দাঁড়ালো। তার মনের অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বলে,

__”স্যার আপনি কি প্রেমে পড়েছেন?”

শিহাবের প্রশ্ন আরুশের কানে আসতেই আরুশ খানিক বিষম খেলো। শিহাব সঙ্গে সঙ্গে এক গাল ভরা হাসি নিয়ে টেবিলের উপর থেকে জলের গ্লাসটি এগিয়ে দিলো আরুশের দিকে। শিহাবের দিকে তাকিয়ে গ্লাসটি নিতে নিতে আরুশের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। হাতের গ্লাস থেকে জল পান করে শিহাব দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

__”হঠাৎ এমনটা মনে হওয়ার কারণ জানতে পারি?”

শিহাব প্রস্তুতই ছিল। আরুশ জিজ্ঞেস করার সঙ্গে শিহাব বলল,

__”সবারই এইটাই মনে হচ্ছে স্যার! কয়েক দিন ধরেই আপনার হাবভাব অন্যরকম…”

__”অন্যরকম মানে??” ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করল আরুশ।

__”আপনার মুখে হাসি লেগেই থাকে সারাক্ষণ। অন্য জগতে থাকেন। এই সবই প্রেমে পরার লক্ষন!”

আরুশ জলের গ্লাস তুলে নিলো আবার। তাতে ছোট চুমুক দিয়ে বলল,

__”মাথায় এই সব চলেই বলে কাজে মন বসে না তাই তো?”

__”কার স্যার? আপনার?” আরুশের দিকে হালকা ঝুঁকে আসলো শিহাব।

__”তোর কথা বলছি শিহাব!!”

আরুশ তিরস্কারের সুরে বলল। শিহাবের সব উৎসাহ একবারে জল হয়ে গড়িয়ে গেলো মাটিতে। আরুশ উঠে দাঁড়ালো। আরুশকে উঠে দাঁড়াতে দেখে শিহাব পিছনে দু কদম পিছিয়ে গেলো। আরুশ শিহাবের দিকে হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ওর কাঁধ চাপড় দিয়ে বলে,

__”কাজে মনোযোগ দে নাহলে তোর চাকরি কিন্তু খেয়ে ফেলবো!”

শিহাব ঢোক গিলে আরুশের দিকে তাকালো। শক্ত চোয়াল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সব মিলিয়ে আরুশকে শিহাবের কাছে ভয়ংকর লাগছে। শিহাব মনে মনে ভাবল,

__”আমারই তো চাকরি খাবে তুমি! প্রেমিকাকে তো ভরে ভরে দিবে!”

__”কথা কানে যাচ্ছে?”

আরুশের বাণীতে শিহাবের জ্ঞান ফিরল। শিহাব আড় চোখে নিজ কাঁধে আরুশের হাতের উপর দৃষ্টি ফেলিয়ে কাতর স্বরে অনুরোধের ভঙ্গিতে শুধালো,

__”যাচ্ছে স্যার! এখন কাজে যাই?”

আরুশ হাত সরিয়ে ফেলল। চোখের ইশারায় অনুমতি দিয়ে পুনরায় নিজের আসনে বসল।
.
দ্যূতি ম্যানেজারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ম্যানেজার মিস্টার রাশেদ হাসান দ্যূতিকে পাঁচ মিনিট ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে নিজ কেবিনে। দ্যূতি চুপ করে পুরো রুমটাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কি সুন্দর করে পুরো কেবিনটি সাজানো। সুন্দর কেবিনে ঠিক মানাচ্ছে না দ্যূতির সামনে বসে থাকা গোল গাল চেহারার বেটে লোকটা! দেখলেই অনিহা জাগে মনে। দ্যূতিকে কখন থেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে! কিছু বলতেও পারছে না।

হঠাৎ কেবিনে নক করে ঢুকল একটি সুন্দরী মেয়ে। দ্যূতি তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ মনোমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো। গোলাপী ফর্সা গায়ের রং, বড়ো বড়ো চোখ। কালো মণি এবং পদ্মপল্লব বিশিষ্ট পাপড়ি। চিকন সরু নাক, গাঢ় গোলাপি ঠোঁট। কাঁধ অব্দি চুল। পরণে গোলাপী কালারের থ্রি পিস। গলায় অফিসের আইডি কার্ড ঝুলছে। তাতে লেখা রয়েছে ‘মিথিলা রহমান মিলি’।
মিলি দ্যূতির পাশে দাঁড়ালো। দ্যূতিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হাসল। দ্যূতিও প্রতি উত্তরে হাসে।

