#জোৎস্না_রাতে_তুমি_আর_আমি — [৫]
লেখনীতে;- #রুদ্রিকা_বেদী
_”আজকের জন্য কি আমি বাড়ি যেতে পারি?”
দ্যূতি অতি ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল আরুশের কাছে। আরুশ দ্যূতির পানে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। দ্যূতি যে অতিরিক্ত নিরাশায় ডুবে গিয়েছে তা আরুশ খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। আরুশের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল।
__”আজকের জন্য যেতে পারো! কালকে সময় মতো কাজে চলে এসো!”
দ্যূতি অসহ্য চাহনি তে আরুশের পানে চাইল। তার এতো রাগ আগে কখনো হয়নি,আজ যতটা নিজের ওপর হচ্ছে! দ্যূতি কেবিনে আর এক মুহুর্তের জন্য দাঁড়ালো না। বেড়িয়ে গেলো।
দ্যূতির বেড়িয়ে যেতেই আরুশ পুনরায় ল্যান্ড লাইন তুলে নিলো। নাম্বার দিয়ে কানে ধরল।
__”দ্যূতির উপর থেকে যেন নজর না সরে! কোথায় যাচ্ছে? কার সাথে দেখা বলছে? কি করছে? সব খবর আমার চাই! মনে থাকে যেন!”
আরুশের গলায় কাঠিন্য ভাব ভেসে উঠলো। হুকুম দিলো কাকে যেন?
.
দ্যূতি বেড়িয়ে এসেছে কম্পানির থেকে। আসার সময় সবাই তার দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল। তাকানোতে অস্বস্তি তৈরি করিয়ে দিয়েছে দ্যূতির শরীরে। আরুশের কেবিন থেকে বেড়িয়ে নিচে আসতেই মিলি ওকে ধরেছিল। আরুশের সাথে কি কথা হয়েছে? কি বলেছে? ওকে এতো বিধ্বস্ত কেন লাগছে? কোথায় যাচ্ছে? সব প্রশ্ন একবারে এবং এক নিঃশ্বাসে করেছে। দ্যূতি কোনো উত্তর দিইনি। স্বাভাবিক ভাবে হ্যা না তে উত্তর দিয়েছে বেরিয়ে এসেছে।
নিজের প্রতি দ্যূতির ভীষণ রাগ হচ্ছে। এতো শিক্ষিত,এতো পড়াশোনা, করার কি মানে যদি একটা পেপারে সিগনেচার করার আগে সেটা নিজের থেকে একবার না পড়ে নেওয়া হয়? দ্যূতি কম্পানির থেকে বেরিয়েই নিজের খোলা চুল ধরে টান মানলো। এই জন্যই হয়তো আজ চুল খুলে এসেছিল দ্যূতি। ফুটপাতের এক মাথায় দাঁড়িয়ে নিরাশ ভাবে তাকিয়ে আছে সামনে।
__”আজ সত্যিই মনে হচ্ছে ওই ছাগলটার গাড়ির নিচে না এসে ভুল করেছি!মেরে দিলেই ভালো হতো! আসলে মিস্টার আরুশ ছাগল না আমি একটা ছাগল….!”
নিজের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো দ্যূতি। দ্যূতি ডানে বামে তাকাতে লাগলো। এখান থেকে সিএনজি রিকশা পাওয়া কষ্টের বিষয়। এই এলাকায় তেমন রিকশা সিএনজি চলে না। সবই প্রাইভেট কার। তাও বৃথা চেষ্টা করছে রৌদ্রে দাঁড়িয়ে…..
হঠাৎ দ্যূতির মনে হতে লাগলো,তাকে কেউ ফলো করছে। আশেপাশে তাকাতে একটা কুকুর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারল না দ্যূতি। তারই মনের ভুল। এই ভেবে হাঁটা শুরু করল সামনে,,, যদি রিকশা পাওয়া যায়?!
.
রাত তখন দশটা,
আরুশ নিজের রুমের আর্মচেয়ারে বসে আছে। পুরো রুমে অন্ধকার। ব্যালকনির স্লাইডিং ডোরেও পর্দা দিই ঢেকে দেওয়া। রুমে আলো প্রবেশ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। এমন সময় ঘরের মুখ্যদ্বার ঠেলে ঘরে ঢুকলেন তুহিন চৌধুরী। দরজার পাশে রুমের সুইচ। তিনি সুইচ অন করলেন। রুমে আলো জ্বলতেই আরুশ নিজের বাম হাত চোখের উপর নিয়ে আসলো। অনেকক্ষণ পর আলোর সংস্পর্শে আসায় আরুশের চোখ তীব্র আলোটি সহ্য করতে পারছিল না। সেকেন্ড দশেক পর আরুশ আস্তে আস্তে হাত সরিয়ে নিলো চোখের উপর থেকে। তুহিন সাহেব ততক্ষণে আরুশের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন।
আরুশ বাবার দিকে একবার চেয়ে সোজা হয়ে বসল। তুহিন চৌধুরী পাশের থেকে চেয়ার টেনে এনে বসলেন। দুজন দুজনের দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। কারো মাঝে কোনো কথা নেই। আছে হয়তো চোখে! যা মুখে প্রকাশ করছে না।
নিস্তব্ধতার এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যেখানে তুহিন সাহেব তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠলেন,
__”কিছু কি বলবি?”
আরুশের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। আরুশের মুখে হাসি তুহিন সাহেবকে নিরীহ করে ফেলে। তিনি নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,
__”বাবা! আমার বৌমার নাম তো বল?”
__”নূর!” গম্ভীর এবং শীতল কন্ঠে বলল আরুশ।
তুহিন সাহেব কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল। চোখের অশ্রু লুকোনোর জন্য ছেলের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকালেন। ভাব এমন করলেন যেন তার চোখে কিছু চলে গিয়েছে। আরুশ উঠে এসে বাবার কাঁধে হাত রাখল। আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
__”লুকোনোর কোনো দরকার নেই বাবা! আমার সামনে কাঁদলে তোমার ইগোতে প্রবলেম হবে না। আফটার অল আমিও একজন ছেলে…. কষ্টে ছেলেদের চোখ থেকে জল পরে!”
