জোৎস্না রাতে তুমি আর আমি পর্ব-০৬

0
3

#জোৎস্না_রাতে_তুমি_আর_আমি — [৬]
লেখনীতে;- #রুদ্রিকা_বেদী

হিসেব মতো আজ দ্যূতির প্রথম দিন কাজে। কালকে থেকেই কাজে জয়েন করার ছিল কিন্তু দ্যূতি ওমন পরিস্থিতিতেই ছিলো না। আরুশের মুখে নিজের নির্বোধের প্রমাণ শুনে দ্যূতি স্থির থাকতে পারেনি। যাইহোক আজ যেমন তেমন করে নিজের মনকে বুঝিয়েছে দ্যূতি। দুই বছর দেখতে দেখতে চলে যাবে শুধু আরুশের কাছ থেকে দূরে থাকবে বলে পণ নিয়েছে দ্যূতি। কোনো ভাবে আরুশের কাছ ঘেঁষা যাবে না।

কালো রঙের থ্রি পিস পরেছে আজ দ্যূতি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মনে বিষন্নতা ছড়িয়ে পরেছে। চোখে আজকে কাজল দেয়নি। চুলগুলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেসি বার্ন হয়ে গেছে। হাতে প্রতিদিনের মতো ঘড়ি। ঠোঁটে হালকা লিপগ্লস!

অফিসে ঢুকতেই দ্যূতির মিলির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। মিলি হাসিমুখে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,

__”গতকাল ওমন ভাবে চলে গেলে কেন? শরীর খারাপ ছিল কি?”

দ্যূতি নিজের মানুষদের বাইরে কারো সাথে বেশি কথা বলতে পছন্দ করে না। সবার মতো সে বাইরের মানুষদের সাথে মিলে যেতে পারে না। পারে না নিজের মনের কথা কোনো রকম চিন্তা ছাড়া ব্যক্ত করতে। এর জন্যও তার মায়ের কাছে কতো কথা শুনতে হয় প্রতিনিয়ত। তার মায়েরও দোষ কি! সবার মায়েরাই হয়তো এইটাই চাই। সবাই তো আর তার পিউ আপির মতো হয় না! সবাই যদি পিউয়ের মতো মন মানসিকতা ধারণ করতো তাহলে দ্যূতি সবার সাথেই মিশতে পারতো।

__”তেমন কিছু হয়নি! যাস্ট একটু শরীর খারাপ ছিল! আজ ঠিক আছি!”

মুখে হাসতে আনার চেষ্টা করে বলল দ্যূতি। মিলি দ্যূতির বাহু আলতো করে ধরে বলে,

__”যাক শুনে ভালো লাগলো! তুমি কি জানো কালকে তোমার যাওয়ার পর কি হয়েছে?”

শেষের কথাটা বলতে যেয়ে মিলির গলার স্বর একদম খাদে চলে এসেছে। দ্যূতি ভ্রু কুঁচকে মিলির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানাই। মিলি দ্যূতিকে ধরে হাঁটতে শুরু করে আর আগের মতো কন্ঠ রেখে বলে,

__”তোমার যাওয়ার পর ম্যানেজারকে বস নিজের কেবিনে ডেকেছিল,,,,”

__”কে? আরুশ চৌধুরী?” প্রশ্ন করল দ্যূতি।

মিলি হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল দ্যূতির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,

__” ‘বস’ আর কয়টা আছে শুনি?”

দ্যূতি চুপসে গেল। মিলি আবার হাঁটা ধরল।

__”প্রথমে ভেবেছিলাম অফিসের কাজে ডেকেছে পরে জানতে পারি ম্যানেজারকে আসলে ডেকেছিল তোমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করার জন্য!”

দ্যূতি চমকে উঠে। কি বলে মেয়েটা?

__”তার পর?” দ্যূতি অতি আগ্রহ সহকারে প্রশ্নটা করল।

__”তার পর আর কী! তুমি তো আর বসকে চেনো না! হেব্বি বদমেজাজি। দিয়েছে একশত কথা শুনিয়ে!”

__”আর কিছু না?”

__”আরো কিছু চাও বুঝি?” দ্যূতির দিকে ডান চোখের ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করল মিলি।

দ্যূতি নিজেকে সামলিয়ে নিলো। অনুভূতিগুলো একটু বেশি প্রকাশ করা হয়ে যাচ্ছে। মিলি দ্যূতির দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হেসে বলে,

__”তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ করার জন্যই হয়তো বস ম্যানেজারকে দুই সপ্তাহের জন্য সাসপেন্ড করেছে অফিস থেকে !”