মিলি সামনে তাকিয়ে ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বলল,

__”স্যার!,, আপনাকে সেই কখন এই ফাইলটিতে সই করতে বলেছিলাম আপনি এখনো করেন নি!?”

ম্যানেজারের সামনে পরে থাকা ফাইলের দিকে ইশারা করে দেখালো মিলি। ম্যানেজার সাহেব চোখ তুলে ফাইলটির দিকে তাকালো।ম্যানেজার সাহেব নিজ জিহ্বায় কামড় বসিয়ে এমন একটা মুখ করলেন যেন তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভুলটা করেছেন।

__”একদম ভুলে গিয়েছি! দাঁড়াও এক্ষুনি করে দিচ্ছি !”

ম্যানেজার সাহেব কথাটা বলে ফাইলটি তুলে নিলেন। দুই মিনিটেই মধ্যে সকল পেপারে সিগনেচার করে মিলির দিকে বাড়িয়ে দিলো। মিলি ফাইলটি নিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে শুকরিয়া জানিয়ে বিদায় নিবে তখন ম্যানেজার মিস্টার রাশেদ হাসান দ্যূতির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন,

__”মিলি দাঁড়াও! এই মেয়েটিকেও সঙ্গে নিয়ে যাও। একে স্যারের কেবিনে দিয়ে আসবে!”

মিলি দ্যূতির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সাঁই দেয়। ম্যানেজার সাহেব দ্যূতির দিকে বললেন,

__”এই মেয়ে! মিলি তোমাকে স্যারের কেবিনে নিয়ে যাবে। স্যারের কেবিনে ভদ্র ভাবে ঢুকবে! আদব কায়দা মেনে চলবে এবং স্যার যা জিজ্ঞেস করবেন তার উত্তর সোজাসুজি দিবে!”

বলে তিনি আবার নিজের কাগজ পত্রে মনোনিবেশ করলেন। দ্যূতি নরম গলায় বলল,

__”জ্বী স্যার! স্যার আরেক কথা ছিল,!”

ম্যানেজার সাহেব চোখ তুলে তাকিয়ে কড়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

__”কী?”

__”আমার মা-বাবা আমাকে ভালবাসে একটা নাম দিয়েছে। ‘দেবাদৃতা’ এই নাম বলতে মানুষের কষ্ট হয়ে যায় বলে তারা ‘দ্যূতি’ বলে ডাক-নাম দিয়েছে। তো আশা করি সামনের দিন থেকে আপনিও আদব কায়দা মেনে আমাকে আমার নাম ধরে ভদ্র ভাবে ডাকবেন!”

বলে চওড়া হাসি হেসে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল,

__”চলেন!”

বলে দ্যূতি বেড়িয়ে গেলো কেবিন থেকে। মিলি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ম্যানেজার সাহেবের দিকে তাকালো। তার গোলগাল চেহারা রাগে লাল হয়ে পড়েছে। মিলি ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,

__”সরি স্যার!”

বলে এক মুহুর্তের জন্য দাঁড়ালো না ওখানে। বেড়িয়ে আসল। বাইরে আসতেই দ্যূতিকে দরজার কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো মিলি। মিলি গুটি গুটি পায়ে দ্যূতির কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। দ্যূতি চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মিলি আস্তে করে দ্যূতির কাঁধে হাত রেখে বলে,

__”রাগ করো না!”

দ্যূতি চোখ মেলে তাকাই তার দিকে। মিলি ভ্রু কুঁচকে হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দ্যূতিকে নিজেকে সংযত করে বিধুর কন্ঠে বলে,

__”সরি! আমি আসলে নিজেকে সামলাতে পারেনি!”

__”আমাকে সরি বলছ কেন? আসলে স্যার একটু ওইরকমই। কাকে কী বলে নিজেও জানেন না! এই যে তোমার সাথে ঝামেলা হলো কিছুদিন পর দেখবে তোমার সাথেই সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।”

__”উনার মতো মানুষের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার কোনো ইচ্ছা নাই!”

মিলির কথার প্রতিবাদ করে বলল দ্যূতি। মিলি আর কথা বাড়ালো না। দ্যূতিকে সঙ্গে নিয়ে আরুশের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো মিলি। এই কয়েক মিনিটে দ্যূতির সঙ্গে সখ্যতা করে ফেলেছে মিলি। দ্যূতি বুঝলো মিলি ভীষণ মিশুকে। মিলি দ্যূতিকে আরুশের কেবিনের কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে গলার কন্ঠ স্বর একদম খাদে নামিয়ে ফিস ফিস করে বলে,

__”স্যার কিন্তু অনেক রাগী! ভিতরে একটু সাবধানে কথা বলো। আমি এখন যাই! একটা কাজ বাকি আছে, তুমি স্যারের সামনে হাজিরা দিয়ে নিচে চলে এসো। আমি ওখানেই থাকবো….”