তুহিন সাহেব ছেলের হাত নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। ছেলের দিকে অশ্রু নয়নে চেয়ে হো হো করে হেসে উঠে দাঁড়ালেন। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন,
__”আমি আমার নূরকে হারিয়ে ফেলেছি! তোর জীবনের নূরকে যত্নে রাখিস! হারাতে দিস না॥”
.
♪….বাগিচায় বুলবুলি তুই
ফুল শাখাতে, দিসনে আজই দোল।
আজো তার
ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি,
তন্দ্রাতে বিলোল।….♪
ফোনে গান চালিয়ে শুইয়ে আছে দ্যূতি। তার অস্বস্তি লাগলে এমন করে গান চালিয়ে রাখে। মন আপনা আপনি শান্ত শীতল ছায়ার মতো হয়ে যায় কিন্তু আজ কিছুতেই তার মন শান্ত হতে চাচ্ছে না। আরুশের ওমর চাহনি দ্যূতি কোনো ভাবেই ভুলতে পারছে না। চোখের সামনে শুধু আরুশের ওই গাঢ় চাহনি যা দ্যূতিকে এক মুহুর্তের জন্য মুহিত করে দিয়েছিল! ঘৃণা করা যায় না ওই চাহনিকে। কি ছিল ওই চাহনিতে? কেন তাকিয়েছিল ওর দিকে ওমন করে? কেন দ্যূতির কাঁটা দাগের প্রতি আরুশ এতো মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলো?
এতো এতো ‘কেন’ এর উত্তর দ্যূতি কোনো ভাবেই খুঁজে পারছে না। বিরক্ত হয়ে এইবার উঠেই বসলো। উঠে বসতে ফোনে মৃদু স্বরে বাজতে থাকা গান হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল তার জায়গায় শুরু হলো ভাইব্রেশন। দ্যূতি তাড়াতাড়ি ফোন হাতে তুলে নিলো। ফোনের স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করে ভেসে উঠে রয়েছে ‘আরাফ’ নামটি। দ্যূতি মুখে হাসি সঙ্গে বিরক্ত দুই ভাবটি ফুটে উঠলো। দ্যূতি সময় নষ্ট না করে কল রিসিভ করল।
__”হ্যালো দেবা?”
__”হ্যাঁ বলছি বল!”
__”কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ?”
আরাফের কন্ঠে চিন্তা ফুটে উঠল। দ্যূতি কোনো রকম অনুভুতি ব্যক্ত করল না। চুপ করে রইল।
আরাফ আর দ্যূতি একই কলেজ থেকে পরেছে। দ্যূতি আর্টসে ছিল আর আরাফ সাইন্সে। বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আরাফ। এতো বছরেও দুজনের বন্ধুত্বে কোনো ফাঁক পরেনি। আরাফ টাইম টু টাইম দ্যূতির সাথে যোগাযোগ করে। সময় পেলে মাঝে মধ্যে দেখাও করে।
__”হ্যালো দেবা? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিস?”
__”আরে না! আমি ঠিক আছি তুই বল! তোর কি খবর?”
__”এই তো আছি সিঙ্গেল! তোকে গার্লফ্রেন্ড বানাতে চাইলাম কিন্তু তুই তো তুই! আমার কথায় পাত্তাই দিস না!”
__”আবার শুরু করলি?” দ্যূতি বিরক্ত কন্ঠে বলল।
__”যতদিন তুই আমাকে হ্যাঁ বলছিস না ততদিন থামবো না!”
দ্যূতি চুপ করে রইল। এই বিষয়ে তার কোনো কথা বলার নেই।
__”তুই কি বুঝিস না আমি তোকে কতোটা ভালোবাসি? কেন আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছিস দেবা?”
__”আমি তোকে কোনো কষ্ট দিচ্ছি না আরাফ! তুই নিজের থেকে নিচ্ছিস! উই আর ভেরি গুড ফ্রেন্ড বাট কান্ট বি আ লাভার্স!”
__”কেন হতে পারি না শুনি? কি কমতি আছে আমার মাঝে? সব কিছুই আছে! তুই বলিস আমি দেখতে সুন্দর! পড়াশোনাই ও ভালো, তাহলে কোথায় সমস্যা দেবা?”
আরাফের কন্ঠে দ্যূতির প্রতি অনুরাগ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। দ্যূতি কি উত্তর দিবে?
__”আমার এইসব বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না আরাফ! অন্য কোনো কথা বলার থাকলে বল নাহলে রাখলাম!” জোর করে কড়া কন্ঠে কথা গুলো বলল দ্যূতি।
আরাফের হাসির শব্দ শোনা গেল কলের এই পাশে। ব্যঙ্গর হাসি।
__”আচ্ছা তুই না চাই এই বিষয়ে কথা বলবো না কিন্তু একটা কথা, আমার থেকে তোকে কেউ বেশি ভালো বাসে না এই পৃথিবীতে মনে রাখিস!”
__”আমি জানি……!”
চলবে…..