মিলির কথাগুলো শুনে দ্যূতি মনে মনে বেশ খুশি হলো। ম্যানেজারকে কয়টা কথা শুনিয়ে দিলো। আরুশকেও ধন্যবাদ দিতে ভুলল না। আরুশকে দুই বার ধন্যবাদ জানাতে হঠাৎ মনের অনুভূতিগুলো থমকে গেল। মনেই প্রশ্ন জাগলো,

__”লোকটা জানলো কীভাবে?”
.
আরুশ আজকে অফিসে আসেনি। কোনো মিটিংয়ে বাইরে গিয়েছে। এইজন্য দ্যূতির অফিসে প্রথম দিনটা বেশ ভালো কাটলো। কোনো রকম চিন্তা ছাড়াই এখান থেকে ওখানে যেতে পেরেছে। সবার সাথে ভালোই মিশে গিয়েছে। প্রথম দিন বলে তেমন কাজ ছিল না আজ তবে যার আন্ডারে দ্যূতি পরেছে, দ্যূতি ভালো বুঝতে পেরেছে লোকটি বেজায় রগচটা! ভয়ংকর মুখের চাহনি! চোখ থেকে মনে হয় এখনি গিলে খাবে আর গলার স্বর তো একদম মিলে গিয়েছে ব্যক্তিত্বের সঙ্গে…… দ্যূতি বেশ বুঝতে পারছে ওই লোকের সাথে কাজ করতে গেলে তার জীবন শেষ হয়ে যাবে …….
.
রাত আটটা,
সবে অফিস থেকে বেরিয়েছে দ্যূতি। ঢাকা শহর বলে চিন্তা নেই। ঢাকা শহর ঘুমোই না। সব সময় গাড়ি পাওয়া যাবে রাস্তায়। দ্যূতি সকালে যেমন বিষন্ন মনে অফিসে ঢুকে ছিল বেড়োনোর সময় তার মন তার থেকেও বেশি খুশি ছিল। কিন্তু উপরওয়ালা তো তার খুশি পরমুহূর্তেই পাল্টিয়ে চারগুণ বিষন্নতায় ফেলে দিবে তা কি সে জানে?

দ্যূতি রাস্তা ধরে হাটছিলো। রিকশা এখানে পাওয়া যাবে দ্যূতি জানে তাই দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করল না। দ্যূতি বেশ জোরেই হাঁটছে। যেন স্টেশনে কোন ট্রেন রয়েছে যা তাকে ধরতে হবেই মিস করলে সারা রাত স্টেশনে কাঁটাতে হবে । জোরে জোরে হাঁটতে হাঁটতে দ্যূতি হঠাৎ পা মচকে পরে গেল। ভাগ্যিস রাস্তায় লোক নেই। তা নাহলে ব্যথার সাথে লজ্জায় নাকটাও যেতো। দ্যূতি পরে যেতেই চেঁচিয়ে উঠলো। আগে থেকেই পায়ে ব্যাথা সেই একই জায়গায় আবার মচকে যাওয়া এই নাহলে দ্যূতির কপাল। দ্যূতি হাতের বলে উঠে দাঁড়াতে গেলো কিন্তু সম্ভব হলো না। ভীষণ ব্যথা করছে পায়ে। দ্যূতির চোখে জল এসে গেলো। ব্যাথায় ছটফট করা ব্যক্তি সে না কিন্তু আজকে নিজেকে সামলাতে পারল না দ্যূতি। আশেপাশে কেউ নেই, কাউকে হেল্পের জন্য ডাকতেও পারছে না। ব্যাথায় দ্যূতি দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। ব্যাগের মধ্যে হাতরে দ্যূতি ফোন বের করল। পিউকে কল করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই…..