দ্যূতি বুঝতে পেরেছে এমন ভাব করে মাথা নাড়ালো। মিলি মিষ্টি করে হেসে নিচে চলে গেলো। মিলি নিচে চলে যাওয়া পর্যন্ত দ্যূতি অপেক্ষা করতে লাগল। মিলি যেতেই মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,

__”ভিতরে যেয়ে নিজের মুখটাকে কন্ট্রোলে রাখিস দ্যূতি। যখন তখন আবার ছাগল বলে ফেলিস না অভদ্র লোকটার সামনে। পিউ আপি তোকে বারবার করে বারণ করে দিয়েছে ‘ছাগল’ শব্দ উচ্চারণ করতে। নিজেকে সংযত রাখবি!”

নিজেকে শুনালো দ্যূতি। পিউ ওকে বারবার করে সাবধান করে দিয়েছে। পিউ বলেছে,

__”খবরদার! ছাগল বলা তোর মুদ্রা দোষে পরিণত হয়েছে। কথায় কথায় শুধু আরুশকে ছাগল বলা! ভুলেও অফিসে যেয়ে আরুশের সামনে তো নাই,অন্য লোকদের সামনেও ছাগল বলবি না! মাইর ধর খাওয়ায় বের করে দেবে!”
.
দ্যূতি লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে নক করল কাঁচের দরজায়। ভিতর থেকে গম্ভীর কন্ঠে ভেসে আসলো আদেশ। ভিতরে প্রবেশ করার! দ্যূতি আস্তে আস্তে করে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল।

আরুশ তার বস চেয়ারে বসে আছে। দ্যূতি প্রবেশ করতেই আরুশের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। দ্যূতি ধীর পায়ে টেবিলের একদম নিকটে যেয়ে দাঁড়ালো। আরুশ চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়ালো। দ্যূতির সামনে এসে টেবিলের একপাশে পায়ে ভর দিয়ে স্থির হয়ে বসল। আরুশকে এতো কাছে আসতে দেখে দ্যূতি দু কদম পিছিয়ে যাবে এমন সময় আরুশ ওর হাত ধরে একটানে নিজের কাছে টেনে নিলো। দ্যূতি বিস্ফারিত চোখে ছটফট করতে লাগল। আরুশ সাথে সাথে ছেড়েও দিলো। দ্যূতি দূরে এসে দাঁড়ালো হাঁপাতে হাঁপাতে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো। আরুশের ঠোঁটের কোণে হাসি যেন আরো চওড়া হয়ে উঠল।

__”কি অসভ্যতামি এগুলো মিস্টার চৌধুরী? আপনি বস বলে যা খুশি করতে পারবেন এই টা ভাববেন না! এটা আপনার বিদেশ নয়!”

__”কেন? বিদেশে কি হতো? আর যদি এইটা বিদেশ হতো তাহলে আমি যা খুশি তাই করতে পারতাম না কী?”

সোজা হয়ে দাঁড়ালো আরুশ। ধীরে ধীরে দ্যূতির নিকট যেতে লাগলো। এই এসি রুমেও দ্যূতি ঘামছে। আরুশকে নিজের দিকে এগোতে দেখে দ্যূতি আঙ্গুল তুলে বলে,

__”কাছে আসছেন কেন?”

আরুশ কোনো উত্তর দিলো না। দ্যূতি দু এক পা করে পিছোতে লাগলো। একপর্যায়ে দ্যূতি মোটা কাঁচের দেওয়াল সাথে ধাক্কা খেলো। আরুশ তখন একদম কাছে চলে এসেছে। ভয়ে দ্যূতির গলায় আওয়াজ যেন ঠান্ডায় বরফ জমে যাওয়ার মতো হিম হয়ে গেছে।

আরুশে একদম নিকটে এসে দেওয়ালে এক হাত ঠেকিয়ে নিজের ভর ছেড়ে দিলো। দ্যূতির দিকে একদম ঝুঁকে গেলো। দ্যূতি ভয়ে চোখ মুখ খেঁচে বন্ধ করে নিলো। হঠাৎ নিজের কপালে শীতল আঙ্গুলের ছোঁয়া পেতেই কেঁপে উঠলো। সেকেন্ডের মধ্যে চোখ খুলে তাকাতেই দেখে আরুশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর কপালে ভ্রু এর কাছে কেটে যাওয়া দাগের দিকে তাকিয়ে আছে। আরুশ তাতে আলতো করো আঙ্গুল ছুঁয়ে দিচ্ছে। তখন যেন আরুশকে শিশুদের মতো লাগছে দ্যূতির কাছে। দ্যূতিও ঠিক চার সেকেন্ড ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল।

__”কি করছেন?”

নিজের কপাল থেকে আরুশের আঙ্গুল সরিয়ে দিয়ে বলল। আরুশের মুখে বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠল। দ্যূতি সেই দিকে তাকাতে ওর সারা শরীরে শিহরণ বয়েই গেলো। দ্যূতি আরুশকে জোরে ধাক্কা মারল। আরুশ আচমকা ধাক্কায় হালকা পিছনে ছিটকে গেলো। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলিয়ে নিলো।

__”আপনি একটা অসভ্য লোক!”

আরুশ হাসে। নিজের আসনে ফিরে যায়। চেয়ারে বসে দ্যূতির দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

__”তোমার ওই কাঁটা দাগটা অনেক সুন্দর!”

দ্যূতি থমকে যায়। কি বললো লোকটা? যে কাঁটা দাগের জন্য তার এতো অস্বস্তি। যে দাগকে লুকানোর জন্য সবসময় চুল সামনে দিয়ে রাখে, কারোর সঙ্গে কথা বলতে গেলো হাত দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়,সেই দাগকে আরুশ সুন্দর বল‌ছে? কেন?

দ্যূতিকে হারিয়ে যেতে দেখে আরুশ মুচকি হাসল। দ্যূতিকে আরো সুন্দর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সুবিধা হয়ে গেল তার জন্য। আরুশ ল্যান্ড ফোন তুলে নিলো হাতে,

__”হ্যালো! কেবিনে কফি পাঠিয়ে দাও!”

দ্যূতির হুঁশ ফেলল। রাগান্বিত চোখে আরুশের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

__”আমি এখানে চাকরি করবো না! আপনার মতো বসের সাথে কাজ করা ইম্পসিবল!”

বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় আরুশ কঠিন কন্ঠে বলে উঠে,

__”তুমি চাকরি ছাড়তে পারবে না মিস্ দ্যূতি!”

দ্যূতি থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। পিছনে ফিরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকালো আরুশের দিকে। আরুশ মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে, চোখের দৃষ্টি অবিচল রেখে তাকিয়ে আছে।

__”মানে? কেন ছাড়তে পারবো না?”

আরুশ চেয়ারে এদিকে ওদিকে সুইং করতে করতে বলল,

__”অফিসে ঢুকে রিসেপশনে তুমি একটা পেপারে সিগনেচার করেছ আশা করি মনে আছে!”

হ্যাঁ দ্যূতির স্পষ্ট মনে আছে সে রিসেপশনে টার্ফ’স এন্ড রুল’স এ সিগনেচার করেছে। কিন্তু তাতে কি ছিল তা পড়া হয়নি দ্যূতির। দ্যূতি চোখ বন্ধ করে নিলো। সে যেন অনেকটাই আন্দাজ করতে পেরেছে।

ইতিমধ্যে পিয়ন রুমে কফি নিয়ে হাজির হয়েছে। আরুশের সামনে কফি রেখে দ্যূতির দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল। আরুশ কফিতে চুমুক দিয়ে হাস্কি স্বরে বলল,

__”সেখানে লেখা ছিল তুমি চাকরি জয়েন করেছ নিজের ইচ্ছায় কিন্তু চাকরি তুমি তোমার ইচ্ছেতে ছাড়তে পারবে না। চৌধুরী ইন্ড্রাস্ট্রির জন্য দুই বছর নিজের ডিউটি নিষ্ঠা সহকারে পালন করে তারপর তুমি তোমার ইচ্ছে চাকরি ছাড়তে পারবে …..”

চলবে……..