দ্যূতি ডায়েল নাম্বারে যেতেই তার মুখের উপর কোথা থেকে যেন বিকট আলোক রশ্মি এসে পরল। দ্যূতি সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুখ কুঁচকে বন্ধ করে নিলো। চোখের উপর হাত এনে চোখ ঢেকে নিলো। তার সোজাসুজি এসে থেমেছে একটি কালো SUV কার। দ্যূতি হাত সরিয়ে গাড়ির দিকে তাকাতেই আনমনে বলে উঠল,

__”ব্ল্যাক ড্রাগন!!!”

গাড়ির দরজা খুলে গেলো। দ্যূতি পুনরায় চোখ বন্ধ করে নিলো। মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে বলল,

__”আবার এই লোকের সামনে পরতে হলো! আর কেউ কি গাড়ি চালায় না এই ঢাকার শহরে? বান্ধানো কপাল নিয়ে জন্মিয়েছি !”

গাড়ির থেকে নেমে আসলো ব্ল্যাক কালারের শার্ট প্যান্ট পরিহিত লম্বা দেহি লোকটি। দ্যূতির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে নিলো আরুশ। সেই দিকে করুণ দৃষ্টিতে চাইলো দ্যূতি। আরুশ হাঁটু গেড়ে বসল দ্যূতির সামনে। দ্যূতির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। দ্যূতি সেকেন্ড হ্যান্ড হিমব্যারেস হয়ে স্লান হাসলো। আরুশ ঠোঁট কামড়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করে বলল,

__”আমি ভেবেছিলাম তুমি মাটির মানুষ কিন্তু এখন দেখছি তুমি রাস্তার মানুষও,,,”

বলে শব্দ করে হেসে উঠলো। দ্যূতি আরুশের দিকে কটমট করে তাকিয়ে হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকালো। আরুশের সেই দিকে দৃষ্টি পরতেই চিল পাখির মতো ছো মেরে হাতের থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো। দ্যূতি অবিশ্বাস্য চোখে নিজের খালি হয়ে থাকা হাতের দিকে তাকালো, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আরুশের হাতের দিকে তাকালো। আরুশের হাতে ঝুলছে তার অতি শখের ফোন। আরুশের মুখে লেগে রয়েছে চঞ্চল হাসি। দ্যূতি নিজের কামিজ খামচে ধরে বলল,

__”কি করছেন টা কি? আমার ফোন দেন!”

__”কাকে ফোন করবে আগে তাই বলো!”

__”যাকেই ফোন করি তাতে আপনার কি?”

আরুশ চুপ করে রইল। দ্যূতি আরুশের হাত থেকে ফোনটা ছো মেরে নিতে গেলো। আরুশ সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে আনলো। দ্যূতি করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,

__”আমার ফোন আমাকে ব্যাক করুন!”

আরুশ উঠে দাঁড়ালো। দ্যূতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

__”ব্যাক করবো কিন্তু এখানে নয়।” বলে হাতের ফোনটা গাড়ির পিছনের সিটে ছুঁড়ে মারল জানালা দিয়ে। দ্যূতি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। এক মুহুর্তের জন্য তার প্রাণ যেন বেরিয়ে যাচ্ছিল।

আরুশ দ্যূতির দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। দ্যূতি আরুশকে এগিয়ে আসতে দেখে বলে,

__”কাছে আসছেন কেন?”

আরুশ কোনো উত্তর দেয় না। দ্যূতি আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওকে ব্রাইডাল স্টাইলে কোলে তুলে নিলো। দ্যূতি যেন কিছুক্ষণের জন্য রোবট হয়ে গেলো। তার চোখ মুখ সব স্থির হয়ে গেলো। আরুশ খুব ইজি করেই ওকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। গাড়িতে বসতেই দ্যূতি ধ্যান ভঙ্গ হলো। সে ছটফট করতে লাগলো। ততক্ষণে আরুশ গাড়িতে বসেছে। দ্যূতিকে ছটফট করতে দেখে আরুশ এক ডাবর দিয়ে বলল,

__”চুপ…..!”

আরুশের এক তিরস্কারে দ্যূতির সকল ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেলো। আরুশ কড়া চোখে দ্যূতির দিকে তাকিয়ে হুকুম দেওয়ার সুরে বলে,

__”সিট বেল্ট বাঁধ!”

দ্যূতি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। আরুশ গাড়ি স্ট্যাট দিতে দিতে বলে,

__”পায়ের ব্যাথা নিয়ে উঠতে পারছে না কিন্তু তাও তেজ কমবে না! অসভ্য মেয়ে একটা!”

দ্যূতি আরুশের দিকে বড়ো চোখ করে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে ওমনি আরুশ চিতা বাঘের মতো গাড়ি চালালো……

চলবে….